SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইসলাম শিক্ষা - Islamic Study - আদর্শ জীবন চরিত | NCTB BOOK

হযরত মুহাম্মাদ (সা.) 

(মক্কা বিজয় থেকে ওফাত পর্যন্ত)

জোড়ায় কাজ

'হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর জীবনীর স্মৃতিচারণ'

উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে পূর্বের শ্রেণিতে পঠিত হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনাদর্শ থেকে তুমি কী কী জেনেছো তা তোমার সহপাঠীর সাথে আলোচনা করে একটি তালিকা প্রস্তুত করো।

খায়বর বিজয়

খায়বার মদিনা থেকে ৮০ মাইল দূরের একটি বসতির নাম। মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মদিনা থেকে বহিষ্কৃত ইহুদিরা খায়বর নামক স্থানে বসবাস করছিল। বহিষ্কারের পরও তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। তারা মহানবি (সা.)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। তারা বনু গাতফান ও বেদুইনদের সঙ্গে মিলিত হয়ে মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এমনকি মুসলমানদের আক্রমণ করার জন্য তারা চার হাজার সৈন্য প্রস্তুত করে। মহানবি (সা.) তাদের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে সপ্তম হিজরিতে ১৬০০ জন সৈন্য নিয়ে খায়বরে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাদেরকে পরাজিত করেন। পরাজয়ের পরও মহানবি (সা.) তাদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ না করে নিরাপত্তা কর প্রদানের বিনিময়ে তাদের ক্ষমা করে দিলেন। তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দিলেন এবং তাদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা প্রদান করলেন। বিজিত অঞ্চলে মহত্ত্বের এরূপ উদাহরণ ইতিহাসে বিরল।

মুতার যুদ্ধ

৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সামন্তরাজ শুরাহবিল সিরিয়া সীমান্তে মুতা নামক স্থানে একজন মুসলিম রাজদূতকে হত্যা করে। বাধ্য হয়ে মহানবি (সা.) যায়েদ বিন হারেসের নেতৃত্বে ৩০০০ মুসলিম সৈন্যের একটি দল মুতা অভিমুখে প্রেরণ করেন। মুতা নামক স্থানে মুসলিম সৈন্যরা লক্ষাধিক রোমান সৈন্যের মুখোমুখি হয়। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরপর তিনজন সেনাপতি যায়েদ, জাফর ও আব্দুল্লাহ শহিদ হন। এরপর মহাবীর খালিদ সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সাময়িকভাবে পশ্চাদপসরণের কৌশল অবলম্বন করেন। ইতোমধ্যে মহানবি (সা.) প্রেরিত সাহায্যকারী একটি সেনাদল মুতায় এসে পৌঁছে। এরপর সম্মিলিত মুসলিম বাহিনী প্রচণ্ড বিক্রমে শত্রুদের ওপর আঘাত হানে। ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এবং মুসলমানদের বিজয় অর্জিত হয়। মহানবি (সা.) এ যুদ্ধে সাহসী নেতৃত্বের জন্য খালিদ বিন ওয়ালিদকে সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তরবারি) উপাধিতে ভূষিত করেন।

মক্কা বিজয়

মক্কা বিজয়ের প্রেক্ষাপট

হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তানুসারে খুজা'আ সম্প্রদায় মহানবি (সা.)-এর সঙ্গে এবং বনু বকর সম্প্রদায় কুরাইশদের পক্ষে যোগদান করেছিল। কিন্তু সন্ধির দুই বছরের মধ্যেই কুরাইশরা হুদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করে। বনু বকর সম্প্রদায় কুরাইশদের সহায়তায় খুজা'আ সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে কয়েকজনকে হত্যা করে। মহানবি (সা.) হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তানুসারে তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। তিনি প্রথমে কুরাইশদের নিকট প্রস্তাব পাঠালেন যে-

১. হয় তোমরা খুজা'আ সম্প্রদায়কে উপযুক্ত অর্থ দিয়ে ক্ষতিপূরণ দাও। 

২. না হয়, বনু বকর গোত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করো। 

৩. না হয়, হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল বলে ঘোষণা করো।

কুরাইশরা শেষোক্ত প্রস্তাব মেনে হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল ঘোষণা করে। ফলে মহানবি (সা.) ১০ হাজার সাহাবি নিয়ে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা অভিযানে রওনা দেন। মুসলিম বাহিনী মক্কার অদূরে মার-উজ-জাহরান গিরি উপত্যকায় শিবির স্থাপন করে। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান দুজন সঙ্গী নিয়ে মুসলমানদের গতিবিধি লক্ষ করার জন্য মক্কার বাইরে আসে। এ সময় হযরত উমর ফারুক (রা.) আবু সুফিয়ানকে বন্দি করে মহানবি (সা.)-এর নিকট নিয়ে আসেন। মহানবি (সা.) তাঁর দীর্ঘদিনের শত্রুকে হত্যা করার সুযোগ পেয়েও ক্ষমা করে দিলেন। মহানবি (সা.)-এর এই মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কা বিজয়কালে মহানবি (সা.) ঘোষণা করেন, যে আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ। যে হাকিম ইন্ন হিযামের ঘরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ। যে ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘরে অবস্থান করবে, সেও নিরাপদ, যে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, সেও নিরাপদ।'

কোনো রক্তপাত না ঘটিয়ে সামান্য বাধা অতিক্রম করে মহানবি (সা.) বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন। বিজয়ের প্রাক্কালে মহানবি (সা.) সাহাবিগণের উদ্দেশে বলেন, মক্কার পশু-পাখি হত্যা করা যাবে না, গাছ কাটা যাবে না, ঘাস বা কোনো গাছ উপড়ে ফেলা যাবে না এবং অনুমতি ব্যতিরেকে কারো পড়ে থাকা জিনিস তুলে নিতে পারবে না।

এরপর মহানবি (সা.) অতীত অত্যাচার-নির্যাতনের কথা ভুলে গিয়ে মক্কাবাসীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বলেন, আজ তোমাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তোমরা যেতে পারো; তোমরা সবাই মুক্ত, স্বাধীন।

মক্কা বিজয়ের গুরুত্ব

মক্কা বিজয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। মক্কা বিজয়ের ফলে সমগ্র আরবে ইসলামের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। এ বিজয়ের ফলে আরবের বেদুইন গোত্রগুলো ইসলামের ছায়াতলে আসতে শুরু করে।

মক্কা বিজয় ছিল রক্তপাতহীন অতুলনীয় একটি বিজয়। মক্কার কাফিরদের নির্যাতনে নিষ্পেষিত হয়ে মুসলমানরা এক সময় মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু মক্কা বিজয়ে তারা অতীতের সকল অন্যায়-অত্যাচার ও কষ্ট ভুলে গিয়ে তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। তাই মক্কা বিজয়ের সময় কোনো হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ, নারী- শিশু নির্যাতন কিংবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি জবরদস্তিমূলক আচরণ সংঘটিত হয়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম রক্তপাতহীন বিজয়ের কোনো তুলনা নেই। এ বিজয়ের পর মক্কাবাসীকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে মহানবি (সা.) অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

মক্কা বিজয়ের ফলে বায়তুল্লাহর পবিত্রতা পুনরায় ফিরে আসে। পবিত্র কাবাগৃহে রক্ষিত ৩৬০টি মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়। এ সময় মহানবি (সা.) পবিত্র কুরআনের এই আয়াত তিলাওয়াত করতে থাকেন-

جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا 

অর্থ: 'সত্য সমাগত, আর মিথ্যা বিতাড়িত। মিথ্যার বিনাশ অনিবার্য।' (বনী ইসরাইল, আয়াত: ৮১)

এরপর হযরত বেলাল (রা.)-এর আযানের পর মহানবি (সা.) সমবেত মুসলমানদের নিয়ে নামায আদায় করলেন। এভাবে কাবাগৃহ থেকে চিরতরে পৌত্তলিকতার অবসান ঘটল।

হুনায়নের যুদ্ধ

মক্কা বিজয়ে পৌত্তলিকতার অবসান ঘটলেও কয়েকটি সম্প্রদায় তখনও ইসলামের বিরোধিতা করতে থাকে। তাদের মধ্যে মক্কার হাওয়াজিন ও সাকিফ গোত্র ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বেদুইনরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তাদের সম্মিলিত বাহিনী মুসলমানদের আক্রমণ করার জন্য ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে মক্কার নিকটবর্তী হুনায়ন নামক স্থানে সমবেত হয়। মহানবি (সা.) এ খবর জানতে পেরে ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে হুনায়ন অভিমুখে যাত্রা করেন। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

মুসলিম সৈন্যরা সংকীর্ণ পার্বত্য পথ অতিক্রমকালে সেখানে ওত পেতে থাকা বেদুইন সৈন্যরা তীর বর্ষণ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। মহানবি (সা.)-এর আহ্বানে মুসলিম সৈন্যরা পুনরায় একত্রিত হয়ে বীরবিক্রমে শত্রুদের উপর আক্রমণ করেন। মহান আল্লাহ এ যুদ্ধে ফেরেশতাগণের দ্বারা মুসলমানদের সাহায্য করেছিলেন। ফলে মুসলিম সৈন্যরা এ যুদ্ধে জয়লাভ করেন। বিপুল পরিমাণ গবাদি পশু, স্বর্ণ-রৌপ্য ও যুদ্ধ উপকরণ মুসলমানদের হস্তগত হয়। এছাড়া ৬০০০ শত্রু সেনাকে বন্দি করা হয়।

এ যুদ্ধে পরাজিত বিধর্মীরা তায়িফ দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে। মুসলিম সৈন্যরা তায়িফ দুর্গ অবরোধ করেন। তিন সপ্তাহ অবরোধের পর তায়িফবাসী আত্মসমর্পণ করে। মহানবি (সা.) তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের পরিবর্তে উদারতা ও মহানুভবতার আচরণ করলেন। তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। মহানবি (সা.)-এর মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে তায়িফবাসী ইসলাম গ্রহণ করলেন।

হুনায়ুনের যুদ্ধের তাৎপর্য

হুনায়নের যুদ্ধ মুসলমানদের জন্য এক বিরাট শিক্ষা। এ যুদ্ধে নিজেদের সংখ্যাধিক্যে মুসলমানরা গর্বিত হয়ে পড়ে এবং শত্রু পক্ষকে অবজ্ঞা করতে থাকে। ফলে শত্রুপক্ষের অতর্কিত হামলায় তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পরাজয়ের মুখে মহান আল্লাহর সাহায্য এবং মহানবি (সা.)-এর দৃঢ় নেতৃত্বে শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা বিজয়ী হয়। এ যুদ্ধে মহান আল্লাহ ফেরেশতা নাযিল করে মুসলমানদের সাহায্য করেছিলেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন অসংখ্য ক্ষেত্রে এবং হুনায়ন যুদ্ধের দিন। যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিল। কিন্তু তা তোমাদের কোনো কাজে আসেনি এবং অনেক বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী তোমাদের জন্য সংকুচিত হয়েছিল। এরপর তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে। এরপর আল্লাহ তাঁর রাসুল এবং মু'মিনদের উপর প্রশান্তি নাযিল করেন এবং এমন এক সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি এবং তিনি তাদের দ্বারা কাফিরদের শাস্তি প্রদান করেন এবং এটাই কাফিরদের কর্মফল।' (সূরা তাওবা, আয়াত: ২৫-২৬)

হুনায়নের যুদ্ধের গুরুত্ব

হুনায়নের যুদ্ধে বিজয় মুসলমানদের এক অজেয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করল। এ যুদ্ধে জয়লাভের ফলে বিপুলসংখ্যক অমুসলিম মহানবি (সা.)-এর আনুগত্য স্বীকারে আগ্রহী হলো। ইসলামের চিরশত্রু বনু বকর ও বনু হাওয়াযিন গোত্রও ইসলাম গ্রহণ করল। এতে মহানবি (সা.)-এর প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায় এবং তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অবাধ কর্তৃত্বের অধিকারী হন। এ সময় হতেই মদিনার প্রশাসনিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। মদিনার ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত হয় এবং এটি একটি আন্তর্জাতিক নগরীর মর্যাদা লাভ করে।

তাবুক অভিযান

তাবুক অভিযান নবম হিজরির উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মহানবি (সা.)-এর নেতৃত্বে মক্কা, তায়িফ ও হুনায়নে ইসলামের বিজয় সূচিত হলে বাইজান্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। মুতার যুদ্ধে খ্রিষ্টানরা পরাজিত হলে তার ঈর্ষা শতগুণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া আরব ইহুদিদের উস্কানি রোম সম্রাটের প্রতিশোধস্পৃহাকে তীব্রতর করে তোলে। ফলে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে রোম সম্রাট প্রায় লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে মদিনা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়।

হিরাক্লিয়াসের অভিযানের কথা জানতে পেরে সে বাহিনীর আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য মহানবি (সা.) ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে তাবুক অভিমুখে রওনা দেন। রোমান সৈনিকরা মুসলমানদের ব্যাপক প্রতিরোধ আয়োজনের সংবাদ পেয়ে পশ্চাদপসরণ করে। মহানবি (সা.) কয়েক দিন সেখানে অপেক্ষা করে মদিনায় ফিরে এলেন। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপ ও অসহ্য পানির কষ্টের মধ্য দিয়ে এ অভিযান পরিচালিত হয়েছিল বলে ইতিহাসে তা 'গাজওয়াতুল উসরা' বা কষ্টের যুদ্ধ নামে পরিচিত।

তাবুক অভিযানের পর ওমান, নাজরান, ইয়েমেন, বাহরাইন প্রভৃতি অঞ্চলের প্রতিনিধিরা এসে মহানবি (সা.) -এর আনুগত্য প্রকাশ করে। বনু তামিম, মুস্তালিক, কিনদা, আযদ, তায়ি প্রভৃতি গোত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।

বিদায় হজ

দশম হিজরিতে মহানবি (সা.) হজ পালনের ইচ্ছা করলেন। তিনি ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে লক্ষাধিক সাহাবি নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। এটা ছিল তাঁর জীবনের শেষ হজ। এজন্যই এই হজকে 'বিদায় হজ' বলা হয়। মহানবি (সা.) হজের কার্যক্রম সমাপ্ত করে আরাফার ময়দানে 'জাবালে রহমত' নামক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সমবেত মুসলমানরদের লক্ষ্য করে এক যুগান্তকারী ভাষণ প্রদান করেন। এ ভাষণে তিনি একটি আদর্শ মুসলিম সমাজের চিত্র সবার সামনে তুলে ধরেন। প্রাচীন রীতি-নীতি, সুদ প্রথা, শোষণ-নির্যাতন, নারীদের প্রতি অবিচার প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপের মূলে কুঠারাঘাত করেন। এটি মানবতার ইতিহাসে এক অনন্য ভাষণ।

মহানবি (সা.) তাঁর ভাষণের শুরুতে মহান আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপন করলেন। অতঃপর মানবমণ্ডলীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। জানি না, হয়তো আমি এ বছরের পর এখানে আর কখনো তোমাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারব না। হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এই দিন ও এই মাসের মতো পবিত্র, তোমাদের প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত। স্মরণ রেখো, তোমাদের একদিন আল্লাহর নিকট হাজির হতে হবে এবং তিনি তোমাদের কাজের হিসাব চাইবেন।

সাবধান, ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করো না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।

হে মানবমণ্ডলী! স্মরণ রেখো তোমাদের আল্লাহ এক, তোমাদের পিতা এক। সাবধান! কোনো আরবের ওপর অনারবের যেমন প্রাধান্য নেই, তেমনি অনারবের ওপর আরবের কোনো প্রাধান্য নেই। কোনো শ্বেতাঙ্গের ওপর যেমন কৃষ্ণাঙ্গের প্রাধান্য নেই, তেমনি কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গেরও কোনো প্রাধান্য নেই। পরস্পরের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে একমাত্র খোদাভীতি বা সৎকর্ম।

হে আমার অনুসারীরা, তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের যেরূপ অধিকার আছে, তোমাদের ওপরও তাদের সেরূপ অধিকার রয়েছে। তোমরা স্বীয় পত্নীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করো। নিশ্চয়ই আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছ এবং তাঁরই আদেশ মতো তাদেরকে তোমাদের জন্য বৈধ করে নিয়েছ।

দাসদাসীদের প্রতি সর্বদা সদয় ব্যবহার করো। তোমরা যা খাবে, তাদেরকেও তা-ই খাওয়াবে, যা পরবে, তাই পরাবে। যদি তারা কোনো অন্যায় করে এবং তা যদি তোমাদের নিকট অমার্জনীয় হয়, তবে তোমরা তাদেরকে পরিত্যাগ করো। কিন্তু তাদের সঙ্গে কর্কশ ব্যবহার করো না। কারণ, তারাও আল্লাহর সৃষ্টি এবং তোমাদের মতোই মানুষ। অন্ধকার যুগের সকল রক্ত (রক্তের প্রতিশোধ) বাতিল করা হলো। আর সর্বপ্রথমে আমি আমার বংশের রাবিয়া ইবনে হারিসের রক্তের প্রতিশোধ বাতিল ঘোষণা করলাম। অন্ধকার যুগের সকল সুদ বাতিল করা হলো। সবার আগে আমার গোত্রের আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের সকল সুদ আজ আমিই রহিত করে দিলাম।

হে মানবমণ্ডলী! আমার কথা শ্রবণ করো এবং তা বুঝার চেষ্টা কর। জেনে রাখো, সমস্ত মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। তোমরা একই ভ্রাতৃমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত। অনুমতি ব্যতীত কেউ কারো কোনো কিছু জোর করে নিতে পারবে না।

তোমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর কালাম কুরআন এবং তাঁর রাসুলের সুন্নাত হাদিস রেখে যাচ্ছি। যত দিন তোমরা এগুলোর অনুশীলন করবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।

তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদাত করবে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে, রমযান মাসে রোযা রাখবে এবং আমি যা নির্দেশ দিয়েছি তা পালন করতে থাকবে। এর দ্বারা তোমরা তোমাদের প্রভুর জান্নাতে প্রবেশ করবে।

এরপর মহানবি (সা.) আকাশপানে তাকিয়ে বললেন, 'হে প্রভু! আমি কি তোমার বাণী মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি? জনতা সমবেত কণ্ঠে জবাব দিল, হ্যাঁ, আপনি আমাদের নিকট সব কথা পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন, 'হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো'।

এ সময় তাঁর নিকট ওহি নাযিল হলো: 'আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নি'আমাত পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।' (সূরা মায়েদা, আয়াত: ৩)

অতঃপর তিনি সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'আমার এ বাণী আজ যারা উপস্থিত আছ তারা, যারা উপস্থিত নেই, তাদের নিকট পৌঁছে দেবে। উপস্থিত ব্যক্তিদের অপেক্ষা অনুপস্থিত লোকেরাই আমার উপদেশ অধিক স্মরণ রাখতে সক্ষম হবে।'

এরপর কিছু সময় নীরব থেকে জনতার দিকে তাকিয়ে মহানবি (সা.) বললেন, 'বিদায়'।

মহানবি (সা.)-এর ওফাত

বিদায় হজের পর মহানবি (সা.) মদিনায় ফিরে যান। কিছুদিন পর আকস্মিকভাবে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্রমেই তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। একদিন তিনি সাহাবিদের একত্র করে বললেন, হে বন্ধুগণ! আমি যদি কখনো কারো ওপর আঘাত করে থাকি, তবে সে যেন আজ তার প্রতিশোধ গ্রহণ করে। আমি যদি কারো সম্মান লাঘব করে থাকি, তবে সে যেন আজ আমার প্রতি তদ্রূপ আচরণ করে। আর আমি যদি কারো সম্পদ আত্মসাৎ করে থাকি, তবে সে যেন আজ আমার সম্পদ থেকে তা নিয়ে নেয়। সে যেন মনে না করে, আমি তার প্রতি অসন্তুষ্ট হব; কারণ, আমার প্রকৃতি এটা হতে মুক্ত।

এ সময় এক ব্যক্তি তাঁর নিকট তিনটি দিরহাম দাবি করল। তিনি তখনই তা পরিশোধ করে দিলেন। এছাড়াও মহানবি (সা.) অসুস্থতার শেষ দিনগুলোয় নামায এবং দাস-দাসীদের সঙ্গে সদাচরণ করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি তোমাদের সালাত, যাকাত ও দাস-দাসীদের সম্পর্কে তোমাদের ওসিয়ত করছি। (মুসনাদে আহমাদ)

মহানবি (সা.)-এর অসুস্থতা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ইন্তিকালের আগে তিনি একাধিকবার অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। তখন তাঁর জ্বরের প্রকোপও বৃদ্ধি পেতে থাকে। জ্বরের প্রচণ্ডতা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, তাঁর গায়ে হাত রাখা যাচ্ছিল না। এ সময় অস্থিরতা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সমগ্র মদিনা নগরীকে গ্রাস করেছিল। সাহাবিগণ অশ্রুসজল নয়নে এবং দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাঁর ঘরের চারপাশে সমবেত হয়েছিলেন। সবাই উদ্বিগ্ন, অস্থির ও ভগ্ন হৃদয়ে প্রিয় নবির (সা.) খোঁজ নিচ্ছিলেন এবং মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছিলেন।

ওফাতের দিন তিনি অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু সময় যতো গড়াতে থাকে তিনি ঘন ঘন বেহুঁশ হতে থাকেন। মহানবি (সা.)-এর একমাত্র কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.) পিতার শয্যার পাশে বসা ছিলেন এবং ভগ্ন হৃদয়ে, অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁর উজ্জ্বল মুখমণ্ডলের দিকে তাকাচ্ছিলেন। মহানবি (সা.) তাঁকে কাছে ডেকে কানে কানে কথা বললেন। তাঁর কথা শেষ হলে ফাতিমা (রা.)-এর দু'চোখ বেয়ে ঝরনার মতো অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল। মহানবি (সা.) তাঁকে পুনরায় ইশারায় কাছে ডেকে কানে কানে কিছু কথা বললেন। এবার ফাতিমা (রা.) হাসিমুখে মাথা উঠালেন। একই সময় হযরত ফাতিমা (রা.)-এর বিপরীতধর্মী দু'রকম আচরণ দেখে উপস্থিত সাহাবিগণ বিস্মিত হয়েছিলেন।

মহানবি (সা.)-এর ওফাতের পর ফাতিমা (রা.) একই সঙ্গে কান্না ও হাসির কারণ সম্পর্কে বলেন, আমার পিতা প্রথমে তাঁর ইন্তিকালের কথা জানান। এ কারণে আমার তখন কান্না পেয়েছিল। তবে পরে তিনি আমাকে বললেন, তুমিই প্রথম, যে আমার সঙ্গে মিলিত হবে। এ সংবাদ আমাকে আনন্দিত করল এবং আমিও বুঝতে পারলাম, অল্প কিছুদিন পরেই আমি তাঁর সঙ্গে মিলিত হব।

বেশ কিছুদিনের শারীরিক অসুস্থতার পর ১১ হিজরি ১২ রবিউল আওয়াল, সোমবার ৬৩ বছর বয়সে বিশ্বনবি মুহাম্মাদ (সা.) ইন্তিকাল করেন। তাঁর তিরোধানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মানবের গৌরবময় পার্থিব জীবনের অবসান ঘটে। তাঁর পবিত্র দেহ একটি চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মহানবি (সা.)-এর ওফাতের সংবাদ সমগ্র মদিনা নগরীতে ছড়িয়ে পড়ে। সাহাবিগণ নির্বাক হয়ে পড়েন। এভাবেই অনেক সময় কেটে যায়।

অনেক সাহাবি মহানবি (সা.)-এর মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন। এই সংবাদে ওমর (রা.) অতিমাত্রায় বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। তিনি গৃহদ্বারে দাঁড়িয়ে সমবেত জনতাকে বলতে লাগলেন, 'মুহাম্মাদ (সা.) মৃত্যুবরণ করেননি, মৃত্যুবরণ করতে পারেন না। যে বলবে তিনি মারা গেছেন, আমি তার গর্দান নেব।' ঠিক এই সময়ে হযরত আবু বকর (রা.) এলেন। রাসুল (সা.)-এর মুখাবরণ তুলে ভক্তিভরে ললাটে বার বার চুমু দিতে লাগলেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, 'জীবনে যেমন সুন্দর ছিলেন, মরণেও আপনি ঠিক তেমনি সুন্দর।

এরপর তিনি ওমরকে বললেন, হে ওমর! ক্ষান্ত হও। রাসুলুল্লাহ (সা.) মৃত্যুবরণ করেছেন, এতে আশ্চর্যের কী আছে? আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, 'জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। (আলে-ইমরান, আয়াত: ১৮৫) আল্লাহ তা'আলা আরো বলেছেন, 'মুহাম্মাদ একজন রাসুল মাত্র; তাঁর পূর্বে অনেক রাসুল গত হয়েছেন। সুতরাং তিনি যদি মারা যান অথবা নিহত হন, তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে?' (আলে-ইমরান, আয়াত: ১৪৪) 'অতএব হে লোক সকল! জেনে নাও, মুহাম্মাদ (সা.) মারা গেছেন। একমাত্র আল্লাহর মৃত্যু নেই, তিনি চিরঞ্জীব।' আবু বকর (রা.)-এর এই বক্তব্য শুনে উমর (রা.)-এর জ্ঞান ফিরে এলো। তিনি থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। তাঁর হাত থেকে তরবারি খসে পড়ল এবং তিনি মাটিতে বসে পড়লেন। সাহাবিগণ নিশ্চিত হলেন, মহানবি (সা.) ইন্তিকাল করেছেন। এ সংবাদে সকলেরই মুখ মলিন হয়ে পড়ে, চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। মদিনার সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। এরপর তাঁরা প্রিয় নবি (সা.)-কে শেষ দেখা ও তাঁর প্রতি সালাত, সালাম ও দোয়া পেশ করতে থাকলেন। মহানবি (সা.) যে কক্ষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।

 

প্রতিফলন ডায়েরি লিখন 

'হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনাদর্শ হলো ধৈর্য, ত্যাগ এবং সহমর্মিতার অন্যতম নিদর্শন' 

(উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনাদর্শ তুমি বাস্তব জীবনে কীভাবে চর্চা করবে তার একটি কর্মপরিকল্পনা করো)।

Content added By