চতুর্থ শ্রেণি (প্রাথমিক) - ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা - নবি-রাসুলগণের পরিচয় ও জীবন আদর্শ | NCTB BOOK

হযরত মূসা (আ) ছিলেন একজন বিখ্যাত নবি। তাঁর পিতার নাম ইমরান। মাতার নাম ইউখাবেজ। তিনি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০৪০ অব্দে মিশরে বনি ইসরাইল বংশে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাচীনকালে মিশরের বাদশাহকে ফিরআউন বলা হতো। তাদের মধ্যে এক ফিরআউনের নাম ছিল ওলীদ। ওলীদ ছিল খুব লোভী। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল নিজেকে উপাস্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। সে তার মন্ত্রী ও বন্ধু হামানের পরামর্শে রাজ্যের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিল। জনগণ ধর্ম ও জ্ঞানচর্চা ভুলে মূর্খে পরিণত হলো। সুযোগ বুঝে সে নিজেকে উপাস্য বলে ঘোষণা করল। কিবতী বংশ তার অনুগত ছিল, তারা তাকে পূজা করতে শুরু করল। কিন্তু বনি ইসরাইল বংশ তখনও হযরত ইউসূফ (আ) এর একত্ববাদের ধর্ম মেনে চলত। তারা ফিরআউনকে খোদা বলতে সম্মত হলো না । ফিরআউন ও কিবতী বংশ বনি ইসরাইলদের উপর কঠিন নির্যাতন চালাতে লাগল। এরই মধ্যে ওলীদ স্বপ্নে দেখল যে, বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে এক ঝলক আগুন বের হয়ে এসে তার রাজপ্রাসাদসহ গ্রাস করছে। তার অনুসারী কিবতী বংশকেও জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বনি ইসরাইলগণ সম্পূর্ণ নিরাপদ। আগুন তাদের স্পর্শ করছে না। ফিরআউন রাজ্যের গণকদের ডেকে এর ব্যাখ্যা জানতে চাইল। বালআম বাউর নামে এক গণক বলল, “ইসরাইল বংশে একটি পুত্র শিশু জন্মগ্রহণ করবে। সে আপনার ও আপনার রাজত্বের ধ্বংসের কারণ হবে এবং কিবতী বংশ ধ্বংস হবে।” স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে ফিরআউন তার সিংহাসন থেকে লাফিয়ে উঠল। সে রাজ্যময় সৈন্যদের পাহারা নিযুক্ত করল এবং জন্মগ্রহণকারী সকল ইসরাইলি শিশুপুত্রকে হত্যার নির্দেশ দিল। সৈন্যরা গর্ভবতী মহিলাদের তালিকা তৈরি করল। আর জন্মগ্রহণকারী পুত্রসন্তানকে হত্যা করতে লাগল। এভাবে অসংখ্য ইসরাইলি শিশুপুত্র ফিরআউনের লোকদের হাতে নিহত হলো ।

জন্ম 

হযরত মূসা (আ)-এর মাতা গর্ভধারণ করেছিলেন। আল্লাহর কুদরতে ফিরআউনের লোকেরা তা বুঝতেই পারে নি। তাঁর জন্ম হলো। মা ফিরআউনের ভয়ে শিশু মূসাকে একটি সিন্ধুকে ভরে আল্লাহর নির্দেশে নদীতে ভাসিয়ে দিলেন। আল্লাহর কুদরতে সিন্ধুকটি ভাসতে ভাসতে নদীর তীরবর্তী ফিরআউনের রাজপ্রাসাদের ঘাটে গিয়ে ভিড়লো। ফুটফুটে মায়াভরা চেহারার শিশুটিকে দেখে ফিরআউনের স্ত্রী হযরত আছিয়া কোলে তুলে নিলেন। আছিয়া ছিলেন ইসরাইলি কন্যা। তিনি এক আল্লাহতে বিশ্বাস করতেন। ফিরআউন তাঁকে জোর করে বিয়ে করেছিল। শিশু মূসা (আ) অন্য কারও দুধ পান না করায় হযরত মূসা (আ)-এর বড়বোন মরিয়মের পরামর্শে মূসা (আ)-এর মাকেই ধাত্রী নিয়োগ করা হলো। আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরতে মূসা (আ) ফিরআউনের ঘরে, তারই অর্থব্যয়ে মায়ের কোলে লালিত পালিত হতে লাগলেন ।

মাদইয়ান বা মাদয়ান গমন 

একবার মূসা (আ) দেখতে পেলেন কিবতী বংশীয় ফিরআউনের এক বাবুর্চি এক ইসরাইলী কাঠুরিয়ার প্রতি অত্যাচার করছে। তিনি ইসরাইলিকে বাঁচাবার জন্য কিবতীকে একটি ঘুষি মারলেন। এতে সে মারা যায়। পরের দিনও অনুরূপ ঘটনা ঘটল। আর এক কিবতী আগের দিনের ইসরাইলির উপর অত্যাচার করছিল। মূসা (আ) এগিয়ে গেলে ইসরাইলী ভয় পেয়ে পূর্বদিনের ঘটনা বলে দেয়। কিবতী এসে ফিরআউনকে খবর দিল যে, কিবতীর হত্যাকারী মূসা (আ)। ফিরআউন মূসা (আ)-এর দণ্ড ঘোষণা করল । এ ঘটনা জানতে পেয়ে মূসা (আ) মিশর ছেড়ে লোহিত সাগরের পূর্বতীরে মাদয়ান চলে যান। সেখানে তিনি বিখ্যাত নবি হযরত শুআইব (আ)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। হযরত শুআইব (আ) মূসা (আ)-এর খেদমত,কর্মদক্ষতা ও চারিত্রিক গুণে মুগ্ধ হয়ে তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা সফুরাকে তাঁর সাথে বিয়ে দেন। সেখানে তিনি দশ বছর কাটান। এ সময় তিনি বকরিও চরিয়েছেন।

নবুয়ত লাভ

হযরত মূসা (আ) স্ত্রী সফুরা এবং খাদেম ও মেষ-বকরি পাল নিয়ে মায়ের সাথে দেখা করার জন্য মাদইয়ান থেকে মিশর যাত্রা করলেন। পথে আগুনের খুব প্রয়োজন ছিল। দূর থেকে আলো দেখে তিনি আগুনের খোঁজে তুর পাহাড়ের কাছে গেলেন। তিনি পাহাড়ের পাদদেশে ‘তুয়া’ নামক পবিত্র উপত্যকায় নবুয়ত লাভ করেন।

 আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বললেন, “আমি তোমাকে মনোনীত করেছি। অতএব যা আদেশ করা হয় তা শুনতে থাক।”- সূরা ত্বাহা: ১৩ 

এ সময় আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (আ)-এর সাথে সরাসরি কথা বলেছিলেন। এজন্য তিনি ‘কালিমুল্লাহ' উপাধিতে ভূষিত হন।

আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসাকে (আ) ফিরআউনের নিকট গিয়ে দীনের দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। হযরত মূসা (আ) আল্লাহর কাছে তাঁর দুর্বলতা ও অসুবিধার কথা জানিয়ে দোয়া করলেন। তিনি যেন তাঁকে সাহস দেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কাজ সহজ করে দেন এবং তার মুখের জড়তা দূর করে দেন। যাতে লোকেরা তাঁর কথা বুঝতে পারে। তিনি তাঁর ভাই হারুন(আ) কেও সহযোগী হিসাবে চাইলেন, আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রার্থনা কবুল করলেন।

হযরত মূসা (আ) তাঁর ভাই হারুন (আ) কে নিয়ে ফিরআউনের কাছে গিয়ে দীনের দাওয়াত দিলেন। তিনি আল্লাহর দেওয়া অলৌকিক ঘটনাও দেখালেন। কিন্তু ফিরআউন কিছুতেই ইমান আনল না। বরং সে হযরত মূসা (আ) কে হত্যা করার সংকল্প করল।

দলবলসহ ফিরআউনের ধ্বংস

হযরত মূসা (আ) ফিরআউনের কুমতলব জানতে পেরে ইসরাইলিদের নিয়ে মিশর ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। সংবাদ পেয়ে ফিরআউন তার সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের পিছু ধাওয়া করল। মূসা (আ) তাঁর অনুসারীদের নিয়ে নীলনদের তীরে উপস্থিত হলেন । সামনে নীলনদ ও পেছনে ফিরআউন বাহিনী।

এমতাবস্থায় আল্লাহ তায়ালার আদেশে হযরত মূসা (আ) হাতের লাঠি দ্বারা নদীতে আঘাত করলেন। পানি দুই ধারে সরে গেল। বনি ইসরাইলের ১২টি দলের জন্য ১২টি রাস্তা হয়ে গেল। হযরত মূসা (আ) তাঁর লোকজনসহ নিরাপদে নদী পার হয়ে গেলেন। ফিরআউন নদীতে শুকনা রাস্তা দেখে সে রাস্তা ধরেই পার হতে লাগল । যেই না তারা নদীর মাঝখানে পৌছল, অমনি রাস্তা নদীর পানিতে মিলিয়ে গেল। ফিরআউন তার দলবলসহ ডুবে মরল । আল্লাহর নবিকে ধ্বংস করতে গিয়ে নিজেই সদলবলে ধ্বংস হলো।

হযরত মূসা (আ)-এর তাওরাত লাভ

হযরত মূসা (আ) আল্লাহর নির্দেশে তাওরাত কিতাব আনার জন্য তুর পাহাড়ে গেলেন। সেখানে তিনি ইবাদতে নিমগ্ন ছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে সামেরী নামক এক ব্যক্তির ধোঁকায় পড়ে অনুসারীদের অনেকেই গো-বৎস পূজায় জড়িয়ে পড়ল। হযরত মূসা (আ) তাওরাত নিয়ে ফিরে এসে এ অবস্থা দেখে ভীষণ ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হলেন। তওবা হিসাবে গো-বৎস পূজারিদের হত্যার নির্দেশ হলো। এতে সত্তর হাজার বনি ইসরাইল নিহত হলো। হযরত মূসা (আ) ও হযরত হারুন (আ)-এর কান্নাকাটিতে অবশিষ্টদের ক্ষমা করা হলো। হযরত মূসা (আ) ১২০ বছর জীবিত ছিলেন।

 

Content added By

Promotion