SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইসলাম শিক্ষা - Islamic Study - NCTB BOOK

আদর্শ জীবন চরিত

প্রিয় শিক্ষার্থীরা, আমরা পূর্বের শ্রেণিতে আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.)সহ কয়েকজন নবি-রাসুল এবং মুসলিম মনীষীর জীবনাদর্শ সম্পর্কে জেনেছি। তাঁদের জীবনাদর্শ আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে অনুশীলন করতে হবে। হযরত মুহাম্মাদ (সা.)- এর জন্ম, নবুওয়াত লাভ, মক্কায় ইসলাম প্রচার, মি'রাজ গমন এবং মদিনায় হিজরত পর্যন্ত জীবনচরিত সম্পর্কে জেনেছি। অষ্টম শ্রেণিতে মদিনায় ইসলাম প্রচার, মদিনা রাষ্ট্র গঠন, আত্মরক্ষায় বদর, ওহুদ, খন্দকসহ বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা এবং হুদায়বিয়ার সন্ধি ও এর তাৎপর্যসহ আরো অনেক বিষয় সম্পর্কে জেনেছি। এ শ্রেণিতে আমরা খায়বর বিজয়, মুতার যুদ্ধ, মক্কা বিজয়, হুনায়নের যুদ্ধ, তাবুক অভিযান ও বিদায় হজ সম্পর্কে জানব।

Content added By

হযরত মুহাম্মাদ (সা.) 

(মক্কা বিজয় থেকে ওফাত পর্যন্ত)

জোড়ায় কাজ

'হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর জীবনীর স্মৃতিচারণ'

উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে পূর্বের শ্রেণিতে পঠিত হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনাদর্শ থেকে তুমি কী কী জেনেছো তা তোমার সহপাঠীর সাথে আলোচনা করে একটি তালিকা প্রস্তুত করো।

খায়বর বিজয়

খায়বার মদিনা থেকে ৮০ মাইল দূরের একটি বসতির নাম। মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মদিনা থেকে বহিষ্কৃত ইহুদিরা খায়বর নামক স্থানে বসবাস করছিল। বহিষ্কারের পরও তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। তারা মহানবি (সা.)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। তারা বনু গাতফান ও বেদুইনদের সঙ্গে মিলিত হয়ে মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এমনকি মুসলমানদের আক্রমণ করার জন্য তারা চার হাজার সৈন্য প্রস্তুত করে। মহানবি (সা.) তাদের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে সপ্তম হিজরিতে ১৬০০ জন সৈন্য নিয়ে খায়বরে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাদেরকে পরাজিত করেন। পরাজয়ের পরও মহানবি (সা.) তাদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ না করে নিরাপত্তা কর প্রদানের বিনিময়ে তাদের ক্ষমা করে দিলেন। তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দিলেন এবং তাদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা প্রদান করলেন। বিজিত অঞ্চলে মহত্ত্বের এরূপ উদাহরণ ইতিহাসে বিরল।

মুতার যুদ্ধ

৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সামন্তরাজ শুরাহবিল সিরিয়া সীমান্তে মুতা নামক স্থানে একজন মুসলিম রাজদূতকে হত্যা করে। বাধ্য হয়ে মহানবি (সা.) যায়েদ বিন হারেসের নেতৃত্বে ৩০০০ মুসলিম সৈন্যের একটি দল মুতা অভিমুখে প্রেরণ করেন। মুতা নামক স্থানে মুসলিম সৈন্যরা লক্ষাধিক রোমান সৈন্যের মুখোমুখি হয়। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরপর তিনজন সেনাপতি যায়েদ, জাফর ও আব্দুল্লাহ শহিদ হন। এরপর মহাবীর খালিদ সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সাময়িকভাবে পশ্চাদপসরণের কৌশল অবলম্বন করেন। ইতোমধ্যে মহানবি (সা.) প্রেরিত সাহায্যকারী একটি সেনাদল মুতায় এসে পৌঁছে। এরপর সম্মিলিত মুসলিম বাহিনী প্রচণ্ড বিক্রমে শত্রুদের ওপর আঘাত হানে। ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এবং মুসলমানদের বিজয় অর্জিত হয়। মহানবি (সা.) এ যুদ্ধে সাহসী নেতৃত্বের জন্য খালিদ বিন ওয়ালিদকে সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তরবারি) উপাধিতে ভূষিত করেন।

মক্কা বিজয়

মক্কা বিজয়ের প্রেক্ষাপট

হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তানুসারে খুজা'আ সম্প্রদায় মহানবি (সা.)-এর সঙ্গে এবং বনু বকর সম্প্রদায় কুরাইশদের পক্ষে যোগদান করেছিল। কিন্তু সন্ধির দুই বছরের মধ্যেই কুরাইশরা হুদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করে। বনু বকর সম্প্রদায় কুরাইশদের সহায়তায় খুজা'আ সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে কয়েকজনকে হত্যা করে। মহানবি (সা.) হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তানুসারে তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। তিনি প্রথমে কুরাইশদের নিকট প্রস্তাব পাঠালেন যে-

১. হয় তোমরা খুজা'আ সম্প্রদায়কে উপযুক্ত অর্থ দিয়ে ক্ষতিপূরণ দাও। 

২. না হয়, বনু বকর গোত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করো। 

৩. না হয়, হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল বলে ঘোষণা করো।

কুরাইশরা শেষোক্ত প্রস্তাব মেনে হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল ঘোষণা করে। ফলে মহানবি (সা.) ১০ হাজার সাহাবি নিয়ে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা অভিযানে রওনা দেন। মুসলিম বাহিনী মক্কার অদূরে মার-উজ-জাহরান গিরি উপত্যকায় শিবির স্থাপন করে। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান দুজন সঙ্গী নিয়ে মুসলমানদের গতিবিধি লক্ষ করার জন্য মক্কার বাইরে আসে। এ সময় হযরত উমর ফারুক (রা.) আবু সুফিয়ানকে বন্দি করে মহানবি (সা.)-এর নিকট নিয়ে আসেন। মহানবি (সা.) তাঁর দীর্ঘদিনের শত্রুকে হত্যা করার সুযোগ পেয়েও ক্ষমা করে দিলেন। মহানবি (সা.)-এর এই মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কা বিজয়কালে মহানবি (সা.) ঘোষণা করেন, যে আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ। যে হাকিম ইন্ন হিযামের ঘরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ। যে ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘরে অবস্থান করবে, সেও নিরাপদ, যে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, সেও নিরাপদ।'

কোনো রক্তপাত না ঘটিয়ে সামান্য বাধা অতিক্রম করে মহানবি (সা.) বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন। বিজয়ের প্রাক্কালে মহানবি (সা.) সাহাবিগণের উদ্দেশে বলেন, মক্কার পশু-পাখি হত্যা করা যাবে না, গাছ কাটা যাবে না, ঘাস বা কোনো গাছ উপড়ে ফেলা যাবে না এবং অনুমতি ব্যতিরেকে কারো পড়ে থাকা জিনিস তুলে নিতে পারবে না।

এরপর মহানবি (সা.) অতীত অত্যাচার-নির্যাতনের কথা ভুলে গিয়ে মক্কাবাসীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বলেন, আজ তোমাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তোমরা যেতে পারো; তোমরা সবাই মুক্ত, স্বাধীন।

মক্কা বিজয়ের গুরুত্ব

মক্কা বিজয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। মক্কা বিজয়ের ফলে সমগ্র আরবে ইসলামের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। এ বিজয়ের ফলে আরবের বেদুইন গোত্রগুলো ইসলামের ছায়াতলে আসতে শুরু করে।

মক্কা বিজয় ছিল রক্তপাতহীন অতুলনীয় একটি বিজয়। মক্কার কাফিরদের নির্যাতনে নিষ্পেষিত হয়ে মুসলমানরা এক সময় মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু মক্কা বিজয়ে তারা অতীতের সকল অন্যায়-অত্যাচার ও কষ্ট ভুলে গিয়ে তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। তাই মক্কা বিজয়ের সময় কোনো হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ, নারী- শিশু নির্যাতন কিংবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি জবরদস্তিমূলক আচরণ সংঘটিত হয়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম রক্তপাতহীন বিজয়ের কোনো তুলনা নেই। এ বিজয়ের পর মক্কাবাসীকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে মহানবি (সা.) অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

মক্কা বিজয়ের ফলে বায়তুল্লাহর পবিত্রতা পুনরায় ফিরে আসে। পবিত্র কাবাগৃহে রক্ষিত ৩৬০টি মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়। এ সময় মহানবি (সা.) পবিত্র কুরআনের এই আয়াত তিলাওয়াত করতে থাকেন-

جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا 

অর্থ: 'সত্য সমাগত, আর মিথ্যা বিতাড়িত। মিথ্যার বিনাশ অনিবার্য।' (বনী ইসরাইল, আয়াত: ৮১)

এরপর হযরত বেলাল (রা.)-এর আযানের পর মহানবি (সা.) সমবেত মুসলমানদের নিয়ে নামায আদায় করলেন। এভাবে কাবাগৃহ থেকে চিরতরে পৌত্তলিকতার অবসান ঘটল।

হুনায়নের যুদ্ধ

মক্কা বিজয়ে পৌত্তলিকতার অবসান ঘটলেও কয়েকটি সম্প্রদায় তখনও ইসলামের বিরোধিতা করতে থাকে। তাদের মধ্যে মক্কার হাওয়াজিন ও সাকিফ গোত্র ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বেদুইনরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তাদের সম্মিলিত বাহিনী মুসলমানদের আক্রমণ করার জন্য ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে মক্কার নিকটবর্তী হুনায়ন নামক স্থানে সমবেত হয়। মহানবি (সা.) এ খবর জানতে পেরে ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে হুনায়ন অভিমুখে যাত্রা করেন। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

মুসলিম সৈন্যরা সংকীর্ণ পার্বত্য পথ অতিক্রমকালে সেখানে ওত পেতে থাকা বেদুইন সৈন্যরা তীর বর্ষণ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। মহানবি (সা.)-এর আহ্বানে মুসলিম সৈন্যরা পুনরায় একত্রিত হয়ে বীরবিক্রমে শত্রুদের উপর আক্রমণ করেন। মহান আল্লাহ এ যুদ্ধে ফেরেশতাগণের দ্বারা মুসলমানদের সাহায্য করেছিলেন। ফলে মুসলিম সৈন্যরা এ যুদ্ধে জয়লাভ করেন। বিপুল পরিমাণ গবাদি পশু, স্বর্ণ-রৌপ্য ও যুদ্ধ উপকরণ মুসলমানদের হস্তগত হয়। এছাড়া ৬০০০ শত্রু সেনাকে বন্দি করা হয়।

এ যুদ্ধে পরাজিত বিধর্মীরা তায়িফ দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে। মুসলিম সৈন্যরা তায়িফ দুর্গ অবরোধ করেন। তিন সপ্তাহ অবরোধের পর তায়িফবাসী আত্মসমর্পণ করে। মহানবি (সা.) তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের পরিবর্তে উদারতা ও মহানুভবতার আচরণ করলেন। তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। মহানবি (সা.)-এর মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে তায়িফবাসী ইসলাম গ্রহণ করলেন।

হুনায়ুনের যুদ্ধের তাৎপর্য

হুনায়নের যুদ্ধ মুসলমানদের জন্য এক বিরাট শিক্ষা। এ যুদ্ধে নিজেদের সংখ্যাধিক্যে মুসলমানরা গর্বিত হয়ে পড়ে এবং শত্রু পক্ষকে অবজ্ঞা করতে থাকে। ফলে শত্রুপক্ষের অতর্কিত হামলায় তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পরাজয়ের মুখে মহান আল্লাহর সাহায্য এবং মহানবি (সা.)-এর দৃঢ় নেতৃত্বে শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা বিজয়ী হয়। এ যুদ্ধে মহান আল্লাহ ফেরেশতা নাযিল করে মুসলমানদের সাহায্য করেছিলেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন অসংখ্য ক্ষেত্রে এবং হুনায়ন যুদ্ধের দিন। যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিল। কিন্তু তা তোমাদের কোনো কাজে আসেনি এবং অনেক বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী তোমাদের জন্য সংকুচিত হয়েছিল। এরপর তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে। এরপর আল্লাহ তাঁর রাসুল এবং মু'মিনদের উপর প্রশান্তি নাযিল করেন এবং এমন এক সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি এবং তিনি তাদের দ্বারা কাফিরদের শাস্তি প্রদান করেন এবং এটাই কাফিরদের কর্মফল।' (সূরা তাওবা, আয়াত: ২৫-২৬)

হুনায়নের যুদ্ধের গুরুত্ব

হুনায়নের যুদ্ধে বিজয় মুসলমানদের এক অজেয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করল। এ যুদ্ধে জয়লাভের ফলে বিপুলসংখ্যক অমুসলিম মহানবি (সা.)-এর আনুগত্য স্বীকারে আগ্রহী হলো। ইসলামের চিরশত্রু বনু বকর ও বনু হাওয়াযিন গোত্রও ইসলাম গ্রহণ করল। এতে মহানবি (সা.)-এর প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায় এবং তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অবাধ কর্তৃত্বের অধিকারী হন। এ সময় হতেই মদিনার প্রশাসনিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। মদিনার ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত হয় এবং এটি একটি আন্তর্জাতিক নগরীর মর্যাদা লাভ করে।

তাবুক অভিযান

তাবুক অভিযান নবম হিজরির উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মহানবি (সা.)-এর নেতৃত্বে মক্কা, তায়িফ ও হুনায়নে ইসলামের বিজয় সূচিত হলে বাইজান্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। মুতার যুদ্ধে খ্রিষ্টানরা পরাজিত হলে তার ঈর্ষা শতগুণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া আরব ইহুদিদের উস্কানি রোম সম্রাটের প্রতিশোধস্পৃহাকে তীব্রতর করে তোলে। ফলে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে রোম সম্রাট প্রায় লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে মদিনা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়।

হিরাক্লিয়াসের অভিযানের কথা জানতে পেরে সে বাহিনীর আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য মহানবি (সা.) ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে তাবুক অভিমুখে রওনা দেন। রোমান সৈনিকরা মুসলমানদের ব্যাপক প্রতিরোধ আয়োজনের সংবাদ পেয়ে পশ্চাদপসরণ করে। মহানবি (সা.) কয়েক দিন সেখানে অপেক্ষা করে মদিনায় ফিরে এলেন। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপ ও অসহ্য পানির কষ্টের মধ্য দিয়ে এ অভিযান পরিচালিত হয়েছিল বলে ইতিহাসে তা 'গাজওয়াতুল উসরা' বা কষ্টের যুদ্ধ নামে পরিচিত।

তাবুক অভিযানের পর ওমান, নাজরান, ইয়েমেন, বাহরাইন প্রভৃতি অঞ্চলের প্রতিনিধিরা এসে মহানবি (সা.) -এর আনুগত্য প্রকাশ করে। বনু তামিম, মুস্তালিক, কিনদা, আযদ, তায়ি প্রভৃতি গোত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।

বিদায় হজ

দশম হিজরিতে মহানবি (সা.) হজ পালনের ইচ্ছা করলেন। তিনি ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে লক্ষাধিক সাহাবি নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। এটা ছিল তাঁর জীবনের শেষ হজ। এজন্যই এই হজকে 'বিদায় হজ' বলা হয়। মহানবি (সা.) হজের কার্যক্রম সমাপ্ত করে আরাফার ময়দানে 'জাবালে রহমত' নামক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সমবেত মুসলমানরদের লক্ষ্য করে এক যুগান্তকারী ভাষণ প্রদান করেন। এ ভাষণে তিনি একটি আদর্শ মুসলিম সমাজের চিত্র সবার সামনে তুলে ধরেন। প্রাচীন রীতি-নীতি, সুদ প্রথা, শোষণ-নির্যাতন, নারীদের প্রতি অবিচার প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপের মূলে কুঠারাঘাত করেন। এটি মানবতার ইতিহাসে এক অনন্য ভাষণ।

মহানবি (সা.) তাঁর ভাষণের শুরুতে মহান আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপন করলেন। অতঃপর মানবমণ্ডলীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। জানি না, হয়তো আমি এ বছরের পর এখানে আর কখনো তোমাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারব না। হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এই দিন ও এই মাসের মতো পবিত্র, তোমাদের প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত। স্মরণ রেখো, তোমাদের একদিন আল্লাহর নিকট হাজির হতে হবে এবং তিনি তোমাদের কাজের হিসাব চাইবেন।

সাবধান, ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করো না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।

হে মানবমণ্ডলী! স্মরণ রেখো তোমাদের আল্লাহ এক, তোমাদের পিতা এক। সাবধান! কোনো আরবের ওপর অনারবের যেমন প্রাধান্য নেই, তেমনি অনারবের ওপর আরবের কোনো প্রাধান্য নেই। কোনো শ্বেতাঙ্গের ওপর যেমন কৃষ্ণাঙ্গের প্রাধান্য নেই, তেমনি কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গেরও কোনো প্রাধান্য নেই। পরস্পরের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে একমাত্র খোদাভীতি বা সৎকর্ম।

হে আমার অনুসারীরা, তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের যেরূপ অধিকার আছে, তোমাদের ওপরও তাদের সেরূপ অধিকার রয়েছে। তোমরা স্বীয় পত্নীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করো। নিশ্চয়ই আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছ এবং তাঁরই আদেশ মতো তাদেরকে তোমাদের জন্য বৈধ করে নিয়েছ।

দাসদাসীদের প্রতি সর্বদা সদয় ব্যবহার করো। তোমরা যা খাবে, তাদেরকেও তা-ই খাওয়াবে, যা পরবে, তাই পরাবে। যদি তারা কোনো অন্যায় করে এবং তা যদি তোমাদের নিকট অমার্জনীয় হয়, তবে তোমরা তাদেরকে পরিত্যাগ করো। কিন্তু তাদের সঙ্গে কর্কশ ব্যবহার করো না। কারণ, তারাও আল্লাহর সৃষ্টি এবং তোমাদের মতোই মানুষ। অন্ধকার যুগের সকল রক্ত (রক্তের প্রতিশোধ) বাতিল করা হলো। আর সর্বপ্রথমে আমি আমার বংশের রাবিয়া ইবনে হারিসের রক্তের প্রতিশোধ বাতিল ঘোষণা করলাম। অন্ধকার যুগের সকল সুদ বাতিল করা হলো। সবার আগে আমার গোত্রের আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের সকল সুদ আজ আমিই রহিত করে দিলাম।

হে মানবমণ্ডলী! আমার কথা শ্রবণ করো এবং তা বুঝার চেষ্টা কর। জেনে রাখো, সমস্ত মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। তোমরা একই ভ্রাতৃমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত। অনুমতি ব্যতীত কেউ কারো কোনো কিছু জোর করে নিতে পারবে না।

তোমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর কালাম কুরআন এবং তাঁর রাসুলের সুন্নাত হাদিস রেখে যাচ্ছি। যত দিন তোমরা এগুলোর অনুশীলন করবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।

তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদাত করবে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে, রমযান মাসে রোযা রাখবে এবং আমি যা নির্দেশ দিয়েছি তা পালন করতে থাকবে। এর দ্বারা তোমরা তোমাদের প্রভুর জান্নাতে প্রবেশ করবে।

এরপর মহানবি (সা.) আকাশপানে তাকিয়ে বললেন, 'হে প্রভু! আমি কি তোমার বাণী মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি? জনতা সমবেত কণ্ঠে জবাব দিল, হ্যাঁ, আপনি আমাদের নিকট সব কথা পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন, 'হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো'।

এ সময় তাঁর নিকট ওহি নাযিল হলো: 'আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নি'আমাত পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।' (সূরা মায়েদা, আয়াত: ৩)

অতঃপর তিনি সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'আমার এ বাণী আজ যারা উপস্থিত আছ তারা, যারা উপস্থিত নেই, তাদের নিকট পৌঁছে দেবে। উপস্থিত ব্যক্তিদের অপেক্ষা অনুপস্থিত লোকেরাই আমার উপদেশ অধিক স্মরণ রাখতে সক্ষম হবে।'

এরপর কিছু সময় নীরব থেকে জনতার দিকে তাকিয়ে মহানবি (সা.) বললেন, 'বিদায়'।

মহানবি (সা.)-এর ওফাত

বিদায় হজের পর মহানবি (সা.) মদিনায় ফিরে যান। কিছুদিন পর আকস্মিকভাবে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্রমেই তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। একদিন তিনি সাহাবিদের একত্র করে বললেন, হে বন্ধুগণ! আমি যদি কখনো কারো ওপর আঘাত করে থাকি, তবে সে যেন আজ তার প্রতিশোধ গ্রহণ করে। আমি যদি কারো সম্মান লাঘব করে থাকি, তবে সে যেন আজ আমার প্রতি তদ্রূপ আচরণ করে। আর আমি যদি কারো সম্পদ আত্মসাৎ করে থাকি, তবে সে যেন আজ আমার সম্পদ থেকে তা নিয়ে নেয়। সে যেন মনে না করে, আমি তার প্রতি অসন্তুষ্ট হব; কারণ, আমার প্রকৃতি এটা হতে মুক্ত।

এ সময় এক ব্যক্তি তাঁর নিকট তিনটি দিরহাম দাবি করল। তিনি তখনই তা পরিশোধ করে দিলেন। এছাড়াও মহানবি (সা.) অসুস্থতার শেষ দিনগুলোয় নামায এবং দাস-দাসীদের সঙ্গে সদাচরণ করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি তোমাদের সালাত, যাকাত ও দাস-দাসীদের সম্পর্কে তোমাদের ওসিয়ত করছি। (মুসনাদে আহমাদ)

মহানবি (সা.)-এর অসুস্থতা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ইন্তিকালের আগে তিনি একাধিকবার অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। তখন তাঁর জ্বরের প্রকোপও বৃদ্ধি পেতে থাকে। জ্বরের প্রচণ্ডতা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, তাঁর গায়ে হাত রাখা যাচ্ছিল না। এ সময় অস্থিরতা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সমগ্র মদিনা নগরীকে গ্রাস করেছিল। সাহাবিগণ অশ্রুসজল নয়নে এবং দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাঁর ঘরের চারপাশে সমবেত হয়েছিলেন। সবাই উদ্বিগ্ন, অস্থির ও ভগ্ন হৃদয়ে প্রিয় নবির (সা.) খোঁজ নিচ্ছিলেন এবং মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছিলেন।

ওফাতের দিন তিনি অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু সময় যতো গড়াতে থাকে তিনি ঘন ঘন বেহুঁশ হতে থাকেন। মহানবি (সা.)-এর একমাত্র কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.) পিতার শয্যার পাশে বসা ছিলেন এবং ভগ্ন হৃদয়ে, অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁর উজ্জ্বল মুখমণ্ডলের দিকে তাকাচ্ছিলেন। মহানবি (সা.) তাঁকে কাছে ডেকে কানে কানে কথা বললেন। তাঁর কথা শেষ হলে ফাতিমা (রা.)-এর দু'চোখ বেয়ে ঝরনার মতো অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল। মহানবি (সা.) তাঁকে পুনরায় ইশারায় কাছে ডেকে কানে কানে কিছু কথা বললেন। এবার ফাতিমা (রা.) হাসিমুখে মাথা উঠালেন। একই সময় হযরত ফাতিমা (রা.)-এর বিপরীতধর্মী দু'রকম আচরণ দেখে উপস্থিত সাহাবিগণ বিস্মিত হয়েছিলেন।

মহানবি (সা.)-এর ওফাতের পর ফাতিমা (রা.) একই সঙ্গে কান্না ও হাসির কারণ সম্পর্কে বলেন, আমার পিতা প্রথমে তাঁর ইন্তিকালের কথা জানান। এ কারণে আমার তখন কান্না পেয়েছিল। তবে পরে তিনি আমাকে বললেন, তুমিই প্রথম, যে আমার সঙ্গে মিলিত হবে। এ সংবাদ আমাকে আনন্দিত করল এবং আমিও বুঝতে পারলাম, অল্প কিছুদিন পরেই আমি তাঁর সঙ্গে মিলিত হব।

বেশ কিছুদিনের শারীরিক অসুস্থতার পর ১১ হিজরি ১২ রবিউল আওয়াল, সোমবার ৬৩ বছর বয়সে বিশ্বনবি মুহাম্মাদ (সা.) ইন্তিকাল করেন। তাঁর তিরোধানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মানবের গৌরবময় পার্থিব জীবনের অবসান ঘটে। তাঁর পবিত্র দেহ একটি চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মহানবি (সা.)-এর ওফাতের সংবাদ সমগ্র মদিনা নগরীতে ছড়িয়ে পড়ে। সাহাবিগণ নির্বাক হয়ে পড়েন। এভাবেই অনেক সময় কেটে যায়।

অনেক সাহাবি মহানবি (সা.)-এর মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন। এই সংবাদে ওমর (রা.) অতিমাত্রায় বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। তিনি গৃহদ্বারে দাঁড়িয়ে সমবেত জনতাকে বলতে লাগলেন, 'মুহাম্মাদ (সা.) মৃত্যুবরণ করেননি, মৃত্যুবরণ করতে পারেন না। যে বলবে তিনি মারা গেছেন, আমি তার গর্দান নেব।' ঠিক এই সময়ে হযরত আবু বকর (রা.) এলেন। রাসুল (সা.)-এর মুখাবরণ তুলে ভক্তিভরে ললাটে বার বার চুমু দিতে লাগলেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, 'জীবনে যেমন সুন্দর ছিলেন, মরণেও আপনি ঠিক তেমনি সুন্দর।

এরপর তিনি ওমরকে বললেন, হে ওমর! ক্ষান্ত হও। রাসুলুল্লাহ (সা.) মৃত্যুবরণ করেছেন, এতে আশ্চর্যের কী আছে? আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, 'জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। (আলে-ইমরান, আয়াত: ১৮৫) আল্লাহ তা'আলা আরো বলেছেন, 'মুহাম্মাদ একজন রাসুল মাত্র; তাঁর পূর্বে অনেক রাসুল গত হয়েছেন। সুতরাং তিনি যদি মারা যান অথবা নিহত হন, তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে?' (আলে-ইমরান, আয়াত: ১৪৪) 'অতএব হে লোক সকল! জেনে নাও, মুহাম্মাদ (সা.) মারা গেছেন। একমাত্র আল্লাহর মৃত্যু নেই, তিনি চিরঞ্জীব।' আবু বকর (রা.)-এর এই বক্তব্য শুনে উমর (রা.)-এর জ্ঞান ফিরে এলো। তিনি থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। তাঁর হাত থেকে তরবারি খসে পড়ল এবং তিনি মাটিতে বসে পড়লেন। সাহাবিগণ নিশ্চিত হলেন, মহানবি (সা.) ইন্তিকাল করেছেন। এ সংবাদে সকলেরই মুখ মলিন হয়ে পড়ে, চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। মদিনার সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। এরপর তাঁরা প্রিয় নবি (সা.)-কে শেষ দেখা ও তাঁর প্রতি সালাত, সালাম ও দোয়া পেশ করতে থাকলেন। মহানবি (সা.) যে কক্ষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।

 

প্রতিফলন ডায়েরি লিখন 

'হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনাদর্শ হলো ধৈর্য, ত্যাগ এবং সহমর্মিতার অন্যতম নিদর্শন' 

(উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনাদর্শ তুমি বাস্তব জীবনে কীভাবে চর্চা করবে তার একটি কর্মপরিকল্পনা করো)।

Content added By

হযরত মুসা (আ.)

জোড়ায় কাজ

'হযরত মুসা (আ.) এবং হযরত আলি (রা.)-এর জীবনাদর্শ হলো আল্লাহর অনুগত্যে পরিপূর্ণ'

উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে হযরত মুসা (আ.) এবং হযরত আলি (রা.)-এর জীবনাদর্শ কোন দিকগুলোতে আল্লাহর অনুগত্য প্রকাশ পেয়েছে তা তোমার সহপাঠীর সাথে আলোচনা করে খুঁজে বের করো।

পেন্টাটিউক প্রাচীন মিসরের রাজধানী, নীল নদের তীরের একটি নগরী। এই নগরীর শেষ প্রান্তে বসবাস করত বনি ইসরাইল বংশের লোকেরা। নগরীর সম্রাটদের 'ফির'আউন' বলা হতো। মুসা (আ.)-এর সমসাময়িক ফির'আউনের নাম ছিল ওয়ালিদ ইবনে মুসআব। তাকে 'দ্বিতীয় রামেসিস'ও বলা হয়। সে বনি ইসরাইল বংশের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিল। কারণ, ফির'আউন একবার স্বপ্নে দেখে যে, 'বায়তুল মুকাদ্দাস' থেকে একঝলক আগুন এসে মিসরকে গ্রাস করে ফেলেছে এবং তার অনুসারী 'কিবতি' সম্প্রদায়কে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বনি ইসরাইলদের কোনো ক্ষতি করছে না। ফির'আউন তার রাজ্যের সকল স্বপ্নবিশারদ থেকে একসঙ্গে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চায়। তারা বলল, ইসরাইল বংশে এমন এক পুত্রসন্তানের আগমন হবে, যে আপনাকে ও আপনার রাজত্বকে ধ্বংস করে দেবে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে ফির'আউন ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ফির'আউন সেনাবাহিনীকে আদেশ দিল যে, বনি ইসরাইল বংশে যত পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, সবাইকে যেন হত্যা করা হয়। তাই সে সময় ফির'আউনের সেনাবাহিনীরা ঘুরে বেড়াত। কেউ জন্মগ্রহণ করলেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করত। এভাবে অসংখ্য ইসরাইলি পুত্রসন্তান নিহত হয়। 

হযরত মুসা (আ.)-এর জন্ম

এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পিতা ইমরান আর মা ইউকাবাদের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন শিশু মুসা (আ.)। জন্মের পরপরই তাঁর মা খুব বিচলিত হয়ে পড়েন। শিশুসন্তানকে বাঁচাতে অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েন। হযরত মুসা (আ.)-কে তাঁর মা তিন মাস গোপনে লালন-পালন করলেন। তখন আল্লাহ তা'আলা তাকে জানিয়ে দিলেন, তিনি যেন একটি বাক্সে ভরে মুসা (আ.)-কে নদীতে ভাসিয়ে দেন। আল্লাহ তা'আলার নির্দেশ অনুযায়ী তিনি কাঠের বাক্স বানিয়ে শিশু মুসাকে নদীতে ভাসিয়ে দেন। সেই কাঠের বাক্স ভাসতে ভাসতে ফির'আউনের প্রাসাদ ঘাটে গিয়ে ভিড়লো। কয়েকজন দাসী এসে তা তুলে নিয়ে ফির'আউন এবং তার স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুজাহিম-এর সামনে পেশ করল।

হযরত আসিয়া (রা.) বাক্সটা খোলার পর হযরত মুসা (আ.)-কে দেখে মুগ্ধ হলেন। তিনি শিশুটিকে নিজের ছেলে হিসেবে রাখতে চাইলেন। কিন্তু বিপত্তি বাধাল ফির'আউন। সে তাকে হত্যা করতে চাইল। তার মনে প্রবল সন্দেহ হলো- এ শিশুটি বনী ইসরাইলের কেউ হবে। হতে পারে এই সে-ই, যার জন্য অসংখ্য শিশুকে সে হত্যা করেছে। কিন্তু হযরত আসিয়া (আ.) যুক্তি দিয়ে বললেন, 'সে হয়তো আমাদের চোখের শীতলতা হবে। তাঁকে হত্যা করবেন না। আমরা তাকে আমাদের সন্তানের মতো করে গড়ে নেব।' ফির'আউন তার কথা মেনে নিল।

হযরত মুসা (আ.)-এর শৈশবকাল

হযরত মুসা (আ.)-কে দুধপান করানো নিয়ে বেশ জটিলতায় পড়লেন আসিয়া (আ.)। ক'জন ধাত্রীকে আনা হলো, অথচ তিনি কারো স্তন্যপান করলেন না। এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলেন মুসা (আ.)-এর বোন মরিয়ম। সে বলল, 'আমি একজন ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি। সে অতি যত্নের সঙ্গে তাকে লালন করবে এবং আমি আশাবাদী সে তাঁর দুধ পান করবে।' এভাবেই মুসা (আ.) তাঁর মায়ের কোলেই রাজ প্রাসাদে লালিত-পালিত হলেন। আল্লাহ তা'আলা তাঁর মায়ের অন্তরে প্রশান্তি দান করলেন।

ফির'আউন শিশু মুসা (আ.)-কে কোলে নিলেন। তখন শিশু মুসা (আ.) ফির'আউনের গালে প্রচণ্ড জোরে চড় মারেন। এই ঘটনায় ফেরাউন বেশ চটে যায়। সে মুসা (আ.)-কে হত্যা করতে চাইল এবং বলল, এই সেই শিশু, যে আমার রাজত্ব ধ্বংস করবে। তখন আসিয়া (আ.) বুঝালেন, এটা নিতান্তই শিশুসুলভ আচরণ। আপনি তাকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আসিয়া (আ.)-এর কথামতো পরীক্ষার আয়োজন করা হলো। এক পাত্রে মণিমুক্তা আরেক পাত্রে আগুনের অঙ্গার রাখা হলো। মুসা (আ.)-কে ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি মণিমুক্তার দিকে গেলেও জিবরাইল (আ.) তাঁকে অঙ্গারের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। তখন আগুন মুখে নেওয়ায় তার মুখে জড়তা তৈরি হয়।

হযরত মুসা (আ.)-এর হিজরত

হযরত মুসা (আ.) একবার দেখতে পেলেন যে, একজন কিবতি জনৈক ইসরাইলিকে অত্যাচার করছে। তিনি অত্যাচারিত লোকটিকে বাঁচানোর জন্য অত্যাচারী কিবতি লোকটিকে একটি ঘুষি মারলেন। এতে লোকটি মারা যায়। হযরত মুসা (আ.) তখন প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থে স্বদেশ ত্যাগ করলেন। তিনি যাত্রা শুরু করলেন মাদইয়ানের উদ্দেশ্যে।

তিনি মাদইয়ানের একটি মরুদ্যানে পৌছাতে সক্ষম হলেন। নিজের কর্মদক্ষতায় তিনি দু'জন অপেক্ষমাণ রমণীকে পানি সংগ্রহ করে দিলেন। তাদের মাধ্যমে হযরত মুসা (আ.) সাক্ষাৎ পেলেন হযরত শুয়াইব (আ.)- এর। হযরত মুসা (আ.) তাঁর সান্নিধ্যে ১০ বছর অতিবাহিত করেন। হযরত শুয়াইব (আ.) তাঁর কর্মদক্ষতা, চারিত্রিক মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা সফুরাকে তাঁর সঙ্গে বিবাহ দেন।

নবুওয়াত লাভ

দীর্ঘ দশ বছর পর হযরত মুসা (আ.) মাদইয়ান থেকে মিসরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও একপাল বকরি। তুর পাহাড়ের পাদদেশে আসার পর সন্ধ্যা হয়ে যায়। রাত্রিযাপনের জন্য তিনি পাহাড়ের নিকটে 'তুয়া' নামক পবিত্র উপত্যকায় তাঁবু স্থাপন করেন এবং সেখানে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন। নবুওয়াতের প্রমাণ হিসেবে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে দিয়েছিলেন অসংখ্য মু'জিযা। তার মধ্যে অন্যতম হলো হাতের লাঠি সাপে পরিণত হওয়া ও হাতের শুভ্রতা। আল্লাহ তা'আলা হযরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে সরাসরি ও ফেরেশতাদের মাধ্যমে কথাবার্তা বলতেন। আর এ কারণে তাঁকে 'কালিমুল্লাহ' তথা আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথনকারী বলা হয়।

দ্বীনের দাওয়াত

নবুওয়াত লাভের পর হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে দ্বীন প্রচারের জন্য আদিষ্ট হন। হযরত মুসা (আ.) তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় ফির'আউনের রাজ প্রাসাদে কাটিয়েছেন। শৈশবে মুখ পুড়ে যাওয়ার কারণে তাঁর মুখে জড়তা সৃষ্টি হয়। অথচ নবুওয়াতের কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য বিশুদ্ধভাষী হওয়া জরুরি। তাই তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানালেন, 'হে আমার পালনকর্তা! আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন এবং আমার জিহ্বা থেকে জড়তা দূর করে দিন!' আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রার্থনা কবুল করলেন এবং অতিসত্বর মিসরে যাওয়ার আদেশ দিলেন। হযরত মুসা (আ.) হযরত হারুন (আ.)-কে নিয়ে ফির'আউনের কাছে যান এবং দ্বীনের দাওয়াত দেন।

হযরত মুসা (আ.) ফির'আউনকে তাঁর মু'জিযাগুলো দেখালেন এবং তাকে আল্লাহ তা'আলার প্রতি ইমান আনার আহ্বান জানালেন। ফির'আউন এতে কর্ণপাত করল না। উপরন্তু সে হযরত মুসা (আ.)-কে যাদুর চ্যালেঞ্জ দিল।

যাদুমঞ্চ ও যাদুকরদের ইমান গ্রহণ

বিশাল মাঠে যাদু দেখানোর আয়োজন করা হলো। অনেক বেশি লোকসমাগম হলো। দেশের সবচেয়ে দক্ষ যাদুকররা এলো। সেই বিশাল জনসভায় মুসা (আ.) দৃপ্তকণ্ঠে বললেন, 'দুর্ভাগ্য তোমাদের; তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করো না। তাহলে তিনি তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেবেন। যে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, সে-ই ব্যর্থ হয়েছে।' মুসা (আ.)-এর কথা শুনে তারা বিস্মিত হয়ে পরস্পর পরামর্শ করল। তারপর মুসা (আ.)-কে লক্ষ্য করে বলল, তুমিই আগে শুরু করবে নাকি আমরা? তিনি বললেন, 'তোমরাই আগে শুরু করো। যাদুকররা তাদের লাঠি আর দড়ি জমিনে নিক্ষেপ করল। সেগুলো যাদুর প্রভাবে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করল। তখন আল্লাহ তা'আলা মুসা (আ.)-কে অভয় দিয়ে বলেন, ভয় করো না, তুমিই বিজয়ী হবে। তোমার ডান হাতে যা আছে তুমি তা নিক্ষেপ করো। এটা যা কিছু তারা করেছে তা গ্রাস করে ফেলবে। তারা যা করেছে তা তো কেবল যাদুকরের কলাকৌশল। যাদুকর যেখানেই থাকুক, সফল হবে না। (সূরা ত্বহা, আয়াত: ৬৫-৭০) মুসা (আ.) যখন তাঁর লাঠি জমিনে নিক্ষেপ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে সেটি বিরাট অজগর হয়ে মাঠের সবগুলো সাপ গ্রাস করে ফেলল। যাদুকররা বুঝতে পারল, এ নিছক যাদু নয়। তারা সকলেই তখন সিজদায় অবনত হয়ে ইমান আনল।

ফির'আউনের পরিণতি

ফির'আউন যখন ইমান আনল না এবং বনি ইসরাইলকেও তার দাসত্ব হতে মুক্তি দিল না, তখন আল্লাহ তা'আলা মুসা (আ.)-কে মিসর ত্যাগ করার আদেশ দেন। রাতের অন্ধকারে মুসা (আ.) বনি ইসরাইলকে নিয়ে বের হয়ে পড়েন। ফির'আউন হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর দলবলের মিসর ত্যাগের খবর শুনে সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাঁদের পেছনে ছুটল। হযরত মুসা (আ.) তাঁর দলবল নিয়ে লোহিত সাগরের তীরে এসে থমকে দাঁড়ালেন। অন্যদিকে ফির'আউন তার সৈন্যবাহিনীসহ তাঁদের খুব কাছাকাছি চলে এলো। তখন মুসা (আ.)-এর অনুসারীরা ভয় পেয়ে গেল। মুসা (আ.) তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই আমার রব আমাদের পথ দেখাবেন। আল্লাহর নির্দেশে হযরত মুসা (আ.) তাঁর লাঠি দ্বারা সাগরে আঘাত করলেন। সাগরের পানিতে রাস্তা তৈরি হলো। বনি ইসরাইলের ১২টি দলের জন্য ১২টি পথ হয়ে গেল। হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা নিরাপদে নদী অতিক্রম করলেন। ফির'আউন ও তার সৈন্যবাহিনী হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের সাগর পার হতে দেখে তাঁদের অনুসরণ করল। যখন তারা সাগরের মাঝখানে পৌঁছল, তখনি রাস্তা সাগরের পানিতে মিশে গেল। ফলে ফির'আউন তার দলবলসহ ডুবে মরল। আল্লাহর নবিকে ধ্বংস করতে গিয়ে নিজেরাই ধ্বংস হলো। আর এভাবে সত্যের জয় হলো

তাওরাত লাভ

আল্লাহ তা'আলা হযরত মুসা (আ.)-কে তাওরাত কিতাব দেওয়ার অঙ্গীকার করলেন। তিনি আল্লাহর আদেশে তাওরাত কিতাব আনতে তুর পাহাড়ে গেলেন। সেখানে ৩০ দিন থাকার ইচ্ছা করলেন, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় আরো ১০ দিন বেশি অবস্থান করলেন। তুর পাহাড়ে হযরত মুসা (আ.) সাওম, ইতিকাফ ও কঠোর সাধনায় মগ্ন থাকতেন। তিনি তুর পাহাড়ে থাকাকালীন তাঁর ভাই হযরত হারুন (আ.)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। এমতাবস্থায় তাঁর অনুসারীদের অনেকেই 'সামেরি' নামক এক ব্যক্তির ধোঁকায় পড়ে গরুর বাছুর পূজা শুরু করে। হযরত মুসা (আ.) তাওরাত কিতাব নিয়ে এসে তাদের এ অবস্থা দেখে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হলেন। তখন তাওবা হিসেবে গরু বাছুর পূজারিদের একে অপরকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হলো। যার ফলে সত্তর হাজার বনি ইসরাইল নিহত হয়। হযরত মুসা (আ.) ও হযরত হারুন (আ.) আল্লাহর নিকট খুব কান্নাকাটি করেন। অবশেষে আল্লাহ তাদের মাফ করে দেন।

ইন্তিকাল

পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। হযরত মুসা (আ.)-ও এর ব্যতিক্রম নন। হযরত মুসা (আ.) ১২০ বছর বয়সে সিনাই উপত্যতায় ইন্তিকাল করেন। তাঁকে তুর পাহাড়ের পাদদেশে সমাহিত করা হয়। আমরা হযরত মুসা (আ.)-এর মতো নির্ভীক হয়ে সত্যের পথে মানুষকে ডাকব। সত্য ও ন্যায়ের পথ অনুসরণের মধ্যেই জীবনের সাফল্য নিহিত।

Content added By

হযরত আলি (রা.)

প্যানেল আলোচনা

'হযরত মুসা (আ.) এবং হযরত আলি (রা.)-এর জীবনাদর্শ চর্চা'

উল্লিখিত মহামানবদের জীবনাদর্শ তোমার জীবনে কীভাবে অনুশীলন করবে শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তা তোমার সহপাঠীর সাথে প্যানেল বা দলে আলোচনা করে উপস্থাপন করো।

হযরত আলি (রা.) মহানবি (সা.)-এর জামাতা এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা। তিনি আহলুল বায়ত বা নবি- পরিবারের অন্যতম সদস্য। তাঁর পিতা ছিলেন আবু তালিব, যিনি মহানবি (সা.)-এর আপন চাচা। তাঁর মা ফাতিমা বিনতে আসাদ, যিনি মহানবি (সা.)-এর কাছেও মাতৃতুল্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

হযরত আলি (রা.)-এর উপনাম আবুল হাসান ও আবু তুরাব। আসাদুল্লাহ (আল্লাহর সিংহ), হায়দার (সিংহ), মুরতাজা (কবুলকৃত), আমিরুল মু'মিনিন (বিশ্বাসীদের নেতা) ইত্যাদি তাঁর উপাধি।

জন্ম ও শৈশব

হযরত আলি (রা.) মহানবি (সা.)-এর ওহি লাভের ১০ বছর পূর্বে এবং হিজরতের ২৩ বছর পূর্বে ৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম হাকিমসহ অনেক ঐতিহাসিকের মতে, তিনি কাবা শরিফের অভ্যন্তরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি শৈশব থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং খাদিজা (রা.)-এর সংসারেই লালিতপালিত হন। তিনি সব সময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গেই থাকতেন।

ইসলাম গ্রহণ ও ইসলামের সেবায় অবদান

হযরত আলি (রা.) বালকদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি যেহেতু রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর ঘরে লালিতপালিত হয়েছেন, সেহেতু ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তিনি কখনো মূর্তিপূজাসহ অনৈসলামিক কোনো কার্যকলাপে যুক্ত হননি।

মহানবি (সা.) তাঁর বাসায় কুরাইশদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সমবেত করে ইসলামের দাওয়াত দেন। আবু লাহাবের প্ররোচনায় তখন কুরাইশ নেতারা তাঁর আহ্বানে সাড়া দেননি। কিন্তু আলি (রা.) তখন দৃঢ় কণ্ঠে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি তাঁর আনুগত্যের ঘোষণা দেন। হিজরতের রাতেও তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মক্কায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘরে তাঁরই বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলেন। জীবনের কঠিন ঝুঁকি সত্ত্বেও তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রদত্ত আমানতের মালের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দেওয়া দায়িত্বের চেয়ে তিনি তাঁর জীবনের মূল্য তুচ্ছ মনে করেছেন। দায়িত্ব পালনেই ছিল তাঁর কাছে বড় ব্যাপার। কিছুদিন পর তিনি মদিনায় হিজরত করেন।

বীরত্ব

আলি (রা.) বদর যুদ্ধসহ প্রতিটি যুদ্ধে মহানবি (সা.)-এর সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। বদরের যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে যুলফিকার তলোয়ার উপহার দেন। সবগুলো যুদ্ধে তিনি পতাকা বহন করেছেন। শুধু তাবুক যুদ্ধে তিনি অংশ নিতে পারেননি। কারণ, এ সময় মহানবি (সা.) তাঁকে মদিনা নগরীর দায়িত্বভার দিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিটি যুদ্ধে তিনি অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। খায়বার যুদ্ধের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে পতাকা প্রদান করেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তিনি ঢাল হারিয়ে ফেললে কামুস দুর্গের অত্যন্ত ভারী একটি দরজাকে ঢাল বানিয়ে যুদ্ধ করেন। পরবর্তীতে এই দরজা উঠাতে আটজন মানুষের সম্মিলিত শক্তির প্রয়োজন হয়েছিল। তাঁর এই অলৌকিক কীর্তিতে মুসলিমরা যুদ্ধে জয়লাভ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে 'আসাদুল্লাহ' বা 'আল্লাহর সিংহ' উপাধি দান করেন।

আলি (রা.) একজন কাতিবে ওহি তথা ওহি লেখক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির সময়ও তিনি সন্ধিপত্র লেখার দায়িত্ব পালন করেন।

বিবাহ

হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা ফাতিমা (রা.)-কে হযরত আলি (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহ দেন। এই পবিত্র সংসারে হযরত হাসান, হোসাইন, মুহসিন, যয়নব ও উম্মে কুলসুম জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালেই মুহসিন (রা.) ইন্তিকাল করেন।

পূর্ববর্তী খলিফাদের প্রতি আনুগত্য ও সহায়তা

হযরত আলি (রা.) তাঁর পূর্বে খলিফা হিসেবে হযরত আবু বকর (রা.), উমর (রা.) ও উসমান (রা.)-কে পেয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকের খিলাফত আমলে তিনি তাঁদের প্রধান পরামর্শদাতার দায়িত্ব পালন করেন। উমর (রা.) এ জন্য বলেছিলেন, 'আলি না থাকলে উমর ধ্বংস হয়ে যেত।' বিশেষ করে উসমান (রা.) শত্রুবেষ্টিত হলে তাঁকে প্রতিরক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালান। এ কাজে তিনি হযরত হাসান (রা.) ও হযরত হোসাইন (রা.)-কেও নিযুক্ত করেছিলেন।

খিলাফতের দায়িত্বলাভ

৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুন খলিফা হযরত উসমান (রা.) শাহাদত বরণ করেন। এর কয়েক দিন পর বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবিদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে হযরত আলি (রা.) চতুর্থ খলিফা হিসেবে খিলাফতের দায়িত্ব লাভ করেন। খিলাফতের দায়িত্ব লাভ করার পর উসমান (রা.)-এর হত্যাকারীদের বিচার করা নিয়ে তিনি নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হন। সাহাবিগণের অনেকেই তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন। কিন্তু হত্যাকারীদের পরিচয় শনাক্ত করা না যাওয়ায় তাদের বিচার করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয় এবং ফলে রক্তক্ষয়ী উষ্ট্রের যুদ্ধ ও সিফফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরবর্তী সময়ে খারেজি নামক চরমপন্থীদের অভ্যুদয় ঘটে। তাদের বিরুদ্ধে হযরত আলি (রা.) নাহরাওয়ানের যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

জ্ঞানসাধনা

আরবে অল্প যে কয়েকজন মানুষ লেখাপড়া জানতেন, হযরত আলি (রা.) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি আরবি ব্যাকরণ শাস্ত্রের প্রবর্তক ছিলেন। তিনি ৫৮৬টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি অসাধারণ জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। মহানবি (সা.) বলেছেন,

أَنَا دَارُ الْحِكْمَةِ وَعَلِيٌّ بَابُهَا

অর্থ: 'আমি প্রজ্ঞার ঘর আর আলি হলেন সে ঘরের দরজা।' (তিরমিযি)

চারিত্রিক গুণাবলি

হযরত আলি (রা.) জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মেধা, বিবেচনাবোধ, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, পরহেযগারিতা, দুনিয়াবিমুখতা ইত্যাদির সমন্বয়ে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। একবার এক ইহুদি তাঁর বর্ম চুরি করে নিয়েছিল। কিন্তু তিনি উপযুক্ত প্রমাণ দিতে না পারায় তাঁরই নিযুক্ত বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে রায় দেয়। তিনিও রায় মেনে নেন। পরবর্তী সময় ইসলামের এই ন্যায়বিচার দেখে সেই ইহুদি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। সাধারণ মানের কাপড় পরতেন।

হযরত আলি (রা.)-এর সম্মান ও মর্যাদা

হযরত আলি (রা.) জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন সাহাবির অন্যতম। হিজরতের পরে মহানবি (সা.) প্রত্যেক মুহাজির সাহাবির সঙ্গে একজন আনসার সাহাবিকে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন এবং নিজের জন্য আলি (রা.)-কে নির্বাচন করেছিলেন। হযরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে হযরত হারুন (আ.)-এর যে সম্পর্ক, আলি (রা.)- এর সঙ্গেও তাঁর তেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন,  

مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ

অর্থ: 'আমি যার অভিভাবক, আলিও তাঁর অভিভাবক।' (তিরমিযি)

আরেকটি হাদিসে মহানবি (সা.) আলি (রা.)-কে বলেছেন, 'তুমি আমার এবং আমি তোমার।' (বুখারি)

হযরত আলি (রা.)-এর কয়েকটি উপদেশ

আলি (রা.) বলেছেন:

■ ধন-সম্পদের চেয়ে জ্ঞান উত্তম। কারণ, ধন-সম্পদ তোমার পাহারা দিতে হয় আর জ্ঞান নিজেই তোমাকে পাহারা দেবে। সম্পদ বিতরণ করলে শেষ হয়ে যাবে আর জ্ঞান যতই বিতরণ করবে, ততই বাড়বে। 

■ তোমার শত্রু তিনজন: তোমার নিজের শত্রু, তোমার শত্রুর বন্ধু এবং তোমার বন্ধুর শত্রু। 

■ দানশীলতা সর্বোত্তম গুণ।

ইন্তিকাল

হযরত আলি (রা) ৪০ হিজরির ১৮ রমযান শুক্রবার ফজরের নামাযে যাবার পথে খারেজি দুর্বৃত্ত আবদুর রহমান ইবনে মুলজিমের বিষাক্ত খঞ্জরের আঘাতে আহত হন। এর তিনদিন পর ২১ রমযান তিনি শাহাদাত বরণ করেন। হযরত হাসান (রা.) তাঁর জানাযা পড়ান। এরপর কুফার জামে মসজিদের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।

প্রতিফলন ডায়েরি লিখন 

হযরত আলি (রা.)-কে কেন আসাদুল্লাহ বলা হয়? 

(উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তুমি একটি প্রতিবেদন তৈরি করো। কাজটি করার জন্য তুমি তোমার পরিবারের সদস্য, সহপাঠী, ধর্মীয়জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি বা অনলাইন সোর্স এর সহায়তা নিতে পারো।)

Content added By

হযরত হাসান (রা.)

হযরত হাসান ইবনে আলি (রা.) হলেন মহানবি (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র। তিনি আহলুল বায়ত বা নবি- পরিবারের অন্যতম সদস্য ছিলেন। মহানবি (সা.) তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। চার খলিফার পরে তিনিই ছিলেন সর্বশেষ খলিফা।

জন্ম ও শৈশব

হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (রা.) ও হযরত আলি (রা.)-এর ঘর আলোকিত করে ৩য় হিজরি মোতাবেক ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে রমযান মাসে হযরত হাসান ইবনে আলি (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মে মহানবি (সা.) অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। আলি (রা.)-এর কাছে এসে তিনি বললেন, 'আমার নাতিকে দেখাও। তাঁর নাম কী রেখেছো?' আলি (রা.) প্রথমে নাম রেখেছিলেন, 'হারব'। মহানবি (সা.) তাঁর 'হারব' নাম বদলে নাম রাখেন হাসান। তিনি নিজেই হাসান (রা.)-এর কানে আযান দেন এবং মেষ দিয়ে আকীকা করেন। হযরত হাসান (রা.)-এর শৈশব রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরম স্নেহ ও ভালোবাসায় অতিবাহিত হয়েছে। কখনো কখনো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সিজদাহ দেওয়ার সময় তিনি ও তাঁর ছোট ভাই হোসাইন (রা.) এসে পিঠে চড়ে বসতেন। তাঁরা যেন বেশিক্ষণ পিঠে থাকতে পারেন, সেজন্য তিনি নামাযের সিজদাও দীর্ঘায়িত করতেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে কখনো কখনো কোলে নিয়ে হাঁটতেন। হাসান-হোসাইন দুইভাই তাঁর কাছে দৌড়ে এলে তিনি তাঁদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতেন। একবার তাঁরা দুজনে লাল রঙের জামা পরে বের হলেন। কিন্তু তাঁরা হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। মহানবি (সা.) তখন খুতবা দিচ্ছিলেন। তিনি খুতবা বন্ধ রেখে দ্রুত নেমে এসে তাঁদেরকে উঠিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসলেন।

আরেকবার মহানবি (সা.) হযরত হাসান (রা.)-কে কাঁধে উঠালেন। তখন একজন সাহাবি বললেন, 'হে বালক! তুমি কত উত্তম সওয়ারিতে আরোহণ করেছ।' এ কথা শুনে মহানবি (সা.) বললেন, 'আরোহী নিজেও তো কত উত্তম।' (তিরমিযি)

হযরত হাসান (রা.)- এর বয়স যখন সাত বছর, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

শিক্ষাদীক্ষা

হযরত হাসান (রা.) তাঁর নানা হযরত মুহাম্মাদ (সা.), পিতা আলি (রা.), মা খাতুনে জান্নাত ফাতিমা (রা.) প্রমুখের কাছে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি তাঁর থেকে সালাতুল বিতরের দোয়াসহ বেশ কিছু হাদিসও বর্ণনা করেছেন। একবার হাসান (রা.) সদকা হিসেবে দেওয়া একটি খেজুর মুখে দিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই সেই খেজুর তাঁর মুখ থেকে বের করে আনেন এবং তাঁকে বুঝিয়ে দেন, নবি-পরিবারের জন্য মানুষের দান-সদকা গ্রহণ করা বৈধ নয়। এভাবে মহানবি (সা.) নিজেই তাঁকে তালিম-তরবিয়ত শিক্ষা দেন।

হযরত হাসান (রা.)-এর সম্মান ও মর্যাদা

অসংখ্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) হযরত হাসান (রা.)-এর মর্যাদা স্পষ্ট করেছেন। হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি, হযরত হাসান এবং হোসাইন (রা.) জান্নাতের যুবকদের সর্দার হবেন। তাঁরা দুনিয়াতে মহানবি (সা.)-এর দুটি ফুলস্বরূপ। হযরত হাসান (রা.)-এর জন্য তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন,

اللهُمَّ إِنِّي أُحِبُّهُ فَأَحِبَّهُ وَأَحِبَّ مَن يُحِبُّهُ

অর্থ: 'আল্লাহ! আমি হাসানকে ভালোবাসি। আপনিও হাসানকে ভালোবাসুন। আর যে হাসানকে ভালোবাসে, তাকেও আপনি ভালোবাসুন।' (বুখারি)

তাই হাসান (রা.)-কে ভালোবাসা আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা প্রাপ্তির অন্যতম উপায়।

বিশিষ্ট সাহাবিগণও ইমাম হাসান (রা.)-কে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) তাঁর সওয়ারির রেকাব ঠিক করে দিতেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়র (রা.) তাঁর কাছে বসলে অত্যন্ত শীতের রাতেও ঘেমে উঠতেন। বলতেন, 'তিনি ফাতিমার সন্তান!'

খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ

মহানবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তাঁর পরে খিলাফত চলবে ৩০ বছর। আলি (রা.)- এর শাহাদতের সময় খিলাফতে রাশেদার ২৯ বছর ৬ মাস পূর্ণ হয়েছিল। তাঁর পরে ইমাম হাসান (রা.) খলিফা হিসেবে ৪০ হিজরির রমযান মাসে (৬৬১ খ্রিষ্টাব্দ) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি প্রায় ছয় মাস খিলাফতের দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন। এরপর মুসলিম উম্মাহর ঐক্য রক্ষার স্বার্থে আমিরে মুয়াবিয়া (রা.)-এর সঙ্গে সন্ধি করেন এবং শাসনক্ষমতা তাঁর হাতে ন্যস্ত করেন। আসলে এটি ছিল মহানবি (সা.)-এর একটি ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন। তিনি হাসান (রা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, 'আমার এ দৌহিত্র সরদার হবে আর সম্ভবত আল্লাহ তা'আলা তাঁর মাধ্যমে মুসলিমদের দু'টি দলের মাঝে মীমাংসা করে দেবেন।'

চরিত্র ও দেহসৌষ্ঠব

ইমাম হাসান (রা.)-এর চেহারা ও শরীরের গঠন মহানবি (সা.)-এর পবিত্র শরীরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। একবার হযরত হাসান (রা.) শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করছিলেন। আবু বকর (রা.) তাঁকে দেখে কাঁধে তুলে নিলেন। বললেন, 'আরে হাসান তো দেখতে মহানবি (সা.)-এর মতো, আলির মতো নয়।' আলি (রা.) একথা শুনে হেসে ফেললেন। আনাস (রা.) বলেছেন, 'হযরত হাসান রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সর্বাধিক সাদৃশ্যপূর্ণ ছিলেন।'হযরত হাসান (রা.) অনেক বেশি ইবাদাত-বন্দেগি করতেন। ফজরের নামায পড়ার পর তিনি সব সময় সূর্যোদয় পর্যন্ত নামাযের স্থানেই বসে থাকতেন এবং যিকর-আযকার করতেন। তিনি মোট ১৫ বার পায়ে হেঁটে হজ করেছিলেন, কোনো বাহন ব্যবহার করেননি। তিনি একটি কবিতায় বলেছেন,

يَا أَهْلَ لَذَّاتِ دُنْيَا لَا بَقَاءَ لَهَا إِنَّ اغْتِرَارًا بِظِلَّ زَائِلٍ حُمْقُ

অর্থ: ওহে দুনিয়ার ভোগী মানুষ। দুনিয়া তো স্থায়ী নয়, অপসৃয়মান ছায়ায় বিভ্রান্ত হওয়া তো নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা।' (কিতাবুয যুহদ)

জীবনীকারগণ তাঁর মহান চরিত্রের বহু দিক উল্লেখ করেছেন। যেমন: তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, দানশীল, ধৈর্যশীল, গভীর প্রজ্ঞাবান এবং দুনিয়াবিমুখ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর আচরণে সবাই মুগ্ধ হতো। সর্বসাধারণ তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখত।

একবার হযরত হাসান (রা.) একটি লোককে দোয়া করতে শুনলেন। সে আল্লাহর কাছে ১০ হাজার দিরহাম প্রার্থনা করেছিল। হাসান (রা.) তখনই বাসায় এসে ঐ লোকটিকে ১০ হাজার দিরহাম দিয়ে দিলেন।আরেকবার তিনি একটি বাগানে গিয়ে দেখতে পেলেন, একজন দাস রুটি খাচ্ছে এবং নিজের রুটি থেকে একটি কুকুরকেও খেতে দিচ্ছে। তিনি বললেন, 'তুমি কুকুরটিকেও খাওয়াচ্ছ?' দাস বলল, 'ওকে রেখে আমার একা খেতে সংকোচ হচ্ছে।' তখন হাসান (রা.) বললেন, 'তুমি এখানেই থাকো। আমি না আসা পর্যন্ত যেয়ো না।' এরপর তিনি ঐ বাগানের মালিকের কাছে গিয়ে ঐ বাগান এবং দাসকে কিনে নিলেন। এরপর ফিরে এসে দাসকে মুক্ত করে দিয়ে বাগানটিও তাকে দান করলেন। সেই দাস অভিভূত হয়ে তখনই বাগানটিকে আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিল। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

আরেকবার হযরত হাসান ইবনে আলি (রা.) একটি খচ্চরে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে একদল দরিদ্র মানুষের সঙ্গে দেখা হলো। তারা মাটিতেই খাবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খাচ্ছিল আর লোকদের কাছে ভিক্ষা করছিল। হযরত হাসানকে দেখে তারা বললো, 'হে রাসুলুল্লাহর সন্তান! আসুন আমাদের সঙ্গে নাশতা করুন।'

হযরত হাসান (রা.) তখনই বাহন থেকে নেমে পড়লেন এবং মাটিতে বসেই তাদের সঙ্গে মাটিতে ছড়ানো খাবার খেলেন। এরপর বললেন, 'তোমাদের দাওয়াত কবুল করেছি। এবার আমার দাওয়াত কবুল করতে হবে।' এরপর একটি সময় তাদের সবাইকে তিনি ডাকলেন এবং অনেক মূল্যবান খাবারের ব্যবস্থা করলেন। এবারও তিনি তাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খেলেন।

ইন্তিকাল

হযরত হাসান (রা.)-কে একদল অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারী বিষ খাইয়েছিল। এই বিষক্রিয়ার প্রভাবে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মদিনা মুনাওয়ারায় শাহাদত বরণ করেন। সেদিন মসজিদে নববিতে আবু হুরায়রা (রা.) কান্নারত অবস্থায় চিৎকার করে সমবেত জনতাকে বলেন, 'ওহে মানুষ! নবিজীর (সা.) প্রিয়তম ব্যক্তি আজ ইন্তিকাল করেছেন। তোমরা কাঁদো!' জানাযা শেষে হযরত হাসান (রা.)-কে জান্নাতুল বাকিতে তাঁর মা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা (রা.)-এর কবরের পাশে দাফন করা হয়।

 

Content added By

হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.)

একক কাজ

'ইসলামে মহিয়সী নারী'

শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তুমি মুসলিম মহিয়সী নারীদের একটি তালিকা করো।

যুগে যুগে পৃথিবীতে এমন ব্যক্তিবর্গও এসেছেন যারা মহান আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। তাঁরা নবি-রাসুলগণের অনুসরণে মানুষকে সত্যপথের সন্ধান দিয়েছেন। এমনই একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.)।

 জন্ম ও পরিচয়

হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) ৯৯ হিজরি মোতাবেক ৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকের বসরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাই তাঁকে বসরি বলা হয়। তাঁর পিতার নাম ইসমাঈল এবং মাতার নাম মায়ফুল। তাঁর পিতা খুব দরিদ্র ছিলেন। যেদিন রাতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, ঐ দিন রাতে তার পিতার ঘরে প্রদীপ জ্বালানোর মতো তেলও ছিল না। চার বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ ছিলেন। তাই তাঁর নাম রাখা হলো রাবিয়া (চতুর্থ)। শৈশবে তাঁর পিতামাতা ইন্তিকাল করেন। ফলে তাঁকে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়।

শিক্ষাজীবন

হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) খুব অল্প বয়সেই মা-বাবার কাছ থেকে কুরআন, হাদিস, ফিকহশাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে তার কখনো কোনো সংকোচ ছিল না। তিনি দরিদ্র হলেও পরম ধার্মিক ও আল্লাহভক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন ভদ্র, নম্র ও সংযমী। সেই সঙ্গে প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারিণী। সব সময় গভীর চিন্তায় ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন। রাগ, হিংসা, অহংকার তাঁর চরিত্রকে কখনো কলুষিত করতে পারেনি। মোটকথা আল্লাহর একজন প্রকৃত অলি হওয়ার জন্য যে গুণাবলি থাকা প্রয়োজন এর সব কিছুই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। দীর্ঘ সাধনার পর রাবিয়া বসরি (রহ.) ইলমে তাসাউফ ও মারেফাতের সূক্ষ্ম জ্ঞান অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে রাবিয়া একজন কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

ক্রীতদাসীর জীবন

হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.)-এর মাতা-পিতার ইন্তিকালের পর তার বড় বোনেরা জীবন ও জীবিকার অন্বেষণে অন্যত্র চলে যান। নিঃসঙ্গ রাবিয়া বসরি (রহ.) কান্নাকাটি করে কাটাতে লাগলেন দিনের পর দিন। হঠাৎ এক পাষন্ড এসে জোর করে তুলে নিয়ে গেল রাবিয়া বসরি (রহ.)-কে। দাসী কেনাবেচার হাটে নিয়ে তাঁকে বিক্রি করে দিল পাষাণহৃদয় এক ব্যক্তির নিকট। ক্রীতদাসীতে পরিণত হলেন রাবিয়া বসরি (রহ.)। তিনি দিনের বেলায় কঠোর পরিশ্রম করতেন। রাতের বেলায় জাগ্রত থেকে আল্লাহ তা'আলার ইবাদাত করতেন। হঠাৎ এক মাঝরাতে তাঁর মনিবের ঘুম ভেঙে যায়। মনিব অস্পষ্ট কিছু কথার গুঞ্জন শুনতে পান। গভীর অন্ধকারে কার কথার শব্দ? খুঁজতে যেয়ে দেখতে পান রাবিয়া ইবাদাত করছে। আকুল স্বরে প্রার্থনা করছে প্রভুর দরবারে। একপর্যায়ে রাবিয়া মোনাজাত ধরে আল্লাহ তা'আলার দরবারে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে কোনো মানুষের অধীন করে না রাখলে আমি সর্বক্ষণ শুধু তোমার ইবাদাত করতাম। রাবিয়ার আকুল প্রার্থনা শুনে মনিবের মন গলে যায়। মনিব মনে মনে বলল, হায়! এ আমি কাকে আমার ঘরে দাসী বানিয়ে রেখেছি? সে তো সামান্য নারী হতে পারে না। সে নিশ্চয় আল্লাহর প্রিয়জন। এ ঘটনার পরদিন সকালে মনিব রাবিয়া বসরি (রহ.)-কে দাসত্ব জীবন থেকে মুক্ত করলেন। এবার রাবিয়া বসরি (রহ.) মুক্ত হয়ে নিজের জীবনকে তিনি উৎসর্গ করলেন প্রভুর ইবাদাতে। তিনি জীবনে বিয়ে করেননি। কেবল আল্লাহ তা'আলার ইবাদাতে কাটিয়ে দেন।

আল্লাহর ওপর আস্থা ও ইবাদাত

তাপসী রাবিয়া বসরি (রহ.) আল্লাহর ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। তিনি জীর্ণ কুটিরে বসবাস করতেন। তবু কোনো মানুষের সাহায্য গ্রহণ করতেন না। একবার হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) অসুস্থ হলে আব্দুল ওয়াহিদ আমর ও প্রখ্যাত মুহাদ্দিস সুফিয়ান সাওরি তাঁকে দেখতে যান। তখন সুফিয়ান সাওরি হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.)-কে বললেন, যদি আপনি দোয়া করেন, তাহলে আল্লাহ তা'আলা আপনাকে সুস্থ করে দেবেন। রাবিয়া বসরি (রহ.) বললেন, হে আবু সুফিয়ান! আপনি কি জানেন না কার ইচ্ছায় আমার এ অসুস্থতা? যার ইচ্ছা, তিনি কি আল্লাহ তা'আলা নন? সুফিয়ান বললেন, হ্যাঁ! রাবিয়া বসরি (রহ.) বললেন, তাহলে কেন আমাকে আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রার্থনা করতে বলছেন। 

মালিক ইবনে দিনার একজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি রাবিয়া বসরি (রহ.)-এর পরিচিত ছিলেন। তিনি একদা রাবিয়ার আর্থিক দুরবস্থা দেখে বললেন, আপনি বললে আমি আমার এক ধনী বন্ধু থেকে আপনার জন্য সাহায্য আনতে পারি। রাবিয়া বললেন, হে মালিক! আমাকে এবং আপনার বন্ধুকে কি আল্লাহই রিযিক দেন না? মালিক বলল, হ্যাঁ! রাবিয়া বললেন, আল্লাহ কি দরিদ্রকে তার দারিদ্র্যের কারণে ভুলে যাবেন এবং ধনীদের তাদের ধনসম্পদের কারণে মনে রাখবেন? মালিক বলল, না। তখন রাবিয়া বললেন, আল্লাহ যেহেতু আমার অবস্থা জানেন, তখন তাকে আমার আবার স্মরণ করানোর দরকার কী? বিশিষ্ট আরবি সাহিত্যিক আল জাহিজ বলেন, রাবিয়ার কয়েকজন পরিচিত লোক তাঁকে বললেন, আমরা যদি আপনার আত্মীয়স্বজনদের বলি তাহলে তারা আপনাকে একজন ক্রীতদাস কিনে দেবেন। রাবিয়া বললেন, সত্য কথা এই যে, যিনি সমস্ত পৃথিবীর মালিক, তার কাছেই পার্থিব কিছু চাইতে আমার লজ্জা হয়। অতএব যারা পৃথিবীর মালিক নয় তাদের কাছে কী করে আমি চাইতে পারি?

ইবাদাত করার ক্ষেত্রে হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) ছিলেন অতুলনীয়। তিনি যখনই সময় পেতেন, তখনই আল্লাহ তা'আলার ইবাদাতে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। অধিকাংশ সময় তিনি দিনে রোযা রাখতেন আর রাতে নফল সালাত আদায় করতেন। তিনি সর্বদা আল্লাহ তা'আলার নিকট এ বলে প্রার্থনা করতেন যে, হে প্রভু! আমাকে আমার নিজ কাজে (ইবাদাতে) ব্যস্ত রাখুন যাতে আমাকে কেউ আপনার যিকির হতে বিমুখ করতে না পারে।

আধ্যাত্মিকতা

শুধু পুরুষরাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছে এমন নয়। অনেক নারীও আল্লাহর অলি হয়েছেন। আল্লাহ তাদের অনেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা দিয়েছেন। হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.)-এরও অনেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল। একবার হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) খাবার রান্না করতে গেছেন। দেখেন পেঁয়াজ নেই। ভাবছেন, পেঁয়াজ কোথা থেকে আনব, কীভাবে আনব, কোনো দাস-দাসী নেই। সেবক সেবিকা নেই। মনে মনে এ কথাই ভাবছিলেন। এমন সময় লক্ষ করলেন, একটি চিল উড়ে যাচ্ছে। তাঁর পায়ে পেঁয়াজ। চিল পেঁয়াজগুলো ছুড়ে মারল, আর তা সোজা হযরত রাবিয়ার কাছে এসে পড়ল। তাঁকে বলা হলো, রাবিয়া! তুমি আমার হয়ে গেছ, আমি চিলকে তোমার সেবায় নিয়োজিত করলাম।

হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) একবার শস্য বুনছিলেন। পঙ্গপাল শস্যক্ষেতের ওপর এসে পড়েছিল। তখন রাবিয়া প্রার্থনা করে বললেন, হে আমার প্রভু! এ হলো আমার জীবিকা। যদি আপনি চান তাহলে আমি তা আপনার শত্রুদের বা বন্ধুদের দিয়ে দেব। তখন পঙ্গপাল উড়ে পালিয়ে গেল।

আল্লাহর অলিদের বহু অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। তবে তারা এসব ক্ষমতা নিয়ে কখনো অহংকার করেননি। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো তা প্রকাশ করেননি; বরং তা আপনা আপনি প্রকাশিত হয়ে যেত।

অনাড়ম্বর জীবনযাপন

হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন। তিনি সর্বদা নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে করতেন। আল্লাহর নিকট বেশি বেশি ক্ষমা চাইতেন, সর্বদা আন্তরিকভাবে আল্লাহর নিকট তাওবা করতেন। তিনি বলতেন, মুখে মিথ্যা তাওবা করে কী লাভ যদি তা প্রমাণ করা না যায়? তিনি সর্বদা মহান আল্লাহর গুণকীর্তন ও মানব সেবায় রত ছিলেন।

রাবিয়া বসরি (রহ.)-এর ইন্তিকাল

অনেক শ্রম, কষ্টসাধ্য ও আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ জীবনযাপন করার পর আল্লাহর প্রিয় এই নারী ১৮৫ হিজরি মোতাবেক ৮০১ খ্রিষ্টাব্দে বসরায় ইন্তিকাল করেন। তাঁকে বসরায় দাফন করা হয়।

বর্ণিত আছে যে, মুহাম্মাদ ইবনে তুসি নামক এক লোক তাঁর কবরে যান। গিয়ে বলেন যে, হে রাবিয়া, আপনি গর্ব করতেন যে, উভয় জগতের বিনিময়েও আপনি আপনার মাথা নত করবেন না। আপনি কি সেই উন্নত অবস্থা লাভ করেছেন? জবাবে একটি আওয়াজ এলো, আমি যা চেয়েছিলাম তা আমি পেয়েছি। আমরা তাঁর জীবনের আলোকে আমাদের জীবন গড়ব। ইহকাল ও পরকালে শান্তি পাব।

প্যানেল/দলে আলোচনা 

'হযরত হাসান (রা.) এবং হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.)-এর জীবনাদর্শের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ' 

(উল্লিখিত দু'জন মনীষীর জীবনাদর্শের আধ্যাত্মিকতা, আত্মত্যাগ, শ্রমের মর্যাদা, সহনশীলতা প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলো শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তুমি প্যানেল বা দলে আলোচনা করে উপস্থাপন করো।)

 

Content added By

সৃষ্টি ও মানবতার কল্যাণে মুসলিম মনীষীগণের অবদান

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায় মুসলমানগণ যুগে যুগে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সেবায় মুসলমানগণ একসময়ে সারা বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সৃষ্টি ও মানবতার কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেছেন। আধুনিক যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্র ও রসায়নশাস্ত্রে মুসলিম মনীষীগণের অবদান নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

একক/জোড়ায় কাজ

'সৃষ্টি ও মানবতার কল্যাণের ক্ষেত্র'

শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক সৃষ্টি ও মানবতার কল্যাণের বিভিন্ন ক্ষেত্র হতে তোমার পছন্দের ক্ষেত্রগুলোর উল্লেখ করো।

চিকিৎসাশাস্ত্র

চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান অবিস্মরণীয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির মূলে রয়েছে মুসলমানদের অবদান। যাঁদের অবদানের কারণে চিকিৎসাশাস্ত্র উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইবনে সিনা, আবু বকর আল রাযি, ইবনে রুশদ ও হাসান ইবনে হাইসাম প্রমুখ। চলো আমরা তাঁদের পরিচয় এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় তাদের অবদান সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।

ইবনে সিনা

ইবনে সিনার পুরো নাম আবু আলি আল হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা। তিনি উজবেকিস্তানের বুখারার নিকটবর্তী আফসানা নামক গ্রামে ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল আবদুল্লাহ। পুত্রের জন্মের কিছুকাল পরেই আবদুল্লাহ তাকে বোখারায় নিয়ে আসেন। সে সময় বোখারা ছিল মুসলিম জাহানের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম কেন্দ্র। ১০ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কুরআন হিফজ করেন। তিনি দার্শনিক, চিকিৎসক, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ এবং মুসলিম জগতের একজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও সর্ববিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন।

১৬ বছর বয়স থেকে ইবনে সিনার ডাক্তারির নেশা জাগে, পড়তে পড়তে আবিষ্কার করতে থাকেন চিকিৎসার নতুন নতুন উপায়। ১৮ বছর বয়সেই পুরোদমে ডাক্তার হয়ে গেলেন। বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন ইবনে সিনা। ফলে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল দূরদূরান্তে। ৯৯৭ সালে আমির নূহ ব্যক্তিগত ডাক্তার পদে ইবনে সিনাকে নিয়োগ দেন। কারণ, তিনি নূহের কঠিন রোগের চিকিৎসা করেছিলেন এবং তাতে তিনি সেরে উঠেছিলেন।

ইবনে সিনা রচিত অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রে 'আল কানুন ফিত তিব্ব' একটি অমর গ্রন্থ। এ গ্রন্থটি চিকিৎসা-বিজ্ঞানে এক বিপ্লব এনে দেয়। এত বিশাল গ্রন্থ সে যুগে আর কেউ রচনা করতে পারেনি। এটি ল্যাটিন, ইংরেজি, হিরু প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। ইউরোপের মেডিকেল কলেজগুলোতে 'আল কানুন' গ্রন্থটি বহুকাল যাবত পাঠ্য ছিল। আল কানুন ৫টি বিশাল খণ্ডে বিভক্ত। বইগুলো সব লেখা শেষ হয় ১০২৫ সালে। গ্রন্থটিতে শতাধিক জটিল রোগের কারণ, লক্ষণ ও পথ্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। ড. ওসলার এ গ্রন্থটিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল বলে উল্লেখ করেন। আধুনিক বিশ্বেও তাঁর গ্রন্থটি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে পাঠদান করা হচ্ছে। চিকিৎসায় তাঁর অসাধারণ অবদানের জন্য তাঁকে 'আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক' বলা হয়।

ইবনে সিনা ৫৮ বছর বয়সে ১০৩৭ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে ইন্তিকাল করেন। তাঁকে ইরানের হামাদানে সমাহিত করা হয়।

ইবনে রুশদ

ইবনে রুশদের পুরো নাম আবু ওয়ালিদ মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ ইবনে রুশদ। তিনি স্পেনের কর্ডোভায় ১১২৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। যুবক ইবনে রুশদ প্রাথমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করেন কর্ডোভাতে। তিনি জ্ঞান আহরণে ছিলেন পুরোপুরি আত্মনিবেদিত। তিনি ব্যাপকভাবে দর্শন ও ভেষজ বিষয়ে লেখাপড়া করেন। দুই প্রখ্যাত শিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছেন। তারা হচ্ছেন, আবু জাফর হারুন এবং ইবনে বাজা। মধ্যযুগে মুসলিমের মধ্যে যাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তিনি তাঁদের একজন।

ইবনে রুশদ ছিলেন আধুনিক সার্জারির জনক। সেই সঙ্গে ছিলেন একজন বড় মাপের আধ্যাত্মিক সাধক। কাজে- কর্মে ছিলেন সর্বশক্তিমান আল্লাহর অনুগত। তাঁর বিশ্বাস ছিল, 'আমি ক্ষতস্থান বেঁধে দেবো, ক্ষত সারাবেন আল্লাহ।' এই বিশ্বাসই তাঁকে অনেক ওপরে উঠার সুযোগ করে দেয়। হয়ে ওঠেন আল্লাহর প্রিয় পাত্র।

এই ক্ষণজন্মা পুরুষ জ্ঞানের সকল শাখায় বিচরণ করেছেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর লেখা গ্রন্থের নাম হলো 'কিতাব আল কুল্লিয়াত'। চিকিৎসাশাস্ত্রে এটি একটি অনন্য গ্রন্থ। এতে রয়েছে চিকিৎসাশাস্ত্রের তিনটি মৌলিক বিষয়- রোগ বিশ্লেষণ (ডায়াগনোসিস), নিরাময় (কিউর) এবং প্রতিরোধ (প্রিভেনশন)। বইটিতে ইবনে সিনার 'আল- কানুন' সম্পর্কে সর্বশেষে উল্লেখ রয়েছে। এতে ইবনে রুশদের আসল পর্যবেক্ষণের বিষয় বিধৃত আছে। ইবনে রুশদ এই বইটি লেখেন ১১৬২ খ্রিষ্টাব্দের আগে। এটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে চিকিৎসা-বিজ্ঞানে সমাদৃত হয়েছে।

ইবনে রুশদ অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'আল জামি'। এ গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন ও চিকিৎসার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। 'কিতাব ফি হারাকাত আল ফালাক' হচ্ছে ইবনে রুশদের জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক একটি বই। এই বইয়ে ভূমণ্ডলের গতি বিষয়ে তিনি আলোচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ ল্যাটিন ও হিব্রু ভাষায় অনুবাদ করা হয়। ইবনে রুশদ ১১৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।

আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে যাকারিয়া আল রাযি

আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে যাকারিয়া আল রাযির নাম মুহাম্মাদ, উপনাম আবু বকর, পিতার নাম যাকারিয়া। তাঁর পুরো নাম আবু বকর মুহম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল রাখি। তিনি আল রাযি নামে পরিচিত। ইউরোপে অবশ্য তিনি আল রাজেস নামে পরিচিত। তিনি ৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ইরানে জন্মগ্রহণ করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে আল রাযির অবদান অবিস্মরণীয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদানের কথা বলতে গেলে প্রথমেই তাঁর কথা বলতে হয়। তবে তিনি শুধু চিকিৎসকই ছিলেন না, ছিলেন একাধারে গণিতবিদ, রসায়নবিদ ও দার্শনিক। দীর্ঘদিন তিনি জুন্দেরশাহপুর ও বাগদাদে সরকারি চিকিৎসালয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তৎকালে তাঁর সুনাম ও সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে পশ্চিম এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ থেকে অনেক রোগী তাঁর নিকট আসতেন।

শল্যচিকিৎসায় আল রাযি ছিলেন তৎকালের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাঁর অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি ছিল গ্রিকদের থেকেও উন্নত। তিনি মোট দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে শতাধিক হলো চিকিৎসাবিষয়ক। তিনি বসন্ত ও হাম রোগের ওপর 'আল জুদাইরি ওয়াল হাসবাহ' নামক একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর আরেকটি গ্রন্থের নাম হলো 'আল মানসুরি'। এটি ১০ খণ্ডে রচিত। এ গ্রন্থ দুটি আল রাযিকে চিকিৎসাশাস্ত্রে অমর করে রেখেছে। আল রাযির ২৩টি ভলিউমে রচিত 'আল কিতাব আল হাওয়ি' গাইনোকোলজি, অবেস্ট্রিকস এবং অপথ্যালমিক সার্জারির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। নয়টি ভলিউমে রচিত 'দ্য ভার্চ্যুয়াস লাইফ' বইটিতে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ও প্লেটোর কাজ সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন বিষয়ে সৃষ্টিশীল ধারণা দেন। এই বইটিতে আল রাযি তার বিভিন্ন বই পড়ে অর্জিত জ্ঞান, নানা রকম রোগ এবং তার চিকিৎসা নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ, তাঁর রাখা সমস্ত নোটকে একত্রিত করেছেন। এই বইটির জন্য অনেক পন্ডিত তাকে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক বিবেচনা করেন।

তিনিই প্রথম চিকিৎসক, যিনি হাম ও গুটিবসন্তকে আলাদা রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর আগে দুটি রোগকে একই ভাবা হতো। হাম ও গুটিবসন্ত সম্পর্কিত তাঁর পর্যবেক্ষণ স্থান পেয়েছে তাঁর 'আজ জুদাইরি ওয়াল হাসবাহ' গ্রন্থে। 'আল মানসুরি' গ্রন্থে তিনি অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, মেজাজ, ঔষধ, স্বাস্থ্যরক্ষা বিধি, চর্মরোগ ও প্রসাধনদ্রব্য, শল্যচিকিৎসা, বিষ, জ্বর ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করেন। তিনি পেডিয়াট্রিকস, অপথালমোলজি, নিউরো সার্জারি, সংক্রামক রোগসহ চিকিৎসাবিদ্যার অনেক শাখার গোড়াপত্তন করেন। তিনি ৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মস্থান ইরানে ইন্তিকাল করেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গৌরবময় অবদানের জন্য তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

হাসান ইবনে হাইসাম

হাসান ইবনে হাইসাম ইরাকের বসরা নগরীতে ৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, সবই তিনি বাগদাদে লাভ করেন। তিনি ছিলেন ধনী পরিবারের সন্তান। সে সময়ে অধিক ব্যয়বহুল হওয়ায় কেবল সমাজের ধনী শ্রেণিই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারত। হাসান ইবনে আল হাইসামের শিক্ষা জীবন শুরু হয় বসরার একটি মক্তব থেকে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে। হাসান ইবনে হাইসাম একজন চক্ষুবিজ্ঞানী ছিলেন। দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত প্রভৃতি বিষয়ে তিনি শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। চক্ষুবিজ্ঞানবিষয়ক মৌলিক গ্রন্থ 'কিতাবুল মানাযির' তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। মধ্যযুগে আলোক বিজ্ঞানের এটি একমাত্র গ্রন্থ ছিল। 

গবেষক রোযার বেকন, নিউলার্ডো, কেপলার প্রমুখ এ গ্রন্থের ওপর নির্ভর করেই তাঁদের গবেষণা করেন। তিনি দৃষ্টিশক্তির প্রতিসরণ ও প্রতিফলন বিষয়ে গ্রিকদের ভুল ধারণা খণ্ডন করেন। তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, বাহ্যপদার্থ থেকেই আমাদের চোখে আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়। চোখ থেকে বের হওয়া আলো বাহ্যপদার্থকে দৃষ্টিগোচর করায় না। তিনিই ম্যাগনিফাইং গ্লাস আবিষ্কার করেন।

আধুনিককালের বিজ্ঞানীরা গতি বিজ্ঞানকে তাদের আবিষ্কার বলে দাবি করলেও ইবনে হাইসাম এ বিষয়ে বহু পূর্বেই বিস্তারিত বর্ণনা করেছিলেন। বায়ুমণ্ডলের ওজন, চাপ ও তাপের কারণে জড়পদার্থের ওজনেও তারতম্য ঘটে। মাধ্যাকর্ষণ বিষয়ে তিনি তাঁর গ্রন্থসমূহে বর্ণনা করেছেন। স্যার আইজ্যাক নিউটনকে (১৬৪২-১৭১৭ খ্রি.) মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কিত শক্তির আবিষ্কারক মনে করা হলেও ইবনে হাইসাম এ বিষয়ে প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। হাসান ইবনে হাইসাম ১০৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মিসরের কায়রো শহরে ইন্তিকাল করেন।

রসায়নশাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান

বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ন্যায় রসায়নশাস্ত্রেও মুসলমানদের অবদান ছিল উল্লেখ করার মতো। আল-কেমি তথা রসায়ন শাস্ত্রে মুসলিম বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান, আল কিন্দি, জুননুন মিসরি, ইবনে আবদুল মালিক আল- কাসি বিশেষ অবদান রাখেন। তাঁদের নিরলস পরিশ্রম ও অকৃত্রিম অবদানের ফলে রসায়নশাস্ত্র আজ উন্নতির উচ্চশিখরে পৌঁছেছে। চলো, আমরা তাঁদের পরিচয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।

জাবির ইবনে হাইয়ান

জাবির ইবনে হাইয়ানের পূর্ণ নাম আবু আবদুল্লাহ জাবির ইবনে হাইয়ান। তিনি আবু মুসা জাবির ইবনে হাইয়ান নামেও পরিচিত। তিনি দক্ষিণ আরবের তুস নগরে আযদ বংশে ৭২২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। গণিতশাস্ত্রে শিক্ষা লাভ শেষে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রেও শিক্ষা গ্রহণ করেন। তৎকালীন বিখ্যাত পণ্ডিত ইমাম জাফর সাদিকের অনুপ্রেরণায় তিনি রসায়ন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে গবেষণা শুরু করেন। খুব অল্প সময়ে তাঁর সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য ও বিভিন্ন পদার্থ আবিষ্কার করতে আরম্ভ করেন এবং খুব অল্প দিনের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ রসায়ন বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত হন। তিনি কুফায় একটি বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠা করে মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই গবেষণারত ছিলেন।

রসায়নকে তিনি সর্বপ্রথম বিজ্ঞানের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র, ইউক্লিড ও আল মাজেস্টের ভাষ্য, দর্শন, যুদ্ধবিদ্যা, রসায়ন, জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর অন্যতম হচ্ছে: জীবাকুশ শরকি, কিতাবুল আরকানিল আরবা, কিতাবুল আহজার, কিতাবুল কালী, কিতাবুর রাহা, কিতাবুল ফিদ্দা, কিতাবুল মিহান, কিতাবুল রিয়াদ, কিতাবুল নুহাস, কিতাবুল ইহরাক ইত্যাদি। রসায়ন ও বিজ্ঞানের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র যথা পরিস্রবণ, দ্রবণ, ভস্মীকরণ, বাষ্পীকরণ, গলানো প্রভৃতি তাঁরই আবিষ্কার। তিনি তাঁর গ্রন্থে ধাতুর শোধন, তরলীকরণ, বাষ্পীকরণ, ইস্পাত তৈরির প্রক্রিয়া, লোহার মরিচা রোধক বার্নিশ ও চুলের কলপ, লেখার কালি ও কাচ ইত্যাদি দ্রব্য প্রস্তুত প্রণালি ও বিধি সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। জাবির ইবনে হাইয়ান রসায়নশাস্ত্রের পরিপূর্ণতা দান করেছেন বিধায় তাঁকে এ শাস্ত্রের 'জনক' বলা হয়।

জাবির ইবনে হাইয়ান বস্তুজগৎকে প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত করেন। প্রথম ভাগে স্পিরিট, দ্বিতীয় ভাগে ধাতু এবং তৃতীয় ভাগে যৌগিক পদার্থ। তাঁর এ আবিষ্কারের ওপর নির্ভর করেই বিজ্ঞানীরা বস্তুজগৎকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন। যথা: বাষ্পীয়, পদার্থ ও পদার্থ বহির্ভূত। বিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে তার অবাধ বিচরণ ছিল না। তিনি সর্বদা হাতে-কলমে কাজ করতেন। প্রতিটি বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যবেক্ষণ করে তার ফলাফল লিখে রাখতেন।

জাবির ইবনে হাইয়ান প্রথম কাপূর, আর্সেনিক ও অ্যামোনিয়াম তাপ দিলে বাষ্প হওয়ার তথ্য তুলে ধরেন। মিশ্র ও যৌগিক পদার্থ সোনা, রুপা, তামা ও দস্তা চূর্ণ করা যায় বলে তথ্য প্রদান করেন। জাবির ইবনে হাইয়ান সর্বপ্রথম নাইট্রিক অ্যাসিড এবং সালফিউরিক অ্যাসিড আবিষ্কার করেন। এই দুই অ্যাসিডের মিশ্রণে তৈরি স্বর্ণ গলানোর পদার্থ 'অ্যাকোয়া রিজিয়া' নামটি তাঁর দেওয়া। জাবির ইবনে হাইয়ান স্বর্ণ ও পরশ পাথর তৈরি করতে পারতেন। জাবির ইবনে হাইয়ান ৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।

আল কিন্দি

আবু ইয়াকুব ইবনে ইছহাক আল কিন্দি ৮০১ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকের কুফায় জন্মগ্রহণ করেন। এখানেই শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেছেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য বাগদাদ যান। দর্শন নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে আল-কিন্দি নিজস্ব দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেন। এই জ্ঞানই তাকে ইসলামি গণিত থেকে ঔষধবিজ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মৌলিক গ্রন্থ ও ভাষ্য রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। গণিত ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞানকে ব্যবহার করে ডাক্তারদের জন্য একটি স্কেল নির্ধারণ করেছিলেন। এই স্কেল দিয়ে ডাক্তাররা তাঁদের প্রস্তাবিত ঔষধের কার্যকারিতা পরিমাপ করতে পারতেন। তাঁর পিতা ইছহাক খলিফা মামুনের শাসনামলে কুফার গভর্নর ছিলেন। তিনি অ্যারিস্টটলের ধর্মতত্ত্ব (Theology of Aristotle) আরবিতে অনুবাদ করেন। খলিফা মামুনের সময় জ্যোতির্বিদ, রসায়নবিদ, চিকিৎসক ও দার্শনিক হিসেবে তাঁর সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি অনধিক ৩৬৫টি গ্রন্থ রচনা করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেন। তাঁর মতে গণিত ছাড়া দর্শনশাস্ত্র অসম্ভব। দর্শন ছাড়াও তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন ও গণিত বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি মাতৃভাষা আরবি ছাড়াও পাহলবি, সংস্কৃত, গ্রিক ও সিরীয় ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। আল কিন্দি ৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।

জুন্নুন মিসরি

জুন্নুন মিসরির নাম ছাওবান, পিতার নাম ইবরাহিম। তিনি জুননুন মিসরি নামে পরিচিত। তিনি মিসরের 'আখমিম' নামক স্থানে ৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সুফি হিসেবে প্রসিদ্ধ হলেও আরব মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে রসায়নশাস্ত্রের ওপর যাঁরা প্রথম দিকে গবেষণা করেন তাঁদের অন্যতম। তিনি রসায়নশাস্ত্রের বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করেন। তাঁর লেখায় সোনা, রুপাসহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থের বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি মিসরীয় সাংকেতিক বর্ণের মর্মার্থ বুঝতেন। তিনি মিসরের আল-জিজাহ নামক স্থানে ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।

ইবনে আবদুল মালিক আল কাসি

ইবনে আবদুল মালিক আল-কাসির নাম আবুল হাকিম মুহাম্মদ ইবনে আবদুল মালিক আল-খারেজমি আল- কাসি। তিনি একাদশ শতাব্দীতে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাগদাদেই অবস্থান করতেন। তাঁর লেখা 'আইনুস সানাহ ওয়া আইওয়ানুস সানাহ' (Essence of the Art and Aid of Worker) গ্রন্থটি রসায়নশাস্ত্রে মূল্যবান একটি সংযোজন। তিনি এ গ্রন্থে রসায়নের প্রতিটি প্রয়োজনীয় শাখার সরল ও সহজ পন্থা সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছেন। যে সকল বস্তু 'সাদা' এবং যে সকল বস্তু 'লাল' এগুলোর ব্যবহার ও পার্থক্য বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন।

রসায়নশাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান অনেক। আমাদের অনেকে হয়তো জানেই না মুসলমানদের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া পৃথিবীর বড় বড় কাজকর্মের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

Content added || updated By