বাংলা সাহিত্য এমন এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার যেখানে প্রকৃতি, মানুষ ও জীবনচিত্র নানা আঙ্গিকে প্রতিফলিত হয়েছে। সেই ভাণ্ডারে কবি জসীম উদ্দীন (১৯০৩–১৯৭৬) এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন এমন এক কবি যিনি গ্রামীণ সমাজ, কৃষকের দুঃখ-কষ্ট, সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতি ও বাংলার লোকসংস্কৃতিকে সাহিত্যিক রূপ দিয়েছেন। তার সাহিত্যকর্মে ফুটে উঠেছে গ্রামের মাঠ-ঘাট, কুসুম-কলি, খেজুর রস, কিষাণ-কিষাণীর হাসি-কান্না ও মাটির টান। এজন্য তাকে বলা হয় “পল্লীকবি”।
কবি জসীম উদ্দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার গোবিন্দপুর গ্রামের (বর্তমানে তাম্বুলখানা) এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আনসার উদ্দীন ছিলেন একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মা আমেনা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই তিনি গ্রামবাংলার লোকসংগীত, পালাগান, জারি-সারি ও মঙ্গলগান শুনে বড় হয়েছেন। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে তার কবিতার মূল প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়।
প্রথমে গ্রামেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (ম্যাট্রিক) পরীক্ষা দেন। পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর (এম.এ) ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি লেখালেখির সাথে যুক্ত ছিলেন এবং শিক্ষক ও সাহিত্যিকদের প্রশংসা পেয়েছিলেন।
জসীম উদ্দীনের সাহিত্যজীবন শুরু হয় ছাত্রাবস্থায়। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “রাখালী” প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। এই গ্রন্থে গ্রামের রাখালের জীবন, প্রেম, প্রকৃতি ও আনন্দের নিখুঁত চিত্র ফুটে ওঠে। রাখালী প্রকাশের পর তিনি দ্রুত পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেন।
পরে প্রকাশিত “নকশী কাঁথার মাঠ” (১৯২৯) তাকে সাহিত্যজগতে স্থায়ী আসন প্রদান করে। এ গ্রন্থে একটি দরিদ্র গ্রামের মেয়ের প্রেম ও বেদনার কাহিনী কবিতার ছন্দে বর্ণিত হয়েছে।
কবি জসীম উদ্দীনের সাহিত্যকর্ম বহুমুখী। তিনি কবিতা, গল্প, গান, নাটক, লোকসংগীত সংগ্রহ ও গবেষণার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
রাখালী (১৯২৭)
নকশী কাঁথার মাঠ (১৯২৯)
সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩)
বাঁশরী (১৯৩৯)
গ্রামবাংলার গান (১৯৪৭)
রাইফেল রোটি আওরাত (১৯৭১) – মুক্তিযুদ্ধকালীন রচনা
কবর (ক্লাসিক ছোটগল্প)
ভরত ও সীতার গল্প
মধুমালা
বাংলা লোকসাহিত্য
হাছন রাজা
তিনি অসংখ্য গান লিখেছেন যেগুলো আজও লোকসংগীত ও পালাগানের মতো গাওয়া হয়। তার গানের ভাষা সহজবোধ্য ও হৃদয়স্পর্শী।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে “নকশী কাঁথার মাঠ” অমর কীর্তি। এটি এক তরুণীর জীবনের প্রেম, দুঃখ, বেদনা এবং সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। কাব্যনাট্য আঙ্গিকে রচিত এই বইয়ে উঠে এসেছে সাধারণ গ্রামের মানুষের অনন্ত বেদনা ও মানবিক ভালোবাসা।
জসীম উদ্দীন শুধু কবিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন গবেষকও। বাংলার গ্রামীণ লোকগীতি, পালাগান, ভাটিয়ালি, জারি-সারি ইত্যাদি সংগ্রহ ও সংরক্ষণে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ফলে অনেক হারিয়ে যাওয়া লোকসাহিত্য তার কারণে টিকে আছে।
কবি জসীম উদ্দীন তার সাহিত্যকর্মের জন্য দেশ-বিদেশে নানা স্বীকৃতি পেয়েছেন।
বাংলা একাডেমি পুরস্কার
একুশে পদক (১৯৭৬, মরণোত্তর)
প্রেসিডেন্ট পুরস্কার
পাকিস্তান সরকারের টামগা-ই-ইমতিয়াজ (যা তিনি মুক্তিযুদ্ধের পর প্রত্যাখ্যান করেন)
জসীম উদ্দীন ছিলেন সরল স্বভাবের, গ্রামীণ জীবনের সাথে একাত্ম। তিনি সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন, বিশেষ করে কৃষক ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষের দুঃখ-কষ্ট তার কবিতায় উঠে এসেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেন এবং “রাইফেল রোটি আওরাত” নামক রচনা প্রকাশ করেন।
১৩ মার্চ ১৯৭৬ সালে কবি জসীম উদ্দীন ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ফরিদপুর শহরে সমাধিস্থ করা হয়। তার কবর আজও সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে পুণ্যভূমি।
কবি জসীম উদ্দীন ছিলেন বাংলার মাটির মানুষ ও বাংলার কৃষক সমাজের কণ্ঠস্বর। তিনি প্রকৃতি, প্রেম, দুঃখ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা সবকিছুকেই কবিতায় রূপ দিয়েছেন। এজন্য তাকে আজও “পল্লীকবি” বলা হয়। তার রচনা আমাদের শেকড়, আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য ও মানুষের সহজ-সরল জীবনকে চিরকাল স্মরণ করিয়ে দেয়।
আপনি আমাকে যেকোনো প্রশ্ন করতে পারেন, যেমনঃ
Are you sure to start over?