নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং - অর্থায়ন ও ব্যবসায় অর্থায়ন | NCTB BOOK

কারবারি অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা বলতে কারবারের জন্য প্রয়োজনমাফিক তহবিল সংগ্রহ, স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে সেই তহবিল বিনিয়োগ এবং তহবিল বণ্টনসংক্রান্ত ব্যবস্থাপনাকে বুঝায়। এই ব্যবস্থাপনার কিছু নীতিমালা আছে, যা নিচে তুলে ধরা হলো।

ক) তারল্য বনাম মুনাফানীতি

একজন মুদি দোকানি তার প্রতিদিনের বিক্রয়লব্ধ নগদ আয় (তরল সম্পদ) সম্পূর্ণটাই কাচামাল ক্রয় ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয়ের কথা চিন্তা করে নিজের কাছে রেখে দিতে পারে অথবা সেই নগদ অর্থের কিছু অংশ কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য রেখে বাকিটা কোনো ব্যাংকের একাউন্টে জমা রাখতে পারে, যা থেকে নির্দিষ্ট সময়ে কিছু সুদ/মুনাফা পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে দোকানিকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, নগদ অর্থ কী পরিমাণ নিজের কাছে রাখলে দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটানো সম্ভব। যদি নগদ অর্থ বেশি পরিমাণে দোকানি নিজের কাছে রেখে দেয়, তাতে ব্যাংক থেকে প্রাপ্য আয়ের পরিমাণ কমে যাবে। আবার ব্যাংকে বেশি পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলে ব্যবসার দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় নগদ অর্থের ঘাটতি হবে, যা ব্যবসার সুষ্ঠু পরিচালনাকে ব্যাহত করবে। ফলে ব্যবসায়ীকে তারল্য ও বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য রেখে আর্থিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। অর্থাৎ একদিকে তাকে যেমন দৈনন্দিন কার্য পরিচালনার মতো নগদ অর্থ হাতে রাখা প্রয়োজন, অন্যদিকে মুনাফা অর্জনের জন্য সেই অর্থ বিনিয়োগ করাও প্রয়োজন। নগদ অর্থ ও মুনাফার মধ্যে বিপরীত সম্পর্ক। নগদ অর্থ বেশি রাখলে মুনাফা কমে যায়, আবার মুনাফা বৃদ্ধিকল্পে বেশি বিনিয়োগ করা হলে তারল্যে ঘাটতি হয়। তারল্য ও মুনাফার মধ্যে উপযুক্ত ভারসাম্য বজায় রাখা অর্থায়নের একটি অন্যতম নীতি।

খ) উপযুক্ততার নীতি

স্বল্পমেয়াদি তহবিল দিয়ে চলতি মূলধন ও দীর্ঘমেয়াদি তহবিল দিয়ে স্থায়ী মূলধন সরবরাহ করা অর্থায়নের একটি নীতি। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালিয়ে রাখার জন্য যে নিত্যনৈমিত্তিক অর্থের প্রয়োজন হয়, সেটিই চলতি মূলধন; যেমন: কাঁচামাল ক্রয়, শ্রমিকের মজুরি প্রদান ইত্যাদি। অন্যদিকে মেশিন ক্রয়, কারবারের দালানকোঠা নির্মাণ ইত্যাদি হলো স্থায়ী মূলধন। চলতি মূলধনের পরিমাণ কম হয় বলে এর উৎসও কম হয়, ফলে এটি স্বল্পমেয়াদি উৎস হতে সংগ্রহ করা ভালো। বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিভিন্ন অর্থায়ন প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগ ব্যাংক, ডিবেঞ্চারহোল্ডার, এই ধরনের উৎসগুলো দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে থাকে। পক্ষান্তরে বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে চলতি মূলধন ব্যবস্থাপনা করা উচিত। দীর্ঘমেয়াদি উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহের জন্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিক হারে সুদ প্রদান করতে হয়। ফলে যদি চলতি ব্যয় নির্বাহের জন্য দীর্ঘমেয়াদি উৎস হতে অর্থ সংগ্রহ করা হয়, তবে দেখা যায় উপার্জিত আয় হতে ঋণের সুদ পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে যায় ।

গ) কারবারের বৈচিত্র্যায়ণ ও ঝুঁকি বণ্টন

তহবিল বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কারবারি পণ্য বা সেবা যতদূর সম্ভব বৈচিত্র্যপূর্ণ হলে কারবারের ঝুঁকি বণ্টিত হয় ও হ্রাস পায়। প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে কেন্দ্র করে মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করে। ফলে ব্যবসাকে নানামুখী ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়। এই ঝুঁকিগুলো বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হতে পারে। যেমন: অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন, বাজারে নতুন পণ্যের উপস্থিতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আকস্মিক দুর্ঘটনা ইত্যাদি। এসব পরিবর্তনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা বা এর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ব্যবস্থাপকদের পক্ষে সাধারণত সম্ভব নয়। তবে ঝুঁকি বণ্টনের নীতি অনুসরণের ফলে অনিশ্চিত বাজার পরিস্থিতিতেও প্রত্যাশিত মুনাফা অর্জন সম্ভব। একজন ব্যবসায়ী যদি শুধু একধরনের পণ্যের ব্যবসা করে, তাহলে ব্যবসায়ের মুনাফা অর্জন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে কারবারের পণ্য যদি বিভিন্ন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়, তাহলে ঝুঁকি বণ্টিত হয়ে যায়। অর্থাৎ কোনো একটি পরিস্থিতিতে একটি পণ্যের বিক্রয় হ্রাস পেলে অন্যান্য পণ্যের বিক্রয় দিয়ে কারবারটির হ্রাসকৃত বিক্রয় পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হয়, ফলে সব ধরনের অবস্থায় কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ মুনাফা অর্জিত হয়। একজন মুদি ব্যবসায়ী যদি তার দোকানে সনাতনী সাবান ও হালাল সাবান দু'ধরনের সাবানই বিক্রয় করেন তবে দু'ধরনের ক্রেতারই দোকানে সমাগম হবে। দোকানি যদি শুধু সাধারণ বা সনাতনী সাবান রাখেন, তবে হালাল সাবানের ক্রেতারা অন্য দোকানে গিয়ে হালাল সাবান কিনবে, এতে শুধু সনাতনী সাবান বিক্রেতার মোট বিক্রয় হ্রাস পাবে। আবহাওয়া ও ঋতুভেদেও কোনো কোনো পণ্যের বিক্রয় হ্রাস বা বৃদ্ধি হয়। যেমন: শীতবস্ত্রের চাহিদা শুধু শীতকালে বেশি থাকে। ফলে এই সময়ে এর বিক্রয় বৃদ্ধি পায়। একজন কাপড় বিক্রেতা যদি শীতবস্ত্র ও গ্রীষ্মকালীন বস্ত্র দুই ধরনের বস্ত্রই তার দোকানে বিক্রয় করেন, তবে ঋতুভিত্তিক পণ্যের চাহিদা হ্রাস-বৃদ্ধির কারণে মুনাফা অর্জন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এমনিভাবে একটি বইয়ের দোকানে যদি শুধু কবিতার বই বিক্রয় করা হয়, আর পাশাপাশি অন্য একটি দোকানে যদি কবিতার বই, গল্পের বই, ধর্মীয় বই, বিভিন্ন শিক্ষণীয় বই বিক্রয় করা হয়, তবে দেখা যায় ক্রেতারা বই কেনার জন্য পরের দোকানটিতেই ভিড় করবে। কারণ ক্রেতারা সেখান থেকে নানা ধরনের প্রয়োজনীয় বই একই সাথে কিনতে পারবে। ঝুঁকি হ্রাসে বৈচিত্র্যায়ণের এই নীতি তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। সেখানে একটি উৎসের বদলে বহুবিধ উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ করাকে প্রাধান্য দেয়া হয় ।

Content updated By