অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় - বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ | NCTB BOOK

ক. প্রবাসে বাঙালিদের ভূমিকা ও কুটনৈতিক তৎপরতা

মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাঙালিরা গণহত্যার প্রতিবাদে ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে একত্রিত হতে থাকে। যুক্তরাজ্যকে কেন্দ্র করে সমগ্র ইউরোপে প্রবাসীদের আন্দোলন চলে । যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সুইডেন, ফ্রান্স, কানাডা ও ইন্দোনেশিয়ার বাঙালিরাও সোচ্চার হয়ে উঠে। গণহত্যার প্রতিবাদে তারা সভা-সমাবেশ আয়োজন করে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ও অর্থ সংগ্রহ করে। কেউ কেউ ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধে অংশ নেয়। বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য মুজিবনগর সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিশেষ দূত নিয়োগ করে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিদেশে সমর্থন আদায় ও জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। যারা এ সময় জীবন ও চাকরির মায়া ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দেয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইরাক, ফিলিপাইন, আর্জেন্টিনা, ভারত ও হংকং দূতাবাসের বাঙালি কর্মকর্তারা। তাদের পদত্যাগ ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর প্রচেষ্টায় জাতিসংঘে ৪৭টি দেশের প্রতিনিধি বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। এতে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই এপ্রিল মাসে প্রবাসী বাঙালি মহিলাদের একটি প্রতিবাদ মিছিল লন্ডনের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণের পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে গিয়ে স্মারকলিপি পেশ করে । জুন মাসে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে লন্ডনে মিছিলের আয়োজন করে। মিছিল শেষে এই প্রতিবাদকারীগণ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে গিয়ে স্মারকলিপি পেশ করে । 

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকেই বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) দিল্লি ও কলকাতায় বাংলাদেশের দুটি মিশন স্থাপন করে। কলকাতাতেই প্রথম বাংলাদেশ মিশন স্থাপিত হয়। এছাড়া বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক এবং লন্ডনেও বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করে । এসব মিশন বাংলাদেশের পক্ষে মিছিল, সমাবেশ, বিভিন্ন অনুষ্ঠান, পার্লামেন্ট সদস্যদের সমর্থন আদায় ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবদান রাখে।

 

খ. বহি:বিশ্বের ভূমিকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পৃথিবীর বড় ও ছোট অনেক দেশ বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন বিভিন্নভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এসব দেশের মধ্যে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে।

ভারত

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণে ভারতের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। ভারত সরকার ২৫শে মার্চ থেকে সংগঠিত পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার নিন্দা করে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের অজুহাতে তখন যে গণহত্যা শুরু হয়েছিল, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তা প্রতিহত করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন । তিনি এই উদ্দেশ্যে প্রায় তিন সপ্তাহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। এসব রাষ্ট্র সফরে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, কূটনৈতিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন। নভেম্বরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে দেখা করেন। এছাড়া ওয়াশিংটনে তিনি বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তাদের সাথেও সাক্ষাৎ করেন। তাঁর সাথে ভারতের বিভিন্ন মন্ত্রী, নেতা ও কর্মকর্তারাও বিদেশ সফর করে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন।

গণহত্যার হাত থেকে বাঁচতে সীমান্ত পেরিয়ে আসা প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে ভারত আশ্রয় দেয় এবং তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়। বাঙালি শরণার্থীদের ব্যয় নির্বাহের জন্য ভারত সরকার এ সময় 'শরণার্থী কর' নামে নতুন একটি কর আরোপ করে। ভারতের মাটিতে এপ্রিলের শেষ দিকে বাঙালি যুবকদের সশস্ত্র ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয় যা নভেম্বর মাস পর্যন্ত চলে। পাশাপাশি কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার পরিচালনা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র' নামে এই সরকারের বেতার কেন্দ্র স্থাপনে ভারত সহায়তা করে ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চার হাজার অফিসার ও জোয়ান প্রাণ বিসর্জন দেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সে দেশের সর্বস্তরের জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে। সরকারের পাশাপাশি ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংগঠন, লেখক-শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী সম্প্রদায় সকলেই এ সময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। ভারতের খ্যাতিমান শিল্পী রবি শঙ্করের উদ্যোগে নিউইয়র্কে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' এর আয়োজন করা হয়। যুক্তরাজ্যের শিল্পী জর্জ হ্যারিসন এই কনসার্টে অংশ নেন। কনসার্ট থেকে প্রাপ্ত অর্থ বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার)-এর হাতে তুলে দেয়া হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিল। এপ্রিলের শুরুতেই সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদপনি বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে চিঠি দেন। শুরা ডিসেম্বর চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধবিরতি বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। উদ্দেশ্য ছিল যৌথবাহিনী যাতে সামরিক বিজয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ও সুযোগ পায়। যৌথবাহিনীকে ঢাকা দখল করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যে কোনো প্রকারে যুদ্ধবিরতির পদক্ষেপকে ঠেকিয়ে রাখাই নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো দানের উদ্দেশ্য ছিল। তাদের এ উদ্দেশ্য সফল হয় ।

যুক্তরাষ্ট্র

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নীতি ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। প্রথমদিকে অস্ত্র এবং সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানকে সহায়তা করে। তবে নিজ দেশের বিরোধী দলের চাপে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতে অবস্থানরত বাঙালি শরণার্থীদের জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রচণ্ড ভারত-বিরোধী ও পাকিস্তান-ঘেঁষা নীতি অনুসরণ করতে থাকে। স্বভাবতই তাদের ভূমিকা বাংলাদেশের বিপক্ষে যায়। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সমর্থনে ভারত মহাসাগরে তাদের সপ্তম নৌবহর পাঠায়। সোভিয়েত ইউনিয়নও পাল্টা নৌবহর পাঠায়। তবে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে শেষ পর্যন্ত তারা সে নৌবহরকে কাজে লাগায় নি। পাকিস্তানের পরাজয়ের মুখে যুদ্ধ বিরতি ঘটিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বাধাগ্রস্ত করতেও জাতিসংঘে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা কংগ্রেসের অনেক সদস্য, বিভিন্ন সংবাদপত্র, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সর্বস্তরের জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা পালন করে ।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার সময় থেকে বিদেশি সাংবাদিকরা পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে। তারাই প্রথম বহির্বিশ্বে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও বর্বরতার খবর ছড়িয়ে দেয়। সাইমন ড্রিং এরকমই একজন সাংবাদিক। ১৯৭১ এর মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তান সরকার কিছু বিদেশি সাংবাদিককে নিয়ন্ত্রিতভাবে বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকা সফর করিয়ে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন লেখানোর ফন্দি আঁটে। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। নিজ চোখে সব দেখে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা সম্পর্কে অবহিত হয় এবং সত্য কথা লিখে পত্রিকা ও বেতারের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে তা অবহিত করে। এভাবে এন্থনি ম্যাসকারেনহাস গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের চাঞ্চল্যকর তথ্য সারা বিশ্বে প্রকাশ করেন। বিবিসির সাংবাদিক মার্ক টালি পুরোটা সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে খবর প্রচার করে গেছেন। এদিকে দেশে অবরুদ্ধ থেকেও অনেক বাঙালি সাংবাদিক ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে খবর পাঠিয়েছেন। এজন্য তাদের শত্রুর হাতে চরম মূল্যও দিতে হয়। একাত্তরের শহিদ নিজামউদ্দিন ও নাজমুল হক এরকমই দুজন সাংবাদিক। এছাড়া আকাশবাণী, বিবিসি, ভোয়া প্রভৃতি বেতারকেন্দ্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিল। আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রতি রাতে প্রচারিত সংবাদ পরিক্রমা' খুবই জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল। এটি পাঠ করে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পরিচিত হয়ে উঠেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘বজ্রকণ্ঠ' ও ‘চরমপত্রসহ’ বিভিন্ন অনুষ্ঠান শ্রোতাদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছে।

কাজ- ১ : মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির পরিচয় ও ভূমিকা বর্ণনা করো । 

কাজ-২ : মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকার গুরুত্ব উল্লেখ করো। 

কাজ-৩ : মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা মূল্যায়ন করো। 

কাজ- ৪ : গ্রন্থাগার, জাদুঘর ও অন্যান্য সূত্র থেকে খবর ও চিত্র সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি দেয়াল পত্রিকা প্রস্তুত করো।

Content added By