SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - উন্নততর জীবনধারা | NCTB BOOK

তামাক গাছের পাতা ও ডাল শুকিয়ে তামাক তৈরি হয়। শুকনা তামাকপাতা কুচি কুচি করে কেটে তাকে বিশেষ কাগজে মুড়িয়ে সিগারেট এবং পাতায় মুড়িয়ে বিড়ি ও চুরুট বানানো হয়। এগুলোকে পুড়িয়ে তার ধোঁয়া ও বাষ্প সেবনকে ধূমপান বলে। তামাক থেকে নিকোটিন নামক পদার্থ বের হয়, যা মাদকদ্রব্য হিসেবে নার্ভকে যেমন সাময়িকভাবে উত্তেজিত করে, তেমনি নানাভাবে শরীরের ক্ষতি করে। ধূমপান করলে নিকোটিন ছাড়াও আরও কিছু বিষাক্ত পদার্থ শরীরে প্রবেশ করে। ধূমপানের ধোঁয়ায় উল্লেখযোগ্য বিষান্ত গ্যাস ও রাসায়নিক পদার্থ এবং মাদকদ্রব্যের সংমিশ্রণ থাকে। এই পদার্থগুলো রক্তের হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন বহনক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এছাড়া কতগুলো আঠালো পদার্থ ও হাইড্রোকার্বন প্রভৃতি এতে থাকে, যা ফুসফুসে নানা ধরনের ব্যাধি (চিত্র ১.০৬), এমনকি ক্যান্সার সৃষ্টি করে।

১.৫.১ ধূমপানের ক্ষতিকর দিক

আমাদের সবচেয়ে পরিচিত মাদক হচ্ছে ধূমপান। ধূমপানের ফলে মানবদেহে যেসব ক্ষতিকারক অবস্থা ও রোগ দেখা দেয় সেগুলো হলো:

১. ধূমপায়ীরা অন্যদের থেকে বেশি রোগাক্রান্ত হয়।

২. ধূমপায়ীরা কোনো না কোনো রোগে ভোগে যেমন: ফুসফুস ক্যান্সার, ঠোঁট, মুখ, ল্যারিংক্স, গলা ও মূত্রথলির ক্যান্সার, ব্রংকাইটিস, পাকস্থলীতে ক্ষত এবং হৃদযন্ত্র ও রক্তঘটিত রোগ।

ফুসফুসে ক্যান্সার দেখা দিলে রোগী প্রায় ৫ বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করে।

৩. সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা বেশি ধূমপান করে, তাদের আয়ু কমে যায় ।

৪. যেসব লোক ধূমপান করে না অথচ ধূমপায়ীদের কাছাকাছি থেকে ধূমপায়ীর নির্গত ধোঁয়া প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে, তাদেরও শারীরিক ক্ষতি হয়।


১.৫.২ ধূমপান ও তামাকজাত পদার্থের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে প্রচেষ্টাসমূহ

১. বাস, রেল, খোলা স্থানে, রেস্তোরাঁয়, অফিস, হাসপাতাল, রেলস্টেশন প্রভৃতি এলাকায় ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেখানে সেখানে ধূমপান করা এখন আইনত দণ্ডনীয় এবং আমাদের দেশে এর জন্য সুনির্দিষ্ট আইনও আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকার কারণে মানুষ এখনো যেখানে সেখানে ধূমপান করে আশপাশের বায়ুকে দূষিত করে যাচ্ছে। প্রচলিত আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা আবশ্যক। এ ব্যাপারে সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।

২. বিক্রয়যোগ্য তামাকজাত পদার্থের মোড়কে “ধূমপান বিষপান” বা “ধূমপান শরীরের জন্য ক্ষতিকর” কথাগুলো ছাপানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

৩. তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

৪. স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিকটে সিগারেট ও তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও বিক্রয় সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।

 ১.৬  ড্রাগ আসক্তি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ড্রাগের একটি সংজ্ঞা দিয়েছে। এই সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ড্রাগ এমন কিছু পদার্থ, যা জীবিত প্রাণী গ্রহণ করলে তার এক বা একাধিক স্বাভাবিক আচরণের পরিবর্তন ঘটে।ড্রাগকে সাধারণ ভাষায় আমরা মাদক বলি। ক্রমাগত মাদকদ্রব্য সেবনের কারণে যখন এমন অবস্থা সৃষ্টি হয় যে মাদকদ্রব্যের সাথে মানুষের এক ধরনের দৈহিক ও মানসিক সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং নিয়মিতভাবে মাদক গ্রহণ না করলে শারীরিক এবং মানসিক সমস্যায় পড়ে, তখন তাকে বলে মাদকাসক্ত বা ড্রাগ নির্ভরতা (চিত্র ১.০৭)।

উল্লেখযোগ্য ড্রাগ যেগুলোর ওপর মানুষের আসক্তি সৃষ্টি হয়, সেগুলো হচ্ছে বিড়ি, সিগারেট, আফিম ও আফিমজাত পদার্থ, হেরোইন, মদ, পেথিড্রিন, বারবিচুরেট, কোকেন, ভাং, চরস, ম্যারিজুয়ানা, এলএসি ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে হেরোইন একটি মারাত্মক ধাপ।ড্রাগের ওপর কোনো ব্যক্তির আসত্তি নানাভাবে জাগতে পারে, যেমন: কৌতূহল, সঙ্গদোষ, হতাশা দূর করার প্রচেষ্টা, মানসিক যন্ত্রণা ভুলে থাকার পদ্ধতি, নিজেকে বেশি কার্যক্ষম করা, পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কিংবা পারিবারিক অভ্যাসগত। বাবা বা মা কোনো মাদকে আসক্ত থাকলে তার থেকে সন্তানে ওই মাদকে আসন্ত হওয়ার সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা থাকে।
 

১.৬.১ মাদকাসন্তির লক্ষণ
যে ব্যক্তি মাদকদ্রব্যে আসক্ত, তার মধ্যে কতগুলো লক্ষণ প্রকাশ পায়। অনেকগুলো লক্ষণ সাধারণত স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে দেখা যায় না। উল্লেখযোগ্য লক্ষণগুলো হলো এরকম:

১. খাওয়ার প্রতি আকর্ষণ কমে যাওয়া

২. সবসময় অগোছালোভাবে থাকা

৩. দৃষ্টিতে অস্বচ্ছতা এবং চোখ লাল হওয়া

৪. কোনো কিছুতে আগ্রহ না থাকা এবং ঘুম না হওয়া

৫. কর্মবিমুখতা ও হতাশা

৬. শরীরে অত্যধিক ঘাম নিঃসরণ

৭. সবসময় নিজেকে সবার থেকে দূরে রাখা

৮. আলস্য ও উদ্বিগ্ন ভাব

৯. মনঃসংযোগ না থাকা, টাকা-পয়সা চুরি করা এমনকি মাদকের টাকার জন্য বাড়ির জিনিসপত্র সরিয়ে গোপনে বিক্রি করা ইত্যাদি।

ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা অনিচ্ছা ছাড়াও কিছু সামাজিক তথা পরিবেশের কারণেও মাদকদ্রব্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ জন্মাতে পারে, যেখান থেকে সে ধীরে ধীরে মাদকাসত্ত্ব হয়ে পড়ে। মাদকাসন্তির কতগুলো কারণ ছকে উল্লেখ করা হলো:

 

          পরিবেশগত কারণ        পরিবারের কারণ
১. মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা
২. বেকারত্ব
৩. অসামাজিক পরিবেশ
৪. অল্প বয়সে স্কুল থেকে বিদায়
৫. সিনেমা বা কোনো টিভি সিরিয়াল দেখা
৬. আশপাশে ড্রাগের রমরমা ব্যবসা
৭. পেশাগত কারণ
৮. অসামাজিক কাজ ও অপরাধ বেশি হয়, সে সব স্থানে বাস করা
৯. যেখানে ড্রাগ নেওয়ার সুযোগ বা দল থাকে, তার আশেপাশে বসবাস করা
১. বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণের অভাব
২. হতাশা
৩. একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা
৪. সন্তানের বেপরোয়া ভাবকে প্রশ্রয় দেওয়া
৫. পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা
৬. সন্তানের প্রতি যত্নহীনতা
৭. উগ্র জীবনযাত্রা বা মানসিকতা
৮. খারাপ সাহচর্য

 

১.৬.২ ড্রাগ আসক্তি নিয়ন্ত্রণ
কোনো ব্যক্তি ড্রাগের উপর আসক্ত হলে তা বন্ধ করা বেশ কঠিন কাজ। কারণ ড্রাগ আসক্ত মানুষ নিজের শরীরে মাদকের কুপ্রভাব বুঝতে পেরেও সেটা ছাড়তে পারে না। সঠিক চিকিৎসাব্যবস্থায় মাদকদ্রব্যে আসক্তি কমানো যায়, তবে সে ক্ষেত্রে মাদকাসক্ত ব্যক্তি যদি সহযোগিতা না করে তাহলে তেমন ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। মাদক নিরাময় হাসপাতাল অথবা কেন্দ্রে মাদকাসক্ত মানুষকে ভর্তি করতে হবে এবং যথেষ্ট সহানুভূতির সাথে তার চিকিৎসা করতে হবে। প্রথমে আসক্ত ব্যক্তিকে তার ড্রাগ নেওয়া বন্ধুদের কাছ থেকে আলাদা করতে হয়। লক্ষ রাখতে হয় কোনোভাবেই যেন তার কাছে মাদকদ্রব্য পৌঁছাতে না পারে। এরপর তার মানসিক চিকিৎসা করা প্রয়োজন হয়, যেন সে ড্রাগের কথা মনে আনতে না পারে, তার জন্য তাকে বিশেষ কোনো কাজে যুক্ত করতে হয়। সে যে মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয়, সেটি একবারে হঠাৎ করে বন্ধ না করে ধীরে ধীরে মাত্রা কমিয়ে কমিয়ে শেষে একেবারে বন্ধ করতে হয়। হঠাৎ করে বন্ধ করা শারীরিকভাবে বিপজ্জনক হতে পারে। ঘুম ঠিকমতো না হলে বা বেশি অস্থিরতা বা বিদ্রোহীভাব দেখা দিলে ডাক্তাররা স্নায়ু শিথিলকারক ঔষধ এবং ঘুমের ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করে থাকেন।

মাদক সেবন শুধু যে ড্রাগ আসক্ত মানুষটির ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সমস্যা তা নয়, মাদক সেবন যেকোনো পরিবারে বড় রকমের সমস্যা ও বিশৃংখলা বয়ে আনে। এই সমস্যা সামগ্রিকভাবে সমাজ ও দেশের উন্নতির পরিপন্থী। মাদকদ্রব্যের ব্যবসা করে সমাজের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ধনী হয়, কিন্তু অন্যদিকে অনেক মানুষের এবং সমাজজীবনে ভয়াবহ দুর্যোগের কালো ছায়া নেমে আসে। সম্ভাবনাময় ছাত্র-
ছাত্রীদের পড়ালেখা নষ্ট হওয়া থেকে শুরু করে সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। শুধু তা-ই নয় মাদকাসক্তির কারণে অকালমৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। এ জন্য মাদকদ্রব্য সেবন ও এর ব্যবসা-বাণিজ্য কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। এর জন্য ব্যক্তিগত এবং সমাজসেবামূলক সংস্থাগুলোর পাশাপাশি দেশের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থা এবং সরকারি প্রচেষ্টা মাদক নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে ফলপ্রসূ হতে পারে।

সামাজিক প্রচেষ্টা
১. মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা এবং তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
২. মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে পরামর্শ দেওয়া।
৩. পুনর্বাসন করে সমাজের স্বাভাবিক স্রোতে এনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা।
সরকারি প্রচেষ্টা
১. মাদক সেবন, বিক্রয় নিষিদ্ধ করা। এ ব্যাপারে কড়া আইন প্রণয়ন করে কঠোরভাবে সেগুলো প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
২. মাদক সেবনের কুপ্রভাবগুলো সরকারি ও বেসরকারি প্রচারমাধ্যম দ্বারা মানুষকে অবহিত করা।
৩. আমাদের দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন বলবৎ আছে। আইনগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ হলে মাদকের বিষাক্ত ছোবল থেকে মানুষ ও দেশকে অনেকটুকু বাঁচানো সম্ভব হবে।

Content updated By