শেষ পর্যন্ত এক কৃষ্ণজীবী পরিবারেই বিয়ে হয় ছবি রাণীর। স্বামী ধনপতির একটি উন্নত জাতের গাড়ি আছে, গাড়ির একটি ছোট্ট বাছুর আছে। সেই বাছুরকে মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত করে দুই বেলা গাড়ির সবটুকু দুধ দোহন করে নেয় ধনপতি। বাছুরকে জোরপূর্বক আটকে রেখে স্বামীকে সহায়তা করে ছবি রাণী। গাভি যেন সামান্য দুধও বাছুরের জন্য রাখতে না পারে, সেদিকে কড়া নজর তাদের। ক'দিন আগে ছবি রাণীর কোন জুড়ে আসে নবজাত ফুটফুটে এক শিশু সন্তান। এই শিশু যখন ক্ষুধায় কান্না করে, ছবি রাণী তখন পরিবারের সব কাজ ফেলে পরম মমতায় সন্তানকে মাতৃদুগ্ধদানে তৃপ্ত করে। একদিন তার শিশু সন্তানকে মাতৃদুগ্ধদানে পরিতৃপ্ত করতে গিয়ে সে অনুভব করে, মাতৃদুগ্ধ-বঞ্চিত রেখে কী নির্মম আচরণ করে যাচ্ছে তারা গাভির অসহায় বাছুরের ওপর। তারপর থেকে সে স্বামীকে এই কাজে আর সহায়তা করে না।
নিঝুম আর অহনা পরস্পরকে গভীরভাবে ভালোভাসে। তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়। কিন্তু নিঝুমের পরিবার সেটা মেনে নেয় না। কারণ, নিঝুম শিক্ষিত এবং ধনী পরিবারের একমাত্র সন্তান। অপরদিকে, অহনার পরিবার অত্যন্ত দরিদ্র। নিঝুম পরিবারের সম্মতিতে অন্যত্র বিয়ে করে এবং একসময় অহনাকে ভুলে যায় । অহনার দিন কাটে কষ্টের সমুদ্রে। কারণ, সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো মরে না ।
বকুল যখন স্বামীহারা হয় তখন তার মেয়ে পারুলের বয়স দুই বছর। একদিকে অর্থকষ্ট, অপরদিকে বদলোকের কুদৃষ্টি। লোকের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে, খেয়ে না খেয়ে মেয়েটাকে বড় করে বকুল। একসময় মেয়ের বিয়েও দেয়। কিন্তু বছর না ঘুরতেই অত্যাচারী স্বামীর সাথে সম্পর্ক ছেধ করে মায়ের কাছে ফিরে আসে পারুল। সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার জন্য মেয়ে পারুল হয় বকুলের অবলম্বন। মায়ের জীবন-সংগ্রাম দেখে বড় হওয়া পারুল মায়ের চেয়ে সাহসী এবং আত্মমর্যাদাশীল। বাড়ির পাশে শাক-সবজি চাষ করে, ঘরে হাঁস-মুরগি পালন করে, ধান ভেনে, কাঁথা সেলাই করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করে মা ও মেয়ে ৷ যে কোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জীবন বলি রাখার দৃঢ় প্রত্যয় বকুল ও পারুলের চাল চলনে
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বর্ষাযাপন' কবিতায় বাংলা ছোটগল্পের গঠন-প্রকৃতি সম্বন্ধে পাওয়া যায়-
“ছোটোপ্ৰাণ ছোটোব্যথা ছোটো ছোটো দুঃখ কথা
সহস্র বিস্মৃতি রাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু'চারিটি অশ্রুজল ।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।”
ছোটোগল্পের এমন চমৎকার সংজ্ঞা আর কেউ দেননি।
বাবার ব্যবসায় দুর্দিন দেখা দিলে বড় ছেলে বাবার ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষেরে সাথে হাত মেলায় ভবিষ্যতের আশায়। ছোট ছেলে বাবার ব্যবসায়িক দুর্দিন কাটানোর চেষ্টার অংশহিসেবে বড় ভাইকে বাবার পাশে থাকার অনুরোধ করে, কিন্তু বড় ছেলের অভিযোগ— বাবার একগুঁয়ে মনোভাব আর ভুল সিদ্ধান্তের কারণে পারিবারিক ব্যবসা ডুবতে বসেছে। তাঁর ব্যর্থতার দায়ভার আমি নেব কেন? বড় ভাইয়ের সমর্থন না পেয়ে সুদিন ফিরিয়ে আনতে একা সংগ্রাম চালিয়ে যায় ছোট ছেলে।
জেলা শহরের সরকারি হাসপাতালে দক্ষ চিকিৎসক ডাক্তার হুমায়ূন। ধনী-গরিব নির্বিশেষে রোগীদের তিনি পরম যত্নে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। একদিন যমুনা নামে এক অসহায় বৃদ্ধা টাকার অভাবে হাসপাতারের টিকেট না কেটে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে পড়লে ডাক্টারের সহকারী দুর্ব্যবহার করে তাকে হাসপাতাল থেকে বের করে দিতে চায়। ডাক্তার হুমায়ূন যমুনাকে ডেকে তার কথা শোনন এবং বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। পরে সহকারীকে ডেকে বলেছেন, “অসহায় মানুষের সেবা করা মানবতার কাজ। সকল মানুষ আমার কাছে সমান।"
খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী ড. সামাদ তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, 'ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এ বাংলাদেশের ইতিহাস শোষণ আর বঞ্চনার। কৃষিই ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রধান অবলম্বন আর ছিল মৃৎশিল্প, তাঁত শিল্প, মৎসজীবীতা। আমাদের পূর্বপুরুষদের বা তাদের পেশার প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়ে জাতি হিসেবে আমরা উন্নতি করতে পারব না। বিদেশি শোষণের নির্মম অত্যাচার সহ্য করে আমাদের পূর্বপ্রজন্ম আমাদের জন্য বর্তমানের যে ভিত তৈরি করেছিলেন, তাই-ই আমাদের শিল্প সাহিত্যের মৌলিক প্রেরণা।'
রাহেলার মা ছাড়া সংসারে আর কেউ নেই। সামান্য পড়ালেখা শিখেছে সে। আর্থিক অবস্থার কারণে তার মা বাধ্য হয়েই এক বয়স্ক লোকে সাথে রাহেলার বিয়ে দেয়। স্বামীর বাড়ি গিয়ে দেখে, সেখানে তার স্বামীর আরো একটি বউ রয়েছে। রাহেলার ভাগ্যই খারাপ। বড় বউ রাহেলাকে মোটেই সহ্য করতে পারে না। সারাদিন খাটায়, ঠিকমতো খেতে-পরতে দেয় না। রাহেলার বিরুদ্ধে স্বামীর কান ভারীর করে। রাহেলা একদিন আবিষ্কার করল তার স্বামী বসির মিয়া চোরাকারবারের সাথে যুক্ত। ঘরে অবৈধ জিনিসপত্র রাখে। আর মধ্যরাতে তার দলের অন্যদের সাথে এসব জিনিসপত্র পাচার করে। রাহেলা এসব দেখে ভয় পেয়ে যায়। সে প্রতিবাদ করে, বিনিময়ে লাথি ঝাঁটা খায়। একদিন পুলিশ আসে ঘরে। রাহেলা পুলিশের কাছে সমস্ত গোপন তথ্য ফাঁস করে দেয় । বসির মিয়ার মুখোশ খুলে যায় ।
কদম আলি একসময় 'মাল্টিপারপাস জনকল্যাণ ফাউন্ডেশন' নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। চটকদার বিজ্ঞাপন আর লোভাতুর প্রচারণায় অল্প সময়ে সে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অধিক মুনাফা লাভেল আশায় এলাকার অশিক্ষিত-অল্পশিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষ তার প্রতিষ্ঠানে অর্থলগ্নি করতে থাকে বছরের পর বছর যায়; কিন্তু জমাকারীরা লাভের মুখ দেখে না । নিকট অতীতে কদম আলির আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকলেও এখন সে প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক । এলাকার এক শিক্ষিত তরুণ সাগর এক যুগ পর গ্রামে এসে দেখে কদম আলি সহজ-সরল মানুষকে কীভাবে প্রতারিত করে যাচ্ছে। সে দেরি না করে এলাকার উদীয়মান তরুণদের সুসংগঠিত করে কদম আলির প্রচারণা বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আনে। প্রশাসন তদন্ত সাপেক্ষে টাকা আত্মসাৎ ও প্রতারণার দায়ে' কদম আলিকে জেল হাজতে প্রেরণ করে ৷
শোনা যায়, তিস্তাপাড়ে এখন আর ফসলি জমি নেই। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী জমিতে মেশিন বসিয়ে উত্তোলন করে নিচ্ছে ভূগর্ভস্থ পাথর। এই অঞ্চলে ফসলের তুলনায় পাথরের মূল্য বেশি। দিনে দিনে মেশিনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এলাকার সচেতন জনগোষ্ঠী দেশের স্বার্থে এতে বাধা দিলে তারা সাময়িকভাবে পাথর উত্তোলন-বদ্ধ রাখে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তিনটি মেশিন বসানোর অনুমতি নিয়ে বাস্তবে তিনশত মেশিন বসিয়ে আবার পাথর উত্তোলন করে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এতে যেমন ব্যাহত হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন, তেমনি নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। ব্যবসায়ীদের তাতে কিছু যায় আসে না, অধিক মুনাফা অর্জনই যেন তাদের লক্ষ্য। এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো শোনা যাবে, মাটির নিচে তলিয়ে গেছে তিস্তাপাড়ের বিশাল জনপদ ।
অমর ও সমর অন্তরঙ্গ বন্ধু। একদা তারা এক বনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল। তারা প্রতিজ্ঞা করেছে পথে কোনো বিপদে কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না। বনের 8 মাঝামাঝি আসতেই তারা এক হিংস্র ভালুকের আক্রমণের শিকার হলো। অমর বন্ধুর কথা না ভেবে নিজের প্রাণ বাঁচাতে একটি বৃক্ষের উপর উঠে গেল; কিন্তু সমর গাছে উঠতে পারে না। উপায় না দেখে সে মৃত মানুষের মতো মাটিতে শুয়ে পড়ল। ভালুকটি দৌড়ে এসে সমরের দেহটিকে অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করে অবশেষে মৃতদেহ ভেবে চলে গেল । বিপদমুক্ত ভেবে অমর এবার বৃক্ষ থেকে নামল আর বন্ধু সমরের কাছে হিংস্র জানতে চাইল, ভালুক তার কাকে কানে কী বলে গেছে? সমর গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল- 'ধূর্ত ও প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারীরা চিরকালই শত্রু হয়, বন্ধু হয় না, এই কথাই বলেছে।'