অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা - আদর্শ জীবনচরিত | NCTB BOOK

পরিচয়
হযরত সুলায়মান (আ.) আল্লাহর প্রসিদ্ধ নবি ছিলেন । তিনি হযরত দাউদ (আ.)-এর কনিষ্ঠ পুত্র । তিনি আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৯৭৫-৯৭০ এর মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন । যে চারজন বাদশাহ সমস্ত পৃথিবীর শাসক ছিলেন হযরত সুলায়মান (আ.) তাঁদের একজন । তিনি পরিণত বয়সে উপনীত হওয়ার পর তাঁর পিতা হযরত দাউদ (আ.) ইন্তিকাল করেন । এরপর আল্লাহ তায়ালা হযরত সুলায়মান (আ.)-কে নবি হিসেবে হযরত দাউদ (আ.) -এর স্থলাভিষিক্ত করেন এবং সমস্ত পৃথিবীর রাজত্ব দান করেন ।

অলৌকিক ক্ষমতা লাভ
নবি হিসেবে হযরত সুলায়মান (আ.)-এর বিশেষ মর্যাদা ছিল। আল্লাহ তাঁকে পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, জীব-জন্তু ও জিন-ইনসানের ভাষা বোঝার ক্ষমতা দিয়েছিলেন । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

“সে (সুলায়মান) বলল : হে মানুষ! আমাকে পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমাকে সবকিছু (জ্ঞান) দেওয়া হয়েছে । নিশ্চয়ই এটা সুস্পষ্ট অনুগ্রহ। (সূরা আন-নামল, আয়াত ১৬)

তিনি ছিলেন সুবিশাল রাজ্যের রাজা । শাসনকার্য সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে সম্পাদন করার জন্য তিনি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে যেতেন । খুব দ্রুত যাতায়াত করার জন্য মহান আল্লাহ তাঁকে বাতাসে ভর করে চলাচল করার ক্ষমতা দান করেছিলেন। বাতাসকে তাঁর অনুগত করে দিয়েছিলেন। তাঁর যখন যে স্থানে যাওয়ার প্রয়োজন হতো তিনি বাতাসকে আদেশ করলে বাতাস তাঁকে তাঁর বিশাল সিংহাসন ও লোকবলসহ মুহূর্তে সে স্থানে পৌঁছে দিত । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

অর্থ : “আমি বায়ুকে সুলায়মানের অধীন করেছিলাম। সে সকালে এক মাসের পথ অতিক্রম করত ও সন্ধ্যায় এক মাসের পথ অতিক্রম করত । (সূরা সাবা, আয়াত ১২)

আল্লাহ তায়ালা জিনদের মধ্য হতে একদলকে হযরত সুলায়মান (আ.)-এর অধীন করে দিলেন । তারা হযরত সুলায়মানের জন্য সমুদ্র হতে মুক্তা সংগ্রহ করে আনত । এ ছাড়া অন্যান্য কাজও করত। যেমন, সু-উচ্চ প্রাসাদ, চৌবাচ্চার ন্যায় বড় পেয়ালা ইত্যাদি নির্মাণ করত । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

অর্থ : (আমি অনুগত করে দিলাম) শয়তানদের, যারা সকলেই ছিল প্রাসাদনির্মাণকারী ও ডুবুরি।” (সূরা সাদ, আয়াত ৩৭)

তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যে গোয়েন্দার কাজ করতে আল্লাহ পাক তাঁকে 'হুদহুদ' নামক একটি পাখি দিয়েছিলেন। সে পাখিটি তাঁকে রানি বিলকিস ও তার রাজত্বের সংবাদ দিয়েছে। এ সবই তাঁর অলৌকিক শক্তির নিদর্শন।

বিচার শক্তি
হযরত সুলায়মান (আ.)-এর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ধী-শক্তি ছিল খুবই প্রখর। আল্লাহ তায়ালা তাকে খুব সূক্ষ্মভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি খুব বুদ্ধিমান ও প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন।

একদা দুজন নারী একটি শিশুর মাতৃত্ব দাবি করল। এর মীমাংসা করার জন্য তারা হযরত দাউদ (আ.)-এর নিকট এলো। সেখানে হযরত সুলায়মান (আ.)ও উপস্থিত ছিলেন। হযরত সুলায়মান (আ.) বললেন শিশু হলো একটি অথচ দাবিদার দুজন। তাহলে শিশুটি কেটে দুভাগ করে দুজনকে দিয়ে দেওয়া হোক । একথা বলে হযরত সুলায়মান (আ.) একটি ছুরি হাতে নিলেন। শিশুটিকে মাটিতে শুইয়ে দু'ভাগ করার জন্য উদ্যত হলেন । তখনই একজন নারী কাঁদতে কাঁদতে বললেন । আল্লাহর দোহাই! শিশুটিকে কাটবেন না আমি আমার দাবি ত্যাগ করলাম । শিশুটিকে জীবিত রাখুন এবং তাকে অপরজনের নিকট দিয়ে দিন। হযরত সুলায়মান (আ.) বুঝলেন এ নারীই শিশুটির প্রকৃত মাতা । তখন তিনি তাকে শিশুটি দিয়ে দিলেন এবং অন্যজনকে মিথ্যা বলার দায়ে শাস্তি দিলেন।

বালক বয়সে হযরত সুলায়মান (আ.)-এর আরও একটি ঘটনা হলো- একদা দুজন লোক হযরত দাউদ (আ.)- এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বিচারপ্রার্থী হলো। তাদের একজন ছিল রাখাল অপরজন কৃষক। কৃষক তথা শস্যক্ষেতের মালিক ছাগল রাখালের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল যে, রাখালের ছাগল রাতে ছাড়া পেয়ে তার সমস্ত ফসল বিনষ্ট করে ফেলেছে। সত্যতা যাচাই করার পর হযরত দাউদ (আ.) রায় দিলেন যে, ছাগলের মালিক তার সমস্ত ছাগল শস্যক্ষেতের মালিককে অর্পণ করুক। মামলার বাদী-বিবাদী উভয়ে রায় শুনে দরবার হতে যাওয়ার পথে হযরত সুলায়মান (আ.)-এর সাথে দেখা হলে তিনি সব শুনে বললেন-আমি রায় দিলে তা ভিন্ন হতো, উভয় পক্ষের উপকার হতো। হযরত সুলায়মান (আ.) তাঁর পিতার নিকট তা ব্যক্ত করার পর তাঁর পিতা বললেন এর চাইতে উত্তম রায় কী হতে পারে? হযরত সুলায়মান (আ.) বললেন আপনি সমস্ত ছাগল শস্যক্ষেতের মালিককে দিয়ে দিন। সে এগুলোর দুধ, পশম দ্বারা উপকৃত হোক। আর শস্যক্ষেত ছাগলের মালিকের নিকট অর্পণ করুন। সে তাতে চাষাবাদ করে শস্য উৎপাদন করবে। যখন শস্যক্ষেত ছাগলে বিনষ্ট করার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে তখন তা তার মালিককে বুঝিয়ে দেবে। হযরত দাউদ (আ.) এ রায় পছন্দ করলেন এবং তা কার্যকর করতে বললেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন-

“এবং আমি সুলায়মানকে এ বিষয়ের মীমাংসা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম এবং তাদের প্রত্যেককে আমি দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান ।” (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ৭৯)

বাইতুল মুকাদ্দাস পুনঃনির্মাণ
হযরত সুলায়মান (আ.)-এর পিতা হযরত দাউদ (আ.) বাইতুল মুকাদ্দাস পুনঃনির্মাণের কাজ সমাপ্ত করার আগে ইন্তিকাল করেন। ইন্তিকালের আগে তিনি দোয়া করেছিলেন যে, হে আল্লাহ! আমার সন্তানের দ্বারা তা নির্মাণ করাও। আল্লাহ তায়ালা তাঁর দোয়া কবুল করলেন। জেরুজালেমের ক্ষমতা গ্রহণ করে হযরত সুলায়মান (আ.) বাইতুল মুকাদ্দাসের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। এ মসজিদ নির্মাণে ৩০ হাজার শ্রমিকের ৭ বছর সময় লেগেছিল বলে কথিত আছে। মূলত জিন জাতিরাই এ মসজিদ পুনঃনির্মাণ করেছিল।

রাজত্বকাল ও ইন্তিকাল
হযরত সুলায়মান (আ.) ৪০ বছর নবুয়তি দায়িত্ব পালন করেন এবং সমগ্র বিশ্বের রাজত্ব করেন । তার শাসনকাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৯৬০-৯২০ সাল পর্যন্ত । তাঁর ইন্তিকালের ঘটনা বিস্ময়কর। বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মাণের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা ছিল অবাধ্য একদল জিন। তারা হযরত সুলায়মান (আ.)-এর ভয়ে কাজ করত । কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের আগে বাইতুল মুকাদ্দাসের কাজ শেষ হবে না আর তাঁর ইন্তিকালের সংবাদ জানলে জিনরাও কাজ করবে না । ফলে বাইতুল মুকাদ্দাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে । তাই হযরত সুলায়মান (আ.) উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে আল্লাহর নির্দেশে ব্যবস্থা নিলেন যে, মৃত্যুর পূর্বক্ষণে তিনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে তাঁর স্বচ্ছ কাঁচের নির্মিত মেহরাবে (বিশেষ কক্ষে) প্রবেশ করলেন। তিনি নিয়ম অনুযায়ী ইবাদতের উদ্দেশ্যে লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। যথাসময়ে তাঁর আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে গেল । কিন্তু লাঠির উপর ভর করে তাঁর দেহ অনড় থাকায় বাইরে থেকে মনে হতো তিনি ইবাদতরত আছেন । জিনেরা তাঁকে জীবিত মনে করে দিনের পর দিন কাজ করতে থাকে। এমতাবস্থায় এক বছর অতিক্রান্ত হয়। এর মাঝে বাইতুল মুকাদ্দাসের কাজও সমাপ্ত হয়। অন্য দিকে আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত সুলায়মান (আ.)-এর লাঠি উঁই পোকায় খেয়ে ফেলে।

লাঠি পড়ে গেলে হযরত সুলায়মান (আ.)-এর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে । তখন সবাই জানতে পারল যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছে । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৫৩ বছর। আল্লাহর বাণী-

“যখন আমি তার (সুলায়মানের) মৃত্যু ঘটালাম তখন জিনদিগকে তার মৃত্যুর বিষয়ে জানাল কেবল মাটির পোকা, যা তার লাঠি খেয়েছিল । (সূরা আল-সাবা, আয়াত ১৪)

তাঁকে জেরুজালেমের কুব্বাতুস্সাখারে দাফন করা হয়। জ্ঞানবুদ্ধির আলোকে মানবিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় যে উদাহরণ হযরত সুলায়মান (আ.) আমাদের শিখিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে অনুকরণীয়।

কাজ : শিক্ষার্থীরা হযরত সুলায়মান (আ.)-এর একটি সূক্ষ্ম বিচার সম্পর্কে অনুচ্ছেদ লিখে শিক্ষককে দেখাবে।
Content added || updated By