নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় - জাতীয় সম্পদ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা | NCTB BOOK

আমরা সাধারণত অর্থ, জমিজমা, বাড়ি, নানারকম প্রয়োজনীয় ও বাধ দ্রব্যসামগ্রী, বর্ণ-রৌপ্য প্রভৃতিকে সম্পদ বলে থাকি। প্রকৃত অর্থে কোনো বস্তু বা দ্রব্যকে সম্পদ কাতে হলে সে ককুর উপযোগ, অপ্রাচুর্য, বাহ্যিকতা এবং হস্তাস্তরযোগ্যতা থাকতে হবে। এগুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো- উপযোগ : কোনো প্রব্যের মানুষের অভাব পূরণের ক্ষমতাকে উপযোগ বলে। যেমন, মানুষের বরের প্রয়োজন বা অভাব আছে। শার্ট, প্যান্ট, শাড়ি- এসব দ্রব্যের বক্সের অভাব পূরণের ক্ষমতা আছে। অর্থাৎ এগুলোর উপযোগ আছে।

অপ্রাচূর্য কোনো দ্রব্য বা সেবার চাহিদার তুলনায় যোগান বা সরবরাহের পরিমাণ কম হলে দ্রব্যটির অপ্রচূর্য দেখা দেয়। যেমন-খাদ্য। যে কোনো দেশে যে কোনো সময়ে খাদ্যের সরবরাহ এর চাহিদার তুলনায় কম। সেই জন্য খাদ্য পেতে হলে এর নাম পরিশোধ করতে হয়। অর্থাৎ খাদ্যের প্রাচুর্য আাছে। পাবার, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য মানুষের প্রতিমুহূর্তেই বাতাসের প্রয়োজন। কিন্তু প্রকৃতিতে বাতাস আরম্ভ হওয়ায় প্রয়োজনের তুলনায় এর সরবরাহ বেশি। তাই বাতাসের জন্য মানুষকে কোনো নাম দিতে হয় না। অর্থাৎ বলা যায়, বাতাদের অপ্রাচুর্য নেই। শুধু উপযোগ ও অধাচূর্য থাকলে একটি জিনিস সম্পদ নাও হতে পারে, যেমন- স্বাস্থের অপ্রাচূর্য এবং উপযোগিতা আছে কিছু বাহ্যিকতা ও হস্তান্তরযোগ্যতা না থাকায় একে সম্পদ বলা যাবে না। তবে কোনো স্বাস্থ্যবান পুরুষ যখন দেহ স্বাস্থ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনে সক্ষম হবেন তখন তার ঐ বিশেষ ধরনের স্বাস্থ্যটি সম্পদ বলে গণ্য হবে।

সম্পদের শ্রেণিবিভাগ

সম্পদকে ব্যক্তিগত, একান্ত ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক- এই পাঁচ শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায়। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জায়গা-জমি, বাড়িঘর, কলকারখানা, অর্থসম্পদ, গাড়ি, দ্রব্যসামগ্রী ইত্যাদি ব্যক্তিগত সম্পদ। নিজস্ব প্রতিভা, ব্যক্তির দক্ষতা ইত্যাদি যদিও হস্তান্তরযোগ্য নয়, কিন্তু ব্যক্তি এগুলো ব্যবহার করে সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে। তাই এগুলো একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদের অন্তর্ভুক্ত।

সমাজের সকলে সম্মিলিতভাবে যে সকল সম্পদ ভোগ করে, সেগুলো সমষ্টিগত সম্পদ। এই সম্পদের ওপরে সকল নাগরিকের সমান অধিকার থাকে এবং এগুলোর প্রতি তাদের সমান দায়িত্বও রয়েছে। রাস্তাঘাট, রেলপথ, বাঁধ, পার্ক,সরকারি হাসপাতাল ও স্কুল, রাষ্ট্রের মালিকানাধীন সকল প্রাকৃতিক সম্পদ (যেমন- বনাঞ্চল, খনিজসম্পদ, নদ-নদী ইত্যাদি) প্রভৃতি সমষ্টিগত সম্পদ। রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের ব্যক্তিগত, একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ এবং সমাজের সমষ্টিগত সম্পদকে একত্রে জাতীয় সম্পদ বলে। তাছাড়া কোনো জাতির নাগরিকের গুণবাচক বৈশিষ্ট্য, যেমন- কর্মদক্ষতা, উদ্ভাবনী শক্তি প্রযুক্তিগত জ্ঞান ইত্যাদি জাতীয় সম্পদের অন্তর্ভুক্ত।

কোনো কোনো সম্পদ আছে, যা বিশেষ কোনো রাষ্ট্রের মালিকানাধীন নয়। বিশ্বের সকল জাতিই সেগুলো ভোগ করতে পারে। এগুলো আন্তর্জাতিক সম্পদ। উদাহরণ হিসেবে সাগর-মহাসাগর, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, প্রযুক্তি ইত্যাদির কথা বলা যায়।

জাতীয় সম্পদের উৎস

জাতীয় সম্পদের উৎস প্রধানত দুটি। প্রথমটি প্রকৃতি প্রদত্ত আর দ্বিতীয়টি মানবসৃষ্ট। কোনো দেশের ভৌগোলিক সীমানার ভিতরের ভূমি, ভূমির উপরিস্থিত এবং অভ্যন্তরস্থ যা কিছু সবই প্রকৃতির দান। প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও বনের গাছপালা-ফলমূল-প্রাণী ও পাখিকুল, নদ-নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয় এবং এগুলোর মৎস্যসম্পদ, অন্যান্য জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ, ভূমির অভ্যন্তরস্থ পানি ও সকল রকম খনিজ সম্পদ-এ সবই প্রকৃতি প্রদত্ত জাতীয় সম্পদ।

কোনো দেশের অধিবাসীরা তাদের শ্রম ও মূলধনের সাহায্যে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার, সগ্রহ ও উত্তোলন করে এবং সেগুলোর রূপান্তর বা স্থানান্তর করে যে নতুন সম্পদ সৃষ্টি করে তা মানবসৃষ্ট সম্পদ। মানুষ ভূমি আবাদ করে শস্য-ফল-ফুল-গাছপালা উৎপাদন করে। জলাশয়ে মাছ চাষ করে, খনিজ সম্পদ উত্তোলন করে ব্যবহার উপযোগী করে। এছাড়া ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে বা সরকারের অর্থ ও পরিচালনায় রাস্তাঘাট, কলকারখানা, যন্ত্রপাতি, যানবাহন, বাঁধ ও সেতু এবং নানারকম স্থাপনা নির্মাণ করে এবং নানারকম শিল্পদ্রব্য উৎপাদন করে। এভাবে দেশের নাগরিকেরা সারা বছরব্যাপী নানারকম অর্থনৈতিক দ্রব্য ও সেবা অর্থাৎ সম্পদ সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত থাকে। এসব মানব সৃষ্ট সম্পদ।

জাতীয় সম্পদের সংরক্ষণ ও অপচয়রোধ

সংরক্ষণের অর্থ বিশেষভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান। আমরা জানি, একটি দেশের সকল নাগরিকের ব্যক্তিগত সম্পদ ও সমষ্টিগত সম্পদ একত্রে জাতীয় সম্পদ। সমষ্টিগত সম্পদের মধ্যে সকল জনগণ সম্মিলিতভাবে যেসব সম্পদের মালিক সেগুলো এবং রাষ্ট্রের মালিকানাধীন সকল প্রাকৃতিক ও উৎপাদিত সম্পদ অন্তর্ভুক্ত। তাই জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণ বলতে ব্যক্তিগত সম্পদ ও সমষ্টিগত সম্পদ উভয়েরই সাক্ষণ বোঝায়।

(ক) ব্যক্তিগত সম্পদ সংরক্ষণ

কোনো বস্তু, দ্রব্য, প্রতিষ্ঠান, সম্পত্তি, বিশেষ যত্নসহকারে রক্ষা করা ও তার তত্ত্বাবধান করাকে বলে সরক্ষণ। ব্যক্তি সাধারণত তার নিজস্ব সম্পদ, যেমন- অর্থ সম্পদ, ভূসম্পত্তি, স্বর্ণ-রৌপ্য, অলংকার, আসবাবপত্র, নিজস্ব কলকারখানা বা শিল্প প্রতিষ্ঠান, যানবাহন ইত্যাদি নিজ স্বার্থেই বিশেষ যত্নের সাথে রক্ষণাবেক্ষণ করে। শুধু তাই নয়, সে এগুলোর উন্নয়ন করতে ও বৃদ্ধি করতেও তৎপর থাকে। এছাড়া প্রত্যেকেই নিজস্ব সম্পদের অপচয় রোধ করতে এগুলোর তত্ত্বাবধানও করে। কোন সম্পদ কোথায় কী অবস্থায় আছে তার খোঁজখবর রাখা, সম্পদের কোনোরকম ক্ষতির কারণ ঘটলে তা রোধ করা বা দূর করা, সম্পদ নষ্ট হলে যথাসম্ভব তা পূরণ করার ব্যবস্থা নেওয়াও সংরক্ষণ কাজের অন্তর্ভুক্ত। ব্যক্তি সাধারণত তার নিজস্ব সম্পদ অযথা ব্যয় করে না বা অপচয় করে না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় না করার জন্য সে সর্বদা সতর্ক থাকে।

(খ) সমষ্টিগত সম্পদ রক্ষণ

রাস্তাঘাট, সেতু, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন যানবাহন (গাড়ি, ট্রেন, জাহাজ, বিমান ইত্যাদি ) ও কলকারখানা, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান, অফিস ভবন, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, প্রাকৃতিক সম্পদ, ভূমি ও ভূমির উপরিস্থিত এবং অভ্যন্তরভাগের সম্পদ ( বনাঞ্চল, নদী-নালা, জলাশয়, মৎস্য সম্পদ, খনিজ সম্পদ ইত্যাদি)- এসবই সমষ্টিগত সম্পদের অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্র ও জনগণ সম্মিলিতভাবে এসব সম্পদের অধিকারী। জনগণ এগুলো ব্যবহার করে ও ভোগ করে। এগুলোর পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্র জনগণের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তাই এসব সমষ্টিগত সম্পদ সরক্ষণে প্রতিটি নাগরিকেরই বিশেষ যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া সমষ্টিগত সম্পদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের যথাযথভাবে তার দায়িত্ব পালন করা আবশ্যক।

বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদের সরক্ষণ ও অপচয় রোধে করণীয়

• জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয় যেসব ব্যবস্থা আছে, সেগুলো যাতে কোনোভাবে ব্যাহত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা। আমরা জানি যে, সেতু, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, অফিস ভবন ইত্যাদি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিরাপত্তা রক্ষী থাকে। এসব কোনো সময় অরক্ষিত দেখলে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো।

• কেউ যেন এসব সম্পদের কোনো ক্ষতিসাধন না করে সে বিষয়ে সচেতন থাকা। এ ধরনের কোনো অপচেষ্টার বিষয়ে জানলে বা দেখলে যথাযথ ব্যক্তি/কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে অবৈধভাবে গাছ কাটা, পশুপাখি শিকার করা ইত্যাদি জাতীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন করা হিসেবে গণ্য হবে।

• জাতীয় সম্পদের উন্নয়ন ও বৃদ্ধিসাধনের জন্য সচেষ্ট থাকা।

• সমষ্টিগত বা জাতীয় সম্পদের অপব্যবহার ও অপচয়রোধে সচেতন ও সচেষ্ট থাকা, যেমন- রাষ্ট্রীয় সংস্থা কর্তৃক সরবরাহকৃত পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদি অপ্রয়োজনে খরচ না করা এবং এগুলো ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়া। সম্পদ সংরক্ষণের জন্য নিজ নিজ কর্তব্য বিষয়ে প্রতিটি নাগরিক সচেতন ও সচেষ্ট থাকলে 

জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণ

এগুলোর অপচয় রোধ করা কঠিন নয়। নাগরিকদের সচেতন করার জন্য গণমাধ্যমে তাদের করণীয় সম্পর্কে প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সম্পদ সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের জন্য নির্ধারিত সংস্থার দায়িত্ব ও কর্তব্য সংস্থার দলিলসমূহে সুস্পষ্টভাবে বিবৃত থাকে। সংস্থার কর্মকর্তা কর্মচারীবৃন্দের এসব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে তৎপর থাকা এবং এসব দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা।

Content added By