নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - পৌরনীতি ও নাগরিকতা - পৌরনীতি ও নাগরিকতা | NCTB BOOK

রাষ্ট্র কখন ও কীভাবে উৎপত্তি লাভ করেছে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অতীত ইতিহাস ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে কতগুলো মতবাদ প্রদান করেছেন । তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১। ঐশী মতবাদ, ২। বল বা শক্তি প্রয়োগ মতবাদ, ৩ । সামাজিক চুক্তি মতবাদ ও ৪। ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ ।

১. ঐশী মতবাদ এটি রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সবচেয়ে পুরাতন মতবাদ । এ মতবাদে বলা হয়- বিধাতা বা স্রষ্টা স্বয়ং রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন এবং রাষ্ট্রকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তিনি শাসক প্রেরণ করেছেন । শাসক তাঁর প্রতিনিধি এবং তিনি তার কাজের জন্য একমাত্র স্রষ্টা বা বিধাতার নিকট দায়ী, জনগণের নিকট নয় । শাসক যেহেতু স্রষ্টার নির্দেশে কাজ করে, সেহেতু শাসকের আদেশ অমান্য করার অর্থ বিধাতার নির্দেশ অমান্য করা । এ মতবাদকে বিধাতার সৃষ্টিমূলক মতবাদও বলা হয় । এ মতবাদ অনুসারে শাসক একাধারে যেমন রাষ্ট্রপ্রধান এবং অন্যদিকে তিনিই আবার ধর্মীয় প্রধান। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এ মতবাদকে বিপদজনক, অগণতান্ত্রিক ও অযৌক্তিক বলে সমালোচনা করেন । তাদের মতে, যেখানে জনগণের নিকট শাসক দায়ী থাকে না, সেখানে স্বৈরশাসন সৃষ্টি হয় ।

২. বল বা শক্তি প্রয়োগ মতবাদ এ মতবাদের মূল বক্তব্য হলো- বল বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে এবং শক্তির জোরে রাষ্ট্র টিকে আছে । এ মতবাদে বলা হয়, সমাজের বলশালী ব্যক্তিরা যুদ্ধ-বিগ্রহ বা বল প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্বলের উপর নিজেদের আধিপত্য স্থাপনের মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে এবং শাসনকার্য পরিচালনা করে। এ মতবাদে আরও বলা হয়, সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এভাবেই যুদ্ধ- বিগ্রহের মাধ্যমে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। সমালোচকরা এ মতবাদকে অযৌক্তিক, প্রাপ্ত ও ক্ষতিকর বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলেন, শক্তির মাধ্যমেই যদি রাষ্ট্র টিকে থাকত তাহলে শক্তিশালী রাষ্ট্রের পাশাপাশি সামরিক দিক থেকে দুর্বল রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারত না। আসলে শক্তির জোরে নয় বরং সম্মতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ে উঠে এবং টিকে থাকে ।

৩. সামাজিক চুক্তি गान এ মতবাদের মূলকথা হলো- সমাজে বসবাসকারী জনগণের পারস্পরিক চুক্তির ফলে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। ব্রিটিশ রাষ্ট্র দার্শনিক টমাস হবসু ও জন শক এবং ফরাসি দার্শনিক জ্যা জ্যাক রুশো সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রবর্তক ছিলেন। টমাস হবস্ जन्म नक এ মতবাদ অনুযায়ী, রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত। তারা প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলত এবং প্রাকৃতিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যে আইন অমান্য করলে শাস্তি দেয়ার কোনো কর্তৃপক্ষ ছিল না। ফলে সামাজিক জীবনে অরাজকতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। মানুষ হয়ে উঠে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। দুর্বলের উপর চলে সবলের অত্যাচার। এ কারণে মানুষের জীবন কষ্টকর ও দুর্বিষহ হয়ে উঠে। এ ছাড়া প্রকৃতির রাজ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। প্রকৃতির রাজ্যের এ অরাজকতাপূর্ণ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করে এবং নিরাপত্তার বিনিময়ে নিজেদের উপর শাসন করার জন্য স্থায়ীভাবে শাসকের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে।

৪. ঐতিহাসিক বা নিবর্তনমূলক মতবাদ এ মতবাদের মূল বক্তব্য হলো- রাষ্ট্র কোনো একটি বিশেষ কারণে হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিনের বিবর্তনের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন শক্তি ও উপাদান ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে হতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। যেসব উপাদানের কার্যকারিতার ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে, সেগুলো হলো- সংস্কৃতির বন্ধন, রক্তের বন্ধন, ধর্মের বন্ধন, যুদ্ধবিগ্রহ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনা ও কার্যকলাপ । ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ সম্পর্কে ড. গার্নার বলেন, 'রাষ্ট্র বিষাভার সৃষ্টি নয়, ফল প্রয়োগের মাধ্যমেও সৃষ্টি হয়নি বরং ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনের ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে।' রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য মতবাদ । এ মতবাদে রাষ্ট্রের উৎপত্তির সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় । আসলে বর্তমানের রাষ্ট্র বহুযুগের বিবর্তনের ফল ।