ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মগ্রহণ করেন ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ সালে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরবালা গ্রামে। তার পিতা শিবচন্দ্র এবং মাতা চন্দ্রকলা ছিলেন গরিব হলেও শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহী। ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন মেধাবী ও অধ্যবসায়ী। তার পরিবারের প্রভাব তাকে সততা, সংযম ও পরিশ্রমের পথ দেখিয়েছে। শৈশবের দিনগুলো তার জীবনের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
শৈশবেই তিনি গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। সীমিত সম্পদের মধ্যে থেকেও পড়াশোনার প্রতি তার অনুরাগ ও অধ্যবসায় প্রশংসনীয়। ছোটবেলা থেকেই সে শিক্ষার সাথে প্রেমিক ছিল এবং জটিল বিষয় সহজে শেখার ক্ষমতা রাখত।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কলকাতায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য যান। এখানে তিনি সংস্কৃত, বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। কলকাতার শিক্ষাজীবন তাকে নতুন চিন্তাধারা ও সমাজ সংস্কারের প্রতি প্রেরণা দেয়।
তিনি শিখেছেন কেবল পাঠ্যবই থেকে নয়, বরং সমাজের বাস্তব চিত্র পর্যবেক্ষণ করে। শিক্ষাজীবনের সময়কাল তার মধ্যে সমাজ-উদ্দেশ্যমূলক চিন্তাভাবনার বীজ বপন করে।
বিদ্যাসাগর বাংলা শিক্ষায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করেছেন। তার অবদানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
বাংলা ভাষার সরলীকরণ: তিনি বাংলা ভাষার জটিলতা কমিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য সহজ ও বোধগম্য করেছেন।
শিক্ষাপুস্তক রচনা: ‘বাল্য শিক্ষা’ সহ বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক রচনা করে শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন।
গ্রামীণ শিক্ষার প্রসার: তিনি গ্রামের শিশুদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করেছেন।
নারী শিক্ষার উন্নয়ন: নারীর শিক্ষার ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা যুগান্তকারী। তিনি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীর শিক্ষাকে সমান গুরুত্ব দেন।
বিদ্যাসাগরের শিক্ষানীতি ও উদ্যোগ শিক্ষাক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন সমাজ সংস্কারের একজন প্রগতিশীল নেতা। তিনি সমাজের কুসংস্কার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। তার গুরুত্বপূর্ণ সমাজ সংস্কারমূলক অবদানগুলো:
বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লড়াই: বাল্যবিবাহ সমাজের জন্য ক্ষতিকর বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করেছেন।
বিধবা বিবাহের প্রচার: সমাজে বিধবা বিবাহকে স্বীকৃতি দিতে তিনি প্রচারণা চালান। বহু বিধবা তার সহায়তায় পুনর্বিবাহ করেন।
নারীর অধিকার ও শিক্ষার প্রসার: নারীদের স্বনির্ভর ও শিক্ষিত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে সচেতনতা: ধর্মীয় কুসংস্কার ও সমাজের অবৈজ্ঞানিক ধারণার বিরুদ্ধে তিনি প্রবন্ধ ও প্রচার চালিয়েছেন।
তার সামাজিক সংস্কারমূলক কাজ কেবল শিক্ষার সাথে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রসারে বড় ভূমিকা রেখেছিল।
বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যেও সমানভাবে অবদান রেখেছেন। তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
শিক্ষাপুস্তক ও পাঠ্যগ্রন্থ: ‘বাল্য শিক্ষা’, ‘অভিধান’, সহজ বাংলা ব্যাকরণমূলক গ্রন্থ।
সামাজিক প্রবন্ধ: সমাজ সংস্কার ও নারী অধিকার সম্পর্কিত লেখা।
ধর্মীয় সাহিত্য ও অনুবাদ: ‘রামায়ণ’ ও অন্যান্য মহাকাব্যের বাংলা অনুবাদ।
ভাষা সংস্কার: বাংলা ভাষাকে সরল ও শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রহণযোগ্য করার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে নতুন দিক উন্মোচিত করেছেন।
তার সাহিত্য ও শিক্ষার মিলিত প্রচেষ্টা বাংলা সমাজে শিক্ষার প্রসার ও মানবিক চিন্তাভাবনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন সৎ, সংযমী, মানবিক ও নির্ভীক। তার জীবন দর্শন ছিল শিক্ষা, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও সমাজকল্যাণের প্রতি অঙ্গীকার। তিনি নিজের সুবিধার জন্য নয়, সমাজের কল্যাণের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তার মধ্যে অধ্যবসায়, নির্ভীকতা এবং মানবপ্রেমের প্রতিফলন দেখা যায়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ২৯ জুলাই ১৮৯১ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে বাংলা সমাজ, শিক্ষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি ঘটে। কিন্তু তার শিক্ষানীতি, সাহিত্যকর্ম ও সামাজিক সংস্কারের অবদান আজও স্মরণীয়। তাকে বাংলা সমাজে ‘বিদ্যাসাগর’ খেতাব দিয়ে চিরস্মরণীয় করা হয়েছে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন কেবল একজন শিক্ষাবিদ নয়, তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যিক, মানবিক চিন্তাবিদ এবং নারীর অধিকার রক্ষাকারী। তার জীবন, চিন্তাধারা ও সাহিত্য আজও শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণনা জোগায়। বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে ও সমাজ সংস্কারে তার অবদান চিরস্মরণীয়।
আপনি আমাকে যেকোনো প্রশ্ন করতে পারেন, যেমনঃ
Are you sure to start over?