নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - অর্থনীতি - বাংলাদেশ সরকারের অর্থব্যবস্থা | NCTB BOOK

বাংলাদেশ একটি নিম্নমধ্যম আয়ের জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, দেশ রক্ষা ও পরিচালনা এবং জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য প্রতিবছর সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করে । গণতন্ত্রের উন্মেষ ও উন্নয়নের ফলে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের পরিধি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে অনেক নতুন নতুন খাতও ব্যয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ।
বাংলাদেশ সরকারের ব্যয়ের প্রধান খাতসমূহ

১. শিক্ষা ও প্রযুক্তি
সরকার মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ ও গুণগত মান উন্নয়ন, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, নারী শিক্ষার উন্নয়ন, ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা বিকাশে বৃত্তিসংখ্যা ও হার বৃদ্ধি এবং উচ্চশিক্ষার প্রসারে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। শিক্ষার সাথে প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটিয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার প্রতিবছর তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয় করে।
দেশকে বিদেশি শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম ক্রয়, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ, বেতন ভাতা, বাসস্থান ও চিকিৎসা প্রভৃতি প্রদানের জন্য সরকার এ খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। জাতীয় নিরাপত্তার কারণে এ খাতে অনেক ব্যয় বরাদ্দ অপ্রকাশিত থাকে।

৩. জনপ্রশাসন
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকারকে জনপ্রশাসন পরিচালনা করতে হয়। প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগে নিয়োজিত কর্মকর্তা- কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং অফিস পরিচালনা বাবদ সরকারকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৪. জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা
অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ বাহিনীসহ অন্যান্য আখা সামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে ও পরিচালনা করতে এবং তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাবদ সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৫. কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প ও কৃষি গবেষণা
বাংলাদেশ সরকার কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বাজেট বরাদ্দের পাশাপাশি কৃষি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি এবং ঋণ বিতরণ করছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশ সরকার প্রথম কৃষি গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেওয়া শুরু করেছে।
৬. জনস্বাস্থ্য
জনগণের সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন, বিনামূল্যে ওষুধ প্রদান, মহামারী প্রতিরোধ, ডাক্তার ও নার্সের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি খাতে সরকারকে অর্থ ব্যয় করতে হয়। চিকিৎসাসেবা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্থাপন এবং সেখানে একজন করে এম.বি.বি.এস ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দিয়েছে। যার ফলে এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
৭. সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ
অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবনধারণের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে বাংলাদেশ সরকার সামর্থ্য অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচী, যেমন : বয়স্কভাতা কর্মসূচি, বিধবাভাতা, এসিডদগ্ধ নারী ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মানীভাতা, প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণে সৃষ্ট সাময়িক বেকারত্ব নিরসন, তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মচারীদের দক্ষতা উন্নয়ন তহবিল এবং বাস্তুহারা গৃহায়ণ তহবিল, একশ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচি, একটি বাড়ি একটি খামার এবং গরিব-দুস্থদের মাঝে রেশনিং কাজে সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করে থাকে ।৮. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি
বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ ও সঞ্চালন বৃদ্ধিকরণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন তহবিল গঠন প্রভৃতি খাতে প্রতিবছর সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৯. পরিবহন ও যোগাযোগ
বাংলাদেশের যাতায়াত, যোগাযোগ ও পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সরকার যোগাযোগ, সড়ক, রেলপথ, নৌপরিবহন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে এবং সেতু বিভাগের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ।
১০. দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান
'ন্যাশনাল সার্ভিস' প্রকল্পের মাধ্যমে বর্তমান সরকার দুই বছরের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় স্বল্প শিক্ষিত, কর্মঠ ও বেকার যুবকদের জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে নানারূপ কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচি (টিআর), খয়রাতি সাহায্য (জিআর), ভিজিএফ ও ভিজিডি বাবদ প্রতিবছর ১০ লাখ মেট্রিক টনের অধিক খাদ্যশস্য বিতরণ করছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করছে । এসব খাতে সরকারের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
১১. ঋণ ও সুদ পরিশোধ
সরকার দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস হতে প্রচুর পরিমাণে ঋণ গ্রহণ করে। এসব ঋণ এবং ঋণের সুদ পরিশোধ করতে সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।

১২. শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবাসমূহ
দেশের শিল্প এবং অর্থনৈতিক বিভিন্ন সেবা খাতের উন্নয়নের জন্য সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার এই ব্যয় করে থাকে । ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎসাহিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক একটি পুন-অর্থায়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
১৩. পরিবেশ ও বন
পরিবেশ সংরক্ষণ-মানোন্নয়ন, শিল্পদূষণ থেকে রক্ষা, তরল বর্জ্য উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানে বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন ইত্যাদি নানামুখী কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য সরকার পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে অর্থ ব্যয় করে ।
১৪. বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম
সরকার দেশের তথ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং যুব ও ক্রীড়ার উন্নয়নে প্রতিবছর অনেক অর্থ ব্যয় করে থাকে ।
১৫. স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়ন
স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয় ।
উল্লিখিত খাতগুলো ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার আরও কয়েকটি খাতে ব্যয় করে, যেমন- মহিলা ও শিশু, পানিসম্পদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, গৃহায়ণ, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার রাজস্ব বা অনুন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ প্রায় ৫৫টি খাতে এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় প্রতিবছর প্রায় ১৮টি খাতে ব্যয় করে থাকে । আধুনিক কল্যাণকামী রাষ্ট্র ধারণার আলোকে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে, অনুন্নয়নমূলক খাতে সরকারি ব্যয় হ্রাস করে উন্নয়নমূলক খাতে সরকারি ব্যয়ের পরিধি আরও প্রসারিত করা উচিত ।

Content added || updated By