Subject Content

ADDED

বাক্যে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি শব্দকে Parts of Speech বলা হয়। 

Rahim eats rice (রহিম ভাত খায়।) এই Sentenceটিতে Rahim, eats এবং rice এই তিনটি Word আছে।এইভাবে প্রতিটি Sentence এর মধ্যে বিভিন্ন রকমের Word বা শব্দ ব্যবহার করা হয়, এগুলি Sentence এর একটি Part বা অংশ, এগুলিকেই ... arts Of Speech বলে।

Parts of Speech মোট ৮ প্রকার। যথা:

1. Noun

2. Pronoun

3. Adjective

4. Verb

5. Adverb

6. Preposition

7. Conjunction &

8. Interjection


ADDED

Noun (বিশেষ্য)

যে word দ্বারা কোন কিছুর নাম প্রকাশ করা হয় তাকেই noun বলে । আম

যেমনঃ  Man, Girl, Kamal, Badal, Rahim, Riya,, Dhaka, Bangladesh, Kolkata, Delhi.

 

... rgin-left:0px;">Jhon Seely তাঁর Oxford A-Z of Grammar & Punctuation বইতে লেখেন,

Nouns are words used to identify people, places, things, and ideas. 

Concrete Noun: যে Noun এর বাহ্যিক বা দৈহিক অবস্থিতি আছে এবং যাকে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধি করা যায় তাকে Concrete Noun বলে। যেমন: boy, book ইত্যাদি।

Noun কে প্রধানত পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-

  1. Proper Noun
  2. Common Noun
  3. Collective Noun
  4. Material Noun
  5. Abstract Noun

ADDED

1. Proper Noun : 

যেসকল noun দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, বস্তু, স্থান ইত্যাদির নাম বুঝায়, তাকে Proper Noun বলে। Proper Noun সবসময় Capital Letter দিয়ে শুরু হয়।

Example of proper noun: Bangladesh, Kar... m, Saturday, Dhaka, Tamim, The Padma, etc.

proper noun আরো কিছু সহজ উদহারণ দেখে নিন:

  1. দিনের নাম: Monday, Sunday, Saturday, etc
  2. স্থানের নাম: Canada, Cumilla, Dhaka, India, Japan, etc.
  3. ধর্মের নাম: Islam, Christian, Hinduism, Buddhism, etc.
  4. জাতির নাম: British, American, Greek, Indian, etc.
  5. প্রতিষ্ঠানের নাম: Oxford University, Dhaka University, Nike, Apple, Microsoft, etc.
  6. মানুষের নাম: Amir, Kabir, Shakil, Mustafizur, Muhammad, etc.

ADDED

Common Noun: 

যে Noun দ্বারা একই শ্রেণির ব্যক্তি, বস্তু, স্থান বা প্রাণীর সাধারণ নাম বুঝায় তাকে common noun বলে।  

Example:

  • I like the story of Shakespeare. (Shakespeare ন... র্দিষ্ট একজন ব্যক্তির নাম)
  •  They cut the tree. ( এখানে tree শব্দটি দ্বারা সকল প্রকার গাছকে বুঝানো হয়েছে) 
  • The Padma is a big river.(এখানে river শব্দটি দ্বারা সকল নদীকে বুঝানো হয়েছে)

ADDED

3. Collective Noun:

যে Noun দ্বারা এক জাতীয় কতগুলো ব্যক্তি বা বস্তুর সমষ্টিকে বোঝায়, তাকে Collective Noun বলা হয়।

Example of Collective noun:

A band of musicians

Our class t... ok a trip to Sundarbans.

A convoy of trucks

A flock of birds 

Bangladeshi Army is doing a great job in UN mission.

Each team contains eleven players.


ADDED&UPDATED

ভাষাবিজ্ঞানের পরিভাষায় ব্যাকরণ বলতে সাধারণত ভাষার কাঠামোর, বিশেষ করে শব্দ ও বাক্যের কাঠামোর, গবেষণাকে বোঝায়। এ অর্থে ব্যাকরণ হল কোন ভাষার রূপমূলতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বের আলোচনা। কখনও কখনও আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে ব্যাকরণ পরিভাষাটি দিয়ে কোন ভাষার কাঠামোর সমস্ত ... িয়মকানুনের বর্ণনাকে বোঝানো হয়, এবং এই ব্যাপকতর সংজ্ঞার ভেতরে ঐ ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব ও প্রয়োগতত্ত্বের আলোচনাও চলে আসে।

উপরে দেওয়া ব্যাকরণের সংজ্ঞাগুলি মূলত উচ্চতর ভাষাবিজ্ঞানী মহলে প্রচলিত এবং এ ধরনের ব্যাকরণকে বর্ণনামূলক ব্যাকরণও বলা হয়। অন্যদিকে স্কুল কলেজে পাঠ্য ব্যাকরণগুলিতে ভাষার সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক বর্ণনা থাকে না, বরং এগুলিতে সাধারণত মান ভাষার কাঠামোর কিছু বিবরণের পাশাপাশি আদর্শ বা মান ভাষাতে লেখার বিভিন্ন উপদেশমূলক নিয়ম বিধিবদ্ধ করে দেওয়া থাকে। এগুলিকে বলা হয় বিধানবাদী ব্যাকরণ।

ব্যুৎপত্তি ও সংজ্ঞা

ব্যাকরণ শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ হলো "বিশ্লেষণ" (বি + আ + ক্রি + অন) বিশেষ এবং সম্যকরূপে বিশ্লেষণ। ভাষার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে নানান সাহিত্যিক নানান মতামত লক্ষ্য করা যায় তবে যে সমস্ত মতামতগুলি গ্রহণযোগ্য তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর মতে, যে শাস্ত্রে কোনো ভাষাকে বিশ্লেষণ করে তার স্বরূপ আকৃতি ও প্রয়োগের নীতি বুঝিয়ে দেওয়া হয়, সেই শাস্ত্র কে বলে সেই ভাষার ব্যাকরণ।

ইতিহাস

প্রথম বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশিত হয় ১৭৪৩ সালে পর্তুগিজ ভাষায়। এর লেখক ছিলেন মানোয়েল দা আসুম্পসাঁও। তাঁর বাংলা-পর্তুগিজ অভিধানের ভূমিকা অংশ হিসেবে তিনি এটি রচনা করেন। এরপর ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত হয় নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড প্রণীত ইংরেজি ভাষায় রচিত পূর্ণাঙ্গ একটি বাংলা ব্যাকরণ।

 

Source: Wikipedia


ADDED

একটি বদ্ধ পাত্রের মধ্যে যদি গ্যাসের কতগুলো অণু ছেড়ে দেয়া হয়, নিশ্চয় অণুগুলো সেই পাত্রের ভিতর অদিক ওদিক ছোটাছুটি করবে । অণুগুলো পাত্রের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ কিংবা উচ্চতা বরাবর ছুটতে পারবে । অর্থাৎ অনুগুলো তিন মাত্রা বরাবর চলাচল করতে পারবে । আদর্শ গ্যাসের অণুগুলো যতগুলো মাত্র... বরাবর চলাচল করতে পারে, তাকে তার স্বাধীনতার মাত্রা বলে ।

এক পারমানবিক গ্যাস যেমনঃ হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন ইত্যাদি গ্যাসের অণুগুলোতে মাত্র একটি অণু থাকায় আমরা এদেরকে একটি বলের মত করে চিন্তা করতে পারি । এই বলগুলো মুক্তভাবে তিন মাত্রা বরাবর বিচরণ করতে পারে । তাই আমরা বলে থাকি, এক পারমানবিক গ্যাসের স্বাধীনতার মাত্রা তিন ।

এবার দ্বি-পারমানবিক গ্যাস যেমনঃ নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ইত্যাদির একটি অণুতে দুইটি করে পরমাণু বন্ধনের মাধ্যমে যুক্ত থাকে । যাদেরকে আমরা চিন্তা করতে পারি, দুইটি বল একটি দন্ডাকার বস্তুর মাধ্যমে যুক্ত আছে । এখানে যেহেতু দুইটি পরমাণু যুক্ত আছে, তাই আমাদের মনে হতে পারে- এদের স্বাধীনতার মাত্রা তিনটি করে মোট ছয়টি হবে । কিন্তু তা নয় । বন্ধনের মাধ্যমে যুক্ত থাকার কারনে এদের উভয়ের মাঝে একটি মাত্রা কমন হয়ে যাবে । সে কারণে দুইটি পরমাণুর এককভাবে দুইটি দুইটি করে মোট চারটি এবং কমন একটি মিলে এদের মোট পাঁচটি মাত্রা পাওয়া যাবে । তাই দ্বি-পারমানবিক গ্যাসের স্বাধীনতার মাত্রা হবে পাঁচটি ।

একইভাবে ত্রি-পারমানবিক গ্যাসের স্বাধীনতার মাত্রা হবে নয়টির পরিবর্তে সাতটি । যেকোন অণু কিংবা পরমাণুর একটি স্বাধীনতার মাত্রা বরাবর শক্তি, 1/2.KT করে । 

তাহলে,

  • এক পারমানবিক গ্যাসের অনুগুলোর মোট শক্তি = 3.1/2.KT
  • দ্বি-পারমানবিক গ্যাসের অনুগুলোর মোট শক্তি = 5.1/2.KT
  • ত্রি-পারমানবিক গ্যাসের অনুগুলোর মোট শক্তি = 7.1/2.KT

 

এভাবেই গ্যাসের অণুগুলোর মোট শক্তি এদের স্বাধীনতার মাত্রা বরাবর সমানভাবে বন্টিত হয় । যাকে বলা হয়, শক্তির সমবিভাজন নীতি ।


ADDED

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার নাম । এতে বিশ্বজগতের সৃষ্টি, ধ্বংস, ইহকালের সব প্রয়োজনীয় বিষয়, মৃত্যু, মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সবকিছুই সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয... েছে । মানবজীবনের এমন কোনো দিক নেই যা ইসলামে আলোচনা করা হয়নি । ইসলাম সম্পর্কে বিস্তৃত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে এ বিষয়গুলো আমরা জানতে পারব । এজন্য ইসলাম-শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য । ইসলাম শিক্ষার পরিসর অত্যন্ত ব্যাপক হওয়ায় একটি পুস্তক বা একটি শ্রেণিতে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় লাভ করা খুবই দুরূহ । এ শ্রেণিতে আকাইদ ও নৈতিক জীবন, শরিয়তের উৎস, ইবাদত, আখলাক ও আদর্শ জীবনচরিত শিরোনামে পাঁচটি অধ্যায়ে ইসলামের সুন্দর আদর্শ ও শিক্ষাসমূহ সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো ।

প্রথম অধ্যায়

আকাইদ ও নৈতিক জীবন

পরিচয়

আকাইদ শব্দটি আকিদা (عقيدة‎‎,) শব্দের বহুবচন । আকাইদ অর্থ বিশ্বাসমালা। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসকেই আকাইদ বলা হয় । ইসলাম আল্লাহ তায়ালার মনোনীত একমাত্র দীন বা জীবনব্যবস্থা। এর দুটি দিক রয়েছে । যথা- বিশ্বাসগত দিক ও আচরণগত বা প্রায়োগিক দিক । ইসলামের বিশ্বাসগত দিকের নামই হলো আকাইদ । আল্লাহ তায়ালা, নবি-রাসুল, ফেরেশতা, আসমানি কিতাব, পরকাল, জান্নাত- জাহান্নাম ইত্যাদি আকাইদের অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়গুলো কুরআন ও হাদিস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত । মুসলিম হতে হলে সবাইকে এ বিষয়গুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় । এরপর নামায, রোযা, হজ, যাকাত ইত্যাদি প্রায়োগিক দিক তথা ইবাদত পালন করতে হয়। বস্তুত আকাইদের বিষয়গুলোর উপর বিশ্বাসের মাধ্যমেই মানুষ ইসলামে প্রবেশ করে । এজন্য ইসলাম সম্পর্কে আলোচনার শুরুতেই আকাইদ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। এ অধ্যায়ে আমরা সংক্ষেপে আকাইদ বা ইসলামি বিশ্বাসমালার কতিপয় মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জানব ।

এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা -

  • ইসলামের পরিচয় ও ইসলাম শিক্ষা পাঠের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব;
  • ইমান ও ইসলামের সম্পর্ক এবং ইমানের মৌলিক সাতটি বিষয়ের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব;
  • ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের প্রতি আস্থা স্থাপনে ও অনুশীলনে উদ্বুদ্ধ হব;
  • তাওহিদে বিশ্বাসের প্রভাব ও মহান আল্লাহর পরিচয় বর্ণনা করতে পারব;
  • তাওহিদের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে পারব;
  • কুফর, শিরক ও নিফাকের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব এবং এগুলোর পরিণতি ও তা পরিহার করে চলার উপায় বর্ণনা করতে পারব;
  • বাস্তবজীবনে কুফর, শিরক ও নিফাক পরিহার করে চলব; মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে ইমানের গুরুত্ব বর্ণনা করতে পারব;

 

  • রিসালাত ও নবুয়তের ধারণা এবং নবি-রাসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে পারব;
  • নবি-রাসুলগণের গুণাবলি, তাঁদের আগমনের ধারা, নবি-রাসুলের প্রতি বিশ্বাস ও তাঁদের অনুসরণ করার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারব;
  • খতমে নবুয়তের ধারণা, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর উপর বিশ্বাস
  • স্থাপনের গুরুত্ব বর্ণনা করতে পারব;
  • নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে রিসালাত ও নবুয়তের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারব; রিসালাতের প্রতি বিশ্বাস এবং এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে নিজের জীবনে রিসালাতের শিক্ষা বাস্তবায়নে আগ্রহী হব;
  • আসমানি কিতাবের পরিচয় ও তৎপ্রতি বিশ্বাসের গুরুত্ব বর্ণনা করতে পারব;
  • নৈতিক জীবন গঠনে আসমানি কিতাবের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করতে পারব;
  • সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে আল-কুরআনের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে
  • পারব; আসমানি কিতাবসমূহ ও কুরআন মজিদের পরিচয় জানব, বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করে কুরআন পাঠ করতে উদ্বুদ্ধ হব এবং তদনুযায়ী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন নৈতিক জীবনযাপন করতে পারব;
  • আখিরাতের ধারণা ও বিশ্বাসের গুরুত্ব বর্ণনা করতে পারব;
  • আখিরাতের জীবনের স্তরসমূহ- মৃত্যু, কবর, কিয়ামত, হাশর, বিচার, মিযান, পুলসিরাত, শাফাআত সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারব;
  • জান্নাত ও জাহান্নামের পরিচয়, জান্নাত ও জাহান্নামের নাম, জান্নাত লাভের ও জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের উপায় বর্ণনা করতে পারব;
  • নৈতিক জীবন গঠনে আখিরাতে বিশ্বাসের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে পারব;
  • আখিরাতে বিশ্বাস ও এর তাৎপর্য অনুধাবন করে পাপমুক্ত, সৎকর্মশীল, নীতিবান, মানবহিতৈষী ব্যক্তি হিসেবে জীবন গঠনে অনুপ্রাণিত হব ।

পাঠ ১

ইসলাম

 

পরিচয়

ইসলাম আরবি শব্দ । আভিধানিক অর্থ হলো আনুগত্য করা, আত্মসমর্পণ করা, শান্তির পথে চলা

ইত্যাদি । ব্যবহারিক অর্থে আল্লাহ তায়ালা ও রাসুল (স.)-এর আনুগত্য করাকে ইসলাম বলে । শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ তায়ালার প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর নিকট পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করা, বিনা দ্বিধায় তাঁর যাবতীয় আদেশ নিষেধের আনুগত্য করা এবং তাঁর দেওয়া বিধান ও হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর দেখানো পথ অনুসারে জীবনযাপন করাকে ইসলাম বলা হয় ।

 

 

 

একটি হাদিসে মহানবি (স.) সুন্দরভাবে ইসলামের মূল পরিচয় তুলে ধরেছেন । তিনি বলেন-

اللهِ وَتُقِيمَ الصَّلوةَ وَتُؤْتِي الزَّكُوةَ وَتَصُومَ الْإِسْلَامُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لا إلهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ

رَمَضَانَ وَتَحجَّ الْبَيْتَ إِنْ اسْتَطَعْتَ إِلَيْهِ سَبِيلًا

অর্থ: “ইসলাম হলো— তুমি এ কথার সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই । আর মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর রাসুল, সালাত আদায় করবে, যাকাত প্রদান করবে, রমযানের রোযা পালন করবে এবং সামর্থ্য থাকলে বাইতুল্লাহর হজ আদায় করবে ।” (বুখারি ও মুসলিম)

আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য যুগে যুগে বহু আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান প্রেরণ করেছেন । এসব আদেশ-নিষেধ শরিয়ত হিসেবে প্রদান করেছেন। শরিয়তের সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ রূপ হলো ইসলাম । এটি হলো মানবজাতির জন্য নির্দেশিত সর্বশেষ ও সর্বোত্তম জীবন বিধান । আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেন-

إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلامُ من

অর্থ: “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট ইসলামই একমাত্র মনোনীত ধর্ম বা জীবনব্যবস্থা ।” (সূরা আলে ইমরান, সুতরাং ইসলাম হলো আল্লাহ তায়ালার নিকট গ্রহণযোগ্য ধর্ম । আর যিনি ইসলাম অনুসারে জীবন পরিচালনা

আয়াত ১৯)

করেন তাকে বলা হয় মুসলিম বা মুসলমান ।

ইসলামের ভূমিকা

ইসলাম হলো আল্লাহ তায়ালার প্রবর্তিত ধর্ম বা জীবন বিধান। এটি মানবজাতির জন্য আল্লাহ তায়ালার একটি বিশেষ নিয়ামত । এটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। মানবজীবনের সকল বিষয় ও সমস্যার পরিপূর্ণ সমাধানের দিকনির্দেশনা এতে দেওয়া হয়েছে ।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا

অর্থ: “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম; আর তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম ।” (সূরা আল- মায়িদা, আয়াত ৩)

মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল কাজকর্মের যথাযথ দিকনির্দেশনা ইসলামে বিদ্যমান । ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সকল বিষয়ই ইসলামে যথাযথভাবে বর্ণনা করা হয়েছে । এমনকি মানুষের মৃত্যুর পরবর্তী জীবন বা পরকালের অবস্থার বর্ণনাও ইসলামে রয়েছে । সুতরাং সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে জীবন পরিচালনার জন্য ইসলামের বিকল্প নেই । ইসলাম শব্দটি (সিলমুন) মূলধাতু হতে নির্গত, সিলমুন অর্থ শান্তি । ইসলাম মানুষকে শান্তির পথে

পরিচালনা করে । ইসলামি বিধি-বিধান মেনে চললে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে পরিপূর্ণ শান্তিময় জীবন

লাভ করতে পারে । এ জন্য ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলা হয় ।

 

 

ইসলাম সর্বজনীন ধর্ম । এটি কোনো কাল, অঞ্চল বা জাতির জন্য সীমাবদ্ধ নয় । অন্যান্য ধর্মের নামকরণ সে সব ধর্মের প্রবর্তক, প্রচারক, অনুসারী কিংবা জাতির নামে করা হয়েছে । কিন্তু ইসলাম সর্বজনীন ধর্ম হওয়ার কারণে এর নামকরণ কারও নামে করা হয়নি । বরং মহান আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্যের মাধ্যমে শান্তির পথে জীবন পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে এর নামকরণ করা হয়েছে ইসলাম ।

ইসলাম-শিক্ষার গুরুত্ব

ইসলাম-শিক্ষা হলো ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা । কোনো কিছু বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমে সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হয় । যেমন সাঁতার কাটতে হলে প্রথমে সাঁতার কী, কীভাবে সাঁতার কাটতে হয় ইত্যাদি শিখতে হয় । গাড়ি চালাতে হলে গাড়ি ও গাড়ি চালনা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হয় । ঠিক তেমনি ইসলাম অনুযায়ী জীবন পরিচালনার জন্য ইসলাম সম্পর্কে প্রথমে জ্ঞান অর্জন করতে হয় । আর এর প্রধান মাধ্যম হলো ইসলাম শিক্ষা ।

ইসলাম শিক্ষার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তায়ালার ইবাদত ও আনুগত্য শিখতে পারি । আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চলাফেরা, উঠাবসা কীভাবে করতে হবে তা জানতে পারি । সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দয়া, ক্ষমা, বিনয়, নম্রতা ইত্যাদি গুণের অনুশীলন করতে পারি । লোভ, হিংসা, মিথ্যাচার, অহংকার, পরনিন্দা ইত্যাদি খারাপ অভ্যাস পরিহার করে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে পারি । সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব, সহিষ্ণুতা, ধৈর্য, সহনশীলতা, পারস্পরিক সহযোগিতা, সহানুভূতি ইত্যাদির মাধ্যমে সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করতে পারি । পরকালীন জীবনে জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় জানতে পারি । এককথায় ইসলাম শিক্ষার মাধ্যমে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি ও সফলতা লাভের দিকনির্দেশনা অর্জন করতে পারি ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা ইসলামের পরিচয়, ভূমিকা ও ইসলাম শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে ১৫টি বাক্য বাড়ি থেকে লিখে এনে শ্রেণি-শিক্ষককে দেখাবে ।

পাঠ ২

ইমান

 

পরিচয়

ইমান শব্দটি আমনুন মূল ধাতু থেকে নির্গত। যার অর্থ- বিশ্বাস করা, আস্থা স্থাপন, স্বীকৃতি দেওয়া, নির্ভর করা, মেনে নেওয়া ইত্যাদি । ইসলামি পরিভাষায়, শরিয়তের যাবতীয় বিধি-বিধান অন্তরে বিশ্বাস করা, মুখে স্বীকার করা এবং তদনুযায়ী আমল করাকে ইমান বলে । ইমানের পরিচয় সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন-

ان تُؤْمِنَ بِاللهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدْرِ خَيْرِهِ وَشَهِ

অর্থ: ইমান হচ্ছে- “আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাকুল, কিতাবসমূহ, রাসুলগণ, পরকাল এবং ভাগ্যের ভালো-মন্দের (ভালো-মন্দ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকেই হয়) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ।” (মুসলিম)

 

 

প্রকৃতপক্ষে, ইসলামের মূল বিষয়গুলোর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসকেই বলা হয় ইমান । ইমানের মৌলিক বিষয়গুলো আল্লাহর বাণী আল-কুরআন ও রাসুলুল্লাহ (স.)-এর পবিত্র হাদিসে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে । ইমানে মুফাসালে ইমানের মৌলিক বিষয়গুলো একত্রে বর্ণিত হয়েছে । যেমন-

أمَنتُ بِاللهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْقَدْرِ خَيْرِه وَشَرِه مِنَ اللَّهِ تَعَالَى وَالْبَعْثِ بَعْدَ الْمَوْتِ

অর্থ: “আমি ইমান আনলাম আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবগুলোর প্রতি, তাঁর রাসুলগণের প্রতি, আখিরাতের প্রতি, তকদিরের প্রতি যার ভালো-মন্দ আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকেই হয় এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের প্রতি ।”

বর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি সুদৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস ব্যতীত ইমানদার হওয়া যায় না । যিনি এগুলোতে পূর্ণ

বিশ্বাস স্থাপন করেন, তাকে বলা হয় মুমিন ।

ইমান ও ইসলামের সম্পর্ক

ইমান ও ইসলাম দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা । ইমান অর্থ বিশ্বাস । ইসলামের মূল বিষয়গুলোর প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি ও তদনুযায়ী আমল করাকে ইমান বলা হয় । অন্যদিকে ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পণ, আনুগত্য ইত্যাদি । মহান আল্লাহর যাবতীয় আদেশ নিষেধ বিনাদ্বিধায় মেনে নেওয়ার মাধ্যমে তাঁর প্রতি পূর্ণাঙ্গরূপে আত্মসমর্পণ করার নাম হলো ইসলাম ।

ইমান ও ইসলামের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান । এদের একটি ব্যতীত অন্যটি কল্পনাও করা যায় না । এদের একটি অপরটির উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল । ইমান ও ইসলামের সম্পর্ক গাছের মূল ও শাখা-প্রশাখার মতো । ইমান হলো গাছের শিকড় বা মূল আর ইসলাম তার শাখা-প্রশাখা । মূল না থাকলে শাখা-প্রশাখা হয় না । আর শাখা-প্রশাখা না থাকলে মূল বা শিকড় মূল্যহীন । তদ্রূপ ইমান ও ইসলাম একটি অন্যটি ব্যতীত পূর্ণাঙ্গ হয় না । ইমান মানুষের অন্তরে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, অনুরাগ ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের বাসনা সৃষ্টি করে । আর তাতে ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে সজীব ও সতেজ হয়ে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যে বিকশিত হয় ইসলাম । ইসলাম হলো ইমানের বহিঃপ্রকাশ । ইমান হলো অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত । আর ইসলাম বাহ্যিক আচার-আচরণ ও কার্যাবলির সাথে সম্পৃক্ত। যেমন- আল্লাহ, রাসুল, ফেরেশতা ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্বাস করা হলো ইমান । আর সালাত, যাকাত, হজ ইত্যাদি বিষয় পালন করা হলো ইসলাম ।

প্রকৃতপক্ষে, ইমান ও ইসলাম একটি অপরটির পরিপূরক । দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করতে হলে

ইমান ও ইসলাম উভয়টিকেই পরিপূর্ণভাবে স্বীয় জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে ।

ইমানের সাতটি মূল বিষয়

ইমান অর্থ বিশ্বাস । একজন মুসলিমকে ইমানের কতগুলো মৌলিক বিষয়ে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হয় । এগুলো আল- কুরআন ও হাদিস দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। এ বিষয়গুলোতে বিশ্বাস ব্যতীত কেউই মুমিন বা মুসলিম হতে পারে না । এরূপ বিষয় মোট ৭টি । এগুলো হলো-

১. আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাস

ইমানের সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান বিষয় হলো আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাস । আল্লাহ তায়ালা এক ও অদ্বিতীয়। তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ বা মাবুদ নেই । তিনি সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও

রক্ষাকর্তা। তিনি সকল গুণের আধার । তাঁর সত্তা ও গুণাবলি তুলনাহীন । সমস্ত প্রশংসা ও ইবাদত একমাত্র তাঁরই জন্য নির্ধারিত । আল্লাহ তায়ালার প্রতি এরূপ বিশ্বাস স্থাপন ইমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ।

২. ফেরেশতাগণের প্রতি বিশ্বাস

ফেরেশতাগণ মহান আল্লাহর এক বিশেষ সৃষ্টি । তাঁরা নুরের তৈরি । তাঁরা সবসময় আল্লাহ তায়ালার ইবাদত ও হুকুম পালনে নিয়োজিত । তাঁদের সংখ্যা অগণিত । তাঁরা নারীও নন, পুরুষও নন। তাঁরা পানাহার ও জৈবিক চাহিদা থেকে মুক্ত । তাঁদের প্রতি এরূপ বিশ্বাস রাখা ইমানের অন্তর্ভুক্ত ।

৩. আসমানি কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস

আসমানি কিতাবসমূহ আল্লাহ তায়ালার বাণী । এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে নিজ পরিচয় প্রদান করেছেন । নানা আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান, সুসংবাদ, সতর্কবাণী ইত্যাদিও এগুলোর মাধ্যমেই এসেছে । আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসুলগণের নিকট এসব কিতাব পাঠিয়েছেন । দুনিয়াতে সর্বমোট ১০৪ খানা আসমানি কিতাব নাজিল করা হয়েছে । এ সমস্ত কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা আবশ্যক ।

৪. নবি-রাসুলগণের প্রতি বিশ্বাস

মানব জাতির হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে বহু নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন । নবি-রাসুলগণ ছিলেন আল্লাহ তায়ালার মনোনীত বান্দা । সকল সৃষ্টির মধ্যে তাঁরাই সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী । তাঁরা ছিলেন নিষ্পাপ । আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে তাঁরা মানব জাতিকে মহান আল্লাহর পথে ডেকেছেন, সত্য ও ন্যায়ের পথ দেখিয়েছেন, ইহকালীন ও পরকালীন শান্তি ও মুক্তির দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন । নবি-রাসুলগণের প্রতি এরূপ বিশ্বাস রাখা ইমানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ৷

৫. আখিরাতে বিশ্বাস

আখিরাত হলো পরকাল । আখিরাতের জীবন চিরস্থায়ী। এ জীবনের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই । সেখানে মানুষকে দুনিয়ার জীবনের সকল কাজকর্মের হিসাব দিতে হবে। কবর, হাশর, মিযান, সিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি আখিরাত জীবনের এক একটি পর্যায় । দুনিয়াতে ভালো কাজ করলে মানুষ জান্নাত লাভ করবে । আর ইমান না আনলে, অসৎ কাজ করলে মানুষের স্থান হবে ভীষণ আযাবের স্থান জাহান্নাম ।

আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য ।

৬. তকদিরে বিশ্বাস

তকদির অর্থ হলো নির্ধারিত পরিমাণ, ভাগ্য বা নিয়তি । আল্লাহ তায়ালা মানুষের তকদিরের নিয়ন্ত্রক । তিনিই তকদিরের ভালোমন্দ নির্ধারণকারী । মানুষ যা চায় তা-ই সে করতে পারবে না। বরং মানুষ শুধু তার কাজের জন্য চেষ্টা সাধনা করবে । অতঃপর ফলাফলের জন্য আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা করবে। যদি চেষ্টা করার পরও কোনো কিছু না পায় তবে হতাশ হবে না । আর যদি পেয়ে যায় তবুও খুশিতে আত্মহারা হবে না । বরং সবর (ধৈর্য) ধারণ করবে ও শোকর (কৃতজ্ঞতা) আদায় করবে । আর তকদিরের ভালোমন্দ একমাত্র আল্লাহ তায়ালার হাতে, মনে প্রাণে এরূপ বিশ্বাস স্থাপন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ।

 

৭. মৃত্যুর পর পুনরুত্থানে বিশ্বাস

মৃত্যুর সাথে সাথেই মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায় না । বরং মানবজীবন দুইভাগে বিভক্ত । ইহকাল ও পরকাল। ইহকাল হলো দুনিয়ার জীবন । আর পরকাল হলো মৃত্যুর পরবর্তী জীবন । আল্লাহ তায়ালা মানুষকে মৃত্যুর পর আবার জীবিত করবেন। সে সময় সকল মানুষ হাশরের ময়দানে একত্রিত হবে । আল্লাহ তায়ালা সেদিন বিচারক হিসেবে মানুষের সকল কাজের হিসাব নেবেন । অতঃপর মানুষকে তার ভালো কাজের জন্য পুরস্কার স্বরূপ জান্নাতে ও মন্দকাজের শাস্তিস্বরূপ জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে । সুতরাং মৃত্যুর পর আমরা সবাই পুনরায় জীবিত হব এ বিশ্বাস রাখা ইমানের অপরিহার্য বিষয় ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা ইমান ও ইসলামের সম্পর্ক বিষয়ে পাঁচটি বাক্য শ্রেণিকক্ষে বসে নিজ খাতায় লিখবে ।

পাঠ-৩

মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে ইমানের গুরুত্ব

ইমান অর্থ বিশ্বাস । ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি বিশ্বাসকেই সাধারণত ইমান বলা হয় । আর মানবিক বলতে মানব সম্বন্ধীয় বুঝায় । অর্থাৎ যেসব বিষয় একমাত্র মানুষের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি হওয়ার যোগ্য তাই মানবিক মূল্যবোধ । অন্যকথায় যেসব কর্মকাণ্ড, চিন্তা-চেতনা মানুষ ও মানব সভ্যতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাই মানবিক মূল্যবোধ ।

মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। এ হিসেবে মানুষের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও কর্মকাণ্ড সবই উন্নত ও সর্বোত্তম হওয়া উচিত। পশুর ন্যায় কাজকর্ম, লোভ-লালসা ইত্যাদি মানবিকতার আদর্শ নয় । যদি কোনো মানুষ এ আদর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে পশুর ন্যায় আচরণ করে তবে সে মানবিক মূল্যবোধকে বিনষ্ট করে । মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বকে সমুন্নত রাখার জন্য উত্তম গুণাবলি ও আদর্শ অনুশীলনের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ রক্ষা করা যায় ।

মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে ইমানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । ইমান নানাভাবে মানুষের মানবিকতার বিকাশ

সাধন করে থাকে । ইমানের মূলকথা হলো-

لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ مُحَمَّدٌ رَّسُولُ اللهِ

(লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ) । অর্থ: “আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই, মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর রাসুল ।” এ কালিমার তাৎপর্য হলো আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক ও মাবুদ । তিনি ব্যতীত প্রশংসা ও ইবাদতের যোগ্য কেউ নেই । তিনি ব্যতীত আর কারও সামনে মাথা নত করা যাবে না। এ কালিমা মানুষকে আত্মমর্যাদাশীল করে । এ কালিমায় বিশ্বাসী ব্যক্তি শুধু আল্লাহ তায়ালার সামনে মাথা নত করে । পৃথিবীর অন্য কোনো সৃষ্টির সামনে মাথা নত করে না বা আত্মসমর্পণ করে না। ফলে মানুষের মর্যাদা সমুন্নত হয়, মানবিক মূল্যবোধ বিকশিত হয় ।

 

 

ইমান মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথে পরিচালনা করে । নৈতিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করে । মুমিন ব্যক্তি সর্বদাই মানবিকতা ও নৈতিকতার ধারক হয় । অন্যায় অত্যাচার ও অনৈতিক কার্যকলাপ ইমানের সম্পূর্ণ বিপরীত। পূর্ণাঙ্গ মুমিন ব্যক্তি কখনোই মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের বিপরীত কাজ করতে পারে না । বরং মুমিন ব্যক্তি সবসময়ই নীতি-নৈতিকতা ও মানবিকতার আদর্শ অনুসরণ করে । সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি সৎগুণাবলির চর্চা করে ।

কুফর, নিফাক, শিরক ইত্যাদি ইমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী । এ সমস্ত বিষয় মানুষের মধ্যে অসৎ কার্যাবলির বিকাশ ঘটায় । এগুলোর প্রভাবে মানবসমাজে অকৃতজ্ঞতা, অবিশ্বাস, মিথ্যাচার, ওয়াদা খেলাপ, ঝগড়া- ফাসাদ, বিদ্রোহ ইত্যাদি জন্ম নেয় । যেমন মুনাফিক সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَاللهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنْفِقِينَ لَكَذِبُونَ )

অর্থ : “আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিঃসন্দেহে মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী।” (সূরা আল-মুনাফিকুন, আয়াত ০১)

ইমান মানুষকে নৈতিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে । মন্দ অভ্যাস ও অশ্লীল কার্যাবলি থেকে বিরত রাখে। ইমান মানুষকে দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহির ব্যাপারে সতর্ক করে। মুমিন ব্যক্তি সবসময় মনে রাখেন যে, তাঁকে একদিন আল্লাহ তায়ালার সামনে হাজির হতে হবে । সেদিন আল্লাহ তায়ালা সব কাজকর্মের হিসাব চাইবেন । অতএব এ জবাবদিহির ভয়ে মুমিন ব্যক্তি সব ধরনের অমানবিক ও অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকেন । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى

অর্থ : “আর যে ব্যক্তি তার প্রভুর সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার ভয় করে এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকে । নিশ্চয়ই জান্নাতই হলো তার বাসস্থান ।” (সূরা আন-নাযিয়াত, আয়াত ৪০-৪১ )

মানবিক মূল্যবোধ ও ইমান পারস্পরিক গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত । ইসলামের মৌলিক বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে ব্যক্তি মুমিন হয়ে ওঠে । জীবনযাপনে সে নিজ খেয়ালখুশির পরিবর্তে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনার অনুসারী হয় । ফলে সে সবধরনের অন্যায়, অবিচার ও অনৈতিকতা বাদ দিয়ে সুন্দর ও উত্তম আদর্শের অনুশীলন করে থাকে । এভাবে ইমান মানুষের মধ্যে মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায় ।

কাজ : শ্রেণিকক্ষে সব ছাত্র/ছাত্রী আলোচনা করে তিনজনকে বাছাই করবে। এ তিনজন 'মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে ইমানের গুরুত্ব' বিষয়ে কী শিক্ষা লাভ করল তা বক্তব্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করবে । শ্রেণির সব শিক্ষার্থী শ্রোতা হিসেবে শুনবে । শিক্ষক সভাপতি ও সঞ্চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন । তিনজন বক্তার মধ্যে সবচেয়ে যে ভালো বক্তৃতা প্রদান করবে তাকে সবাই শুভেচ্ছা জানাবে ।

 

 

 

পাঠ-৪

তাওহিদ

পরিচয়

তাওহিদ শব্দের অর্থ একত্ববাদ । ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহ তায়ালাকে এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে স্বীকার করে নেওয়াকে তাওহিদ বলা হয় । তাওহিদের মূল কথা হলো- আল্লাহ তায়ালা এক ও অদ্বিতীয় । তিনি তাঁর সত্তা ও গুণাবলিতে অদ্বিতীয় ।

তিনিই প্রশংসা ও ইবাদতের একমাত্র মালিক । তাঁর তুলনীয় কেউ নেই । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٍ .

অর্থ: “কোনো কিছুই তাঁর সদৃশ নয় ।” (সূরা আশ্-শুরা, আয়াত ১১)

আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা ও ইবাদতের যোগ্য এক ও অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে বিশ্বাসের নামই তাওহিদ ।

তাওহিদের গুরুত্ব

ইমানের সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান বিষয় হলো তাওহিদ । অর্থাৎ মুমিন বা মুসলিম হতে হলে একজন মানুষকে সর্বপ্রথম আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদে বিশ্বাস করতে হবে । তাওহিদে বিশ্বাস ব্যতীত কোনো ব্যক্তিই ইমান বা ইসলামে প্রবেশ করতে পারে না । ইসলামের সকল শিক্ষা ও আদর্শই তাওহিদের উপর প্রতিষ্ঠিত । দুনিয়াতে যত নবি-রাসুল এসেছেন সকলেই তাওহিদের দাওয়াত দিয়েছেন । সকলের দাওয়াতের মূলকথা ছিল- -ajjajj লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বা আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই । তাওহিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য নবি-রাসুলগণ আজীবন সংগ্রাম করেছেন । হযরত ইবরাহিম (আ.) অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন । আমাদের প্রিয়নবি (স.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছেন । বস্তুত, তাওহিদই হলো ইমানের মূল । ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম।

তাওহিদের প্রভাব

তাওহিদ হলো আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদে বিশ্বাস । মানব জীবনে এ বিশ্বাসের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক । তাওহিদে বিশ্বাস মানুষকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ করে দেয় । কেননা আল্লাহ তায়ালাই আমাদের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা । তাওহিদে বিশ্বাসের মাধ্যমে মানুষ এ সত্যকে স্বীকার করে নেয় ৷ মানুষ এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞতা আদায় করে ।

তাওহিদে বিশ্বাস মানুষকে আত্মসচেতন ও আত্মমর্যাদাবান করে । মানুষ আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কারও নিকট মাথা নত করে না । ফলে জগতের সকল সৃষ্টির উপর মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় । মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মর্যাদা লাভ করে ।

সৎচরিত্রবান হওয়ার ক্ষেত্রেও মানবজীবনে তাওহিদের প্রভাব অপরিসীম । মানুষ আল্লাহ তায়ালার গুণাবলি ও পরিচয় লাভ করে এবং সেসব গুণে গুণান্বিত হওয়ার অনুশীলন করে । মানব সমাজে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায়ও তাওহিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । কেননা তাওহিদে বিশ্বাস মানব সমাজে এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করে যে, সকল মানুষই আল্লাহর বান্দা ও সমান মর্যাদার অধিকারী । এভাবে মানুষের মধ্যে ঐক্যের চেতনা জাগ্রত হয় ।

তাওহিদে বিশ্বাস মানুষকে ইবাদত ও সৎকর্মে উৎসাহিত করে । আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের জন্য মানুষ সৎকর্মে ব্রতী হয় । অসৎ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে । ফলে মানব সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় ।

 

তাওহিদে বিশ্বাস পরকালীন জীবনে মানুষকে সফলতা দান করে । তাওহিদে বিশ্বাস ব্যতীত কেউই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না । বস্তুত মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রেই তাওহিদে বিশ্বাস মুক্তি ও সফলতার দ্বার উন্মুক্ত করে ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা তাওহিদের পরিচয়, গুরুত্ব ও প্রভাব সম্পর্কে নিজের অর্জিত ধারণা শিক্ষকের নিকট মৌখিকভাবে উপস্থাপন করবে । শিক্ষক তা মূল্যায়ন করবেন ।

পাঠ-৫

আল্লাহ তায়ালার পরিচয়

আল্লাহ তায়ালা এ বিশ্বজগতের অধিপতি ও মালিক । তিনি একক ও অদ্বিতীয় সত্তা । তাঁর কোনো শরিক নেই । তিনি অনন্য ও অতুলনীয় ।

‘আল্লাহ' শব্দের মধ্যেই তাঁর তুলনাহীন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় । 20] (আল্লাহ) আরবি শব্দ । পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই এ শব্দের কোনো প্রতিশব্দ নেই । এর কোনো একবচন; বহুবচন নেই । এ শব্দের কোনো স্ত্রীলিঙ্গ বা পুংলিঙ্গ নেই । এ শব্দটি একক ও অতুলনীয় । আল্লাহ তায়ালাও তদ্রূপ । তিনি তাঁর সত্তা ও গুণাবলিতে একক ও অদ্বিতীয় । তাঁর সমতুল্য বা সমকক্ষ কিছুই নেই । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌنَ اللهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدُهُ وَلَمْ يُولَدُ لا وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌة

অর্থ : “বলুন (হে নবি!) তিনিই আল্লাহ । একক ও অদ্বিতীয় । আল্লাহ কারও মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী । তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেওয়া হয়নি । আর তাঁর সমতুল্য কেউই নেই ৷” (সূরা আল-ইখলাস, আয়াত ১-৪)

আল্লাহ তায়ালা স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা। তিনি অনাদি অনন্ত । তিনি চিরস্থায়ী ও চিরবিরাজমান । তাঁর কোনো শুরুও নেই, শেষও নেই । তিনি পানাহার, নিদ্রা, তন্দ্রা, ক্লান্তি সবকিছু থেকে মুক্ত । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

هُوَ الْاَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ هِ

অর্থ: “তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ। তিনিই প্রকাশ্য, তিনিই গোপন এবং তিনি সর্ব বিষয়ে সম্যক অবহিত।” (সূরা আল- হাদিদ, আয়াত ৩)

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,

اللهُ لا إلهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ لَهُ مَا فِي السَّمَوتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ

অর্থ : “তিনি আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই । তিনি চিরঞ্জীব ও সর্বসত্তার ধারক । তন্দ্রা বা নিদ্রা তাঁকে কখনোই স্পর্শ করতে পারে না । আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে সবই তাঁর অধীন।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৫৫)

 

 

 

আল্লাহ তায়ালা সকল গুণের আধার । সকল গুণ তাঁর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান । তিনি সৃষ্টিকর্তা। বিশ্বজগৎ ও এর মধ্যে যা কিছু রয়েছে সবই তাঁর সৃষ্টি । তিনি রিযিকদাতা। সকল সৃষ্টিই রিজিকের জন্য তাঁর মুখাপেক্ষী । তিনিই সর্বশক্তিমান সবকিছুর নিয়ন্ত্রক । সকলকিছুই তাঁর পরিচালনায় সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এককথায় তিনি সর্বগুণে গুণান্বিত । তাঁর গুণের কোনো সীমা নেই । সুন্দর ও পবিত্র নামসমূহ একমাত্র তাঁরই জন্য নির্ধারিত। তাঁর কতিপয় গুণবাচক নাম হলো- রহিম (পরম করুণাময়), জাব্বার (প্রবল), গাফফার (অতি ক্ষমাশীল), বাসির (সর্বদ্রষ্টা), সামিউ (সর্বশ্রোতা), আলিউ (মহান), হাফিয (মহারক্ষক) ইত্যাদি ।

বস্তুত আল্লাহ তায়ালা তাঁর সত্তা ও গুণাবলিতে এক ও অতুলনীয় । তাঁর কোনো শরিক নেই । সকল প্রশংসা তাঁরই জন্য, ইবাদতের যোগ্য সত্তা একমাত্র তিনিই ।

পাঠ-৬

কুফর

পরিচয়

কুফর শব্দের আভিধানিক অর্থ অস্বীকার করা, অবিশ্বাস করা, ঢেকে রাখা, গোপন করা, অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, অবাধ্য হওয়া ইত্যাদি । ইসলামি পরিভাষায় আল্লাহ তায়ালার মনোনীত দীন ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর কোনো একটিরও প্রতি অবিশ্বাস করাকে কুফর বলা হয় ।

কুফর হলো- ইমানের বিপরীত । ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোতে বিশ্বাসের নাম ইমান । আর এসব বিষয়ে অবিশ্বাস করা হলো কুফর ।

কাফির

যে ব্যক্তি কুফরে লিপ্ত হয় তাকে বলা হয় কাফির । অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি ইসলামের কোনো মৌলিক বিষয়ে অবিশ্বাস করে তখন তাকে কাফির বলা হয় । কাফির অর্থ অবিশ্বাসী, অস্বীকারকারী । মানুষ নানাভাবে কাফির বা অবিশ্বাসী হতে পারে । যেমন:

ক. আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব অবিশ্বাস বা অস্বীকার করার দ্বারা । অর্থাৎ ‘আল্লাহ নেই' এমন কথা বললে সে ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে ।

খ. আল্লাহ তায়ালার গুণাবলি অস্বীকার করা । যেমন- আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টিকর্তা বা রিজিকদাতা না মানা গ. ইমানের মৌলিক সাতটি বিষয়ে অবিশ্বাস করা । যেমন- ফেরেশতা, নবি-রাসুল, আসমানি কিতাব, আখিরাত, তকদির ইত্যাদি অবিশ্বাস করা ।

ঘ. ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলো অস্বীকার করা । যেমন- সালাত, যাকাত, সাওম, হজ ইত্যাদিকে ইবাদত হিসেবে না মানা ৷

ঙ. হালালকে হারাম মনে করা । যেমন- হালাল খাদ্যকে হারাম মনে করে না খাওয়া ।

চ. হারামকে হালাল মনে করা । যেমন- মদ, জুয়া, সুদ, ঘুষ ইত্যাদিকে হালাল বা জায়েজ মনে করা ।

 

ছ. ইচ্ছাকৃতভাবে কাফিরদের অনুকরণ করা, তাদের ধর্মীয় চিহ্ন ব্যবহার করা ।

জ. ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা । যেমন, মহানবি (স.) কিংবা কুরআনকে

নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করা । উপরোল্লিখিত কাজগুলো করার মাধ্যমে মানুষ কাফির হয়ে যায় । এমতাবস্থায় পুনরায় ইমান আনতে ও খাঁটি মনে তওবা করতে হবে এবং ভবিষ্যতে এরূপ ঘৃণ্য কাজ না করার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে ।

কুফরের পরিণতি ও কুফল

মানবজীবনে কুফরের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ । কুফরের ফলে শুধু দুনিয়াতেই নয় বরং আখিরাতেও মানুষকে শোচনীয় পরিণতি বরণ করতে হবে । এর কতিপয় কুফল নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

ক. অবাধ্যতা ও অকৃতজ্ঞতা

কুফর মানুষের মধ্যে অবাধ্যতা ও অকৃতজ্ঞতার জন্ম দেয় । আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টিকর্তা । তিনিই আমাদের লালন-পালন করেন । পৃথিবীর সকল নিয়ামত তাঁরই দান । কাফির ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে অবিশ্বাস করে, এসব নিয়ামত অস্বীকার করে । সে আল্লাহ তায়ালার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয় । আল্লাহ তায়ালার বিধি-নিষেধ অমান্য করে । ফলে সমাজে সে অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ হিসেবে পরিচিত হয় ।

খ. পাপাচার বৃদ্ধি

কাফির ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা, পরকাল, হাশর, মিযান, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি অবিশ্বাস করে । মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে মানুষকে তার কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে এরূপ ধারণাও অস্বীকার করে । তার নিকট দুনিয়ার জীবনই প্রধান । সুতরাং দুনিয়ায় ধন-সম্পদের ও আরাম-আয়েশের লোভে সে নানারকম অসৎ ও অশ্লীল কাজে জড়িয়ে পড়ে। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, সন্ত্রাস, সুদ-ঘুষ, জুয়া ইত্যাদিতে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে । ফলে সমাজে পাপাচার বৃদ্ধি পায় ।

গ. হতাশা সৃষ্টি

স্বভাবগতভাবেই মানুষ ভরসা করতে পছন্দ করে । আশা-ভরসা না থাকলে মানুষ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারে না । কাফির ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা ও তকদিরে অবিশ্বাস করে । ফলে সে যেকোনো বিপদে আপদে ধৈর্যহারা হয়ে পড়ে । মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে ধৈর্যধারণ করতে পারে না । অন্যদিকে তকদিরে বিশ্বাস না থাকায় যেকোনো ব্যর্থতায় সে চরম হতাশ হয়ে পড়ে । ফলে তার জীবন চরম হতাশাগ্রস্তভাবে অতিবাহিত হয় ।

ঘ. অনৈতিকতার প্রসার

কুফর মানবসমাজে অনৈতিকতার প্রসার ঘটায় । আখিরাত, জান্নাত ও জাহান্নামে বিশ্বাস না থাকায় কাফির ব্যক্তি নৈতিকতার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে না এবং দুনিয়ার স্বার্থে মিথ্যাচার, অনাচার, ব্যভিচার ইত্যাদি যেকোনো পাপ ও অনৈতিক কাজই সে বিনা দ্বিধায় করতে পারে । নবি-রাসুলগণকে বিশ্বাস না করায় তাঁদের নৈতিক চরিত্র এবং শিক্ষাও সে অনুসরণ করে না । এভাবে কুফরের মাধ্যমে সমাজে অনৈতিকতার প্রসার ঘটে ।

 

ঙ. আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টি

কুফরির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার প্রতি অবিশ্বাস, অকৃতজ্ঞতা ও অবাধ্যতা সৃষ্টি হয় । কাফির আল্লাহ তায়ালার বিধি-বিধান ও আদেশ-নিষেধের কোনো পরোয়া করে না । বরং আল্লাহ তায়ালা, ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে বিদ্রোহ ও বিরোধিতা করে । ফলে আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন । আর যার প্রতি আল্লাহ তায়ালা অসন্তুষ্ট হন, সে যত ক্ষমতা ও সম্পদের মালিক হোক না কেন তার ধ্বংস অনিবার্য ।

চ. অনন্তকালের শাস্তি

পরকালে কাফিররা জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে । তারা জাহান্নামে চিরকাল থাকবে । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِا يُتِنَا أُولَئِكَ أَصْحَبُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَلِدُونَ 6

অর্থ : “যারা কুফরি করবে এবং আমার নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করবে তারাই জাহান্নামের অধিবাসী । সেখানে তারা চিরদিন থাকবে ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৩৯)

কুফর একটি মারাত্মক পাপ । সুতরাং এ থেকে সকলেরই বেঁচে থাকা উচিত ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা কুফরের পরিণতি ও কুফল সম্পর্কে ১০টি বাক্য নিজ খাতায় লিখে শিক্ষককে দেখাবে ।

পাঠ-৭ 

শিরক

পরিচয়

শিরক শব্দের অর্থ অংশীদার সাব্যস্ত করা, একাধিক স্রষ্টা বা উপাস্যে বিশ্বাস করা । ইসলামি পরিভাষায় মহান আল্লাহর সাথে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে শরিক করা কিংবা তাঁর সমতুল্য মনে করাকে শিরক বলা হয় । যে ব্যক্তি শিরক করে তাকে বলা হয় মুশরিক । শিরক হলো তাওহিদের বিপরীত । আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং শিরকের ধারণা খণ্ডন করেছেন । তিনি বলেন- قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ

অর্থ : “বলুন (হে নবি!) তিনি আল্লাহ্, এক ও অদ্বিতীয় ।” (সূরা আল-ইখলাস, আয়াত ১) । অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন- অর্থ : “কোনো কিছুই তাঁর সদৃশ নয় ।” (সূরা আশ্-শুরা, আয়াত ১১) । আল-কুরআনে আরও বলা হয়েছে-

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٍ . ج

لَوْ كَانَ فِيْهِمَا أَلِهَةٌ إِلَّا اللهُ لَفَسَدَتَاء

অর্থ : “যদি সেথায় (আসমান ও জমিনে) আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ থাকত তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত ।” (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ২২)

 

 

 

আল-কুরআনের এসব আয়াত দ্বারা স্পষ্টভাবে আল্লাহ তায়ালার সত্তা ও গুণে অতুলনীয়তার বিষয়টি বোঝা যায় । সুতরাং আল্লাহ তায়ালার সাথে কাউকে অংশীদার করা নিঃসন্দেহে শিরক ও জঘন্য অপরাধ ।

আল্লাহ তায়ালার সাথে শিরক চার ধরনের হতে পারে । যথা-

১. আল্লাহ তায়ালার সত্তা ও অস্তিত্বে শিরক করা । যেমন- ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর পুত্র মনে করা । আল্লাহ তায়ালার গুণাবলিতে শিরক করা। যেমন- আল্লাহ তায়ালার পাশাপাশি অন্য কাউকে সৃষ্টিকর্তা বা রিজিকদাতা মনে করা ।

৩. সৃষ্টি জগতের পরিচালনায় কাউকে আল্লাহর অংশীদার বানানো । যেমন- ফেরেশতাদের জগৎ পরিচালনাকারী হিসেবে মনে করা ।

৪. ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার সাথে কাউকে শরিক করা । যেমন- আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদাহ করা, কারও নামে পশু জবাই করা ইত্যাদি ।

শিরকের কুফল ও প্রতিকার

শিরক অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ। পৃথিবীর সকল প্রকার জুলুমের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো শিরক । আল্লাহ তায়ালা বলেন- إِنَّ الشَّرُكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ

অর্থ : “নিশ্চয়ই শিরক চরম জুলুম।” (সূরা লুকমান, আয়াত ১৩)

বস্তুত আল্লাহ তায়ালাই আমাদের স্রষ্টা ও প্রতিপালক । তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতই আমরা ভোগ করি । এরপরও কেউ যদি আল্লাহ তায়ালার সাথে কাউকে অংশীদার স্থাপন করে তবে তা অপেক্ষা বড় জুলুম আর কি হতে পারে ।

আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের প্রতি খুবই অসন্তুষ্ট । তিনি অপার ক্ষমাশীল ও অসীম দয়াময় হওয়া সত্ত্বেও শিরকের অপরাধ ক্ষমা করেন না । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

إِنَّ اللهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ

অর্থ : “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না । এতদ্ব্যতীত যেকোনো পাপ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন ।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত ৪৮)

বস্তুত আল্লাহ তায়ালার দয়া, ক্ষমা ও রহমত ব্যতীত দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ লাভ করা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয় । পরকালে মুশরিকদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি । আল-কুরআনে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ।

b إِنَّهُ مَنْ تُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْولهُ النَّارُ

অর্থ : “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করবে আল্লাহ তার জন্য অবশ্যই জান্নাত হারাম করে দেবেন । এবং তার আবাস জাহান্নাম ।” (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৭২)

 

 

 

প্রকৃতপক্ষে শিরক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ । এরূপ কাজ থেকে সকলেরই সদাসর্বদা সতর্ক থাকতে হবে । ভুলক্রমে আল্লাহ তায়ালার সাথে শিরক করে ফেললে সাথে সাথে পুনরায় ইমান আনতে হবে । অতঃপর বিশুদ্ধ অন্তরে তওবা করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে । সাথে সাথে ভবিষ্যতে এরূপ পাপ না করার শপথ গ্রহণ করতে হবে । তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তায়ালা স্বীয় দয়া ও করুণার মাধ্যমে পাপ ক্ষমা করে দিতে পারেন ।

আমরা অবশ্যই শিরক থেকে বেঁচে থাকব এবং আল্লাহর উপর সুদৃঢ় ইমান এনে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হব। তাহলেই আমাদের ইহকাল ও পরকাল মঙ্গলময় হবে ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা শিরকের পরিচয়, কুফল ও প্রতিকার বিষয়ে ১০টি বাক্য বাড়ি থেকে পোস্টার আকারে তৈরি করে নিয়ে আসবে।

পাঠ-৮ 

নিফাক

পরিচয়

নিফাক শব্দের আভিধানিক অর্থ ভণ্ডামি, কপটতা, দ্বিমুখীভাব, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা ইত্যাদি । এর ব্যবহারিক অর্থ হলো অন্তরে একরকম ভাব রেখে বাইরে এর বিপরীত অবস্থা প্রকাশ করা । অর্থাৎ অন্তরে বিরোধিতা গোপন রেখে বাইরে আনুগত্য প্রদর্শন করা । ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, অন্তরে কুফর ও অবাধ্যতা গোপন করে মুখে ইসলামকে স্বীকার করার নাম হলো নিফাক । যে এরূপ কাজ করে তাকে বলা হয় মুনাফিক । মুনাফিকরা অন্তরের দিক থেকে কাফির ও অবাধ্য । কিন্তু বাহ্যিকভাবে তারা ইসলাম ও ইমান স্বীকার করে এবং মুসলিমদের ন্যায় ইবাদত পালন করে ।

রাসুলুল্লাহ (স.) মুনাফিকদের চিহ্ন বর্ণনা করে বলেছেন-

أَيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثٌ إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ

অর্থ : “মুনাফিকের চিহ্ন তিনটি । যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে, আর যখন কোনো কিছু তার নিকট আমানত রাখা হয় তার খিয়ানত করে ।” (সহিহ্ বুখারি)

নিফাকের কুফল ও প্রতিকার

নিফাক একটি মারাত্মক পাপ । এটি মানুষের চরিত্র ও নৈতিকতা ধ্বংস করে দেয় । এর ফলে মানুষ মিথ্যাচারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَاللهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنْفِقِينَ لَكُذِبُونَ

অর্থ : “আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা নিঃসন্দেহে মিথ্যাবাদী।” (সূরা আল- ল-মুনাফিকুন, আয়াত ০১)

 

 

 

মিথ্যার পাশাপাশি মুনাফিকরা অন্যান্য খারাপ ও অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে । পার্থিব লোভ-লালসা ও স্বার্থ রক্ষায় তারা মানুষের অকল্যাণ করতেও পিছপা হয় না । তারা পরনিন্দা ও পরচর্চা করে । ফলে সমাজে সন্দেহ ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় । মুনাফিকরা ভেতরে এক আর বাইরে অন্য রকম হওয়ায় লোকজন তাদের বিশ্বাস করে না । বরং সন্দেহ ও ঘৃণার চোখে দেখে। সমাজের মানুষের নিকট তারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে জীবন কাটায় ।

ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য মুনাফিকরা খুবই ক্ষতিকর । কেননা তারা মুসলমানদের সাথে মিশে ইসলামের শত্রুদের সাহায্য করে। মুসলমানদের গোপন তথ্য ও দুর্বলতার কথা শত্রুদের জানিয়ে দেয়। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগেও মদিনাতে মুনাফিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল ।

তারা ইসলাম ও মুসলমানগণের সাথে থেকেও আল্লাহ তায়ালার অবাধ্য ছিল । পরকালীন জীবনে মুনাফিকদের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ । তাদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, অর্থ : “নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে ।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত ১৪৫)

で إِنَّ الْمُنفِقِينَ فِي التَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ

আমরা নিফাক থেকে বেঁচে থাকব । আমাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সকলের নিকট নিফাকের কুফল ও পরিণতির কথা তুলে ধরব ও তাদের সতর্ক করব । রাসুলুল্লাহ (স.) মুনাফিকদের যে তিনটি চিহ্ন বা নিদর্শনের কথা বলেছেন এগুলো থেকে আমরা অবশ্যই বেঁচে থাকব এবং নিজ জীবনে উত্তম চরিত্র অনুশীলন করব ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা মুনাফিকের চিহ্নগুলো লিখে একটি পোস্টার তৈরি করবে ।

পাঠ ৯

রিসালাত

পরিচয়

রিসালাত শব্দের আভিধানিক অর্থ বার্তা, চিঠি পৌছানো, পয়গাম, সংবাদ বা কোনো ভালো কাজের দায়িত্ব বহন করা । ইসলামি পরিভাষায়, মহান আল্লাহ তায়ালার পবিত্র বাণী মানুষের নিকট পৌছে দেওয়ার দায়িত্বকে রিসালাত বলা হয় । আর যিনি এ দায়িত্ব পালন করেন তাঁকে বলা হয় রাসুল । রাসুল শব্দের বহুবচন রুসুল ।

রিসালাতে বিশ্বাসের গুরুত্ব

ইসলামি জীবনদর্শনে রিসালাতে বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য । তাওহিদে বিশ্বাসের সাথে সাথে প্রত্যেক মুমিন ও মুসলিমকেই রিসালাতে বিশ্বাস করতে হয় । ইসলামের মূলবাণী কালিমা তায়্যিবাতে এ বিষয়টি

 

 

সুন্দরভাবে বিবৃত হয়েছে । এ কালিমার প্রথমাংশ  (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ; অর্থ- আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই) দ্বারা তাওহিদের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আর সাথে সাথে দ্বিতীয়াংশ (মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ অর্থ- মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর রাসুল) দ্বারা রিসালাতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে । সুতরাং তাওহিদে বিশ্বাস স্থাপনের ন্যায় রিসালাতেও বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে ।

বস্তুত রিসালাতে বিশ্বাস না করলে কেউ মুমিন হতে পারে না । কেননা মানুষের জ্ঞান সীমাবদ্ধ । এ স্বল্প জ্ঞান দ্বারা অনন্ত, অসীম আল্লাহ তায়ালার পূর্ণ পরিচয় লাভ করা সম্ভব নয় । তাই নবি-রাসুলগণ মানুষের নিকট আল্লাহ তায়ালার পরিচয় তুলে ধরেছেন । তাঁর পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা ও গুণাবলির বর্ণনা প্রদান করেছেন । তাঁরা ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের জন্য আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত জীবনবিধান ও দিকনির্দেশনা নিয়ে এসেছেন। হযরত মুহাম্মদ (স.) না আসলে নবি ও রাসুল সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতে পারতাম না। এমনকি আল্লাহ তায়ালার সত্তা ও সিফাতের পরিচয়ও লাভ করতে পারতাম না । মূলত নবি-রাসুলগণের আনীত বাণী ও বর্ণনার ফলেই মানুষের পক্ষে তা সম্ভব হয়েছে। সুতরাং নবি-রাসুলগণের এ সমস্ত সংবাদ বা রিসালাতকে বিশ্বাস করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, রিসালাতকে অস্বীকার করলে মহান আল্লাহকেই প্রকারান্তরে অস্বীকার করা হয় । অতএব, মানবজীবনে রিসালাতে বিশ্বাস করা ইমানের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে নির্ধারিত ।

নবি-রাসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য

আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য-অগণিত নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন । তাঁদের উদ্দেশ্যহীনভাবে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়নি বরং তাঁরা নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেছেন । নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁদের বেশ কিছু কাজ করতে হতো । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতিপয় কাজ হলো-

তাঁরা মানুষের নিকট আল্লাহ তায়ালার পরিচয় তুলে ধরতেন । অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার জাত-সিফাত, ক্ষমতা, নিয়ামত ইত্যাদি বিষয়ের কথা মানুষের নিকট প্রকাশ করতেন ।

সত্য ও সুন্দর জীবনের দিকে আহবান জানাতেন ।

আল্লাহ তায়ালার ইবাদত ও ধর্মীয় নানা বিধি-বিধান শিক্ষা দিতেন ।

পরকাল সম্পর্কে ধারণা প্রদান করতেন ।

পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধান বাস্তবায়নের জন্য হাতে-কলমে শিক্ষা দিতেন ।

নবি-রাসুলগণের গুণাবলি

নবি-রাসুলগণ ছিলেন আল্লাহ তায়ালার মনোনীত বান্দা । আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তাঁদের নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত করেছেন । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

اللهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَئِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌة

 

 

 

 

অর্থ : “আল্লাহ তায়ালাই ফেরেশতাদের মধ্য থেকে এবং মানুষের মধ্য থেকেও রাসুল মনোনীত করেন; আল্লাহ তো সর্বশ্রোতা, সম্যক দ্রষ্টা ।” (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত ৭৫)

সুতরাং মনোনীত বান্দা হিসেবে নবি-রাসুলগণ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন । প্রথমত, তাঁরা ছিলেন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তায়ালার উপর বিশ্বাসী । সবধরনের কথায় ও কাজে তাঁরা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশের অনুসরণ করতেন । আল্লাহ তায়ালার পূর্ণ আনুগত্যই ছিল তাঁদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ।

নবি-রাসুলগণ ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, সুবিবেচক ও বিচক্ষণ। তাঁরা ছিলেন নিষ্পাপ। তাঁরা সবধরনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র ছিলেন । স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাঁদের সকল প্রকার অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে বাঁচিয়ে রাখতেন । হযরত ইউসুফ (আ.) ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ নবি । তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 66 আমি তাঁকে মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখার জন্য এভাবে নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। সে তো ছিল আমার বিশুদ্ধচিত্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত ।” (সূরা ইউসুফ, আয়াত ২৪)

নবি-রাসুলগণ ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী । সকল সৎগুণ তাঁরা অনুশীলন করতেন । তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সৎ, সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ । দয়া, ক্ষমা, ধৈর্য ইত্যাদি সব ধরনের মানবিক গুণ তাঁদের চরিত্রে বিদ্যমান ছিল । মিথ্যা, প্রতারণা, পরনিন্দা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি খারাপ স্বভাবের লেশমাত্র তাঁদের চরিত্রে কখনোই ছিল না । বরং তাঁরা ছিলেন সৎস্বভাবের জন্য মানবজাতির অনুপম আদর্শ ।

কর্তব্যনিষ্ঠা ও দায়িত্বপালনে নবি-রাসুলগণ ছিলেন অতুলনীয় । নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাঁরা বিন্দুমাত্র অলসতা ও উদাসীনতা প্রদর্শন করেননি । বরং এজন্য কাফিরদের বহু অত্যাচার ও নিপীড়ন ধৈর্যসহকারে সহ্য করেছেন । কিন্তু তারপরও তাঁরা যথাযথভাবে মানুষের নিকট আল্লাহ তায়ালার বাণী পৌঁছিয়েছেন । তাঁরা ছিলেন নির্লোভ ও নিঃস্বার্থ। পার্থিব কোনো লাভের আশায় তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব থেকে কখনো পিছপা হননি । কাফিররা ইসলামের দাওয়াত প্রচার বন্ধ করার জন্য তাঁদের নানা প্রলোভন দেখাত । কিন্তু তাঁরা পার্থিব স্বার্থের কাছে মাথা নত করেননি ।

দীন প্রচারে নবি-রাসুলগণ ছিলেন ত্যাগের মূর্ত প্রতীক । বিনা দ্বিধায় পার্থিব আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস, ধন-সম্পদ তাঁরা আল্লাহর নির্দেশে ত্যাগ করতেন । দীন প্রচারের স্বার্থে প্রিয়নবি (স.) বাড়ি-ঘর, আত্মীয়- স্বজন, এমনকি নিজ দেশ মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেছিলেন । নবি-রাসুলগণের জীবনীতে ত্যাগের এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় । নবুয়তের ধারা

আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন । সর্বপ্রথম নবি ছিলেন হযরত আদম (আ.), আর সর্বশেষ নবি ও রাসুল হলেন হযরত মুহাম্মদ (স.)। এঁদের মাঝখানে আল্লাহ তায়ালা আরও বহু নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন । নবি-রাসুলদের আগমনের এই ধারাবাহিকতাকেই নবুয়তের ক্রমধারা বলা হয় । দুনিয়াতে আগত সকল গোষ্ঠী বা জাতির জন্যই আল্লাহ তায়ালা নবি-রাসুল বা পথপ্রদর্শনকারী পাঠিয়েছেন ।

 

 

 

 

আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍه

অর্থ : “আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যই পথপ্রদর্শক রয়েছে ।” (সূরা আর-রাদ, আয়াত ৭)

তাঁরা মানুষকে এক আল্লাহ তায়ালার দিকে ডাকতেন । সত্য ও সুন্দর জীবনবিধান তথা আল্লাহর দীন অনুসরণের নির্দেশ দিতেন ।

সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত শরিয়ত তথা দীনের বিধি-বিধান এক রকম ছিল না। বরং মানবজাতির পরিবেশ, পরিস্থিতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন শরিয়ত দেওয়া হতো । নবি-রাসুলগণ তা মানবসমাজে বাস্তবায়ন করতেন। তবে সব নবি-রাসুলের দীনের মৌলিক কাঠামো ছিল এক ও অভিন্ন । আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ বা তাওহিদ ছিল সবারই প্রচারিত দীনের মূলকথা । হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে আগত সকল নবি-রাসুলই এ দীন প্রচার করেছেন । হযরত নূহ (আ.), হযরত ইবরাহিম (আ.), হযরত মুসা (আ.), হযরত দাউদ (আ.), হযরত ঈসা (আ.) সকলেই এই একই দীন ও শিক্ষা প্রচার করেছেন । আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন নবুয়তের ধারার সর্বশেষ নবি । তাঁর পরে আর কোনো নবি আসেননি, আসবেনও না । সুতরাং আল্লাহ তায়ালা তাঁর মাধ্যমে দীনের পূর্ণতা প্রদান করেন । আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন-

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا

অর্থ : “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দীন হিসেবে মনোনীত করলাম ।” (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৩) এভাবে দীনের বিধি-বিধান পূর্ণতা প্রাপ্তির ফলে নবি-রাসুলগণের আগমনের ধারাও বন্ধ হয়ে যায় । ফলে নবুয়তের ধারাও পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় । মানুষের হিদায়াতের জন্য আগমনকারী এসব নবি-রাসুল সকলেই ছিলেন আল্লাহ তায়ালার মনোনীত বান্দা । তাঁদের সকলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

أمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَّبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللهِ وَمَلَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ قف احَدٍ مِّن رُّسُلِهِ " 3

অর্থ : “রাসুল, তাঁর প্রতি তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে ইমান এনেছেন এবং মুমিনগণও। তাদের সবাই আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ এবং তাঁর রাসুলগণে ইমান এনেছে । তারা বলে, আমরা তাঁর রাসুলগণের মধ্যে কোনো তারতম্য করি না।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৮৫)

নবুয়তের ধারায় আগমনকারী সব নবি-রাসুলকে বিশ্বাস করা ইমানের অপরিহার্য শর্ত । এঁদের কাউকে বিশ্বাস এবং কাউকে অবিশ্বাস করা যাবে না । বরং সকলকেই আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত নবি-রাসুল হিসেবে বিশ্বাস করতে হবে । নবি-রাসুল হিসেবে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে। কারও প্রতিই কোনোরূপ ঠাট্টা-বিদ্রূপ বা কটাক্ষ করা যাবে না ।

 

 

 

সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি

নবুয়তের ধারার সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি ছিলেন আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) । তিনি ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী । দুনিয়াতে আগমনকারী সব নবি-রাসুলই কোনো বিশেষ গোত্র, বিশেষ দেশ, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন সারা বিশ্বের সকল স্থানের সকল মানুষের নবি । তিনি বিশ্বনবি । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

قُلْ يَأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا

অর্থ : “(হে নবি!) আপনি বলুন, হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সকলের জন্যই আল্লাহর রাসুল হিসেবে প্রেরিত ।” (সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৫৮)

রাসুলুল্লাহ (স.) ছিলেন সর্বকালের নবি । কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আগমন করবে সকলের নবি তিনিই । তাঁর শিক্ষা, আদর্শ ও আনীত কিতাব আল-কুরআন সকলকেই অনুসরণ করতে হবে । তিনি রহমতের নবি । মানবজাতির জন্য তিনি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ নিয়ামত ও অনুগ্রহ স্বরূপ । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَمَا أَرْسَلْنَكَ إِلَّا رَحْمَةٌ لِلْعَلَمِينَ

অর্থ : “(হে নবি!) আমি তো আপনাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি ।” (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)

অতএব, আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি । হযরত মুহাম্মদ (স.)- কে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হিসেবে বিশ্বাস করা প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি কর্তব্য ।

খতমে নবুয়তের অর্থ ও এতে বিশ্বাসের গুরুত্ব

হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন সর্বশেষ নবি । তাঁর মাধ্যমে দীনের পূর্ণতা ঘোষিত হয় এবং নবুয়তের ধারা সমাপ্ত হয় । তিনি নবি-রাসুলগণের ধারায় সর্বশেষে আগমন করেছেন । আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যিন’ তথা সর্বশেষ নবি বলে অভিহিত করেছেন ।

খাতামুন অর্থ শেষ, সমাপ্তি । আর নবুয়ত হলো নবিগণের দায়িত্ব । সুতরাং খতমে নবুয়তের অর্থ নবুয়তের সমাপ্তি । আর যার মাধ্যমে নবুয়তের ধারার সমাপ্তি ঘটে তিনি হলেন খাতামুন নাবিয়্যিন বা সর্বশেষ নবি ।

আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন। এঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম ছিলেন হযরত আদম (আ.)। আর সর্বশেষ ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (স.)। হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর মাধ্যমে নবি-রাসুলগণের আগমনের ধারা শেষ বা বন্ধ হয়ে যায় । সুতরাং তিনিই সর্বশেষ নবি বা খাতামুন নাবিয়্যিন । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّنَ

 

 

অর্থ : “মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসুল এবং শেষ নবি ।” (সূরা আল আহযাব, আয়াত ৪০ )

খাতামুন শব্দের অন্যতম অর্থ সিলমোহর । কোনো কিছুতে সিলমোহর তখন অঙ্কিত করা হয় যখন তা পূর্ণ হয়ে যায় । সিলমোহর লাগানোর পর তাতে কোনো কিছু প্রবেশ করানো যায় না । নবুয়তের সিলমোহর হলো নবুয়তের পরিসমাপ্তির ঘোষণা। নবুয়তের দায়িত্বের পরিসমাপ্তি ঘোষণা । অর্থাৎ নতুনভাবে কোনো ব্যক্তি নবি হতে পারবে না এবং নবুয়তের ধারায় প্রবেশ করতে পারবে না । এটাই হলো খতমে নবুয়তের মূল কথা ।

আমাদের প্রিয় নবি (স.) হলেন খাতামুন নাবিয়্যিন । তিনি সর্বশেষ নবি । তাঁর পরে আর কোনো নবি নেই । তাঁর পরে আজ পর্যন্ত কোনো নবি আসেননি । কিয়ামত পর্যন্ত আসবেনও না । তাঁর পরবর্তীতে যারা নবুয়ত দাবি করেছে তারা সবাই ভণ্ড, মিথ্যাবাদী ও প্রতারক । কেননা মহানবি (স.) বলেছেন,

أَنَا خَاتَمُ النَّبِينَ لَا نَبِيَّ بَعْدِي

অর্থ : “আমিই শেষ নবি । আমার পরে কোনো নবি নেই ।” (সহিহ মুসলিম)

অন্য একটি হাদিসে মহানবি (স.) বলেছেন- “অচিরেই আমার উম্মতের মধ্যে মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব হবে । তারা প্রত্যেকেই নবি হওয়ার দাবি করবে । অথচ আমিই সর্বশেষ নবি । আমার পর আর কোনো নবি আসবে না ।” (আবু দাউদ)

হযরত মুহাম্মদ (স.)-কে খাতামুন নাবিয়্যিন হিসেবে বিশ্বাস করা ইমানের অন্যতম অঙ্গ । তাঁর পরবর্তীতে যারা নবি বলে দাবি করেছে সবাই মিথ্যাবাদী । আমরা তাদের নবি হিসেবে বিশ্বাস করব না । তাদের শিক্ষা, আদর্শ বর্জন করব।

আমরা জীবনের সর্বাবস্থায় মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণ করে চলব ।

কাজ : ক. শিক্ষার্থীরা রিসালাতের গুরুত্ব সম্পর্কে ১০টি বাক্য নিজ খাতায় লিখবে ।

           খ. শিক্ষার্থীরা নবি-রাসুলগণের গুণাবলি সম্পর্কে ১০টি বাক্য লিখে একটি পোস্টার তৈরি করবে।

পাঠ ১০

নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে রিসালাত ও নবুয়ত

ইসলাম নীতি-নৈতিকতার ধর্ম । ইসলামের সমস্ত আকিদা-বিশ্বাস, বিধি-বিধান, শিক্ষা-আদর্শ নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে । ইসলামি জীবনদর্শনে রিসালাত ও নবুয়ত অপরিহার্য বিষয় । নবুয়ত ও রিসালাত হলো নবি-রাসুলগণের দায়িত্ব । আল্লাহ তায়ালার বাণী ও শিক্ষা মানুষের নিকট পৌঁছে দেওয়াকে নবুয়ত ও রিসালাত বলা হয় । মানবজীবনে নৈতিক মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসারে নবুয়ত ও রিসালাত প্রধানত দুই ভাবে ভূমিকা রাখতে পারে ।

 

 

প্রথমত, নবুয়ত ও রিসালাতের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব, পরিচয় ও গুণাবলি সম্পর্কে জ্ঞান দান করা । মানুষকে সত্য ও সুন্দরের দিকে পরিচালনা করা । সর্বোপরি ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ ও সফলতার দিকনির্দেশনা প্রদান করা । নবুয়ত ও রিসালাতের শিক্ষা মানুষকে শান্তি ও শৃঙ্খলার দিকে পরিচালনা করে । জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের সকল কাজকর্ম আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত পথে পরিচালনা করতে সাহায্য করে । এভাবে দেখা যায়, যে ব্যক্তি নবুয়ত ও রিসালাতের শিক্ষানুসারে জীবনযাপন করে সেই পরিপূর্ণ মানুষ । এরূপ ব্যক্তি সমস্ত মানবিক গুণের অধিকারী হয় । পশুত্বের অভ্যাস ত্যাগ করে মনুষ্যত্বের অভ্যাস অনুশীলন করে । নবুয়ত ও রিসালাতের চেতনা মানুষের মধ্যকার সমস্ত খারাপ অভ্যাস, অশ্লীলতা ও মন্দকর্মের চর্চা দূর করে দেয় । মানুষ সৎ ও সুন্দর জীবনযাপনে উৎসাহিত হয় । উত্তম চরিত্র ও নৈতিক আচার-আচরণে উদ্বুদ্ধ হয় । এভাবে নবুয়ত ও রিসালাতের শিক্ষায় মানুষ নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত হয় ।

দ্বিতীয়ত, নবুয়ত ও রিসালাত মানুষকে নবি-রাসুলগণের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে । নবি-রাসুলগণ ছিলেন নিষ্পাপ । তাঁরা ছিলেন সকল সৎগুণের অধিকারী । উত্তম চরিত্রের নমুনা ছিল তাঁদের জীবনচরিত । কোনোরূপ অন্যায়, অনৈতিক ও অশ্লীল কাজকর্ম তাঁদের চরিত্রে কখনোই ছিল না । বরং সর্বাবস্থায় নীতি ও নৈতিকতার আদর্শ রক্ষা করাই ছিল তাঁদের অন্যতম দায়িত্ব । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

لَقَد كَانَ لَكُمْ فِي رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ

অর্থ : “তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ ।” (সূরা আল-আহযাব, আয়াত ২১)

বস্তুত নবি-রাসুলগণ ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তাঁদের জীবনী ও শিক্ষা আমাদের জন্য আদর্শ । রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি । (ইবনে মাজাহ)

রাসুলুল্লাহ (স.) ছিলেন মানবতার মহান শিক্ষক । তিনি মানুষকে মানবতা ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়েছেন । মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদির নির্দেশনা প্রদান করেছেন । অত্যাচার, অবিচার ও অনৈতিকতার বদলে সত্য, ন্যায় ও মানবিকতার কথা বলেছেন । মানুষকে উত্তম চরিত্রবান হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন । নিজ জীবনে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ অনুশীলনের মাধ্যমে হাতে কলমে মানুষকে নৈতিকতা সমুন্নত রাখতে শিক্ষা দিয়েছেন । তিনি স্বয়ং বলেছেন-

الما بُعِثْتُ لِأُتَيْمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ

অর্থ : “উত্তম গুণাবলির পরিপূর্ণতা দানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি ।” (বায়হাকি) বস্তুত নবি-রাসুলগণ সকলেই ছিলেন উত্তম আদর্শের নমুনা । আর আমাদের প্রিয়নবি (স.) ছিলেন তাঁদের মধ্যে সর্বোত্তম । তাঁর চরিত্রে মানবিক সবগুণ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল ।

নবুয়ত ও রিসালাতে বিশ্বাসের মাধ্যমে আমরা ইসলামি জীবনদর্শনে প্রবেশ করি । অতঃপর নবি-রাসুলগণের জীবনী ও আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ কামনা করি । এভাবে আমাদের জীবন ও চরিত্র উত্তম হয় । নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকশিত হয় । মানবসমাজে পশুত্বের পরিবর্তে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে ।

 

 

কাজ : শিক্ষার্থীরা নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে রিসালাত ও নবুয়তের গুরুত্ব সম্পর্কে ১৫টি বাক্য নিজ খাতায় বাড়ি থেকে লিখে এনে শ্রেণি-শিক্ষককে দেখাবে ।

পাঠ ১১

আসমানি কিতাব

পরিচয়

কিতাব শব্দের অর্থ লিপিবদ্ধ বা লিখিত বস্তু । এর প্রতিশব্দ হলো গ্রন্থ, পুস্তক, বই ইত্যাদি । আসমানি কিতাব হলো এমন গ্রন্থ যা আল্লাহ তায়ালা থেকে অবতীর্ণ হয়েছে ।

ইসলামি পরিভাষায় যেসব কিতাব আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য দিকনির্দেশনা স্বরূপ নাজিল করেছেন তাকে আসমানি কিতাব বলে । অন্যকথায় আল্লাহ তায়ালার বাণী সম্বলিত গ্রন্থাবলিকে আসমানি কিতাব বলা হয়। সুতরাং আসমানি কিতাব হলো আল্লাহর বাণীসমষ্টি । আল্লাহ তায়ালা জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে তাঁর বাণী রাসুলগণের নিকট প্রেরণ করেছেন । অতঃপর নবি-রাসুলগণ তা মানুষের নিকট পৌছে দিয়েছেন ।

আসমানি কিতাবের বিষয়বস্তু

আল্লাহ তায়ালা আসমানি কিতাবসমূহে নানা বিষয়ের আলোচনা উপস্থাপন করেছেন । যেমন-

ক. আল্লাহ তায়ালার সত্তাগত পরিচয় ।

খ. আল্লাহ তায়ালার গুণাবলির বর্ণনা ।

গ. নবি-রাসুলগণের বর্ণনা ।

ঘ. পূর্ববর্তী জাতিসমূহের বিবরণ ।

ঙ. অবাধ্য ও কাফিরদের পরিণতির বিবরণ ।

চ. হালাল-হারামের বর্ণনা ।

ছ. বিধি-বিধান সংক্রান্ত বিবরণ ।

জ. শাস্তি ও সতর্কীকরণ বিষয়ে আলোচনা ।

ঝ. উপদেশ ও সুসংবাদ সম্পর্কে বিবরণ ।

ঞ. আকিদা সংক্রান্ত বিষয়সমূহের বিবরণ ।

ট. পরকাল সংক্রান্ত বিষয়সমূহের বিবরণ ইত্যাদি ।

 

 

 

ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা

প্রসিদ্ধ আসমানি কিতাবসমূহ

আল্লাহ তায়ালা সর্বমোট ১০৪ খানা আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন । এর মধ্যে ৪ (চার) খানা বড় ও প্রসিদ্ধ এবং ১০০ খানা ছোট কিতাব । ছোট কিতাবগুলোকে সহিফা বলা হয়। বড় চারখানা কিতাব চারজন প্রসিদ্ধ রাসুলের উপর নাজিল হয় । এগুলো হলো-

১. তাওরাত - হযরত মুসা (আ.)-এর উপর নাজিল হয়েছে । 

২. যাবুর - হযরত দাউদ (আ.)-এর উপর নাজিল হয়েছে ।

৩. ইঞ্জিল - হযরত ঈসা (আ.)-এর উপর নাজিল হয়েছে । 

৪. কুরআন - বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর উপর নাজিল হয়েছে ।

আর ১০০ খানা সহিফা মোট চারজন নবির উপর নাজিল হয় । এঁরা হলেন- 

১. হযরত আদম (আ.) । তাঁর উপর ১০ খানা সহিফা নাজিল হয়েছে ।

২. হযরত শিস (আ.) । তাঁর উপর ৫০ খানা সহিফা নাজিল হয়েছে ।

৩. হযরত ইবরাহিম (আ.) । তাঁর উপর ১০ খানা সহিফা নাজিল হয়েছে ।

৪. হযরত ইদরিস (আ.) । তাঁর উপর ৩০ খানা সহিফা নাজিল হয়েছে ।

আসমানি কিতাবে বিশ্বাসের গুরুত্ব

আসমানি কিতাবসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করা ইমানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । আসমানি কিতাবসমূহে বিশ্বাস স্থাপন না করলে ইমানের মূল বিষয়ই নড়বড়ে হয়ে যায় । কেননা অসমানি কিতাবগুলোর মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহ তায়ালা, নবি-রাসুল, ফেরেশতা, পরকাল ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পেরেছে । এসব বিষয় সম্পর্কে পবিত্র আল-কুরআনের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি । যদি কেউ আসমানি কিতাবসমূহ ও তাতে বর্ণিত বিষয়সমূহে অবিশ্বাস করে তবে স্বভাবতই সে ইমানের অন্যান্য বিষয়গুলোও অস্বীকার করে । সুতরাং ইমান আনার জন্য আসমানি কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য । অন্যথায় পূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না ।

আসমানি কিতাবসমূহ হলো সকল জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস। এর মাধ্যমেই আমরা সৃষ্টিজগৎ, মানবসৃষ্টি, পরকাল ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জানতে পারি । মানব জীবনে চলার পথ সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা আসমানি কিতাবসমূহেই পাওয়া যায় । আসমানি কিতাবসমূহে বিশ্বাসই এসব বিষয়কে আমাদের বাস্তবজীবনে অনুশীলনের অনুপ্রেরণা দেয় ।

সর্বশেষ আসমানি কিতাব ‘আল-কুরআন’

আল-কুরআন আল্লাহ তায়ালার বাণী । মানবজাতির হিদায়াতের লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা হযরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর উপর এ কিতাব নাজিল করেন । আল-কুরআনই হলো সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব ।

নবি করিম (স.)-এর ৪০ বছর বয়সে হেরাগুহায় ধ্যানমগ্ন থাকাবস্থায় সর্বপ্রথম সূরা আলাকের প্রথম ৫টি আয়াত নাজিল হয় । এভাবে পবিত্র কুরআন নাজিল শুরু হয় । অতঃপর রাসুল (স.)-এর নবুয়তের ২৩ বছরে অল্প অল্প করে প্রয়োজন মাফিক সম্পূর্ণ কুরআন নাজিল হয় ।

 

 

 

আল-কুরআন ৩০টি খণ্ডে বিভক্ত । এগুলোর প্রত্যেকটিকে এক একটি পারা বলা হয় । এর সূরা সংখ্যা ১১৪টি এবং রুকু সংখ্যা ৫৫৮টি।

কুরআনের নামকরণ

কুরআন অর্থ পঠিত । আল-কুরআন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পঠিত গ্রন্থ । প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে বাধ্যতামূলকভাবে কুরআন তিলাওয়াত করা হয় । এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ মহাগ্রন্থকে কুরআন বলা হয় । কুরআনের অন্য অর্থ একত্র করা বা জমা করা । আল-কুরআনে পূর্ববর্তী সকল আসমানি কিতাবের শিক্ষা ও মূলনীতি একত্র করা হয়েছে বিধায় একে কুরআন বলা হয় ।

আল-কুরআনের বেশকিছু নাম রয়েছে । এগুলোর মধ্যে প্রসিদ্ধ নাম-

১. আল-কিতাব গ্রন্থ।

২. আল-ফুরকান (সত্য-মিথ্যার) পার্থক্যকারী ।

৩. আল-হিকমা বা জ্ঞান, প্রজ্ঞা ।

৪. আল-বুরহান ও সুস্পষ্ট প্রমাণ ।

৫. আল-হক - সত্য ।

৬. আন-নুর - জ্যোতি ।

৭. আল-হুদা - পথনির্দেশ ।

৮. আয-যিকর - উপদেশ ।

৯. আশ-শিফা    - নিরাময় ।

১০. আল-মজিদ     সম্মানিত, মহিমান্বিত ।

১১. আল-মাওয়িযা -  সদুপদেশ।

১২. আর-রাহমাহ , অনুগ্রহ, দয়া ইত্যাদি ।

কুরআনের বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য

আল-কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে মর্যাদাবান গ্রন্থ । এটি দুনিয়ার সকল গ্রন্থ, এমনকি অন্যান্য আসমানি কিতাবের তুলনায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত । এর সমকক্ষ আর কোনো কিতাব নেই ।

আল-কুরআন পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ কিতাব । এ গ্রন্থ সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধার । সব বিষয়ের মূলনীতি এ গ্রন্থে বিদ্যমান । আল্লাহ তায়ালা বলেন- 

 

 

 

مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتُبَ مِنْ شَيْءٍ

অর্থ : “আমি এই কিতাবে কোনো কিছুই বাদ দেই নি ।” (সূরা আল-আনআম, আয়াত ৩৮)

সুতরাং আল-কুরআন হলো পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। মানবজীবনের প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ের যথাযথ নির্দেশনা এ কিতাবে বিদ্যমান ।

আল-কুরআন সর্বশেষ আসমানি কিতাব । আল্লাহ তায়ালা মহানবি (স.)-এর মাধ্যমে ইসলামকে পরিপূর্ণ

জীবনব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা করেছেন । ফলে পৃথিবীতে আর কোনো নবি-রাসুল আসবেন না । কোনো

আসমানি কিতাবও নাজিল হবে না । কুরআনের শিক্ষাই কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে । তা ছাড়া পূর্ববর্তী সকল আসমানি কিতাবের সার-নির্যাসও কুরআনে রয়েছে । সুতরাং এটি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। আল-কুরআন সন্দেহমুক্ত কিতাব । দুনিয়ার কোনো গ্রন্থই নির্ভুল বা অকাট্য নয়। কিন্তু কুরআন নির্ভুল এবং এটি সন্দেহেরও বাইরে । সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে এমন কোনো বিষয়ই এতে নেই । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

ذلِكَ الْكِتَبُ لَا رَيْبَ فِيهِ

অর্থ : “এটি (কুরআন) সেই কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২)

সর্বজনীন কিতাব হিসেবেও আল-কুরআনের মর্যাদা অনন্য। এটি কোনো দেশ, কাল বা জাতির জন্য সীমাবদ্ধ নয় । বরং সকল যুগের সব মানুষের জন্য এটি উপদেশ ও পথনির্দেশক । সুতরাং এটি সর্বজনীন কিতাব । আল-কুরআন একমাত্র অবিকৃত গ্রন্থ । নাজিলের পর থেকে আজ পর্যন্ত এর একটি হরকত বা নুকতাও পরিবর্তিত হয়নি । স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এর রক্ষক । তিনি বলেন-

انا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِكرَ وَإِنَّا لَهُ تَحْفِظُونَ

অর্থ : “আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্য আমিই এর সংরক্ষক ।” (সূরা আল-হিজর, আয়াত ৯)

বস্তুত আল-কুরআন অবিকৃত ও অপরিবর্তিত গ্রন্থ । আজ পর্যন্ত এতে কোনোরূপ সংযোজন, সংশোধন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন বা বিয়োজন হয়নি, আর ভবিষ্যতেও হবে না ।

কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ও মর্যাদাপূর্ণ কিতাব । এতে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য, ইতিহাস, ভবিষ্যদ্বাণী, বিজ্ঞান, সৃষ্টি রহস্য ইত্যাদি বিষয় খুব সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এটি যেহেতু আল্লাহ তায়ালার বাণী সুতরাং এর মর্যাদাও তাঁরই ন্যায় অতুলনীয় । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

بَلْ هُوَ قُرْآنٌ مَّجِيدٌ هُ فِي لَوْحٍ مَحْفُوظة

অর্থ : “বস্তুত এটি সম্মানিত কুরআন । সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ ।” (সূরা আল-বুরুজ, আয়াত ২১-২২) আল-কুরআন মহান আল্লাহর বাণী । এটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও মহিমায় ভাস্বর। এটি পরিবর্তন, বিকৃতি, সংযোজন-বিয়োজন থেকে মুক্ত ও পবিত্র । এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ আসমানি কিতাব ।

 

 

 

আমরা পবিত্র কুরআনের মাহাত্ম্য অনুধাবন করব । ভক্তি ও সম্মান সহকারে আমরা কুরআন পাঠ করব এবং এর শিক্ষা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান লাভ করে তা আমাদের বাস্তব জীবনে কার্যকর করব । কুরআনই হবে আমাদের জীবন চলার পাথেয় ।

কাজ : ক. শিক্ষার্থীরা আসমানি কিতাবের বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটি তালিকা তৈরি করবে । 

খ. শিক্ষার্থীরা পবিত্র কুরআনের ১০টি নামের একটি তালিকা তৈরি করবে ।

পাঠ ১২

নৈতিক জীবন গঠনে আসমানি কিতাবের ভূমিকা

পথহারা ও পথভ্রষ্ট মানুষের হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তায়ালা নবি-রাসুলগণের মাধ্যমে যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তাই আসমানি কিতাব । আসমানি কিতাব হলো আল্লাহ তায়ালার বাণী ও বিধি-নিষেধের সমন্বিত গ্রন্থ । মানব জীবনকে নৈতিক ও আদর্শিক পথে পরিচালনা করতে আসমানি কিতাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।

আসমানি কিতাবগুলো মানুষকে আল্লাহ তায়ালার সত্তা, গুণাবলি, ক্ষমতা ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে। তাছাড়া মানুষ আসমানি কিতাবের বর্ণনা দ্বারা পরকাল, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞান ও পরিচয় জানতে পারে । এসব বিষয়ের জ্ঞান মানুষকে সত্য ও সুন্দর জীবন গঠনে অনুপ্রাণিত করে ।

আল্লাহ তায়ালা আসমানি কিতাবসমূহে বহু নবি-রাসুলের ঘটনাও বর্ণনা করেছেন । পাশাপাশি তাঁদের অনুসারী পুণ্যবান ও মুমিনদের সফলতার কাহিনীও তুলে ধরেছেন। আসমানি কিতাবের মাধ্যমে মানুষ এসব কাহিনী ও ঘটনা জানতে পারে । তাঁদের সফলতা ও সম্মানের মূল চাবিকাঠি হিসেবে নৈতিকতার গুরুত্ব বুঝতে পারে । ফলে মানুষ নৈতিক জীবন গঠনে উৎসাহিত হয় । নবি-রাসুলগণের ঘটনার পাশাপাশি আসমানি কিতাবসমূহে কাফির, মুশরিক ও পাপাচারীদের ঘটনাও বর্ণনা করা হয়েছে । এরূপ করা হয়েছে এজন্য যে, মানুষ যেন এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা লাভ করে । আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ আসমানি কিতাব আল-কুরআনে ফিরআউন, নমরূদ, কারুন প্রমুখ নাফরমানের ঘটনা বর্ণনা করেছেন । আদ, ছামুদ ইত্যাদি পাপাচারী জাতিসমূহের কথাও বর্ণনা করা হয়েছে । এ ছাড়াও আল্লাহ তায়ালার প্রতি অকৃতজ্ঞতা, অবাধ্যতা, গর্ব-অহংকার, পাপাচার, মিথ্যাচার, অনৈতিক ও অশ্লীল কার্যকলাপের দরুন তাদের শোচনীয় পরিণতির কথা আমরা আসমানি কিতাবের মাধ্যমেই জানতে পারি । এসব ঘটনা আমাদের অনৈতিক ও অন্যায় কার্যাবলি থেকে বিরত থাকতে এবং সৎ ও মানবিক জীবনযাপনে অনুপ্রাণিত করে ।

জ্ঞান বা শিক্ষা হলো এক প্রকার আলো । এটি মানুষের অন্তর চক্ষুকে খুলে দেয়। শিক্ষিত মানুষ ব্যর্থতার কারণ ও সফলতার সোপান সম্পর্কে অবগত থাকে । সুশিক্ষিত মানুষ নৈতিক ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী হয় এবং ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে শান্তি ও সফলতা লাভ করে থাকে। আসমানি কিতাব মূলত জ্ঞানের সর্বোত্তম উৎস । আসমানি কিতাব মানুষকে সবধরনের কল্যাণের পথনির্দেশ করে । আল-কুরআন

 

 

 

প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

ذلِكَ الْكِتَبُ لا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ )

অর্থ : “এটি সেই কিতাব যাতে কোনো সন্দেহ নেই । এটি মুত্তাকিদের জন্য পথনির্দেশক ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ০২)

আল-কুরআন হলো সকল জ্ঞানের আধার। মানবজীবনের প্রয়োজনীয় সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূলনীতি ও সারকথা এ গ্রন্থে নির্ভুলভাবে বর্ণিত হয়েছে । এভাবে আল-কুরআনের শিক্ষা মানুষকে সুশিক্ষিত করে তোলে ও নৈতিকতা বিকাশে সহায়তা করে ।

আসমানি কিতাবসমূহে মানুষকে নীতি-নৈতিকতার আদর্শ অনুসরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । এসব গ্রন্থে উন্নত আদর্শ ও সৎগুণাবলির নানা বিষয় অত্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে । পাশাপাশি যেসব কাজ ও অভ্যাসের দ্বারা নৈতিক জীবনাচরণ লঙ্ঘিত হয় সে সম্পর্কে সতর্ক ও নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে । তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল ইত্যাদি কিতাব পাঠ করলেও মানবিকতার বহু দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া যায় । পবিত্র কুরআন নাজিল হওয়ার পর থেকে অন্য কিতাবগুলোর কার্যকারিতা রহিত করা হয়েছে । সর্বোপরি আল-কুরআনে নীতি-নৈতিকতার পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা রয়েছে । এ কিতাব অনুসরণে জীবন পরিচালনা করলে মানব জীবন নীতি-নৈতিকতামণ্ডিত সুন্দর ও শান্তিময় হয় ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা নৈতিক জীবন গঠনে আসমানি কিতাবের ভূমিকা সম্পর্কে ১০টি বাক্য খাতায় লিখে শিক্ষককে দেখাবে।

পাঠ ১৩

আখিরাত

 

পরিচয়

আখিরাত অর্থ পরকাল । মানুষের মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে আখিরাত বলা হয় । মানবজীবনের দুটি পর্যায় রয়েছে । ইহকাল ও পরকাল । ইহকাল হলো দুনিয়ার জীবন । আর মৃত্যুর পরে মানুষের যে নতুন জীবন শুরু হয় তার নাম পরকাল বা আখিরাত ।

আখিরাত অনন্তকালের জীবন । এ জীবনের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। এটি মানুষের চিরস্থায়ী আবাস । আখিরাতে মানুষের দুনিয়ার কাজকর্মের হিসাব নেওয়া হবে । অতঃপর ভালো কাজের পুরস্কার স্বরূপ জান্নাত এবং মন্দ কাজের জন্য জাহান্নামের শাস্তি দেওয়া হবে ।

আখিরাতে বিশ্বাসের গুরুত্ব

আখিরাত ইমানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । ইসলামি জীবনদর্শনে আখিরাতে বিশ্বাস স্থাপন অপরিহার্য । এ বিশ্বাসের গুরুত্বও অপরিসীম । আখিরাতে বিশ্বাস ছাড়া মুমিন ও মুত্তাকি হওয়া যায় না । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

 

 

 

وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ

অর্থ : “আর তারা (মুত্তাকিগণ) আখিরাতে দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৪) 

তাওহিদ ও রিসালাতে বিশ্বাসের পাশাপাশি আখিরাতেও বিশ্বাস করা অত্যাবশ্যক । আখিরাতে বিশ্বাস না করলে কেউ মুমিন বা মুসলিম হতে পারে না । পরকালীন জীবনের সফলতা ও জান্নাত লাভ করার জন্যও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। আখিরাতে বিশ্বাস না করলে মানুষ সত্যপথ থেকে দূরে সরে যায়, পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَمَنْ يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَلًا بَعِيدًا

অর্থ : “আর কেউ আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসুলগণ এবং আখিরাত দিবসের প্রতি অবিশ্বাস করলে সে তো ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়বে ।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত ১৩৬)

আখিরাতে বিশ্বাস মানুষকে পাপ থেকে বিরত রাখে এবং পুণ্য কাজ করতে উৎসাহ যোগায় । কেননা আখিরাতে বিশ্বাসী ব্যক্তি জানে যে, পরকালে তাকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে, দুনিয়ার সব কাজকর্মের হিসাব দিতে হবে । ফলে বিশ্বাসী ব্যক্তি দুনিয়াতে সৎকাজে উৎসাহিত হয় এবং অসৎকাজ থেকে বিরত থাকে । এভাবে মানুষ অসৎচরিত্র বর্জন করে সৎচরিত্রবান হয়ে ওঠে । অপরদিকে আখিরাতে যে অবিশ্বাস করে সে সুযোগ পেলেই পাপাচার ও অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে । কেননা সে পরকালীন জবাবদিহিতে বিশ্বাসী নয় । এভাবে আখিরাতের প্রতি অবিশ্বাস মানবসমাজে অত্যাচার ও পাপাচার বৃদ্ধি করে । আখিরাতে বিশ্বাসী মানুষ কখনো পাপাচার ও অশ্লীল কাজে লিপ্ত হতে পারে না ।

অন্যদিকে, আখিরাতে বিশ্বাস মানবজীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এটি মানবজীবনকে কলুষমুক্ত, পবিত্র ও সুন্দর করে তোলে ।

অতএব, আমরা আখিরাতের প্রতি দৃঢ় ইমান আনব এবং আখিরাতে মুক্তির জন্য সৎ ও সুন্দর কাজ করব এবং ইসলামের বিধি-বিধান অনুসরণ করে জীবন-যাপন করব ।

পাঠ ১৪

আখিরাতের জীবনের কয়েকটি স্তর

আখিরাত হলো পরকাল । মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে আখিরাত বলে । এ জীবন চিরস্থায়ী ও অনন্ত । এ জীবনের কোনো শেষ নেই । আখিরাত বা পরকালের বেশ কয়েকটি স্তর বা পর্যায় রয়েছে। এ পাঠে আমরা সংক্ষেপে আখিরাতের বিভিন্ন স্তর বা পর্যায় সম্পর্কে জানব ।

ক. মৃত্যু

আখিরাত বা পরকালীন জীবনের শুরু হয় মৃত্যুর মাধ্যমে। সুতরাং মৃত্যু হলো পরকালের প্রবেশদ্বার।

 

 

 

আল্লাহ তায়ালা সকল প্রাণীর মৃত্যু নির্ধারণ করে রেখেছেন । তিনি বলেন-

كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ

অর্থ : “প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে । ”(সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৮৫) দুনিয়ার কোনো প্রাণীই মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাবে না । ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, সুস্থ-অসুস্থ, শাসক- শাসিত কেউই মৃত্যুকে এড়াতে পারবে না । যত বড় ক্ষমতাধারীই হোক আর যত সুরক্ষিত স্থানে বসবাস করুক সবার নির্দিষ্ট সময়ে মৃত্যু হবেই । এ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীরও মৃত্যু অনিবার্য । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

أَيْنَ مَا تَكُونُوا يُدْرِكُكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِي بُرُوجٍ مُّشَيَّدَةٍ

অর্থ : “তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই, এমনকি সুউচ্চ সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করলেও ।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত ৭৮)

মৃত্যুর সাথে সাথে আখিরাতের জীবন শুরু হয় । পুণ্যবান মানুষের মৃত্যু হয় আল্লাহ তায়ালার রহমতের সাথে । আর পাপীদের মৃত্যু খুব কষ্টকর হয় ।

খ. কবর

মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময়কে কবরের জীবন বলা হয় । এর অপর নাম বারযাখ । এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ

অর্থ : “আর তাদের সামনে বারযাখ থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত ।” (সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত ১০০)

দুনিয়াতে মানুষকে মৃত্যুর পর কবরস্থ করা হয় । এসময় মুনকার-নাকির নামক দুজন ফেরেশতা কবরে আসেন । তাঁরা মৃত ব্যক্তিকে তিনটি প্রশ্ন করেন । এগুলো হলো-

مَن رَّبِّكَ ؟ ا د

তোমার রব কে?

তোমার দীন কী?

- তোমার নবি কে? অথবা, je (রাসুল (স.) এর প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়) এই ব্যক্তি কে?

যাদের কবর দেওয়া হয় না তাদেরও এ প্রশ্ন করা হবে । দুনিয়াতে যারা ইসলাম অনুসারে জীবন পরিচালনা করবে তারা এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর দিতে পারবে। তাদের জন্য কবরের জীবন হবে শান্তিময় । আর যারা ইসলাম অনুসরণ করবে না তারা এসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না । তারা বলবে ‘আফসোস । আমি জানি না ।' কবরের জীবনে তারা কঠোর শাস্তি ভোগ করবে ।

 

 

গ. কিয়ামত

আকাইদ শাস্ত্রে কিয়ামত বলতে দুটি অবস্থাকে বোঝানো হয় ।

প্রথমত : কিয়ামত অর্থ মহাপ্রলয় । আল্লাহ তায়ালা এ গোটা বিশ্ব মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন । আর মানুষকে তাঁর ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন । কিন্তু এমন একদিন আসবে যখন গোটা বিশ্বে মহান আল্লাহর ইবাদত করার মতো কেউ থাকবে না । এমনকি আল্লাহ নাম নেওয়ার মতোও কাউকে পাওয়া যাবে না । সকল মানুষ গোমরাহি ও নাফরমানিতে লিপ্ত হয়ে পড়বে । সেসময় আল্লাহ তায়ালা এ পৃথিবী ধ্বংস করে দেবেন । তাঁর নির্দেশে হযরত ইসরাফিল (আ.) শিঙ্গায় ফুঁক দেবেন । ফলে চন্দ্র-সূর্য ও তারকারাজি খসে পড়বে, পাহাড় পর্বত তুলার ন্যায় উড়তে থাকবে, ভূগর্ভস্থ সবকিছু বের হয়ে যাবে, সকল প্রাণী মৃত্যু বরণ করবে এবং গোটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে । এ সময় শুধু আল্লাহ তায়ালা থাকবেন । আর কেউ বিদ্যমান থাকবে না । পৃথিবী ধ্বংসের এ মহাপ্রলয়ের নাম কিয়ামত ।

দ্বিতীয়ত : কিয়ামতের অন্য অর্থ দাঁড়ানো । পৃথিবী ধ্বংসের বহুদিন পর আল্লাহ তায়ালা আবার সকল জীব ও প্রাণীকে জীবিত করবেন । আল্লাহর নির্দেশে ইসরাফিল (আ.) পুনরায় শিঙ্গায় ফুঁক দেবেন । তখন মানুষ পুনরায় জীবিত হয়ে কবর থেকে উঠে হাশরের ময়দানে হিসাব নিকাশের জন্য সমবেত হবে । ঐ সময়ে কবর থেকে উঠে দাঁড়ানোকে বলা হয় কিয়ামত । একে ‘ইয়াওমুল’ বা ‘আছ’ বা পুনরুত্থান দিবসও বলা হয় । কিয়ামতের এ উভয়বিধ অবস্থা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ إِلَّا مَنْ شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ نُفِخَ فِيْهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ

ينظُرُونَ

অর্থ : “আর শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে । ফলে যাদের আল্লাহ ইচ্ছা করেন তারা ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সকলেই মূর্ছিত হয়ে পড়বে । অতঃপর আবার শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, তখনই তারা দণ্ডায়মান হয়ে তাকাতে থাকবে ।” (সূরা আয্-যুমার, আয়াত ৬৮)

ঘ. হাশর

হাশর হলো মহাসমাবেশ । আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে সকল মানুষ ও প্রাণীকুল মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হবে। সকলেই সেদিন একজন আহবানকারী ফেরেশতার ডাকে হাশরের ময়দানে সমবেত হবে । এ ময়দান বিশাল ও সুবিন্যস্ত । পৃথিবীর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল মানুষই সেদিন এ মাঠে একত্রিত হবে । মানুষের এ মহাসমাবেশকেই হাশর বলা হয় ।

হাশরের ময়দান হলো হিসাব নিকাশের দিন, জবাবদিহির দিন । এদিন আল্লাহ তায়ালা হবেন একমাত্র বিচারক । আল্লাহ তায়ালা বলেন- beauties

অর্থ : “তিনি (আল্লাহ) বিচার দিবসের মালিক ।” (সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত ৩)

সেদিন সকল মানুষের সমস্ত কাজকর্মের হিসাব নেওয়া হবে । হাশরের ময়দানে মানুষের আমলনামা দেওয়া হবে । যাঁরা পুণ্যবান তারা ডান হাতে আমলনামা লাভ করবেন । আর পাপীরা বাম হাতে আমলনামা পাবে।

 

 

হাশরের ময়দান ভীষণ কষ্টের স্থান। সেদিন সূর্য মাথার উপর একেবারে নিকটে থাকবে। মানুষ প্রচণ্ড তাপে ঘামতে থাকবে। সেদিন আল্লাহ তায়ালার আরশের ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না ।

সাত শ্রেণির লোক সেদিন আরশের ছায়াতলে স্থান পাবে। এদের মধ্যে একশ্রেণি হলো সেসব ব্যক্তি যে যৌবনকালে আল্লাহর ইবাদত করেছে। হাশরের ময়দানে পানীয় জলের কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। একমাত্র হাউজে কাউছারের পানি থাকবে। আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) সেদিন তাঁর খাটি উম্মতগণকে হাউজে কাউছার থেকে পানি পান করাবেন। পাপীরা সেদিন তৃষ্ণায় নিদারুণ কষ্ট ভোগ করবে ।

বস্তুত পুণ্যবানগণ হাশরের ময়দানে নানাবিধ সুবিধাজনক স্থান লাভে ধন্য হবেন। পক্ষান্তরে পাপীরা হাশরের ময়দানেই কঠোর শাস্তি ভোগ করবে ।

ঙ. মিযান

মিযান অর্থ পরিমাপক যন্ত্র বা দাঁড়িপাল্লা। হাশরের ময়দানে মানুষের আমলসমূহ ওজন করার জন্য আল্লাহ তায়ালা যে পাল্লা প্রতিষ্ঠা করবেন তাকে মিযান বলা হয় । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيمَةِ

অর্থ : “আর আমি কিয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করব।” (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ৪৭ )

মিযানের পাল্লায় মানুষের পাপ পুণ্য ওজন করা হবে। যার পুণ্যের পাল্লা ভারী হবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যার পাপের পাল্লা ভারী হবে সে হবে জাহান্নামি ।

চ. সিরাত

সিরাত এর শাব্দিক অর্থ পথ, রাস্তা, পুল, সেতু ইত্যাদি । ইসলামি শরিয়তের ভাষায় সিরাত হলো হাশরের ময়দান হতে জান্নাত পর্যন্ত জাহান্নামের উপর দিয়ে চলমান একটি উড়াল সেতু। (তিরমিযি)। এ সেতু পার হয়ে নেক আমলকারী বান্দা জান্নাতে প্রবেশ করবেন। আখিরাতে সকল মানুষকেই এ সেতুতে আরোহণ করে তা অতিক্রম করতে হবে। সিরাত সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, “এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তা অতিক্রম করবে, এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত।” (সূরা মারইয়াম, আয়াত ৭১)

এ সম্পর্কে মহানবি (স.) বলেন,

অর্থ : “জাহান্নামের উপর সিরাত স্থাপিত হবে।” (মুসনাদে আহমাদ)

নেক আমলকারী বান্দাগণকে মহান আল্লাহ জান্নাতে যাওয়ার অনুমতি দেবেন। জান্নাতিগণ সিরাতের উপর দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। নেককারদের জন্য তাঁদের আমল অনুসারে সিরাত প্রশস্ত হবে। ইমানদারগণ নিজ নিজ আমল অনুযায়ী সিরাত অতিক্রম করবেন। কেউ বিদ্যুৎগতিতে, কেউ ঝড়ের গতিতে, কেউ ঘোড়ার গতিতে, কেউবা দৌড়ের গতিতে, কেউ হেঁটে হেঁটে আবার কেউ কেউ হামাগুড়ি দিয়ে সিরাত পার হবেন।

 

 

 

সিরাত হলো অন্ধকার পুল । সেখানে মুমিন ও নেক আমলকারী ব্যক্তির জন্য আলোর ব্যবস্থা থাকবে । কিন্তু যারা ইমানদার নয় এবং পাপী তাদের জন্য কোনো আলোর ব্যবস্থা থাকবে না । সুতরাং দুনিয়ায় যে দৃঢ় ইমান ও বেশি নেক আমলের অধিকারী সিরাত তাঁর জন্য সবচেয়ে বেশি আলোকিত হবে । ইমানের আলোতে সে সহজেই সিরাত অতিক্রম করবে ।

অন্যদিকে যারা ইমানদার নয় এবং পাপী মহান আল্লাহ তাদের জাহান্নামে যাওয়ার নির্দেশ দেবেন । জাহান্নামিদের জন্য সিরাত অত্যন্ত ভয়াবহ স্থান । তাদের জন্য সিরাত হবে চুলের চাইতেও সূক্ষ্ম এবং তরবারি অপেক্ষা ধারালো । এ অবস্থায় সিরাতে আরোহণ করে তারা কিছুতেই তা অতিক্রম করতে পারবে না । বরং তারা করুণভাবে জাহান্নামে পতিত হবে ।

অতএব, আমরা সিরাতে বিশ্বাস স্থাপন করব । সহজে সিরাত অতিক্রম করার জন্য প্রকৃত ইমানদার হব এবং সকল প্রকার অন্যায় ও পাপ কাজ বর্জন করে অধিক পরিমাণে নেক আমল করব । মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করব ।

ছ. শাফাআত

শাফাআত শব্দের অর্থ সুপারিশ করা, অনুরোধ করা ইত্যাদি । ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় কল্যাণ ও ক্ষমার জন্য আল্লাহ তায়ালার নিকট নবি-রাসুল ও নেক বান্দাগণের সুপারিশ করাকে শাফাআত বলে ।

কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা মানুষের সকল কাজকর্মের হিসাব নেবেন । তারপর আমল অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য জান্নাত বা জাহান্নাম নির্ধারণ করবেন । তখন মহান আল্লাহ পুণ্যবানগণকে জান্নাতে ও পাপীদের জাহান্নামে যাওয়ার নির্দেশ দেবেন । নবি-রাসুল ও পুণ্যবান বান্দাগণ এ সময় আল্লাহর দরবারে শাফাআত করবেন । ফলে অনেক পাপীকে মাফ করা হবে । এরপর তাদেরকে জাহান্নাম থেকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে ।

আবার অনেক পুণ্যবানের জন্যও এদিন শাফাআত করা হবে । ফলে তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে । কিয়ামতের দিন সকল মানুষকে এক বিশাল ময়দানে সমবেত করা হবে। সেদিন সূর্য খুব নিকটবর্তী হবে । মানুষ অসহনীয় দুঃখ-কষ্টে নিপতিত থাকবে । এ সময় তারা হযরত আদম (আ.), হযরত নূহ (আ.), হযরত ইবরাহিম (আ.), হযরত মুসা (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.) এর নিকট উপস্থিত হয়ে হিসাব-নিকাশ শুরু করার জন্য আল্লাহর নিকট শাফাআত করতে অনুরোধ করবে । তাঁরা সকলেই অপারগতা প্রকাশ করবেন । এ অবস্থায় সকল মানুষ মহানবি (স.)-এর নিকট উপস্থিত হবে । তখন মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) আল্লাহ তায়ালার নিকট সুপারিশ করবেন ।

অন্যদিকে কিয়ামতের দিন পাপীদের ক্ষমা ও পুণ্যবানদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য শাফাআত করা হবে । নবি-রাসুল, ফেরেশতা, শহিদ, আলেম, হাফিয এ শাফাআতের সুযোগ পাবেন। আল-কুরআন ও সিয়াম (রোযা) কিয়ামতের দিন শাফাআত করবে বলেও হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে ।

কিয়ামতের দিন নবি-রাসুল ও নেক বান্দাগণ আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবেন । আল্লাহ তায়ালা এসব শাফাআত কবুল করবেন এবং বহু মানুষকে জান্নাত দান করবেন । তবে শাফাআতের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা থাকবে আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর অধিকারে । তিনি নিজেই বলেছেন- أعْطِيتُ الشَّفَاعَةَ

 

 

 

 

অর্থ : “আমাকে শাফাআত (করার অধিকার) দেওয়া হয়েছে ।” (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম) অন্য একটি হাদিসে রাসুল (স.) বলেছেন- “পৃথিবীতে যত ইট ও পাথর আছে, আমি তার চেয়েও বেশি লোকের জন্য কিয়ামতের দিন শাফাআত করব ।” (মুসনাদে আহমাদ)

শাফাআত একটি বিরাট নিয়ামত । মহানবি (স.)-এর শাফাআত ব্যতীত কিয়ামতের দিন সফলতা, কল্যাণ ও জান্নাত লাভ করা সম্ভব হবে না ।

অতএব, আমরা শাফাআতে বিশ্বাস স্থাপন করব । আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স.)-কে ভালোবাসব । আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স.)-এর আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী আমাদের জীবন পরিচালনা করব । তাহলে পরকালে আমরা প্রিয়নবি (স.)-এর শাফাআত লাভে ধন্য হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব ।

জ. জান্নাত

জান্নাত অর্থ উদ্যান, বাগান, সুশোভিত কানন । ইসলামি পরিভাষায় পরকালীন জীবনে পুণ্যবানগণের জন্য পুরস্কার স্বরূপ যে আরামদায়ক স্থান তৈরি করে রাখা হয়েছে তাকে বলা হয় জান্নাত ।

জান্নাতে সবধরনের নিয়ামত বিদ্যমান । মুমিনগণ সেখানে চিরকাল অবস্থান করবেন । তাঁরা সেখানে তাঁদের পুণ্যবান মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে মিলিত হবেন। তাঁরা যা চাইবেন তাই সাথে সাথে লাভ করবেন । আল্লাহ তায়ালা বলেন, “সেখানে (জান্নাতে) তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমাদের মন চায় এবং সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা তোমরা ফরমায়েশ কর । এটি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ থেকে আপ্যায়ন ।” (সূরা হা-মিম আস-সাজদা, আয়াত ৩১-৩২)

বস্তুত জান্নাতের সুখ-শান্তি ও নিয়ামত অফুরন্ত । এর বর্ণনা শেষ করা যায় না । একটি হাদিসে কুদসিতে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “আমি আমার নেক বান্দাদের জন্য (জান্নাতে) এমন সব নিয়ামত প্রস্তুত করে রেখেছি যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান কোনোদিন তা শুনেনি এবং কোনো মানব হৃদয় কখনো কল্পনাও করতে পারেনি।” (সহিহ বুখারি)

আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের জন্য আটটি জান্নাত তৈরি করে রেখেছেন । এগুলো হলো- (১) জান্নাতুল ফিরদাউস, (২) দারুল মাকাম, (৩) দারুল কারার, (৪) দারুস্স্সালাম, (৫) জান্নাতুল মাওয়া, (৬) জান্নাতুল আদন, (৭) দারুন নাইম ও (৮) দারুল খুলদ ।

জান্নাত চরম সুখের আবাস । দুনিয়াতে যারা ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করে চলবে তারা পরকালে জান্নাত লাভ করবে । সকল কাজকর্মে আল্লাহ তায়ালার আদেশ ও রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সুন্নাহ অনুসরণ করলে জান্নাত লাভ করা সম্ভব হবে । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى لَ فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى

অর্থ : “আর যে ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে জান্নাতই হবে তার আবাস ।” (সূরা আন-নাযিআত, আয়াত ৪০-৪১)

 

 

 

সুতরাং আমরাও জান্নাত লাভের জন্য সদা সর্বদা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করব, তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলব, অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে নিজেকে রক্ষা করে উত্তম চরিত্র গঠন করব । তাহলে মহান আল্লাহ আমাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন, আমরা পরকালে জান্নাত লাভ করব ।

ঝ. জাহান্নাম

জাহান্নাম হলো শাস্তির স্থান । পরকালে মুমিনগণের জন্য যেমন জান্নাতের ব্যবস্থা রয়েছে তেমনি পাপীদের জন্য রয়েছে শাস্তির স্থান । আর জাহান্নামই হলো সে শাস্তির জায়গা । জাহান্নামকে (নার) বা আগুন ও বলা হয় ।

জাহান্নাম চির শাস্তির স্থান । এর শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ । মানুষের পাপের পরিমাণ অনুসারে শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে । জাহান্নামের আগুন অত্যন্ত উত্তপ্ত । রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন-

نَارُكُمْ جُزءٍ مِنْ سَبْعِينَ جُزْءًا مِنْ نَارِ جَهَنَّمَ

অর্থ : “তোমাদের এ পৃথিবীর আগুন জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের এক ভাগ মাত্র ।” (সহিহ বুখারি

এ আগুনে মানুষের হাড়, চামড়া, গোশত সবকিছুই পুড়ে যাবে । কিন্তু তাতে তার মৃত্যু হবে না । বরং আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে পুনরায় তার দেহ পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে। পুনরায় তা পুড়ে দগ্ধ হবে । এভাবে পুনঃপুনঃ চলতে থাকবে ।

জাহান্নাম বিষাক্ত সাপ, বিচ্ছুর আবাসস্থল। সেখানকার খাদ্য হলো বড় বড় কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ । উত্তপ্ত রক্ত ও পুঁজ হবে জাহান্নামিদের পানীয় । মোটকথা জাহান্নাম অতি যন্ত্রণাদায়ক স্থান । আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা কুফরি করে তাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে আগুনের পোশাক, তাদের মাথার উপর ঢেলে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি, ফলে তাতে তাদের পেটে যা আছে তা এবং তাদের চামড়া বিগলিত হয়ে যাবে, আর তাদের জন্য থাকবে লৌহমুদ্গর । যখনই তারা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে জাহান্নাম থেকে বের হতে চাইবে তখনই তাদেরকে তাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে । আর তাদের বলা হবে, আস্বাদন কর দহন-যন্ত্রণা ।” (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত ১৯-২২ )

পাপীদের শাস্তি দানের জন্য আল্লাহ তায়ালা ৭টি দোযখ তৈরি করে রেখেছেন । এগুলো হলো- (১) জাহান্নাম, (২) হাবিয়া, (৩) জাহিম, (৪) সাকার, (৫) সাইর, (৬) হুতামাহ এবং (৭) লাযা । জাহান্নাম হলো ভীষণ শাস্তির স্থান । কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকরা তথায় চিরকাল শাস্তি ভোগ করবে । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

فَأَمَّا مَنْ طَغَى وَأَثَرَ الْحَيَوةَ الدُّنْيَا فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَى

(সূরা আন- নাযিআত, আয়াত ৩৭-৩৯)

অর্থ : “অনন্তর যে সীমালঙ্ঘন করে এবং দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দেয় জাহান্নামই হবে তার আবাস।”

 

 

 

যাদের ইমান রয়েছে কিন্তু পাপের পরিমাণ বেশি এমন মুমিনরাও জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে । তবে তাদের পাপের শাস্তি শেষ হওয়ার পর তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে ।

আমরা সব রকম পাপ থেকে মুক্ত থাকব । খাঁটি ইমানদার হব । আল্লাহ ও তাঁর রাসুল হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর আনুগত্য করব । তাহলেই জাহান্নামের আগুন ও শাস্তি থেকে আমরা রেহাই পাব ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা আখিরাতের জীবনের স্তরগুলোর একটি তালিকা তৈরি করবে ।

পাঠ ১৫

সৎকর্মশীল ও নৈতিকজীবন গঠনে আখিরাতে বিশ্বাসের ভূমিকা

আখিরাত হলো পরকাল । মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে আখিরাত বলা হয় । আখিরাত হলো মানুষের অনন্ত জীবন । এটি চিরস্থায়ী । পক্ষান্তরে দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী । বস্তুত দুনিয়ার জীবন হলো আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্র । বলা হয়েছে- الدُّنْيَا مَزْرَعَةُ الْآخِرَةِ

অর্থ : “দুনিয়া হলো আখিরাতের শস্যক্ষেত্র । ” (প্রবাদ)

মানুষ শস্যক্ষেত্রে যেরূপ চাষাবাদ করে, বীজ বপন করে, যেভাবে পরিচর্যা করে; ঠিক সেরূপই ফল লাভ করে । যদি কোনো ব্যক্তি তার শস্যক্ষেত্রের পরিচর্যা না করে তবে সে ভালো ফসল লাভ করে না । তদ্রূপ দুনিয়ার কাজকর্মের প্রতিদান আখিরাতে দেওয়া হবে । দুনিয়াতে ভালো কাজ করলে আখিরাতে মানুষ পুরস্কৃত হবে । আর মন্দ কাজ করলে শাস্তি ভোগ করবে ।

কবর, হাশর, মিযান, সিরাত, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি আখিরাত জীবনের এক একটি পর্যায় । ইসলামি বিশ্বাস মোতাবেক, যে ব্যক্তি ইমান আনে, সৎকর্ম করে সে আখিরাতে শান্তিময় জীবন লাভ করবে । কবর থেকে শুরু করে আখিরাতের প্রতিটি পর্যায়ে সে সুখ, শান্তি ও সফলতা লাভ করবে। অন্যদিকে দুনিয়াতে যে ব্যক্তি অবাধ্য হবে, পাপাচার করবে সে আখিরাতের সকল পর্যায়ে কষ্ট ভোগ করবে । তার স্থান হবে জাহান্নাম ।

মানবজীবন গঠনের জন্য আখিরাতে বিশ্বাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । কেননা আখিরাতে বিশ্বাস মানুষকে জীবন পরিচালনায় নীতি ও আদর্শের অনুসরণ করতে বাধ্য করে । যে ব্যক্তি আখিরাতে বিশ্বাস করে সে প্রত্যহ তার প্রতিটি কাজের হিসাব নিজেই নিয়ে থাকে। এভাবে দৈনন্দিন আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষ তার ভুল-ত্রুটি শোধরিয়ে নিয়ে সৎচরিত্রবান হিসেবে গড়ে ওঠে ।

 

 

 

আখিরাতে পুণ্যবানকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করানো হবে । জান্নাত হলো চিরশান্তির স্থান । জান্নাত লাভের আশা মানুষকে দুনিয়ার জীবনে সৎকর্মশীল করে তোলে । মানুষ জান্নাত ও তার নিয়ামত প্রাপ্তির আশায় নেক আমল করে, ভালো কাজ করতে উৎসাহিত হয় । কেননা আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা ও সৎকর্ম ব্যতীত জান্নাত লাভ করা যায় না । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّلِحَتِ لَهُمْ جَنَّتْ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَشْهُرُ : ذَلِكَ الْفَوْزُ الْكَبِيرُة

অর্থ : “নিশ্চয়ই যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত যার নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত । এটাই মহাসাফল্য ।” (সূরা আল-বুরূজ, আয়াত ১১)

এভাবে পরকালীন জীবনে জান্নাত লাভের আশা মানুষকে সৎকর্মশীল হতে সাহায্য করে ।

জাহান্নাম অতি কষ্টের স্থান । এতে রয়েছে সাপ, বিচ্ছু ও আগুনের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি । দুনিয়ার জীবনের পাপী, অবাধ্য ও মন্দ আচরণের লোকদের পরকালে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

فَأَمَّا مَنْ طَغَى وَأَثَرَ الْحَيَوةَ الدُّنْيَا فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَى

অর্থ : “অনন্তর যে সীমালঙ্ঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দেয় জাহান্নামই হবে তার আবাস ।” (সূরা আন-নাযিআত, আয়াত ৩৭-৩৯)

জাহান্নামের শাস্তির ভয়ও মানুষকে অন্যায় ও পাপ থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করে । দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালার আদেশ না মানা, পার্থিব লোভ লালসার বশবর্তী হয়ে অন্যায় অনৈতিক কাজ করা ইত্যাদি জাহান্নামিদের কাজ । সুতরাং জাহান্নামের ভয়ে মানুষ এসব কাজ থেকে বেঁচে থাকে এবং আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করে ।

আখিরাতে বিশ্বাস মানুষকে বড় বড় অন্যায় এবং অনৈতিক কাজের পাশাপাশি ছোট ছোট পাপ ও অসৎ কাজ থেকেও বিরত রাখে । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُهُ

অর্থ : “কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলেও তা সে দেখতে পাবে । আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও সে দেখবে ।” (সূরা আল-যিলযাল, আয়াত ৭-৮)

 

 

 

 

ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা

আল্লাহ তায়ালা পরকালে মানুষের সামান্যতম ভালো বা মন্দ কাজ সবই প্রদর্শন করবেন । অতঃপর এগুলোর পুরস্কার বা শাস্তি দেওয়া হবে । সুতরাং আখিরাতে বিশ্বাস মানুষকে ছোট-বড়, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব ধরনের অন্যায় থেকে বিরত রাখে এবং পাপমুক্ত, সৎকর্মশীল ও নৈতিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করে ।

আমরা আখিরাতে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করব এবং এ বিশ্বাসের আলোকে ইহকালে আমাদের জীবনকে পাপমুক্ত রাখব, সৎকর্মশীল হব এবং নৈতিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হব ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা ‘সৎকর্মশীল হতে ও নৈতিক জীবন গঠনে আখিরাতে বিশ্বাসের ভূমিকা' সম্পর্কে ১০টি বাক্য লিখে শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে ।

 

 

নমুনা প্রশ্ন

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১. ইসলামের মূল বিষয়গুলোর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসকে কী বলা হয়?

ক. ইমান

খ. ইসলাম

গ. ইহসান

ঘ. ইনসাফ

‘আলহিকমাতু’ শব্দের অর্থ কী ?

ক. উপদেশ

খ. প্রজ্ঞা

গ. জ্যোতি

ঘ. অনুগ্রহ

৩. মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্ব নিম্নস্তরে অবস্থান করবে, কারণ তারা-

i. সমাজে চিহ্নিত মানুষ

ii. অন্তরে কুফর লুকিয়ে রাখে

iii. কাফিরদের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i ও ii

খ. i ও iii

গ. ii ও iii

ঘ. i, ii ও iii

 

 

নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং ৪ ও ৫ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও

পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে সূর্যের উদয় ও অস্ত যাওয়ার পদ্ধতি একই নিয়মে চলে আসছে। এ অবস্থা দেখে সুলতান সাহেব বিশ্বাস করেন, পৃথিবী কখনোই ধ্বংস হবে না ।

৪. সুলতান সাহেব আখিরাতের কোন বিষয়টিকে অস্বীকার করেন ?

ক. কবর

খ. হাশর

গ. কিয়ামত

ঘ. মিযান

৫. সুলতান সাহেবের ধারণার ফলে, তাকে বলা যায়-

ক. কাফির

খ. মুশরিক

গ. ফাসিক

ঘ. মুনাফিক

 

সৃজনশীল প্রশ্ন

১. ফরিদ ও সেলিম দুই বন্ধু। তারা উভয়ে একটি দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে গেল। ফরিদ সেখানে মাটির তৈরি মূর্তি ও পাথরের কারুকার্যের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সিজদাহ করার মত মাথানত করে সম্মান প্রদর্শন করে। এরপর উভয়ে কেন্টিনে নাস্তা করার এক পর্যায়ে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। সেলিম মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন নবী রাসূলগণের আগমনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকাই যুক্তিযুক্ত।

ক. ইসলাম এর ব্যবহারিক অর্থ কী ?

খ.  আখিরাতে বিশ্বাস করা অপরিহার্য কেন ? ব্যাখ্যা কর । 

গ. ফরিদের আচরণে যে বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে তা ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. নবী রাসূলগণের আগমন বিষয়ে সেলিমের বক্তব্যের যথার্থতা নিরূপণ কর ।

২. প্রেক্ষাপট-১

আদ্যক্ষর সু নামক প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তার পেশাগত প্রশিক্ষণ, এমনকি ডিপ্লোমা সনদ নেই । তারপরও তারা চিকিৎসক ও সেবিকা সেজে স্পর্শকাতর পরীক্ষা চালাচ্ছেন ও লোকজনকে

টিকা দিচ্ছেন । এই সুযোগে তারা হাজার হাজার টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন । (সংক্ষেপিত : প্ৰথম আলো, ০৫ জুলাই ২০১২)

 

প্রেক্ষাপট-২

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার এভাবে বাড়তে থাকলে খুব শীঘ্রই মানবজাতি জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রাণরক্ষার যুদ্ধে পরাস্ত হবে । গৃহপালিত পশুপাখিকে রোগমুক্ত রেখে কম সময়ে অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের অবাধ ব্যবহার হয়ে আসছে । পোলট্রিতে উৎপাদন বাড়াতে অর্থাৎ পোলট্রির দৈহিক বৃদ্ধির জন্য অনেক খামারি গ্রোথ প্রোমোটার হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে । যা হৃদরোগীর জন্য খুবই ক্ষতিকর । (সংক্ষেপিত : যুগান্তর ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১২)

ক. আল্লাহর নিকট একমাত্র জীবন ব্যবস্থা কী?

খ. ‘তাওহিদের স্বরূপ' ব্যাখ্যা কর ।

গ. ১ নম্বর প্রেক্ষাপটে কোন বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে? পাঠ্যপুস্তকের আলোকে ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. ২ নম্বর প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি ফুটে ওঠে, তা ‘সৎকর্মশীল হতে ও নৈতিক জীবন গঠনে আখিরাতে বিশ্বাসের ভূমিকা'র আলোকে বিশ্লেষণ কর ।

 

 


ADDED&UPDATED

দ্বিতীয় অধ্যায়

শরিয়তের উৎস

ইসলাম শুধু একটি ধর্মই নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা । এটি সর্বজনীন ও সর্বকালীন বিধি-বিধানের সমষ্টি । বিশ্বাসগত বিষয়গুলোর পাশাপাশি মানবজীবনের আচরণগত সম... ্ত দিকও ইসলামে আলোচনা করা হয়েছে । আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির সার্বিক কল্যাণের জন্য নানা বিধি-বিধান ও আচার-আচরণগত দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন । মহান আল্লাহ প্রদত্ত এসব বিধি-বিধানকেই শরিয়ত বলা হয় । আল্লাহ তায়ালা ও মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) -এর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা, সকল কাজে তাঁদের আনুগত্য করা, শরিয়তের অন্যতম দাবি । এগুলোর পরিপূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক সফলতা লাভ করা যায় । এ অধ্যায়ে আমরা ইসলামি শরিয়তের পরিচয় ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানব । পাশাপাশি শরিয়তের উৎসগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা লাভ করব । এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-

  • শরিয়ত ও শরিয়তের উৎসের ধারণা এবং প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করতে পারব;
  • কুরআন ও হাদিসের সংরক্ষণ ও সংকলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করতে পারব;
  • মক্কি ও মাদানি সূরার সংখ্যা ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে পারব;
  • কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে পারব; নির্বাচিত সূরাগুলো শুদ্ধভাবে মুখস্থ বলতে পারব;
  • নির্বাচিত সূরাগুলোর অর্থ ও পটভূমিসহ (শানে নুযুল) শিক্ষা বর্ণনা করতে পারব;
  • কুরআনের নির্বাচিত সূরাগুলোর শিক্ষা নিজ জীবনে প্রয়োগে উদ্বুদ্ধ হব;
  • নির্বাচিত দশটি হাদিসের অর্থ ও শিক্ষা বর্ণনা করতে পারব;
  • ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অর্জনের ক্ষেত্রে হাদিসের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব;
  • নির্বাচিত হাদিসসমূহের শিক্ষার আলোকে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জীবন গঠনে অনুপ্রাণিত হব;
  • ইজমা এর পরিচয় ও উৎপত্তি সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারব;
  • কিয়াস এর ধরন বর্ণনা করতে পারব;
  • শরিয়তের বিভিন্ন পরিভাষা সম্পর্কে আলোচনা করতে পারব ।

পাঠ ১

পরিচয়

শরিয়ত

শরিয়ত আরবি শব্দ । এর অর্থ পথ, রাস্তা । এটি জীবনপদ্ধতি, আইন-কানুন, বিধি-বিধান অর্থেও ব্যবহৃত হয় । ব্যাপক অর্থে শরিয়ত হলো এমন সুদৃঢ় ও সুস্পষ্ট পথ, যা অনুসরণ করলে মানুষ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে নিজ

 

 

 

গন্তব্যে পৌছতে পারে । ইসলামি পরিভাষায় ইসলামি কার্যনীতি বা জীবনপদ্ধতিকে শরিয়ত বলা হয় । অন্যকথায়, ইসলামি আইন-কানুন বা বিধি-বিধানকে একত্রে শরিয়ত বলা হয় । অর্থাৎ মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স.) যেসব আদেশ-নিষেধ ও পথনির্দেশনা মানুষকে জীবন পরিচালনার জন্য প্রদান করেছেন তাকে শরিয়ত বলে । শরিয়ত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

ثُمَّ جَعَلْنَكَ عَلَى شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ

অর্থ : “অতঃপর আমি আপনাকে শরিয়তের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছি । সুতরাং আপনি তার অনুসরণ করুন। আর আপনি অজ্ঞদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করবেন না ।” (সূরা আল-জাসিয়া, আয়াত ১৮) শরিয়তের বিষয়বস্তু ও পরিধি

শরিয়তের বিষয়বস্তু ও পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক । এটি হলো মানবজাতির জন্য সার্বিক ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা।

মানব জীবনের সকল বিষয়ের বিধি-বিধান ও নির্দেশনা এতে বিদ্যমান । এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا

অর্থ : “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামত

পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দীন হিসেবে মনোনীত করলাম ।” (সূরা আল-মায়িদা,

আয়াত ৩)

সুতরাং বোঝা গেল যে, ইসলামি শরিয়তের বিষয়বস্তু ও পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। মুসলিম মনীষীগণ শরিয়তের বিষয়বস্তুকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন । যথা-

ক. আকিদা বা বিশ্বাসগত বিধি-বিধান ।

খ. নৈতিকতা ও চরিত্র সংক্রান্ত রীতি-নীতি ।

গ. বাস্তব কাজকর্ম সংক্রান্ত নিয়মকানুন ।

বস্তুত মানুষের সবধরনের আচার-আচরণ, চিন্তা-চেতনা উপরিউক্ত তিনটি বিষয়ের আওতাভুক্ত । ফলে মানুষের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সকল কাজই শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত । শরিয়তের নির্দেশনার বাইরে কোনো কাজই নেই ।

শরিয়তের গুরুত্ব

মানবজীবনে শরিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম । শরিয়ত হলো মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রদত্ত আদেশ-ি গ-নিষেধ ও বিধি- বিধান । সুতরাং শরিয়ত মেনে চললে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুল খুশি হন । অন্যদিকে, শরিয়ত অস্বীকার করা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুলকে অস্বীকার করার নামান্তর । কোনো মুসলমান এরূপ কাজ করতে পারে না। এমনকি শরিয়তের এক অংশ পালন করা আর অন্য অংশ অস্বীকার করাও মারাত্মক

 

 

 

 

পাপ (কুফর) । যে ব্যক্তি এরূপ করে তার জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে । আল্লাহ তায়ালা বলেন, কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস কর, আর কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান কর? তোমাদের যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল হলো পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা । আর কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৮৫) “তবে

শরিয়ত হলো জীবন পরিচালনার দিকনির্দেশনা। এর দ্বারা জীবনের নানা ক্ষেত্রে ইসলামি বিধি-নিষেধ জানা যায় ।

কোনটি হালাল, কোনটি হারাম ইত্যাদি জানা যায় । ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞানও শরিয়তের শিক্ষার মাধ্যমেই লাভ করা যায় । উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতার নানা শিক্ষাও শরিয়তে বিবৃত রয়েছে । সুতরাং সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে জীবন পরিচালনার জন্য শরিয়ত অপরিহার্য ।

তাছাড়া শরিয়ত আমাদের ইবাদতের পদ্ধতি ও নিয়ম-কানুন শিক্ষা দেয়। সালাত, যাকাত, সাওম, হজ ইত্যাদি কীভাবে, কোথায়, কোন সময়ে আদায় করতে হয় তাও শরিয়তের বর্ণনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি । আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনের উপায়, পারিবারিক ও সামাজিক সম্প্রীতি ইত্যাদিও শরিয়তের আওতাভুক্ত । অতএব, মানুষের সার্বিক জীবনাচরণে শরিয়তের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

শরিয়তের উৎসসমূহ

শরিয়ত হলো ইসলামি জীবনপদ্ধতি । এটি আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুলের আদেশ-নিষেধ ও দিকনির্দেশনার সমষ্টি । অতএব, শরিয়ত এর প্রধান উৎস দুটি । যথা- আল-কুরআন ও আল-হাদিস বা সুন্নাহ ।

পরবর্তীতে কুরআন ও সুন্নাহ এর স্বীকৃতি ও নির্দেশনার ভিত্তিতে শরিয়তের আরও দুটি উৎস নির্ধারণ করা

হয় । এগুলো হলো ইজমা ও কিয়াস । সুতরাং আমরা বলতে পারি- শরিয়ত এর উৎস চারটি । যথা-

১. আল-কুরআন (الْقُرْآنُ)

২. সুন্নাহ 

৩. ইজমা 

৪. কিয়াস 

আমরা পর্যায়ক্রমে শরিয়তের এ চারটি উৎস সম্পর্কে জানব ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা ইসলামি শরিয়তের পরিচয় ও গুরুত্ব সম্পর্কে ১০টি বাক্য নিজ খাতায় বাড়ি থেকে লিখে এনে শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করবে।

 

 

 

পাঠ ২

শরিয়তের প্রথম উৎস : আল-কুরআন

শরিয়তের সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান উৎস হলো আল-কুরআন । ইসলামি শরিয়তের সকল বিধি-বিধানের মূল উৎসই আল- কুরআন । এর উপরই ইসলামি শরিয়তের ভিত্তি ও কাঠামো প্রতিষ্ঠিত । আল-কুরআন শরিয়তের অকাট্য ও প্রামাণ্য দলিল। মানব জীবনের প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ের সমাধানসূচক মূলনীতি ও ইঙ্গিত আল-কুরআনে বিদ্যমান। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَبَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ

অর্থ : “আমি আপনার প্রতি কিতাব নাজিল করেছি প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ ।” (সূরা আন-নাহল, আয়াত ৮৯)

আল-কুরআন আল্লাহ তায়ালার পবিত্র বাণী । এটি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব । আল্লাহ তায়ালা হযরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর উপর এ কিতাব নাজিল করেন । এ কিতাব আরবি ভাষায় নাজিলকৃত । ইসলামি শরিয়তের প্রধান উৎস হিসেবে আল-কুরআনে মানবজাতির জীবন পরিচালনার সুস্পষ্ট মূলনীতি ও নির্দেশনা বিদ্যমান । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَلَقَدْ صَرَفْنَا لِلنَّاسِ فِي هَذَا الْقُرْآنِ مِنْ كُلِّ مَثَلٍ ن

অর্থ : “আর অবশ্যই আমি মানুষের জন্য এ কুরআনে বিভিন্ন উপমা বিশদভাবে বর্ণনা করেছি ।” (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৮৯)

কুরআন মজিদ সহজ ও সাবলীল ভাষায় নাজিলকৃত । এতে কোনোরূপ অস্পষ্টতা, বক্রতা, কিংবা জটিলতা নেই । বরং এতে খুবই সুন্দর ও সরল ভাষায় নানা বিষয়ের বর্ণনা করা হয়েছে । অতি সাধারণ মানুষও এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

فَإِنَّمَا يَشَرْنَهُ بِلِسَانِكَ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ

অর্থ : “আমি তো কুরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে ।” (সূরা আদ-দুখান, আয়াত ৫৮)

অবতরণ

আল-কুরআন আল্লাহ তায়ালার কালাম । এটি 'লাওহে মাহফুজ' বা সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ । এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

بَلْ هُوَ قُرْآنٌ مَّجِيدٌ هُ فِي لَوْحٍ مَّحْفُوظة

অর্থ : “বস্তুত এটি সম্মানিত কুরআন । সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ ।” (সূরা আল-বুরূজ, আয়াত ২১-২২)

 

 

 

 

আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম কদরের রাতে গোটা কুরআন মজিদ লাওহে মাহফুজ থেকে ‘বায়তুল ইযযাহ’ নামক স্থানে নাজিল করেন । বায়তুল ইযযাহ হলো প্রথম আসমানের একটি বিশেষ স্থান ।

মহানবি (স.) হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় মহান আল্লাহর নির্দেশে জিবরাইল (আ.) আল-কুরআনের সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নিয়ে তথায় মহানবি (স.)-এর নিকট অবতরণ করেন । এটাই ছিল দুনিয়াতে আল-কুরআনের প্রথম নাজিলের ঘটনা। এরপর বিভিন্ন সময় ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে মহানবি (স.)-এর প্রতি কুরআন নাজিল হয় ।

এভাবে মহানবি (স.)-এর জীবদ্দশায় মোট ২৩ বছরে সম্পূর্ণ কুরআন নাজিল হয় । এটি একসাথে নাজিল হয়নি । বরং অল্প অল্প করে প্রয়োজনানুসারে নাজিল হতো । কখনো ৫ আয়াত, কখনো ১০ আয়াত, কখনো আয়াতের অংশবিশেষ, আবার কখনো একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা একসাথে নাজিল হতো । আল্লাহ তায়ালা এ প্রসঙ্গে বলেন-

وَقُرْ انَّا فَرَقْنَهُ لِتَقْرَاهُ عَلَى النَّاسِ عَلَى مُكْثٍ وَنَزَّلْنَهُ تَنْزِيلًاه

অর্থ : “আর আমি খণ্ড-খণ্ডভাবে কুরআন নাজিল করেছি যাতে আপনি তা মানুষের নিকট ক্রমে ক্রমে পাঠ করতে পারেন আর আমি তা ক্রমশ নাজিল করেছি ।” (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ১০৬)

অন্যান্য আসমানি কিতাবের ন্যায় আল-কুরআন একসাথে নাজিল করা হয়নি । তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল ইত্যাদি একসাথে পূর্ণাঙ্গ আকারে নাজিল করা হয়েছিল। কিন্তু আল-কুরআন এর ব্যতিক্রম । এটি আল-কুরআনের বিশেষ মর্যাদার পরিচায়ক । মক্কার কাফিররা এ সম্পর্কে রাসুল (স.)-কে প্রশ্ন করলে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “কাফিররা বলে, তাঁর উপর সমগ্র কুরআন একবারে অবতীর্ণ হলো না কেন? আমি এভাবেই অবতীর্ণ করেছি আপনার হৃদয়কে তার দ্বারা মজবুত করার জন্য এবং আমি তা ক্রমে ক্রমে স্পষ্টভাবে আবৃত্তি করেছি ।” (সূরা আল-ফুরকান, আয়াত ৩২)

আল-কুরআন আল্লাহ তায়ালার বাণী । জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা অল্প অল্প করে মহানবি (স.)-এর ২৩ বছরের নবুওয়াতি জীবনে পূর্ণরূপে নাজিল করেন ।

পাঠ ৩

আল-কুরআন সংরক্ষণ ও সংকলন

আল-কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ আসমানি কিতাব । কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল মানুষের সার্বিক জীবনবিধান ও দিকনির্দেশনা এতে বিদ্যমান । সুতরাং এর সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । মহান আল্লাহ স্বয়ং এর সংরক্ষণের ভার গ্রহণ করেছেন । তিনি ঘোষণা করেন-

انا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِكرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَفِظُونَ

অর্থ : “আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্য আমিই এর সংরক্ষক ।” (সূরা আল-হিজর, আয়াত ৯)

 

 

 

 

আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং আল-কুরআনের সংরক্ষক । তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ কিতাব সংরক্ষণ করেন । এজন্যই আজ পর্যন্ত এ কিতাবের একটি হরফ (অক্ষর), হরকত বা নুকতারও পরিবর্তন হয়নি । এটি যেভাবে নাজিল হয়েছিল আজও ঠিক সেভাবেই বিদ্যমান । আর কিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত থাকবে ।

আল-কুরআন সংরক্ষণ

আল-কুরআন আরব দেশে মহানবি (স.)-এর উপর নাজিল হয় । এ সময় মহানবি (স.) সাথে সাথে নাজিলকৃত আয়াত মুখস্থ করে নিতেন । এরপর বারবার তিলাওয়াতের মাধ্যমে তা স্মৃতিতে ধরে রাখতে চেষ্টা করতেন । আল-কুরআন মুখস্থকরণে রাসুল (স.)-এর দ্রুতপাঠ ও ব্যাকুলতা দেখে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সান্ত্বনা দেন । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

لا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلْ بِهِ أَ إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ 8

অর্থ : “তাড়াতাড়ি ওহি আয়ত্ত করার জন্য আপনি দ্রুত আপনার জিহ্বা তাঁর সাথে সঞ্চালন করবেন না ।:

এটা সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমারই ।” (সূরা আল-কিয়ামাহ, আয়াত ১৬-১৭) এরপর রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ব্যাকুলতা দূরীভূত হয় এবং তিনি সহজেই কুরআনের আয়াতগুলো মুখস্থ

করে সংরক্ষণ করতে লাগলেন ।

আল-কুরআন নাজিল হলে রাসুলুল্লাহ (স.) সাহাবিগণকেও তা মুখস্থ করতে বলতেন । সাহাবিগণ তা মুখস্থ করতেন, দিনরাত তিলাওয়াত করতেন, নামাযে পাঠ করতেন এবং পরিবার-পরিজন, স্ত্রী-সন্তান ও বন্ধু-বান্ধবদেরও মুখস্থ করাতেন । গভীর রাতে তাঁদের ঘর থেকে কুরআন তিলাওয়াতের গুনগুন আওয়াজ শোনা যেত । অনেক সময় রাসুলুল্লাহ (স.) স্বয়ং তাঁদের গৃহপার্শ্বে গিয়ে তিলাওয়াত শুনতেন ।

কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দেওয়ার জন্য নবি করিম (স.) সাহাবিগণকে নানা স্থানে প্রেরণ করতেন । যেমন হিজরতের পূর্বে তিনি হযরত মুসআব ইবনে উমায়র (রা.) ও আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)-কে কুরআন শিক্ষাদানের জন্য মদিনায় প্রেরণ করেন ।

এভাবে মুখস্থ করার মাধ্যমে আল-কুরআন সর্বপ্রথম সংরক্ষণ করা হয় । উল্লেখ্য, তৎকালীন আরবদের স্মৃতিশক্তি ছিল খুবই তীক্ষ্ণ । তারা কোনো জিনিস শিখলে তা আর কখনো ভুলত না । ফলে এ অসাধারণ স্মরণশক্তির কারণে পবিত্র কুরআন সহজেই তাদের স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয় ।

এছাড়া সেসময় লিখিতভাবেও আল-কুরআন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় । আরবদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক লোকই ছিল শিক্ষিত । তা ছাড়া সেসময় লেখার উপকরণও ছিল দুষ্প্রাপ্য। এজন্য সেসময় আল-কুরআন একত্রে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়নি । তবে আল-কুরআনের কোনো অংশ বা আয়াত নাজিল হলে সাথে সাথেই লিখে রাখা হতো । খেজুর গাছের ডাল, পশুর চামড়া ও হাড়, পাথর, গাছের পাতা ইত্যাদি ছিল তখনকার লেখনীর উপকরণ । সাহাবিগণ এগুলোতেই আল-কুরআনের আয়াত লিখে তা সংরক্ষণ করতেন ।

যেসব সাহাবি লেখাপড়া জানতেন তাঁরা প্রায় সকলেই কুরআন লিখার মর্যাদা লাভ করেছিলেন । আল-কুরআন লিপিবদ্ধকারী সাহাবিগণকে বলা হয় কাতিবে ওহি বা ওহি লেখক । তাঁরা ছিলেন সংখ্যায় মোট

 

 

 

 

৪২ জন । এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.)। এছাড়াও হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.), হযরত উমর ফারুক (রা.), হযরত উসমান (রা.), হযরত আলি (রা.), হযরত মুআবিয়া (রা.), হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রা.), হযরত মুগিরা ইবনে শু'বা (রা.), হযরত আমর ইবনে আস (রা.), হযরত যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আরকাম (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য । এঁদের কেউ না কেউ সদা সর্বদা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে থাকতেন এবং কুরআনের কোনো অংশ বা আয়াত নাজিল হলে সাথে সাথে তা লিখে নিতেন । এভাবে লেখনীর মাধ্যমেও আল-কুরআনকে সংরক্ষণ করা হয় । 

আল-কুরআন সংকলন

মহানবি (স.)-এর সময়ে আল-কুরআন মুখস্থ ও লেখনীর মাধ্যমে পুরোপুরি সংরক্ষণ করা হয় । কিন্তু সে সময় তা একত্রে গ্রন্থাবদ্ধ করা হয়নি । বরং তাঁর তত্ত্বাবধানে লিপিবদ্ধ টুকরোগুলো নানাজনের নিকট সংরক্ষিত ছিল । হযরত আবু বকর (রা.)-ই সর্বপ্রথম কুরআন সংকলনের উদ্যোগ নেন ।

হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা । তাঁর সময়ে নবুয়তের কতিপয় মিথ্যা দাবিদার বা ভণ্ড নবি ও যাকাত অস্বীকারকারীর আবির্ভাব ঘটে । তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন । এরূপই একটি যুদ্ধ ছিল ইয়ামামার যুদ্ধ । এটি মুসায়লিমা কাযযাব নামক ভণ্ড নবির বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় । এ যুদ্ধে বহুসংখ্যক কুরআনের হাফিয সাহাবি শাহাদাত বরণ করেন। এতে হযরত উমর (রা.) উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন । তিনি ভাবলেন যে, এভাবে হাফিয সাহাবিগণ শাহাদাত বরণ করতে থাকলে একসময় কুরআন মুখস্থকারী লোকই খুঁজে পাওয়া যাবে না । ফলে কুরআন বিলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দেবে । সুতরাং তিনি হযরত আবু বকর (রা.)-কে কুরআন সংকলন করে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার পরামর্শ দান করেন । পরামর্শ শ্রবণে হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, হে উমর! রাসুলুল্লাহ (স.) যে কাজ করে যাননি তা আপনি কীভাবে করতে চাচ্ছেন? হযরত উমর (রা.) বললেন, আল্লাহর শপথ! এতে কল্যাণ রয়েছে । এভাবে হযরত উমর (রা.)- বারবার অনুরোধ করায় হযরত আবু বকর (রা.) কুরআন সংকলনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন । তিনি প্রধান ওহি লেখক সাহাবি হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.)-কে এ গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন। হযরত যায়দ (রা.) কুরআন সংকলনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নিম্নোক্ত চারটি পন্থা অবলম্বন করেন :

ক. হাফিয সাহাবিদের তিলাওয়াতের মাধ্যমে প্রতিটি আয়াতের বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতা যাচাইকরণ ।

খ. হযরত উমর (রা.)-এর হিফযের সাথে মিলিয়ে আয়াতের বিশুদ্ধতা যাচাইকরণ । গ. রাসুলুল্লাহ (স.)-এর উপস্থিতিতে লিখিত হওয়ার ব্যাপারে ন্যূনতম দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ।

গ. চূড়ান্তভাবে লিখিত আয়াতগুলো অন্যান্য সাহাবির সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপির সাথে তুলনা ও যাচাইকরণ ।

এভাবে চরম সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.) পবিত্র কুরআন সর্বপ্রথম গ্রন্থাকারে সংকলন করেন । এটাই ছিল সর্বপ্রথম গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ আল-কুরআন । কুরআনের এ কপিটি হযরত আবু বকর (রা.)-এর নিকট সংরক্ষিত ছিল । তাঁর ইন্তিকালের পর এটি হযরত উমর (রা.)-এর তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত ছিল । হযরত উমর (রা.)-এর শাহাদাতের পর পবিত্র কুরআনের এ পাণ্ডুলিপিটি তাঁর কন্যা, উম্মুল মুমিনিন হযরত হাফসা (রা.)-এর নিকট সংরক্ষিত ছিল ।

 

 

 

 

 

তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.)-এর খেলাফতকালে কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে নানা মতানৈক্য দেখা দেয় । এর মূল কারণ ছিল বিভিন্ন গোত্রীয় রীতিতে কুরআন পাঠ । মহানবি (স.) সহজ করণার্থে আরবদের ৭টি রীতিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি দিয়েছিলেন । আরবগণ এ ৭টি রীতিতে পাঠের বিষয়টি জানতেন বলে প্রথমদিকে কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ইসলামি খেলাফতের ব্যাপক বিস্তৃতির ফলে অনারবগণ মুসলমান হতে লাগল । তারা আরবি ভাষার এসব আঞ্চলিক রীতিসমূহ সম্পর্কে সচেতন ছিল না । ফলে ভিন্ন ভিন্ন রীতিতে কুরআন পাঠে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় । এমনই এক ঘটনা ঘটে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান অঞ্চলে জিহাদের সময়। এ সময় ভিন্ন রীতিতে কুরআন পাঠে মুসলমানদের মধ্যে ঝগড়ার সূত্রপাত ঘটে । হযরত হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান (রা.) ঘটনাটি খলিফা হযরত উসমান (রা.)-কে অবহিত করেন । এমতাবস্থায় হযরত উসমান (রা.) প্রধান সাহাবিগণের পরামর্শক্রমে কুরআন সংকলনের জন্য চারজন সাহাবির একটি বোর্ড গঠন করেন। এঁরা ছিলেন হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.),সাঈদ ইবনে আস (রা.) এবং আব্দুর রহমান ইবনে হারিস (রা.) । এ বোর্ডের নেতৃত্ব হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.) এর উপর ন্যস্ত করা হয় ৷

হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.) সর্বপ্রথম হযরত হাফসা (রা.)-এর নিকট থেকে কুরআনের প্রথম পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে আসেন এবং এ থেকে আরও সাতটি কপি তৈরি করেন । অনুলিপি তৈরিতে সাহাবিগণ হাফিযগণের কেরাতের সাথে মিলিয়ে পুনরায় এর নির্ভুলতা যাচাই করতেন । অতঃপর মূল কপিটি হযরত হাফসার (রা.) নিকট ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং তৈরি অনুলিপিগুলোর একটি খলিফার নিকট কেন্দ্রে সংরক্ষণ করা হয় আর বাকিগুলো বিভিন্ন শাসনকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয় । ফলে আল-কুরআন বিকৃতি ও গরমিলের হাত থেকে রক্ষা পায় । এরপর বিক্ষিপ্তভাবে রক্ষিত কপিগুলো একত্র করে তা পুড়িয়ে বিনষ্ট করে ফেলা হয়। এভাবে হযরত উসমান (রা.)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আল-কুরআন সংকলিত হয় । এ মহান কাজের জন্য তাঁকে ‘জামিউল কুরআন' বা কুরআন একত্রকারী (সংকলক) বলা হয় ।

কুরআনের এ সংকলনসমূহে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নির্দেশনার কোনোরূপ পরিবর্তন করা হয়নি। বরং রাসুলুল্লাহ (স.) যেভাবে কোন আয়াতের পর কোন আয়াত হবে বলে গেছেন সেভাবেই সংকলন করা হয়। এভাবে সূরাসমূহেও রাসুলুল্লাহ (স.) বর্ণিত ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সাজানো হয় । বস্তুত আল্লাহ তায়ালাই রাসুলুল্লাহ (স.)-কে এরূপ ধারাবাহিকতা শিক্ষা দিয়েছিলেন । জিবরাইল (আ.) যখনই কোনো আয়াত নিয়ে আসতেন তখনই ঐ আয়াত কোন সূরার কোথায় স্থাপন করতে হবে তা বলে দিতেন । সে অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ (স.) ও সাহাবিগণের দ্বারা লিখিয়ে নিতেন । পবিত্র কুরআনের পাণ্ডুলিপি তৈরিতে এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয় । ফলে লাওহে মাহফুজে যেভাবে কুরআন বিন্যস্ত রয়েছে বর্তমান কুরআন মজিদও ঠিক সে বিন্যাসেই বিদ্যমান রয়েছে ।

হযরত উসমান (রা.)-এর সময়ে তৈরিকৃত কুরআনের পাণ্ডুলিপিতে হরকত বা স্বরচিহ্ন ছিল না। ফলে অনারব মুসলমানগণ কুরআন তিলাওয়াতে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হন । ইরাকের উমাইয়া বংশীয় শাসনকর্তা হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ পবিত্র কুরআনে হরকত সংযোজন করে এ অসুবিধা দূর করেন । বস্তুত এটা কুরআনে কোনো নতুন সংযোজন নয়। বরং আগে হরকতসহ পড়া হলেও তা লিখা হতো না । কেননা আরবগণ এমনিই তা বুঝতে পারতেন । হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ উচ্চারিত এসব হরকতসমূহ পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করে দেখিয়ে দেন মাত্র । ফলে অনারবগণের জন্যও কুরআন তিলাওয়াতের বাধা অপসারিত হয় ।

 

 

 

 

উল্লেখ্য, পরবর্তী সময়ে পবিত্র কুরআন আরও নবতর ও সহজ উপায়ে সংকলন করা হয় । মুদ্ৰণ যন্ত্ৰ আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত হাতের লিখার মাধ্যমেই আল-কুরআন সংকলন করা হতো । মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পরবর্তীতে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আল-কুরআনের লক্ষ লক্ষ কপি মুদ্রণ করা হতে থাকে । এমনকি বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ভাষায় এর অনুবাদ ও ব্যাখ্যা-গ্রন্থও প্রকাশিত হয় ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা আল-কুরআন সংরক্ষণ ও সংকলন সম্পর্কে একটি অনুচ্ছেদ বাড়ি থেকে লিখে নিয়ে আসবে।

পাঠ ৪

মক্কি ও মাদানি সূরা

আল-কুরআন সর্বমোট ৩০টি অংশে বিভক্ত । এ অংশগুলোকে পারা বলা হয় । কুরআন মজিদে রয়েছে ১১৪টি সূরা এবং ৬২৩৬টি মতান্তরে ৬৬৬৬টি আয়াত । অবতরণের সময় বিবেচনায় কুরআন মজিদের সূরাসমূহ ২ ভাগে বিভক্ত । যথা- মক্কি ও মাদানি । নিম্নে এ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো ।

মক্কি সূরা

সাধারণভাবে বলা যায়, পবিত্র মক্কা নগরীতে আল-কুরআনের যেসব সূরা নাজিল হয়েছে সেগুলো মক্কি সূরা । প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী, মহানবি (স.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পূর্বে নাজিল হওয়া সূরাসমূহকে মক্কি সূরা বলা হয় ।

এ প্রসঙ্গে ইয়াহইয়া ইবনে সালাম বলেন, “মহানবি (স.)-এর হিজরত কালে মদিনায় গমনের পথে মদিনায় পৌঁছার পূর্বপর্যন্ত যা নাজিল হয় তাও মক্কি সূরা ।”

আল-কুরআনে মক্কি সূরার সংখ্যা মোট ৮৬টি ।

মক্কি সূরার বৈশিষ্ট্য

১. মক্কি সূরাসমূহে তাওহিদ ও রিসালাতের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে ।

২. মৃত্যুর পরবর্তী জীবন কিয়ামত, জান্নাত-জাহান্নাম তথা আখিরাতের বর্ণনা এসব সূরায় প্রাধান্য লাভ করেছে।

৩. শিরক-কুফরের পরিচয় বর্ণনা করে এগুলোর অসারতা প্রমাণ করা হয়েছে ।

৪. মুশরিক ও কাফিরদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে । ৫. এতে পূর্ববর্তী মুশরিক ও কাফিরদের হত্যাযজ্ঞের কাহিনী, ইয়াতীমদের সম্পদ হরণ করা, কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া ইত্যাদি কুপ্রথা ও কু-আচরণের বিবরণ রয়েছে।

 

 

 

 

৬. পূর্ববর্তী নবি-রাসুলগণের সফলতা ও তাঁদের অবাধ্যদের শোচনীয় পরিণতির বর্ণনা রয়েছে ।

৭. এ সূরাগুলোতে শরিয়তের সাধারণ নীতিমালার উল্লেখ রয়েছে ।

৮. এতে উত্তম চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা করা হয়েছে ।

৯. এ সূরাসমূহ সাধারণত আকারে ছোট এবং আয়াতগুলোও তুলনামূলকভাবে ছোট । ১০. এর শব্দমালা শক্তিশালী, ভাবগম্ভীর ও অন্তরে প্রকম্পন সৃষ্টিকারী ।

১১. এতে প্রসিদ্ধ বিষয়সমূহ শপথের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে ।

মাদানি সূরা

সাধারণ ভাষায় বলা যায়, মদিনাতে নাজিল হওয়া সূরাগুলো মাদানি সূরা । তবে প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী, মহানবি (স.)-এর মদিনায় হিজরতের পর নাজিল হওয়া সকল সূরাকে মাদানি সূরা নামে আখ্যায়িত করা হয় ।

ইয়াহইয়া ইবনে সালাম বলেন, “মহানবি (স.)-এর মদিনায় হিজরতের পর মদিনার বাইরে সফরে থাকাবস্থায় নাজিল হওয়া সূরাসমূহও মাদানি সূরা।” অর্থাৎ হিজরতের পর নাজিল হওয়া সকল সূরাই মাদানি সূরা । মাদানি সূরা মোট ২৮টি।

মাদানি সূরার বৈশিষ্ট্য

১. মাদানি সূরাসমূহে আহলে কিতাব তথা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের প্রতি ইসলামের আহ্বান জানানো হয়েছে ।

২. এতে আহলে কিতাবের পথভ্রষ্টতা ও তাদের কিতাব বিকৃতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে ।

৩. এ সূরাসমূহে নিফাকের পরিচয় ও মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ।

৪. ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে । ৫. পারস্পরিক লেনদেন, উত্তরাধিকার আইন, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয়সহ যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিধান বর্ণিত হয়েছে ।

৬. বিচার ব্যবস্থা, দণ্ডবিধি, জিহাদ, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে ।

৭. ইবাদতের রীতিনীতি, সালাত, যাকাত, হজ, সাওম ইত্যাদি বিষয় বিবৃত হয়েছে ।

৮. শরিয়তের বিধি-বিধান, ফরজ, ওয়াজিব, হালাল-হারাম ইত্যাদির সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে ।

৯. এ সূরাগুলো ও এর আয়াতসমূহ তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ ।

কাজ: শিক্ষার্থীরা মক্কি ও মাদানি সূরার বৈশিষ্ট্যগুলো লিখে একটি বড় পোস্টার বাড়িতে তৈরি করে এনে শ্রেণিতে প্রদর্শন করবে ।

 

 

 

 

পাঠ ৫

তিলাওয়াত : গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য

তিলাওয়াত শব্দের অর্থ পাঠ করা, আবৃত্তি করা, পড়া, অনুসরণ করা ইত্যাদি । আল-কুরআন পাঠ করাকে ইসলামি পরিভাষায় কুরআন তিলাওয়াত বলা হয় ।

কুরআন মজিদ মুখস্থ পড়া যায়, আবার দেখেও তিলাওয়াত করা যায়। আল-কুরআন দেখে পড়াকে নাযিরা

তিলাওয়াত বলা হয়।

কুরআন মজিদ শিখতে হলে প্রথমে দেখে দেখে তা পাঠ করতে হয়। অতঃপর হরকত, হরফ ইত্যাদি চিনে তাজবিদ সহকারে পাঠ করতে হয় । আমরা অনেকেই পুরো কুরআন মজিদ মুখস্থ করতে পারিনি । সুতরাং আমরা নিয়মিত দেখে দেখে তাজবিদসহ আল-কুরআন তিলাওয়াত করব। এভাবে দেখে দেখে কুরআন তিলাওয়াত করাও উত্তম কাজ। এতে অনেক নেকি বা সাওয়াব পাওয়া যায় ।

আল-কুরআন মহান আল্লাহর পবিত্র বাণী । এটি মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ নিয়ামত। এটি হলো পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান-ভাণ্ডার। এতে যেমন তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত, ইবাদত ইত্যাদি বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে, তেমনি পার্থিব জীবনের প্রয়োজনীয় নানা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ও নির্দেশনা রয়েছে। এজন্য একজন ফরাসি পণ্ডিত যথার্থই বলেছেন, “কুরআন বিজ্ঞানীদের জন্য একটি বিজ্ঞান সংস্থা, ভাষাবিদদের জন্য শব্দকোষ, বৈয়াকরণের জন্য ব্যাকরণ গ্রন্থ এবং বিধানের জন্য একটি বিশ্বকোষ ।

সুতরাং হালকাভাবে আল-কুরআন পাঠ করলেই চলবে না। বরং একে খুবই গুরুত্বের সাথে তিলাওয়াত করতে হবে । এর মর্মার্থ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে হবে। এতে বর্ণিত বিষয়াদি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করতে হবে। তাহলে আমরা আল-কুরআনের জ্ঞান ও শিক্ষা আয়ত্ত করতে পারব। আল্লাহ তায়ালাও চিন্তা-গবেষণা সহকারে কুরআন তিলাওয়াতের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “তবে কি তারা কুরআন সম্বন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে না, না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?” (সূরা মুহাম্মদ, আয়াত ২৪) অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “এটি কল্যাণময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি নাজিল করেছি যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ (এ থেকে) উপদেশ গ্রহণ করে।” (সূরা সা'দ, আয়াত ২৯)

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন,

وَلَقَد يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِكَرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍه

অর্থ : “নিশ্চয়ই আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি, অতএব কোনো উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি?” (সূরা আল-কামার, আয়াত ২২)

অতএব, বুঝেশুনে ও চিন্তা-গবেষণা সহকারে কুরআন পড়া উচিত। এভাবে তিলাওয়াত করলে আল-কুরআনের শিক্ষা ও উপদেশ অনুধাবন করা যায় ।

 

 

 

 

 

চিন্তা-গবেষণার পাশাপাশি আল-কুরআন সহিহ-শুদ্ধ ও সুন্দরভাবে পাঠ করাও অত্যাবশ্যক । কুরআন মজিদ ভুল ও অসুন্দর সুরে তিলাওয়াত করলে গুনাহ হয় । অশুদ্ধ ও অসুন্দররূপে কুরআন তিলাওয়াত করলে নামায শুদ্ধ হয় না । শুদ্ধ ও সুন্দররূপে কুরআন তিলাওয়াত করার নিয়মকে তাজবিদ বলা হয় । পূর্ববর্তী শ্রেণিসমূহে আমরা তাজবিদের নানা নিয়মকানুন জেনে এসেছি । তাজবিদসহ কুরআন তিলাওয়াত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ রয়েছে । তিনি বলেন-

وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًاه

অর্থ : “আপনি কুরআন আবৃত্তি করুন ধীরে ধীরে ও সুস্পষ্টভাবে ।” (সূরা আল- ল-মুয্যাম্মিল, আয়াত ৪) সুন্দর সুরে কুরআন তিলাওয়াত প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন-

لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَّمْ يَتَغَنَّ بِالْقُرْآنِ -

অর্থ : “যে ব্যক্তি সুললিত কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয় । অর্থাৎ সে ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত নয় ।” (বুখারি)

বস্তুত রাসুলুল্লাহ (স.) অত্যন্ত সুন্দর সুমধুর স্বরে তাজবিদ সহকারে কুরআন তিলাওয়াত করতেন । আমরাও

শুদ্ধ ও সুন্দররূপে কুরআন তিলাওয়াত করতে চেষ্টা করব ।

কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত অত্যন্ত বেশি । এর প্রতিটি হরফ তিলাওয়াতেই নেকি পাওয়া যায় । নবি করিম (স.) বলেন,

مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا -

অর্থ : “যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব থেকে একটি হরফও পাঠ করবে সে একটি নেকি লাভ করবে । আর এ নেকির পরিমাণ হলো দশ গুণ ।” (তিরমিযি)

বস্তুত, কুরআন তিলাওয়াত উত্তম ইবাদত । রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন-

أفضَلُ عِبَادَةِ أُمَّتِى قِرَاءَةُ الْقُرْآنِ -

অর্থ : “আমার উম্মতের উত্তম ইবাদত হলো কুরআন তিলাওয়াত ।” (বায়হাকি)

কুরআন হলো নুর বা জ্যোতি। এটি তিলাওয়াতকারীর মর্যাদা সমুন্নত করে । কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভ করতে পারে। এর মাধ্যমে মানুষের অন্তর পরিশুদ্ধ হয় । মানুষ নৈতিক ও মানবিক গুণাবলিতে উদ্ভাসিত হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, “এই অন্তরসমূহে মরিচা ধরে যেভাবে লোহায় পানি লাগলে মরিচা ধরে । তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো : হে আল্লাহর রাসুল (স.), এর পরিশোধক কী? তিনি বললেন, মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করা এবং কুরআন তিলাওয়াত করা ।” (বায়হাকি)

 

 

 

 

প্রকৃতপক্ষে, যথাযথভাবে কুরআন তিলাওয়াত করার দ্বারা মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করতে পারে । শুদ্ধ ও সুন্দররূপে কুরআন তিলাওয়াত করলে এবং এর মর্মার্থ বুঝে সে অনুযায়ী আমল করলে মানুষ প্রভূত সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়। হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করে এবং সে অনুযায়ী আমল করে, কিয়ামতের দিন তার পিতামাতাকে সূর্যের চাইতেও উজ্জ্বল মুকুট পরানো হবে ।” (আহমাদ ও আবু দাউদ) । অতএব, আমরা কুরআন তিলাওয়াতে যত্নবান হব ।

শানে নুযুল

‘শান’ শব্দের অর্থ অবস্থা, মর্যাদা, কারণ, ঘটনা, পটভূমি । আর নুযুল অর্থ অবতরণ । অতএব, শানে নুযুল অর্থ অবতরণের কারণ বা পটভূমি । ইসলামি পরিভাষায়, আল-কুরআনের সূরা বা আয়াত নাজিলের কারণ বা পটভূমিকে ‘শানে নুযুল’ বলা হয় । একে ‘সববে নুযুল’ও বলা হয় ।

আল-কুরআন মহানবি (স.)-এর প্রতি একসাথে নাজিল হয়নি । বরং নানা প্রয়োজন উপলক্ষে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে অল্প অল্প করে নাজিল হয়েছে। কোনো ঘটনার বিধান বর্ণনায় কিংবা কোনো সমস্যার সমাধানে কুরআনের অংশবিশেষ নাজিল হতো । যে ঘটনা বা অবস্থাকে কেন্দ্র করে আল-কুরআনের আয়াত বা সূরা নাজিল হতো সে ঘটনা বা অবস্থাকে ঐ সূরা বা আয়াতের শানে নুযুল বলা হয় । যেমন : রাসুলুল্লাহ (স.)-এর শিশুপুত্র ইন্তিকাল করলে কাফিররা তাঁকে আবতার বা নির্বংশ বলে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে লাগল । এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা মহানবি (স.)-কে সান্ত্বনা দিয়ে সূরা আল-কাওসার নাজিল করেন । অতএব, মহানবি (স.)-এর প্রতি কাফিরদের উপহাস করার ঘটনাটি সূরা আল-কাওসারের শানে নুযুল হিসেবে পরিচিত । শানে নুযুল জানার উপকারিতা অনেক । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

ক. এর দ্বারা শরিয়তের বিধান প্রবর্তনের রহস্য জানা যায় ।

খ. আয়াতের অর্থ, উদ্দেশ্য ও সঠিক মর্মার্থ অবগত হওয়া যায় ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে ১০টি বাক্য নিজ খাতায় লিখে শিক্ষককে দেখাবে ।

অর্থ ও পটভূমিসহ কুরআনের কতিপয় সূরা পাঠ ৬ সূরা আশ-শাম্স (

পরিচয়

সূরা আশ-শামস মক্কি সূরার অন্তর্গত । এর আয়াত সংখ্যা ১৫টি । এ সূরার প্রথম শব্দ শামস থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে আশ-শামস । এটি আল-কুরআনের ৯১তম সূরা ।

 

 

 

 

 

 

আয়াতগুলোতে বর্ণিত বিষয়ের তাগিদ করেছেন। সূরার দ্বিতীয় ভাগে আল্লাহ তায়ালা মানুষের অবস্থা বর্ণনা করেছেন । আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাকে সৎকর্ম ও অসৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন । এতদসত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিজেকে পাপের দ্বারা কলুষিত করে তার জন্য ধ্বংস অনিবার্য । পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সৎকর্ম করে তার জন্য রয়েছে সফলতা ।

সূরার শেষভাগে আল্লাহ তায়ালা ছামুদ সম্প্রদায়ের উদাহরণের মাধ্যমে মানুষের ব্যর্থতার বিষয়টি বর্ণনা করেছেন । ছামুদ সম্প্রদায় ছিল খুবই উন্নত-সমৃদ্ধ একটি জাতি । কিন্তু তারা আল্লাহর প্রেরিত রাসুলকে অবিশ্বাস করে এবং তাঁর নির্দেশ অমান্য করে। তাদের এ অবাধ্যতার জন্য আল্লাহ তায়ালা তাদের শাস্তি প্রদান করেন এবং তাদের ধ্বংস করে দেন ।

শিক্ষা

১. আল্লাহ তায়ালাই আসমান, জমিন ও মানুষের স্রষ্টা ।

তিনিই সূর্য, চন্দ্র, রাত, দিনের আবর্তন ঘটান ।

৩. তিনিই মানুষের ভালো-মন্দ, সৎকর্ম-অসৎকর্মের জ্ঞান দান করেন ।

8.

যে ব্যক্তি সৎকর্ম করবে সে সার্বিক সফলতা লাভ করবে ।

৫. আর যে ব্যক্তি নিজেকে পাপ পংকিলতায় জড়িয়ে ফেলবে সে ব্যর্থ ও ধ্বংস হবে ।

৬. আমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মধ্যে যারা অবাধ্য ছিল আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতেই তাদের শাস্তি প্ৰদান করেন । বস্তুত আল্লাহ তায়ালার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর

সুতরাং আমরা আল্লাহ তায়ালার শাস্তি সম্পর্কে সচেতন থাকব । তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলব । সৎ ও পুণ্যকর্মের মাধ্যমে আমরা নিজেদের পূত-পবিত্র রাখব । তাহলেই আমরা ইহকালীন ও পরকালীন সফলতা লাভ করতে পারব ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা সূরা আশ-শামস-এর শিক্ষা লিখে একটি পোস্টার তৈরি করবে ।

 

 

 

পাঠ ৭

সূরা আদ-দুহা

পরিচয়

সূরা আদ-দুহা আল-কুরআনের ৯৩তম সূরা । এর আয়াত সংখ্যা ১১। এটি পবিত্র মক্কা নগরীতে নাজিল হয় । সূরাটির প্রথম শব্দ দুহা থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে আদ-দুহা ।

শানে নুযুল

হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার রাসুলুল্লাহ (স.) অসুস্থ থাকার কারণে দুই-তিন রাত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতে পারেননি । এ সময় জিবরাইল (আ.) আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁর নিকট ওহি নিয়ে

 

 

আমরা জানি, হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা ইন্তিকাল করেন । এরপর তাঁর ছয় বছর বয়সে তাঁর মাতা ইন্তিকাল করেন । কিন্তু আল্লাহ তায়ালা স্বীয় অসীম রহমতে তাঁকে সুন্দরভাবে লালনপালন করেন । রাসুলুল্লাহ (স.) মানবজাতির দুঃখকষ্ট লাঘবের জন্য ও পরকালীন মুক্তির জন্য চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন । আল্লাহ তায়ালা তাঁকে হিদায়াত দান করেন, সত্য ও সুন্দর পথের নির্দেশনা প্রদান করেন । মহানবি (স.) দরিদ্র ছিলেন । আল্লাহ তায়ালাই তাঁকে অভাবমুক্ত করেন । সচ্ছলতা দান করেন । এভাবে রাসুলুল্লাহ (স.)-কে দুনিয়ার জীবনে আল্লাহ তায়ালা বহু নিয়ামত দান করেন ।

পাশাপাশি পরকালেও আল্লাহ তায়ালা রাসুল (স.)-কে নানা নিয়ামত দান করার সুসংবাদ দান করেছেন এ সূরায় । আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন যে, মহানবি (স.)-এর আখিরাতের জীবন দুনিয়ার জীবন অপেক্ষা বহুগুণে উত্তম হবে । সেখানে তিনি উত্তম প্রতিদান লাভ করবেন এবং আল্লাহ তায়ালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন।

এ সমস্ত নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহ তায়ালা রাসুল (স.)-কে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নির্দেশ দেন । রাসুল (স.)-কে ইয়াতীম ও ভিক্ষুকদের সাথে কঠোর ব্যবহার না করার আদেশ দেন । পরিশেষে আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও প্রচার করার দায়িত্ব প্রদান করেন ।

শিক্ষা

এ সূরা থেকে আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শিক্ষা লাভ করি । যেমন :

১. আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের কখনোই পরিত্যাগ করেন না ।

২. তিনিই তাঁদের সকল বিপদাপদ থেকে রক্ষা করেন ।

৩. পরকালে তিনি তাঁদের কল্যাণময় জীবন দান করবেন ।

৪. ধনী ও সচ্ছল ব্যক্তিদের উচিত গরিব-দুঃখী, ইয়াতীম ও ভিক্ষুকদের কল্যাণ করা ।

৫. অভাবী, সাহায্যপ্রার্থী, ইয়াতীমদের প্রতি কঠোর হওয়া যাবে না, তাদের গালমন্দ কিংবা মারধর করা যাবে না এবং তাঁদের ধমকও দেওয়া যাবে না । বরং তাদের সাথে সদাচরণ করতে হবে ।

৬. দুনিয়ার সকল কল্যাণ ও নিয়ামত আল্লাহ তায়ালার দান । এসব নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সকলের কর্তব্য । যেমন আল্লাহ তায়ালা আমাদের ইমান, কুরআন, ধন-দৌলত, জ্ঞান-বুদ্ধি ইত্যাদি নিয়ামত দান করেছেন । সুতরাং এসবের জন্য আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে । এসব নিয়ামতের কথা মানুষের মাঝে প্রচার করতে হবে ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা সূরা আদ-দুহা -এর শানে নুযুল নিজ খাতায় মুখস্থ লিখে শিক্ষককে দেখাবে ।

 

 

 

 

 

 

বলেন যে, দুঃখের পরই সুখ আসে । কাফিরদের এসব অত্যাচার নির্যাতন দীর্ঘস্থায়ী হবে না । বরং তিনি মুসলমানদের বিজয় দান করবেন । এসব দুঃখকষ্টের পর তারা শান্তি ও স্বস্তি লাভ করবে । এরপর আল্লাহ তায়ালা মহানবি (স.)-কে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে বলেন যে, যখনই ইসলাম প্রচার, সাথিদের প্রশিক্ষণ, পারিবারিক দায়-দায়িত্ব ইত্যাদি থেকে তিনি অবসর হন তখনই তিনি যেন আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করেন।

শিক্ষা

১. যে ব্যক্তি সত্য ও ন্যায়ের জন্য চেষ্টা-সাধনা করে আল্লাহ তায়ালা তার অন্তরকে খুলে দেন । তাকে সৎ পথ প্রদর্শন করেন ।

২. আল্লাহ তায়ালাই মানুষের কষ্ট-যাতনা দূর করেন । ৩. মানুষের মান-সম্মান, খ্যাতি-মর্যাদা সবকিছুই আল্লাহ তায়ালার হাতে । তিনি যাকে ইচ্ছা সম্মান মর্যাদা দান করেন ।

৪. মানব জীবনে সুখ-দুঃখ থাকবেই । সুতরাং দুঃখ ও কষ্টে হতাশ হওয়া চলবে না । বরং ধৈর্যসহকারে এর মোকাবিলা করতে হবে । ৫. জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত মূল্যবান । অতএব, এ সময়কে কাজে লাগাতে হবে । দায়িত্ব ও কর্তব্য

সঠিকভাবে পালন করতে হবে । ৬. পার্থিব প্রয়োজনীয় কাজ সমাধানের পর আল্লাহ তায়ালার ইবাদত ও স্মরণে আত্মনিয়োগ করতে হবে । সকল কিছুতেই আল্লাহ তায়ালার প্রতি মনোনিবেশ করা তাঁর প্রিয় বান্দার বৈশিষ্ট্য ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা সূরা আল-ইনশিরাহ -এর শিক্ষা সম্পর্কে ৫টি বাক্য শ্রেণিকক্ষে দাঁড়িয়ে উপস্থাপন করবে ।

পাঠ ৯

সূরা আত-তীন

পরিচয়

সূরা আত-তীন আল-কুরআনের ৯৫তম সূরা । এটি মক্কায় অবতীর্ণ এবং এর আয়াত সংখ্যা ৮ । সূরার প্রথম শব্দ তীন থেকে এ সূরার নাম আত-তীন রাখা হয়েছে ।

শানে নুযুল

বিশেষ কোনো ঘটনা বা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ সূরাটি নাজিল করা হয়নি। বরং মানবজাতির জন্য পরিপূর্ণ সফলতা লাভের দিকনির্দেশনা ও পরকালের জবাবদিহির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা এ সূরা নাজিল করেন । মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালার প্রদত্ত কতিপয় নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পর আল্লাহ্ তায়ালা এতে মানবজাতির উৎপত্তি ও পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ সূরা নাজিল করেন।

 

 

 

إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّلِحَتِ

فَلَهُمْ أَجْرُ غَيْرُ مَمْنُونٍ فَمَا يُكَذِّبُكَ بَعْدُ بِالدِّينِ 6

কিন্তু তারা ব্যতীত, যারা ইমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে। তাদের জন্য তো রয়েছে অশেষ পুরস্কার।

৭. সুতরাং (হে মানুষ!) কিসে তোমাকে বিচার দিবস সম্বন্ধে

الَيْسَ اللَّهُ بِأَحْكَمِ الْحَكِمِينَ

অবিশ্বাসী করে। ৮. আল্লাহ কি বিচারকগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বিচারক নন।

সূরা আত-তীনের প্রথম তিন আয়াতে আল্লাহ তায়ালা চারটি বস্তুর শপথ করেছেন। তন্মধ্যে প্রথম দুটি হলো আঞ্চির (ডুমুর জাতীয় ফল) ও যায়তুন। আজির হলো একটি উপাদের ফল। আর যায়তুনের ফল অভ্যন্ত বরকতময় ও এর ভৈল খুবই উপকারী। এ দুটি বৃক্ষ সিরিয়া ও ফিলিস্তিন অঞ্চলে বেশি উৎপন্ন হয় । আর সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে অগণিত নবি রাসূল আগমন করেছিলেন। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা দূর পর্বতের শপথ করেছেন। এ পর্বত অত্যন্ত বরকতময় স্থান। এ পর্বতে হযরত মুসা (আ.) মহান আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন করেন । আর সেখানেই তাওরাত কিতাব নাজিল হয়। তৃতীয় আয়াতে নিরাপদ নগরীর শপথ করা হয়েছে। আর এটা হলো মক্কা নগরী। এ নগরীতে মহানবি (স.) জন্মগ্রহণ করেন। এতে পবিত্র বায়তুল্লাহ বা কাবা শরিফ অবস্থিত, সেখানে রক্তপাত ও মারামারি নিষিদ্ধ ।

এ সূরায় প্রথম তিনটি আয়াতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শপথ করে আল্লাহ তায়ালা মানুষের আকৃতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অত্যন্ত সুন্দর সৃষ্টি হিসেবে ঘোষণা করেন। সৃষ্টিজগতের মধ্যে মানুষের আকৃতিই সবচেয়ে সুন্দর। তবে মানুষ যদি ভালো কাজ না করে অসৎ কাজে লিপ্ত হয় তাহলে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখিরাতে ডাকে লাঞ্ছিত-অপমানিত করেন। তাকে শাস্তি প্রদান করেন।

এ সূরার শেষাংশে আল্লাহ তায়ালা পরকাল সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। এ সুরায় সৎকর্মশীল ও পুণ্যবানগণের জন্য পরকালে জান্নাতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, পরকালে আল্লাহ তায়ালা মানুষের সকল কাজের হিসাব নেওয়ার জন্য একত্র করবেন। এদিন হবে প্রতিফল দিবস বা শেষ বিচারের দিন। আল্লাহ তায়ালা হবেন সেদিনের একমাত্র বিচারক। তিনিই সর্বোত্তম ন্যায়বিচারক। মানুষের দুনিয়ার কৃতকর্মের জন্য তিনি পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান করবেন।

১. মানুষ সৃষ্টিজগতের শ্রেষ্ঠ ও সুদরতম সৃষ্টি ।

২. মানুষের সম্মান ও মর্যাদা সৎকর্মের উপর নির্ভরশীল। অসৎকর্ম করলে মানুষ মনুষ্যত্বের স্তর থেকে পশুত্বের স্তরে নেমে যায় ।

৩. সৎকর্মশীলগণ পরকালে অশেষ ও অফুরন্ত পুরস্কার লাভ করবেন। 

৪. আল্লাহ তায়ালা সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক। শেষ বিচারের দিন তিনি সকল মানুষের কৃতকর্মের হিসাব নেবেন ।

 

 

 

 

 

 

 

পাঠ ১১

শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস : সুন্নাহ

শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস হলো সুন্নাহ । সুন্নাহ অর্থ রীতিনীতি । ইসলামি পরিভাষায় মহানবি (স.)-এর বাণী, কর্ম ও তাঁর সমর্থিত রীতিনীতিকে সুন্নাহ বলে। সুন্নাহকে হাদিস নামেও অভিহিত করা হয় । সুন্নাহ হলো আল-কুরআনের ব্যাখ্যা স্বরূপ ।

আল্লাহ তায়ালা কুরআন মজিদে বিভিন্ন বিষয়ের সংক্ষিপ্ত মূলনীতি বর্ণনা করেছেন । আর মহানবি (স.)

তাঁর সুন্নাহর মাধ্যমে এসব বিধি-বিধান ও বিষয়সমূহ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ اللَّكُرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمُ

অর্থ : “আর আমি আপনার প্রতি কুরআন নাজিল করেছি, মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যা তাদের প্রতি নাজিল করা হয়েছে ।” (সূরা আন-নাহল, আয়াত ৪৪)

একটি উদাহরণের মাধ্যমে এ বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে । যেমন আল-কুরআনে বলা হয়েছে-

অর্থ : “তোমরা সালাত কায়েম কর ।” (সূরা আল-আনআম, আয়াত ৭২)

কিন্তু কোথায়, কীভাবে, কোন সময়ে সালাত আদায় করতে হবে এর কোনো পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা আল-কুরআনে পাওয়া যায় না । বরং রাসুলুল্লাহ (স.) এর ব্যাখ্যা করেছেন । তিনি সালাতের সমস্ত নিয়মকানুন তাঁর হাদিস বা সুন্নাহ এর মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেছেন । এভাবে আল-কুরআনের নির্দেশ ও সুন্নাহর বর্ণনার মাধ্যমে সালাত প্রতিষ্ঠা হয় ।

মূলত, সুন্নাহ বা হাদিস হলো আল-কুরআনের পরিপূরক । আল-কুরআনে একে শরিয়তের দলিল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । আল্লাহ বলেন - - وَمَا الكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا অর্থ : “রাসুল তোমাদের যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর আর তোমাদের যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত

থাক ।” (সূরা আল-হাশর, আয়াত ৭)

সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, সুন্নাহ বা হাদিস শরিয়তের অন্যতম দলিল ও উৎস । আল-কুরআনের পরই এর স্থান ।

আল-হাদিস

হাদিস অর্থ কথা বা বাণী । ইসলামি পরিভাষায় হাদিস বলতে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর বাণী, কর্ম ও মৌনসম্মতিকে বোঝানো হয় । হাদিসের দুটি অংশ: একটি সনদ (i) ও অপরটি মতন (ও) । হাদিসের রাবি পরম্পরাকে সনদ বলা হয় । যিনি হাদিস বর্ণনা করেন তাঁকে বলা হয় রাবি বা বর্ণনাকারী । হাদিস বর্ণনায় হাদিসের রাবিগণের পর্যায়ক্রমিক উল্লেখ বা বর্ণনা পরম্পরাই সনদ । আর হাদিসের মূল বক্তব্য বা মূল অংশকে বলা হয় মতন  । হাদিস শাস্ত্রে সনদ ও মতন উভয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

 

 

 

প্রকারভেদ

মতন বা হাদিসের মূল বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে হাদিসকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয় । যথা-

ক. কাওলি,

খ. ফি'লি এবং

গ. তাকরিরি

ক. কাওলি হাদিস

রাসুলুল্লাহ (স.)-এর বাণীসূচক হাদিসকে কাওলি হাদিস বলা হয় । অর্থাৎ মহানবি (স.)-এর পবিত্ৰ মুখনিঃসৃত বাণীকে কাওলি বা বাণীসূচক হাদিস বলে ।

খ. ফি'লি হাদিস

ফি‘লি শব্দের অর্থ কাজ সম্বন্ধীয় । যে হাদিসে মহানবি (স.)-এর কোনো কাজের বিবরণ স্থান পেয়েছে তাকে ফি'লি বা কর্মসূচক হাদিস বলা হয় ।

গ. তাকরিরি হাদিস

তাকরিরি অর্থ মৌন সম্মতি জ্ঞাপক । রাসুলুল্লাহ (স.)-এর অনুমোদনসূচক হাদিসই হলো তাকরিরি হাদিস । অর্থাৎ সাহাবিগণ রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সামনে কোনো কথা বলেছেন কিংবা কোনো কাজ করেছেন কিন্তু রাসুলুল্লাহ (স.) তা নিজে করেননি এবং তাতে বাধাও দেননি বরং মৌনতা অবলম্বন করে তাতে সম্মতি বা অনুমোদন দিয়েছেন । এরূপ অবস্থা বা বিষয়ের বর্ণনা যে হাদিসে এসেছে সে হাদিসকে তাকরিরি বা সম্মতিসূচক হাদিস বলা হয় ।

সনদ বা রাবির পরম্পরার দিক থেকে হাদিস আবার তিন প্রকার । যথা- (ক) মারফু, (খ) মাওকুফ ও (গ)

মাকতু ।

ক. মারফু হাদিস

যে হাদিসের সনদ রাসুলুল্লাহ (স.) পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মারফু হাদিস বলা হয় ।

খ. মাওকুফ হাদিস

যে হাদিসের সনদ সাহাবি পর্যন্ত পৌছে শেষ হয়ে গেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) পর্যন্ত পৌঁছেনি এরূপ হাদিসকে মাওকুফ হাদিস বলে ।

গ. মাকতু হাদিস

যে হাদিসের সনদ তাবিঈ পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মাকতু হাদিস বলে । অন্যকথায়, যে হাদিসে কোনো তাবিঈর বাণী, কাজ ও মৌন সম্মতি বর্ণিত হয়েছে তাকে মাকতু হাদিস বলা হয় ।

প্রকৃতপক্ষে, শরিয়তে আরও বহু প্রকারের হাদিস দেখা যায় । আমরা পরবর্তীতে এগুলো সম্পর্কে জানব । হাদিসের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকার হলো হাদিসে কুদসি । কুদসি শব্দের অর্থ পবিত্র । এ প্রকার হাদিস সরাসরি আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পৃক্ত । ইসলামি পরিভাষায়, যে হাদিসের শব্দ ও ভাষা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নিজস্ব, কিন্তু তার অর্থ, ভাব ও মূলকথা আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকে ইলহাম বা স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত, তাকে

 

 

 

হাদিসে কুদসি বলে । সংক্ষেপে, যে হাদিসের মূল কথা আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকে প্রাপ্ত এবং মহানবি (স.) নিজের ভাষায় তা উম্মতকে জানিয়ে দিয়েছেন সেটাই হাদিসে কুদসি । হাদিসে কুদসির ভাব, অর্থ ও মূলকথা আল্লাহ তায়ালার হলেও তা আল-কুরআনের অন্তর্ভুক্ত নয় । বরং এটি হাদিস হিসেবে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ।

হাদিস সংরক্ষণ ও সংকলন

রাসুলুল্লাহ (স.)-এর বাণী, কর্ম ও মৌনসম্মতিকে সাধারণভাবে হাদিস বলা হয়। সুতরাং রাসুলুল্লাহ (স.) থেকেই হাদিসের উৎপত্তি । রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবদ্দশায় হাদিস লিখে রাখা নিষেধ ছিল । কেননা তখন আল-কুরআন নাজিল হচ্ছিল । এ অবস্থায় মহানবি (স.)-এর হাদিস লিখে রাখলে তা আল-কুরআনের বাণীর সাথে সংমিশ্রণের আশঙ্কা ছিল । এ কারণে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবদ্দশায় ব্যাপকভাবে হাদিস লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণ করা হয়নি ।

তবে সাহাবিগণ মহানবি (স.)-এর বাণীসমূহ মুখস্থ রাখতেন । রাসুলুল্লাহ (স.) কোন সময় কী কাজ করতেন তা খেয়াল রাখতেন । আরবদের স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ । তাঁরা একবার যা স্মৃতিতে ধারণ করতেন কখনোই তা ভুলতেন না । ফলে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর প্রতিটি বাণী ও কাজ সাহাবিগণের স্মৃতিতে সংরক্ষিত হতো । রাসুলুল্লাহ (স.)ও স্বয়ং তাঁদের হাদিস মুখস্থ করার জন্য উৎসাহিত করতেন । তিনি বলেন, “আল্লাহ ঐ ব্যক্তির জীবন উজ্জ্বল করবেন, যে আমার কথা শুনে তা মুখস্থ করল ও সঠিকরূপে সংরক্ষণ করল এবং এমন ব্যক্তির নিকট পৌছে দিল যে তা শুনতে পায়নি ।” (তাবারানি) । সাহাবিগণ রাসুল (স.)-এর কথা শুনতেন, তা মনে রাখতেন এবং তা হুবহু বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের নিকট পৌঁছে দিতেন । এভাবে রাসুলুল্লাহ (স.) এর জীবদ্দশাতেই হাদিস সংরক্ষণ শুরু হয় ।

তা ছাড়া লিখিত আকারেও সেসময় বেশ কিছু হাদিস সংরক্ষিত হয় । বহু সাহাবি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর অনুমতিক্রমে ব্যক্তিগত উদ্যোগে হাদিস লিখে রাখতেন । এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.)-এর সহিফা ‘আস-সাদিকা’-এর কথা উল্লেখযোগ্য । এ সহিফাতে তিনি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর বহুসংখ্যক হাদিস লিখে রেখেছিলেন । তা ছাড়া রাসুলুল্লাহ (স.)-এর চিঠিপত্র, সন্ধিপত্র-চুক্তিনামা, সনদ, ফরমান ইত্যাদি লিখিত আকারে সংরক্ষিত ছিল ।

হাদিস সংকলনের ক্ষেত্রে উমাইয়া খলিফা হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযিয (র.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । তিনিই সর্বপ্রথম সরকারিভাবে হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন । তাঁর উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনে নতুন গতি সঞ্চার হয় । এরই ধারাবাহিকতায় হযরত ইমাম মালিক (র.) সর্বপ্রথম হাদিসের বিশুদ্ধ সংকলন তৈরি করেন । তাঁর এ গ্রন্থের নাম আল-মুয়াত্তা ।

হিজরি ৩য় শতক ছিল হাদিস সংকলনের স্বর্ণযুগ । এ সময় হাদিসের বিশুদ্ধতম ছয়টি কিতাব সংকলিত হয়। এগুলোকে একত্রে সিহাহ সিত্তাহ বা ছয়টি বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ বলা হয় । এ ছয়টি গ্রন্থ এবং এদের সংকলকগণের নাম :

১. সহিহ বুখারি

- ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল আল-বুখারি (র.)

 

 

২. সহিহ মুসলিম ইমাম আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ আল-কুশাইরি (র.)

৩. সুনানে নাসাই ইমাম আবু আব্দুর রহমান আহমদ ইবনে শুআইব আন-নাসাই (র.) -

৪. সুনানে আবু দাউদ ইমাম আবু দাউদ সুলায়মান ইবনে আশআস (র.) ৫. জামি তিরমিযি ইমাম আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আত-তিরমিযি (র.)

-

৬. সুনানে ইবনে মাজাহ - ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মাজাহ (র.)। -

হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

ইসলামি শরিয়তে হাদিসের গুরুত্ব অপরিসীম। হাদিস হলো শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস । এটিও এক প্রকার ওহি। মহানবি (স.) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনা প্রাপ্ত হয়েই মানুষকে নানা বিষয়ের নির্দেশনা প্রদান করতেন । যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন :

وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى لَا إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌّ يُوحَى

অর্থ : “আর তিনি নিজ প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না । তা তো ওহি, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।” (সূরা আন-নাজম, আয়াত ৩-৪) সুতরাং রাসুলুল্লাহ (স.)-এর বাণী ও কাজের অনুসরণ করা আবশ্যক । রাসুলুল্লাহ (স.)-এর আনুগত্য

করলে প্রকারান্তরে আল্লাহ তায়ালারই আনুগত্য করা হয় । আল্লাহ তায়ালা এতে সন্তুষ্ট হন । আল্লাহ তায়ালা

বলেন, “আপনি বলুন! তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য কর । যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে

জেনে রাখুন, আল্লাহ তো কাফিরদের পছন্দ করেন না ।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩২)

আল-হাদিস পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা স্বরূপ । আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে শরিয়তের যাবতীয় আদেশ- নিষেধ, বিধি-বিধান ও মূলনীতি অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করেছেন । অতঃপর নবি (স.)-এর দায়িত্ব ছিল এসব বিধি-বিধান স্পষ্টরূপে বর্ণনা করা । আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর আমি আপনার প্রতি কুরআন নাজিল করেছি, মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যা তাদের প্রতি নাজিল করা হয়েছে ।” (সূরা আন-নাহল, আয়াত ৪৪ )

রাসুলুল্লাহ (স.) কুরআনের বিধি-বিধানসমূহের প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দিতেন। অনেক ক্ষেত্রে নিজে আমল করার দ্বারা এসব বিধান হাতে-কলমে শিক্ষা দিতেন । রাসুলুল্লাহ (স.)-এর এসব বাণী ও কর্মই হাদিস । সুতরাং কুরআনের বিধি-বিধান সুস্পষ্টরূপে অনুসরণের জন্য হাদিস অত্যন্ত প্রয়োজনীয় । নিম্নের উদাহরণের মাধ্যমে আমরা আরও ভালোভাবে বিষয়টি বুঝতে পারি । যেমন- কুরআন মজিদে সালাত কায়েম করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । কিন্তু কীভাবে কোন সময়,কত রাকআত সালাত আদায় করতে হবে তার বিস্তারিত দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি । ঠিক তেমনিভাবে কুরআনে যাকাত প্রদানেরও হুকুম দেওয়া হয়েছে । কিন্তু কে যাকাত দেবে, কাকে দেবে, কতপরিমাণ দেবে, এর কোনো নিয়ম সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়নি । রাসুলুল্লাহ (স.) হাদিসের দ্বারা আমাদের এসব নিয়ম-কানুন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বর্ণনা করেছেন । ফলে আমরা যথাযথভাবে এগুলো আদায় করতে পারছি । এজন্য আল্লাহ তায়ালা বলেছেন :

وَمَا الكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا تَهْكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا

 

 

 

অর্থ : “রাসুল তোমাদের যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর । আর যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।” (সূরা আল-হাশর, আয়াত ৭)

আর রাসুলুল্লাহ (স.)-এর আদেশ-নিষেধ এর পরিপূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণের জন্যও হাদিস জানা অত্যাবশ্যক । কেননা হাদিসের মাধ্যমেই আমরা এসব বিষয় জানতে পারি । মহানবি (স.) স্বয়ং হাদিসের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন,

تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكُتُمْ بِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ رَسُوْلِهِ -

অর্থ : “আমি তোমাদের মধ্যে দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি । যতদিন তোমরা এ দুটোকে আঁকড়ে থাকবে : ততদিন পর্যন্ত তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না । একটি হলো আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) এবং অপরটি তাঁর রাসুলের সুন্নাহ ।” (মুয়াত্তা)

প্রকৃতপক্ষে, কুরআন ও হাদিস ইসলামি শরিয়তের সর্বপ্রধান দুটি উৎস । এগুলো মানুষকে সত্য, ন্যায় ও শান্তির পথে পরিচালনা করে । এ দুটোর শিক্ষা ও আদর্শ ত্যাগ করলে মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে । সুতরাং মানবজীবনে আল-কুরআনের পাশাপাশি মহানবি (স.)-এর হাদিসের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস সুন্নাহ বা হাদিস -এর পরিচয় ও গুরুত্ব সম্পর্কে একটি অনুচ্ছেদ নিজ খাতায় বাড়ি থেকে লিখে আনবে ।

মহানবি (স.)-এর ১০টি হাদিস পাঠ ১২ হাদিস ১

(নিয়ত সম্পর্কিত হাদিস)

শব্দার্থ

إِثْمَا

প্রকৃতপক্ষে, বস্তুত, আসলে

الأعمال

আমলসমূহ, কর্মসমূহ

নিয়ত, সংকল্প,

উদ্দেশ্য

النيات

إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِيَّاتِ

অর্থ : “প্রকৃতপক্ষে সকল কাজ (এর ফলাফল) নিয়তের উপর নির্ভরশীল ।” (বুখারি)

 

 

এই হাদিসটি সহিহ বুখারির সর্বপ্রথম হাদিস। এর তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক । মানুষের সকল কাজই নিয়তের সাথে সংশ্লিষ্ট । নিয়ত বা উদ্দেশ্য ছাড়া মানুষ কোনো কাজই করে না । কাজের উদ্দেশ্যের গুরুত্ব এ হাদিস দ্বারা বুঝতে পারা যায় । সাথে সাথে কোন কাজের উদ্দেশ্য কেমন হওয়া উচিত তাও এ হাদিসের তাৎপর্য বিশ্লেষণে জানা যায় ।

আল্লাহ তায়ালা পরকালে মানুষের সকল কৃতকর্মের হিসাব নেবেন । সেদিন তিনি মানুষের সকল কাজের নিয়ত বা উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন। মানুষ যদি সৎ উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করে তবে সে তার পুরস্কার লাভ করবে । নেক নিয়তে কাজ করে ব্যর্থ হলেও সে তার জন্য পুরস্কার পাবে । আর যদি মন্দ উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করে তবে সে শাস্তি ভোগ করবে । এমনকি খারাপ উদ্দেশ্যে ইবাদত করলে কিংবা ভালো কাজ করলেও তাতে কোনো সাওয়াব হয় না । বরং নিয়ত সঠিক না হওয়ায় সে ভালো কাজও মন্দ হিসেবে পরিগণিত হয় ।

উপরে বর্ণিত হাদিসটির শেষাংশ জানলে আমরা নিয়তের বিশুদ্ধতার বিষয়টি আরও সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারব । এ হাদিসের শেষাংশে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নিয়তে (তাঁদের সন্তুষ্টি লাভের জন্য) হিজরত করে তবে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টি লাভ করবে । আর যদি সে পার্থিব লাভ বা কোনো স্ত্রীলোককে বিয়ে করার জন্য হিজরত করে তবে সে শুধু তাই লাভ করবে, যে জন্য সে হিজরত করেছে।

রাসুলুল্লাহ (স.) বিশেষ এক প্রেক্ষাপটে এ হাদিসটি বর্ণনা করেন । আর তা হলো- উম্মে কায়স নামক একজন মহিলা ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় হিজরত করেন । তখন জনৈক ব্যক্তি তাঁকে বিয়ে করার জন্য মদিনায় হিজরত করে চলে আসেন । ঐ ব্যক্তির উদ্দেশ্য জানতে পেরে নবি (স.) এ হাদিসটি বর্ণনা করেন। যার মূল বক্তব্য হলো- আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য হিজরত করা অত্যন্ত পুণ্যময় কাজ । আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়ত না থাকায় লোকটি হিজরতের সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হলেন ।

শিক্ষা

১. কাজের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যকে নিয়ত বলা হয় ।

২. নিয়তের উপরেই কাজের সফলতা নির্ভর করে । অর্থাৎ নিয়ত যদি ভালো হয় তবে ব্যক্তি উত্তম প্রতিদান লাভ করবে । আর নিয়ত যদি খারাপ হয় তবে ভালো কাজ করলেও ব্যক্তি সাওয়াব লাভ করবে না ।

৩. আল্লাহ তায়ালা মানুষের বাহ্যিক আমলের সাথে সাথে অন্তরের অবস্থাও লক্ষ করেন ।

সুতরাং সকল কাজেই আমরা নিয়তকে বিশুদ্ধ রাখব । লোক দেখানোর জন্য বা পার্থিব কোনো লাভের আশায় সৎকর্ম করব না, বরং আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টির জন্য কাজ করব ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা নিয়ত সম্পর্কিত হাদিসটি অনুবাদসহ লিখে একটি পোস্টার তৈরি করবে ।

 

 

 

 

 

 

 

الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يُسْلِمُهُ وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةٍ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِي حَاجَتِهِ

অর্থ : “এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই । সে তার ভাইয়ের উপর অত্যাচার করে না, তাকে শত্রুর হাতে সোপর্দ করে না । যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে সচেষ্ট হয়, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করে দেন ।” (বুখারি ও মুসলিম)

 

 

 

ব্যাখ্যা

মুসলমানগণ পরস্পর ভাই ভাই । তারা সকলে একই আদর্শে বিশ্বাসী, একই জীবনাদর্শের অনুসারী । ফলে পৃথিবীর যে স্থানেই কোনো মুসলমান থাকুক না কেন সকলেই ইসলামি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ । এতে দেশ, কাল, জাতি, বর্ণ ইত্যাদির কোনো ভেদাভেদ নেই । ধনী-গরিব, সাদা-কালো, আরব-অনারব সকল মুসলমানই পরস্পর ভাই-ভাই । সুতরাং এক মুসলমানকে অন্য মুসলমানের প্রতি বেশকিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয় । যেমন- কোনো মুসলমান ভাইয়ের প্রতি কোনোরূপ অন্যায়-অত্যাচার করা যাবে না ও -নির্যাতন করা যাবে না । বরং সর্বাবস্থায় তার সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। তার জান, মাল, ইজ্জত- জুলুম- সম্মান রক্ষা করতে হবে । শত্রুর মোকাবিলায় তাকে সাহায্য করতে হবে । তার শত্রুকে সাহায্য করা যাবে না । ছোট-বড় যেকোনো প্রয়োজনে অপর মুসলমান ভাইকে সাধ্যমতো সাহায্য করতে হবে । সামর্থ্য থাকলে ধন-সম্পদ ব্যয় করে তার সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে । অন্যথায় বুদ্ধি পরামর্শ ও সৎ উপদেশের মাধ্যমে সাহায্য করতে হবে । এমনকি প্রয়োজনে দৈহিক পরিশ্রমের মাধ্যমেও তাকে সাহায্য করতে হবে ।

বস্তুত নিজের সামর্থ্যানুযায়ী আন্তরিকভাবে অপর মুসলমান ভাইয়ের বিপদে এগিয়ে আসতে হবে । এতে আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হন । তিনি স্বয়ং সাহায্যকারীকে সাহায্য করেন । তার সকল প্রয়োজন পূরণ করে দেন ।

শিক্ষা

১. মুসলমানগণ পরস্পর ভাই-ভাই ।

২. তারা পরস্পর অন্যায় অত্যাচার করবে না ।

৩. শত্রুর মোকাবিলায় সকলে একত্রে এগিয়ে আসবে ।

, বিপদে আপদে পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে । 8.

৫. সাহায্যকারী মুসলিম আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রিয় । আল্লাহ তায়ালা তার প্রয়োজন পূরণ করে দেন ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা পরোপকার সম্পর্কিত হাদিসটির অনুবাদ ও শিক্ষা লিখে শ্রেণি শিক্ষককে দেখাবে ।

 

 

ব্যাখ্যা

এ হাদিসে মানবজীবনের নানা অবস্থায় কীরূপ আচরণ করতে হবে সে সম্পর্কে সুন্দর দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। মানবজীবনে সুখ-শান্তির পাশাপাশি দুঃখ-কষ্টও বিদ্যমান। এগুলো আল্লাহ তায়ালার পরীক্ষা স্বরূপ। আল্লাহ তায়ালা সুখ ও দুঃখের মাধ্যমে মানুষের পরীক্ষা করে থাকেন। মানুষের উচিত সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর হুকুম পালন করা। প্রকৃত মুমিন ব্যক্তি এরূপ করে থাকেন । ফলে সকল অবস্থাই তার জন্য কল্যাণকর । কেননা দুঃখ কষ্টে নিপতিত হলে মুমিন ব্যক্তি হতাশ হয়ে পড়েন না। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য অন্যায় কাজ করেন না। বরং এ অবস্থাতেও তিনি আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালন করেন ও ধৈর্যসহকারে মহান আল্লাহর উপর ভরসা করেন। এতে আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি সন্তুষ্ট হন । তাকে সাওয়াব দান করেন এবং দুঃখ-কষ্ট থেকে উদ্ধার করেন। ফলে দুঃখ-কষ্টের অবস্থাও মুমিন ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর হয়ে যায় ।

আর সুখ-শান্তির অবস্থাতেও মুমিন ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে ভুলে যান না। বরং তিনি সুখ-শান্তি ও নিয়ামতের জন্য আল্লাহ তায়ালার শোকর করেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করেন । ফলে আল্লাহ তায়ালা তার উপর খুশি হন ও তাঁর নিয়ামতসমূহ আরও বাড়িয়ে দেন। ফলে এ অবস্থায় মুমিন ব্যক্তি সর্বাধিক কল্যাণ লাভ করেন।

শিক্ষা

১. সুখ-দুঃখ মানবজীবনের স্বাভাবিক বিষয় ।

২. দুঃখ-কষ্টের সময় হতাশ হওয়া চলবে না । বরং ধৈর্যসহকারে আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালন করতে হবে।

৩. আনন্দের সময়ও আল্লাহ তায়ালার আদেশ ভুলে গেলে চলবে না । বরং তাঁর শুকরিয়া আদায় করতে হবে।

৪. এভাবে সুখ-দুঃখ সর্বাবস্থায় শোকর ও সবরের মাধ্যমে কল্যাণ লাভ করা যায় ।

৫. মুমিন ব্যক্তির সকল কাজই কল্যাণজনক । কেননা, মুমিন ব্যক্তি সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালন করেন । কোনো অবস্থাতেই আল্লাহ বিমুখ হন না। ফলে সবর ও শোকরের মাধ্যমে তিনি সর্বোচ্চ কল্যাণ লাভ করেন। প্রকৃত মুমিন হতে হলে আমাদেরকে সদা সর্বদা আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালনে সচেষ্ট হতে হবে ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা সম্পর্কিত হাদিসটির অনুবাদ ও শিক্ষা নিজ খাতায় লিখে শ্রেণি শিক্ষককে দেখাবে।

 

 

 

 

 

তৃতীয়ত, এ বাক্যদ্বয় মিযানে বা দাঁড়িপাল্লায় খুবই ভারী হবে। কিয়ামতের দিন মানুষের সকল কৃতকর্ম দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হবে। নেকির পাল্লা ভারী হলে মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর নেকির পাল্লা হালকা হলে তার স্থান হবে জাহান্নাম । এ বাক্যদ্বয়ের সাওয়াব ওজনে খুবই ভারী । মিযানে এগুলো নেকির ওজনকে ভারী করে তুলবে।

অতএব, আমরা এ বাক্য দুটো মুখস্থ করব এবং সব সময় পাঠ করব। ফলে মহামহিম ও মহাপবিত্র আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন এবং অধিক পরিমাণ প্রতিদান দেবেন ।

শিক্ষা

১. আল্লাহ তায়ালা মহাপবিত্র, মহামহিম। তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করলে তিনি খুশি হন । ২. সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আযিম- আল্লাহ তায়ালার প্রিয় দুটি বাক্য। আমরা সদা সর্বদা এ বাক্যদ্বয়ের যিকির করব ।

৩. হাশরের দিন মিযানে এ বাক্যদ্বয় খুবই ভারী হবে। ফলে এর পাঠকারী সফলতা লাভ করবে ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা বাড়ি থেকে পোস্টারে আরবিতে একটি হাদিস লিখে এনে শ্রেণি কক্ষে প্রদর্শন করবে।

পাঠ ২২

শরিয়তের তৃতীয় উৎস : আল-ইজমা

পরিচয়

শরিয়তের তৃতীয় উৎস হলো ইজমা। ইজমা আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ- একমত হওয়া, ঐক্যবদ্ধ হওয়া, মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। ব্যবহারিক অর্থে কোনো বিষয় বা কথায় ঐকমত্য পোষণ করাকে ইজমা বলে । ইসলামি পরিভাষায়, শরিয়তের কোনো বিষয়ে একই যুগের মুসলিম উম্মতের পুণ্যবান মুজতাহিদগণের (গবেষক) ঐকমত্য পোষণ করাকে ইজমা বলা হয়। ইজমা মহানবি (স.)-এর পরবর্তী যেকোনো যুগে হতে পারে। সাহাবিগণ থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি যুগেই ইজমা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে । ইজমা কুরআন-সুন্নাহ সমর্থিত হওয়া আবশ্যক । কুরআন-সুন্নাহর মূলনীতি বিরোধী কিংবা কোনো অন্যায় ও পাপ কাজে ইজমা হয় না। ইজমা আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত মুসলমানদের জন্য এক বিশেষ মর্যাদা ও নিয়ামত।

ইজমার উৎপত্তি

ইজমা বা ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো সমস্যার সমাধান করা কিংবা নতুন বিধান প্রবর্তন করা কোনো নতুন ঘটনা নয় । বরং রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সময় হতেই এর ব্যবহার বা প্রচলন লক্ষ করা যায়। রাসুলুল্লাহ (স.) স্বয়ং বিভিন্ন বিষয়ে সাহাবিগণের পরামর্শ নিতেন। অতঃপর তাঁদের মতামতের আলোকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

 

 

 

অর্থ : “আর তাদের কাজকর্ম সম্পাদিত হয় পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে ।” (সূরা আশ-শুরা, আয়াত ৩৮)

এভাবেই রাসুলুল্লাহ (স.) ইজমার বৈধতা, দৃষ্টান্ত ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন । পরবর্তীতে সাহাবিগণের যুগে এর পূর্ণাঙ্গ প্রচলন ঘটে । খলিফাগণ নতুন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে সর্বপ্রথম আল-কুরআনে এর সমাধান খুঁজতেন । তাতে খুঁজে না পেলে মহানবি (স.)-এর হাদিসের মাধ্যমে সমাধান করতেন । আর যদি হাদিসেও সে সমস্যার সুস্পষ্ট কোনো সমাধান না পেতেন তখন তাঁরা বিশিষ্ট সাহাবিগণের মতামত নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমাধান দিতেন। যেমন- হযরত আবু বকর (রা.)-এর সময়ে সাহাবিগণের ঐকমত্যের মাধ্যমেই কুরআন সংকলনের কাজ শুরু করা হয় । দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.)-এর সময়ে বিশ রাকআত তারাবি-এর সালাত জামাআতের সাথে আদায় করার ব্যাপারে সাহাবিগণের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয় । এভাবে পরবর্তী যুগগুলোতেও ইজমার মাধ্যমে নানা সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা হয়েছে ।

ইজমার হুকুম ও কার্যকারিতা

ইজমা শরিয়তের তৃতীয় উৎস । বিধি-বিধান নির্ধারণে ইজমা অকাট্য দলিল হিসেবে সাব্যস্ত । সাধারণভাবে ইজমার ভিত্তিতে প্রণীত বিধানের উপর আমল করা ওয়াজিব ।

ইজমার গুরুত্ব ও বৈধতা

ইসলামি শরিয়তে ইজমা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । আল-কুরআন ও হাদিসের পরই এর স্থান । এটি শরিয়তের তৃতীয় উৎস ও অকাট্য দলিল । আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিস দ্বারা ইজমার বৈধতা প্রমাণিত । আল্লাহ তায়ালা বলেন,

كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ

অর্থ : “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব ।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১১০) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে,

وَكَذَلِكَ جَعَلْنَكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ

অর্থ : “এভাবে আমি তোমাদের এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষ্যদাতা হতে পার ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৪৩)

উপরিউক্ত আয়াতদ্বয়ে উম্মতে মুহাম্মদি তথা মুসলিম জাতিকে শ্রেষ্ঠ ও মধ্যপন্থী উম্মত হিসেবে উল্লেখ করা

হয়েছে,

যা ইজমার পরোক্ষ দলিল স্বরূপ ।

মুসলিম মুজতাহিদগণ একমত হয়ে কোনো বিষয়ে ফয়সালা করলে তার বিরোধিতা করা চরম পাপ । আল্লাহ তায়ালা এ প্রসঙ্গে বলেন-

 

 

 

 

 وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نُوَلِهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ

অর্থ : “সৎপথ প্রকাশিত হওয়ার পরও কেউ যদি রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনগণের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, তবে আমি তাকে ঐ দিকেই ফিরিয়ে দেব যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত ১১৫)

উক্ত আয়াতে মুমিনদের অনুসৃত পথ বলতে মুসলিমদের ঐকমত্য বা ইজমা এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে । আমাদের প্রিয়নবি (স.) বলেছেন- مَا رَاهُ الْمُسْلِمُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللهِ حَسَنَ

অর্থ : : “মুসলমানগণ যা ভালো বলে মনে করে তা আল্লাহ তায়ালার নিকটও ভালো

এ হাদিস দ্বারাও ইজমা তথা মুসলমানদের ঐকমত্যের গুরুত্ব প্রমাণিত ।

(তাবারানি

মহানবি (স.) বলেছেন, “আল্লাহ তায়ালা আমার উম্মতকে নিশ্চয়ই গোমরাহির উপর জমায়েত করবেন না । আল্লাহর হাত (রহমত ও সাহায্য) দলবদ্ধ থাকার উপর রয়েছে। যে ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে (অবশেষে) দোযখে যাবে ।” (তিরমিযি)

ইজমা শরিয়তের অন্যতম দলিল । এর বৈধতা কুরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত । এর বিধানের উপর আমল করা আবশ্যক ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা আল-ইজমার পরিচয়, উৎপত্তি ও গুরুত্ব সম্পর্কে একটি অনুচ্ছেদ বাড়ি থেকে লিখে আনবে

এবং শ্রেণি শিক্ষককে দেখাবে ।

পাঠ ২৩

শরিয়তের চতুর্থ উৎস : আল-কিয়াস

পরিচয়

শরিয়তের চতুর্থ উৎস হলো কিয়াস । কিয়াস শব্দের অর্থ অনুমান করা, তুলনা করা, পরিমাপ করা ইত্যাদি । ইসলামি পরিভাষায় কুরআন ও সুন্নাহর আইন বা নীতির সাদৃশ্যের ভিত্তিতে বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করে পরবর্তীতে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান দেওয়াকে কিয়াস বলে । অন্য কথায়, কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমাতে যে সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় না ইসলামি মূলনীতি অনুযায়ী বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করে সে সমস্যার সমাধান করাই হলো কিয়াস ।

 

 

 

কিয়াসের গুরুত্ব

কিয়াস ইসলামি শরিয়তের অন্যতম উৎস । ইজমার পরই এর স্থান । ইসলামি শরিয়তের পূর্ণাঙ্গতার জন্য কিয়াসের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মানবজীবন ও সমাজ সতত পরিবর্তনশীল । পরিবর্তন ও বিবর্তনের ধারায় জগতে নতুন নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটে । ফলে নতুন নতুন জিজ্ঞাসা, সমস্যা ও জটিলতার সৃষ্টি হয়। এ সমস্ত সমস্যার সমাধান সভ্যতা ও সংস্কৃতির আলোকেই করতে হয় । ইসলাম অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মতভাবে এসব সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম । কেননা, ইসলাম একটি গতিশীল জীবনব্যবস্থা । এটি পূর্ণাঙ্গ ও সর্বজনীন জীবন-বিধান । কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল মানুষের জন্য পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা এতে দেওয়া হয়েছে। কুরআন ও হাদিসে শরিয়তের বিষয়গুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন এগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সর্বযুগে সর্বকালে সমস্ত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় । আর এ পদ্ধতির নামই কিয়াস । সুতরাং শরিয়তের পূর্ণাঙ্গতার জন্য কিয়াস অপরিহার্য ।

আল-কুরআন ও হাদিসে কিয়াসকে শরিয়তের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- فَاعْتَبِرُوا لِأُولِي الْأَبْصَارِه

অর্থ : “অতএব, হে চক্ষুষ্মানগণ! তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর ।” (সূরা আল-হাশর, আয়াত ২)

এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের চিন্তা ও গবেষণা করে শিক্ষা গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন । আর কিয়াস মুসলিম জ্ঞানীদের চিন্তা-ভাবনারই ফল ।

কিয়াস শরিয়তের সর্বনিম্ন স্তর । যখন কোনো বিষয়ে আল-কুরআন, হাদিস ও ইজমায় পরিষ্কারভাবে সমাধান পাওয়া যায় না তখনই কিয়াস প্রযোজ্য হয় । রাসুলুল্লাহ (স.) সাহাবিগণকে কিয়াস করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন । উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মহানবি (স.) যখন হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.)-কে ইয়েমেনের বিচারক হিসেবে প্রেরণ করেন তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘যখন কোনো সমস্যার উদ্ভব হবে তখন তুমি কীভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে?' হযরত মুআয (রা.) বললেন, আল্লাহর কিতাব অনুসারে । রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, “যদি আল্লাহর কিতাবে তা না পাও, তবে?' তিনি বললেন, তাহলে নবির সুন্নাহ মোতাবেক । রাসুল (স.) পুনরায় বললেন, “যদি তাতেও না পাও, তাহলে?' হযরত মুআয (রা.) বললেন, তা হলে আমি আমার বিবেক বুদ্ধি প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত প্রদান করব । তাঁর উত্তর শুনে নবি (স.) বললেন, “সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি তাঁর রাসুলের দূত দ্বারা এমন উত্তর প্রদান করালেন যাতে তাঁর রাসুল সন্তুষ্ট হলেন ।” (আবু দাউদ)

উপরোক্ত কুরআনের আয়াত ও রাসুলুল্লাহ (স.)-এর হাদিসে স্পষ্টভাবে কিয়াস বা গবেষণার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে । সুতরাং কিয়াস যে শরিয়তের অন্যতম উৎস এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই ৷

কিয়াসের নীতিমালা

রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ইন্তিকালের পর খুলাফায়ে রাশেদিনের যুগে কিয়াসের মাধ্যমে নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করা হতো । পরবর্তী যুগে কিয়াসের ব্যবহার আরও ব্যাপক হয়ে ওঠে । তবে নিজের খেয়ালখুশি মতো স্বার্থপরভাবে কিয়াস করা বৈধ নয় । শরিয়তের ইমামগণ কিয়াস করার ব্যাপারে কতিপয় নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন । এগুলো হলো :

 

 

 

ক. যেসব বিষয়ের সমাধান কুরআন, হাদিস ও ইজমায় পাওয়া যায় সেসব বিষয়ে কিয়াস করা যাবে না ।

খ. কিয়াস কখনোই কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমার বিরোধী হবে না ।

গ. কিয়াসের পদ্ধতি ও আইন মানুষের জ্ঞানের পরিসীমার মধ্যে থাকতে হবে ।

ঘ. কুরআন, হাদিস ও ইজমা দ্বারা প্রবর্তিত আইনের মূলনীতি বিরোধী কোনো আইন তৈরি করা কিয়াসের আওতা বহির্ভূত ।

প্রকৃতপক্ষে, কিয়াস ইসলামি শরিয়তের একটি বিজ্ঞানসম্মত ও যৌক্তিক উৎস । কিয়াস ইসলামি আইনকে গতিশীল করেছে ও সর্বজনীনতা দান করেছে। এর মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বায়নের নতুন নতুন বিষয়ের বিধান দেওয়া সম্ভব ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা আল-কিয়াস-এর পরিচয়, গুরুত্ব ও নীতিমালা সম্পর্কে ১৫টি বাক্য বাড়ি থেকে লিখে আনবে

এবং শ্রেণি শিক্ষককে দেখাবে ।

পাঠ ২৪

শরিয়তের আহকাম সংক্রান্ত পরিভাষা

শরিয়ত হলো ইসলামি বিধি-বিধানের সমন্বিত রূপ। পরিভাষায় শরিয়ত বলতে এমন সুদৃঢ় সোজাপথকে বুঝায় যার দ্বারা তার অবলম্বনকারী ব্যক্তি হিদায়াত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মপন্থা লাভ করতে পারেন । আর আহকাম হলো বিধানাবলি ।

প্রতিটি বিষয়েরই নিজস্ব কিছু পরিভাষা থাকে। ইসলামি শরিয়তেরও এরূপ বেশ কিছু পরিভাষা বিদ্যমান। এসব পরিভাষার মাধ্যমে শরিয়তের বিধানাবলির পর্যায়ক্রমিক গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায় । ইসলামি শরিয়তের আহকাম বা বিধানাবলি সংক্রান্ত পরিভাষাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব, মুবাহ ইত্যাদি । এ পাঠে আমরা উল্লিখিত পরিভাষাগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানব ।

ফরজ

ফরজ ও অর্থ অবশ্য পালনীয়, অত্যাবশ্যক । শরিয়তের যেসব বিধান কুরআন-সুন্নাহর অকাট্য দলিল দ্বারা অবশ্য কর্তব্য ও অলঙ্ঘনীয় বলে প্রমাণিত তাকে ফরজ বলা হয় ।

ফরজ কাজ কোনো অবস্থাতেই পরিত্যাগ করা যায় না । ফরজ অস্বীকার করলে ইমান থাকে না বরং এর অস্বীকারকারী কাফির হয়। আর এগুলো পালন না করলে কবিরা গুনাহ বা মারাত্মক পাপ হয় । ফরজ কাজ পালন না করলে আখিরাতে ভয়ঙ্কর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে ।

ফরজ দুই প্রকার । যথা- ১. ফরজে আইন

২. ফরজে কিফায়া

 

 

 

১. ফরজে আইন

যে সকল ফরজ বিধান সকলের উপর পালন করা অত্যাবশ্যক তাকে ফরজে আইন বলে । অর্থাৎ যেসব ফরজ কাজ ব্যক্তিগতভাবে সকল মুসলমানকেই আদায় করতে হয় তা-ই ফরজে আইন । যেমন- দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা, রমযান মাসে রোযা রাখা, এসব কাজ প্রত্যেক ব্যক্তিকেই নিজে আদায় করতে হয়।

২. ফরজে কিফায়া

ফরজে কিফায়া হলো সামষ্টিকভাবে ফরজ কাজ । অর্থাৎ যেসব কাজ মুসলমানের উপর ফরজ, কিন্তু সমাজের কতিপয় মুসলমান যদি আদায় করে ফেলে তবে সকলের পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যায় । কিছু লোকের আদায় করার দ্বারা সমাজের বাকি সবাই সে দায়িত্ব থেকে মুক্তি পায় । তবে যদি সমাজের কেউই আদায় না করে তবে সকলেই গুনাহগার হবে । যেমন- জানাযার সালাত । কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে ঐ এলাকার সবার উপর তার জানাযার সালাত আদায় করা ফরজ । এ পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের কতিপয় মুসলমান যদি তার জানাযার সালাত আদায় করে ফেলে তবে সকলেই এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করবে । কিন্তু কেউই যদি মৃতব্যক্তির জানাযার সালাত আদায় না করে তবে সকলেই ফরজ ত্যাগের কারণে গুনাহগার হবে ।

ওয়াজিব

ওয়াজিব অর্থ : অবশ্য পালনীয়, কর্তব্য, অপরিহার্য ইত্যাদি । শরিয়তের এমন কিছু বিধান রয়েছে যা পালন করা কর্তব্য । তবে ফরজ নয় । এরূপ বিধানকে ওয়াজিব বলা হয় ।

শরিয়তে ফরজের পরই ওয়াজিবের স্থান। এটি ফরজের কাছাকাছি । অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত না হলেও এটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য । ওয়াজিব অস্বীকার করলে মানুষ কাফির হয় না। তবে সে বড় রকমের অপরাধী হিসেবে গণ্য হয় । ওয়াজিব কাজ আদায় না করলেও কঠিন পাপ হয় । এর জন্য আখিরাতে শাস্তি পেতে হবে । ইসলামি শরিয়তে বহু ওয়াজিব কাজ রয়েছে। যেমন- দুই ঈদের সালাত, বিতরের সালাত ইত্যাদি । সালাত আদায়ের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু ওয়াজিব কাজ রয়েছে । যেমন- সূরা ফাতিহা পড়া, রুকুর পর সোজা হয়ে দাঁড়ানো, সিজদাহর মধ্যে সোজা হয়ে বসা ইত্যাদি । সালাতের এসব ওয়াজিব কাজ বাদ পড়লে সিজদাহ সাহু দিতে হয় । নতুবা সালাত শুদ্ধ হয় না । পুনরায় তা আদায় করতে হয় ।

সুন্নত

সুন্নত অর্থ- পথ, পন্থা, রীতি, নিয়ম, পদ্ধতি ইত্যাদি। পরিভাষায় মহানবি (স.) থেকে যে সমস্ত কাজ ইসলামি শরিয়তের বিধান হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে সেগুলোকে বলা হয় সুন্নত । অর্থাৎ যে সকল কাজ মহানবি (স.) নিজে করেছেন বা যা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন কিংবা অনুমোদন করেছেন তাকে সুন্নত বলা হয় । সুন্নত দুই প্রকার । যথা-

১. সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ

২. সুন্নতে যায়িদাহ ।

 

 

 

 

১. সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ

যে সকল কাজ মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) নিজে সর্বদাই পালন করতেন, অন্যদেরকে তা পালনের তাগিদ দিতেন তাকে সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ বলে । যেমন- আযান ও ইকামত দেওয়া, ফজরের ফরজ নামাযের পূর্বে দুই রাকআত, যোহরের ফরজের পূর্বে চার রাকআত ও পরে দুই রাকআত, মাগরিব ও এশার ফরজের পর দুই রাকআত নামায আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ ।

সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ ওয়াজিবের কাছাকাছি । এগুলো পালন করা কর্তব্য । ইচ্ছাকৃতভাবে বা অবহেলাবশত

বিনা কারণে এগুলো পালন না করলে গুনাহ হয় ।

২. সুন্নতে যায়িদাহ

সুন্নতে যায়িদাহ হলো অতিরিক্ত সুন্নত । পরিভাষায়, যে সকল কাজ নবি (স.) করেছেন বলে প্রমাণিত তবে তিনি সর্বদা তা পালন করতেন না, বরং কখনো করতেন আবার কখনো ছেড়ে দিতেন এসব কাজকে সুন্নতে যায়িদাহ বলা হয় । মহানবি (স.) এরূপ কাজ করার জন্য উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন । তবে এ ব্যাপারে তিনি তাগিদ করেননি এবং তা না করলে গুনাহ হয় না । সুন্নতে যায়িদাহকে সুন্নতে গায়রে মুয়াক্কাদাহও বলা হয় । যেমন- আসর ও এশার ফরজের পূর্বে চার রাকআত সুন্নত নামায আদায় করা ॥ সুন্নতে যায়িদাহ পালনে অনেক সাওয়াব অর্জন করা যায়

মুস্তাহাব

মুস্তাহাব অর্থ পছন্দনীয়। যে সকল কাজের প্রতি রাসুলুল্লাহ (স.) উম্মতকে উৎসাহ প্রদান করেছেন এবং তা করলে নেকি পাওয়া যাবে, কিন্তু না করলে গুনাহ হবে না সেসব কাজকে শরিয়তে মুস্তাহাব বলে । ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত ব্যতীত অতিরিক্ত সবধরনের ইবাদত ও ভালো কাজই মুস্তাহাব হিসেবে গণ্য । এ মুস্তাহাবকে নফল বা মানদুবও বলা হয় ।

মুবাহ

যে সকল কাজ করলে কোনোরূপ সাওয়াব নেই, আবার না করলে কোনোরূপ গুনাহও হয় না এরূপ কাজকে মুবাহ বলা হয় । মানুষ ইচ্ছা করলে এরূপ কাজ করতে পারে, আবার ইচ্ছা করলে তা না-ও করতে পারে ।

হালাল-হারাম

পার্থিব জীবন মানুষের জন্য পরীক্ষাগার । আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্যই এ বিশ্বজগতের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন । তিনি বলেন-

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَّا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا

অর্থ : “তিনিই সে সত্তা যিনি তোমাদের জন্য এ পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৯)

আর এ সবকিছু সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো মানুষকে পরীক্ষা করা । এজন্য আল্লাহ তায়ালা সৃষ্ট বস্তুর কিছু কিছু হালাল করে দিয়েছেন আর কিছু কিছু বস্তুকে হারাম করে দিয়েছেন । যেসব বস্তু মানুষের জন্য সামগ্রিকভাবে

 

কল্যাণকর সেগুলোকে হালাল করেছেন । আর যেসব বস্তু মানুষের জন্য অকল্যাণকর তা হারাম করে দিয়েছেন । অতঃপর নবি-রাসুলও আসমানি কিতাবের মাধ্যমে হালাল-হারামের পরিচয় সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন । সুতরাং মানুষের উচিত হালালকে গ্রহণ করা ও যাবতীয় হারাম বস্তু ও কাজকে বর্জন করা । এ পাঠে হালাল ও হারাম সম্পর্কে আমরা জানতে চেষ্টা করব ।

হালাল

হালাল অর্থ- বৈধ, সিদ্ধ, আইনানুগ বা অনুমোদিত বিষয় । এছাড়া পবিত্র, গ্রহণযোগ্য ইত্যাদি অর্থেও হালাল শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ইসলামি পরিভাষায় যে সকল বিষয়ের বৈধ হওয়া কুরআন-হাদিস দ্বারা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত, শরিয়তে তাকে হালাল বলা হয়। হালাল কথা, কাজ বা বস্তু সবই হতে পারে । যেমন- যেসব বস্তু বা দ্রব্য ব্যবহার করা শরিয়তে বৈধ তা হালাল দ্রব্য হিসেবে পরিচিত । যেমন- গরুর গোশত, চাল-ডাল, ফলমূল আহার করা, শালীন ও রুচিসম্মত পোশাক পরিধান করা ইত্যাদি । তেমনি আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুল (স.) যেসব কথা বা কাজের অনুমতি দিয়েছেন সেগুলো হালাল কাজ হিসেবে স্বীকৃত। যেমন- সত্য কথা বলা, সুন্নত সম্মত পন্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য করা, মানুষের উপকার করা ইত্যাদি । হারাম

হারাম হলো হালালের বিপরীত । হারাম অর্থ নিষিদ্ধ, মন্দ, অসংগত, অপবিত্র ইত্যাদি । পরিভাষায় যে সকল কাজ বা বস্তু কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশে অবশ্য পরিত্যাজ্য, বর্জনীয় তাকে হারাম বলা হয় । অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুল (স.) যেসব কাজ করতে বা যেসব বস্তু ব্যবহার করতে সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন সেসব কাজ বা বস্তু মানুষের জন্য হারাম । যেমন সুদ, ঘুষ, জুয়াখেলা, শূকরের গোশত খাওয়া, মদ পান করা ইত্যাদি হারাম ।

হালাল-হারামের সংখ্যা

আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে হালাল ও হারাম সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন । মহানবি (স.) বলেছেন-

الْحَلَالُ بَيْن وَالْحَرَام بَيْن

অর্থ : “হালাল বিষয় সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত । আর হারামও সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত ।” (বুখারি ও মুসলিম)

পৃথিবীতে হালাল জিনিস বা বস্তু অগণিত । এর কোনো সীমা পরিসীমা নেই । এগুলো আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত হিসেবে চিহ্নিত । আল্লাহ তায়ালা বলেন- وإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا

অর্থ : “তোমরা যদি আল্লাহর নিয়ামত গণনা করতে চাও তবে গুনে তা শেষ করতে পারবে না ।” (সূরা ইবরাহিম, আয়াত ৩৪)

 

 

 

শরিয়তের ভাষ্য অনুযায়ী প্রত্যেক বিষয় মুবাহ বা বৈধ। তবে এর বিপক্ষে কুরআন ও হাদিসে যদি কোনোরূপ নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যায় তবে তা হারাম হবে । সুতরাং বোঝা গেল যে, হালালের সংখ্যা অগণিত । আর হারাম বস্তুর সংখ্যা সীমিত ।

এসব হালাল ও হারাম বিষয়গুলো চিনে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় । কেননা হালালকে হারাম মনে করা ও হারাম বিষয়কে হালাল বলে বিশ্বাস করা কুফর । যেহেতু হারাম সীমিত সংখ্যক, সেহেতু নিম্নে বর্তমান সমাজে প্রচলিত কতিপয় হারাম বিষয় ও দ্রব্যের তালিকা উল্লেখ করা হলো :

১. মৃত জীবজন্তু খাওয়া (তবে মৃত মাছ খাওয়া হারাম নয়)।

2. রক্ত পান করা (তবে হালাল জন্তুর গোশতে লেগে থাকা রক্ত হারাম নয়)।

৩. মানুষের গোশত খাওয়া ।

৪. শূকরের গোশত খাওয়া ।

৫. আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে উৎসর্গীকৃত পশুর গোশত খাওয়া ।

৬. মদ্যপান করা।

৭. মাদকদ্রব্য যেমন- হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, আফিম সেবন করা ।

৮. গলা টিপে, উঁচু থেকে ফেলে দিয়ে হত্যাকৃত পশুর গোশত খাওয়া ।

৯. হিংস্র প্রাণী যেমন- বাঘ, সিংহ, ভল্লুক ইত্যাদির গোশত খাওয়া ।

১০. বিষাক্ত ও ক্ষতিকর প্রাণীর গোশত খাওয়া । যেমন- সাপ, বিচ্ছু ইত্যাদি ।

১১. যেসব প্রাণী ময়লা ও নাপাক দ্রব্য খেয়ে বাঁচে তাদের গোশত খাওয়া । যেমন- কাক, শকুন, কুকুর ইত্যাদি ।

১২. গাধা, খচ্চর, হাতি ইত্যাদির গোশত খাওয়া । ১৩. সুদ, ঘুষ ও জুয়ার মাধ্যমে উপার্জিত সম্পদ ।

১৪. চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, প্রতারণার মাধ্যমে উপার্জিত দ্ৰব্য ।

১৫. অবৈধ পণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন ।

১৬. মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, মিথ্যা হলফ করা, গিবত, গালি-গালাজ করা ।

১৭. সর্বোপরি অশ্লীল, অশালীন ও মানুষকে কষ্টদায়ক সকল দ্রব্য, কথা ও কাজ ।

প্রকৃতপক্ষে, কুরআন ও সুন্নতে নিষেধকৃত সকল বস্তুই হারাম । এগুলো থেকে বেঁচে থাকা সকল মুমিনের অপরিহার্য কর্তব্য ।

মানবজীবনে হালালের প্রভাব

আল্লাহ তায়ালা সকল কিছুর স্রষ্টা । তিনিই সবচেয়ে ভালো জানেন কোনটা উপকারী ও কোনটা অপকারী । যেসব দ্রব্য ও বিষয় মানুষের জন্য কল্যাণকর আল্লাহ তায়ালা তা হালাল করে দিয়েছেন । তিনি বলেন-

ييهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَللًا طَيْبًا ن

 

 

অর্থ : “হে মানবজাতি! তোমরা পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু আহার কর ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৬৮) হালাল বস্তু গ্রহণ করার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত গ্রহণ করে এবং সর্বোচ্চ কল্যাণ প্রাপ্ত হয় । হালাল দ্রব্য মানুষকে ইবাদতে উৎসাহিত করে । মানুষ অধিক পরিমাণে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করতে পারে । আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন :

يايها الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا

অর্থ : “হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার কর এবং সৎকাজ কর ।” (সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত ৫১) হালাল ও পবিত্র দ্রব্য মানুষের দেহ ও মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখে । অন্তরে নুর সৃষ্টি করে । ফলে মানুষ অন্যায় ও অসৎ চরিত্রকে ঘৃণা করতে থাকে । মানুষ সৎগুণাবলি সম্পন্ন হয়ে গড়ে ওঠে । বস্তুত হালাল খাদ্য মানুষের মধ্যে পবিত্র ভাব ও আত্মশুদ্ধির উদ্রেক করে । ফলে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে প্রভূত কল্যাণপ্ৰাপ্ত হয় ।

মানবজীবনে হারামের প্রভাব

মানব জীবনে হারাম বস্তু, কথা ও কাজের পরিণাম ও কুফল অত্যন্ত ভয়াবহ । কোনো কোনো হারাম দ্রব্যের মধ্যে এমন উপাদান বিদ্যমান থাকে যা মানুষের মন, মস্তিষ্ক ও শরীরের জন্য চরম ক্ষতিকর । এগুলো অনেক সময় মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত করে । এমনকি অনেক মারাত্মক ও প্রাণনাশক রোগ সৃষ্টি করে । যেমন- মদ, গাঁজা, হেরোইন ইত্যাদি ।

তা ছাড়া আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, হিংস্র প্রাণীর দেহে এমন সব জীবাণু আছে যা মানুষের দেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর ।

হারাম কাজ মানবসমাজেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে । যেমন- সুদ, ঘুষ, জুয়া, লটারি ইত্যাদি । এতে সামাজিক পরিবেশ নষ্ট হয়, নৈতিক মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস হয়, সমাজে বৈষম্য দেখা দেয়, অনেকে সর্বস্বান্ত ও দেউলিয়া হয়ে যায় । এমনকি অনেকে আত্মহত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না ।

হারাম খাদ্যদ্রব্য মানুষের অন্তরে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে । মানুষ অন্যায়, অশ্লীলতা ও অসৎচরিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয় । মানব চরিত্রের সৎগুণাবলি নষ্ট হয়ে যায় । মানুষ ইবাদতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে । তার ইবাদত- দোয়া কবুল হয় না । মহানবি (স.) বলেছেন, “কোনো ব্যক্তি দীর্ঘ সফর করে আসে এবং অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে তার দু'হাত তুলে আল্লাহর নিকট বলতে থাকে, হে আল্লাহ! হে আল্লাহ! কিন্তু তার পানাহার হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম । সুতরাং এমতাবস্থায় তার দোয়া কীভাবে কবুল হতে পারে?” (মুসলিম)

রাসুলুল্লাহ (স.) অন্য হাদিসে বলেছেন- “যে শরীর হারামের মাধ্যমে গঠিত, তা জাহান্নামের ইন্ধন হবে ।” (আহমাদ, বায়হাকি ও দারিমি)

প্রকৃতপক্ষে, হারাম মানুষকে অকল্যাণ ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় । সুতরাং আমরা সদা সর্বদা হারামের ব্যাপারে সতর্ক থাকব । সকল কথা, কাজ ও পানাহারে হালাল পন্থা গ্রহণ করব ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা শরিয়তের আহকাম সংক্রান্ত পরিভাষাগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে শিক্ষককে দেখাবে ।

 

 

 

নমুনা প্রশ্ন

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১. (লা-তাহার) অর্থ কী?

ক. ধমক দেবেন না

খ. নিষেধ করবেন না

গ. আশ্রয় দেবেন না

ঘ. কঠোর হবেন না ।

২. ওহি লেখক সাহাবিদের সংখ্যা কত ছিল ?

খ. ৪২

ক. ২৮

ঘ. ৮৬ ।

গ. ৪৭

৩. মক্কি সূরার বৈশিষ্ট্যে বর্ণনা করা হয়েছে -

i. শিরক-কুফরের পরিচয়

ii. মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের কথা

iii. শরিয়তের সাধারণ নীতিমালা

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i ও ii

খ. i ও iii

গ. ii ও iii

ঘ. i, ii ও iii

নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং ৪ - ৬ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও

আলম সাহেব গ্রামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি । তিনি তাঁর ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার সকল সম্পদ

দখল করে ছোট ভাইয়ের সন্তানদের বাড়ি থেকে বের করে দেন ।

৪. আলম সাহেবের কাজের মাধ্যমে কাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে ?

ক. গরিবদের

খ. অসহায়দের

গ. ইয়াতীমদের

ঘ. বঞ্চিতদের ।

৫. আলম সাহেবের কাজের মাধ্যমে শরিয়তের কোন উৎসের বিধান লঙ্ঘিত হয়েছে ?

ক. কুরআন

খ. হাদিস

গ. ইজমা

ঘ. কিয়াস ।

৬. শরিয়তের দৃষ্টিতে আলম সাহেব হবেন

খ. কাফির

ক. ফাসিক

গ. মুনাফিক

ঘ. যালিম ।

 

 

 

সৃজনশীল প্রশ্ন

১ । সাজিব ও সাজিদ ঘনিষ্ঠ বন্ধু । সাজিব প্রায়ই ফজরের সালাত সূর্যোদয়ের পর এবং আসরের সালাত সূর্যাস্তের সময় আদায় করে । সাজিদ এলাকার যুবকদের সত্য কথা বলা ও নিয়মিত সালাত আদায় করার জন্য আহ্বান জানালে কতিপয় যুবক তার কথা শুনে কটূক্তি করে । যুবকদের অত্যাচার অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছলে সে শিক্ষকের শরণাপন্ন হয়, শিক্ষক কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি পড়ে শোনান—

إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا

ক. ‘ফারগব’ শব্দের অর্থ কী?

খ. ‘আমি মানুষকে সুন্দরতম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি’– বুঝিয়ে লেখ । 

গ. সাজিবের কাজের মাধ্যমে কাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে? ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. সাজিদের কার্যক্রম চিহ্নিত করে তোমার পাঠ্যবইয়ের সংশ্লিষ্ট সূরার আলোকে বিশ্লেষণ কর ।

 

২ । নাসির ও জাবির সাহেব দুই বন্ধু । নাসির সাহেব তার বাড়ির চারপাশে অনেক ফলের গাছ লাগিয়েছেন । মানুষেরা সেই গাছের ছায়ায় বসে আরাম করে এবং পাখিরা ফল খায়। নাসির সাহেব প্রতিবেশীদেরও ফল দেন। আর জাবির সাহেবের দোকানে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রয় হয় । কোনো ভেজাল নেই । তাই অনেক মানুষ রমযান মাসে তার দোকানে বাজার করে ।

ক. শরিয়তের তৃতীয় উৎসের নাম কী ?

খ. হারাম বর্জনীয় কেন?

গ. নাসির সাহেবের কাজটি কী হিসেবে গণ্য হবে? হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. জাবিরের কাজের ফলাফল ইসলামের আলোকে মূল্যায়ন কর ।


ADDED

তৃতীয় অধ্যায়

ইবাদত

মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ইবাদত করা । দৈনন্দিন জীবনে মানুষ মহান আল্লাহর আদেশ যেমন- সালাত, সাওম, হজ, যাকাত পালন করা এবং নিষেধ যেমন- সুদ, ঘুষ, ব... পর্দা, বেহায়াপনা ইত্যাদি পরিহার করে চলাকে ইবাদত বলে । তেমনিভাবে নবি ও রাসুলের দেখানো পথ অনুযায়ী একে অপরের সাথে উত্তম আচার ব্যবহার করাও ইবাদত। মূলত ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্ব প্রকাশ করা হয় । এর মধ্যেই মানুষের কল্যাণ নিহিত রয়েছে ।

এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা -

  • হাক্কুল্লাহ (স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য) ও হাক্কুল ইবাদ (সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য) এর ধারণা লাভ করবো এবং এগুলো আদায়ের পদ্ধতি বর্ণনা করতে পারব;
  • হাক্কুল্লাহ (স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য) ও হাক্কুল ইবাদ (সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য) চিহ্নিত করে বাস্তব জীবনে এর যথাযথ প্রয়োগ করতে পারব;
  • সালাতের পরিচয় ও গুরুত্ব বর্ণনা করতে পারব;
  • সাওমের (রোযার) গুরুত্ব ও শিক্ষা বর্ণনা করতে পারব;
  • যাকাতের ভূমিকা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব; হজের ধারণা ও নিয়মাবলি বর্ণনা করতে পারব;
  • ভ্রাতৃত্ববোধ, শৃঙ্খলাবোধ ও নৈতিকতা অর্জনে হজের শিক্ষা বর্ণনা করতে পারব;
  • অসহায় ও দরিদ্রের অধিকার বর্ণনা করতে পারব;
  • মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারব;
  • ইলম (জ্ঞান) এর ধারণা, প্রকারভেদ ও গুরুত্ব বর্ণনা করতে পারব;
  • শিক্ষার্থীর বৈশিষ্ট্য ও শিক্ষকের গুণাবলি বর্ণনা করতে পারব;
  • ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এবং শিক্ষা ও নৈতিকতার ধারণা বর্ণনা করতে পারব;
  • জিহাদের ধারণা, প্রকারভেদ ও গুরুত্ব বর্ণনা করতে পারব;
  • জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদের পার্থক্য ব্যাখ্যা করতে পারব এবং সন্ত্রাসবাদের কুফল বর্ণনা করতে পারব;
  • জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদের পার্থক্য অনুধাবন করে সন্ত্রাসমুক্ত মানবতাবাদী জীবনযাপনে সচেষ্ট হতে পারব;
  • মৌলিক ইবাদতগুলো পালনের মাধ্যমে নৈতিক ও মানবিক জীবন গঠনে অগ্রসর হতে পারব ।

 

পাঠ ১ ইবাদত

ইবাদত আরবি শব্দ । এর অর্থ হলো চূড়ান্তভাবে দীনতা-হীনতা ও বিনয় প্রকাশ করা এবং নমনীয় হওয়া । আর ইসলামি পরিভাষায় দৈনন্দিন জীবনের সকল কাজ-কর্মে আল্লাহ তায়ালার 

 

 

 

মেনে চলাকে ইবাদত বলা হয় । আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টি করে এ পৃথিবীতে সহজভাবে জীবনযাপন করার জন্য অসংখ্য নিয়ামত দান করেছেন ।

আমরা আল্লাহর বান্দা। তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য । আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলেছেন,

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ 

অর্থ : “জিন ও মানবজাতিকে আমি (আল্লাহ) আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি ।” (সূরা আয্-যারিয়াত, আয়াত ৫৬)

আমরা পৃথিবীতে যত ইবাদতই করি না কেন, সকল ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যই হলো মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা । আর এ ইবাদত একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য না হলে আল্লাহ তা কবুল করবেন না । আল্লাহ তায়ালা বলেন- “তারাতো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে ।” (সূরা আল-বাইয়্যিনা, আয়াত ০৫)

কীভাবে ইবাদত করলে ও জীবনযাপন করলে আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হবেন, তা শেখানোর জন্য নবি-রাসুলগণ প্রেরিত হয়েছিলেন । আল্লাহ তায়ালা তাঁদের অনুসরণ করতে পবিত্র কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেন । মহান আল্লাহ বলেন, “(হে নবি!) আপনি বলুন, তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য কর, যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রাখুন, আল্লাহ তো কাফিরদের পছন্দ করেন না ।” (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ৩২)

উক্ত আয়াত থেকে আমরা বুঝলাম আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কর্তৃক নির্দেশিত পথ ও মত অনুসরণ করার নাম ইবাদত । সুতরাং তাঁদের নির্দেশিত কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পাদন করতে পারলে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হব ।

ইবাদতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো বিবেক-বুদ্ধি ও জ্ঞানের । যদি মানুষ সে বিবেক-বুদ্ধি ও জ্ঞান দিয়ে আল্লাহর ইবাদত করতে না পারে তাহলে সে চতুষ্পদ জন্তু কিংবা তার চেয়েও অধম হয়ে যায় । আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না । তাদের চক্ষু আছে তা দ্বারা দেখে না, তাদের কর্ণ আছে তা দ্বারা শুনে না; এরা পশুর ন্যায় । বরং অধিক নিকৃষ্ট (পশু হতে); তারা হলো অচেতন।” (সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৭৯) । অতএব ইবাদত বলতে শুধু উপাসনাকেই বুঝায় না । বরং আল্লাহর খলিফা (প্রতিনিধি) হিসেবে সকল কার্য আল্লাহর বিধানমতো

করাই হলো ইবাদত । আল্লাহ তায়ালা বলেন- فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلوةُ فَانْتَشِرُ وا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللهِ وَاذْكُرُوا اللهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ )

অর্থ : “সালাত আদায় করার পর তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়বে । আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে ব্যাপৃত হবে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করবে । যাতে তোমরা সফলকাম হও ।” (সূরা আল-জুমুআ, আয়াত ১০)

 

 

 

 

এ আয়াতের মর্ম থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহর আদিষ্ট কাজগুলো পরিপূর্ণভাবে আদায় করে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি ও কৃষিকাজ করা এবং বৈধ পন্থায় সম্পদ উপার্জন ও দুনিয়ার অন্যান্য সকল ভালো কাজ করা ইবাদত। এমনিভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা, তাঁর রহমতের আশা, শাস্তির ভয়, ইখলাস, সবর, শোকর, তাওয়াক্কুল ইত্যাদি সব কাজই ইবাদতের মধ্যে শামিল ।

আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স.)-এর প্রদর্শিত পন্থা যথাযথভাবে অনুসরণ করলে পরকালে আল্লাহ আমাদের পুরস্কৃত করবেন । ফলে দুনিয়া ও আখিরাতে আমরা শান্তি পাব ।

হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদ

ইবাদত প্রধানত দুই প্রকার : (ক) হাক্কুল্লাহ ও (খ) হাক্কুল ইবাদ ।

(ক) হাক্কুল্লাহ (আল্লাহর হক)

আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত অধিকার বা কর্তব্যকে হাক্কুল্লাহ বলে । আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য অনেক ধরনের ইবাদত (কাজ) করি । সেগুলোর মধ্যে কিছু ইবাদত শুধু আল্লাহ তায়ালার জন্য নির্দিষ্ট, এগুলো হলো হাক্কুল্লাহ, যেমন- সালাত (নামায) কায়েম করা, সাওম (রোযা) পালন ও হজ করা ইত্যাদি । এসব কাজ করার পূর্বে প্রত্যেক মানুষকে অন্তর থেকে যা বিশ্বাস করতে হবে তা হলো- আল্লাহ আছেন, তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরিক (অংশীদার) নেই, তিনিই সবকিছুর স্রষ্টা । তাঁর আদেশেই পৃথিবীর সবকিছু আবার ধ্বংস হবে । আমাদের জীবন-মৃত্যু সবই তাঁর হাতে । পৃথিবীর সবকিছুই তাঁর জ্ঞানের আওতাভুক্ত । তাঁর হাতেই সকল সৃষ্টির রিজিক। আমরা তাঁরই ইবাদতকারী । তিনি ব্যতীত উপাসনার উপযুক্ত আর কেউ নেই । এ সবকিছু মনে প্রাণে বিশ্বাস করা ও স্বীকার করাই হলো বান্দার উপর আল্লাহর হক ।

আল্লাহর হক আদায় করতে হলে আমাদের অবশ্যই নিম্নোক্ত কাজগুলো করতে হবে :

১. সামগ্রিক জীবনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব স্বীকার করা ।

আল্লাহর দেওয়া সকল আদেশ-নিষেধ মেনে চলা ।

৩. . সর্বাবস্থায় নিজেকে আল্লাহর নিকট সমর্পণ এবং তাঁর অনুগ্রহ কামনা করা । আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে আল্লাহর বিধানগুলো মেনে চলব; তাতে তিনি আমাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন । ফলে আমরা পরকালে তাঁর থেকে পুরস্কার পাব ।

(খ) হাক্কুল ইবাদ (বান্দার হক)

মানুষ সামাজিক জীব । সমাজবদ্ধ হয়েই মানুষকে বসবাস করতে হয়। আমরা পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে সামাজিকভাবে একসাথে বসবাস করি । একজনের দুঃখে অন্যজন সাড়া দেই । আপদে-বিপদে একে-অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করি । পরস্পরের প্রতি এই সহানুভূতি ও দায়িত্বই হাক্কুল ইবাদ (বান্দার হক বা অধিকার) । কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে জানা যায় যে, ইসলামে বান্দার হক তথা মানবাধিকারের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ।

 

 

 

 

 

 

মানবাধিকার সম্পর্কে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, নিশ্চয় তোমার উপর তোমার প্রতিপালকের, তোমার শরীরের, তোমার স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির হক রয়েছে । অন্যত্র রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেছেন,“এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের ছয়টি অধিকার রয়েছে । যেমন- সালামের জবাব দেওয়া, রোগীকে দেখতে যাওয়া, জানাযায় অংশগ্রহণ করা, দাওয়াত কবুল করা, মজলুমকে সাহায্য করা ও হাঁচির জবাব দেওয়া ।” (বুখারি ও মুসলিম)

মানুষের প্রতি মানুষের হক বা অধিকারকে আটটি ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন : (১) নিকটাত্মীয়ের হক, (২) দূরাত্মীয়ের হক, (৩) প্রতিবেশীর হক, (৪) দেশবাসীর হক, (৫) শাসক-শাসিতের হক, (৬) সাধারণ মুসলমানের হক, (৭) অভাবী লোকের হক এবং (৮) অমুসলিমের হক ।

আমরা আল্লাহর হক পালন করার সাথে সাথে মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হব । কাজ : শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে আল্লাহর হক ও বান্দার হক সম্পর্কিত প্রতিটির উপর তিনটি করে উদাহরণ তৈরি করবে ।

পাঠ ২

সালাত

পরিচয়

সালাত আরবি শব্দ । এর ফার্সি প্রতিশব্দ হলো নামায । এর অর্থ দোয়া, ক্ষমা প্রার্থনা করা ও রহমত (দয়া) কামনা করা । যেহেতু সালাতের মাধ্যমে বান্দা প্রভুর নিকট দোয়া করে, দয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে তাই একে সালাত বলা হয় । ইসলাম যে পাঁচটি রুকনের (স্তম্ভের) উপর প্রতিষ্ঠিত তার দ্বিতীয়টি হলো সালাত । এ সম্পর্কে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন-

بنِي الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلُوةِ وَإِيتَاءِ الزَّكُوةِ وَصَوْمِ

رَمَضَانَ وَالْحَج

অর্থ : “ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত (১) এ সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর রাসুল; (২) সালাত প্রতিষ্ঠা করা; (৩) যাকাত দেওয়া; (৪) রমযানের রোযা রাখা; (৫) হজ করা ।” (সহিহ বুখারি)

কিয়ামতের দিন আল্লাহ সর্বপ্রথম সালাতের হিসাব নেবেন । রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন-

اَوَّلُ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الصَّلُوةُ -

অর্থ : “কিয়ামতের দিন বান্দার কাছ থেকে সর্বপ্রথম নামাযের হিসাব নেওয়া হবে ।” (তিরমিযি)

মহান আল্লাহ মুমিনের উপর দৈনিক পাঁচবার সালাত ফরজ (আবশ্যক) করেছেন । তা হলো-ফজর, যোহর, আসর, মাগরিব ও এশা । সালাত একজন মুমিনকে (বিশ্বাসী) মন্দ ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে ।আল্লাহ তায়ালা বলেন-

 

 

 

 

 

إنَّ الصَّلوةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ

অর্থ : “নিশ্চয় সালাত মানুষকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে ।” (সূরা আল-‘আনকাবুত, আয়াত ৪৫) : শরিয়ত অনুমোদিত কারণ ব্যতীত কখনোই সালাত ত্যাগ করা যাবে না ।

ধর্মীয় গুরুত্ব

একজন মুসলিমের দৈনন্দিন জীবনে সালাতের গুরুত্ব অপরিসীম । সালাত মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সহায়তা করে । এর মাধ্যমে বান্দা তার প্রভুর সান্নিধ্য লাভ করতে পারে । ইমান মজবুত হয়, আত্মা পরিশুদ্ধ হয় । মানুষকে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে অভ্যস্ত করে তোলে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী । সালাতের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুল (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মনোযোগসহ সালাত আদায় করে, কিয়ামতের দিন ঐ সালাত তার জন্য নুর হবে।” (তাবারানি)

একদা হযরত মুহাম্মদ (স.) তাঁর সাথিদের লক্ষ্য করে বললেন- ‘যদি কারও বাড়ির পাশ দিয়ে একটি নদী প্রবাহিত হয় এবং কোনো লোক দৈনিক পাঁচবার ঐ নদীতে গোসল করে, তাহলে কি তার শরীরে কোনো ময়লা থাকবে? সাহাবিগণ উত্তরে বললেন, ‘না’ হে আল্লাহর রাসুল! তখন মহানবি (স.) বললেন- পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ঠিক তেমনি তার (সালাত আদায়কারীর) গুনাহসমূহ দূর করে দেয়। মহানবি (স.) আরও বলেছেন, “সালাত হলো ইমান ও কুফরের মধ্যে পার্থক্যকারী ।” (তিরমিযি)

মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) জামাআতের সাথে সালাত আদায় করার গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন । তিনি বলেন, “জামাআতে সালাত আদায় করলে একাকী আদায় করার চাইতে সাতাশ গুণ বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়।” (বুখারি ও মুসলিম)

আর আল্লাহ তায়ালাও সালাতকে জামাআতের সাথে আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন । আল্লাহ বলেন,

وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ

অর্থ : “তোমরা রুকুকারীদের সাথে রুকু কর ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৪৩)

সামাজিক গুরুত্ব

পবিত্র কুরআনের বহুস্থানে সম্মিলিতভাবে সালাত আদায় করার কথা বলা হয়েছে । সালাতের কারণে দৈনিক পাঁচবার মুসলমানগণ একস্থানে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায় । একে-অপরের খোঁজ-খবর নিতে পারে । সুখে-দুঃখে একে অপরের সহযোগিতা করতে পারে । এতে তাদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয় । এমনকি নামাযের সারিতে দাঁড়াতে গিয়ে উঁচু-নিচু কোনো ভেদাভেদ থাকে না। ফলে সালাত আদায়কারীদের মধ্যে সাম্য সৃষ্টি হয় । সালাত আদায়ের মাধ্যমে মানুষ পারস্পরিক সকল মতপার্থক্য ভুলে একসাথে কাজ করার শিক্ষা পায় ।

 

 

 

 

 

সালাত আমাদেরকে সময়ের গুরুত্ব ও শৃঙ্খলাবোধ শিক্ষা দেয়। নেতার অনুসরণ করতে এবং নিয়মতান্ত্রিক ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করে । আমরা সময়ের প্রতি লক্ষ রেখে নিয়মিত সালাত আদায় করব । জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলব ।

কাজ : শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা গ্রুপভিত্তিক সালাতের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্বের উপর পাঁচটি করে বাক্য তৈরি করবে ।

পাঠ ৩

পরিচয়

সাওম

সাওম আরবি শব্দ । এর ফার্সি প্রতিশব্দ হলো রোযা । এর আভিধানিক অর্থ হলো বিরত থাকা । ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় সাওম হলো- সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিয়তের সাথে পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকা ।

প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যেক নারী ও পুরুষের উপর রমযান মাসের এক মাস সাওম পালন করা ফরজ । এটি ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি । আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সাওমের শিক্ষা ও গুরুত্ব অপরিসীম ।

সাওমের নৈতিক শিক্ষা

সাওম কেবল আমাদের উপরই ফরজ নয় । বরং পূর্বের সকল নবি-রাসুলের উম্মতের উপরও ফরজ ছিল । এর মাধ্যমে সাওম পালনকারীর আত্মিক উৎকর্ষ সাধিত হয় । সাওমের মাধ্যমে মানুষের মনে তাকওয়া (আল্লাহভীতি) ও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয় । ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাতর হয়েও মানুষ মহান আল্লাহর ভালোবাসা ও ভয়ে কিছুই পানাহার করে না ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি লাভ করে না । মহান আল্লাহ বলেন-

كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصَّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

অর্থ : “তোমাদের উপর সাওম (রোযা) ফরজ করা হয়েছে । যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর । যেন তোমরা তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি) অর্জন করতে পার ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৮৩)

আমরা তাকওয়া অর্জনের জন্য রমযান মাসে সিয়াম পালন করব ।

মানুষ লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ-ক্ষোভ ও কামভাবের বশবর্তী হয়ে অনেক মন্দ কাজে লিপ্ত হয় । সাওম মানুষকে এসব কাজ থেকে মুক্ত থাকতে শেখায় । সাওম হলো কোনো ব্যক্তি ও তার মন্দ কাজের মাঝে ঢাল স্বরূপ । মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন-

الصَّيَامُ جَنَّةٌ

অর্থ : “সাওম (রোযা) ঢালস্বরূপ।” (বুখারি ও মুসলিম)

 

 

 

 

সর্বোপরি সাওম পালনের মাধ্যমে দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক প্রশান্তি অর্জিত হয় । সাওমের সামাজিক শিক্ষা

সিয়াম সাধনার ফলে সমাজের লোকদের মাঝে পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা সৃষ্টি হয় । সাওম পালন করে এরূপ ব্যক্তি ক্ষুধার্ত থাকার ফলে সে অন্য আরেকজন অনাহারীর ক্ষুধার জ্বালা সহজে বুঝতে পারে । ক্ষুধা ও পিপাসার যন্ত্রণা যে কীরূপ পীড়াদায়ক হতে পারে তা সে উপলব্ধি করতে পারে। এতে অসহায় নিরন্ন মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতার ভাব জাগ্রত হয় । মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, “এ মাস সহানুভূতির মাস ।” (ইবনে খুযায়মা)

রমযান মাসে রাসুলুল্লাহ (স.) অন্যদের দান-সদকা করতে যেমন উদ্বুদ্ধ করেছেন, তিনি নিজেও তেমনিভাবে খুব দান-সদকা করতেন । হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, “রাসুলুল্লাহ (স.) লোকদের মধ্যে অধিক দানশীল ছিলেন । বিশেষ করে রমযান এলে তার দানশীলতা আরও বেড়ে যেত ।” (বুখারি ও মুসলিম) । সাওম অসহায় ও দরিদ্রকে দান করতে উদ্বুদ্ধ করে ।

সাওমের ধর্মীয় গুরুত্ব

ধর্মীয় দিক থেকেও সাওমের অনেক গুরুত্ব রয়েছে । সকল সৎকাজের প্রতিদান আল্লাহ দশগুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবেন । কিন্তু সাওম এর প্রতিদান সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন-

الصَّوْمُ لِي وَأَنَا أَجْزِئُ بِهِ

অর্থ : “সাওম আমার জন্য আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দেবো।” (বুখারি)

যেহেতু সাওয়াবের আশায় আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাওম পালন করা হয় সেহেতু আল্লাহ তায়ালা রোযাদারের পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেন । যেমন, মহানবি (স.) বলেছেন-

مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ -

অর্থ : “যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সাওয়াবের আশায় রমযান মাসে রোযা রাখে, আল্লাহ তায়ালা তার পূর্বের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেন ।” (বুখারি)

এটি একটি মৌলিক ফরজ কাজ । যদি কেউ তা অস্বীকার করে তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে ।

সাওমের সামাজিক গুরুত্ব

সাওম পালনের মাধ্যমে একজন লোক ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারে । সমাজের নিরন্ন ও অভাবীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতে পারে । সাওম (রোযা) পালনকারী ব্যক্তি অন্যায়-অশ্লীল কথাবার্তা পরিহার করে চলে । হানাহানি থেকে দূরে থাকে । ফলে সমাজে শান্তি বিরাজ করে । অধিক সাওয়াব পাওয়ার আশায় একে অপরকে সাহারি ও ইফতার করায় এবং অভাবীকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে । এতে পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয় এবং সামাজিক বন্ধন আরও মজবুত ও শক্তিশালী হয় । সুতরাং আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় এবং সাওমের সামাজিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে আমাদের সাওম পালন করা উচিত । আমরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সাওম পালন করব ।

 

 

কাজ : শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে সাওমের সামাজিক শিক্ষার উপর একটি অনুচ্ছেদ তৈরি করবে ।

পাঠ ৪

যাকাত

পরিচয়

অর্থনৈতিকভাবে ধনী ও গরিব উভয় শ্রেণির মানুষ সমাজে রয়েছে । ধনী ও গরিবের মাঝে আর্থিক সমন্বয়সাধন করতে মহান আল্লাহ যাকাতের বিধান দিয়েছেন । যাকাত আদায় করলে সমাজের দুর্বল লোকেরাও আর্থিকভাবে সবল হয়ে উঠবে। ফলে ধনী ও গরিবের মাঝে সেতুবন্ধ তৈরি হবে। এতে সমাজে শান্তি- শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বজায় থাকবে । হযরত মুহাম্মদ (স.) যাকাতকে ইসলামের সেতুবন্ধ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন-

الزَّكُوةُ قَنْطَرَةُ الْإِسْلَامِ

অর্থ : যাকাত হলো ইসলামের সেতুবন্ধ ।” (বায়হাকি)

যাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো পবিত্রতা, পরিশুদ্ধতা ও বৃদ্ধি পাওয়া । আর ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনো মুসলিম নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে বছরান্তে তার সম্পদের শতকরা ২.৫০ হারে নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলে । নিসাব হলো ন্যূনতম সম্পদ, যা থাকলে যাকাত ফরজ হয়। এ ক্ষেত্রে যাকাত প্রদানে ধনীর সম্পদ পবিত্র, পরিশুদ্ধ ও বৃদ্ধি পায় । তাই একে যাকাত বলা হয় । ইসলামের দৃষ্টিতে যাকাত গরিবের প্রতি ধনীর দয়া নয় বরং এটা গরিবের অধিকার । তাই আল্লাহ যাকাত আদায় করাকে আবশ্যক করেছেন । আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-

وَأَقِيمُوا الصَّلوةَ وَأَتُوا الزَّكوة

অর্থ : “তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর ।” (সূরা আন-নুর, আয়াত ৫৬)

যাকাতের গুরুত্ব

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে অনেক স্থানে সালাতের সাথে যাকাতের কথাও বলেছেন । যাকাত ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়। যাকাতের সামাজিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে। এসব কারণেই মহান আল্লাহ মুসলমানদের উপর যাকাত ফরজ করেছেন ।

সামাজিক গুরুত্ব

যাকাত সমাজ থেকে অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করে পারস্পরিক সৌহার্দ স্থাপন করে । সামাজিক নিরাপত্তা দানের পাশাপাশি সমাজের মানুষের মাঝে সম্পদের বৈষম্য দূর করে । যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন,

كي لا يَكُونَ دُولَةٌ بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ ط 

 

 

 

 

অর্থ : “যাতে সম্পদ শুধু তোমাদের অর্থশালীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয় ।” (সূরা আল-হাশর, আয়াত ৭)

সুতরাং সমাজে যাকাত ব্যবস্থা চালু করে বৈষম্য দূর করে সাম্যের ভিত্তিতে জীবন গড়ে তোলাই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

নৈতিক গুরুত্ব

যাকাত মানুষের মনে খোদাভীতি সৃষ্টি করে। পবিত্র ও উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে । অপচয় রোধ করতে

শেখায় । সর্বোপরি যাকাত মানুষের আত্মিক প্রশান্তি, নৈতিক উন্নতি, সম্পদের পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতা

নিশ্চিত করে । যেমন, মহান আল্লাহ বলেন-

خُذُ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةٌ تُطَهَّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا

অর্থ : “আপনি তাদের ধন-সম্পদ থেকে সাদাকা (যাকাত) গ্রহণ করুন । এর মাধ্যমে আপনি তাদের পবিত্র এবং পরিশোধিত করবেন।” (সূরা আত্-তাওবা, আয়াত ১০৩)

অতএব নৈতিকভাবে পরিশুদ্ধ হওয়ার জন্য আমরা যাকাত আদায় করব ।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব

ইসলামি অর্থ ব্যবস্থার উৎসগুলোর মধ্যে যাকাত হলো অন্যতম । এর উপর ইসলামি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি ও জনকল্যাণমুখী প্রকল্পসমূহের সাফল্য নির্ভরশীল । এতে সম্পদের প্রবাহ গতিশীল হয় । ধনীর সম্পদ পুঞ্জীভূত না থেকে দরিদ্র লোকদের হাতেও যায় । ফলে রাষ্ট্রের অর্থনীতি সচল হয় । উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং বেকারত্ব হ্রাস পায় । মাথাপিছু আয় বেড়ে যায় । রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত মজবুত ও শক্তিশালী হয় । আর্থিকভাবে অসচ্ছল লোকগুলো ধীরে ধীরে সচ্ছল হতে থাকে । দিনে দিনে সম্পদশালী লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

يَمْحَقُ اللهُ الرَّبُوا وَ يُرْبِي الصَّدَقَتِ،

অর্থ : “আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বাড়িয়ে দেন ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৭৬) আমরাও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য যথাযথভাবে যাকাত আদায়ের চেষ্টা করব ।

ধর্মীয় গুরুত্ব

কোনো মুসলমান যাকাত না দিলে সে আর পরিপূর্ণ মুসলমান থাকতে পারে না । আল্লাহ বলেন- الَّذِينَ لَا يُؤْتُونَ الزَّكُوةَ وَهُمْ بِالْآخِرَةِ هُمْ كَفِرُونَ

অর্থ : “যারা যাকাত দেয় না এবং তারা পরকালও অস্বীকারকারী ।” (সূরা হা-মীম আস্-সাজদা, আয়াত ৭) যাকাত অস্বীকার করা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অস্বীকার করার শামিল । ইসলামি আইনে যাকাত দানের উপযুক্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই যাকাত দিতে হবে। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) যাকাত 

 

 

 

অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন । সালাত ও সাওম শারীরিক ইবাদত । আর যাকাত হলো আর্থিক ইবাদত । সুতরাং যাকাত আদায় করা একজন মুসলিমের ইমানি দায়িত্ব । যাকাত অসহায় ও দরিদ্রের অধিকার

যাকাত প্রদান করা দরিদ্রের প্রতি ধনী লোকের কোনো দয়া বা অনুগ্রহ নয় । বরং যাকাত হলো দরিদ্র লোকের প্রাপ্য বা অধিকার । কেউ ইসলামের অনুসারী হলে তার উচিত স্বেচ্ছায় যাকাত প্রদান করা এবং অসহায় লোকদের নিকট তা পৌঁছে দেওয়া । মহান আল্লাহ বলেন-

وَفِي امْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ 

অর্থ : “আর তাদের (ধনীদের) সম্পদে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতের অধিকার রয়েছে।” (সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত ১৯)

তাই সম্পদশালী ব্যক্তি তার সম্পদ ভোগ করার পূর্বে চিন্তা করবে যে, এতে অসহায়দের অধিকার আছে । তাদের অধিকার অবশ্যই দিতে হবে । অন্যথায় সমুদয় সম্পদ তার জন্য অপবিত্র হয়ে যাবে । পরিণামে তাকে পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে । মহান আল্লাহ বলেন, “আর যারা স্বর্ণ ও রুপা (সম্পদ) জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না তাদেরকে কঠিন শাস্তির সংবাদ দিন ।” (সূরা আত্-তাওবা, আয়াত ৩৪)

আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় করে বেকার ও গরিবদের জন্য অনেক কর্মসংস্থান করা যেতে পারে । এতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে । দারিদ্র্য দূরীভূত হবে এবং দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। ধনী-দরিদ্রের মাঝে সম্পদের বৈষম্য দূর হবে । কাজেই ধনীদের শরিয়তের বিধান অনুসারে যাকাত আদায় করা একান্ত আবশ্যক ।

কাজ: শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে যাকাতের অর্থনৈতিক গুরুত্বের উপর একটি অনুচ্ছেদ তৈরি করবে ।

পাঠ ৫ 

হজ

পরিচয়

হজ ইসলামের পঞ্চম ভিত্তি। 'হজ' এর আভিধানিক অর্থ হলো- সংকল্প করা, ইচ্ছা করা। ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের নির্ধারিত দিনসমূহে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বাইতুল্লাহ (আল্লাহর ঘর) ও সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহ যিয়ারত করাকে হজ বলে । হজ ঐ সমস্ত ধনী-মুসলমানের উপর ফরজ যাদের পবিত্র মক্কায় যাতায়াত ও হজের কাজ সম্পাদন করার মতো আর্থিক ও দৈহিক সামর্থ্য রয়েছে । মহান আল্লাহ বলেন-

 

 

 

وَلِلهِ عَلَى النَّاسِ حُجُ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا ،

অর্থ : “মানুষের মধ্যে যার আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌছার সামর্থ্য আছে তার উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হজ করা অবশ্য কর্তব্য ।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৯৭) ।

সামর্থ্যবানদের জন্য হজ জীবনে একবার পালন করা ফরজ ।

হজের ফরজ ও ওয়াজিব সমূহ

হজের মোট ৩টি ফরজ রয়েছে । যথা-

১. ইহরাম বাঁধা (আনুষ্ঠানিকভাবে হজের নিয়ত করা) ।

২. ৯ই জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা ।

তাওয়াফে যিয়ারত (১০ই জিলহজ ভোর থেকে ১২ই জিলহজ পর্যন্ত যেকোনো দিন কাবা শরিফ তাওয়াফ করা) । হজের ওয়াজিব-৭টি । যথা-

১. ৯ই জিলহজ দিবাগত রাতে মুযদালিফা নামক স্থানে অবস্থান করা ।

২. সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাঈ (দৌড়ানো) করা ।

৩. ১০, ১১, ও ১২ই জিলহজ পর্যায়ক্রমে মিনায় তিনটি নির্ধারিত স্থানে ৭টি করে কংকর (পাথর কণা) শয়তানের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করা ।

৪. কুরবানি করা ।

৫. মাথা কামানো বা চুল কেটে ছোট করা ।

৬. বিদায়ী তাওয়াফ করা (এটি মক্কার বাইরের লোকদের জন্য ওয়াজিব) ।

৭. দম দেওয়া । (ভুলে বা স্বেচ্ছায় হজের কোনো ওয়াজিব বাদ পড়লে তার কাফফারা হিসাবে একটি অতিরিক্ত কুরবানি দেওয়া)।

অপর পৃষ্ঠায় চিত্রের মাধ্যমে হজের কার্যক্রমগুলো দেখানো হলো ।

 

 

 

 

হজের ধর্মীয় গুরুত্ব

ইসলামে হজের গুরুত্ব অপরিসীম । আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে সূরা হাজ্জ নামে একটি সূরা অবতীর্ণ করেছেন । এ ছাড়াও পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ হজের ব্যাপারে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন । রাসুলুল্লাহ (স.) থেকেও হজের গুরুত্বের ব্যাপারে অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে ।

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন-

الحج الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءُ إِلَّا الْجَنَّةُ -

অর্থ : “মাকবুল (আল্লাহর নিকট গ্রহণীয়) হজের বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নেই ।” (বুখারি-মুসলিম) । হজের মাধ্যমে বিগত জীবনের গুনাহ মাফ হয় । মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি হজ করে সে যেন নবজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায় ।” (ইবনে মাজাহ)

হজ অস্বীকারকারী কাফির হয়ে যাবে । আমাদের উচিত আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় হজ করার ব্যাপারে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া ।

সামাজিক গুরুত্ব

হজের মাধ্যমে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব তৈরি হয় । প্রতিবছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলিম একই স্থানে সমবেত হয় । হজ বিশ্ব মুসলিমের মহাসম্মেলন । পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “এবং মানুষের নিকট হজের ঘোষণা করে দাও; তারা তোমার নিকট (মক্কায়) আসবে পায়ে হেঁটে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটের পিঠে আরোহণ করে । তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে ।” (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত ২৭)

হজে এসে সবাই একই রকম পোশাক পরিধান করে আল্লাহর দরবারে নিজেকে সমর্পণ করে । সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ করে বলতে থাকে লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক : হাজির হে আল্লাহ! আমরা তোমার দরবারে হাজির ।

হজের শিক্ষা ও তাৎপর্য

ধন-সম্পদ, বর্ণ-গোত্র ও জাতীয়তার দিক থেকে মানুষে মানুষে পার্থক্য থাকলেও হজ এসব ভেদাভেদ ভুলিয়ে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে শেখায় । হজ মুসলমানদের আদর্শিক ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে। রাজা-প্রজা, মালিক-ভৃত্য সকলকে সেলাইবিহীন একই কাপড় পরিধান করায় । একই উদ্দেশ্যে মহান প্রভুর দরবারে উপস্থিত করে সাম্যের প্রশিক্ষণ দেয় । হজ মানুষকে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলাবোধের শিক্ষা দিয়ে সহানুভূতিশীল করে গড়ে তোলে । বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ শেখায় । পারস্পরিক ভাব ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সৌহার্দবোধ জাগ্ৰত করে । আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করার কারণে সাধারণ মানুষ হাজিদের সম্মান করে থাকে । সুতরাং আল্লাহর রহমত পেতে হলে তাঁর আদেশ পালনার্থে ধনী মুসলমানদের যতশীঘ্র সম্ভব হজ আদায় করা উচিত । আমরাও হজ থেকে শিক্ষা লাভ করে বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হব ।

 

 

 

কাজ : শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের কয়েকটি দলে বিভক্ত করে প্রতি দলের একজনকে ‘হজ বিশ্ব মুসলিমের মহাসম্মেলন' এর উপর ২/৩ মিনিট বক্তৃতা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন ।

পাঠ ৬

মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা ইত্যাদি একজন মানুষের মৌলিক অধিকার । আর এ অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে মানুষ প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে । মানুষ সামাজিক জীব । পৃথিবীর কোনো মানুষই একা তার সকল কাজ করতে পারে না । শিল্পায়নের এ যুগে জীবনধারণের জন্য প্রত্যেক মানুষকেই একে অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয় । সমাজের বিভিন্ন স্তরে এক ব্যক্তির অধীনে একাধিক ব্যক্তি কাজকর্ম করে । এতে কেউ মালিক হয় আবার কেউ হয় শ্রমিক । মালিকের সাথে শ্রমিকের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় । মালিক শ্রেণি যেমন শ্রমিক শ্রেণির সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না তেমনিভাবে শ্রমিক শ্রেণির দৈনন্দিন জীবন মালিক শ্রেণির বেতন-ভাতার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল । নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অন্যের কাজ করে শ্রমের মূল্য গ্রহণ করা ঘৃণার কাজ নয় । আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (স.)ও শ্রমিকের কাজ করেছেন । তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো- কোন প্রকারের উপার্জন উত্তম ও পবিত্র? তিনি বললেন, কোনো ব্যক্তির নিজ শ্রমের উপার্জন এবং সৎব্যবসালব্ধ মুনাফা । (বায়হাকি)

ইসলাম অধীনস্থ লোকদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছে । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَى وَالْمَسْكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنبِ وَابْنِ السَّبِيْلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ

অর্থ : “তোমরা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকিনদের সাথে ভালো আচরণ কর এবং নিকট- প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথি, মুসাফির ও তোমাদের অধীনস্থ যেসব দাস-দাসী (শ্রমিক) রয়েছে তাদের প্রতিও সদয় হও।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত ৩৬)

মালিক ও শ্রমিকের মাঝে এক চমৎকার দৃষ্টান্ত আমরা হযরত আনাস (রা)-এর জীবন থেকে পাই । তিনি বলেন, “আমি দশ বছর যাবৎ রাসুলুল্লাহ (স.)-এর খেদমত করেছি । তিনি আমার সম্পর্কে কখনো উহ! শব্দ বলেননি এবং কখনো বলেননি, এটা করোনি কেন ? এটা করেছ কেন ? আমার বহুকাজ তিনি নিজ হাতে করে দিতেন ।” (বুখারি)

হযরত উমর (রা) আমিরুল মুমিনিন ছিলেন । জেরুজালেম সফরে উটের পিঠে চড়া ও উট টেনে নেওয়ার ব্যাপারে তিনি সাম্য ও মানবতাবোধ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । তিনি উটের পিঠে চড়া ও উটের রশি টানার বিষয়ে নিজের ও ভৃত্যের মাঝে পালাক্রম ঠিক করে নিয়েছিলেন । মালিক-শ্রমিকের এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল ।

 

 

 

বিদায় হজের সময় রাসুল (স.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, একজন অধীনস্থ কর্মচারীকে কতবার ক্ষমা করা যেতে পারে? হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছিলেন-

كُلَّ يَوْمٍ سَبْعِينَ

অর্থ : “দৈনিক সত্তর বার ।” (তিরমিযি)

মনিবের উচিত তার শ্রমিকের শক্তি ও সামর্থ্য বিচার করে তাকে কাজ দেওয়া । রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন-

وَلَا يُكَلِّفُ مِنْ الْعَمَلِ إِلَّا مَا يُطِيقُ

অর্থ : “তাকে (শ্রমিককে) তার সাধ্য ও সামর্থ্যের বাইরে কোনো কাজ দেওয়া যাবে না ।” (মুসলিম)

খাওয়া পরা থেকে আরম্ভ করে সকল কাজে মালিক শ্রমিকের মাঝে কোনো বৈষম্য ইসলাম অনুমোদন করে না । শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, “তারা (যারা তোমাদের কাজ করে) তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। সে (মালিক) যা খায় তার অধীনস্থদেরও যেন তা খাওয়ায় । সে (মালিক) যা পরে তাদেরকে যেন তা পরতে দেয় । আর তাকে এমন কর্মভার দেবে না যা তার ক্ষমতার বাইরে । এমন কাজ (ক্ষমতার বাইরের) হলে তাকে (শ্রমিককে) যেন সাহায্য করে ।” (বুখারি ও মুসলিম)

খুব দ্রুত শ্রমিকের পারিশ্রমিক আদায়ের ব্যাপারে ইসলামের বিধান সুস্পষ্ট । হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন-

أعطوا الْأَجِيرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ تَجِفَّ عَرَقُهُ

অর্থ : “শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।” (ইবনে মাজাহ)

পারিশ্রমিক দিতে অকারণে বিলম্ব করা সমীচীন নয় । শ্রমিক যাতে তার শ্রমের সঠিক মূল্য পায় সে ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, “মজুরের পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিয়োগ করো না ।” একইভাবে শ্রমিককেও তার মালিকের দেওয়া দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার ব্যাপারে ইসলামে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে । হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, “গোলাম (শ্রমিক) যখন তার মালিকের কাজ সুচারুরূপে করে এবং সুষ্ঠুভাবে আল্লাহর ইবাদত করে তখন সে দ্বিগুণ প্রতিদান পায় ।” (বুখারি ও মুসলিম)

মালিক-শ্রমিক যদি ইসলাম স্বীকৃত পন্থায় তাদের সম্পর্ক তৈরি করতে পারে, তাহলে শ্রমিক তার ন্যায্য পারিশ্রমিক পাবে আর মালিকও তার সঠিক শ্রম পাবে । শ্রমিক ও মালিকের মাঝে কোনো দিন মনোমালিন্য হবে না । কল-কারখানায় স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করবে । কাজেই দেশ ও জাতির কল্যাণে আমাদের ইসলাম প্রদত্ত আদর্শ শ্রমনীতি অনুসরণ করা উচিত ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা ক্লাসে শ্রমিকের অধিকারের উপর ১০টি বাক্য তৈরি করবে ।

 

 

 

পাঠ ৭

ইলম (জ্ঞান)

ইলম আরবি শব্দ । এর অর্থ হলো- জ্ঞান, জানা, অবগত হওয়া, বিদ্যা ইত্যাদি । ইসলামি পরিভাষায়, ইলম হলো কোনো বস্তুর প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করা । অপরদিকে ইসলাম অর্থ আনুগত্য করা ও আত্মসমর্পণ করা। তাই প্রতিটি মুসলিম কার আনুগত্য করবে এবং কীভাবে করবে? কার নিকট আত্মসমর্পণ করবে? এবং কীভাবে আত্মসমর্পণ করবে? তা অবশ্যই জানতে হবে । ইলম ব্যতীত তা জানা যাবে না । তাই ইসলামে ইলমের গুরুত্ব অপরিসীম ।

ইসলামে ইলমের গুরুত্ব

ইসলামে ইলম (জ্ঞান) এর গুরুত্ব এত বেশি যে, মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন নাজিলের সূচনা করেছেন

পড়ুন  শব্দ দ্বারা । আল্লাহ ঘোষণা করেছেন—

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ

অর্থ : “পড়ুন আপনার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন ।” (সূরা আলাক, আয়াত ১) । সুতরাং পড়ার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন হয় বিধায় মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে এবং পরিপূর্ণ মানুষরূপে গড়ে উঠতে জ্ঞানচর্চা অপরিহার্য । জ্ঞানবান ব্যক্তি ও অজ্ঞ ব্যক্তি কখনো সমান হতে পারে না । জ্ঞান জ্ঞানীর মর্যাদা সমৃদ্ধ ও সমুন্নত করে । যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন—

يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ، وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَتٍ -

অর্থ : “তোমাদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদের মর্যাদায় সমুন্নত করবেন ।” (সূরা আল-মুজাদালা, আয়াত ১১)

ইসলাম জ্ঞানার্জনকে সকল মুসলিমের উপর ফরজ (আবশ্যক) করেছে । মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন- طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ

অর্থ : “ইলম (জ্ঞান) অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ ।” (ইবনে মাজাহ)

হযরত মুহাম্মদ (স.) অন্যত্র জ্ঞানার্জনকে উত্তম ইবাদত বলে অভিহিত করেছেন । ইলমের অনেক শাখা-প্রশাখা রয়েছে । এর মধ্যে যে ধরনের ইলম অর্জন করলে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করা যায়, বৈধ-অবৈধ বোঝা যায় এবং আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভ করা যায় তাই হলো উত্তম ইলম ।

ইলম-এর প্রকারভেদ

ইলম দুই ভাগে বিভক্ত । যথা: (ক) দীনি ইলম (ধর্মীয় জ্ঞান) ও (খ) দুনিয়াবি ইলম (পার্থিব জ্ঞান)।

 

 

 

 

দীনি ইলম বলতে সাধারণত ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত জ্ঞানকেই বুঝায় । যেমন- কুরআন, হাদিস, ফিকাহ, তাফসির ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞান ।

আর দুনিয়াবি ইলম বলতে শুধু পার্থিব উন্নতির সাথে সম্পৃক্ত জ্ঞানকেই বুঝায় । যেমন- গণিত, বিজ্ঞান, ভূগোল, সাহিত্য, পদার্থ, রসায়ন ইত্যাদির জ্ঞান ।

অন্যভাবে ইলমকে আবার দুভাগে ভাগ করা যায় । যথা: (ক) গ্রহণীয় জ্ঞান (খ) বর্জনীয় জ্ঞান ।

গ্রহণীয় জ্ঞান হলো যে জ্ঞান ইহকাল ও পরকালে মানুষের কল্যাণে আসে । যেমন— নৈতিক জ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৌশল, পদার্থ-রসায়নসহ সকল কল্যাণকর জ্ঞান। আর বর্জনীয় জ্ঞান হলো যে জ্ঞান মানুষের কোনো কল্যাণে আসে না বরং যার দ্বারা ইহকাল ও পরকালে অকল্যাণ সাধিত হয় । যেমন- অনৈতিক জ্ঞান, চুরি, ডাকাতি, অন্যায়, জুলুম, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা । ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক । তবে প্রত্যেক সম্প্রদায় বা দেশ থেকে একদলকে অবশ্যই ইসলাম ধর্মের জ্ঞানে পণ্ডিত হতে হবে, অন্যথায় সকলকেই আল্লাহর নিকট পরকালে কৈফিয়ত দিতে হবে । মহান আল্লাহ বলেন-

فَلَوْلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمُ

অর্থ : “তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ বের হয় না কেন, যাতে তারা দীন সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে ।” (সূরা আত- তাওবা, আয়াত ১22)

সুতরাং আমাদের মধ্যে একদল লোককে অবশ্যই দীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে । ইসলামের দৃষ্টিতে দীনি শিক্ষার ব্যাপারে যেমন গুরুত্ব রয়েছে তেমনিভাবে পার্থিব শিক্ষা অর্জনেরও গুরুত্ব রয়েছে । তবে তা অবশ্যই আল্লাহর কোনো বিধানের পরিপন্থী হতে পারবে না । বরং তার সাথে নৈতিকতার সমন্বয় থাকতে হবে । কারণ শিক্ষার সাথে নৈতিকতা থাকলেই কেবল মানুষের মনুষ্যত্ব বিকশিত হয় । আর শিক্ষার সাথে নৈতিকতা না থাকলে মানুষের মনুষ্যত্ব ধ্বংস হয়ে যায় ।

মূলত ইসলামের উদ্দেশ্য হলো মানুষের কল্যাণ করা । যেমন মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন- “দীন হলো কল্যাণ করা।” (মুসলিম)। তাই যেসব ইলম মানবজীবনে কল্যাণ সাধন করে তা অর্জন করা অবশ্যই কর্তব্য । সুতরাং যে ইলম মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ সাধন করবে তা আমরা শিখব ও শিখাব ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে গ্রহণীয় জ্ঞান ও বর্জনীয় জ্ঞানের উপর ৫টি করে উদাহরণ পেশ করবে ।

 

 

 

 

 

ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা

পাঠ ৮

শিক্ষার্থীর বৈশিষ্ট্য

যে নিয়মিত লেখাপড়া করে এবং শেখার প্রতি আগ্রহী ও যত্নশীল থাকে তাকে শিক্ষার্থী বলা হয় । একজন প্রকৃত শিক্ষার্থীর কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক । নিম্নে একজন আদর্শ শিক্ষার্থীর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো-

১. শিক্ষকগণের আদেশ-নিষেধ মেনে চলা ।

২. সাক্ষাৎ হলে বিনয়ের সাথে সালাম দিয়ে তাঁদের খোঁজ-খবর নেওয়া ।

৩. শিক্ষক যা শিক্ষা দেন তা মনোযোগ সহকারে শোনা ও পালন করা । 

8.   সব সময় শিক্ষকগণের সাথে নম্র, ভদ্র ও উত্তম আচরণ করা ।

৫. সহপাঠীদের সাথে সদ্ভাব ও সুসম্পর্ক বজায় রাখা ।

৬. নিয়মিত শ্রেণিতে উপস্থিত থাকা ।

৭. শ্রেণিকক্ষ ও বিদ্যালয়ের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা । 

৮. শরীর ও পোশাক-পরিচ্ছদ পরিচ্ছন্ন রাখা ।

৯. শ্রেণিকক্ষে বা অন্য কোথাও শিক্ষকের সাথে দেখা হলে সাথে সাথে দাঁড়িয়ে সম্মান করা ।

১০. অনুমতি নিয়ে শ্রেণিকক্ষের বাইরে যাওয়া । 

১১. জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষকদের উত্তম শিক্ষা মেনে চলা ।

১২. শিক্ষকগণ অপছন্দ করেন এমন কাজ না করা ।

১৩. কোনো অবস্থাতেই কারও সাথে অভদ্র আচরণ না করা ।

১৪. সর্বাবস্থায় শিক্ষকের কল্যাণ কামনা করা ও মৃত্যুর পর তাঁদের জন্য দোয়া করা ।

১৫. সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া ।

১৬. শেখার প্রতি উৎসাহী হওয়া ও সর্বদা শিক্ষকের সাহচর্যে থাকার চেষ্টা করা ।

১৭. সবকিছু বুঝেশুনে পড়া, না বুঝে পড়ার অভ্যাস ত্যাগ করা ।

১৮. শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে যা পাঠদান করবেন তা লিখে নেওয়া ।

১৯.   জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে লজ্জাশীলতা পরিহার করা ।

২০. প্রতিদিনের পড়া নিয়মিতভাবে আয়ত্ত করা ।

২১. পরের দিনের পড়া পূর্বের দিন দেখে ক্লাসে যাওয়া ।

ইমাম শাফেয়ি (র.) ছাত্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাঁর শিক্ষক আল্লামা ওয়াকি (র.)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন— “ছাত্রের একমাত্র বৈশিষ্ট্য হলো সকল পাপকাজ বর্জন করা ।”

আমরা শিক্ষার্থীর এ বৈশিষ্ট্যগুলো আয়ত্ত করব ও আদর্শ ছাত্র হব ।

 

 

 

কাজ : শিক্ষার্থীরা একজন আদর্শ শিক্ষার্থীর বৈশিষ্ট্যের উপর ৫টি প্ল্যাকার্ড বাড়ির কাজ হিসেবে তৈরি করে আনবে এবং শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে ।

পাঠ ৯

শিক্ষকের গুণাবলি

যিনি আমাদের শিক্ষা দেন তিনি শিক্ষক । পৃথিবীতে সবচাইতে সম্মান ও মর্যাদার পেশা হলো শিক্ষকতা । আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) নিজেকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেছেন-

انَّمَا بُعِثْتُ مُعَلِّما

অর্থ : “আমাকে শিক্ষক হিসেবেই প্রেরণ করা হয়েছে ।” (ইবনে মাজাহ)

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পেশার লোকের বৈশিষ্ট্যগুলোও শ্রেষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন । নিম্নে শিক্ষকের কতিপয় বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলো :

ক. একজন ভালো শিক্ষক অবশ্যই আদর্শবান হবেন । তিনি- (১) আদর্শিক জ্ঞানের অধিকারী হবেন; (২) নিজস্ব ধর্মীয় দর্শন ও অন্যান্য জীবন দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান রাখবেন; (৩) উত্তম আদর্শের ভিত্তিতে তিনি ছাত্রদের গড়ে তুলবেন; (৪) কথা ও কাজে মিল রাখবেন; (৫) আদর্শ প্রচারে কৌশলী ও সাহসী হবেন; (৬) শিক্ষকতাকে নিজের জীবনের পেশা ও ব্রত হিসেবে নেবেন; (৭) দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণকে সামনে রেখে এ পেশায় আত্মনিয়োগ করবেন ও (৮) অন্যায়ের ব্যাপারে আপসহীন হবেন ।

খ. একজন ভালো শিক্ষক অবশ্যই গভীর জ্ঞানের অধিকারী হবেন । তিনি- (১) সবসময় জ্ঞানচর্চা করবেন; (২) ক্লাসে পড়ানোর জন্য আগেই প্রস্তুতি নেবেন; (৩) সমসাময়িক বিষয়ে ধারণা রাখবেন; (৪) মেধা বিকাশে সহায়ক বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেবেন; (৫) বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করবেন ।

একজন ভালো শিক্ষক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হবেন । তিনি- (১) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবেন; (২) শালীন, মার্জিত ও ব্যক্তিত্বরক্ষাকারী পোশাক পরিধান করবেন; (৩) বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও প্রকাশভঙ্গির অধিকারী হবেন; (৪) মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখবেন; (৫) নিয়মনীতির ক্ষেত্রে কঠোর হবেন; (৬) সুস্থ মন ও দেহের অধিকারী হবেন ।

ঘ. একজন ভালো শিক্ষক ছাত্রদের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালোবাসা সম্পন্ন হবেন । তিনি-

(১) স্নেহ-মমতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করবেন ।

(২) সকল শিক্ষার্থীকে সমান চোখে দেখবেন ।

 

 

 

 

(৩) ছাত্রদের মাঝে জ্ঞান লাভের উৎসাহ তৈরি করবেন । 

(৪) প্রয়োজনে একটি বিষয় বার বার বলবেন।

(৫) ছাত্রদের একান্ত আপনজন হবেন ।

(৬) শিক্ষার্থীদের অহেতুক ধমক দেবেন না অথবা শাসন করবেন না ।

(৭) তাদেরকে প্রহার বা তাদের প্রতি নির্মমতা প্রদর্শন করবেন না বরং দরদি মন নিয়ে তাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন । প্রখ্যাত সাহাবি মুআবিয়া ইবনুল হাকাম আস-সুলানি রাসুল (স.) সম্পর্কে বলেন, “আমি তাঁর পূর্বে ও পরে তাঁর চেয়ে সুন্দর শিক্ষাদানকারী শিক্ষক আর দেখিনি । আল্লাহর কসম তিনি আমাকে বকাবকি করেননি, মারেননি এবং গালমন্দও করেননি ।” (মুসলিম)

ঙ. একজন ভালো শিক্ষক বিচক্ষণ হবেন । তিনি ছাত্রদের মনমেজাজ, পছন্দ-অপছন্দ ও গ্রহণ করার ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ে দৃষ্টি দেবেন ।

চ. একজন ভালো শিক্ষক প্রতিষ্ঠানের প্রতি হবেন আন্তরিক ও দরদি । প্রশাসনের সাথে থাকবে তাঁর সুসম্পর্ক। কর্মজীবনে আমরা শিক্ষকতার মহান পেশায় নিযুক্ত হলে এসব বৈশিষ্ট্য অর্জন করব এবং আদর্শ শিক্ষক হব।

কাজ : শিক্ষার্থীরা শ্রেণিতে একজন ভালো শিক্ষকের গুণাবলির উপর ১০টি বাক্য লিখবে ।

পাঠ ১০

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক

শিক্ষক হলেন আদর্শ জাতি গঠনের কারিগর । পিতা-মাতার পরই শিক্ষকের মর্যাদা । শিক্ষক পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্র । পিতা-মাতা সন্তানকে জন্ম দিয়ে শুধু লালন-পালন করেন । পক্ষান্তরে শিশুদেরকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলেন একজন শিক্ষক ।

শিক্ষার্থীরা অনুকরণপ্রিয় । কাজেই একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের যে শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন, শিক্ষার্থীরা তাই শিখবে । শিক্ষার্থীদের জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী হবে শিক্ষকরাই ছোট বেলায় তা শিখিয়ে দেন । শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় নিয়ম-কানুন, আদব-কায়দা, শিষ্টাচার, বিনয়, নম্রতা, নিয়মানুবর্তিতা, দয়া, সহানুভূতি ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে থাকেন, যা তারা পরিণত বয়সে কাজে লাগিয়ে সার্বিক উন্নতি লাভ করে । ছাত্রদের সার্বিক কল্যাণ কামনায় শিক্ষকগণ যেভাবে ত্যাগের পরিচয় দেন তার জন্য শিক্ষকগণের যথাযথ সম্মান করা আমাদের কর্তব্য ।

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হলো আত্মার সম্পর্ক। এটি পিতা-পুত্রের সম্পর্কের ন্যায়। পিতা যেমন সর্বদা পুত্রের কল্যাণ কামনা করেন ও তাকে কল্যাণের পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করেন, শিক্ষকও তেমনি তাঁর ছাত্রের কল্যাণ কামনা করেন ও তাকে সৎ পথ দেখান। পুত্র তার পিতা থেকে সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়, অন্যদিকে ছাত্রও তার শিক্ষক থেকে জ্ঞানের উত্তরাধিকারী হয়। পুত্র যেমন পিতা থেকে প্রাপ্ত সম্পদের পরিচর্যা করে বড় সম্পদশালী হতে পারে, শিক্ষার্থীও তেমনি শিক্ষক থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান সমৃদ্ধ করে বড় জ্ঞানী হতে পারে।

 

 

নবি ও রাসুল (আ.) গণ হলেন শিক্ষক আর তাঁদের উম্মত হলো তাঁদের ছাত্র। রাসুলুল্লাহ (স.) এই উম্মতের জ্ঞানীদেরকে নবিদের উত্তরাধিকারী বলেছেন । তিনি বলেন, “আলেমগণ (জ্ঞানীরা) হলেন নবিদের উত্তরাধিকারী । তাঁরা সম্পদ ও মালের উত্তরাধিকারী নন, বরং তাঁরা হলেন জ্ঞানের উত্তরাধিকারী ।” (তিরমিযি)

সুতরাং পুত্র ও পিতার মাঝে যেমন উত্তরাধিকারের সম্পর্ক আছে । ছাত্র-শিক্ষকের মাঝেও তেমন সম্পর্ক বিদ্যমান । তাই আমরা এই সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হব । ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলি (রা.) বলেছেন, “যার কাছে আমি একটি শব্দও শিখেছি আমি তার দাস । তিনি ইচ্ছা করলে আমাকে বিক্রি করতে পারেন কিংবা আযাদ করে দিতে পারেন কিংবা ইচ্ছা করলে দাস বানিয়েও রাখতে পারেন ।” তাই তাঁর মতে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হলো ভৃত্য-মুনিব সম্পর্ক । এক বিনম্র শিক্ষার্থীর দৃষ্টিতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এ বিষয়টি ফুটে উঠেছে। বস্তুত ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হবে সুন্দর, যেখানে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, স্নেহ ও ভালোবাসা বিরাজ করবে ।

কাজ : শিক্ষকের সাথে ছাত্রের আচরণ কেমন হওয়া উচিত- শিক্ষার্থীরা এর উপর একটি অনুচ্ছেদ তৈরি করবে।

পাঠ ১১

শিক্ষা ও নৈতিকতা

শিক্ষা

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড । শিক্ষাহীন জাতি মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর মতো। সঞ্চিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাকে নিজের জীবনে সফলভাবে প্রয়োগ করাকেই শিক্ষা বলে । এই শিক্ষা মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে সাহায্য করে এবং মানব হৃদয়কে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে । শিক্ষা বলতে আমরা বুঝি মানুষের শরীর, মন ও আত্মার সমন্বিত বিকাশসাধন । এখানে শিক্ষা বলতে বিশেষভাবে ইসলামি শিক্ষাকেই বোঝানো হয়েছে । আর যে শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণরূপে তুলে ধরা হয়েছে তাকে ইসলামি শিক্ষা বলে । এককথায় কুরআন ও হাদিসের আলোকে সমন্বিত শিক্ষাই হলো ইসলামি শিক্ষা । এ শিক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সৎ, চরিত্রবান, খোদাভীরু, দেশপ্রেমিক, দায়িত্বশীল ও সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে ।

ইসলাম শিক্ষার মূল উৎস হলো দু'টি—

১. আল-কুরআন : এই কুরআনে মানবজাতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবকিছুই মহান আল্লাহ বর্ণনা করেছেন । মহান আল্লাহ বলেন-

مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَبِ مِنْ شَيْءٍ

অর্থ : “কিতাবে (কুরআনে) কোনো কিছুই আমি বাদ দেইনি ।” (সূরা : আল-আনআম, আয়াত ৩৮) অন্যত্র আল্লাহ আরও বলেন-

 

 

 

وَنَزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَبَ تِبْيَانَ لِكُلِّ شَيْءٍ

অর্থ : “আমি সকল বিষয়ের বর্ণনা দিয়ে আপনার উপর কিতাব (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি ।” (সূরা আন্-নাহল,

আয়াত ৮৯)

২. আল হাদিস : রাসুলুল্লাহ (স.)-এর বাণী, কাজ ও মৌন সম্মতি হলো হাদিস । এটি ইসলামি শিক্ষার

দ্বিতীয় উৎস । হাদিসের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-

وَمَا الكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ فى وَمَا تَهكُم عَنْهُ فَانْتَهُوا

অর্থ : : “রাসুল (স.) তোমাদের যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর । আর যা থেকে তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক।” (সূরা আল-হাশর, আয়াত ৭)

কুরআন ও হাদিস ব্যতীত ইসলাম ধর্মবিশারদদের ঐকমত্য (ইজমা) এবং তাঁদের সাদৃশ্যমূলক অভিমত (কিয়াস) ইসলামি শিক্ষার যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ উৎস ।

একজন মুসলমানের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জীবনের সর্বস্তরে আল্লাহর বিধিবিধান মেনে নেওয়া ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করাই হলো ইসলামি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। মূলত ইসলামি শিক্ষার ভিত্তি : তাওহিদ (আল্লাহর একত্ববাদ), রিসালাত (আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নবি ও রাসুলগণ (আ.)-এর কার্যক্রম ও দাওয়াত) ও আখিরাত (মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের হিসাব-নিকাশ ও জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি) এ তিনটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। আমরা এগুলোর আলোকে জীবন গড়ব এবং জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করতে চেষ্টা করব ।

নৈতিকতা

সততা, সদাচার, সৌজন্যমূলক আচরণ, সুন্দর স্বভাব, মিষ্টি কথা ও উন্নত চরিত্র- এ সবকিছুর সমন্বয় হলো নৈতিকতা । একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাল-চলন, উঠা-বসা, আচার-ব্যবহার, লেন-দেন সবকিছুই যখন প্রশংসনীয় ও গ্রহণযোগ্য হয় তখন তাকে নৈতিক গুণাবলি সম্পন্ন ব্যক্তি বলে । এই নৈতিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে রাসুলুল্লাহ (স.) সর্বোত্তম লোক বলে অভিহিত করেছেন । তিনি বলেছেন, “নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম, যার চরিত্র উত্তম ।” (বুখারি ও মুসলিম)

নৈতিকতা হলো ব্যক্তির মৌলিক মানবীয় গুণ এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যা অর্জন করলে তার জীবন সুন্দর ও উন্নত হয়। এর মাধ্যমে সে অর্জন করে সম্মান ও মর্যাদা। ইসলামি শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া । নীতিহীন ও চরিত্রহীন মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট । মহান আল্লাহ বলেন, “তাদের হৃদয় আছে উপলব্ধি করে না, চোখ আছে দেখে না; কান আছে শুনে না; এরা হলো চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়, বরং তার থেকেও নিকৃষ্ট । আর এরাই হলো গাফিল ।” (সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৭৯)

আমরা নৈতিকগুণে সমৃদ্ধ হব এবং তা চর্চা করে উত্তম মানুষ হব ।

 

 

 

নৈতিকতার গুরুত্ব

ইসলামি জীবন ব্যবস্থায় নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম । মানুষকে ইমান ও নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার জন্য

মহানবি (স.) প্রেরিত হয়েছিলেন । তিনি বলেন, “আমি মহান নৈতিক গুণাবলিকে পরিপূর্ণতা দান করার জন্যই প্রেরিত হয়েছি।” (বুখারি) নৈতিকতার কথা শুধু মুখে বললে চলবে না । বরং বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শসমূহ জীবনে

বাস্তবায়ন করে নৈতিকতার প্রতিফলন ঘটাতে হবে ।

মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) নীতিবান লোককে পরিপূর্ণ মুমিন হিসেবে অভিহিত করে বলেন-

اكمل الْمُؤْمِنِينَ إِيْمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا -

অর্থ : “চরিত্রের বিচারে যে লোকটি উত্তম মুমিনদের মধ্যে সেই পূর্ণ ইমানের অধিকারী ।” (তিরমিযি)

মানুষের নৈতিকতা যত উন্নত হবে, সে তত উত্তম মানুষে পরিণত হবে । এভাবে সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (স.)-এর প্রিয়পাত্র হয়ে যাবে । মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) আরও বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সেই লোকটিই আমার নিকট অধিক প্রিয় যার আখলাক (নৈতিকতা) সবচাইতে সুন্দর ।” (বুখারি) । এমনিভাবে জনৈক ব্যক্তি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর নিকট জানতে চাইলেন মহান আল্লাহ মানুষকে অনেক কিছু দান করেছেন; এর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান দান কোনটি? নবি করিম (স.) বললেন, “সবচেয়ে মূল্যবান দান সুন্দর চরিত্র ।”

আমাদের উচিত সুন্দর চরিত্র ও নৈতিক আচরণ অর্জন করে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর প্রিয়পাত্র হওয়া । ইসলামি শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিকতা সম্পর্কে জানা ও তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা অধিকতর সহজ । ইসলামি শিক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি পরিপূর্ণ নৈতিকতা লাভ করতে পারে । তাই বলা যায় যে, নৈতিক শিক্ষা ইসলামি শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ও নৈতিকতা বিষয়ে ১০টি বাক্য বাড়ির কাজ হিসেবে তৈরি করে আনবে এবং শ্রেণি শিক্ষককে দেখাবে ।

পাঠ ১২

জিহাদ

পরিচিতি

জিহাদ আরবি শব্দ । এর আভিধানিক অর্থ পরিশ্রম, সাধনা, কষ্ট, চেষ্টা ইত্যাদি । আর ইসলামি পরিভাষায় জান-মাল, ইলম, আমল, লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আল্লাহর দীনকে (ইসলামকে সমুন্নত করাই হলো জিহাদ । অনেকেই জিহাদ বলতে (শুধু) রক্তপাত ও কতল (হত্যা) বোঝেন । এটা সঠিক নয়। কেননা জিহাদ একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। পৃথিবীর যা কিছু উত্তম তাতেই আল্লাহর

 

 

 

সন্তুষ্টি । আর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই শুধু জিহাদ হতে পারে । আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন-

وَجَاهِدُوا فِي اللهِ حَقَّ جِهَادِهِ ط

অর্থ : “তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ কর যেভাবে জিহাদ করা উচিত ।” (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত ৭৮)

বস্তুত সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে এবং অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব ধরনের চেষ্টা, শ্রম ও সাধনাই হলো জিহাদ।

জিহাদের প্রকারভেদ

ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদ তিন প্রকার-

(১) স্বীয় নফসের (প্রবৃত্তির) সাথে জিহাদ করা । যেমন হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন-

الْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِي طَاعَةِ اللهِ

অর্থ : “প্রকৃত মুজাহিদ সে ব্যক্তি, যে আল্লাহর আনুগত্য করার ব্যাপারে নিজের নফসের (কুপ্রবৃত্তির সাথে জিহাদ করে ।” (মুসনাদে আহমাদ) এরূপ জিহাদকে রাসুলুল্লাহ (স.) সবচাইতে বড় জিহাদ বলে অভিহিত করেছেন । তিনি বদর যুদ্ধ থেকে

ফিরে এসে বলেছেন-

رَجَعْنَا مِنَ الْجِهَادِ الْأَصْغَرِ إِلَى الْجِهَادِ الْأَكْبَرِ

অর্থ : “আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের (কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ) দিকে ফিরে এসেছি ।” (কানযুল উম্মাল) (২) জ্ঞানের সাহায্যে জিহাদ করা। এরূপ জিহাদকে পবিত্র কুরআনে জিহাদে কাবির (বড়) বলা হয়েছে ।

আল্লাহ বলেন-

فَلَا تُطِعِ الْكَفِرِينَ وَجَاهِدُهُم بِهِ جِهَادًا كَبِيرًا O

অর্থ : : “সুতরাং আপনি কাফিরদের আনুগত্য করবেন না এবং আপনি কুরআনের (জ্ঞানের) সাহায্যে তাদের সাথে প্রবল জিহাদ চালিয়ে যান ।” (সূরা আল-ফুরকান, আয়াত ৫২)

(৩) ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা । এটি হলো জিহাদের সর্বোচ্চ স্তর । কেউ ধর্মদ্রোহী হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে আঘাত হানলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ।

জিহাদের গুরুত্ব

জিহাদ ইসলামের একটি আমল । জীবনের সকল ক্ষেত্রে দীনের বৈশিষ্ট্যসমূহ রক্ষা করা এবং ইসলামের বিধিবিধান ও অনুশাসন মেনে চলা যেমন একজন মুমিনের দায়িত্ব, অনুরূপভাবে দীন রক্ষা করা, দীনকে সমুন্নত রাখা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে জিহাদের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করাও তেমনিভাবে তার কর্তব্য । মূলত শান্তির জন্য জিহাদ । বান্দাকে মানবীয় কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্ত করে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর অনুগত বানিয়ে দেওয়াই জিহাদের উদ্দেশ্য ।

 

জিহাদের ফজিলত বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন-

مَا اغْبَرَتْ قَدَمَا عَبْدٍ فِي سَبِيلِ اللهِ فَتَمَسَّهُ النَّارُ

অর্থ : “আল্লাহর পথে যে বান্দার দু'পায়ে ধূলি লাগে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না ।” (বুখারি)

কাজ : ‘জিহাদ অর্থ সন্ত্রাস নয়' শিক্ষার্থীরা এ পাঠের আলোকে শ্রেণিতে একটি অনুচ্ছেদ তৈরি করবে ।

পাঠ ১৩

জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদ

জিহাদ সম্পর্কে পূর্বের পাঠে বর্ণনা করা হয়েছে । আমরা এ পাঠে সন্ত্রাসবাদ (263) সম্পর্কে বর্ণনা করব ।

সন্ত্রাসবাদ বলতে আমরা বুঝি পার্থিব কোনো স্বার্থ লাভের আশায় বিশৃঙ্খলা ও তাণ্ডবলীলার মাধ্যমে

জনসাধারণের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ও তাদের ক্ষতি করা ।

ইসলামি জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে এক শ্রেণির লোক জিহাদ ও সন্ত্রাসকে এক করে ফেলেছে । বস্তুত উভয়ের মাঝে বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান । বলা যায়, এ দুটো পরস্পর বিপরীত । রাজ্য জয়, ক্ষমতা দখল, সম্পদের লোভ, খুন-খারাবি, লুটতরাজ এবং অন্যায় রক্তপাত জিহাদের উদ্দেশ্য নয় । বরং মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে নিয়ে আসা এবং জুলুম ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে ইনসাফ ও ন্যায়ের সুশীতল ছায়াতলে নিয়ে আসাই জিহাদের উদ্দেশ্য ।

মানুষকে সত্যনিষ্ঠ ও নৈতিকগুণে গুণান্বিত করাও জিহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ।

আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلهِ :

অর্থ : “এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ।” (সূরা আল- আনফাল, আয়াত ৩৯)

পক্ষান্তরে, সন্ত্রাসবাদের উদ্দেশ্য হলো অন্যায়ভাবে রক্তপাত করে রাজ্য জয়, ক্ষমতা দখল, সম্পদ অর্জন করা এবং লুটতরাজ ও খুন-খারাবির মাধ্যমে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা ।

ইসলাম জিহাদের মাধ্যমে মুসলমানদের রক্তপাত করতে শিখায়নি । বরং ইসলাম যে জিহাদের কথা বলে তাতে রক্তপাত নয়, মানবতার দিকনির্দেশনা দেয়। মুসলমানদের কোনো জিহাদেই নিরপরাধ সাধারণ লোকজনের কোনো ক্ষতি হয়নি । রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবদ্দশায় তিনি প্রায় একশত-এর কাছাকাছি

 

 

 

জিহাদে (যুদ্ধে) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন । সবগুলো জিহাদ মিলিয়ে উভয়পক্ষে পাঁচশ এর কম লোকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ।

বর্তমান যুগে জিহাদের নামে যেভাবে বোমাবাজি, জঙ্গিবাদ, খুন-খারাবি ও নিরীহ লোকজনকে হত্যা করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে, তার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই । বরং এটা সন্ত্রাসেরই নামান্তর । বস্তুত জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদ এক নয় ।

উপরোক্ত আলোচনা ও বাস্তব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, জিহাদে সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই । জিহাদের সাথে সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক নেই । সুতরাং আমরা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও ইতিহাস জেনে জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদের মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন করব এবং প্রকৃত মুসলমান হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার চেষ্টা করব ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা দু'দলে বিভক্ত হয়ে জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদের পার্থক্য আলোচনা করবে ।

নমুনা প্ৰশ্ন

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১. ইসলামের কোন মূল স্তম্ভের বর্ণনায় একটি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে?

ক. সালাত

খ. যাকাত

গ. সাওম

ঘ. হজ ।

২. ‘যাতে সম্পদ শুধু তোমাদের অর্থশালীদের হাতেই পুঞ্জীভূত না হয় ।' অত্র আয়াত কোন বিষয়টি নির্দেশ করে?

ক. হজ করা

খ. দান করা

গ. যাকাত আদায়

ঘ. সাহায্য করা ।

 

 

 

 

নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং ৩ ও ৪ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও

বেলাল সাহেব বাংলাদেশ থেকে পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমন করেন। হজের সকল বিধি-বিধান সুষ্ঠুভাবে পালন করলেও অসুস্থতার কারণে তাওয়াফে যিয়ারত করতে পারেননি ।

৩. বেলাল সাহেব হজের কোন বিধানটি পালনে অপারগ হয়েছেন ?

ক. মুস্তাহাব

খ. সুন্নত

গ. ওয়াজিব

ঘ. ফরজ ।

৪. এমতাবস্থায় বেলাল সাহেবের করণীয় কী ?

ক. পুনরায় হজ করা

খ. দম প্রদান করা

ঘ. আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা ।

গ. সামর্থ্য থাকলে পুনরায় হজ করা

সৃজনশীল প্রশ্ন

 

১। জনাব শফিকুর রহমান একজন রিকশা চালক । ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলেন । কেউ অসুস্থ হলে তার রিকশায় হাসপাতালে নিয়ে যান। একদা রিকশাচালক জনাব শফিকুর রহমান জনৈক যাত্রীর ব্যাগসহ রেখে যাওয়া পাঁচ লক্ষ টাকা স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নিকট জমা দেন । প্রধান শিক্ষক সাহেব টাকার মালিকের ব্যাগে সংরক্ষিত ঠিকানার মাধ্যমে টাকাসহ ব্যাগ মালিকের বাড়িতে পৌঁছে দেন ।

ক. হজের ওয়াজিব কয়টি?

খ. ইসলাম শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যটি ব্যাখ্যা কর ।

গ. প্রধান শিক্ষক সাহেবের কাজের মাধ্যমে কোন ধরনের ইবাদত পালন হয়েছে? ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. জনাব শফিকুর রহমানের কর্মকাণ্ডগুলো সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আলোকে বিশ্লেষণ কর ।

 

 

 

 

২। সাজ্জাদ ও সাকিব সাহেব দুই বন্ধু। সাজ্জাদ সাহেব একটি পোশাক শিল্পের মালিক। গত রমযানের ঈদে শ্রমিকদের বোনাস দিতে গড়িমসি করায় কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য পেতে একদিন কর্মবিরতি পালন করেন। আর সাকিব সাহেব মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে হাসপাতালে কর্মরত আছেন। তিনি হাসপাতালে নিয়মিত উপস্থিত থেকে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেন। একদিন তাঁর স্কুলজীবনের শিক্ষক চিকিৎসার উদ্দেশ্যে হাসপাতালে এলে তাঁকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানান এবং চিকিৎসার অধিকাংশ ব্যয়ভার বহনসহ যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

কে আদর্শ জাতি গঠনের কারিগর ?

(খ) শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার পরিশ্রমিক দিয়ে দাও - হাদিসটি বুঝিয়ে লেখ।

(গ) সাজ্জাদ সাহেবের আচরণে কার আদর্শ লঙ্ঘিত হয়েছে? ব্যাখ্যা কর ।

(ঘ) সাকিব সাহেবের কাজটি চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট পাঠের আলোকে মূল্যায়ন কর ।