বাংলা অঞ্চল ও বাংলাদেশ: রাজনৈতিক ইতিহাসের বৈচিত্র্যময় গতিপথ
প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলা অঞ্চলের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার ইতিহাস অনুসন্ধান করব আজ আমরা। দীর্ঘ এই আলাপের মধ্য দিয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা করব কীভাবে রাষ্ট্র নামের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়েছে, কী ধরনের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। আমরা আরও অনুধাবন করব, রাষ্ট্র ও শাসক শ্রেণির সঙ্গে ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে মানুষের সম্পর্ক কেমন ছিল এবং কী ধরনের প্রতিকূলতা মানুষ জয় করেছে।
সাধারণ মানুষের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সেই সব বিপ্লব আর বিদ্রোহে জনমানুষের অনেক নেতাই নেতৃত্ব দিয়েছেন। হাজার বছরে গড়ে ওঠা রাজনীতি আর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তাঁদের হাত ধরেই এসেছে পরিবর্তন। মানুষের সামগ্রিক কল্যাণে নিজেদের জীবন পর্যন্ত তাঁরা বিলিয়ে নানান উত্থান-পতন আর ভাঙা- গড়ার অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। বাংলা অঞ্চলের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ এবং দৃষ্টান্তমূলক এই ঘটনার যিনি রূপকার তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একমাত্র নেতা যিনি বাংলা অঞ্চলের কাদা- মাটি, নদী-নালা, বিল, হাওর-বাঁওড়, বৃষ্টি আর সবুজের ভেতর দিয়ে ওঠে এসে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর আগে বাংলার ইতিহাসে এই ভূখণ্ড থেকে ওঠে আসা আর কোনো নেতা সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য, সকল ধর্মের সকল মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করেন নি। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এক অতি সাধারণ পরিবারের সন্তান শেখ মুজিবই সর্বপ্রথম ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য
বাংলা অঞ্চলে প্রাচীন জনপদ: রাজনীতির সূচনা
ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাংশ তথা বাংলা অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ছোটো ছোটো অনেক ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক পরিচয় গড়ে উঠতে শুরু করে। একক ও ঐক্যবদ্ধ কোনো রাজ্য বাংলা অঞ্চলে ছিল না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নাম-পরিচয়গুলোকে বলা হয় জনপদ বা ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক একক। জনপদগুলো গড়ে উঠেছিল বাংলায় আর্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের আগমনের বহু আগেই। প্রাচীনকালে লিখিত বৌদ্ধ ও সংস্কৃত গ্রন্থগুলো থেকে আমরা যে কটি জনপদের নাম জানতে পারি, তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটির পরিচয় সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক।
বঙ্গ
বঙ্গ নামক কোনো একটি কৌম বা জনগোষ্ঠীর হাত ধরে বঙ্গ জনপদের জন্ম হয়েছিল বলে জানা যায়। এই শব্দের অর্থ 'জলাভূমি' বা 'কার্পাস তুলা'। তবে বাংলার মতো জল-কাদা ও জঙ্গলের ভূখণ্ডে মানুষের টিকে থাকার লড়াইয়ে এই জনগোষ্ঠী বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিল। মহাকবি কালিদাসের লেখা থেকে জানা যায়, নৌযুদ্ধে বঙ্গীয়রা ছিল খুবই দক্ষ। বাংলার জলভিত্তিক সক্রিয় ব-দ্বীপ এলাকা তথা, বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা-ফরিদপুরের বৃহত্তর এলাকায় প্রাচীন বঙ্গ জনপদ গড়ে উঠেছিল। এর সীমানা কখনো কখনো পশ্চিম দিকেও সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের প্রধান অংশটি অতীতের বিভিন্ন কালপর্বে বঙ্গের আওতাভুক্ত ছিল।
পুণ্ড্র
পুণ্ড্র বাংলার আরেকটি প্রাচীনতম জনপদ। পুন্ডু নামের একটি জনগোষ্ঠীর থেকেই এই জনপদের উৎপত্তি। এই জনপদের কেন্দ্র ছিল পুণ্ড্রনগর। এই পুণ্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রাপ্ত প্রত্নস্থল বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে। পুণ্ড্র জনপদেরই একটি অংশের নাম প্রাচীনকালে বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিল। তোমরা জেনে আনন্দ পাবে যে, প্রাচীনকালে এই পুণ্ড্র শব্দটির অর্থ ছিল ইক্ষু বা আখ।
রাঢ়
বাংলা অঞ্চলের পশ্চিমে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদীর উভয় তীরের এক বিস্তৃত জনপদ হিসেবে ছিল এর অবস্থান। দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত এই জনপদ বিস্তৃত ছিল। এই রাঢ়েই আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে তাম্র-প্রস্তর যুগের সূচনা ঘটেছিল। অজয় নদের তীরে পাণ্ডু রাজার ঢিবি নামে পরিচিত স্থানে বাংলার আদি মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতি রচনার সর্বপ্রথম নিদর্শন পাওয়া গেছে। আবার রাঢ় এলাকাতেই আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে তাম্রলিপ্তি নামে একটি নৌ এবং সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠেছিল। বাংলার সবচেয়ে পুরোনো এই বন্দর ধরে বাংলার শস্য, বস্ত্র, সুগন্ধি মসলা গ্রিসসহ বর্তমান ইউরোপের নানান স্থানে রপ্তানি হতো।
সমতট
সমতট ছিল বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাংশের জনপদ। মেঘনা নদীর পূর্ব তীর থেকে শুরু করে বর্তমান কুমিল্লা- নোয়াখালী-চট্টগ্রাম এবং ভারতের ত্রিপুরার প্রধান অংশ নিয়ে এই জনপদ গড়ে উঠেছিল। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে সুয়ান জাং (হিউয়েন সাং) নামে একজন চৈনিক পর্যটক বাংলায় এসেছিলেন। তাঁর লেখা ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে আমরা জানতে পারি, প্রাচীন সমতট ছিল বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রধান একটি কেন্দ্র। এখানে তিনি অনেক স্থাপনা দেখেছিলেন। এই স্থাপনাগুলোকে বলা হতো বিহার। বিহারগুলোতে বৌদ্ধধর্মের ভিক্ষুরা বসবাস করতেন, ধর্ম এবং জ্ঞান চর্চা করতেন।
বাংলার প্রাচীন এই জনপদগুলোর কথা আমরা জানতে পারি প্রধানত বৈদিক সাহিত্য থেকে। বৈদিক সাহিত্য রচিত হয়েছিল আর্য ভাষার মানুষের হাতে। এসব গ্রন্থে বাংলার প্রাচীন জনপদের কথা এলেও খুব সম্মানজনকভাবে আসেনি। অধিকাংশ কেন এই রকম বলা হয়েছে জানো? পণ্ডিতগণ বলে থাকেন, প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে যখন আর্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করছিলেন তখন এই অঞ্চলে অনেক আগে থেকে যাঁরা বসবাস করছিলেন তাঁদের বাধার মুখে তাঁরা পড়েছিলেন। আধিপত্য বিস্তারে এই দ্বন্দ্বের কারণেই সেই সময়ের সংস্কৃত সাহিত্যে বাংলা অঞ্চলের মানুষদের তুচ্ছ করে দেখানো হয়েছে।
যাহোক, আর্যদের মধ্য থেকেই একসময় মৌর্য, গুপ্ত প্রভৃতি শক্তিশালী রাজবংশের উত্থান ঘটে। এইসব রাজশক্তির হাত ধরে বাংলায় আর্য ভাষাগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বা বৈদিক সংস্কৃতি প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে এইসব জনপদের নগরকেন্দ্রিক মানুষের ওপরও আর্য ধর্ম ও ভাষা-সংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
বাংলা অঞ্চলে মৌর্য ও গুপ্তদের রাজনীতি ও ক্ষমতা সম্প্রসারণ
মৌর্যদের পর উত্তর ভারতে শক্তিশালী সাম্রাজ্য স্থাপন করেন গুপ্ত বংশের সম্রাটগণ। এই বংশের সম্রাটদের মধ্যে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখ নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মৌর্যদের মতো গুপ্তরাও রাজ্য সম্প্রসারণবাদী নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। চতুর্থ শতকের মাঝমাঝি সময়ে সমুদ্রগুপ্ত বাংলা অঞ্চলে সৈন্য অভিযান পরিচালনা করে বঙ্গ, পুণ্ড্র প্রভৃতি জনপদ নিয়ন্ত্রণে নেন। সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় মেঘনা নদীর পূর্ব তীরে সমতট পর্যন্ত গুপ্তদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছিল বলে গুপ্তদের বিভিন্ন উৎস হতে জানা যায়।
শাসনকাজ পরিচালনার জন্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্র থেকে সম্রাট বড়ো বড়ো যোদ্ধা এবং সেনাপতিদের পাঠাতেন। উচ্চপদস্থ এই প্রশাসকেরা বাইরে থেকে এসে বাংলা অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। তাঁদের পাশাপাশি আসতেন নতুন ধর্ম-সংস্কৃতি আর অনেক বিদ্বান, পুরোহিত, ব্যবসায়ী মানুষজন। রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি নতুন ধর্ম-সংস্কৃতি বিস্তারেও তারা কাজ করতেন। এভাবে দীর্ঘকাল চলতে থাকে। কোনো এক সময় কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যে গোলযোগ দেখা দিলে কিংবা সম্রাট দুর্বল হয়ে পড়লে বাংলা অঞ্চলের উচ্চপদস্থ সামরিক ব্যক্তিদের অনেকেই নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা দিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলতেন। বাংলা অঞ্চলে যেসব রাজার নাম তোমরা পাবে তাদের অধিকাংশই দেখবে বাংলা ভূখণ্ডের সীমানার বাইরে বহুদূর থেকে এই অঞ্চলে প্রবেশ করেছেন। তার মানে কী জানো? তার মানে হচ্ছে, বাংলায় আদি যে অধিবাসীরা ছিলেন রাজক্ষমতা তাঁদের হাতে ছিল না। তাঁরা ছিলেন সাধারণ। প্রতিকূল প্রকৃতি আর নিজেদের বাঁচিয়ে জীবন-ধারণ করাই ছিল তাঁদের জন্য সবচাইতে বড়ো চ্যালেঞ্জ। বাংলা অঞ্চলে তাই যখনই কোনো রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তার নেতৃত্ব দিয়েছেন বাইরের অঞ্চল থেকে আসা কোনো কোনো যোদ্ধা।
বাংলা অঞ্চল: গুপ্ত পরবর্তীকালীন রাজনৈতিক অবস্থা
ষষ্ঠ শতকের শেষ দিকে উত্তর ভারতকেন্দ্রিক গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন হয়। কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে কেন্দ্র থেকে দূরের রাজ্যগুলো তখন আবারও স্বাধীন হতে শুরু করে। এই সময় ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশের মতো পূর্বাংশ তথা বাংলা অঞ্চলেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যসত্তা গড়ে ওঠার খবর পাওয়া যায়। বঙ্গ তেমনই একটি রাজ্যসত্তা হিসেবে বিকশিত হয়েছিল। বঙ্গ রাজ্যের উত্থান হয়েছিল গোপচন্দ্র নামে একজন শাসকের হাত ধরে ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয় দশকে। রাজ্যটির কেন্দ্রস্থল ছিল বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায়। আর খুব সম্ভবত বিস্তৃত ছিল গঙ্গা নদীর দুই স্রোতোধারা অর্থাৎ পদ্মা ও ভাগীরথী নদীর অন্তর্বর্তী ভূভাগের প্রধান অংশে। এই হিসেবে বঙ্গ রাজ্যের সীমানা বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা, ফরিদপুর, যশোরের বৃহত্তর এলাকা এবং বর্তমান ভারতের পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাংশব্যাপী বিস্তৃত হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদ বিএন মুখার্জী গবেষণা করে জানিয়েছেন। গোপচন্দ্র ছাড়াও ধর্মাদিত্য, সমাচারদেব, দ্বাদশাদিত্য, সুধন্যাদিত্য ছিলেন বঙ্গ রাজ্যের পাঁচ জন রাজা। তাঁদের জারি করা তাম্রশাসন ও মুদ্রা পাওয়া গেছে। আনুমানিক ৫২৫ থেকে ৬০০ সালের মধ্যে এই সকল রাজা বঙ্গের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।
গৌড় নামে আরেকটি রাজ্যসত্তার উত্থান ঘটেছিল সপ্তম শতকের শুরুর দিকে রাজা শশাঙ্কের হাত ধরে। গৌড় রাজ্যের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ যা এখন বর্তমান ভারতের পশ্চিম বাংলা প্রদেশের মুর্শিদাবাদ জেলায় খুঁজে পাওয়া যাবে। এই গৌড় রাজ্যসত্তার অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলা অঞ্চলের উত্তরাংশ এবং পশ্চিমাংশের বিস্তৃত এক এলাকা; যার মধ্যে ছিল বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুরের এলাকাসমূহ এবং বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ এবং বিহারের অংশবিশেষ। তবে হ্যাঁ, বঙ্গ এবং গৌড়ের সীমানা যে সব সময়
একই ছিল তা কিছুতেই বলা যাবে না। রাজাদের শক্তি ও ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সীমানাও বদল হয়ে যেত। কখনো এসব রাজ্যের রাজারা অভিযান চালিয়ে নতুন এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন, আবার কখনো অন্য এলাকার রাজাদের আক্রমণের ফলে নিজ রাজ্যের সীমানা সংকুচিত হয়েছে।
শশাঙ্কের রাজত্বের আনুমানিক বিস্তার
এই কৃতিত্বের পাশাপাশি শশাঙ্ক নিজের শক্তি প্রদর্শনের জন্য তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা-কেন্দ্র মগধ, উৎকল এবং কঙ্গোদের দিকেও সৈন্য পরিচালনা করেছিলেন বলে তাম্রশাসন, মুদ্রা এবং অন্যান্য সাহিত্যিক উৎস থেকে জানা যায়। শশাঙ্ককে বাংলা অঞ্চলের প্রথম সাম্রাজ্যবাদী শাসক বলা যেতে পারে। নিজের রাজ্যের বাইরে উত্তর ভারতের দিকে সৈন্য পরিচালনার মাধ্যমে তিনি সাম্রাজ্যবাদের সূচনা করেছিলেন। শশাঙ্কের পর বাংলার পাল বংশের শাসক ধর্মপাল এবং দেবপালও একইভাবে সাম্রাজ্যবাদী কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছিলেন। মগধ এবং কনৌজে আধিপত্য বিস্তার করে নিজেদের আধিপত্য বৃদ্ধিতে এবং গৌরব প্রচারে তৎপর হয়েছিলেন।
মাৎস্যন্যায় ও পাল রাজাদের রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল বাংলা অঞ্চলে শক্তিশালী কোনো শাসক ছিলেন না। এর ফলে বাংলায় বহিঃশক্তির আক্রমণ শুরু হয়। বাংলার অভ্যন্তরেও সামন্তরাজারা একে অন্যকে হত্যা করে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এর ফলে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রায় একশ বছর ধরে চলমান এই অরাজকতা ইতিহাসে 'মাৎস্যন্যায়' নামে পরিচিত। পুকুরে বড়ো মাছ ছোটো মাছকে ধরে গিলে ফেলার মতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে বলে মাৎস্যন্যায়। শব্দটি প্রথম কৌটিল্য তাঁর 'অর্থশাস্ত্র' গ্রন্থে ব্যবহার করেছিলেন। যাহোক, এই অরাজকতার অবসান হয় অষ্টম শতকের মধ্যভাগে গোপাল নামে একজন শাসকের হাত ধরে বাংলায় পাল বংশের উত্থানের মধ্য দিয়ে। এই বংশের রাজারা সাধারণভাবে বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।'
পাল বংশের শাসকদের মধ্যে ধর্মপাল, দেবপাল, প্রথম মহীপাল এবং রামপালের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গোপালের মৃত্যুর পর ৭৮১ সালে তাঁর পুত্র ধর্মপাল ক্ষমতায় আরোহণ করেন। পাল বংশের অন্যতম ক্ষমতাধর রাজা বলা হয় তাঁকে। ধর্মপালের রাজত্বকালে পাল বংশ এতই ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে যে, উত্তর ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশ এবং রাজপুতনার গুর্জরপ্রতিহার বংশের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। ক্ষমতা প্রদর্শন ও আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াই ইতিহাসে 'ত্রিশক্তির সংঘর্ষ' নামে পরিচিত। এই সংঘর্ষের প্রথম পর্যায়ে ধর্মপাল প্রতিপক্ষের উভয়ের কাছেই পরাজিত হলেও পরে কিছুকালের জন্য বারাণসী এবং প্রয়াগ দখল করে গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী এলাকা পর্যন্ত বাংলার রাজ্য সীমানা বিস্তৃত করেন। ধর্মপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দেবপাল ক্ষমতায় বসেন। দেবপালের সময়েই পাল বংশের রাজ্যসীমা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বিস্তৃতি লাভ করেছিল।
কৈবর্ত বিদ্রোহ'
দেবপালের মৃত্যুর পর পাল বংশের আধিপত্য ক্রমে কমে আসতে থাকে এবং তাঁদের রাজ্যসীমাও হ্রাস পেতে শুরু করে। এমনই এক দুর্বল শাসকের সময়ে বাংলার উত্তরাংশে বরেন্দ্র এলাকায় কৈবর্তদের একটি বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। কৈবর্ত শব্দের মানে হচ্ছে মৎস্যজীবী সম্প্রদায়। মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের নেতা দিব্যোক ছিলেন একজন সামন্ত জমিদার। দিব্যোকের নেতৃত্বে পাল বংশীয় রাজা দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করে বরেন্দ্র এলাকায় কৈবর্ত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলার ইতিহাসে এই কৈবর্ত বিদ্রোহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচিত হয়। এই সময়েই প্রথম রাজশক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে অস্ত্র ধারণ করতে দেখা যায়। অন্যান্য সামন্ত শক্তির সমর্থন থাকলেও দিব্যোক মূলত মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়েই বরেন্দ্র দখল করেছিলেন।
বরেন্দ্র থেকে ক্ষমতা হারালেও পাল শাসনের অবসান হয়নি। বরেন্দ্র এলাকায় যখন কৈবর্ত শাসন বিদ্যমান তখন রামপাল নামে একজন পালবংশীয় রাজা ক্ষমতায় বসেন। রামপাল তাঁর পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রকূট, মগধ, রাঢ় সহ চৌদ্দটি রাজ্যের রাজাদের কাছ থেকে সৈন্য ও অস্ত্রসহায়তা নিয়ে বরেন্দ্র আক্রমণ করেন। বরেন্দ্রের শাসনক্ষমতায় তখন দিব্যোকের ভ্রাতুস্পুত্র ভীম। ভীম এবং রামপালের সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে ভীম পরাজিত ও নিহত হন। বরেন্দ্র আবারও পাল সাম্রাজের অধীনে চলে আসে। তবে এই রামপালই ছিলেন পাল বংশের সর্বশেষ শক্তিশালী রাজা। এরপর মদনপালের সময় পালবংশের পতন ঘটে।
দেব ও চন্দ্র রাজাদের রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়
পাল রাজবংশের উত্থান হয়েছিল বাংলা অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিম অংশে বরেন্দ্র এলাকায়। তাঁদের ক্ষমতার কেন্দ্রও ছিল উত্তর-পশ্চিম অংশে এবং মগধের অংশবিশেষে। আঞ্চলিক বাংলার উত্তর-পশ্চিম দিকে যখন পাল রাজাদের শাসন চলছে, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তখন অনেকগুলো পৃথক ও স্বাধীন রাজবংশের শাসন চলছিল। এঁদের মধ্যে ভদ্র বংশ, খড়গ বংশ, দেব বংশ এবং চন্দ্র বংশের শাসকেরা নদী দিয়ে বিভাজিত বাংলার খানিকটা অংশে বেশ প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে রাজত্ব করেন। রাজবংশগুলোর রাজধানী ছিল যথাক্রমে কর্মান্ত-বসাক, দেবপর্বত এবং বিক্রমপুর। দেব বংশের রাজাদের রাজধানীর নাম ছিল দেবপর্বত। ক্ষীরোদা নামের একটি নদীকে আশ্রয় করে প্রাচীন দেবপর্বত নগরী গড়ে উঠেছিল। কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের কোনো একটি স্থানে ছিল দেবপর্বতের অবস্থান। শান্তিদেব, বীরদেব, আনন্দদেব, ভবদেব ছিলেন দেব বংশের উল্লেখযোগ্য রাজা। এদের ক্ষমতা কেন্দ্রভূমি ছিল প্রধানত প্রাচীন সমতট এলাকা। বাংলা অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজবংশ ধরা হয় চন্দ্র বংশকে।
দশম শতাব্দীর শুরু থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত চন্দ্র বংশের রাজারা ক্ষমতায় ছিলেন। এই বংশের উল্লেখযোগ্য দুজন রাজা হলেন ত্রৈলোক্যচন্দ্র এবং শ্রীচন্দ্র। কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের রোহিতগিরি ছিল চন্দ্র বংশের রাজাদের উত্থানের কেন্দ্র। এখান থেকেই তাঁরা বঙ্গ ও সমতট এলাকায় ক্ষমতা বিস্তার করেন। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের পর তাঁর পুত্র শ্রীচন্দ্র ক্ষমতায় বসেন। শ্রীচন্দ্রের সময় চন্দ্র বংশের উত্তর-পূর্ব দিকে কামরূপ এবং উত্তরে গৌড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শ্রীচন্দ্র কামরূপে দখল অভিযান পরিচালনা করেছিলেন এবং সাফল্য লাভ করেছিলেন। প্রাচীন শ্রীহট্ট (বর্তমান সিলেট) ছিল চন্দ্র বংশের রাজ্যভুক্ত। পাল এবং চন্দ্র বংশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল বলে জানা যায়। শ্রীচন্দ্রের সময়ে চন্দ্র বংশের রাজধানী ছিল বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর।
সেন রাজাদের রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়
একাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে আঞ্চলিক বাংলার একটি অংশে (রাঢ় এবং গৌড়) সেন রাজবংশের উত্থান ঘটে। সেন রাজাদের আদি নিবাস ছিল দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট। বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারে যারা সৈন্য ও অস্ত্র দিয়ে রামপালকে সহায়তা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বিজয় সেন। রামপালের মৃত্যুর পর পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে বিজয় সেন বাংলার কিছু অংশ দখল করে নেন। বিজয় সেন একদিকে পাল বংশের রাজা মদনপালকে পরাজিত করে বাংলার উত্তর-পশ্চিম অংশ এবং অন্যদিকে বর্ম রাজাকে পরাজিত করে দক্ষিণ-পূর্ব অংশ দখল করে নেন। এছাড়াও কামরূপ, কলিঙ্গ, মিথিলা আক্রমণসহ নানান স্থানে তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং ক্রমেই আঞ্চলিক বাংলার প্রায় সবটুকু অংশের উপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অংশ জয় করার পর বিজয় সেন বিক্রমপুরে (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলা) সেন রাজবংশের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন।
বিজয় সেনের পর তাঁর পুত্র বল্লাল সেন এবং লক্ষণ সেন বংশানুক্রমে সিংহাসন অধিকার করেন। ত্রয়োদশ শতকের শুরু এবং লক্ষণ সেনের শাসনকালের শেষদিকে তুর্কি-আফগান যোদ্ধা বখতিয়ার খলজি ভারতবর্ষের পূর্বদিকে আক্রমণ পরিচালনা করে সেন সাম্রাজ্যে ভাঙনের সূচনা ঘটান। সেনদের ক্ষমতা বর্তমান বাংলাদেশের বিক্রমপুরে সীমিত হয়ে পড়ে আর বাংলা অঞ্চলের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কিছু অংশ (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের অংশবিশেষ) তুর্কি খলজিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
তুর্কি-আফগান খলজিদের রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়
বাংলা অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিমাংশে তুর্কি-আফগান যোদ্ধা ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজির হাত ধরে নতুন এক রাজনীতি আর ক্ষমতা বিস্তারের ইতিহাস গড়ে ওঠে। বখতিয়ার খলজি ছিলেন জাতিতে তুর্কি এবং আফগানিস্তানের গরমসির এলাকার অধিবাসী। অযোধ্যার শাসনকর্তা হুসামউদ্দীনের অধীনে ভারতের উত্তর প্রদেশের মির্জাপুর জেলায় ভিউলী ও ভাগত নামের দুটি পরগনার জায়গির লাভ করেন। ভিউলী এবং ভাগতে বসেই বখতিয়ার কিছু সৈন্য সংগ্রহ করে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেন। এরপর পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ও জমিদারি এলাকায় আকস্মিক আক্রমণের মধ্য দিয়ে মগধ পর্যন্ত অগ্রসর হন। আকস্মিক আক্রমণের নীতি অনুসরণ করেই বখতিয়ার একদিন গোপনে প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিয়ে ঝাড়খন্ডের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সেন রাজার প্রাসাদ অভিমুখে সৈন্য পরিচালনা করেন। বলা হয়ে থাকে, ঝাড়খন্ডের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বখতিয়ার এত দ্রুত সৈন্য পরিচালনা করেন যে তাঁর সঙ্গে মাত্র সতেরো-আঠারোজন সৈন্য রাজপ্রাসাদে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।
এভাবেই বখতিয়ার খলজি আমাদের বাংলা অঞ্চলের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন। রাজা লক্ষণ সেনকে বিক্রমপুরের রাজধানীতে ফিরে যেতে বাধ্য করে প্রতিষ্ঠা করেন খলজি বংশের শাসন। লখনৌতিতে স্থাপিত হয় তাঁদের রাজধানী। খলজি রাজাদের ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতি ছিল ভারতের পূর্বাংশ তথা বাংলা অঞ্চলের সাধারণ মানুষের ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন। ধীরে ধীরে পির, সুফি, দরবেশ ও সুলতানগণ তাঁদের নিজ নিজ এলাকায় প্রচলিত ইসলামি সংস্কৃতি বাংলা অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে খুব দ্রুত ছড়িয়ে দেন।
দিল্লির সুলতান এবং মোগল শাসকগণ বাংলার জল-জঙ্গলে নিয়মিত নিষ্কর জমি দান করতেন। তাঁদের ভূমি সম্প্রসারণ নীতি বাংলা অঞ্চলে ইসলাম বিস্তারে ভূমিকা রেখেছিল বলে রিচার্ড ইটন, অসীম রায় এবং মমতাজুর রহমান তরফদার সূত্রে জানা যায়। পরবর্তীকালে আরো নানান রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনা এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলা অঞ্চলে নানান ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও এই ভূমির সকল মানুষ সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের এক আশ্চর্য বন্ধনে আবদ্ধ। ধর্মের চেয়ে মানুষ পরিচয় সব সময়ই এখানে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। জীবনানন্দ দাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম- সবাই মানবতার জয়গান করেছেন। মধ্যযুগের কবির ভাষায়-
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'!
তোমরা পরবর্তীতে বাংলা অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাস আরও বিস্তৃত পরিসরে পাঠ করার সুযোগ পাবে, তখন উৎসের গভীরতা অনুসন্ধানের মাধ্যমে অনেক সত্য উদ্ঘাটন করতে পারবে। কিন্তু একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কেবল রাজা-বাদশাহদের ইতিহাস পাঠ করে এই ভূমির মানুষকে তুমি মোটেই জানতে ও বুঝতে পারবে না। মানুষকে জানতে হলে মানুষের সংস্কৃতি, রীতিনীতি, প্রথা-পদ্ধতি- সবই জানতে হবে। তোমরা দেখবে, বিভিন্ন শতাব্দীতে বিভিন্ন রাজবংশের উত্থান হচ্ছে। উত্তর ভারতের সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ তৎপরতার বিপরীতে চলছে ভারতেরই বিভিন্ন অংশে আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ভারতের পূর্বাংশ তথা বাংলা অঞ্চল নিয়ন্ত্রণকারী শাসকদের সঙ্গেও চলেছে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। বাংলার একেকটি অংশে আলাদা রাজবংশ শাসন করেছে। বাইরে থেকে বিশাল যোদ্ধার দল এসে দখল করে নিয়েছে বাংলার ভূভাগ। এভাবেই কালক্রমে বাংলা অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন মেরুকরণ ঘটেছে। বাংলা অঞ্চলের সাধারণ মানুষেরা রাজনীতি আর রাজনৈতিক সংস্কৃতির গঠন ও রূপান্তরে ধীরে ধীরে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন।
যাহোক, মধ্য এশিয়া থেকে আগত যোদ্ধারা পদাতিক এবং অশ্বারোহী সৈন্য হিসেবে যুদ্ধবিদ্যায় অভ্যস্ত ছিলেন। জল-জঙ্গল বেষ্টিত বাংলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যুদ্ধ পরিচালনা করার সক্ষমতা তাঁদের ছিল না। বখতিয়ার তাই পূর্ব দিকে (যেখানে বর্তমান বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে) সেন শাসিত এলাকায় প্রবেশ না করে তিব্বতের দিকে পরবর্তী অভিযান পরিচালনা করেন এবং মৃত্যুমুখে পতিত হন। এরপর বখতিয়ারের সেনাপতি আলী মর্দান খলজি লখনৌতির সিংহাসন নিয়ন্ত্রণে নেন। আলী মর্দানের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগ নিয়ে বখতিয়ারের অপর দুই সেনাপতি শীরান খলজি এবং গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজির বিবাদ শুরু হয়। ত্রিপক্ষীয় এই দ্বন্দ্বে শীরান এবং মর্দান দুজনেই নিহত হন। লখনৌতির ক্ষমতায় বসেন গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজি। বখতিয়ার খলজি লখনৌতিতে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। দিল্লির শাসনকর্তা কুতুবউদ্দীন আইবাক ও গজনীর সুলতান মোহাম্মদ ঘোরীর প্রতি মৃত্যু অবধি আনুগত্য প্রদর্শন করে গিয়েছেন। লখনৌতিকে প্রথম স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়ে নিজের নামে খুতবা প্রচার ও মুদ্রা জারি করেন আলী মর্দান খলজি। গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজি ক্ষমতায় আরোহণ করার পর মর্দানের পন্থা অনুসরণ করেন। তিনি দিল্লির মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজের নামে খুতবা পাঠ ও মুদ্রা জারি করেন। ১২১২ থেকে ১২২৭ পর্যন্ত প্রায় ১৫ বছর লখনৌতি শাসন করেন সুলতান গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজি। ১২২৭ সালের দিকে ইওজ খলজি যখন বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রাজ্য বিস্তারের জন্য সেন রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, সেই সময় দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশের পুত্র নাসিরউদ্দীন লখনৌতি আক্রমণ করেন। ইওজ খলজি তা প্রতিহত করতে দ্রুত ছুটে যান লখনৌতির দিকে। সেখানে গিয়ে তিনি দিল্লির সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন ও সপরিবার নিহত হন।
ইওজ খলজির মৃত্যুর পর ভারতের তৎকালীন অন্যান্য বহু আঞ্চলিক রাজ্যের মতো লখনৌতি রাজ্য দীর্ঘকালের জন্য দিল্লির শাসকদের অধীনে চলে যায়। লখনৌতির শাসনকর্তা প্রেরিত হয় দিল্লি থেকে। দিল্লির সুলতানের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে শাসনকাজ পরিচালনা করতেন লখনৌতির শাসকেরা। আনুগত্যের বদলে কেউ বিদ্রোহ করলে এবং যথাযথ রাজস্ব প্রদান না করলে কেন্দ্রীয় শাসকেরা সৈন্য প্রেরণ করে স্থানীয় শাসকদের উচ্ছেদ করে নতুন শাসক নিয়োগ দিতেন। এ সময়কালে লখনৌতি রাজ্যে যাঁরা শাসনকর্তা হিসেবে আসেন তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন দিল্লির শাসকদের ক্রীতদাস। এজন্য এই সময়কে অনেকে 'দাস শাসন' বা 'মামলুক শাসন' বলেও অভিহিত করে থাকেন।
বাংলা অঞ্চলে ইলিয়াস শাহী ও হোসেন শাহী বংশের রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়
দিল্লি এবং লখনৌতির শাসকদের উভয়েই মুসলমান ছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে চলেছে ধারাবাহিক দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই লখনৌতির বিদ্রোহী শাসকগণ সুযোগ পেলেই লখনৌতির দক্ষিণ ও পূর্বদিকে সমর অভিযান পরিচালনা করে রাজ্য সম্প্রসারণ করতেন। এসব অভিযানের ফলে বাংলা অঞ্চলের বৃহৎ অংশ লখনৌতির শাসকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৩৩৮ সালের মধ্যে লখনৌতির পাশাপাশি বাংলায় আরও দুটি শক্তিকেন্দ্র তৈরি হয়। একটি হচ্ছে, লখনৌতির দক্ষিণ দিকে সাতগাঁ, অন্যটি দক্ষিণ পূর্ব দিকে সোনারগাঁ। দিল্লির সুলতানগণ লখনৌতির পাশাপাশি বাকি দুটি কেন্দ্রেও শাসনকর্তা নিয়োগ দিতেন।
সোনারগাঁ
বাংলার পৃথক তিনটি শাসনকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বাংলা অঞ্চলের একটি বৃহৎ অংশে শাসক হিসেবে স্বাধীন সুলতানি শাসনকালের সূচনা করেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। ১৩৪২ সালে লখনৌতির ক্ষমতায় বসেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ, প্রথমে লখনৌতির দক্ষিণের শাসনকেন্দ্র সাতগাঁ নিয়ন্ত্রণে নেন। এরপর নেপাল ও ত্রিহুত আক্রমণ করে প্রচুর ধনসম্পদ সংগ্রহ করেন। ১৩৫২ সালে ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁ আক্রমণ করেন এবং গাজি শাহকে পরাজিত করে সোনারগাঁ দখল করে নেন। তিনটি প্রশাসনিক কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে ইলিয়াস শাহ বাংলার প্রায় সিংহভাগ জায়গা তাঁর শাসনাধীনে নিয়ে আনতে সক্ষম হন। দিল্লির মুসলমান সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলক বাংলার মুসলমান সুলতান ইলিয়াস শাহকে উচ্ছেদ করার জন্য বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে অভিযান পরিচালনা করেন। ইলিয়াস শাহ সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে একডালা নামে একটি দুর্গে আশ্রয় নেন। বাংলার বৈরী আবহাওয়া, বর্ষার জল, জঙ্গল ও মশার উপদ্রবে দিল্লির সৈন্যরা বেশি দিন টিকতে পারেননি। ফিরোজ শাহ তুগলক বাধ্য হয়েই দিল্লি ফিরে যান।
দিল্লির দরবারি ঘটনাপঞ্জি লেখক শামস-ই-সিরাজ আফীফ তাঁর লেখা একটি গ্রন্থে ইলিয়াস শাহকে 'শাহ- ই বাঙ্গালাহ', 'শাহ-ই-বাঙ্গালীয়ান' এবং 'সুলতানই বাঙ্গালাহ' বলে উল্লেখ করেছেন। 'বঙ্গ' থেকে উদ্ভূত বাঙ্গালা' ও 'বাঙ্গালীয়ান' শব্দ দুটি সমুদয় বাংলা অঞ্চল ও অঞ্চলের সকল মানুষের পরিচয় নির্ধারণে খুব সম্ভবত সেই প্রথম ব্যবহৃত হয়। কিন্তু নাম-পরিচয় নির্ধারণের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে এ অঞ্চলের সাধারণ প্রজাদের কোনো সম্পর্ক ছিল বলে কোনো উৎস হতে জানা যায় না।
সুলতান ইলিয়াস শাহের বংশধরেরা অনেক দিন বাংলা শাসন করেন। ইলিয়াস শাহী বংশের দুইজন উল্লেখযোগ্য শাসক হলেন সিকান্দর শাহ এবং গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ। ইলিয়াস শাহী সুলতানদের সময় বাংলার আঞ্চলিক ভূখণ্ডের প্রধান একটি অংশে আবারও স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় এই সময় শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশের পরিবেশ তৈরি হয়। সুলতান আজম শাহের রাজত্বকালেই শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ 'ইউসুফ জুলেখা' রচনা করেন। সুলতান আজম শাহ নিজেও ফার্সি ভাষায় কাব্য রচনা করতেন এবং পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ ছিল বলে জানা যায়।
ইলিয়াস শাহী বংশের পর বাংলার ইতিহাসে আরেকটি রাজবংশের শাসন দেখা যায়। এটি হলো হুসেন শাহী বংশ। আবিসিনীয় হাবসি ক্রীতদাসদের একটি দল বাংলার শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন। চারজন হাবসি ক্রীতদাস প্রায় ছয় বছর বাংলার রাজক্ষমতায় ছিল। একেকজন শাসককে হত্যা করে অন্য একজন শাসক ক্ষমতায় এসেছিলেন। হাবসি ক্রীতদাসদের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে ১৪৯৩ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন আলাউদ্দীন হুসেন শাহ। বহু দূরের ভূখণ্ড থেকে তিনি ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্ত অর্থাৎ বাংলা অঞ্চলে এসেছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার অধিবাসী। যাহোক, ক্ষমতা অধিকার করে হুসেন শাহ গোলযোগ সৃষ্টিকারী হাবসি ক্রীতদাস ও আমীরদের অনেককেই হত্যা করেন এবং বাকিদের বিতাড়িত করেন। রাজ কাজে সহায়তার জন্য তিনি তথাকথিত উচ্চ বংশ, অভিজাত ও শিক্ষিত মুসলমান এবং হিন্দুদের নিয়োগ দান করেন। হুসেন শাহ একজন সাম্রাজ্য সম্প্রসারণবাদী শাসক ছিলেন। নিজের রাজ্যসীমা বৃদ্ধি এবং ধন-সম্পদ আহরণের লক্ষ্যে তিনি কামরূপ, কামতা, বিহার ও উড়িষ্যার দিকে বারংবার যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করেছেন।
হুসেন শাহী শাসনামলে বাংলায় শিল্প, সাহিত্য ও স্থাপত্যকলার বিশেষ উন্নয়ন লক্ষ করা যায়। এই সময় বাংলার সাহিত্য অঙ্গনে মালাধর বসু, বিজয় গুপ্ত, যশোরাজ প্রমুখ সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়। বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য নামে একটি সাহিত্যধারা চালু হয় মূলত এই সময় থেকেই। আলাউদ্দীন হুসেন শাহী শাসনামলে গৌড়ের 'ছোটো সোনা মসজিদ', 'বড়ো সোনামসজিদ', 'বারোদুয়ারি মসজিদ'সহ অনেকগুলো মসজিদ, মাদ্রাসা, দুর্গ ও তোরণ নির্মিত হয়।
আফগান ও মোগল শক্তির রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়ে বাংলা অঞ্চল
খেয়াল করে দেখবে, বাংলা অঞ্চলের বৃহৎ একটি অংশে যেসব শাসনকর্তা শাসন করেছেন, তাঁদের প্রায় সকলেই ছিলেন আরব ও পারস্যের ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুসারী অভিজাত মুসলমান। এরা একদিকে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিলেন, অন্যদিকে দিল্লির মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধেও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়েই নিজেদের শাসন ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। ক্ষমতার এই টানাপোড়েনে বাংলা অঞ্চলের সাধারণ মানুষের যে কোনো ভূমিকা ছিল না তা বলাই বাহুল্য।
দিল্লিতে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর দিল্লির সিংহাসন নিয়ে আফগান শাসক শেরশাহ শূর এবং মোগল শাসক হুমায়ুনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্বের ঢেউ এসে বাংলার সিংহাসনেও লাগে। শের শাহ এবং হুমায়ুন উভয়েই কিছুকালের জন্য আঞ্চলিক বাংলার প্রধান অংশে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন রাজধানী গৌড় নিয়ন্ত্রণে রাখেন। হুমায়ুনকে দিল্লির সাম্রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে শের শাহ বাংলাকেও দিল্লির অধীন নিয়ে যান। শেরশাহ ছিলেন আফগান বংশোদ্ভূত শাসক। শের শাহের সূত্র ধরেই বাংলার শাসনক্ষমতা কিছুদিনের জন্য আফগানদের হাতে চলে যায়। দিল্লিতে মোগল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলেও বাংলায় আফগান শাসক সোলায়মান কররানী এবং দাউদ কররানীর শাসন চলতে থাকে।
পরাজিত ও নিহত হন। বাংলায় মোগল শক্তির রাজনীতি ও শাসন সম্প্রসারণের সূত্রপাত ঘটে। আফগান শাসক দাউদ কররানীকে পরাজিত করার পর মোগল শাসকরা বাংলা শাসন করার জন্য সুবাদার প্রেরণ করেন। কিন্তু সুবাদারদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অংশের কয়েকজন শক্তিশালী জমিদার। এই জমিদাররা সংঘবদ্ধ হয়ে মোগল সুবাদারদের বাধা প্রদান করেন এবং স্বাধীনভাবে নিজ নিজ জমিদারি এলাকা শাসন করতে থাকেন। ইতিহাসে এই জমিদারগণ বারোভূঁইয়া নামে পরিচিত। বারোভূঁইয়াদের নেতা ছিলেন সোনারগাঁর জমিদার ঈসা খান এবং তাঁর পুত্র মুসা খান। ঈসা খানের মিত্র হিসেবে মোগল বিরোধী যুদ্ধে আরও যেসব জমিদার যুক্ত ছিলেন তার মধ্যে ভূষণার চাঁদরায় ও কেদার রায়, ভুলুয়ার জমিদার বাহাদুর গাজী, শ্রীপুরের লক্ষণ মাণিক্যের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মোগল শাসক জাহাঙ্গীরের সময় বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন ইসলাম খান। ইসলাম খান প্রথমেই মুসা খানকে পরাজিত করেন। এরপর অন্য জমিদারদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। এভাবে তিনি বাংলা অঞ্চলের বিরাট একটি অংশকে মোগল শক্তির নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যান। মোগল সুবাদার ইসলাম খানই প্রথম ১৬১০ সালে সুবা বাংলার রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকায় এবং এর নাম রাখেন 'জাহাঙ্গীর নগর'।
বাংলা অঞ্চলে সুবাদারি ও নবাবি শাসন প্রতিষ্ঠা
তোমরা সকলেই জানো যে, মোগল শাসকগণ তাঁদের অধীনস্থ প্রদেশগুলোর নাম দিয়েছিলেন সুবা। প্রতিটা সুবায় শাসনকাজ পরিচালনার জন্য একজন করে সুবাদার নিয়োগ করতেন তাঁরা। শাহ সুজা, মীর জুমলা এবং শায়েস্তা খান ছিলেন বাংলার উল্লেখযোগ্য সুবাদার। কথিত আছে যে, শায়েস্তা খানের সময়ে বাংলায় এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। এই ধরনের সাধারণীকরণ তথ্য সম্পর্কে আরো সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। নানান উৎসকে সমালোচনামূলক অনুসন্ধান এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তবেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
বাংলার মানুষের প্রধান পেশা ছিল কৃষি, প্রধান শস্য ছিল ধান। বাংলার কৃষকেরা দিনরাত খেটে যে ফসল ফলাতেন তার ন্যায্য মূল পেতেন কি না, তা নিয়ে এখন তাই প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। তবে বাংলার সুবাদাররা যে এখান থেকে প্রচুর পরিমাণে রাজস্ব ও উপঢৌকন দিল্লিতে পাঠাতেন তা বিভিন্ন উৎস থেকেই জানা যায়। মোগল শাসকদের যে অগাধ জৌলুশ আর বিলাসী জীবনের গল্প শোনা যায়, সেই বিলাসিতার পেছনে বাংলার খেটে খাওয়া মানুষদের উৎপাদিত ফসল, শ্রম ও ঘামের দাগ থাকলেও তার মূল্যায়ন কি কেউ করেছেন?
১৭০০ সালে বাংলার ক্ষমতায় আসেন মুর্শিদ কুলি খান। তিনি কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে প্রায় স্বাধীনভাবেই বাংলার শাসনকাজ পরিচালনা শুরু করেন। নবাব মুর্শিদ কুলি খানের সময় থেকে শুরু হয় বাংলার নবাবি শাসনকাল। সুবাদারি শাসনের আগে থেকেই বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের আগমন এবং বাণিজ্য তৎপরতা শুরু হয়। কলকাতা, চুঁচুড়া, চন্দননগর, হুগলী, চট্টগ্রাম, সাতগাঁও প্রভৃতি এলাকা ইংরেজ, ওলন্দাজ, দিনেমার, পর্তুগিজ, ফরাসি বণিকদের ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে। বাণিজ্যকেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি তাদের অনেকেই বাংলায় লুণ্ঠনকাজও পরিচালনা করতেন। এসব অপতৎপরতার কারণে সুবাদার এবং নবাবদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়েই পর্তুগিজ, ফরাসি এবং ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বাইরের বণিকদের পাশাপাশি বাংলার অভ্যন্তরেও নবাবি শাসনের আসন দখল নিয়ে অভিজাতদের মধ্যে বিবাদ চলছিল। এরূপ বহুমুখী বিবাদের ফল হিসেবেই ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটে এবং ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার ক্ষমতায় আসীন হয়।
অনুশীলনী সকল শিক্ষার্থীকে ৪টি দলে বিভক্ত করে দেওয়া হলো। এই ৪টি দল বাংলা অঞ্চলের হাজার বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন মানুষের আগমন ও বসতি স্থাপন বিষয়ে পৃথক পৃথক দেয়ালিকা প্রস্তুত করবে। দলের সকল শিক্ষার্থী দেয়ালিকা তৈরির কাজে অংশগ্রহণ করবে। প্রত্যেকে লেখা দিয়ে কিংবা ছবি এঁকে দেয়ালিকা তৈরিতে সাহায্য করবে। লেখা এবং ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে থাকবে ইংরেজ ও পাকিস্তানি শাসনের পূর্বে বাংলা অঞ্চলে রাজনীতি আর রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার ইতিহাস। শিক্ষার্থীরা এই অধ্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের লেখা এবং ছবি প্রস্তুত করবে। |
শোষিত মানুষেরা ধীরে ধীরে নিজেদের অধিকার বিষয়ে সচেতন হয়েছে এবং ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এই সময়ই ব্যাপকভাবে রাজশক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে কখনো অস্ত্র হাতে আবার কখনো অস্ত্র ছাড়াই লড়াই করতে দেখা যায়। ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষার বিস্তার ঘটে, কতিপয় দেশীয় এবং ইউরোপীয় সমাজ সংস্কারক কুসংস্কার ও গোঁড়ামিমুক্ত নতুন সমাজ নির্মাণে ব্রত হন। এর ফলে মানুষের মধ্যে সার্বিক শিক্ষা ও অধিকার সচেতনতার বোধ আরও প্রবল হয়। নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ বিপ্লবী আন্দোলন- এই দুই ধারাতেই এখানে মানুষের রাজনৈতিক জাগরণ ঘটে। ধারাবাহিক আন্দোলন, বিপ্লব, মিছিল ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলা অঞ্চলের মানুষ একসময় সত্যিকার অর্থেই শোষণমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে রাজনৈতিক সাফল্য অর্জনের পথে এগিয়ে যায়।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ
ফকির-সন্ন্যাসীরা সাধারণত খানকাহ এবং আখড়ায় বসবাস করতেন। কোম্পানির শাসকগণ এমন কিছু আইন করে যার ফলে ফকির-সন্ন্যাসীদের স্বাভাবিক জীবনধারা ব্যাহত হয়। এর ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষেরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন এবং ফকির মজনু শাহের নেতৃত্বে ১৭৬০ হতে ১৭৮৬ সাল পর্যন্ত বাংলার ফকির-সন্ন্যাসীরা কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন পরিচালনা করেন। সন্ন্যাসীদের পক্ষ থেকে ভবানী পাঠক নামে একজন ব্রাহ্মণ মজনু শাহের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন বলে জানা যায়। মজনু শাহের সঙ্গে এই আন্দোলনের বাংলার সাধারণ প্রজাগণও যুক্ত ছিলেন।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয় ১৭৬৩ সালে। তাঁদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইংরেজ সরকারের বাণিজ্যকুঠিগুলো। বর্শা, তরবারি, বল্লম, বন্দুক, অগ্নিনিক্ষেপক যন্ত্র, কামান প্রভৃতি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিদ্রোহীরা রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, ঢাকা, পাটনা, কোচবিহার, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এলাকায় বিভিন্ন ইংরেজ কুঠিতে আক্রমণ পরিচালনা করে লুণ্ঠন করতেন। যুদ্ধে সৈন্যদের খাদ্য, গোলাবারুদ ও রসদ বহনের জন্য মজনু শাহ উট এবং ঘোড়া ব্যবহার করতেন। সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত একেকটি যুদ্ধে পাঁচ থেকে পঞ্চাশ হাজার ফকির-সন্ন্যাসী যোদ্ধা যোগ দিতেন বলে জানা যায়। এর মধ্যে সাধারণ কৃষক আর প্রজাগণও ছিলেন। ফকির- সন্ন্যাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসে ইংরেজ কুঠিয়ালসহ অনেক সৈনিকের মৃত্যু হয়। মজনু শাহের মৃত্যুর পর মুসা শাহ, পরাগল শাহ, কৃপানাথ, শ্রীনিবাস প্রমুখ ফকির ও সন্ন্যাসী নেতা আরও বহুদিন এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থ ও সম্পদ লুটপাটের শিকার হয় বাংলার সাধারণ মানুষ। ইতিপূর্বে যেকোনো ধরনের দুর্যোগ, অনাবৃষ্টি বা প্লাবনের সময় বাংলার স্থানীয় জমিদার ও শাসকগণ প্রজাদের খাজনা মওকুফসহ নানা সুবিধা দিয়ে থাকতেন। মহাস্থান ব্রাহ্মীলিপিতে আমরা দেখেছি, প্রাচীনকালে দুর্যোগের সময় প্রজাদের সহায়তা করার জন্য কেন্দ্রীয় রাজ্য থেকে খাদ্যশস্য ও অর্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু রবার্ট ক্লাইভ পরিচালিত কোম্পানির সরকার অনাবৃষ্টির কারণে কৃষকেরা ফসল ফলাতে পারেননি জেনেও পূর্ব বছর পূর্ণমাত্রায় রাজস্ব আদায় করে। পরের বছর আবারও অনাবৃষ্টির কারণে ফলন খুবই কম হয়। যেটুকু শস্য উৎপন্ন হয়েছিল, তা-ও রাজস্ব বাবদ কোম্পানির লোকেরা নিয়ে যায়। মানুষের জন্য ত্রাণ বা রাজস্ব মওকুফের কোন ব্যবস্থা রাখে না। এর ফলে দেশ জুড়ে বিভীষিকাময় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ইংরেজি ১৭৭০ সাল এবং বাংলায় ১১৭৬ বঙ্গাব্দে সংঘটিত এই দুর্ভিক্ষে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যায়। বাংলায় ১১৭৬ বঙ্গাব্দে সংঘটিত এই দুর্ভিক্ষ ইতিহাসে 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' নামে পরিচিত।
নীলকর বিদ্রোহ
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনক্ষমতা লাভের পর বাংলার প্রান্তিক কৃষক ও রায়তদের জীবনে যে চরম দুর্দশা নিয়ে এসেছিল তার আরেকটি অন্যতম নজির হচ্ছে নীল চাষ। ইউরোপে শিল্পকারখানাগুলোতে কাপড়ে রং করার জন্য নীলের দরকার হতো। ইউরোপে নীলের দাম ও চাহিদা ছিল প্রচুর। বাংলার কৃষকদের দিয়ে নীল চাষ করিয়ে ইউরোপে রপ্তানি করে অর্থ উপার্জনের নীল নকশা করে কোম্পানির সরকার। বাংলার কৃষকদের উৎকৃষ্ট জমিগুলো তারা নীল চাষ করার জন্য দাগিয়ে দিতে থাকে। জোর করে কৃষকদের হাতে চাষের খরচ বাবদ কিছু অর্থও তুলে দেয়। একে বলা হতো দাদন। এই দাদনের টাকা সুদ সমেত আদায় করে নিতো নীল সংগ্রহের মাধ্যমে। কৃষকেরা বছরের পর বছর নীল চাষ করেও জোর করে ধরিয়ে দেওয়া দাদনের ঋণ থেকে মুক্তি পেতেন না। কোনো কৃষক নীল চাষ করতে না চাইলে ইংরেজ কুঠিয়ালরা তাঁকে কাছারিবাড়িতে ধরে নিয়ে ভয়ংকর রকমের নিপীড়ন করত। বাংলার কৃষকদের সবচেয়ে উর্বর জমিগুলোতে খাদ্য শস্যের পরিবর্তে নীল চাষ হতে থাকে। সাধারণ কৃষকেরা অপরিমেয় দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হন। এক সময় বাধ্য হয়েই তাঁরা বিদ্রোহ শুরু করেন।
নীল চাষের বিরুদ্ধে সংঘটিত বাংলার সাধারণ কৃষদের এই বিদ্রোহ ইতিহাসে 'নীল বিদ্রোহ' নামে পরিচিত। ১৮৫০ সলের পর থেকেই তৎকালীন ফরিদপুর, যশোর, মুর্শিদাবাদ, ঢাকা, পাবনা, রাজশাহী, নদীয়া এলাকার কৃষকরা সংগঠিত হয়ে স্থানীয় নীলকরদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করেছিলেন। পত্র-পত্রিকায় নীলকর ইংরেজদের অত্যাচারের কাহিনি ছাপা হতে থাকে। যশোরে নীল বিদ্রোহের নেতা ছিলেন ননী মাধব ও বেনী মাধব, হুগলীতে বৈদ্যনাথ ও বিশ্বনাথ সর্দার, নদীয়ায় বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস। শেষ পর্যন্ত কৃষকদের জয় হয়। ব্রিটিশ সরকার এই তীব্র আন্দোলনের মুখে নতুন একটি আইন করে। জোর করে কৃষকদের দিয়ে নীল চাষ করানোর প্রক্রিয়াকে সেই আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা ও ফরায়েজি আন্দোলন
সাধারণ কৃষক, তাঁতি, জেলে, তেলি প্রমুখ বাংলার নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের স্বার্থ রক্ষা এবং ইংরেজ শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনায় নীল-বিদ্রোহের সমসাময়িক আরও দুজন মানুষের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের একজন হলেন তিতুমির, অন্যজন ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহ। উনিশ শতকে ভারতবর্ষের মুসলমান সমাজে দুটি ধারায় ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এই সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়েই হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং তিতুমির বাংলার নিপীড়িত রায়ত, কৃষক, জেলে, তাঁতি প্রভৃতি প্রান্তিক মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ইংরেজ, জমিদার ও নীলকর কুঠিয়ালদের অত্যাচারে পীড়িত মানুষদের সংগঠিত করে তাঁরা সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে অন্যায়ের প্রতিবাদ শুরু করেন। ১৮৩১ সালে ইংরেজ সরকার তিতুমিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রেরণ করে। তিতুমির একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে সেখানে কৃষক-শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত লাঠিয়াল বাহিনীর সৈন্য সমাবেশ করেন। ইংরেজরা কামান-বন্দুক নিয়ে আক্রমণ করলে তিতুমির দেশীয় লাঠি, বর্শা, বল্লম, তরবারি নিয়েই পাল্টা আক্রমণ করেন। অসম এই যুদ্ধে তিতুমির নিহত হলেও তাঁর এই সাহস মানুষকে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করার সাহস জুগিয়েছে।