অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - সংগীত - NCTB BOOK
Please, contribute to add content into তত্ত্বীয়.
Content
Please, contribute to add content into সংগীতের নীতি.
Content

প্রথম অধ্যায়

সংগীতের নীতি
প্রথম পরিচ্ছেদ
পরিভাষা

ঠাটের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

একটি সন্তুকে শুদ্ধ, কোমল ও তীব্র মিলে মোট ১২টি স্বর রয়েছে। ঠাট হচ্ছে সপ্তকের পরবর্তী ধাপ। সংস্কৃত
গ্রন্থে ঠাঁটকে মেল বলা হয়। মেল বা ঠাট হচ্ছে স্বরের একটি বিশেষ রূপ, যাকে রাগের বর্গীকরণের ক্ষেত্রে
ব্যবহার করা হয়। মেল বা ঠাট গাওয়া বা বাজানো যায় না। কারণ এর কোনো রঞ্জকতা গুণ নেই। বেশকিছু
সংখ্যক রাগকে একটি গোত্রের পরিচয়ে (যেমন- পারিবারিক) সংঘবদ্ধ করে এই ঠাট। ঠাটের নামকরণ হয়
গোত্র বিশেষের প্রধান ও প্রসিদ্ধ রাগের নাম অনুসারে। অর্থাৎ স্বরের ব্যবহারের ওপর লক্ষ্য রেখে রাপকে ঠাটের
অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দক্ষিণ ভারতীয় পণ্ডিত ব্যাঙ্কটমুখি সপ্তক থেকে সর্বমোট ৭২টি মেল বা ঠাট হতে পারে
এমনটি আবিষ্কার করেন। পণ্ডিত ব্যাঙ্কটমুথির সূত্র ধরেই হিন্দুস্তানি সংগীতে সপ্তক থেকে ৩২টি ঠাট আবিষ্কৃত
হয়। পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে বিংশ শতাব্দীতে এই ঠাট পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ
ভাতখণ্ডে এই ৩২টি ঠাটের উন্মেষ ঘটিয়ে তার মধ্যে মাত্র ১০টি ঠাটের অধীনে হিন্দুস্তানি সংগীতে প্রচলিত সব
রাগকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছেন।

সংগীতে শুল্ক বিকৃত স্বরভেদে ক্রমিক সাত স্বরের সমাবেশকে ঠাট বলে। ঠাঁট মূলত সপ্তস্বরের একটি কাঠামো।
বিংশ শতাব্দীতে প্রচলিত রাগগুলোকে গোত্রীকরণ করার ক্ষেত্রে এই ঠাট পদ্ধতি বিশেষ উপযোগী ঠাটের
বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে দেয়া হলো:

اد
ঠাটে স্বর সংখ্যা হবে সাতটি।

সাতটি স্বরই হবে ক্রমানুসারে। যথা: সা রে গ ম প ধ নি।

ঠাটে কেবলমাত্র আরোহণ হবে।

বিশেষ বিশেষ রাগের নামানুসারে ঠাটের নামকরণ করা হয়েছে।

ঠাটের সংখ্যা ৩২টি, তবে রাগগুলোকে শ্রেণিকরণের সুবিধার্থে ৩২টি ঠাট থেকে

১০টিকে মুখ্য হিসেবে নির্বাচন করা হয়।

একই ঠাটে শুদ্ধ ও বিকৃত স্বর পাশাপাশি ব্যবহৃত হয় না।

ঠাঁট রচনায় রঞ্জকতার প্রয়োজন নেই।

ঠাঁট গাওয়া বা বাজানোর জন্য নয়। এই কারণে ঠাটের বন্দিশ, বাদী সমবাদী, পড়
আলাপ, বিস্তার, তান, সরগম প্রভৃতি হয় না।

81

দশটি ঠাটের বিবরণ

ঠোটের নাম

স্বরসপ্তক বা স্বররূপ

ব্যবহৃত স্বর

বিলাবল

কল্যাণ

সারেগমপধ নি

সারেগমপধ নি

মধ্যম স্বরটি তীব্র বা কড়ি, অবশিষ্ট সব শুদ্ধ স্বর।

নিষাদ স্বরটি কোমল, অবশিষ্ট সব শুদ্ধ স্বর।

কাফী

সারেগমপধ নি
সা রে গ ম প ধ নি

আশাবরী

ভৈরব

সা রে প ম প ধনি

সা রে গমপধ নি

গান্ধার ও নিষাদ স্বর দুটি কোমল, অবশিষ্ট সব শুদ্ধ স্বর ।
গান্ধার, ধৈবত ও নিষাদ স্বরগুলি কোমল, অবশিষ্ট সব শুদ্ধ স্বর।
কার্যত ও ধৈবত স্বর দুটি কোমল, অবশিষ্ট সব শুদ্ধ স্বর।
ঋষত, গান্ধার, ধৈবত ও নিষাদ স্বর গুলি কোমল, অবশিষ্ট সব

ভৈরবী

সা রে গ ম প ধ নি

শুদ্ধ স্বর।

পূরবী

সা রে প ম প ধ নি

ক্ষষত ও ধৈবত স্বপ্ন দুটি কোমল, মধ্যম স্বরটি তীব্র বা কড়ি,
অবশিষ্ট সব শুদ্ধ স্বর ।

যাযজ্ঞ স্বরটি কোমল, মধ্যম স্বরটি তীব্র বা কড়ি, অবশিষ্ট সব

মারোয়া

টোড়ী

সা রে গ ম প ধ নি

শুদ্ধ স্বর ।

ঋষত, গান্ধার ও ধৈবত স্বর তিনটি কোমল, মধ্যম স্বরটি তীব্র
বা কড়ি, অবশিষ্ট সব শুদ্ধ স্বর।

রাগের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

'রাগ' শব্দটি সংস্কৃত। 'রজ' ধাতু থেকে এর উৎপত্তি। অর্থাৎ রঞ্জকতা-ই রাগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাদী-সমবাদী,
আরোহ-অবরোহ প্রভৃতি অবলম্বনে যে পাঁচ বা ততোধিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নিয়মাবদ্ধ স্বরবিন্যাস মানবচিত্তকে
অনুরক্ত তথা ভাবময় করতে সক্ষম হয় তাকে 'রাগ' বলে। 'রাগ' রচনার ক্ষেত্রে কতগুলো নিয়ম কানুন রয়েছে।
এর ব্যতিক্রম ঘটলে সেই রচনাকে 'রাগ' আখ্যা দেয়া যায় না। 'রাগ' রচনার নিয়ম কানুন বা বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে
দেয়া হলো:

১। 'রাগ' যে কোনো ঠাটের অন্তর্গত হতে হবে।

২। 'রাগ' রচনায় কমপক্ষে পাঁচটি ও অনধিক সাতটি স্বর ব্যবহার করতে হবে।

৩। রাগের আরোহ অবরোহ, বাদী সমবাদী, পকড়, পরিবেশনের সময়, জাতি ইত্যাদি থাকা আবশ্যক।
৪। কোনো রাগে ষড়জ স্বরটি বর্জিত হবে না।

৫। কোনো রাগে মধ্যম এবং পঞ্চম স্বর একত্রে বর্জিত হবে না।

৬। কোনো রাগে একই স্বরের দুটি রূপ যথা: শুদ্ধ রে, কোমল রে- সাধারণত পাশাপাশি প্রয়োগ হয় না। তবে

এই নিয়মের কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়।

৭। রাগে রঞ্জকতা গুণ অবশ্যই থাকতে হবে।

৮। রাগে একটি বিশেষ রসের বা ভাবের অভিব্যক্তি একান্ত প্রয়োজন।

৯। রাগে স্বর তথা বর্ণের ব্যবহার অপরিহার্য।

আশ্রয় রাগ বা ঠাটবাচক রাগ

যে রাগের নামানুসারে ঠাটের নামকরণ করা হয় সেই মূল রাগটিকে আশ্রয় রাগ বা ঠাট বাচক রাগ বলা হয়।

যেমন: খাম্বাজ রাগটিকে আশ্রয় করে খাম্বাজ ঠাট এবং টোড়ি রাগকে আশ্রয় করে টোড়ি ঠাট উৎপন্ন হয়েছে।

জন্য রাগ

প্রত্যেকটি রাগই কোনো না কোনো ঠাটের অধীন। ঠাটরাগ বা আশ্রয় রাগ ব্যতীত সকল রাগকেই বলা হয় জন্য

রাগ। অতএব জনক রাগ ছাড়া অন্য সব রাগকে জন্য রাগ বলা হয়ে থাকে। যেমন: বাগেশ্রী, রাপেশ্রী ইত্যাদি।

জনক রাগ

এটি ঠাটের একটি লক্ষণ। জনক শব্দের অর্থ পিতা হলেও কার্যত জনক ও জন্য রাগে ছোটো বড়ো বলে কোনো
কথা নেই। রাগের ঠাট নির্বাচনের স্বার্থে প্রতিটি ঠাটে এমন একটি রাগ নির্বাচন করা হয়েছে, যার কম বেশি
প্রভাব ঠাটের অন্তর্গত অন্যান্য রাগে পড়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। একে বলে জনক রাগ। দশটি ঠাটের
জনক রাগ দশটি। জনক রাগের অন্যান্য নাম: আশ্রয় রাগ, পিতৃ রাগ, প্রধান রাগ, ঠাট রাগ, মেল রাগ, মূল
রাগ ইত্যাদি।

সরল ও বক্র রাগ

রাগের চলন দুই ধরনের হতে পারে। যথা: সরল ও বক্র চলন। আর এই চলনেই রাগের স্বরূপ প্রকাশ পায়।
রাগের সরল ও বক্র চলন দ্বারাই সরল রাগ ও বক্র রাগ নির্ণয় করা হয়। রাগে ব্যবহৃত স্বরসমূহের আরোহ ও
অবরোহ সরল অর্থাৎ সপ্তকের স্বরের ক্রমানুসারে হয় তবে তাকে সরল রাগ বলে। যেমন: ভূপালী, ভৈরবী,
কাফী ইত্যাদি। আর যদি কোনো রাগে ব্যবহৃত স্বরসমূহের আরোহ ও অবরোহ, সপ্তকের স্বরের ক্রমানুসারে
না হয়ে বক্রভাবে হয় তখন তাকে বক্র রাগ বলে। যেমন: জয়জয়ন্তী, কেদার, কামোদ, দেশি ইত্যাদি।

সংগীতের শ্রেণিবিভাগ

সংগীতশাস্ত্রে বা সংগীত বিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার জন্যে ব্যবহারিক ও তত্ত্বীয় দুটি বিষয়েই যথেষ্ট ধারণা থাকা
দরকার। কেননা, ব্যাবহারিক ও তত্ত্বীয় বিষয় দুটি একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সংগীতের
উদ্ভব ও বিকাশের আদি লগ্নে দুটি ধারা বা রীতি প্রবাহমান ছিল, যাকে বলা হতো 'মার্গসংগীত' ও 'দেশি
সংগীত'। কালের প্রবাহে 'মার্গসংগীত' শাস্ত্রীয়সংগীতের রূপ লাভ করেছে। আর 'দেশি' সংগীত
লোকসংগীতের ধারায় রয়ে গেছে। আধুনিক কালে শাস্ত্রীয়সংগীত বলতে উচ্চাঙ্গসংগীত বা রাগসংগীতকে
বোঝানো হয়।

শাস্ত্রীয়সংগীত এবং লোকসংগীত উভয় ধারাই আজ যথেষ্ট সমৃদ্ধ। প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত
সংগীত বিষয়ের অনেক গ্রন্থ পাওয়া যায়। আবার অনেক কিছুই আছে যা শ্রুত-স্মৃতি অর্থাৎ শুনে শুনে মনে
রাখার মতো বিষয়, যাকে মৌখিক পরম্পরা বলা হয়। সংগীত গুরুমুখী বিদ্যা হওয়ার কারণে এবং লিখিত বা
রেকর্ড করার মতো সুযোগের অভাবে হয়ত অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। তবে সংগীতশাস্ত্র সম্পর্কে মৌখিক
পরম্পরায় যতটুকু তথ্য পাওয়া যায় তা একেবারে অবহেলা করার মতো নয়। তাই পুঁথিগত ও মৌখিক
পরম্পরায় প্রাপ্ত শাস্ত্রীয়সংগীতের গঠন, প্রকৃতি এবং ব্যবহারিক ক্রিয়াদি তত্ত্বীয় সংগীত হিসেবে বিবেচিত।

সংগীত

সংগীত বলতে মূলত গীত, বাদ্য ও নৃত্য এই তিনটি ত্রিক্রয়াকে বোঝায়।

গীত

গীত বলতে সংগীত বা কণ্ঠসংগীতকে বোঝায়। সংগীতের দুটি প্রধান ধারা। ১. শাস্ত্রীয়সংগীত বা

উচ্চাঙ্গসংগীত বা রাগসংগীত ২. লোকসংগীত।
এই উপমহাদেশের শাস্ত্রীয়সংগীতের দুটি ধারা। হিন্দুস্তানি সংগীত ও কর্ণাটকি সংগীত। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয়সংগীতের
প্রধান গীতিশৈলী চারটি। ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা ও ঠুমরি। এ ছাড়া ধামার, সাদরা, দাদরা, গজল ইত্যাদিও
রাগসংগীত নির্ভর গীতিশৈলী। লোকসংগীতের বহু ধারা। বাংলা লোকসংগীতের প্রধান ধারাসমূহ হচ্ছে: বাউল,
ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, ঝুমুর, জারি, সারি ইত্যাদি।

বাদ্য

যন্ত্রসংগীতকে বাদ্য বা বাদ্যসংগীত (Instrumental Music) বলা হয়। যন্ত্রসংগীতে কয়েকটি প্রকারভেদ
আছে। যেমন: তত বাদ্য, আনদ্ধ বাদ্য, ঘন বাদ্য ও সুধির বাদ্য।

নৃত্য

তাল, লয়সহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করাকে নৃত্য বলে। নৃত্যেরও অনেক

প্রকারভেদ আছে। যেমন: ভরতনাট্যম, কথাকলি, মণিপুরি, কথক ইত্যাদি।

উপর্যুক্ত চারটি প্রধান নৃত্যধারা ছাড়াও অনেক আঞ্চলিক লোকনৃত্য প্রচলিত আছে। সুর, ভাব, ছন্দ, গতি ও

সুন্দরের বন্দনা প্রায় সকল ধারার সাথে সম্পৃক্ত। গীত, বাদ্য ও নৃত্য সমষ্টিগতভাবে অথবা স্বতন্ত্রভাবে

পরিবেশন করা সম্ভব।

শুদ্ধ রাগ

যে রাগ মৌলিক অর্থাৎ অন্য কোনো রাগের মিশ্রণে রচিত নয় তাকে বলা হয় শুদ্ধ রাগ বা শুদ্ধ শ্রেণির রাগ।
যেমন: ইমন, ভৈরব, পূরবী ইত্যাদি।

শাল রাগ বা ছায়ালগ রাগ

যে রাগে অন্য রাগের ছায়া পরিলক্ষিত হয় তাকে সালঙ্ক বা ছায়ালগ শ্রেণির রাগ বলা হয়। যেমন: ভীমপলশ্রী,
বাগেশ্রী ইত্যাদি।

সংকীর্ণ রাগ

যে রাগ একাধিক রাগের মিশ্রণে রচিত তাকে সংকীর্ণ রাগ বা সংকীর্ণ শ্রেণির রাগ বলা হয়। যেমন: কাফি,
ভৈরবী ইত্যাদি।

বন্দিশ

সাধারণত সুর, তাল, লয় এবং কখনও কখনও বাণীর সমন্বয়ে যে বিশিষ্ট রচনাকে অবলম্বন করে কণ্ঠসংগীত
বা যন্ত্রসংগীত বিস্তৃতি লাভ করে তাকে বন্দিশ বলে ।

ভুক্‌

তুর্ক অর্থ অংশ। গানের অংশ বিশেষকে তুর্ক বলে। স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী এবং আভোগ প্রভৃতি তুকের নাম ।
ধ্রুপদ গানে এই চারটি তুক্ ব্যবহৃত হয়। খেয়াল, টপ্পা ও ঠুমরিতে সাধারণত দুটি ভূক্ থাকে।

স্থায়ী

গীত বা বন্দিশের প্রথম তুর বা অংশের নাম স্থায়ী। স্থায়ীকে অস্থায়ীও বলা হয়ে থাকে। এই অংশটি বিশেষ
গুরুত্বপূর্ণ। স্থায়ীর স্বর বিন্যাস সাধারণত মধ্য ও মন্দ্র সপ্তকে হয়ে থাকে। এর গতি ধীর এবং গম্ভীর। গীত বা
বাদ্যের আরম্ভ যেমন স্থায়ীতে তেমনি সমাপ্তিও ঘটে এই স্থায়ীতে।

অন্তরা

গীত বা বন্দিশের দ্বিতীয় ভুক বা অংশকে অন্তরা বলে। অর্থাৎ স্থায়ীর পরবর্তী পদ বা তুকের নাম অন্তরা। অন্তরার
সুর সাধারণত মধ্য সপ্তকের গান্ধার বা মধ্যম থেকে তার সন্তুকের মধ্যম বা পঞ্চম পর্যন্ত বিস্তৃত।

সঞ্চারী

গীত বা বন্দিশের তৃতীয় তুক বা পদকে সঞ্চারী বলে। অর্থাৎ স্থায়ী ও অন্তরার পরের ভুক বা পদ সঞ্চারী।

সাধারণত মধ্য সপ্তকের ষড়জ ও পঞ্চমের মধ্যবর্তী স্থানে সঞ্চারীর মুখ্য প্রকাশ ।

আভোগ

গীত বা বন্দিশের চতুর্থ ভুককে সংগীতের পরিভাষায় আভোগ বলে। অর্থাৎ স্থায়ী, অন্তরা ও সঞ্চারীর পরবর্তী
পদই হলো আভোগ।

গায়কি

গায়কীর অর্থ হলো গাইবার ঢং। কোনো গুণী তাঁর নিজস্ব প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়ে এক স্বতন্ত্র গায়নভঙ্গি বা

বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলে তাকে গায়কী বলে।

নায়কি

শুরু পরম্পরায় শিক্ষাপ্রাপ্ত সংগীতকে নির্ভুল ও অবিকৃতরূপে প্রকাশ করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় নায়কী।

কম্পন

কোনো একটি স্বর বার বার ধ্বনিত হলে কম্পন সৃষ্টি হয়। এর ফলে একটি স্বর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী শ্রুতিতে

আন্দোলিত হয়ে থাকে।

স্পর্শ স্বর বা কণ স্বর

কোনো একটি স্বরের ক্ষণস্থায়ী স্পর্শে একটি অধিকতর স্থায়ী স্বর উচ্চারিত হলে অথবা একটি অধিকতর স্থায়ী
স্বরের স্পর্শে একটি ক্ষণস্থায়ী স্বর উচ্চারিত হলে উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষণস্থায়ী স্বরটিকে স্পর্শ বা কণ স্বর বলা হয়।

অলংকার

অলংকার শব্দের অর্থ হলো ভূষণ। সংগীতের ক্ষেত্রে আরোহ-অবরোহকে ঠিক রেখে বিভিন্ন বর্ণ মিশ্রণজাত স্বর
বিন্যাসকে অলংকার বলা হয়।

গমক
নাভি থেকে গম্ভীরভাবে উচ্চারিত চিত্তাকর্ষক স্বর কম্পনকে গমক বলা হয়।

Content added By
তদর্থক
অস্থায়ী
শপথপত্র
ক ও খ উভয়ই

ছন্দ

তবলায় একাধিক মাত্রার সমন্বয়ে নির্দিষ্ট সময় পর পর যখন একটি ঝোঁক তৈরি হয় তখন তাকে ছন্দ বলে।
এই সমন্বয়ের ফলে এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়, যা একান্তভাবেই অনুভবের বিষয়। সাধারণত ছন্দকে দুই ভাগে
ভাগ করা যায় সম ও বিসম।

পদ বা বিভাগ

তালের চলনকে স্পষ্ট করে প্রকাশ করার জন্য ঐ তালের নির্দিষ্ট মাত্রা সমষ্টিকে কতকগুলি ছোটো-বড়ো ভাগে
বিভক্ত করা হয়। এদের প্রত্যেকটিকে এক একটি বিভাগ বলে। এই বিভাগগুলি দুই বা ততোধিক মাত্রার হতে
পারে। তাল বিশেষে এক মাত্রার বিভাগও দেখা যায়।

সঙ্গত

সঙ্গত অর্থ হলো সঙ্গ দেয়া বা সহযোগিতা করা। গান-বাজনার ভালো মন্দ যে অনেকাংশেই সঙ্গতকারীর উপর
নির্ভর করে, এ কথা বলতে কোনো বাধা নেই। আসলে সঙ্গতকারের কাজ হলো গান-বাজনাকে প্রাণবন্ত করে
তোলা। তাই যেখানে যা দরকার এবং যতটুকু দরকার, সেইখানে ঠিক ততটুকুই উপযুক্তভাবে প্রয়োগ করতে
হয়।

তাল পরিচিতি

তাল: তেওড়া

বিভাগ

ছন্দ

সম বা তালি

প্রথম মাত্রায় সম ও চতুর্থ মাত্রা এবং ষষ্ঠ মাত্রায় তালি

খালি বা ফাঁক

নেই
বিসমপদী

পদ

তবলা ও পাখওয়াজ

তেওড়া তালের তাললিপি

বাদন

৩/২/২ মাত্রার ছন্দ

भावा

د

ধা

দেন তা

তেটে

কতা

গদি

ধা

বোল

চিহ্ন

x

ঘেনে।

তাল: ঝাঁপতাল

বিভাগ

ছम

সম বা তালি

খালি বা ফাঁক

পদ

বাদন

৩৪

8
২/৩/২/৩ মাত্রার ছন্দ
প্রথম মাত্রায় সম, তৃতীয় মাত্রা এবং অষ্টম মাত্রায় তালি

ষষ্ঠ মাত্রায়
বিসমপদী

তবলা, পরিওয়াজ

ঝাঁপতালের ভাললিপি

৯ ১০ ১

ধি না। বিধি না । ভি না । ধি ধি না। ধা

বোল

চিহ্ন

তাল: রূপক

মাত্রা
বিভাগ

সম বা তালি

৩/২/২ মাত্রার ছন্দ
চতুর্থ মাত্রা এবং ষষ্ঠ মাত্রায় তালি

খালি বা ফাঁক

প্রথম মাত্রায়
বিসমপদী

পদ

তবলা

বাপন

রূপক তালের তাললিপি

মাত্রা

বোল

তিন তিন না

ধিন

না

ধিন না

। তিন

চিহ্ন

 

 

Content added || updated By
Please, contribute to add content into সংগীতের ইতিহাস.
Content

বাংলাগানের ইতিহাস

বিশ্বসংগীতের প্রাচীনতম সংগীতধারার মধ্যে অন্যতম 'বাংলাগান' এর যাত্রা শুরু হয় খ্রিস্টীয় দশম শতকে।
এর প্রথম নিদর্শন 'চর্যাগীতি' ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাগানে প্রধান সংগীতধারা হিসেবে
স্বীকৃত। ছোটো ছোটো পদে বিভক্ত চর্যাগীতির বিষয়বস্তু ছিল সহজিয়া বৌদ্ধ সাধুদের জীবনাচার। এই পদের
মাধ্যমে ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের নৈতিক তত্ত্ব প্রচার করতেন বৌদ্ধ সাধকরা। চর্যাপদের ভাষা ছিল
'সন্ধ্যাভাষা'। প্রাকৃত (সেই সময়ের কথ্য ভাষা) ও বিশুদ্ধ বাংলার সংমিশ্রণে রচিত এই পদসমূহের বৈশিষ্ট্য ছিল
এই যে, এগুলো ছিল দ্ব্যর্থবোধক। সাধারণের জন্য আপাত অর্থের বিপরীতে প্রত্যেক পদের একটি গূঢ় অর্থ ছিল
যা সহজিয়া সাধকগণই বুঝতেন। প্রত্যেক পদের উপরের শিরোনামে পদে ব্যবহৃত রাগের নাম এবং পদের
শেষে পদকর্তার ভণিতা ( ছন্দে ও সুরে গীত পদকর্তার নাম) থাকত। সাহিত্য ও সংগীত গবেষক
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগারে এই চর্যাপদের পাণ্ডুলিপি
আবিস্কার করেন।

বাংলা সংগীতধারার পরবর্তী সংগীত গীতগোবিন্দ মূলত সংস্কৃতে লিখিত। কিন্তু বাংলার পরবর্তী সংগীত বিশেষ
করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং ভারত উপমহাদেশীয় নৃত্য-সংগীত-ধারার অনুপ্রেরণা ছিল গীতগোবিন্দ। গোবিন্দ
অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ-এর জীবনের নাটকীয় ঘটনাই ছিল গীতগোবিন্দের বিষয়বস্তু। মোট বারো সর্গে বিভক্ত এই গান
পরবর্তী শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পূর্বসুরী। গীতগোবিন্দ রচনা করেন রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেব।
গীতগোবিন্দের পরিবেশনায় গান করতেন জয়দেব এবং নৃত্যে সহযোগিতা করতেন তার স্ত্রী পদ্মাবর্তী।

বাংলাগানের ইতিহাসে গীতগোবিন্দের পরবর্তী ধারা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বিষয়বস্তু রাধা-কৃষ্ণের
জীবনলীলা। বাংলায় লিখিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন গীতগোবিন্দের মতোই শ্রীকৃষ্ণের জীবননির্ভর ছোটো ছোটো
নাট্যদৃশ্যে ভাগ করা। তবে এখানে দৃশ্যকে সর্গ না বলে খণ্ড বলা হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচয়িতা হিসেবে চণ্ডীদাস
নামের ভণিতা (শেষ স্তবকে লিখিত রচয়িতার নাম) পাওয়া যায়। তবে চণ্ডীদাস নামের পূর্বে বড়ু চণ্ডীদাস, বীজ
চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ইত্যাদি বিশেষণ থাকাতে এবং আজ পর্যন্ত প্রাপ্ত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কলেবর (আকার
পরিমাণ) বিবেচনা করে ধারণা করা হয় চণ্ডীদাস এক ব্যক্তি ছিলেন না বরং চণ্ডীদাস ছদ্মনামে বিভিন্ন সাধক
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করেন।

পরবর্তী ধারা বৈষ্ণব পদাবলি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেরই ধারাবাহিক প্রকরণ। পদাবলি কীর্তন পূর্বতন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেরই
উত্তরধারা। বৈষ্ণব পদাবলির বিশেষ বৈশিষ্ট্য এর কাব্যিক ভাষা। মিথিলার বৈষ্ণব সাধু বিদ্যাপতি তাঁর সংগীত
জীবন কাটান বাংলায়। বিদ্যাপতি মৈথিলী এবং বাংলাভাষার মিশ্রণে বৈষ্ণব পদাবলির জন্য গীতিকাব্যিক
ব্রজবুলি ভাষার অবতারণা করেন। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ধারায় গীত বৈষ্ণব পদাবলি ষোড়শ শতকের
দ্বিতীয়ার্ধে রাজশাহীর নরোত্তম দাসের নেতৃত্বে আহুত খেতুরীর মহোৎসবে গরাণহাটি, রাণীহাটি, মন্দারিণী,
মনোহরশাহী এবং ঝাড়খণ্ডী এই পাঁচটি গীতধারায় বিভক্ত হয়। পঞ্চদশ শতকের বৈষ্ণব সাধক শ্রীচৈতন্য

নামকীর্তনের (পদাবলির গল্পভিত্তিক গান নয়, শুধু নাম ছন্দে ও সুরে গাওয়া) মাধ্যমে বাংলায় কীর্তন গানে
গীতবিস্তারের সূচনা করেন। বৈষ্ণবপদাবলি কীর্তনগান, বাংলায় পরবর্তী বিভিন্ন সংগীতধারা এমনকি হাল
আমলের সিনেমার গান ও ব্যান্ড সংগীতকেও প্রভাবিত করেছে।

বাংলাসংগীতের আরেকটি প্রাচীন আখ্যানধর্মী গীতধারা মঙ্গল গান। মঙ্গল অর্থে শুভ, যেকোনো মাঙ্গলিক শুভ

অনুষ্ঠান, বিশেষ করে বিবাহ অনুষ্ঠানে এই গান পরিবেশনার রীতি প্রচলিত। লোকায়ত দেব-দেবীর কাহিনি এই

গানের বিষয়বস্তু। প্রচলিত মঙ্গল পানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ইত্যাদি।

অষ্টাদশ শতকে এসে বাংলাগান খণ্ডগীতি আকারে একটি স্পষ্ট রূপ নিতে থাকে। এই শতকের প্রধান দুটি
গীতধারা, শাক্তগীতি ও টপ্পা। মঙ্গল গান রচয়িতা রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়ের হাতে শাক্ত পদাবলির
সূত্রপাত। কিন্তু এর রূপটি উৎকর্ষিত হয়েছে রামপ্রসাদ সেনের হাতে। শাক্তপদাবলি, শাক্তগীতি মূলত শক্তি
দেবী শ্যামা এবং দুর্গা (উষা) কে নিয়ে রচিত। শ্যামাসংগীত, শ্যামার করাল, ভয়াল রূপের বিপরীতে তাঁর শেহ
বৎসল মাতৃরূপ কল্পনা করে মাতৃভক্তির পান। অন্যদিকে উমাসংগীতে, উমাকে (দুর্গা) সন্তান কল্পনা করে।
বাৎসল্যের গান।

অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে টপ্পা গানের মাধ্যমে রামনিধি গুপ্ত (নিধু বাবু) কেবল নতুন গীতরীতির অবতারণা
করেননি বরং বাংলা গানে আনেন মানবীয় অনুভূতির প্রকাশ। পূর্ববর্তী বাংলা গানে দেখা যায় ধর্ম
সম্প্রদায়ভিত্তিক দেবমাহাত্ম্য ও ভক্তির প্রকাশ। নিধুবাবুর টপ্পা সেদিক থেকে নর-নারীর প্রেমানুভূতির
প্রকাশক নিধুবাবু প্রায় ছয়শত টপ্পা সুরের প্রেমসংগীত রচনা করেন। সমকালের আরেক গীতধারা আখড়াই
গানের নব প্রবর্তনেও নিধুবাবুর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। টপ্পার সুর কবিগান, আখড়াই, পাঁচালী, যাত্রা ইত্যাদি
সমকালের অন্যান্য গীতধারাকে প্রভাবিত করেছিল। বাংলা টপ্পাপানে নিধুবাবু ছাড়া আর যার নাম বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য তিনি হচ্ছেন কালী মীর্জা বা কালিদাস চট্টোপাধ্যায় ।

উনিশ শতকের অন্যান্য গীতধারার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— পাঁচালী, কবিগান, যাত্রা ইত্যাদি। পাঁচালী,
পৌরাণিক গল্প ও লৌকিক উপকথাকে আশ্রয় করে আখ্যানভিত্তিক কিংবা গল্পভিত্তিক পরিবেশনায় একজন
পাঁচালীকার থাকে। তার সাথে থাকে যন্ত্রী এবং দোহার। পাঁচালীকার গল্পটি অভিনয় সহযোগে গানে গানে
পরিবেশন করেন। দোহারগণ গানের কথোপকথন, গান, সংলাপ ও অভিনয়ের মাধ্যমে গল্পের চরিত্র চিত্রণে
সহযোগিতা করেন। উনিশ শতকের উল্লেখযোগ্য পাঁচালীকার ছিলেন দাশরথি রায়।

কবি গান মূলত দুইজন স্বভাবকবির গান ও কাব্যের লড়াই। কবির লড়াইয়ে একেক দলে প্রধান গায়কের সাথে
একজন বাঁধনদার (কাব্য রচনার সহায়ক) এবং যন্ত্রীদল থাকেন। একজন কবিয়াল কাব্যে, গানে প্রশ্ন করেন,
যাকে চাপান বলা হয় এবং অপর কবি উতোর অর্থাৎ উত্তর দেন। কবিগানে রাতব্যাপী চলে এই চাপান
উভোরের পালা। আসর শেষে সুর ও কাব্যের উৎকর্ষতার ভিত্তিতে জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়। উনিশ শতকের
উল্লেখযোগ্য কবিয়ালদের অন্যতম, ভোলা ময়রা, হরু ঠাকুর, গোজলা এই এবং এন্টনি ফিরিঙ্গি।

উনিশ শতকের শুরুতে বাংলাসংগীতে 'ব্রহ্মসংগীত' নামে নতুন এক অধ্যাত্মগীতির (ভক্তিগীতি) সূচনা করেন
রাজা রামমোহন রায়। সমাজসংস্কারক রাজা রামমোহন রায় তৎকালীন কুসংস্কারভিত্তিক ধর্মচর্চার পরিবর্তে
একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্মের প্রচলন করেন। হাজার বছরের আচরিত সংস্কারভিত্তিক ধর্মচর্চার বিপরীতে ব্রাহ্মধর্মের
প্রচারে প্রধান মাধ্যম হিসেবে গানকে আশ্রয় করেন রামমোহন রায়। পূর্বতন সম্প্রদায়নির্ভর, পৌগুলিক

ধর্মসংগীতের তুলনায় অসাম্প্রদায়িক, অপৌত্তলিক, একেশ্বরবাদী এই নতুন ভক্তিগীতি শিক্ষিত বাঙালির মনে
স্থান করে নেয়। সুরের দিক থেকে রামমোহন রচিত প্রথম দিককারই একটি টপ্পাশ্রিত গান ছাড়া ব্রাহ্মসংগীত
মূলত হিন্দুস্তানি ধ্রুপদ সুরে রচিত। প্রথম যুগের ব্রাহ্মসমাজে পায়কগণ ছিলেন বিষ্ণুপুরী ধ্রুপদীশৈলীর
সংগীতজ্ঞ। আদি ব্রাহ্মসমাজ ক্রমে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ এবং নববিধান ব্রাহ্মসমাজ নামে তিন ধারায় বিভক্ত হয়।
তিন ধারাতেই ব্রহ্মসংগীতের চর্চা অব্যাহত থাকে। ব্রহ্মসংগীতের ধ্রুপদী ধারার পাশে বাংলার লোকসুর ও
কীর্তনসুর যুক্ত হয়। তবে ব্রহ্মসংগীতের প্রধান চর্চাস্থল হিসেবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি স্বীকৃত। রামমোহনের
পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পৃষ্ঠপোষকতায়, তাঁর পুত্রদের সক্রিয় অংশগ্রহণে পরিপৃষ্ঠ হয় ব্রহ্মসংগীত এবং
রবীন্দ্রনাথের হাতে এসে এই সংগীতধারা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।

আবহমান কালের বাংলাগান নাট্য ও সংগীতের পরিপুরকতায় বেড়ে উঠেছে। পলাশীর যুদ্ধের পর অষ্টাদশ
শতকের শেষার্ধে ইংরেজ শাসকদের একচ্ছত্র আধিপত্যে কোলকাতার সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে
পরিবর্তনের ছোয়া লাগে। ইউরোপীয় ক্লাব প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হতে থাকে অপেরা। ক্রমে এই অপেরাথিয়েটার
প্রভাবিত করে বাংলাসংগীত সংস্কৃতিকে। নাট্যগীতি ও গীতিনাট্য নামে দুটি নতুন ধারার সূত্রপাত হয়। এ
সময়ে নাট্যগীতি ও গীতিনাট্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নাম- গিরীশ চন্দ্র ঘোষ, বিনোদবিহারী দত্ত, অতুলকৃষ্ণ মিত্র
ইত্যাদি।

উনিশ শতকের গানের অপর ধারা স্বদেশি সংগীত বা দেশাত্মবোধক গান। বাংলা সাহিত্যে স্বাদেশিকতা,
জাতীয়তাবোধ উনিশ শতকের প্রারম্ভে শুরু হলেও দেশপ্রেমের গান স্বাদেশিক সংগীত বিকশিত হয়। মূলত
১৯৬৭ সালে 'হিন্দুমেলা' ও 'সঞ্জিবনী' সভাকে আশ্রয় করে। স্বাদেশিকতা নিয়ে এই গান ফল্গুধারার মতো পুনরায়
প্রবাহিত হয় ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।

এর পরবর্তী সময় পঞ্চকবির যুগ বলে আখ্যায়িত। বাংলাগানের পঞ্চভাম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়,
রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন, কাজী নজরুল ইসলাম কথা ও সুরের পরিপূরকতায় এক নতুন ধারার
সূচনা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ শতকের বাংলাগানের পথ চলা।

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সমৃদ্ধ শাখা লোকসংগীত। বাঙালি সংগীতপ্রিয় জাতি।
এদেশের মানুষ যখন থেকে বাংলা ভাষা পেয়েছে তখন থেকেই লোকসংগীত রচিত ও গীত হয়ে আসছে।
এগারো শত বছর আগে রচিত 'চর্যাপদ' ছিল বাংলাসংগীত ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন। ভাষাও ছিল আদি
বাংলা। শ্রুতি ও স্মৃতি নির্ভর এসব রচনার ভাষায় প্রাচীনতাও রক্ষিত হয়নি। নাথগীতিকা, ময়মনসিংহ গীতিকা
ও পূর্ববঙ্গ গীতিকাগুলি মধ্যযুগের রচনা। চর্যাপদে ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে উল্লেখ আছে এমন অনেক প্রবাদ আজও
প্রচলিত। যেখানে লোকসংগীতের অনুসঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়।

লোকসংগীতের সংজ্ঞ

সাধারণ অর্থে জনশ্রুতিমুলক গানকে লোকসংগীত বলা হয়। অর্থাৎ, যে গান শ্রুতি এবং স্মৃতি নির্ভর করে
প্রবহমান নদীর ধারার মতো বয়ে চলে তাকে লোকসংগীত বলে। এই গানে মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না
ইত্যাদি অতি সহজ কথা ও সুরে প্রকাশ হয়ে থাকে। ড. আরতোষ ভট্টাচার্যের মতে “যাহা একটি মাত্র ভাব
অবলম্বন করিয়া গীত হইবার উদ্দেশ্যে রচিত ও লোকসমাজ কর্তৃক মৌখিক প্রচারিত হয়, তাহাকেই
লোকসংগীত বলে।" বাংলাদেশের প্রতি অঞ্চলে এই গানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এজন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বলেছেন- “নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাঙ্গণে প্রাঙ্গণে যেমন- ছোটো বড়ো নদী-নালা স্রোতের জাল বিছিয়ে

দিয়েছে, তেমনি বয়েছিল গানের স্রোত নানা ধারায়.... লোকসংগীতের এত বৈচিত্র্য আর কোনো দেশে আছে
কিনা জানিনে।" লোকসংগীতের সংজ্ঞা অনুযায়ী কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো:

লোকসংগীতের বৈশিষ্ট্য

১। কৃষিজীবী জনমানস থেকে স্বতঃউৎসারিত এক প্রাচীন গীতরীতি যা মৌখিকভাবে প্রচলিত লোকসমাজে।
২। এই প্রাচীন গীতরীতি যা বর্তমানকাল অবধি বহমান থাকে তাকে 'লোকসংগীত বলা হয়। যা রাগসংগীত

বা জনপ্রিয় আধুনিক সংগীত দ্বারা প্রভাবিত নয়।

৩। লোকসংগীত সমবেত কণ্ঠে গীত হয় যেমন; তেমনি একক কণ্ঠেও গীত হয়।
৪। এখানে পল্লি মানুষের সহজ ভাষা, আঞ্চলিক উচ্চারণ ও সহজ সুরের প্রকাশ।

৫। সম্মিলনে হৃদয়গ্রাহী কথা ও সুরের আবেদন।

৬। সুরের আবেদন সার্বজনীন হলেও কিছু কিছু গান আঞ্চলিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভাই এ গানগুলোকে
আঞ্চলিক গানও বলা হয়।

৭। প্রাকৃতিক নির্ভরতা অর্থাৎ নিসর্গ প্রান্তর, নদী ও নৌকা প্রভৃতি গ্রাম সভ্যতার রূপক এই গানে ব্যবহার হয়ে থাকে।

৮। জগৎ-জীবন ও দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার নিরাভরণ প্রকাশ।

৯। সহজ স্বাভাবিক ছন্দের ব্যবহার।

১০। মানবিক প্রেমের বিরহ-মিলিতজাত ভাবাবেগের প্রবল উচ্ছ্বাস।

বাংলাদেশের লোকসংগীতের বিভিন্ন ধারা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ধারা তুলে ধরা হলো:

চটকা গান

চটকা মূলত ভাওয়াইয়া পানের অন্তর্গত। চটুল বাণী ও চটুল সুরে এবং দ্রুত লয়ে গাওয়া হয় বলে এটাকে চটকা
গান বলা হয়। তবে ভাওয়াইয়া গানের মতো এই গানেও গলার ভাঙা অলঙ্কার থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-
প্রেম জানে না রসিক কালাচাঁন্দ।

গম্ভীরা

বৃহত্তর রাজশাহী জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জে এই গান প্রচলিত গম্ভীরা গানের বিষয়বস্তু মূলত বিনোদনমূলক
লোকসংগীত। এটি দলীয় সংগীত, তবে মূখ্য ভূমিকা পালন করে 'নানা' ও 'নাতি' নাম ভূমিকায় দুজন শিল্পী।
হারমোনিয়াম, ঢোল, দোতারা, বাঁশি, খঞ্জনী এবং করতাল বাজিয়ে অন্যান্য বাদক সাহায্য করে। গম্ভীরা গানের
একটি উদাহরণ:

হে নানা বড়োর জ্বালা যেমন তেমন ছোটোর জ্বালায় বাঁচিনা...।

ভাদু

পূজা উপলক্ষের গান। ভদ্রেশ্বরী দেবীকে উপলক্ষ করে সারা ভাদ্র মাসে এই গান গাওয়া হয়। মূলত ভাদুর
আগমনী উপলক্ষেও এ গান গীত হয়। তেমনি একটি গান:

আমার ভাদু দক্ষিণ যাবে

ক্ষিদে লাগলে খাবে কি

আনো ভাদু গায়ের গামছা.....।

আলকাপ

আলকাপ মিশ্র আঙ্গিকের গান। এতে বাদ্য, গান, নাচ, অভিনয় ও কৌতুকের সংমিশ্রণ আছে। এজন্য আলকাপ
গানের দল প্রায় ১৫-২০ জনের শিল্পী দল গঠিত হয়। দলের প্রধান গান রচনা ও গাইতে পারেন। আলকাপ
গানের শিল্পীরা সকলেই গ্রাম গঞ্জের সমাজের সকল স্তর থেকে আসে। আলকাপ গানের আসর বসে
পূজা মণ্ডপে, খোলা মাঠে। হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা-পার্বনেও এ গান পরিবেশিত হয়। এই গান টাপাইনবাবগঞ্জ
জেলায় প্রচলিত। আলকাপ গানের একটি উদাহরণ-

বাংলা মা তোর আকাশ মাটি হলো।

তোর গতর হতে এই মাটিতে সুবাস বহে চিরকাল

বিয়ের গান

বিয়ের গান উৎসবের গান। এটি শুধু সামাজিক জীবনের উল্লেখযোগ্য আনুষ্ঠানিক গান। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে
সমাজভুক্ত সকলেই এই গানে অংশ গ্রহণ করে। বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে পানচিনি, গায়ে হলুদ ইত্যাদি
অনুষ্ঠানের প্রতিটিতে গান পরিবেশন করা হয়। উল্লেখযোগ্য একটি বিয়ের গান:

সোনার বরণী কন্যা

সাজে নানান রে
কালো মেঘ যেন সাজিলরে

Content added || updated By

লালন শাহ

ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে বাস করতেন সম্পন্ন গৃহস্থ গোলাম কাদির দেওয়ান। তার পুত্র দরিবুল্লা
দেওয়ান ও পুত্রবধূ আমিনা খাতুনের ছিল তিন পুত্র সন্তান। বড়ো ছেলের নাম আলম, মেজো ছেলের নাম কলম
ও ছোটো ছেলের নাম ছিল লালন। এই ছোটো ছেলে লালনই পরবর্তীকালে নিজ প্রতিভা ও সাধনার বলে
হয়েছিলেন লালন শাহ্।

বাংলার এই অধ্যাত্ম সাধক ও কবি লালন শাহের জন্ম ১১৭৯ সালের ১ কার্তিক মোতাবেক ১৭৭৪ সালের ১৪
অক্টোবর মতান্তরে ১৭ অক্টোবর। তার জন্মের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পিতা দরিবুল্লা দেওয়ানের মৃত্যু ঘটে।
বড়ো ভাই আলম জীবিকার সন্ধানে চলে যান কোলকাতায়। মেজো ভাই কলম পিতার সামান্য জমিজমা নিয়ে
কৃষি কাজ করে কোনোরকমে সংসার চালাতেন। লালন তাঁকে গৃহকাজ ও কৃষি কাজে সামান্য সাহায্য করেন।
এমনি অভাবের মধ্য দিয়ে লালনের শৈশবকাল কাটে।

হরিশপুর গ্রামের পাশেই ছিল এক প্রকাণ্ড মাঠ। ছোট লালন সেই মাঠে গরু ছেড়ে দিয়ে সমবয়সী রাখাল
ছেলেদের সাথে খেলা করতেন এবং গান গাইতেন, তবে গানের প্রতিই ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। তাঁর কণ্ঠটি
ছিল যেমন শ্রুতিমধুর তেমনি ছিল গায়ন ভঙ্গি। তার গান শুনে মাঠে ও জমিতে কর্মরত সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত।
লালনও এতে উৎসাহ বোধ করতেন। এভাবেই সংগীতের প্রতি তার আকর্ষণ বাড়তে থাকে। সে সময়ে তাদের
ও আশেপাশের গ্রামগুলোতে প্রায়ই পালাগান, কীর্তন, জারি, কবিগান, যাত্রাগান, গাজীর গান ইত্যাদি নানা
রকম গানের আসর বসত। লালন যখন তখন ছুটে যেতেন সেসব আসরে গান শুনতে। এই গানের আসরে
যাওয়া নিয়ে মেজো ভাই কলমের শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে ঘরও ছাড়তে হয়েছিল। গৃহত্যাগী লালন আশ্রয়
পান সে এলাকার অবস্থাপন্ন গৃহস্থ ইনু কাজীর বাড়িতে। এভাবে লালন কৈশোরে পদার্পণ করেন; ইতোমধ্যে
তার মাতৃবিয়োগ ঘটে।

মায়ের মৃত্যুর পর লালন পুরোপুরি গৃহত্যাগী হয়ে দিন কাটাতে থাকেন গানের আসরে, পীর-ফকিরের
আস্তানায়, হাটে-ঘাটে। এমনি লক্ষ্যহীনভাবে নানাদিকে ঘুরে ফিরে অবশেষে লালন সাধক পুরুষ সিরাজ
শাহের নজরে পড়েন। সিরাজ শাহের নিবাস ছিল হরিশপুরে। তিনি ছিলেন পালকি বাহক। গ্রামের লোকেরা।
তাকে 'ছিরাবদ্দি বেহারা' বলে ডাকত। তিনি ছিলেন ভাবসাধক। সিরাজ শাহের অধ্যাত্ম গুরু ছিলেন আমানদি
শাহ। আমানন্দি শাহের গুরু ছিলেন মানিক শাহ এবং তিনি ছিলেন সিলেটের বিখ্যাত সাধক আমানতুল্লা শাহের
শিষ্য। ভাই সাধক ঘরানার অনুসারী হিসেবে সেসময় অধ্যাত্ম সাধক সিরাজ শাহের যথেষ্ট সম্মান ছিল। দয়ালু
সিরাজশাহ সংসার ত্যাগী লালনকে পুত্র স্নেহে বুকে টেনে নেন। লালনেরও তাঁর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা জন্মে এবং
তাঁর কাছেই দীক্ষা গ্রহণ করেন। দীক্ষা গ্রহণ করার পর শুরু ও গুরুমায়ের সেবায় লালনের দিন কাটতে থাকে,
এর পাশাপাশি চলে সাধুসঙ্গ। এভাবেই তার তত্ত্ব জ্ঞানের ভাণ্ডার পূর্ণ হতে থাকে। এ অবস্থায় বিবাগী লালনকে
সংসারমুখী করার উদ্দেশ্যে সিরাজ শাহ সেই গ্রামের মেছের শাহ ফকিরের কন্যার সাথে তার বিবাহ দেন। কিন্তু
অল্পদিনের মধ্যেই লালনের পত্নীবিয়োগ ঘটে। সে আঘাত ভুলতে লালন গুরু ও গুরুমার সেবায় আরো
মনোযোগী হন এবং অধ্যাত্ম সাধনায় গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। সেবায় তুষ্ট হয়ে এ সময়েই সিরাজ শাহ্
লালনকে পূর্ণ ফকিরি ও খেরকা (ফকিরি পোশাক) প্রদান করেন।

১৭৯৮ সালে সিরাজ শাহ্ এবং এর কিছুদিন পর তার স্ত্রী মারা যান। গুরু ও গুরুমাকে হারিয়ে লালন অত্যন্ত
অসহায় হয়ে পড়েন। গুরু প্রদত্ত খেরকা এবং আঁচল-ঝোলা সম্বল করে তিনি অজানার পথে হরিশপুর ত্যাগ
করে তীর্থস্থান ভ্রমণ করতে থাকেন।

একবার তিনি রাজশাহীর খেতুরির মেলায় যোগ দিয়ে ফেরার পথে নৌকায় প্রচণ্ড গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন। মাঝি
ও যাত্রীরা তাকে অচেতন অবস্থায় কালীগঙ্গা নদীর তীরে ফেলে রেখে চলে যায়। পার্শ্ববর্তী ছেউড়িয়া গ্রামের
মলম কারিগর (তন্তুবায়) মুমূর্ষ অবস্থায় তাঁকে নদীতীরে দেখতে পেয়ে নিজগৃহে নিয়ে যান এবং নিরলস
সেবাযত্ন করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। এ ব্যাপারে মলমের স্ত্রীও আন্তরিক সহযোগিতা করেন। সে যাত্রায়
আরোগ্য লাভ করলেও লালনের একটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।

আরোগ্য লাভের পর লালনের পরিচয় পেয়ে মলম ও তাঁর স্ত্রী পরম শ্রদ্ধাভরে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শুধু
তাই নয়, গুরুর প্রতি অসামান্য ভক্তির নিদর্শন স্বরূপ মলম গুরুর আশ্রম তৈরির জন্য নিজের বসতবাড়ি ও ষোলো
বিঘা জমি লালনের নামে উইল করে দেন। সে জমিতেই লালন শাহ্ সাধু ও ভক্তদের জন্য আশ্রম গড়ে তোলেন
যা আজও 'লালন শাহের আখড়া' নামে পরিচিত।

এই ছেউড়িয়াতেই লালনের বাকি জীবন অতিবাহিত হয়। এখানে লালন তার সেবার জন্য বিশাখা নামে এক
সাধক মহিলাকে বিবাহ করেন। আরো জানা যায় যে, তাঁদের কোনো সন্তান হয়নি বলে বিশাখা লালনের
অনুমতি নিয়ে একটি পোষ্য কন্যা গ্রহণ করেছিলেন। এতেই প্রমাণিত হয় যে, ত্যাগী ও সংসার বিবাগী সাধক
হয়েও লালন সংসার বিচ্ছিন্ন সন্ন্যাস জীবনের পক্ষপাতি ছিলেন না। স্ত্রী, পোষ্য কন্যা এবং অনুসারী শিষ্যদের
নিয়েই লালন গড়ে তুলেছিলেন তাঁর সাধনার জগত।

লালনের অধিকাংশ গান এই ছেউড়িয়াতেই রচিত হয়। তাঁর গানের মূল বিষয় ছিল মানবপ্রেম। তিনি গানগুলো
মুখে মুখে রচনা করতেন এবং শিষ্যরা তা লিখে রাখতেন। কালক্রমে নিজ বৈশিষ্ট্য গুণেই লালনের গানগুলো
'লালনগীতি' নামে পরিচিত লাভ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লোক জীবনের এমন কোন বিষয় নেই যা লালনের
গানে ঠাই পায়নি। মারফতি, মুর্সিদি, দেহতত্ত্ব, মনশিক্ষা, প্রার্থনা, নবীতত্ত্ব, বিচ্ছেদী, মানবতাবাদ, একেশ্বরবাদ,
অধ্যাত্মবাদ ইত্যাদি। নিগুঢ় তাত্ত্বিক মত সুন্দরভাবে স্থান লাভ করেছে তার গানে। এ প্রসঙ্গে তার কিছু বিখ্যাত
গানের প্রথম কলি উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন আমি একদিনও না দেখিলাম তারে', 'সবলোকে কয়
লালন কি জাত সংসারে', 'কোথায় হে দয়াল কাণ্ডারী', 'এলাহি আলামিন গো আল্লা', 'মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার",
'পারে লয়ে যাও আমায়, 'পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়', 'কোন সাধনে শমন জ্বালা যায়', 'আজব আয়না
মহল নদি গভীরে', 'তিন পাগলে হলো মেলা নদেয় এসে', 'কে কথা কয়রে দেখা দেয় না', 'মিলন হবে
কতদিনে আমার মনের মানুষের সনে', 'দিন থাকতে মুরশিদ রতন চিনে নে না', 'সাই আমার কখন খেলে কোন
খেলা' ইত্যাদি।

একমাত্র সংগীত রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে যে কয়জন সাধক কবি বাঙালি মানসলোকে ধ্রুব তারার ন্যায়
উজ্জ্বল হয়ে আছেন, মরমি সাধক লালন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। জানা যায় যে, লালন সংগীতে বিমোহিত হয়ে
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে 'বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ কবি' বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কেবল তাই
নয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সংগীত রচনার অনেক ক্ষেত্রে লালনের ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন বলেও গবেষকগণ মনে করেন।

ভাবে, রসে, দর্শনে, লালনের সংগীত যে অমৃত লোকের সন্ধান দিয়েছে তা চিরকালই আমাদের জীবন দর্শনের
উৎস হয়ে থাকবে। সংগীতের এই অসাধারণ পুরুষ বাংলা ১২৯৭ সালের ১ কার্তিক (১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৭
অক্টোবর ১১৮ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হিসেবে সবার কাছে আদৃত। অসংখ্য কবিতার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যের সব শাখাতেই
আশ্চর্য সুন্দর সব লেখা উপহার দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্য, সংগীতের এমন কোনো দিক নেই যা তাঁর
সৃষ্টি-স্পর্শে সমৃদ্ধ হয়নি। 'চোখের বালি, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ 'চার অধ্যায়, শেষের কবিতা তার
উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তার নাটক মুক্তধারা, শারদোৎসব', 'রক্তকরবী', 'ডাকঘর ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যে
উল্লেখযোগ্য সংযোজন। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সাহিত্য বাঙালির চিন্তার জগৎকে প্রসারিত ও পরিণত করেছে।
তাঁর সাহিত্য, সাহিত্যের পথে', 'কালান্তর', 'সভ্যতার সংকট' প্রভৃতি প্রবন্ধের বই মানুষকে অনেক চিন্তার
খোরাক জুগিয়েছে। বলা যায়, বাংলা ভাষা তাঁর হাতেই আধুনিক রূপটি লাভ করেছে।

এত কিছু করার পরে রবীন্দ্রনাথ নিজে মনে করতেন তাঁর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে গানই সবচেয়ে বেশিদিন টিকবে।
এ থেকে বোঝা যায় নিজের লেখা গানকে তিনি কত উচ্চমূল্য দিতেন। তিনি শুধু গান লেখেননি, গানে সুর
দিয়েছেন, নিজে গেয়েছেন এবং অন্যদের শিখিয়ে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে চমৎকার সব অনুষ্ঠান করেছেন।
রুচিশীল মানুষ আর ভালো সমাজ তৈরি করার জন্য তিনি অক্লান্তভাবে কাজ করেছেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি শহর
থেকে দূরে প্রকৃতির কোলে বোলপুরে নিজের মতো করে 'শান্তিনিকেতন' শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়েছেন। তিনি
ছাত্রদের লেখাপড়া শেখানোর সাথে সাথে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। শান্তিনিকেতনে
প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত ঋতুভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতেন সারা বছর। এভাবে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির
নাগরিক সংস্কৃতির একটা ধারা তৈরি করে নিয়ে গেছেন। এটাই আজ অবধি বাঙালি সংস্কৃতির মূলধারা।

রবীন্দ্রনাথের জন্ম কোলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫ বৈশাখ তারিখে, তখন
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সমাজ-সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের
ভাবধারায় বিশ্বাসী। রামমোহনকে এদেশে আধুনিক শিক্ষা ও ভাবনার পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য করা হয়।
সেদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়ের তুলনায় মুক্ত উদার পরিবেশে মানুষ হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বালক
বয়সে পিতার সঙ্গে ভ্রমণের সঙ্গী হয়ে তাঁর চিন্তাধারাতে অনুপ্রাণিত হন। তাঁর অনেক গানে এই গভীর দার্শনিক
ভাব প্রকাশ পেয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ শৈশবে শিক্ষকের কাছে যেমন পড়া শিখেছেন তেমনি আবার পানও শিখেছেন সংগীত শিক্ষকের
নিকট। গান শিখেছেন প্রথমে পারিবারিক বন্ধু বিষ্ণু চক্রবর্তী ও শ্রীকন্ঠ সিংহের কাছে। তারপর লিখেছেন প্রসিদ্ধ
বাঙালি সংগীতজ্ঞ যদুভট্টের কাছে। দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার সংগীত চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রেখেছেন। পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকেই তাঁদের পরিবারে পাশ্চাত্য সংগীতের কিছু চর্চা
ছিল। তাছাড়া সতের বছর বয়সে প্রথমবার বিলেত গিয়ে রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সংগীতের সাথে ভালোভাবে
পরিচিত হন। ভারতীয় শাস্ত্রীয়সংগীতের মতো পাশ্চাত্য সংগীত থেকেও তিনি অনেক সুর নিজের গানে ব্যবহার
করেছেন। এসবের পাশাপাশি দেশীয় লোকসংগীত, কীর্তন, বাউল গান প্রভৃতির সুরও তাকে অনুপ্রাণিত
করেছে। তিনি যেমন লালন শাহের গান ভালোবাসতেন, তেমনি পছন্দ করতেন নানা ধরনের লোকসংগীত আর
উপমহাদেশের নানা অঞ্চলের পান। এসব গানের সুরে তিনি বহু গান রচনা করেছেন।

অনেক বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্রনাথের সংগীত জীবনকে তিনটি যুগে ভাগ করেন। প্রথম যুগ হলো ১৮৮১ থেকে ১৯০০
পর্যন্ত। এটিকে ধরা হয় তাঁর প্রস্তুতি পর্ব। ১৯০১ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত বিস্তৃত দ্বিতীয় যুগকে তাঁরা কবির
পরীক্ষা-নিরীক্ষার যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তৃতীয় যুগ হলো ১৯২১ থেকে ১৯৪১-এ তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত।

এ হলো পরিণত পর্ব। এছাড়া কবি নিজে ভাবের দিক থেকে তাঁর গানকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করেছেন
- যথাক্রমে পূজা, স্বদেশ, প্রেম ও প্রকৃতি। এছাড়াও গীতবিতানে বিচিত্র ও আনুষ্ঠানিক নামে দুটি পর্যায় আছে।
ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পার মতো হিন্দুস্তানি সুরের কাঠামোয় যেমন তিনি গান বেঁধেছেন তেমনি
বাংলার লোকসংগীত, পশ্চিমের অপেরা সংগীত বা বিভিন্ন প্রাদেশিক ভারতের লোক গানের সুর ব্যবহার করে
স্বাতন্ত্র্যে তাঁর সংগীতকে রূপময় করেছেন। তারই গানের মাধ্যমে ধ্রুপদ গানের স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও
আভোগ-এ চার ভাগের বা তুকের কাঠামোটি বাংলাগানে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

রবীন্দ্রসংগীত নানা বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। তার মধ্যে তাল ও ছন্দ বৈচিত্র্যও উল্লেখযোগ্য বিষয়। গানের ভাব প্রকাশের
জন্য তালের ব্যবহার ছাড়াও নতুন কয়েকটি ছন্দ প্রয়োগ করেছেন। ছয়টি নতুন তালের সৃষ্টি করেছেন তিনি।
এগুলো হলো- রূপকড়া, নবতাল, ষষ্ঠী, একাদশী, ঝম্পক, নবপঞ্চ।

বিভিন্ন ভাবের, উচ্চ কাব্যগুণের দুই হাজারের বেশি গান তিনি রচনা করেছেন। এমনি করে উনিশ শতকের
বাংলা কাব্যসংগীত রবীন্দ্রনাথের সাধনায় উজ্জ্বল এবং সমৃদ্ধ হয়েছে। বাণী রচনায় ও সুর সংযোজনে
বাংলাগানকে প্রায় একক প্রচেষ্টায় তিনি চটুল রস থেকে মুক্ত করে এমন গভীরতা দেন। তিনি সংগীত, নৃত্য ও
নাটকের অসাধারণ মিলন ঘটান "বালীকি প্রতিভা', 'মায়ার খেলা', 'শাপমোচন', 'শ্যামা', 'চিত্রাঙ্গদা',
'চণ্ডালিকা' প্রভৃতি সার্থক গীতিনৃত্যনাট্য রচনা করে। ভাষা, সাহিত্য এবং শিক্ষা সংস্কৃতিতে উন্নত মানের
সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক বাঙালির জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছেন। তাঁর লেখা ও গান
অনুপ্রেরণার উৎস। মুক্তিযুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথের বহুগান গাওয়া হয়েছে, এমনকি যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের
কণ্ঠেও শোনা গেছে এই গান। তাঁর গান আমাদের শক্তি দেয়, শাস্তি দেয়— সুরে ও কথায়, ভাবের গভীরতায়
এ গান সবসময় উদ্দীপক এবং প্রাণময়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১)
কোলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

হাছন রাজা

সুনামগঞ্জ জেলার অন্তর্গত 'লক্ষণশ্রী' গ্রামে ১২৬১ বঙ্গাব্দের ১৭ পৌষ (১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে) হাছন রাজার জন্ম
হয়। 'লক্ষণশ্রী' গ্রামটি সে অঞ্চলে 'লক্ষণছিরি' বা 'লখনস্থিরি' নামে পরিচিত। তাঁর পিতার নাম ছিল দেওয়ান
আলী রাজা চৌধুরী এবং মাতার নাম ছিল হুরমত জাহান বিবি। তার বৈমাত্রেয় ভাই দেওয়ান ওবায়দুর রাজা
তার নাম রেখেছিলেন দেওয়ান অহিদুর রাজা চৌধুরী। দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও গবেষক দেওয়ান মোহাম্মদ
আজরফ সাহেবের লেখা থেকে জানা যায় যে, সিলেটের তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফারসি ভাষাবিদ নাজিরউল্লা
তার নামকরণ করেন হাছন রাজা। হাছন রাজা নিজেও এ নামেই পরিচিত হতে বেশি পছন্দ করতেন।

জানা যায় যে, হাছন রাজার পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন হিন্দু আর্য গোষ্ঠির ক্ষত্রিয় শ্রেণির উত্তর প্রদেশের অধিবাসী ।
ষোড়শ শতাব্দীতে তারা বসতি স্থাপনের জন্য বর্ধমান জেলায় এবং সেখান থেকে যশোরে আসেন। সেসব
স্থানে স্থায়ী বসতি স্থাপনে ব্যর্থ হয়ে তারা সিলেট অঞ্চলে চলে আসেন এবং ধীরে ধীরে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন।
সেই জমিদার বংশের অন্যতম বংশধর দেওয়ান বাবু রায় চৌধুরী পবিত্র ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়ে 'বাবু খাঁ' নাম
গ্রহণ করেন। তারও কয়েক পুরুষ পরের বংশধর হাছন রাজার পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী 'লক্ষণশ্রী
গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। হাছন রাজা তার দ্বিতীয় পুত্র। হাছন রাজা দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারার
অধিকারী ছিলেন। লম্বা সুঠাম দেহ, বলশালী বাহু, সুতীক্ষ্ম নাসিকা, কোকড়া চুল, টানা-টানা চোখ -এ সকল
দৈহিক গঠনের জন্য তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়।

শৈশবকালে হাছন রাজা অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতির ছিলেন। লেখাপড়ার প্রতি তার তেমন আগ্রহ ছিল না। তবে
নৌকা বিহার, ঘোড়ায় চড়া, হাতিতে চড়া, পশুপাখি শিকার করা ইত্যাদি কাজে তাঁর খুব ঝোঁক ছিল। যৌবনে
ঘোড়সওয়ারী হিসেবে তিনি ছিলেন কিংবদন্তিসম জনপ্রিয়। ঘোড়দৌড়ে সেকালের নবাবদের ও ইংরেজ
সাহেবদের ঘোড়াকে হারিয়ে তিনি বহুবার পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন।

তিনি লেখপড়া জানতেন না বলে যে জনশ্রুতি রয়েছে, আসলে তা সত্য নয়। বংশের রীতি অনুযায়ী যতটুকু
বিদ্যালাভ প্রয়োজন, ততটুকু শিক্ষা তাঁর ছিল। বরং পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ী আরবি শিক্ষার পাশাপাশি তিনি
সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার চর্চা করেছিলেন বলেও গবেষকগণ মনে করেন। সে সময়ের জমি-জমা সংক্রান্ত অনেক
কাগজপত্রে তাঁর সুন্দর স্বাক্ষরের কথাও অনেকে তাদের লেখায় উল্লেখ করেছেন। জানা যায় যে, অনাগ্রহের
কারণে বাল্যকালে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জিত না হওয়ায় পরিণত বয়সে তিনি শিক্ষা প্রসারে ব্রতী হয়েছিলেন।

মাত্র পনের বছর বয়সে হাছন রাজার পিতৃবিয়োগ ঘটে। এই অল্প বয়সে জমিদারি হাতে পেয়ে তার কৈশোর
ও যৌবন কাটে যথেষ্ট ভোগ বিলাসের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে এই ভোগ বিলাসের প্রতি ক্রমেই তার অনাশক্তি
দেখা দেয়। জাগতিক সব কিছুকেই তাঁর তুচ্ছ বলে মনে হয়; অন্তরে জন্ম নেয় আধ্যাত্মিক চেতনা। বাসনা
জাগে সৃষ্টির রহস্য জানার। এই আধ্যাত্মিক চেতনাবোধ থেকেই প্রকাশ ঘটে মরমি গীতিকবি হাছন রাজার।
স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি সু-গভীর প্রেমই হাছন রাজার গানের মূল দর্শন। তাই স্রষ্টাকে তিনি যেমন দেখেছেন 'মাওলা'
বা 'মৌলা' রূপে, তেমনি দেখেছেন, 'সোনাবন্ধু', 'কানাই', 'হাছনজান' ও 'কালা' রূপে।

বিশেষজ্ঞগণও তাঁর রচনাকে মোট তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা- ১। প্রেম ২। বৈরাগ্য বা অনাসক্তি
ও ৩। উচ্চানুভূতি বা অতিন্দ্রিয়ানুভূতি। তবে সকল ধারাতেই প্রেমিক হাছন রাজার উপস্থিতি সুস্পষ্ট। এ পর্যন্ত
সংগৃহীত হাছন রাজার গানের সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। সংখ্যার দিক থেকে ততটা উল্লেখযোগ্য না হলেও
বাণী ও সুরগত দিক থেকে তাঁর গান সহজ সরল ও প্রাঞ্জল হওয়ায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে অস্বাভাবিক। আঞ্চলিক
ভাষা ও সুরের সাবলীল ও সার্থক প্রয়োগের কারণে তাঁর গান বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এমন এক নতুন
মাত্রাযোগ করতে সক্ষম হয়, যা তাঁকে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতায় কালজয়ী করে তোলে।

স্বভাবকবিদের মতো মুখে মুখে গান রচনা করতেন বলে হাছন রাজা স্বভাবকবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি
নিজ হাতে গান লিখতেন না। অবিরাম মুখে মুখে রচনা করতেন এবং নিয়োজিত কর্মচারিরা তা লিখে রাখত।
কখনো কখনো তাঁর সহচর সহচরীগণও এ কাজে তাঁকে সাহায্য করতেন। রাতে গানের জলসায় এ সকল গান
বিভিন্ন গায়িকাদের দিয়ে গাওয়ানো হতো। আবিদ আলী নামে হাছন রাজার প্রিয় ঢোল বাদক সেসব গানের
সাথে সঙ্গতও করতেন। হাছনরাজা নিজেও মাঝে-মধ্যে তাদের সাথে ঢোল বাজাতেন। সাথে মন্দিরা বাজাতেন
সোনাজান নামে একজন গায়িকা। জানা যায় যে, তাঁর প্রিয় পরিচারিকা দিলারাই ছিল সেসব জলসার মূল
পরিচালক। প্রতিদিন জলসায় পরিবেশিত এ গানগুলোর সংকলন নিয়েই প্রকাশিত হয় তাঁর 'হাসন উদাস'
গ্রন্থটি।

হাছন রাজা বিয়ে করেছিলেন বেশ কয়েকবার। তাঁর সন্তানদের মধ্যে একলীমুর রাজা ছিলেন তাঁর কবি
প্রতিভার সুযোগ্য উত্তরসূরী। একলীমুর রাজার গানও এক সময় স্থানীয়ভাবে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাঁর
জ্যেষ্ঠপুত্র তৈমুর রাজাও অনেক গান রচনা করেন বলে জানা যায়। ১৯১৪ সালে হাছন রাজা জীবিত
থাকাকালীন সময়েই তাঁর 'হাসন উদাস' গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। এ গ্রন্থটিতে প্রায় দুইশত গান স্থান পায়।

এর পরে 'সৌখিন বাহার' নামে গাছপালা, পশুপাখি এবং নারী প্রকৃতি বিষয়ক তথ্যবহুল একটি বইও তাঁর
প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানা যায়।

হাছন রাজার বিভিন্ন ধারার গানের মধ্য থেকে কিছু গানের প্রথম কলি উল্লেখ করা হল। যেমন: ঐশী প্রেমমূলক
গান-- 'বাউল কে বানাইলো রে, হাছন রাজারে বাউলা কে বানাইলো রে', 'আমি যাইমু ও যাইমু আল্লার সঙ্গে
বৈরাগ্য বিষয়ক গান— 'লোকে বলে বলেরে ঘরবাড়ি ভালা না আমার', 'মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়ারে
কান্দে হাছন রাজার মন ময়নায় রে', 'হাছন রাজায় কয়, আমি কিছু নয়রে আমি কিছু নয়, প্রেমের গান- 'নেশা
লাগিলরে বাঁকা দুই নয়নে', 'সোনা বন্ধে আমারে দিওয়ানা বানাইলো' এবং অতিন্দ্রিয়ানুভূতির গান— 'রূপ
দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে' ইত্যাদি।

কেবলমাত্র তিনটি ধারার গানেই হাছন রাজার যে আধ্যাত্মিক চেতনা, প্রেম তথা ইহলৌকিক ও পরলৌকিক
বিষয়গুলো সহজ বর্ণনায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে বাংলা সাহিত্যে তা বিরল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও হাছন
রাজার গানে আকৃষ্ট হয়ে তার রচনার প্রশংসা করেছিলেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁর রচনায়
সর্বক্ষেত্রেই প্রেমের ভাবটি পরিস্ফুট হয়েছে সর্বাধিক। তিনি নিজেও এ ব্যাপারে বলতেন, 'যার প্রেম নেই, তার
কিছুই নেই'। তিনি একটি গানে আরও স্পষ্টভাবে বলেছেন-
'আমি করিরে মানা, অপ্রেমিকে গান আমার শুনিবে না।

কিরা দিই, কসম দিই, আমার বই কেউ হাতে নিবে না
অপ্রেমিক পান শুনিলে কিছুমাত্র বুঝবে না,

কানার হাতে সোনা দিলে লাল ধলা চিনবে না।

হাছন রাজার কসম দেয়, আর দেয় মানা,

আমার গান শুনবে না যার প্রেম নাই জানা।

বাংলা ১৩২৯ সালের ২২ অগ্রহায়ণ ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে এই প্রেমবাদী অমর গীতিকবি হাছন রাজার মৃত্যু হয়।

ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ

যে সমস্ত সংগীত সাধক ভারতবর্ষের সংগীত জগতকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে
ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিস্ক। ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ এমন এক অলৌকিক প্রতিভার
নাম, যার সংগীতপ্রেম, সাধনা ও সৃজনী শক্তির প্রভাব কিরানা ঘরানা তথা ভারতবর্ষের সংগীতকে করেছিল
বেগবান ও সমৃদ্ধতর। শুধু তাই নয়, সংগীতকে সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচারের জন্য তাঁর সার্থক অবদান
অনস্বীকার্য। কিরানা ঘরানার এই অবিসংবাদী সুরসম্রাট আব্দুল করিম খাঁ ১৮৭২ সালে ১১ নভেম্বর উত্তর
প্রদেশের মোজাফ্ফর নগর জেলার কিরানায় জন্মগ্রহণ করেন। আব্দুল করিম খাঁর পিতামহ মুহম্মদ শাহর
রাজত্বকালে রাজানুগ্রহ পেয়েছিলেন। পিতা কালে খাঁ ও চাচা আব্দুল্লাহ্ খাঁ ছিলেন কিরানা ঘরানার প্রধান
গুণিব্যক্তিত্ব। তার মাতা ছিলেন লাঠিয়াল কুস্তিগির বংশের মেয়ে। আব্দুল করিম খাঁ শৈশবকাল থেকেই
সংগীতের খুব ভক্ত ছিলেন। তাই শৈশবেই তিনি বীণা, সেতার, তবলা, নাকাড়া, জলতরঙ্গ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র
বাদনে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। এই প্রতিভাবান সংগীতশিল্পী শৈশবে পিতা কালে খাঁ ও চাচা আব্দুল্লাহ্
খাঁর কাছে সংগীতের তালিম শুরু করেন। পরবর্তীতে হায়দরাবাদের নিজামের সভাগায়ক ওস্তাদ নান্নে খাঁর
কাছে আব্দুল করিম খাঁ তালিম নেন। তৎকালে দুই আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব সিডিডির সাঁই বাবা ও নাগপুরের
তাজউদ্দিন বাবার সান্নিধ্যে এসে ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁর সংগীত জীবনের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।

আব্দুল করিম খাঁ শিশুকাল থেকেই অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন । শোনা যায়, ১৮৭৮ সালে মাত্র ছয়
বছর বয়সে সংগীত পরিবেশন করে তিনি তৎকালীন সংগীতগুণিদের তাক লাগিয়ে দেন। ১৮৮৩ সালে মাত্র
এগারো বছর বয়সে আব্দুল করিম খাঁ তার ভ্রাতা আব্দুল লতিফ খাঁর সঙ্গে যুগলবন্দী রীতিতে রাগ মুলতানী ও
পুরবীতে তান সরগম এর বহর শুনিয়ে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়কের স্বীকৃতি লাভ করেন। ১৮৮৯ সালে ১৭ বছর
বয়সে মহীশূরের মহামান্য মহারাজার দশহারা উৎসবে রাগ টোড়ী পরিবেশন করেন। তাঁর এই গানে মুগ্ধ হয়ে
মহারাজা দামি শাল ও সোনার মণিবন্ধ উপহার দেন। তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে জুনাগড়ের নবাবও প্রচুর উপহার,
উপঢৌকন প্রদান করেন এবং এক বছরকাল তাঁর দরবারে সভাপায়ক হিসেবে নিযুক্ত থাকেন । অন্যদিকে তাঁর
বিনয়ী ব্যবহার, সুরেলা গলা, মাহফিলের শ্রোতা বুঝে মনোরঞ্জন করার ক্ষমতায় বড়োদার মহারাজা ও মহারাণী
মুগ্ধ হয়ে অতি অল্প বয়স হওয়া সত্ত্বেও প্রাসাদের মেয়েদের সংগীত শিক্ষা দেওয়ার চাকরি দেন । শোনা যায়,
বড়োদার মহারাজার দরবারে বড়োলাট লর্ড এসৃগিন আব্দুল করিম খাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে একটি সার্টিফিকেট
ও দুইটি সোনার আংটি উপহার দিয়েছিলেন। এছাড়া মহাত্মা গান্ধীও তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে উচ্ছসিত প্রশংসা
করেছিলেন। ১৯২৪ সালে দিলীপকুমার রায়ের আমন্ত্রণে তিনি প্রথম কোলকাতায় সংগীত পরিবেশন করেন।
ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ ১৯৩৬ সালে কোলকাতায় অলবেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে সংগীত পরিবেশন করে
বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন ।

কিরানা ঘরানার দুইটি ধারা। একটি আব্দুল করিম খাঁর এবং অন্যটি আব্দুল ওয়াহিদ খাঁর। এই দুই সংগীত
ধারার মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও মূল চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য ছিল রাগ বিস্তারের ক্ষেত্রে। ওস্তাদ আব্দুল করিম
খাঁ খেয়ালে নতুন ধরনের ছন্দবহুল সরগম এর প্রচলন ঘটান এবং তিনিই প্রথম বড়ো খেয়াল অংশে
অতিবিলম্বিত রাগ বিস্তারের প্রচলন ঘটান। শোনা যায়, এই অতি বিলম্বিত অংশে সুর লাগানোর কায়দা তিনি
পেয়েছিলেন হদু খাঁ এর পুত্র রহমত খাঁ এর কাছ থেকে। ১৯১৬ সালে ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ পুণাতে 'আর্য
সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যার একটি শাখা ১৯৭১ সালে চেন্নাইতে ( মাদ্রাজে ) স্থাপিত হয়। এই দুই
জায়গাতেই তিনি গুরুকূল সংগীত শিক্ষা পদ্ধতিতে তালিম দিতেন। সেই স্কুলে শিষ্য-শিষ্যাবর্গের থাকা খাওয়ার
ব্যবস্থা স্কুলকেই বহন করতে হতো। আর এ কারণে তিনি নিয়মিত আট আনা টিকিটে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের

আয়োজন করতেন। ঐসব অনুষ্ঠানে শিষ্য-শিষ্যাদের গান ও নাটক পরিবেশন করতে হতো। এছাড়া খাঁ সাহেব
নিজেও সেই অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করতেন। আব্দুল করিম খাঁর গায়ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথমেই আসে
তাঁর কন্ঠ। তাঁর কণ্ঠের আওয়াজ ছিল বাঁশির মতো। তাঁর গায়ন শৈলীর বিশেষ কতকগুলো বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি
"অ" বা "হ" বর্ণ প্রয়োগ করে কন্ঠের আওয়াজ লাগাতেন। তাঁর গায়কীতে 'অ-কার' অথবা 'হ-কার" বর্ণের
বিস্তারের মধ্যে বেশিরভাগ থাকত বোল বিস্তার। সুর ও শ্রুতির ওপর তিনি বেশি জোর দিতেন। আব্দুল করিম
যাঁর গান ছিল ধ্যান পর্যায়ের। তিনি যখন গাইতেন তখন সুরের গভীরে লীন হয়ে যেতেন, আর শ্রোতারাও তাঁর
সেই গানে সম্মোহিত হয়ে যেত। আব্দুল করিম খাঁ বোলের সাহায্যে একটির পর একটি স্বর পেরিয়ে রাগ বিস্তার
করতেন, আর সেই স্বর বিস্তারে থাকত শান্তরস সমৃদ্ধ এক গভীর সুরব্যঞ্জনা। ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ ভারি
গমক তান ও দ্রুত সপাট তান খুব পছন্দ করতেন। তবে সুর ও সরগম এর উপর প্রাধান্য দিতেন বেশি। তিনি
বোল-বাট বা লয়কারীর আবেদনকে অভূতপূর্ব সরগম' রচনার মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। তাঁর সেই অভূতপূর্ব
সরগম রচনার ক্ষমতায় অভিভূত হয়ে যেতেন শ্রোতা দর্শক। তার গায়ন শৈলীতে কর্ণাটকি ও হিন্দুস্তানি সংগীতের
অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল। তাঁর পাওয়া 'যমুনা কি তাঁর মত যাইয়ো রাখে বিখ্যাত ভৈরবী ঠুমরিটি তৎকালীন
গুণিসমাজে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। এটি তাঁর নিজের রচনা। এছাড়া তাঁর গাওয়া 'পিয়া বিন নাহি
আবত চৈন' এই ঠুমরিটিও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা,
দাদরা, ভজন প্রভৃতি গীতরীতিতে যেমন সমান পারদর্শী ছিলেন তেমন বীণা বাদনেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ওস্তাদ
আব্দুল করিম খাঁর শিষ্য প্রশিষ্যের তালিকা বিশাল। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে বড়োদার রাজকুমার ফতেহ সিং,
সওয়াই গান্ধর্ব, দশরথবুয়া মূলে, সুরেশবাবু মানে, পণপত্রাও বেহরে, বালকৃষ্ণবুয়া কোপিলেশ্বরী, শামসুদ্দিন
খাঁ, প্যারে খাঁ, রৌশন আরা বেগম (ভাইজী), বিশ্বনাথয়া বঝে, সরস্বতী রাণে, হীরাবাঈ বড়োদেকর,
শংকররাও সরনায়েক প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ।

ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ-ই প্রথম খেয়ালে রাগ বিস্তার ও ছন্দোলয়মুক্ত 'সরগম এর প্রচলন করে খেয়াল গানের
রূপ পাল্টে দেন। শুধু তাই নয় সংগীতের প্রচার ও প্রসারের জন্য তিনি দুটি সংগীত বিদ্যালয় স্থাপন ও আট
আনা মূল্যের টিকিটের বিনিময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিরও আয়োজন করেন। শাস্ত্রীয়সংগীতে এই বৈপ্লবিক
পরিবর্তনের জন্য তাকে 'রোমান্টিক মুভমেন্ট'-এর জন্মদাতা বলা যায়। ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁর আধ্যাত্মিক
জীবন ছিল উঁচু স্তরের। যে কারণে তার কাছে মানুষ মানুষে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। এক কথায় তিনি ছিলেন
ভক্তিবাদী এক প্রেমিক, যার সন্ধান পাওয়া যায় তাঁর রচিত অনেক ভক্তিগীতিতে।

১৯৩৭ সালে ভক্তদের অনুরোধে মাদ্রাজের এক সংগীত সম্মেলনে যোগদান করেন ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ।
সেখান থেকে পণ্ডিচেরীতে যাওয়ার পথে হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করলেন। তিনি বুঝলেন যে, তাঁর অন্তিম সময়
উপস্থিত হয়েছে। ভাই পরবর্তী স্টেশন 'সিঙ্গাপেরুমল কোইলে' নেমে শিষ্যদের চাদর বিছিয়ে তানপুরা বাঁধার
আদেশ দিলেন। প্লাটফর্মে বসে তিনি 'দরবারী কানাড়া রাগটি গাইতে শুরু করলেন। আর এ রাগ গাইতে
গাইতেই ভারতবর্ষের কিরানা ঘরানার সুরসম্রাট ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ ১৯৩৭ সালের ২৭ অক্টোবর শেষ
নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

কাজী নজরুল ইসলাম

বাংলা সাহিত্যের অনন্য সাধারণ কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, শিল্পী ও সুরস্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম। এই অমিত
প্রতিভাধর কবি (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অনুযায়ী ১৩ মোহররম ১৩১৭ হিজরি ২৪মে ১৮৯৯ সালে)
জন্মগ্রহণ করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার
চুরুলিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ, মাতা কাজী জাহেদা খাতুন।
চার ভাই-বোনের ভিতর কবি ছিলেন দ্বিতীয়। বড়ো ভাই কাজী সাহেবজান, দ্বিতীয় কাজী নজরুল ইসলাম,
তৃতীয় কাজী আলি হোসেন এবং বোন কাজী উম্মে কুলসুম। কথিত আছে, চার ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর পর
কবির জন্ম হওয়ায় সবাই তাঁকে 'দুখু মিঞা' বলে ডাকত। আবার অনেকে বলেন শিশুকালে পিতৃবিয়োগ হওয়ায়
নিদারুণ দারিদ্রের ভিতর তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। সেই কারণেই তাঁকে 'দুখু মিঞা' বলে ডাকা হতো।
মাত্র নয় বৎসর বয়সে ৭ চৈত্র ১৩১৪ বঙ্গাব্দ ১৬ সফর ১৩২৬ হিজরি ২০ মার্চ ১৯০৮ সালে নজরুলের পিতার
মৃত্যু হয়। ফলে সংসারে দারিদ্র্য চরমে ওঠে। এ সময়ে নজরুল গ্রামের মক্তবের ছাত্র ছিলেন। এই মক্তব
থেকেই তিনি প্রাথমিক পরীক্ষায় পাশ করেন। কিন্তু নিদারুণ দারিদ্র্য আর সাংসারিক অশান্তির কারণে তার
স্বাভাবিক পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। সংসার চালানোর জন্য মাত্র দশ বৎসর বয়সে বালক নজরুলকে মক্তবে
শিক্ষকতা করতে হয়। শুধু তাই নয়, মসজিদে ইমামতি, মাজার শরিফে বিদমভগিরি, গ্রামে মোল্লাগিরি করতে
হয় অর্থ উপার্জনের জন্য। অত্যন্ত সৎ ধার্মিক মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করার ফলে পিতার ধর্মপরায়ণতা,
সততার দ্বারা বাল্যকালেই নজরুল প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতেও তা অটুট ছিল। নজরুলের স্বাভাবিক
পড়াশোনা বাধাপ্রাপ্ত হলেও তাঁর জ্ঞানপিপাসা থেমে থাকেনি। স্কুলের বিধিবদ্ধ পড়াশোনার বাইরে যাকিছু
শিক্ষণীয় সবকিছুই তাঁকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করত। কবি আরবি ও ফারসি ভাষার প্রথম পাঠ গ্রহণ করেন
মক্তবের শিক্ষক কাজী ফজলে আহমদের কাছে। তার পিতৃব্য (পিতার চাচাত ভাই) বজলে করিম ফারসি ভাষায়
সুপণ্ডিত ছিলেন এবং ফারসি ভাষায় কবিতা লিখতেন। তাঁর সাহচর্যে কবি আরবি ও ফারসি মিশ্রিত বাঙলা
কাব্য রচনা শুরু করেন। উক্ত ভাষা ও সাহিত্যচর্চা, ইমামতি, খিদমত পিরি পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ নতুন ধারার
ইসলামি সংগীত বিশেষভাবে গজল গানে যথোপযুক্ত আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দ প্রয়োগে সহায়তা করে।

কবি মাত্র বারো বছর বয়সে অর্থ উপার্জনের জন্য 'লেটো' দলে যোগ দেন। লেটোগান, কবি ও যাত্রা সম্বলিত
এক প্রকার গীতি । দুই দলের মধ্যে কবিতা ও গানের মাধ্যমে যেকোনো একটি বিষয়কে ভিত্তি করে লড়াই, এর
প্রধান উপজীব্য। কবি প্রাথমিকভাবে খুব সাধারণ অবস্থায় লেটো দলে যোগ দিলেও খুব কম সময়ের মধ্যেই
নিজ প্রতিভাবলে দলের শ্রেষ্ঠতম ওস্তাদ পদটি অধিকার করে নিয়েছিলেন। ওস্তাদ হওয়ার সুবাদে তাঁকে প্রায়ই
দলের অনুরোধ মতো বিভিন্ন বিষয়ে লেটো গান লিখতে হয়েছে। যার ফলে তিনি পরবর্তীকালে ভক্তিগীতি ও
বিভিন্ন ফরমায়েসী সংগীত রচনায় অনায়াসে সাফল্য লাভ করেন।

সদাচঞ্চল কৰি কোনো এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারতেন না। কাজেই এখানেও ব্যতিক্রম ঘটলো না।
হঠাৎ করেই লেটোদল ছেড়ে বর্ধমানের মাথরুন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। শিক্ষক ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন
মল্লিক। কিছুদিনের মধ্যেই আর্থিক অনটনের কারণে আবার স্কুল ত্যাগ করেণে। এরপর কিছুদিন বাসুদেবের
সখের কবিগানের আসরে ঢোলক বাজিয়ে গান করেছিলেন। এই সময় তিনি পালাগান, স্বরচিত কবিতায়
সুরারোপ করতে ব্যস্ত ছিলেন। এই সময়টি পরবর্তীকালে স্বনামধন্য সুরকার ও সংগীতজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠা
পাওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে সহায়তা করে।

একদিন এই সখের কবিগানের আসরে নজরুলের গান শুনে এক খ্রিষ্টান গার্ড সাহেব মুগ্ধ হন এবং তাকে
বাবুর্চির কাজ দিয়ে তার প্রাসাদপুরের বাংলায় নিয়ে যান। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই গার্ড সাহেবের দেওয়া
চাকরি ছেড়ে আবার চলে আসেন আসানসোল। এবার তিনি চাকরি নেন এম বশের চা রুটির দোকানে। বিনা
পয়সায় খাওয়া দাওয়াসহ বেতন ছিল মাসে এক টাকা। কিন্তু থাকার কোনো জায়গা ছিল না। সারাদিন পরিশ্রম
করে পরিশ্রান্ত নজরুল পাশের একটি তিন তলা বাড়ির নিচে ঘুমিয়ে থাকতেন। ঐ বাড়িতে কাজী রফিজউল্লাহ
নামে পুলিশের এক সাব-ইন্সপেকটর থাকতেন। তিনি কবিকে পাঁচ টাকা বেতনে গৃহভৃত্যের কাজে নিযুক্ত
করেন। কাজী রফিজউল্লাহ এবং তার স্ত্রী নজরুলকে খুব স্নেহ করতেন। তাদের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ জেলার
কাজীর শিমলা গ্রামে। তারা কবি নজরুলকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং দরিরামপুর হাই স্কুলে সপ্তম
শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। কিন্তু এখানেও কবি মাত্র কয়েক মাস থাকেন এবং বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে কাউকে কিছু
না জানিয়ে চলে যান। তারপর আবার তিনি রাণিগঞ্জ চলে যান এবং শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে
ভর্তি হন। সেখানে তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তার মেধা ও প্রতিভার পুরস্কার হিসেবে রাজ
পরিবার থেকে মাসিক সাত টাকা বৃত্তি ও বিনা খরচে ছাত্রাবাসে থাকা ও খাওয়ার সুযোগ পান। এখানে কবির
পরিচয় ঘটে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় এর সাথে এবং অচিরেই এই পরিচয় গভীর বন্ধুত্বে
পরিণত হয়।

কবি শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালীন শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন হাফিজ নুরন্নবী সাহেবকে।
তিনি নজরুলের মেধা, কাব্যপ্রীতি ও ফারসি ভাষায় দখল দেখে মুগ্ধ হন এবং স্কুলে তাঁর দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে
সংস্কৃত ছাড়িয়ে ফারসি পড়ার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীকালে নজরুলের ফারসি ভাষায় জ্ঞান, ফারসি সাহিত্য
পড়া এবং তাঁর কবিতায় ব্যবহার সবকিছুতেই সেই শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। সংগীতের প্রতি কবির
আগ্রহ ছিল প্রথম থেকেই। উক্ত স্কুলে আরও একজন শিক্ষক ছিলেন শ্রী সতীশ চন্দ্র কাঞ্জিলাল। শাস্ত্রীয়সংগীতে
তার যথেষ্ট দখল ছিল। উক্ত শিক্ষকের সাহচর্যে এসে কবির সংগীতের প্রতি আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল। সতীশচন্দ্র
অত্যন্ত যত্নের সাথে কবিকে শাস্ত্রীয়সংগীতের তালিম দিতে থাকেন। কিন্তু সদাচঞ্চল কৰি এখানেও বেশিদিন
থাকতে পারলেন না।

প্রি-টেস্ট পরীক্ষা দেওয়ার পর চারিদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। সৈন্য যোগাড়ের তোড়জোড়
চলছিল। অর্থের প্রয়োজনে কবি বাধ্য হয়ে ১৯১৭ সালে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে প্রথমে লাহোরের
নৌশরাতে চলে যান। সেখানে তিন মাস ট্রেনিং নেওয়ার পর তিনি করাচি সেনানিবাসে চলে যান। ১৯১৭ সাল
থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত তিনি সেনা বিভাগে চাকরি করেন এবং হাবিলদার পদে উন্নীত হন। সৈনিক জীবনের
কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেও নজরুলের সাহিত্য চর্চা থেমে থাকেনি বরং প্রকৃত সাহিত্যচর্চা এখানেই
শুরু হয়। তাঁর প্রথম গল্প 'বাউন্ডুলের আত্মকাহিনি', প্রথম কবিতা 'মুক্তি' এখানেই রচিত হয়। এই সময় তাঁর
পরিচয় ঘটে এক পাঞ্জাবি মৌলভী সাহেবের সাথে। তিনি ফারসি সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন। পূর্বে নজরুলের
ফারসি জানা থাকার কারণে মৌলভি সাহেবের কাছে বিখ্যাত পারস্য কবিদের অমূল্য কাব্যগ্রন্থ পাঠের সুযোগ
পান। পরবর্তীকালে নজরুল হাফিজের গজল ও রুবাইয়াত এর অনুবাদ করেন এবং ১৯৩০ সালে অনুবাদগুলো
পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।

যুদ্ধের পর বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া হলো। নজরুল সোজা চলে এলেন কোলকাতায় বন্ধু শৈলজানন্দ
মুখোপাধ্যায় এর বাড়িতে। পরে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে চলে আসেন এবং সমিতির সার্বক্ষণিক
কর্মী মুজাফফর আহমদকে বন্ধু এবং একমাত্র সাথি হিসেবে পান। প্রকৃতপক্ষে এখানেই নজরুলের সাহিত্যিক
জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। তৎকালীন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নজরুলের কবিতা, গান, গল্প, প্রবন্ধ
একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে। এই সময় কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত দৌলতপুর গ্রামের আলি আকবর খান
নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তার আলাপ হয় এবং তার অনুরোধে হঠাৎ করে কুমিল্লা এসে হাজির হন। সেটা
ছিল ১৯২১ সালের এপ্রিল ১৩২৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে। সেখানে কয়েক মাস থাকার পর ১৩২৮ সালে ৩ আষাঢ়
১৯২১ সালের ১৭ জুন শুক্রবার আলি আকবর খান সাহেবের ভাগ্নী নার্গিস আসার খানমের সঙ্গে তার বিবাহ
সম্পন্ন হয়। কিন্তু এই বিবাহ আদৌ সুখের হয়নি। এমনকি বিয়ের দিনগত রাত্রেই কবি দৌলতপুর ত্যাগ করে
কুমিল্লা চলে আসেন। সেখানে বিখ্যাত সেনগুপ্ত পরিবারে তিনি অত্যন্ত আদরের সাথে কিছুদিন বাস করেন।
তারপর নজরুলের অকৃত্রিম বন্ধু মুজাফ্ফর আহমদ তাঁকে কোলকাতা ফিরিয়ে নিয়ে যান এবং তালতলা লেনের
এক বাড়িতে বসবাস শুরু করেন, সেখানেই লিখেছিলেন তাঁর চিরস্মরণীয় কবিতা 'বিদ্রোহী'। ১৩২৮ সালের
কার্তিক সংখ্যা মোসলেম ভারত পত্রিকায় কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কিন্তু জনসমক্ষে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়
১৩২৮ সালের ২২ পৌষ ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি 'সাপ্তাহিক বিজলী'র মাধ্যমে। কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার
সঙ্গে সঙ্গে সুধীমহলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এবং সারা বাংলায় তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বাইশ বছর বয়সের এক
তরুণের পক্ষে এমন বলিষ্ঠ কবিতা লেখা সত্যিই অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

নজরুল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনার ও সাংবাদিকতার কাজ
করেন। যেমন– দৈনিক নবযুগ, সেবক এবং মোহাম্মদীতে সাংবাদিকতা ও 'ধূমকেতু', 'লাঙল' 'গণবাণী'
ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে 'ধূমকেতু' পত্রিকা সে সময়ে ইংরেজ বিরোধী
আন্দোলনে বাঙালি তথা ভারতবাসীদের ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৯২২ সালের ধূমকেতু পূজা সংখ্যায়
নজরুলের কবিতা 'আনন্দময়ীর আগমনে' প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি এবং ধূমকেতু' ইংরেজ সরকারের
কোপানলে পড়ে এবং উক্ত সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। শুধু তাই নয় উক্ত অপরাধে নজরুলকে গ্রেপ্তার করে
কারাগারে পাঠানো হয়। হুগলী জেলে থাকাকালে রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর অমানুষিক ব্যবহারের প্রতিবাদে
নজরুল ৩৯ (ঊনচল্লিশ) দিন অনশন ধর্মঘট করেন। এই অনশনের পর নজরুলের খ্যাতি আরও বেড়ে যায়।
এই সময় ১০ মাঘ ১৩২৯ বঙ্গাব্দ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'বসন্ত' নাটকটি কবি নজরুলের নামে উৎসর্গ
করেন।

তারপর ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ১২ বৈশাখ অনুযায়ী ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল কুমিল্লার গিরীবালা দেবীর কন্যা প্রমীলা
সেনগুপ্তকে বিবাহ করেন। সাহিত্য ও সংগীতের মাধ্যমে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করার জন্য নজরুল সম
দেশবাসীকে ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আজীবন দারিদ্র্য আর প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও তিনি শোষণ,
অত্যাচার, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তৎকালীন কোলকাতায় হিন্দু মুসলিম লাগার সময়
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নজরুল সক্রিয়ভাবে লেখনী ধরেন। রচনা করেছেন অসংখ্য মানবতাবাদী
অসাম্প্রদায়িক গান ।

কবি নজরুল হুগলীতে থাকাকালে তার প্রথম পুত্র আজাদ কামালের জন্য হয়। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তার
অকাল মৃত্যু ঘটে। এরপর ১৯২৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের জন্ম হয় কৃষ্ণনগরে এবং তার
নামানুসারে তার সংগীত গ্রন্থের নামকরণ করেন 'বুলবুল'। এই সময় নজরুল গজল গান রচনায় মেতে ওঠেন
এবং বেশকিছু অসাধারণ গজল গান রচনা করেন।

নজরুলের যশখ্যাতি যেমনভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল সে তুলনায় মোটেও তার অর্থ প্রাপ্তি ঘটেনি। এর
কারণ হয়ত তার শিশুর মতো সরল মন। অনেকেই তাকে ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করেছেন কিন্তু তিনি তার
সামান্যই ভোগ করতে পেরেছেন। এই নিদারুণ অর্থ কষ্টের ভিতর ১৯৩৭ সালের ২৪ বৈশাখ ইংরেজি ১৯৩০
সালের ৭ মে বুধবার পুত্র বুলবুল বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এই মৃত্যু কবির মনে গভীর ক্ষত।
সৃষ্টি করেছিল। তিনি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন। এই অশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি এক
আধ্যাত্মিক গৃহযোগী বরোদাচরণ গুপ্তের সান্নিধ্যে আসেন। কিছুদিন নির্বাসিত জীবন যাপন করার পর তিনি
মানসিক শান্তি লাভ করেন। তাঁর বিশৃঙ্খল জীবনে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। এই সময়ে নজরুল বেশকিছু অসাধারণ
শ্যামাসংগীত ও ভক্তিগীতি রচনা করেন।

তার অসাধারণ কাব্যগ্রন্থের ভিতর কয়েকটির নাম: ব্যথার দান, অগ্নিবীণা, যুগবাণী, দোলনচাপা, বিষের বাঁশি,
ভাঙার গান, রিক্তের বেদন, ঝিঙে ফুল, পূবের হাওয়া, ছায়ানট, সিন্ধু হিল্লোল, সর্বহারা, ফণি-মনসা, বাঁধনহারা,
জিঞ্জির, বুলবুল, চক্রবাক, সন্ধ্যা, প্রলয় শিখা, কুহেলিকা ইত্যাদি। ১৯২৮ সালে নজরুল গ্রামোফোন রেকর্ড
কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হন। এসময় কবি সংগীত চর্চা ও গবেষণায় মগ্ন হয়ে যান।

তিনি ছায়াছবি ও রঙ্গমঞ্চের সাথেও যুক্ত হন এবং কয়েকটি ছায়াছবিতেও অভিনয় করেন। আলেয়া, বিদ্যাপতি,
সাপুড়ে, মহুয়া প্রভৃতিতে গীত রচনা, সুর ও সংগীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৭ সাল থেকে
১৯৪২ সাল পর্যন্ত কবি বেতারের সঙ্গে যুক্ত থেকে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান উপহার দেন। ১৯৪০ সালের
দিকে কোলকাতা বেতার থেকে 'হারামণি ও নবরাগমালিকা' নামে দুইটি অনুষ্ঠান তার পরিকল্পনা ও
পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হতো এবং প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

১৯৪০ সালের শেষের দিকে কবি অনুভব করেছিলেন তার অসুস্থতার কথা। এর কিছুদিন পর তার স্ত্রী প্রমীলা
নজরুল পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। এই সময়টি নজরুলের জীবনে সবচেয়ে দুঃসময় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
নিদারুণ অর্থকষ্ট, স্ত্রীর অসুস্থতা কবিকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল। এই দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণা বোধহয় আর সহ্য
করতে পারেননি কবি। ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি নির্বাক হয়ে
গেলেন। কিন্তু তাঁর চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। প্রায় দশ বৎসর পর ১৯৫২ সালের ২৭ জুন নজরুল
সমিতি গঠিত হয়।

কবিকে প্রথমে রাঁচি সেন্ট্রাল হাসপাতালে পাঠিয়ে কিছুদিন চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু কোনো সুফল পাওয়া
যায়নি। শেষে ১৯৫৩ সালের ১০ মে সন্ত্রীক কবিকে লন্ডন পাঠানো হয়। তারপর ভিয়েনা। সেখানকার
ডাক্তারগণ কবির অসুস্থতা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে আরোগ্য লাভের কোনো আশা বলে নেই অভিমত প্রকাশ
করেন। ফলে ১৫ ডিসেম্বর কবিকে পুনরায় কোলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়।

কবি নির্বাক হয়ে যাওয়ার পর ১৯৪৫ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে 'জগত্তারিণী" পুরস্কারে ভূষিত
করে। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার 'পদ্মভূষণ' উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
সম্মানসূচক 'ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করে।

কবি পত্নী প্রমীলা নজরুল ১৯৬২ সালের ৩০ জুন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলাদেশ
প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক চেষ্টায় ভারত সরকার এই লোকপ্রিয় কবিকে
বাংলাদেশে নিয়ে আসার অনুমতি দেন। তারপর ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে ঢাকা আনা হয় এবং ২৫ মে
দেশব্যাপী বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কবির ৭৩তম জন্মদিন পালন করা হয়। বাংলাদেশ সরকার,
দেশের সকল মানুষ তাঁকে রাজকীয় সম্মানে ভূষিত করলেন। অপরিসীম শ্রদ্ধায় সরকার ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি
মাসে কবিকে নাগরিকত্ব প্রদান করেন এবং দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত করেন। এছাড়াও
১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। বাংলাদেশ সরকার ও
বাংলাদেশের মানুষ তাকে আমাদের জাতীয় কবির মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯
আগস্ট ১৩৮৩ বাং সালের ১২ ভাদ্র রবিবার তৎকালীন ঢাকা পিজি হাসপাতালে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে
পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।

কাজী নজরুল ইসলামের সংগীত জীবন

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুণিজনের সাহচর্যে আসেন এবং সংগীত চর্চা করেন। কিশোর
বয়সে অর্থের প্রয়োজনে লেটো দলে যোগ দিয়ে দলপতির কাছে গান শিখে আবার অন্যদের শিক্ষা দিতেন। তাঁর
প্রতিভা ও অনুশীলনের ফলে অভ্যন্ত কম সময়ের মধ্যে তিনি লেটো দলের দলপতির পদে উন্নীত হয়ে
দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি হারমোনিয়াম, বাঁশি ও তবলা বাদনে সবিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
তারপর শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালীন উক্ত স্কুল শিক্ষক শ্রী সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলালের কাছে
শাস্ত্রীয়সংগীতের তালিম নেন। এছাড়াও কবি মুর্শিদাবাদের তৎকালীন প্রখ্যাত ওস্তাদ কাদের বক্স এবং মঞ্জু
সাহেবের কাছে শাস্ত্রীয়সংগীতের তালিম নেন। চুঁচুড়ার প্রখ্যাত সেতার বাদক প্রকৃতি গঙ্গোপাধ্যায়-এর কাছে
কিছুদিন সেতার শেখেন। এছাড়া নজরুল বিশেষভাবে শাস্ত্রীয়সংগীতের তালিম নেন তৎকালীন প্রখ্যাত
সংগীতগুণি গ্রামোফোন কোম্পানির সংগীত প্রশিক্ষক ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁর কাছে। নজরুলের সংগীত চর্চা ও
গবেষণা বাংলাগানের ভাণ্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়।

বাংলায় গজল গান ও ইসলামি সংগীতের তিনিই প্রবর্তক। প্রচলিত ও লুপ্তপ্রায় রাগ-রাগিণীর চর্চা ছাড়াও তিনি
বেশ কয়েকটি রাগ সৃষ্টি করেন। তিনি প্রাচীন কয়েকটি ছন্দের প্রচলন ও নবনন্দন নামে একটি ভাল সৃষ্টি করেন।
কবিসৃষ্ট কয়েকটি রাগের নাম এখানে উল্লেখ করা হলো। যেমন: রাগ - বেণুকা, উদাসী ভৈরব, অরুণভৈরব,
সন্ধ্যামালতী, বনকুন্তলা, নির্ঝরিণী, অরুণরঞ্জণী, দোলনচাঁপা, আশাভৈরবী ইত্যাদি। নজরুল যে সকল সংস্কৃত
ছন্দ তাঁর গানে ব্যবহার করেছেন সেগুলো হলো: প্রিয়া (৭ মাত্রা) মনিমালা (২০ মাত্রা) মঞ্জুভাষিণী (১৮ মাত্রা)
স্বাগত (১৬ মাত্রা)।

বাংলাগানে কবি নজরুল যে অবদান রেখে গেছেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাগানের এমন কোনো
শাখা নেই যেখানে কবির বিচরণ ছিল না। ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরি, কাজরি, গজল, দেশাত্মবোধক, হাসির
গান, ইসলামি, জাগরণী, ভাটিয়ালি, ছাত্রদলের গান, মার্চ সংগীত, শ্যামা সংগীত, ঝুমুর, কীর্তন, বাউল, ভজন
সকল পর্যায়ের গান রচনা করে কবি বাংলাগানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন। নজরুল তিন হাজারেরও
অধিক গান রচনা করে গেছেন। এককভাবে কোনো গীতিকবি ও সুরকারও এত বিপুল সংখ্যক গান রচনা
করেননি। বাংলাগানের ইতিহাসে নজরুলের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরদিন।

তানসেন

সংগীত জগতে নানা অলৌকিক কাহিনি এবং অসামান্য অবদানের জন্য যিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি হলেন
সংগীতসম্রাট তানসেন। এত বড়ো একজন সংগীতগুণি সম্বন্ধে তাই নানা রঙের নানা গল্প এবং নানা বিতর্ক
থাকাও কিছু অস্বাভাবিক নয়। তথাপি অধিকাংশের সমর্থিত মতে জানা যায় যে, গোয়ালিয়রের কাছে 'বিহট'
নামক গ্রামে ১৫২০ খ্রিষ্টাব্দে এক ব্রাহ্মণ বংশে মকরন্দ পাণ্ডের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন তানসেন। প্রথম জীবনে
তার নাম ছিল রামতনু। মহম্মদ গৌসের পরামর্শে পরে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হন এবং গোয়ালিয়রেই
স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।

বালক রামতনুর অপূর্ব কন্ঠস্বর ও সংগীতের অসামান্য মেধার পরিচয় পেয়ে সংগীতজ্ঞ মাতুল গদাধর মিশ্র
তাঁকে খুবই আগ্রহ ভরে গান শেখাতে শুরু করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রামতনুর সংগীতের কৃতিত্বের কথা
চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে বৃন্দাবনের প্রসিদ্ধ হরিদাস স্বামীর সাক্ষাৎ পান রামতনু এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ
করেন। গুরুকে মান্য করে কিছু গানও তিনি রচনা করেছিলেন, যা আজও গ্রন্থের পাতায় তার গুরুভক্তির স্বাক্ষর
বহন করছে। কারো কারো মতে, গোয়ালিয়রের রাজা মানসিংহ তোমরের পত্নী মৃগনয়নীর কাছে তানসেনের
প্রথম সংগীত শিক্ষা ঘটে। কিন্তু অধিকাংশের মতে তানসেনের জন্মের পূর্বেই পাঠানের হাতে মানসিংহের মৃত্যু
ও গোয়ালিয়রের পতন ঘটায় মৃগনয়নীর অস্তিত্বের কথাই জানা যায় না। সুতরাং তাঁর কাছে সংগীত শিক্ষার
প্রশ্নই ওঠে না। হরিদাস স্বামীর পরে গোয়ালিয়রের মহম্মদ গৌসের কাছেও তিনি সংগীত শিক্ষা করেন, যিনি
পারস্যের সংগীতধারার বাহক। মনে হয় সেইজন্যেই তানসেনের মধ্যে ভারতীয় ও পারস্য উভয় সংগীতধারার
সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে সম্পূর্ণ নতুন সাংগীতিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত 'সেনী ঘরানা'।

১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বান্ধবগড়ের রাজা রামচাঁদের দরবারে ছত্রিশ বছর বয়সে তানসেন শ্রেষ্ঠ গায়কের পদে
অধিষ্ঠিত হন । রামচাদের সুমিষ্ট ব্যবহারে বিগলিত হয়ে তানসেন চৌতালে দরবারী কানাড়া রাগে যে গান রচনা
করেন তার স্থায়ীতে তিনি বলেন 'রাজা রামগুণ নিধান, আর আভোগে বলেন 'তানসেন কহত যুগযুগ জিয়ো
জিয়ো।' দিল্লীর সম্রাট আকবরের অভিপ্রায়ে ১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দে তানসেন প্রিয় রাজ্য, নিজ স্ত্রী-পুত্র প্রভৃতিকে ছেড়ে
মনে পরম বেদনা নিয়ে আগ্রায় সম্রাটের দরবারে চলে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু আগ্রায় গিয়ে ভাঙা মন নিয়ে
তানসেন প্রথমে কিছুতেই নিজেকে গানের মধ্যে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করতে পারতেন না। সম্রাট আকবর তার
প্রাণের আবেদনহীন গান শুনে ভাবেন এই কি রাজা রামচাদের দরবারের বহু বিশ্রুত শ্রেষ্ঠ রত্ন। হঠাৎ সম্রাটের
মনে কী ভাবের যেন উদয় হয়। হারেমের অপরূপ সুন্দরী ও মধুময় কন্ঠের অধিকারিণী মেহেরউন্নিসাকে গান
শেখাবার দায়িত্ব সম্রাট তানসেনকে অপর্ণ করেন। তানসেনের জীবনে দেখা দেয় নতুন অধ্যায়। গানের সুর
ক্রমে ক্রমে দুটি প্রাণের সুরকে একাত্ম করে ফেলে। তানসেন রূপান্তরিত হয়ে যান মেহেরউন্নিসার স্বামীরূপে।

 

 

 

Content added || updated By

বীণা তত বাদ্যযন্ত্র। ভত যন্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে বীণা অতি প্রাচীন। বীশা যন্ত্রটি প্রস্তুত করতে কয়েক খণ্ড কাঠ, দুইটি
লাউ, কিছু তার, সেলুলয়েড, সুতো আর হাড়ের প্রয়োজন। পূর্বে কাঠের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহৃত হতো। দুই বা
আড়াই ইঞ্চি চওড়া কাঠ বা বাঁশের মঞ্চের সঙ্গে দুইটি লাউ সংযুক্ত করা হয়। লাউ দুইটি গোল। বীণাতে খোল
থেকে বাইশটি সারিকা পটরীর বুকে মুগা সুতো দিয়ে বাঁধা থাকে। এই যন্ত্রে সাতটি তার ব্যবহৃত হয়।

চিত্ৰ: বীণা

সারিকার উপরিভাগে হাড়ের তৈরি ভারপহণের ওপর বাজাবার প্রধান চারটি তার সংযোজিত হয়। বাকী তিনটি
তার চিকারীর। বাঁধার নিচের অংশে কাঠের দতে এই ভারগুলো লাগাবার ব্যবস্থা করা হয়। সাতটি কাঠের তৈরি
বয়লাতে এই ভারগুলো লাগানো থাকে। সাতটি বয়লার মধ্যে পাঁচটি বীপার উপরের দিকে কাঠের দক্ষের
দুইপাশে আটকানো হয় এবং বাকী দুইটি বয়লা লাউরের মধ্যখানে একটা সমান দূরত্ব রেখে আটকানো হয়।
বাজাবার সময় বীণার একটি লাউ বা কাঁধের ওপর এবং আরেকটি লাউ উরুতে রাখতে হয়। বাঁ হাতের আঙ্গুল
দিয়ে তার চেপে ডান হাতের আঙুলে মিজৱাব লাগিয়ে তারে আঘাত করে বীণা বাজাবার নিয়ম।

তানপুরা

তানপুরা জাতীয় যন্ত্র। তানপুরার আদি নাম তামুরা। তারা একটি অতি প্রাচীন যন্ত্র। তানপুরা যন্ত্রটি
গঠন প্রকৃতি সহজ ও সাধারণ। একটি গোলাকার শুকনো পাউরের সঙ্গে খোদাই করা একটি কাঠের খণ্ড জোড়া
লাগানো হয়। এই লম্বা কাষ্ঠ খণ্ডকে বলা হয় দত। দক্ষের আকৃতি অর্ধগোলাকার। এই দলের ওপর আরেকটি

-

অর্থপোলাকার কাজপত যুক্ত করা হয়। পরের অর্থ গোলাকৃতি কাঠখণ্ডটিকে বলা হয় পটরী। লাউরের ওপর
একটি কাঠের তরুনীর আচ্ছাদন লাগানো হয়। তরুণীর আকৃতিও ঈষৎ গোলাকার। লাউরের নিম্নাংশে একটি
হাজেরা লেংকট লাগানো হয়। অবলীর ওপর একটি কাঠের যা হাড়ের তৈরি সোয়ারী স্থাপন করা হয়। তানপুরার
মাথার দিকে দুইটি তারগহন পটরীর সঙ্গে যুক্ত থাকে। দক্ষের দুইপাশে পটরীর মাথার দিকে দুইটি কাঠের গোল
বয়না লাগানো হয়। বরলাতে তার আবদ্ধ থাকে। তানপুরাতে সাধারণত চারটি তার ব্যবহৃত হয়। সুর
মেলানোর জন্য প্রতিটি ভারে মেনকা সংযোজন করা হয়।

এটি একটি প্রাচীন লোক বাদ্যযন্ত্র। শুধুমাত্র বাংলাদেশ এবং ভারতেই এই বস্তুটি প্রচলিত। এর আকৃতি
অনেকটা মৃদঙ্গ বা পাশওয়াজের মতো। তবে খোলটি কাঠের না মাটির তৈরি। তাই এর আওয়াজ আলাদা।
খোলের উত্তর দিকের মুখ দুটো পাখখরাজের চেরে কিছুটা খাটো। মোচাকৃতি লম্বা গোলের উত্তর মুখে চামড়ার
ছাউনি থাকে এবং ছাউনির মাঝখানে গানের ভাগ্নি লাগানো হয়। গোলের ডানমুখ ছোটো এবং বারাসুখ
অপেক্ষাকৃষ্ণ বড়ো। ফিতার সাহায্যে গলায় ঝুলিয়ে অথবা মাটিতে রেখে খালি হাতে বাজানো হয়। কীর্তন
মনিপুরী নৃত্যের সঙ্গে খোগ বাজানো হয়। এছাড়াও রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীতেও শ্রীখোল ব্যবহৃত হয়।

চিত্রা গ্রীখোল

বাংলা ঢোল

বাংলা ঢোল বাংলার নিজস্ব বাদ্য। নলাকৃতি দুইমুখো ভালবাদ্য কে বলা হয় ঢোল। এর উভয় পায়েই আছে
ছাউনী। বাদ্যটির বৈশিষ্ট্য হলো যে- এর চামড়ার ছাউনীতে কালো গাব নেই। সাধারণভাবে দড়ির সাহায্যে
বাদ্যটি পলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সভায়মান অবস্থায় এই ঢোল বাজানো হয়। এক হাতে ক্ষুদ্র কাঠির সাহায্যে
অন্য হাতের আঙ্গুল যারা ঢোলের ছাউনীতে আঘাত করা হয়। অনেক সময় তুলিয়া দুই হাতেই কাঠি নিয়ে।
চোলের একদিকে ছাউনীতে আঘাত করে। বাংলার বিভিন্ন উৎসবে এই লোকবাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয়ে থাকে।

অনুশীলনী

রচনামূলক প্রশ্ন

১। সংক্ষেপে বাংলাগানের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা কর।

২। লোকসংগীতের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য লেখ।

৩। বীণা কী জাতীয় বাদ্যযন্ত্র? বীণার বর্ণনা দাও।

৪। চিত্রসহ তানপুরার বর্ণনা দাও।

৫। শ্রীখোল-এর বর্ণনা দাও।

৬। বাংলা ঢোলের সচিত্র পরিচিতি লেখ।

৭। লালন শাহের জীবন সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখ ।

৮। লালনের জীবনে সিরাজ শাহের অবদান মূল্যায়ন কর।
৯। বাংলাগানে লালনগীতির গুরুত্ব কতখানি? ব্যাখ্যা কর।

১০। লালনের ছেউড়িয়া জীবনের বিশদ বিবরণ দাও।
১১। লালনের গানের মূল ভাবগুলো বুঝিয়ে লেখ।

১২। বাংলাগানে রবীন্দ্রনাথের অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত লেখ।

১৩। রবীন্দ্রনাথ কীভাবে সংগীতের শিক্ষা লাভ করেছেন লেখ।
১৪। রবীন্দ্রসংগীতের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা কর।

১৫। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সংস্কৃতি ধারা কীভাবে প্রবর্তন করেন লেখ।
১৬। হাছন রাজার জীবনী সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখ ।

১৭। বাংলাগানের ক্ষেত্রে হাছন রাজার অবদান আলোচনা কর।

১৮। উদাহরণসহ হাছন রাজার গানের ধারাগুলোর মূলভাব ব্যক্ত কর ।

১৯। ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ-র সংগীত জীবন আলোচনা কর।

২০। ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ-র গায়ন বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা কর।

২১। সংগীতের প্রচার ও প্রসারে ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ-র অবদান লেখ।

২২। আব্দুল করিম খাঁ বিভিন্ন সময়ে যেসব উপহার ও সম্মান পান সেসব সম্বন্ধে বর্ণনা কর।
২৩। নজরুলের শৈশব জীবন সম্পর্কে লেখ।

২৪। নজরুলের জীবনী বিস্তারিতভাবে আলোচনা কর।

২৫। নজরুলের সংগীত জীবন সম্পর্কে লেখ এবং বাংলাগানে তাঁর অবদান মূল্যায়ন কর।

২৬। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের অবদান লেখ।
২৭। রামনিধি ও টপ্পা গান সম্পর্কে আলোচনা কর।

২৮। তানসেনের জীবনী আলোচনা কর।

২৯। কমল দাশগুপ্ত সম্পর্কে যা জানো লেখ।

সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন

১। লালন শাহ করে জন্মগ্রহণ করেন। তার বংশ পরিচয় দাও।

২। লালনের শৈশবকাল কীভাবে কাটে?

৩। লালন কখন গুটি বসন্তে আক্রান্ত হ

৪। বসন্ত রোগে আক্রান্ত লালন কীভাবে আরোগ্য লাভ করেন?

৫। মলম কারিগর কেন তার বসতবাড়ি ও জায়গাজমি লালনকে লিখে দিয়েছিলেন?

৬। চটকা গান কী?

৭। গম্ভীরা গান সম্পর্কে সংক্ষেপে যা জানো লেখ।

৮। আলকাপ গান সম্পর্কে সংক্ষেপে যা জানো লেখ।

৯। উদাহরণসহ বিয়ের গানের বর্ণনা দাও।

১০। ভাদু গান কী?

১১। লালন কীভাবে সংগীত রচনা করতেন এবং কীভাবে তা সংরক্ষিত হতো?

১২। রবীন্দ্রনাথ লালনের মূল্যায়ন করেছিলেন কীভাবে?

১৩। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গীতিনাট্য এবং নৃত্যনাট্যের নাম লেখ।

১৪। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট তালগুলোর নাম লেখ।

১৫। রবীন্দ্রনাথের সংগীত শিক্ষা গুরুদের নাম উল্লেখ কর।

১৬। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানের কোনো যোগ আছে কী?

১৭। রবীন্দ্রনাথের গানে কত ধরনের সুর ব্যবহৃত হয়েছে?
১৮। হাছন রাজা কবে, কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?

১৯। হাছন রাজা স্রষ্টাকে তাঁর গানে কী বলে অভিহিত করেছেন?

২০। হাছন রাজা রচিত গানের সংখ্যা কত? কোন গ্রন্থে গানগুলো প্রকাশিত হয়?

২১। হাছন রাজা কীভাবে গান রচনা করতেন?

২২। হাছন রাজার বংশধরদের মধ্যে কে কে গান লিখতেন?

২৩। 'হাছন রাজার সৌখিন বাহার' গ্রন্থটিতে কী কী বিষয় স্থান পেয়েছে?

২৪। ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ শৈশবে যেসব বাদ্যযন্ত্র বাদনে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন সেগুলোর নাম লেখ।

২৫। ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ-র শিষ্যদের নাম লেখ।

২৬। লেটো গান কী?

২৭। নজরুলের পাঁচটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখ।
২৮। নজরুল কী কী পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন‍

২৯। নজরুলের কয়েকজন সংগীত গুরুর নাম লেখ।
৩০। নজরুল সৃষ্ট পাঁচটি রাগের নাম লেখ।

৩১। নজরুল সৃষ্ট পাঁচটি তালের নাম লেখ।

৩২। নজরুল কত সালে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং কত সালে তাঁর বিদ্রোহী' কবিতা প্রকাশিত হয়?
৩৩। কী অপরাধে এবং কত সালে নজরুলকে কারাগারে পাঠানো হয়?

৩৪। নজরুল কত সালে গ্রামোফোন কোম্পানি যোগ দেন এবং তাঁর গানের সংখ্যা কত?

৩৫। কবিগান কী?

৩৬। ব্রহ্মসংগীত সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

 

 

 

 

 

 

 

Content added || updated By

আরও দেখুন...