SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় - রাষ্ট্র, নাগরিকতা ও আইন | NCTB BOOK

নাগরিকের ধারণা

রাষ্ট্র গঠনের একটি পূর্বশর্ত হলো জনসমষ্টি। যখন একটি রাষ্ট্র পূর্ণাঙ্গভাবে আত্মপ্রকাশ করে তখন সেই জনসমষ্টি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে এর নাগরিকের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। রাষ্ট্রের নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যজ্ঞানের ওপর রাষ্ট্রের কার্যক্রমের সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে। নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং কীভাবে সুনাগরিক হওয়া যায় তা আমাদের জানতে হবে।

ল্যাটিন শব্দ Civics থেকে Citizen বা নাগরিক শব্দটির উৎপত্তি হয়। পৌরনীতি পাঠের মূল বিষয়বস্তু হলো নাগরিকত্ব ও রাষ্ট্র। সাধারণত নাগরিক শব্দটি দ্বারা নগরে বসবাসরত অধিবাসীকে বোঝায়। একসময়ে যারা শাসনকার্যে সরাসরি জড়িত থাকতেন, তাদেরকেই কেবল নাগরিক হিসেবে ধরা হতো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল নাগরিকের সংজ্ঞায় বলেছেন, 'সে ব্যক্তিই নাগরিক যে নগর রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব ও শাসনকার্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তিনি তাঁর ধারণায় অধিকাংশ জনগণকে নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেননি। তাঁর মতে অধিকাংশেরই যথাযথভাবে নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করার সামর্থ্য কিংবা অফুরন্ত সময় নেই। গ্রিক নগররাষ্ট্রে এ যুক্তিতে দাস এবং নারীদের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো না এবং তারা রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ করতে পারত না।

বর্তমানে নগর রাষ্ট্রের স্থলে জাতীয় রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছে। আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ আয়তনে অনেক বড়, এখানে জনসংখ্যাও বেশি এবং নাগরিক সুবিধাসমূহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সকলেই ভোগ করে। কিন্তু এত বিপুল জনসমষ্টিকে সরাসরি শাসনকার্যে অন্তর্ভূক্ত করা সম্ভব নয়। তাই নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে জনগণের শাসনকার্যে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের স্থলে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন এবং যারা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করেন এই মাপকাঠি ধরা হয়েছে। আধুনিক ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড জে'লাকি তাঁর নাগরিকের সংজ্ঞায় বলেছেন, 'যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে তাকেই নাগরিক বলা হয়। অধ্যাপক গেটেল বলেন, "নাগরিক হচ্ছে রাজনৈতিক সমাজের সেসব সদস্য, যারা উক্ত সমাজের প্রতি কর্তব্য পালনে বাধ্য থাকেন এবং সমাজ থেকে সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা লাভের অধিকারী হন।

সুতরাং, নাগরিকত্ব বলতে বোঝায়, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অধিকার, নাগরিক সুবিধা ভোগ করা এবং রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বাধ্য হওয়া। বৃহৎ অর্থে, নাগরিক হচ্ছেন তিনি, যিনি ঐ রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং রাষ্ট্রের আইন, সংবিধান ও অন্যান্য নির্দেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনে নিজের কর্মের মাধ্যমে ভূমিকা রাখেন এবং রাষ্ট্র কর্তৃক কণ্টনকৃত সকল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সকলেই সমান অধিকার ভোগ করে। বর্তমানে নারী-পুরুষ, ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে সকলেই নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারে; তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব অর্জনের শর্তাবলী বিভিন্ন রকম।নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য

রাষ্ট্র যেমন নাগরিকদের বিবিধ সুযোগ-সুবিধা এবং অধিকার দিয়ে থাকে তেমনি রাষ্ট্রের প্রতিও নাগরিকদের কতগুলো পায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর নির্ভরশীল ও পরিপূরক। নাগরিকদের উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ নিম্নরূপ :

নাগরিকের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নির্দেশ মেনে চলা। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা,অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য প্রত্যেক নাগরিককে সর্বদা সজাগ এবং চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন ও সংবিধান মেনে চলা এবং আইনের প্রতি সম্মান দেখানো নাগরিকদের অন্যতম দায়িত্ব। কেউ আইন অমান্য করলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। স্বাভাবিক জীবনের ব্যাঘাত ঘটে। তাই সুষ্ঠু জীবনযাপন, শান্তি শুশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রত্যেক নাগরিককে আইন মেনে চলতে হবে। সততা ও সুবিবেচনার সাথে ভোট দেওয়া নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। এর ফলে যোগ্য ও উপযুক্ত প্রার্থী জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হবেন। অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ প্রার্থীকে ভোটদানে বিরত থাকা উচিত। রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস নাগরিকদের প্রদেয় কর ও খাজনা। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক প্রতিরক্ষা এবং উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। নাগরিকদের যথাসময়ে কর প্রদান করে রাষ্ট্রীয় কাজে সহযোগিতা করতে হবে। রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা নাগরিকের কর্তব্য। সরকারের গৃহীত যে কোনো কাজ জনগণের কাজ। নাগরিকদের সততা, কাজে একাগ্রতা ও নিষ্ঠার ওপর সরকারের সফলতা, উন্নতি ও অগ্রগতি নির্ভর করে। প্রতিটি শিশুই রাষ্ট্রের নাগরিক। পিতামাতা তার অভিভাবক হিসেবে কাজ করেন। তাই সন্তানদের জীবন রক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষেধক টিকাদান, সুস্থ সবল রাখা এবং নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলে পাঠানো পিতামাতার দায়িত্ব। এতে করে সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে অবদান রাখবে।প্রত্যেক নাগরিককেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। নিজস্ব সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় অর্জন ও সফলতা এবং সবসময় দেশের মঙ্গল কামনা করা নাগরিকদের কর্তব্য। জাতীয় সংগীত, জাতীয় ইতিহাস, জাতীয় বীর ও মনীষীদের অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হবে। প্রত্যেক নাগরিকের একে অপরকে সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে। ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, ভিন্নমত মূল্যায়ন করা ও সম্মান করার মধ্য দিয়ে জাতীয় সংহতি অর্জন করা সম্ভব। এটা প্রত্যেককেই বিশ্বাস করতে হবে যে, বৈচিত্র্যের মধ্যেই সৌন্দর্য নিহিত। প্রত্যেক নাগরিককেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এমনকি রাষ্ট্রের বেজাইনি কোনো কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নাগরিকদের নৈতিক দায়িত্ব। তবে কোনোক্রমেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। তাহলেই সুশাসন এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে।

Content added By