মৃগাঙ্কবাবুর সন্দেহটা যে অমূলক নয় সেটা প্রমাণ হলো পানাগড়ের কাছাকাছি এলে। গাড়ির পেট্রোল ফুরিয়ে গেল। পেট্রোলের ইনডিকেটরটা কিছুকাল থেকেই গোলমাল করছে, সে কথা আজও বেরোবার মুখে ড্রাইভার সুধীরকে বলেছেন, কিন্তু সুধীর গা করেনি। আসলে কাঁটা যা বলছিল তার চেয়ে কম পেট্রোল ছিল ট্যাংকে।
'এখন কী হবে?' জিজ্ঞেস করলেন মৃগাঙ্কবাবু।
'আমি পানাগড় চলে যাচ্ছি', বলল সুধীর, 'সেখান থেকে তেল নিয়ে আসব।'
*পানাগড় এখান থেকে কতদূর?”
'মাইল তিনেক হবে।'
'তার মানে তো দু-আড়াই ঘণ্টা। শুধু তোমার দোষেই এটা হলো। এখন আমার অবস্থাটা কী হবে ভেবে দেখেছ?” মৃগাঙ্কবাবু ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ, কিন্তু আড়াই ঘণ্টা খোলা মাঠের মধ্যে একা পাড়িতে বসে থাকতে হবে জেনে মেজাজটা খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল।
'তাহলে আর দেরি করো না, বেরিয়ে পড়ো। আটটার মধ্যে কলকাতা ফিরতে পারবে তো? এখন সাড়ে তিনটে।”
“ভা পাৱৰ বাৰু।'
‘এই নাও টাকা । আর ভবিষ্যতে এমন ভুলটি করো না কখনো । লংজার্নিতে এসব রিস্কের মধ্যে যাওয়া কখনোই
উচিত নয়।’
সুধীর টাকা নিয়ে চলে গেল পানাগড় অভিমুখে
মৃগাঙ্কশেখর মুখোপাধ্যায় খ্যাতনামা জনপ্রিয় সাহিত্যিক। দুর্গাপুরে একটি ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁকে ডাকা হয়েছিল মানপত্র দেওয়া হবে বলে। ট্রেনে রিজার্ভেশন পাওয়া যায়নি, তাই মোটরে যাত্রা । সকালে চা খেয়ে বেরিয়েছেন, আর ফেরার পথে এই দুর্যোগ । মৃগাঙ্কবাবু কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না, পাঁজিতে দিনক্ষণ দেখে যাত্রা করাটা তাঁর মতে কুসংস্কার, কিন্তু আজ পাঁজিতে যাত্রা নিষিদ্ধ বললে তিনি অবাক হবেন না । আপাতত গাড়ি থেকে নেমে আড় ভেঙে তিনি তাঁর চারদিকটা ঘুরে দেখে নিলেন
মাঘ মাস, খেত থেকে ধান কাটা হয়ে গেছে, চারদিক ধু-ধু করছে মাঠ, দূরে, বেশ দূরে, একটিমাত্র কুঁড়েঘর একটি তেঁতুলগাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এ ছাড়া বসতির কোনো চিহ্ন নেই। আরও দূরে রয়েছে একসারি তালগাছ, আর সবকিছুর পিছনে জমাটবাঁধা বন। এই হলো রাস্তার এক দিক, অর্থাৎ পুব দিকের দৃশ্য । পশ্চিমেও বিশেষ পার্থক্য নেই। রাস্তা থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ হাত দূরে একটা পুকুর রয়েছে। তাতে জল বিশেষ নেই । গাছপালা যা আছে তা—দু একটা বাবলা ছাড়া—সবই দূরে। এদিকেও দুটি কুঁড়েঘর রয়েছে, কিন্তু মানুষের কোনো চিহ্ন নেই। আকাশে উত্তরে মেঘ দেখা গেলেও এদিকে রোদ। মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে একটা কাকতাড়ুয়া ।
শীতকাল হলেও রোদের তেজ আছে বেশ, তাই মৃগাঙ্কবাবু গাড়িতে ফিরে এলেন। তারপর ব্যাগ থেকে একটা গোয়েন্দাকাহিনি বার করে পড়তে আরম্ভ করলেন ।
এর মধ্যে দুটো অ্যাম্বাসাডর আর একটা লরি গেছে তাঁর পাশ দিয়ে, তার মধ্যে একটা কলকাতার দিকে। কিন্তু কেউ তাঁর অবস্থা জিজ্ঞেস করার জন্য থামেনি । মৃগাঙ্কবাবু মনে মনে বললেন, বাঙালিরা এ-ব্যাপারে বড়ো স্বার্থপর হয়। নিজের অসুবিধা করে পরের উপকার করাটা তাদের কুষ্ঠিতে লেখে না। তিনি নিজেও কি এদের মতোই ব্যবহার করতেন? হয়ত তাই । তিনিও তো বাঙালি। লেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতি আছে ঠিকই, কিন্তু তাতে তাঁর মজ্জাগত দোষগুলোর কোনো সংস্কার হয়নি।
উত্তরের মেঘটা অপ্রত্যাশিতভাবে দ্রুত এগিয়ে এসে সূর্যটাকে ঢেকে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঠান্ডা হাওয়া। মৃগাঙ্কবাবু ব্যাগ থেকে পুলোভারটা বার করে পরে নিলেন। এদিকে সূর্যও দ্রুত নিচের দিকে নেমে এসেছে। পাঁচটার মধ্যেই অস্ত যাবে। তখন ঠান্ডা বাড়বে। কী মুশকিলে ফেলল তাঁকে সুধীর!
মৃগাঙ্কবাবু দেখলেন যে, বইয়ে মন দিতে পারছেন না। তার চেয়ে নতুন গল্পের প্লট ভাবলে কেমন হয়? ‘ভারত’ পত্রিকা তাঁর কাছে একটা গল্প চেয়েছে, সেটা এখনও লেখা হয়নি। একটা প্লটের খানিকটা মাথায় এসেছে এই পথটুকু আসতেই । মৃগাঙ্কবাবু নোটবুক বার করে কয়েকটা পয়েন্ট লিখে ফেললেন ।
নাহ্, গাড়িতে বসে আর ভালো লাগে না ।
খাতা বন্ধ করে আবার বাইরে এসে দাঁড়ালেন মৃগাঙ্কবাবু। তারপর কয়েক পা সামনে এগিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখে তাঁর মনে হলো বিশ্বচরাচরে তিনি একা। এমন একা তিনি কোনোদিন অনুভব করেননি।
না, ঠিক একা নয়। একটা নকল মানুষ আছে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে।
ওই কাকতাড়ুয়াটা
মাঠের মধ্যে এক জায়গায় কী যেন একটা শীতের ফসল রয়েছে একটা খেতে, তারই মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে কাকতাড়ুয়াটা। একটা খাড়া বাঁশ মাটিতে পোঁতা, তার সঙ্গে আড়াআড়িভাবে একটা বাঁশ ছড়ানো হাতের মতো দুদিকে বেরিয়ে আছে। এই হাত দুটো গলানো রয়েছে একটা ছেঁড়া জামার দুটো আস্তিনের মধ্যে দিয়ে। খাড়া বাঁশটার মাথায় রয়েছে একটা উপুড় করা মাটির হাঁড়ি। দূর থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু মৃগাঙ্কবাবু অনুমান করলেন সেই হাঁড়ির রং কালো, আর তার ওপর সাদা রং দিয়ে আঁকা রয়েছে ড্যাবা ড্যাবা চোখ মুখ । আশ্চর্য— এই জিনিসটা পাখিরা আসল মানুষ ভেবে ভুল করে, আর তার ভয়ে খেতে এসে উৎপাত করে না। পাখিদের বুদ্ধি কি এতই কম? কুকুর তো এ ভুল করে না। তারা মানুষের গন্ধ পায়। কাক চড়ুই কি তাহলে সে গন্ধ পায় না?
মেঘের মধ্যে একটা ফাটল দিয়ে রোদ এসে পড়ল কাকতাড়ুয়াটার গায়ে। মৃগাঙ্কবাবু লক্ষ করলেন যে, যে জামাটা কাকতাড়ুয়াটার গায়ে পরানো হয়েছে সেটা একটা ছিটের শার্ট। কার কথা মনে পড়ল ওই ছেঁড়া লাল-কালো ছিটের শার্টটা দেখে? মৃগাঙ্কবাবু অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না। তবে কোনো একজনকে তিনি ওরকম একটা শার্ট পড়তে দেখেছেন—বেশ কিছুকাল আগে ।
আশ্চর্য—ওই একটি নকল প্রাণী ছাড়া আর কোনো প্রাণী নেই । মৃগাঙ্কবাবু আর ওই কাকতাড়ুয়া । এই সময়টা খেতে কাজ হয় না বলে গ্রামের মাঠেঘাটে লোকজন কম দেখা যায় ঠিকই, কিন্তু এরকম নির্জনতা মৃগাঙ্কবাবুর অভিজ্ঞতায় এই প্রথম ৷
মৃগাঙ্কবাবু ঘড়ি দেখলেন। চারটা কুড়ি। সঙ্গে ফ্লাস্কে চা রয়েছে। সেটার সদ্বব্যবহার করা যেতে পারে। গাড়িতে ফিরে এসে ফ্লাস্ক খুলে ঢাকনায় চা ঢেলে খেলেন মৃগাঙ্কবাবু। শরীরটা একটু গরম হলো । কালো মেঘের মধ্যে ফাঁক দিয়ে সূর্যটাকে একবার দেখা গেল। কাকতাড়ুয়াটার গায়ে পড়েছে লালচে রোদ। সূর্য দূরের তালগাছটার মাথার কাছে এসেছে, আর মিনিট পাঁচেকেই অস্ত যাবে।
আরেকটা অ্যাম্বাসাডর মৃগাঙ্কবাবুর গাড়ির পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। মৃগাঙ্কবাবু আরেকটু চা ঢেলে খেয়ে আবার গাড়ি থেকে নামলেন । সুধীরের আসতে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি। কী করা যায়?
পশ্চিমের আকাশ এখন লাল। সেদিক থেকে মেঘ সরে এসেছে। চ্যাপটা লাল সূর্যটা দেখতে দেখতে দিগন্তের আড়ালে চলে গেল। এবার ঝপ করে অন্ধকার নামবে ।
কাকতাড়ুয়া ৷
কেন জানি মৃগাঙ্কবাবু অনুভব করছেন প্রতি মুহূর্তেই ওই নকল মানুষটা তাঁকে বেশি করে আকর্ষণ করছে। সেটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে থাকতে মৃগাঙ্কবাবু কতকগুলো জিনিস লক্ষ করে একটা হৃদকম্প অনুভব করলেন।
ওটার চেহারায় সামান্য পরিবর্তন হয়েছে কি ? হাত দুটো কি নিচের দিকে নেমে এসেছে খানিকটা? দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা কি আরেকটু জ্যান্ত মানুষের মতো? খাড়া বাঁশটার পাশে কি আরেকটা বাঁশ দেখা যাচ্ছে? ও দুটো কি বাঁশ, না ঠ্যাং? মাথার হাঁড়িটা একটু ছোটো মনে হচ্ছে না? তিনি কি এই তেপান্তরের মাঠে একা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে চোখে ভুল দেখছেন ? কাকতাড়ুয়া কখনো জ্যান্ত হয়ে ওঠে? কখনোই না ৷
কিন্তু-
মৃগাঙ্কবাবুর দৃষ্টি আবার কাকতাড়ুয়াটার দিকে গেল । কোনও সন্দেহ নেই। সেটা জায়গা বদল করেছে। সেটা ঘুরে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে খানিকটা এগিয়ে এসেছে। এসেছে না, আসছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা, কিন্তু দু পায়ে চলা । হাঁড়ির বদলে একটা মানুষের মাথা । গায়ে এখনো সেই ছিটের শার্ট; আর তার সঙ্গে মালকোঁচা দিয়ে পরা খাটো ময়লা ধুতি । 'বাবু!’
মৃগাঙ্কবাবুর সমস্ত শরীরের মধ্যে দিয়ে একটা শিহরন খেলে গেল। কাকতাড়ুয়া মানুষের গলায় ডেকে উঠেছে এবং এ গলা তাঁর চেনা। এ হলো তাঁদের এককালের গৃহকর্মী অভিরামের গলা। এদিকেই তো ছিল অভিরামের দেশ। একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন মৃগাঙ্কবাবু। অভিরাম বলেছিল সে থাকে মানকড়ের পাশের গাঁয়ে। পানাগড়ের আগের স্টেশনই তো মানকড় মৃগাঙ্কবাবু চরম ভয়ে পিছোতে পিছোতে গাড়ির সঙ্গে সেঁটে দাঁড়ালেন। অভিরাম এগিয়ে এসেছে তাঁর দিকে। এখন সে মাত্র দশ গজ দূরে। ‘আমায় চিনতে পারছেন বাবু?'
মনে যতটা সাহস আছে সবটুকু একত্র করে মৃগাঙ্কবাবু প্রশ্নটা করলেন ।
মানুষেরই মতো দেখাচ্ছে অভিরামকে, তাই বোধহয় মৃগাঙ্কবাবু সাহস পেলেন। বললেন, ‘তোমাকে চিনেছি তোমার জামা দেখে। এ জামা তো আমিই তোমাকে কিনে দিয়েছিলাম।' ‘হ্যাঁ বাবু, আপনিই দিয়েছিলেন। আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন, কিন্তু শেষে এমন হলো কেন বাবু? আমি তো কোনো দোষ করিনি । আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করলেন না কেন?”
মৃগাঙ্কবাবুর মনে পড়ল। তিন বছর আগের ঘটনা। অভিরাম ছিল মৃগাঙ্কবাবুদের বিশ বছরের পুরনো গৃহকর্মী। শেষে একদিন অভিরামের ভীমরতি ধরে। সে মৃগাঙ্কবাবুর বিয়েতে পাওয়া সোনার ঘড়িটা চুরি করে বসে। সুযোগ-সুবিধা দুই-ই ছিল অভিরামের । অভিরাম নিজে অবশ্য অস্বীকার করে । কিন্তু মৃগাঙ্কবাবুর বাবা ওঝা ডাকিয়ে কুলোতে চাল ছুড়ে মেরে প্রমাণ করিয়ে দেন যে, অভিরামই চোর। ফলে অভিরামকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয় । অভিরাম বলল, ‘আপনাদের ওখান থেকে চলে আসার পর আমার কী হলো জানেন? আর আমি চাকরি করিনি কোথাও, কারণ আমার কঠিন ব্যারাম হয়। উদুরি। টাকা-পয়সা নাই । না ওষুধ, না পথ্যি। সেই ব্যারামই আমার শেষ ব্যারাম। আমার এই জামাটা ছেলে রেখে দেয়। সে নিজে কিছুদিন পরে। তারপর সেটা ছিঁড়ে যায়। তখন সেটা কাকতাড়ুয়ার পোশাক হয়। আমি হয়ে যাই সেই কাকতাড়ুয়া। কেন জানেন? আমি জানতাম একদিন না একদিন আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে । আমার প্রাণটা ছটফট করছিল। —হ্যাঁ, মৃত লোকেরও প্রাণ থাকে—আমি মরে গিয়ে যা জেনেছি সেটা আপনাকে বলতে চাইছিলাম ।’
‘সেটা কী অভিরাম?' ‘বাড়ি ফিরে গিয়ে আপনার আলমারির নিচে পিছন দিকটায় খোঁজ করবেন। সেখানেই আপনার ঘড়িটা পড়ে আছে এই তিন বছর ধরে। আপনার নতুন চাকর ভালো করে ঝাড়ু দেয় না, তাই সে দেখতে পায়নি। এই ঘড়ি পেলে পরে আপনি জানবেন অভিরাম কোনো দোষ করেনি।' অভিরামকে আর ভালো করে দেখা যায় না— সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মৃগাঙ্কবাবু শুনলেন অভিরাম বলছে, ‘এতকাল পরে নিশ্চিন্ত হলাম বাবু। আমি আসি । আমি আসি...' মৃগাঙ্কবাবুর চোখের সামনে থেকে অভিরাম অদৃশ্য হয়ে গেল ।
‘তেল এনেছি বাবু।’ সুধীরের গলায় মৃগাঙ্কবাবুর ঘুমটা ভেঙে গেল। গল্পের প্লট ফাঁদতে ফাঁদতে কলম হাতে গাড়ির মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। ঘুম ভাঙতেই তাঁর দৃষ্টি চলে গেল পশ্চিমের মাঠের দিকে। কাকতাড়ুয়াটা যেমন ছিল
তেমনভাবেই দাঁড়িয়ে আছে । বাড়িতে এসে আলমারির তলায় খুঁজতেই ঘড়িটা বেরিয়ে পড়ল। মৃগাঙ্কবাবু স্থির করলেন ভবিষ্যতে আর কিছু গেলেও ওঝার সাহায্য আর কখনো নেবেন না।
লেখক-পরিচিতি সত্যজিৎ রায়ের জন্ম ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায়। তাঁর পূর্ব-প্রজন্মের ভিটা ছিল কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামে। সত্যজিৎ রায় একজন চলচ্চিত্র-নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্পনির্দেশক, সংগীত পরিচালক ও লেখক। তিনি বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের একজন হিসাবে বিবেচিত। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী' (১৯৫৫) বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে কল্পকাহিনি লেখক, প্রকাশক ও চিত্রকর । তিনি ছোটোগল্প ও উপন্যাসও রচনা করেছেন। তাঁর সৃষ্ট জনপ্রিয় চরিত্র গোয়েন্দা ফেলুদা ও প্রোফেসর শঙ্কু । ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অনেক আশা-ভরসা নিয়েই শহরে গিয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, কিছু টাকাপয়সা সাহায্য পেলে আবার নতুন করে দাঁড় করাবেন স্কুলটাকে। আবার শুরু করবেন গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর কাজ। কত আশা !
আশার মুখে ছাই!
কেউ সাহায্য দিল না স্কুলটার জন্য। না চৌধুরীরা। না সরকার। সরকারের কাছে সাহায্য চাইতে গিয়ে তো রীতিমতো ধমকই খেলেন শনু পণ্ডিত। শিক্ষা বিভাগের বড়ো সাহেব শমসের খান বললেন, রাজধানীতে দুটো নতুন হোটেল তুলে, আর সাহেবদের ছেলেমেয়েদের জন্য একটা ইংলিশ স্কুল দিতে গিয়ে প্রায় কুড়ি লাখ টাকার মতো খরচ। ফান্ডে এখন আধলা পয়সা নেই সাহেব। অযথা বারবার এসে জ্বালাতন করবেন না আমাদের। পকেটে যদি টাকা না থাকে, স্কুল বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকুন। এমনভাবে ধমকে উঠেছিলেন তিনি যেন স্কুলের জন্য সাহায্য চাইতে এসে ভারি অন্যায় করে ফেলেছেন শনু পণ্ডিত।
হেঁট মাথায় সেখান থেকে বেরিয়ে চলে এলেও, একেবারে আশা হারাননি তিনি । ভেবেছিলেন সরকার সাহায্য দিল না, চৌধুরী সাহেব নিশ্চয়ই দেবেন। এককালে তো চৌধুরী সাহেবের সহযোগিতা পেয়েই না স্কুলটা দিয়েছিলেন শনু পণ্ডিত ৷
সে আজ বছর পঁচিশেক আগের কথা— আশেপাশে দু-চার গাঁয়ে স্কুল বলতে কিছুই ছিল না । লেখাপড়া কাকে বলে তা জানতই না গাঁয়ের লোক । তখন সবেমাত্র এনট্রান্স পাশ করে বেরিয়েছেন শনু পণ্ডিত। বাইশ বছরের জোয়ান ছেলে । চৌধুরীর তখন যৌবনকাল। গাঁয়েই থাকতেন তিনি। গাঁয়ে থেকে জমিদারির তদারক করতেন। অবসর সময় তাস, পাশা আর দাবা খেলতেন বসে বসে। কথায় কথায় গাঁয়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার ইচ্ছেটা তাঁর কাছে ব্যক্ত করেছিলেন শনু পণ্ডিত । জুলু চৌধুরী বেশ আগ্রহ দেখালেন। বললেন, সে তা বড়ো ভাল কথা, গাঁয়ের লোকগুলো সব গণ্ডমূর্খ রয়ে যাচ্ছে। একটা স্কুলে যদি ওদের লেখাপড়া শেখাতে পারো সে তো বড়ো ভালো কথা। কাজ শুরু করে দাও।
টাকাপয়সা খুব বেশি না দিলেও, স্কুলের জন্য একটা অনাবাদী জমি ছেড়ে দিয়েছিলেন জুলু চৌধুরী। শহর থেকে ছুতোর মিস্ত্রি নিয়ে এসে গুটিকয়েক ছোটো ছোটো টুল আর টেবিলও তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি । একমাত্র সম্বল দু-টুকরো ধেনো জমি ছিল শনু পণ্ডিতের। সে দুটো বিক্রি করে, স্কুলের জন্য টিন, কাঠ আর বেড়া তৈরির বাঁশ কিনেছিলেন তিনি
ব্যয়ের পরিমাণটা তাঁরই বেশি ছিল, তবু চৌধুরীর নামেই স্কুলটার নামকরণ করেছিলেন তিনি—জুলু চৌধুরীর স্কুল । আটহাত কাঠের মাথায় পেরেক আঁটা চারকোনি ফলকের ওপর জুলু চৌধুরীর নামটা জ্বলজ্বল করত সকাল, বিকেল ।
আজো করে। যদিও আকস্মিক ঝড়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে ভেঙে পড়েছে স্কুলটা। আর তার টিনগুলো জং ধরে অকেজো হয়ে গেছে বয়সের বার্ধক্যহেতু।
স্কুলটা ভেঙে পড়েছে। সেটা আবার নতুন করে তুলতে হলে অনেক টাকার দরকার। শনু পণ্ডিত ভেবেছিলেন, সরকার সাহায্য দিল না, জুলু চৌধুরী নিশ্চয়ই দেবেন। কিন্তু ভুল ভাঙল। সাহায্যের নামে রীতিমতো আঁতকে উঠলেন জুলু চৌধুরী। বললেন, পাগল, টাকাপয়সার কথা মুখে এনো না কখনো। দেখছ না কত বড়ো স্টাব্লিশমেন্ট। চালাতে গিয়ে রেগুলার হাঁসফাঁস হয়ে যাচ্ছি। আধলা পয়সা নেই হাতে। এদিক দিয়ে আসছে, ওদিক দিয়ে যাচ্ছে। শনু পণ্ডিত বুঝলেন, গাঁয়ের ছেলেগুলো লেখাপড়া শিখুক, তা আর চান না চৌধুরী সাহেব । কেউই চান না । না চৌধুরী, না সরকার, কেউ না ৷ অগত্যা গাঁয়ে ফিরে এলেন শনু পণ্ডিত।
ভেঙে পড়া স্কুলটার পাশ দিয়ে আসবার সময় দু-চোখে পানি উপচে পড়ছিল শনু পণ্ডিতের। লুঙ্গির খুঁটে চোখের পানিটা মুছে নিলেন । গ্রামের লোকগুলো উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করছিল তাঁর অপেক্ষায়। ফিরে আসতেই জিজ্ঞেস করল, কী পণ্ডিত, টাকা-পয়সা কিছু দিল চৌধুরী সাহেব? না, গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন শনু পণ্ডিত। চৌধুরীর আশা ছাইড়া দাও মিয়ারা। এক পয়সাও আর পাইবা না তার কাছ থাইকা । সেই আশা ছাইড়া দাও ।
পণ্ডিতের কথা শুনে কেমন ম্লান হয়ে গেল উপস্থিত লোকগুলো । বুড়ো হাশমত বলল, আমাগো ছেইলাপেইলাগুলা বুঝি মূর্খ থাইকবো? তা, , আর কী কইরবার আছে কও । আমি তো আমার সাধ্যমতো করছি? আস্তে বলল শনু পণ্ডিত! বুড়ো হাশমত বলল, তুমি আর কী কইরবা পণ্ডিত। তুমি তো এমনেও বহুত কইরছ। বিয়া কর নাই, শাদি কর নাই। সারা জীবনটাই তো কাটাইছ ওই স্কুলের পিছনে। তুমি আর কী কইরবা । দুপুরে তপ্ত রোদে তখন খাঁ খাঁ করছিল মাঠ ঘাট, প্রান্তর। দূরে খাসাড়ের মাঠে গরু চরাতে গিয়ে বসে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিল কোনো রাখাল ছেলে । বাতাসে বেগ ছিল না। আকাশটা মেঘশূন্য । সবাইকে চুপচাপ দেখে আমিন বেপারি বলল, আর রাইখা দাও লেখাপড়া। আমাগো বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষে কোনো দিন লেখাপড়া করে নাই। খেতের কাজ কইরা খাইছে। আমাগো ছেইলাপেইলারাও তাই কইরবো। লেখাপড়ার দরকার নাই । তা মন্দ কও নাই বেপারি। তাকে সমর্থন জানাল মুন্সি আকরম হাজি। লেখাপড়ার কোনো দরকার নাই । আমাগো বাপ-দাদায় লেখাপড়া কারে কয় জাইনতোও না । বাপ-দাদায় জাইনতোও না দেইখা বুঝি আমাগো ছেইলাপেইলাগুলাও কিছু জাইনবো না । ইতা কিতা কও মিয়া । তকু শেখ রুখে উঠল ওদের ওপর। শনু পণ্ডিত বলল, আগের জমানা চইলা গেছে মিয়া। এই জমানা অইছে লেখাপড়ার জমানা। লেখাপড়া না জাইনলে এই জমানায় মানুষের কদর অয় না ৷ তা তোমরা কি কেবল কথা কইবা, না কিছু কইরবা। জোয়ান ছেলে তোরাব আলী অধৈর্য হয়ে পড়ল। বলল, চৌধুরীরা তো কিছু দিব না, তা বুঝাই গেল । আর গরমেন্টো—গরমেন্টোর কথা রাইখা দাও। গরমেন্টোও মইরা গেছে। এহন কী কইরবা, একডা কিছু করো। হুঁ। কী কইরবা করো। চিন্তা করো মিয়ারা। বিড়বিড় করে বলল শনু পণ্ডিত। বুড়ো হাশমত চুপচাপ কী যেন ভাবছিল এতক্ষণ। ছেলে দুটো আর বাচ্চা নাতিটাকে অনেক আশা-ভরসা নিয়ে স্কুলে দিয়েছিল সে। আশা ছিল আর কিছু না হোক লেখাপড়া শিখে অন্তত কাচারির পিয়ন হতে পারবে ওরা। গভীরভাবে হয়ত তাদের কথাই ভাবছিল সে। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বলল, যতসব ইয়ে অইছে—যাও ইস্কুল আমরাই দিমু। কারো পরোয়া করি না। না গরমেন্টো। না চৌধুরী, বলে কোমরে গামছা আঁটল হাশমত। বুড়ো হাশমতকে গামছা আঁটতে দেখে জোয়ান ছেলে তোরাব আলীও লাফিয়ে উঠল। বলল, টিনের ছাদ যদি না দিবার পারি অন্তত ছনের ছাদ তো দিবার পারমু একডা । কি মিয়ারা? হ-হ ঠিক। ঠিক কথাই কইছ আলির পো । গুঞ্জরন উঠল চারদিকে।
হাশমত বলল, মোক্ষম প্রস্তাব । ছনের ছাদই দিমু আমরা । ছনের ছাদ দিতে কয় আঁটি ছন লাইগবো? কী পণ্ডিত, চুপ কইরা রইলা ক্যান ৷ কও না? কমপক্ষে তিরিশটা লাইগবো। মুখে মুখে হিসেব করে দিল শনু পণ্ডিত। তকু বলল, ঘাবড়াইবার কি আছে, আমি তিনডা দিমু তোমাগোরে । আমি দুইডা দিমু পণ্ডিত। আমারডাও লিস্টি করো। এগিয়ে এসে বলল কদম আলী । তোরাব বলল, আমার কাছে ছন নাই । ছন দিবার পারমু না আমি । আমি বাঁশ দিমু গোটা সাত কুড়ি । বাঁশও তো সাত-আট কুড়ির কম লাইগবো না । হ-হ ঠিক ঠিক। সবাই সায় দিল ওর কথায় । দু দিনের মধ্যে জোগাড়যন্ত্র সব শেষ । বাঁশ এল, ছন এল । তার সঙ্গে বেতও এল বাঁশ আর ছন বাঁধবার জন্য । আয়োজন দেখে আনন্দে বুকটা নেচে উঠল শনু পণ্ডিতের । এতক্ষণ গম্ভীর হয়ে কী যেন ভাবছিল আমিন বেপারি । সবার যাতে নজরে পড়ে এমন একটা জায়গায় গলা খাঁকরিয়ে বলল সে, জিনিসপত্তর তো জোগাড় কইরাছ মিয়ারা । কিন্তুক যারা গতর খাইটবো তাগোরে পয়সা দিবো কে? হাঁ, তাই তো । কথাটা যেন এক মুহূর্তে নাড়া দিল সবাইকে । হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন শনু পণ্ডিত। এইডা বুঝি একটা কথা অইল। নিজের কাম নিজে করমু পয়সা আবার কে দিবো? বলে বাঁশ কেটে চালা বাঁধতে শুরু করলেন তিনি। বললেন, নাও নাও মিয়ারা শুরু কর। হুঁ। শুরু করো মিয়ারা। বলল তকু শেখ। স্কুলের খুঁটি তৈরির জন্য লম্বা একটা গাছের গুঁড়ি খালপার থেকে টেনে নিয়ে এল তোরাব। হুঁ, টান মারো না মিয়ারা। টান মারো। হুঁ। মারো জোয়ান হেঁইয়ো—সাবাস জোয়ান হেঁইয়ো। টান মারো। টান মারো। আস্তে আস্তে । এত তড়বড় করলে অয়। বলল বুলির বাপ। হুঁ। কামের মানুষ হেঁইয়ো–আপনা কাম হেঁইয়ো। টান টান। মরা চৌধুরী হেঁইয়ো। চৌধুরীর লাশ হেঁইয়ো। হঠাৎ খিলখিলিয়ে হেসে উঠল তোরাব আর তকু । হাসল সবাই । খকখক করে কেশে নিয়ে বুড়ো হাশমত বলল, মরা গরমেন্টো কইলানা মিয়ারা? মরা গরমেন্টো কইলা না? হুঁ। মরা গরমেন্টো হেঁইয়ো। —গরমেন্টোর লাশ হেঁইয়ো। টান টান। করম মাঝি চুপ করে এতক্ষণ। বলল, ফুর্তিছে কাম কর মিয়া সিন্নি পাকাইবার বন্দোবস্ত করিগা। বাবা, মাজির পো, বাবা। চালাও ফুর্তি। কলকণ্ঠে চিৎকার উঠল চারদিক থেকে— পাটারি বাড়ির রোগা লিকলিকে বুড়ো কাদের বক্সটাও এসে জুটেছে সেখানে। তাকে দেখে আমিন বেপারি ভ্রূ কুঁচকালো। কী বক্স আলী। সিন্নির গন্ধে ধাইয়া আইছ বুঝি? কয় দিনের উপাস?
যত দিনের অই; তোমার তাতে কী? বেপারির কথায় খেপে উঠল কাদের বক্স। এত দেমাক দেহাও ক্যান মিয়া উপাস ক্যাডা না থাকে? তুমিও থাক। সক্কলে থাকে । ঠিক ঠিক। তফু সমর্থন করল তাকে। চৌধুরীরা ছাড়া আর সক্কলেই এক-আধ বেলা উপাস থাকে । এমন কোনো বাপের ব্যাটা নাই যে বুক থাবড়াইয়া কইবার পারব—জীবনে একদিনও উপাস থাকে নাই—হ। তকু আর কাদেরের কথায় চুপসে গেল আমিন বেপারি । তোরাব বলল, কী মিয়ারা, কিতা নিয়া তর্ক কর তোমরা । বেড়াটা ধরো। টান মারো । হুঁ । মারো জোয়ান হেঁইয়ো—চৌধুরীর লাশ হেঁইয়ো—মরা চৌধুরী হেঁইয়ো। আহারে চৌধুরী রে! খিলখিলিয়ে হেসে উঠল সবাই একসঙ্গে। আকরম হাজি রুষ্ট হলো এদের ওপর। এত বাড়াবাড়ি ভালা না মিয়ারা। এত বাড়াবাড়ি ভালা না। এহনও চৌধুরীর জমি চাষ কইরা ভাত খাও। তারে নিয়া এত বাড়াবাড়ি ভালা না । চাষ করি তো মাগনা চাষ করি নাকি মিয়া । তোরাব রেগে উঠল ওর কথায়। পাল্লায় মাইপা অর্ধেক ধান দিয়া দিই তারে ৷ পাক্কা অর্ধেক । বলল কাদের। সন্ধ্যা নাগাদ তৈরি হয়ে গেল স্কুলটা। শেষ বানটা দিয়ে চালার ওপর থেকে নেমে এলেন শনু পণ্ডিত। লম্বা স্কুলটার দিকে তাকাতে আনন্দে চিকচিক করে উঠল কর্মক্লান্ত চোখগুলো । সৃষ্টির আনন্দ । কদম আলী বলল, গরমেন্টোরে আর চৌধুরীরে আইনা একবার দেখাইলে ভালা অইবো পণ্ডিত। তাগোরে ছাড়াও চইলবার পারি আমরা । হ-হ। তাগোরে ছাড়াও চইলবার পারি। ঘাড় বাঁকাল শনু পণ্ডিত। একটু দূরে সরে গিয়ে বটগাছের নিচে বসতেই কাঠের ফলকটার দিকে চোখ গেল তকু শেখের । আট-হাত লম্বা কাঠের ওপর পেরেক-আঁটা ফলক। তার ওপর জুলু চৌধুরীর নামটা জ্বলজ্বল করে সকাল বিকেল। ওইটা আর এইহানে ক্যান? বলল তকু শেখ। ওইটারে ফালাইয়া দে খালে; চৌধুরী খালে ভাসুক। হঠাৎ কী মনে করে আবার নিষেধ করল তোরাব। থাম—থাম—ফালাইস না। ইদিকে আন। কালো চারকোনি ফলকটার ওপর ঝুঁকে পড়ে একখানা দা দিয়ে ঘষে ঘষে চৌধুরীর নামটা তুলে ফেলল তোরাব আলী। তারপর বুড়ো হাশমতের কল্কে থেকে একটা কাঠকয়লা তুলে নিয়ে অপটু হাতে কী যেন লিখল সে ফলকটার ওপর। শনু পণ্ডিত জিরোচ্ছিল বসে বসে। বলল, ওইহানে কী লেইখবার আছ আলীর পো। কিতা লেইখবার আছ ওইহানে? পইড়া দেহ না পণ্ডিত, আহ পইড়া দেহ। আটহাত লম্বা কাঠের ওপর পেরেক-আঁটা ফলকটাকে যথাস্থানে গেঁড়ে দিল তোরাব । অদূরে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে মৃদুস্বরে পড়লেন পণ্ডিত। শনু পণ্ডিতের ইস্কুল। পড়েই বার্ধক্য-জর্জরিত মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল তাঁর। বিড়বিড় করে বললেন, ইতা কিতা কইরাছ আলীর পো । ইতা কিতা কইরাছ? ঠিক কইরছে। একদম ঠিক। ফোকলা দাঁত বের করে মৃদু হাসল বুড়ো হাশমত। লজ্জায় তখন মাথাটা নুয়ে এসেছে শনু পণ্ডিতের।
তিরিশ পয়ত্রিশ বছর আগে আমাদের পারে দুজন ডাক্তার ছিলেন। একজন হোমিওপ্যাথ আর একজন এ্যালোপ্যাথ। গাঁয়ের লোক ঠিক ঠিক বলতে পারত না একজনকে বলত হেমাপ্যাথি আর একজনকে বলত এ্যালাপ্যাথি। দুজনের চিকিৎসার ধরন ছিল বাধা। খবর দিতেন একরকম।
হোমিওপ্যাথ অথোর ডাক্তারের কাছে গেলেই একটুখানি সাদা ময়দার মতো গুঁড়োতে দু-তিন ফোঁটা স্পিরিট টপ টপ করে ফেলে তিন-চারটি পুরিয়া করে দিতেন। খেতে ভালোও লাগত না, মন্দও লাগত না। কখনো কখনো আবার স্রেফ টিউবওয়েলের পানিতে দু-তিন ফোঁটা স্পিরিট মিশিয়ে দিয়ে বলতেন, 'যা, খাপে যা।' ওষুধ হাতে নিয়ে, আমি হয়ত কম করে জিজ্ঞেস করে বসতাম, 'ডাক্তারবাবু ভালো হবে তো? অধোর ডাক্তার দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলে উঠতেন, 'ভালো হবে না মানে? ভালো হয়ে উপচে পড়বে। যা, ওষুধ খাপে।” আমি বলতাম, 'পেটের ভেতর গরগর করে।' 'ও কিছু না, ব্যাঙ্ক হয়েছে তোর পেটে।"
“ওরে বাবা, ব্যাঙ হয়েছে আমার পেটে! গোঁ গোঁ শব্দ হয় যে ডাক্তারবাবু । “ও কিছু না-ব্যাঙ ডাকে গোঁ গোঁ করে । আমার ওষুধ যেই এক পুরিয়া খাবি, দেখবি তখন ব্যাঙের লাফানি।' 'কী করে দেখব? ব্যাঙ যে পেটের ভেতরে ।
অঘোর ডাক্তার তখন বলতেন, ‘ওরে বাবা, দেখবি মানে বুঝবি। বুঝবি ঠেলা ।' এই হচ্ছে আমাদের গাঁয়ের এক নম্বর ডাক্তার অঘোরবাবুর কথা। এইবার দুই নম্বর তোরাপ ডাক্তারের কথা বলি। আগেই বলেছি, ইনি ছিলেন এ্যালোপ্যাথ ডাক্তার। কী করে যে তিনি ডাক্তার হয়েছিলেন, কেউ জানে না। শোনা যায়, বাল্যকালে তিনি নাকি এক বড়ো ডাক্তারের হুঁকো সাফ করতেন। সে যাই হোক, তোরাপ ডাক্তারের একটা ছোট্ট শেয়াল-রঙের বেতো ঘোড়া ছিল। তার সামনের পা-দুটি ছাঁদনা দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকত প্রায় সময়। এই বাঁধা পা নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে গাঁয়ের আশেপাশে চরে বেড়াত ঘোড়াটা। কারো ক্ষতি করতে দেখিনি কোনো দিন ।
তোরাপ ডাক্তার খালি ডাক্তারিই করতেন না কিন্তু। নিজের হাতে হালচাষ করতেন। বর্ষা আর শীতের সময় ডাক্তারির ধার ধারতেন না তিনি। বর্ষাটা হচ্ছে চাষবাসের সময় আর শীতকালটা হচ্ছে ফসল কাটার মরশুম । এই সময় রোগী মরে গেলেও তোরাপ ডাক্তারকে পাওয়া যাবে না । বর্ষা আর শীতে গাঁয়ের লোকদের রোগী হয়ে শুয়ে থাকার কোনো উপায় নেই। এই দুই সময়ে কাজ করতে না-পারলে পেটে ভাত জুটবে না। কাজেই রোগটোগ সব শিকেয় তুলে রেখে দিতে হতো তাদের বাধ্য হয়ে । তারপর শরৎকাল এলে তোরাপ ডাক্তারের মোটামুটি অবসর হতো আর গাঁয়ের লোকদেরও রোগী হয়ে শুয়ে থাকার একটু-আধটু মওকা মিলত ।
এই সময়ের জন্যেই যেন ওঁৎ পেতে থাকত ম্যালেরিয়া জ্বর। বাঘ যেমন গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের টুটি কামড়ে ধরে, ঠিক তেমনি করে ম্যালেরিয়া জ্বর এসে গাঁয়ের গরিব লোকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত । এটা ঘটত আশ্বিন মাস থেকে। ম্যালেরিয়ার মতো বাঘা জ্বর তখন আর কিছু ছিল না । ঘরে ঘরে মানুষ ছেঁড়া কাঁথা, ন্যাকড়া, ত্যানা গায়ে চাপিয়ে কোঁকাত। আর সে কী কাঁপুনি। কাঁপুনি থামাবার জন্যে পাথরের জাঁতা পর্যন্ত গায়ে চাপাতে দেখেছি।
এই সময়টায় ছিল তোরাপ ডাক্তারের মজা। ঘরে ঘরে লোক ম্যালেরিয়া জ্বরে ধুঁকছে। চিকিৎসার জন্যে তোরাপ ডাক্তার ছাড়া গতি নেই । ম্যালেরিয়া পুরোনো হয়ে গেলে কিছুতেই সারতে চায় না। পেটের মধ্যে পিলে উঁচু হয়ে ওঠে, হাত-পা হয়ে যায় প্যাঁকাটির মতো সরু। তোরাপ ডাক্তারের এইরকম অনেক পিলে-ওঠা পুরোনো ম্যালেরিয়া-রোগী ছিল ।
রোগের আর একটা সময় ছিল চোত-বোশেখ মাস। এই সময়টায় কলেরা আর বসন্ত হয়ে গ্রামকে গ্রাম সাফ হয়ে যেত। ম্যালেরিয়া আর কলেরার সব রোগী তোরাপ ডাক্তারের। এখানে অঘোর ডাক্তারের কোনো ভাগ ছিল না । জ্বর হলে, সর্দি হলে, বেশি খেয়ে বা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে পেট ছেড়ে দিলে লোক অঘোর ডাক্তারের কাছে যেত । আনা দুই পয়সা দিলেই, তিনি দিয়ে দিতেন দুই-তিন পুরিয়া ওষুধ। পয়সা দিতে না-পারলে ধারেও দিতেন। এমনকি একটা লাউ বা দুটো শশা নিয়ে গেলেও তিনি রোগী ফেরাতেন না ।
অঘোর ডাক্তারের চাষবাসও ছিল না, ভিনগাঁয়ে ‘কলে’ যাবার ঘোড়াও ছিল না। হোমিওপ্যাথি ওষুধ রাখার জন্য একটা কাঠের বাক্স ছাড়া চিকিৎসার সরঞ্জাম বলতে আর কিছুই ছিল না তাঁর। তবে ওরকম বাক্যবাগীশ লোক লাখে একটা মিলবে কিনা সন্দেহ। তিনি বলতেন, ‘বলি, মরতে তোরা আমার কাছে আসিস কেন বল দিকিনি। তোরাপের কাছে যা না। তা তো যাবি না—গেলে যে ব্যাটা কসাই ঘাড়টি মটকে তাজা রক্ত খাবে তোদের। বলি, এ কী ডাক্তারি বল দিকিন তোরা ? তুই বললি, আমার অসুখ করেছে, আর অমনি তোরাপ হয় ছুরি বার করবে, না-হয় কোদাল বার করবে, না-হয় কুড়াল বার করবে.... একজন রোগী হয়ত বাধা দিয়ে বলল, ‘না না ডাক্তারবাবু, তোরাপ ডাক্তার আবার কোদাল কুড়ুল কবে বার করলে!' ‘ওই হলো, , লাঙলের ফালের মতো ছুঁচওয়ালা একটা বোতল বার করল। কী? না ইঞ্জেকশন দেব, গলা কাটব, মারব, ধরব। তারপর ওষুধ চাও, দেবে তোমাকে এক বোতল পিশাচের রক্ত। ওয়াক থু। যেমন দুৰ্গন্ধ, তেমনি বিচ্ছিরি সোয়াদ-ছ্যা ছ্যা ছ্যা! আর আমাদের হোমিওপ্যাথ কী করছে? বাঘ যেমন ভেড়ার পাল তাড়িয়ে নিয়ে যায় ঠিক তেমনি করে একটি পুরিয়ার আমার এই ওষুধ তোমার পায়ের আঙুলের ডগা থেকে জীবাণু বাবাজিদের খেদাতে খেদাতে মাথার চুলের ডগা দিয়ে বার করে দিচ্ছে। অথচ তুমি জানতেও পারছ না ।' সে বছর শরৎকালে ধান কেবল ডাঁশিয়ে উঠছে, ধানের ভেতর সাদা দুধ জমে চাল বাঁধছে, বেশ ঝরঝরে আবহাওয়া, আকাশভর্তি রোদ, একটু একটু ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে—এমনি সময়ে হুড়মুড়িয়ে চলে এল ম্যালেরিয়া জ্বর। ব্যস, ম্যালেরিয়া জ্বরে লোক দমাদম বিছানা নিতে লাগল । ছেলে-বুড়ো কেউই বাদ যায় না। ম্যালেরিয়া যাদের পুরোনো হয়ে গেছে তাদের তো খুব মজা । ঠিক বেলা দশটার সময় চোখে সূর্যটা একটু হলুদ হলুদ ঠেকে, তারপর গা একটু গরম হয়, চোখ দুটি সামান্য জ্বালা করে তবে তারপর হুড় হুড় করে এসে পড়ে জ্বর। সঙ্গে সঙ্গে কী পিপাসা! ঘটি ঘটি পানি খেয়ে পিপাসা কমে না। পানি পেটে গিয়ে গরম হয়ে যায়, তারপর গা-টা গুলিয়ে ওঠে, তারপরেই বমি। বমি হয়ে গেলেই আবার পিপাসা। আবার ঘটি ঘটি পানি খাওয়া তারপর আবার বমি। জ্বর কমে আসে আস্তে আস্তে । রাত দশটার দিকে একদম জ্বর চলে গিয়ে গা ঠান্ডা গাঁয়ের অর্ধেকের বেশি লোক ম্যালেরিয়া জ্বরে পড়ল। তোরাপ ডাক্তার হলুদ রঙের বড়ো বড়ো বিকট দাঁত বের করে এ্যাই বড়ো সিরিঞ্জ নিয়ে, রোগীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে লাগলেন। দুই পকেট ভর্তি ম্যাপাক্রিন বড়ি। সে যে কি ভয়ানক বড়ি ভাবা যায় না। রোগী যেখানেই থাক, সে মাটির দাওয়াতেই হোক আর খোলা আকাশের নিচে উঠোনেই হোক বা ঘরের ভেতরেই হোক, গলায় স্টেথোটি ঝুলিয়ে ইনজেকশনের বাক্সটি হাতে নিয়ে তোরাপ ডাক্তার ঠিক হাজির । লোকেই-বা আর কী করে? কাজেই বাধ্য হয়ে তোরাপ ডাক্তারকে ডাকতেই হয়। বেচারা অঘোর ডাক্তারের গুঁড়োতে যে কোনো কাজই হয় না ।
সে যাই হোক, ঘরে ঘরে ঢুকেই গোদা গোদা এ্যাকাব্যাঁকা আঙুল দিয়ে তোরাপ ডাক্তার রোগীর কব্জি চেপে ধরে কিছুক্ষণ নাড়ি পরীক্ষা করতেন। রোগীরা সব বলাই সাধু। হয়ত জিজ্ঞেস করল, “তবে কি ‘ম্যালোরি’ জ্বর ডাক্তার সাহেব?” তোরাপ ডাক্তার দাঁত কড়মড়িয়ে বলতেন, ‘তাছাড়া আর কী হবে? এই যে দেখাচ্ছি মজা, একটি ইনজেকশনে ম্যালেরিয়ার ভূত ছাড়াব। এই বলে আশেপাশের লোকদের আদেশ দিতেন, ‘ধর তো এটাকে চেপে, সুঁইটা দিয়ে দিই একবার । আর দুটো টাকা রাখ এখানে আমার সামনে, আমার ফি আর ওষুধের দাম । উঁহু আগে টাকা রাখ, তারপর অন্য কাজ । এই বলে তোরাপ ডাক্তার একদিকের পকেটে টাকা দুটো ভরতেন, আরেক পকেট থেকে বের করতেন ইনজেকশন দেবার সিরিঞ্জ । কী প্রচণ্ড সিরিঞ্জ ! আর তার ছুঁচ তো নয়, , ঠিক যেন মোষের লাঙলের ফলা । লোকের গায়ে ফুঁড়তে ফুঁড়তে ছুঁচের মাথা গিয়েছে ভোঁতা হয়ে । সেই ভয়ানক যন্ত্র দেখেই তো রোগী বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে পালাবার চেষ্টা করত। তোরাপ ডাক্তার চিৎকার করতেন, ‘ধর ধর, ঠেসে, চেপে ধর’-সঙ্গে সঙ্গে তিন- চারজন ষণ্ডাগোছের লোক গিয়ে বিছানার সঙ্গে চেপে ধরত রোগীকে। তারপর কোমরের কাপড়ের কষিটা খুলে তোরাপ ডাক্তার মাংসের মধ্যে প্যাট করে ঢুকিয়ে দিতেন সেই মোটা ছুঁচ। সঙ্গে সঙ্গে রোগীর সমস্ত পা-টা যেত অবশ হয়ে ।
এইরকম করে ইনজেকশন দিয়ে সে-বছর শরৎকালে তোরাপ ডাক্তার দুহাতে টাকা রোজগার করতে লাগলেন । ম্যালেরিয়ার প্রকোপ যত বাড়ে ততই বাড়ে তাঁর রোজগার। ইনজেকশন দিয়ে তিনি দু-তিনটে লোককে তো চিরদিনের জন্য খোঁড়া করে দিলেন। তাঁর ম্যাপাক্রিন বড়ি খেয়ে কয়েকজন তো চিরকালের জন্য কালা হয়ে গেল। তবু লোকে বাধ্য হয়ে তাঁর কাছেই যেতে লাগল। হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়ে ম্যালেরিয়ার মতো দুর্দান্ত জ্বর ঠেকানের সাধ্য ছিল না অঘোর ডাক্তারের। তাঁর কাছে আর কেউ যায় না। তাঁর সংসার চলাই দায় হয়ে উঠল। শেষপর্যন্ত কী আর করেন তিনি!
একদিন অঘোর ডাক্তার চুপিচুপি জেলা শহরে গিয়ে একটা সিরিঞ্জ আর কিছু কুইনাইন ইনজেকশন কিনে আনলেন । মনে মনে বললেন, তোরাপটার বড্ড বাড় বেড়েছে। খুব দু-পয়সা করে নিচ্ছিস, না? কিন্তু আমি হচ্ছি সব্যসাচী, সে খবরটা তো জানিস না তোরাপ । আমি দুই হাতে তির ছুড়তে পারি। ইচ্ছে হলে হোমোপ্যাথি করব আবার ইচ্ছে হলে এ্যালাপ্যাথি ইনজেকশন দেবো। মনে মনে এইসব কথা ভেবে তিনি সিরিঞ্জের ছুঁচ কিনলেন খুব মিহি দেখে। কাউকে কোনো কথা না-বলে সরঞ্জাম সব কিনে চুপি চুপি বাড়ি ফিরে এলেন সন্ধেবেলা ।
পরের দিন সকাল বেলায় মুখটি ধুয়ে দাওয়ায় কাঠের টুল পেতে কেবল বসেছেন তিনি—এমন সময় ইদরিস আলীর বাড়ি থেকে লোক এল । ইদরিস আর তার পুরো পরিবার অনেকদিন থেকে তাঁর রোগী । শত অসুখ-বিসুখে তারা কোনোদিন তোরাপ ডাক্তারের কাছে যায় না, বলে, হেমাপ্যাথির ওপর ওষুধ আছে নাকি ডাক্তারবাবু? মরলে আপনার হেমাপ্যাথি খেয়েই মরব, তবু তোরাপ ডাক্তারের হাতে জান দিতে পারব না।
ইদরিস আলীর বাড়ির লোকের কাছ থেকে অঘোর ডাক্তার শুনলেন যে গত পাঁচ-সাত দিন থেকে ইদরিস নিদারুণ ম্যালেরিয়া জ্বরে বেহুঁশ । কিন্তু তোরাপ ডাক্তারের নাম করলেই তার হুঁশ ফিরে আসছে আর তখন সে বলছে, “আমি অঘোর ডাক্তারের হেমাপ্যাথি খেয়ে মরব, কিছুতেই এ্যালাপ্যাথি চিকিচ্ছে করাব না।' কথা শুনে অঘোর ডাক্তার মিটিমিট হেসে বললেন, “কেন রে, এ্যালাপ্যাথি চিকিচ্ছেটা খারাপ হলো কোথায়? তোরাপ হলো ডাকাত, ও আবার ডাক্তার হলো কবে? এখন থেকে আমিই এক-আধটু এ্যালাপ্যাথি করব ভাবছি। ইদরিসের বাড়ির লোকটা অবাক হয়ে বলল, 'তুমি এ্যালাপ্যাথি করবে কী গো? তুমি আবার সুঁই দেবে নাকি? অঘোর ডাক্তার রেগে বললেন, ‘কেন, দেব না কেন? সব বিদ্যাই জানা আছে আমার বুঝলি? চিকিচ্ছেটা তোরাপের লাঙল চালানো নয় । কেমন মিহি সুঁই কিনেছি দেখবি । ইদরিসকে আজ ফুঁড়ব। তুই যা, আমি আসছি। আর শোন বাবা, দুটো টাকা আগে জোগাড় করে রাখিস। তোরাপও দু-টাকা করে নেয়, আমাকে দিবি না কেন? অঘোর ডাক্তার কুইনাইন ইনজেকশন দিবেন এই খবর দেখতে দেখতে সারা গাঁয়ে চাউর হয়ে গেল । গাঁয়ের যত সুস্থ মানুষ ছিল, সব ছুটল ইদরিসের বাড়ির দিকে। ইদরিসের মেটেবাড়ির ছোট্ট ঘরে আর তিলধারণের জায়গা নেই—একটা লোক কোমরে চাদর জড়িয়ে হেঁড়ে গলায় চেঁচাতে লাগল, ‘এই, এই সব বাতাস ছেড়ে দাও, বাতাস আসতে দাও।' কিন্তু কে কার কথা শোনে! অঘোর ডাক্তার হেমাপ্যাথি ছেড়ে ইনজেকশন দেবে—এ কী সোজা কথা !
রোগা অঘোর ডাক্তার বহু কষ্টে ঘরে ঢুকে, ট্যাক থেকে সিরিঞ্জ, ওষুধ এইসব বের করলেন। লোকজনের দিকে তাকিয়ে তাঁর দুই হাঁটু থরথর করে কাঁপতে লাগল। মুখে অবশ্য তম্বি করলেন, “ভিড় কমাও, আলো আসতে দাও তোমরা।'
এই কথা বলে বহু কষ্টে সিরিঞ্জের মাথায় সুচ লাগালেন, তারপর ওষুধ ভরে রোগীর দিকে এগিয়ে গেলেন। ঠিক এই সময় জ্বরের ঘোর ভেঙে জবাফুলের মতো গোল দুটো চোখ মেলে ইদরিস বলল, ‘ডাক্তারবাবু শেষে আপনার এই কাজ!' এই বলে ইদরিস চোখ বন্ধ করে মড়ার মতো পড়ে রইল । অঘোর ডাক্তার বললেন, “ধর বাবা তোরা, ইদরিসকে একটু ধর।' চোখ না খুলেই ইদরিস বলল, 'কাউকে ধরতে হবে না ডাক্তারবাবু, আপনি ইনজিশন দ্যান—বরঞ্চ আপনাকে ধরতে হলে ওদেরকে বলুন।'
হঠাৎ কেমন বোকার মতো অঘোর ডাক্তার হাসলেন, তারপর ইদরিসের কোমরের নিচে মাংসে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘হেঁ হেঁ বড়ো মিহি কিনেছি ছুঁচটা, এই তুললাম', এই কথা বলে সকলের দিকে চেয়ে প্রায় কাঁদো-কাঁদো গলায় আবার বললেন, ‘হেঁ হেঁ তোরাপের কম্ম নয়, তোমরা দ্যাখো একবার, এই তুললাম সিরিঞ্জ, এইবার, এইবার'—বলেই প্যাট করে সিরিঞ্জের সুচ ঢুকিয়ে দিলেন ইদরিসের কোমরের মাংসে। হাত কাঁপতে লাগল তাঁর, বারবার বলতে লাগলেন, ‘গভীর করে ফুঁড়তে হবে, গভীর করে ফুঁড়তে, এই যাহ্।' পট করে একটা আওয়াজ উঠল আর হাহাকার করে উঠলেন অঘোর ডাক্তার, ‘হায় হায়, ছুঁচ ভেঙে গেছে, ছুঁচ ভেঙে গেছে, গেল গেল, সর্বোনাশ হল, হায় হায়...।'
সুচটা তখন মাংসের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। অঘোর ডাক্তারের শীর্ণ দুই হাত আঁতিপাঁতি করে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেটাকে । তখন কোথা থেকে একটা জোয়ান ছেলে ছুটে এসে দাঁত দিয়ে কামড়ে তুলে ফেলল সুচটা ইদরিসের কোমর থেকে । সবাই চুপ করে আছে—ছেলেটা দাঁত থেকে খুলে হাতে নিল সুচটা, অঘোর ডাক্তারের দিকে চেয়ে বলল, “এই যে ডাক্তারবাবু পেয়েছি।' অঘোর ডাক্তার দেখতে পেলেন না। ক্ষোভে দুঃখে তখন তাঁর চোখে অশ্রুর ঢল নেমেছে।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছে সেই ছেলেবেলা থেকে। রঞ্জুর বয়স তখন চার, বড়ো বোন শিউলির ঘরে তার জন্যে ছোটো খাট দেওয়া হলো, সেখানে রইল রংচঙে চাদর আর ঝালর-দেওয়া বালিশ। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে যেন একা একা না লাগে সেজন্যে মাথার কাছে রইল তার প্রিয় খেলনা ভালুক। গভীর রাতে আম্মা দেখেন রঞ্জু ঘুম থেকে উঠে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলে এসেছে। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, 'কী হলো? ঘুম থেকে উঠে এলি যে? রাষ্ট্র তার আব্বা আর আমার মাঝখানে শুভে শুতে বলল, 'ভালুকটা ঘুমাতে দেয় না। ” আম্মা চোখ কপালে তুলে বললেন, 'খেলনা ভালুক তোকে ঘুমাতে দেয় না? 'না। যখনই ঘুমাতে যাই তখনই খামটি দেয়। রঞ্জু শার্টের হাতা গুটিয়ে দেখাল, এই দেখ।' আম্মা দেখলেন আঁচড়ের দাগ। বিকেলবেলা পাশের বাসার ছোটো মেয়েটির পুতুল কেড়ে নিতে গিয়ে খামচি খেয়েছিল, নিজের চোখে দেখেছেন। মাঝরাতে সেটা নিয়ে মনুর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেন না । পরদিন তার বিছানায় খেলনা ভালুকটা সরিয়ে সেখানে ছোটো একটা কোলবালিশ দেওয়া হলো। কিন্তু আবার মধ্যরাতে দেখা গেল রুহু গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলে এসেছে। আম্মাকে ডেকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিজের জন্য জায়গা করতে করতে বলল, 'খুব দুষ্টুমি করছে।'
“কে?” ‘ময়ূরটা।’ ‘কোন ময়ূর?” ‘ওই যে দেয়ালে ।'
আম্মার মনে পড়ল সেই ঘরের দেয়ালে শিউলি একটা ময়ূরের ছবির পোস্টার লাগিয়ে রেখেছে, বললেন, ‘সেটা তো ছবি।' রঞ্জু মাথা নাড়ল, ‘ছবি ছিল। রাত্রিবেলা ছবি থেকে বের হয়ে এসে পায়ে ঠোকর দেয়। এই দেখ আমার বুড়ো আঙুলে ঠোকর দিয়েছে। অন্ধকারে আম্মা রঞ্জুর পায়ের নখ বা ময়ূরের কাজকর্ম দেখার উৎসাহ অনুভব করলেন না। রঞ্জুকে পাশে শোয়ার জায়গা করে দিলেন
ব্যাপারটা এইভাবে শুরু হয়েছে প্রয়োজনে রঞ্জু চমৎকার গল্প ফেঁদে বসে। আব্বা বললেন, ‘ছোটো মানুষ সত্যি-মিথ্যে গুলিয়ে ফেলে। বড়ো হলে ঠিক হয়ে যাবে।' আরেকটু বড়ো হলে দেখা গেল তার গল্প বলার অভ্যাস বেড়ে গেছে। আগে প্রয়োজনে বানিয়ে বানিয়ে বলত আজকাল অপ্রয়োজনেও বানানো শুরু করেছে। যত দিন যেতে থাকল রঞ্জুর বানিয়ে গল্প বলার অভ্যাস আরো বেড়ে যেতে থাকল। ব্যাকরণ ক্লাসে একদিন হোমওয়ার্ক না-করে চলে এসেছে, কিন্তু রঞ্জু ঘাবড়াল না, হাসিমুখে বলল, ‘স্যার আমি হোমওয়ার্কটা করেছি স্যার। করেছিস তাহলে আনিসনি কেন?” ‘সেটা একটা বিশাল গল্প স্যার।'
রঞ্জু স্যারের দৃষ্টি উপেক্ষা করে গল্প শুরু করে দিল : “আমার বড় বোনের নাম শিউলি, গভমেন্ট স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। তার খুব চা খাওয়ার শখ। রাতে আমার আম্মাকে বলল, সে চা খাবে। আম্মা ধমক দিয়ে বললেন, এত রাতে চা খাবি কী! ঘুমাতে যা।”
শিউলি আপা খুব মন খারাপ করে ঘুমাতে গেল । কিন্তু মনের মাঝে রয়ে গেছে চা খাওয়ার শখ। গভীর রাতে দেখলাম সে বিছানা থেকে উঠে হাঁটতে শুরু করল । চোখ বন্ধ করে ঘুমের মাঝে হাঁটতে শুরু করেছে-ইংরেজিতে এটাকে বলে ‘স্লিপ ওয়াকিং'। যখন কেউ স্লিপ ওয়াকিং করে তখন তাকে ডিস্টার্ব করতে হয় না। আমি তাই তাকে ডিস্টার্ব করলাম না। দেখলাম সে রান্না ঘর থেকে এক কেতলি পানি নিয়ে এল। তারপর আমার হোমওয়ার্কের খাতাটা নিয়ে হোমওয়ার্কের পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দিল । সেই আগুনে কেতলির পানি গরম করে মাঝরাতে চা তৈরি করে খেল। এ রকম সময়ে ডিস্টার্ব করতে হয় না স্যার— তাই আমি কিছু বলতে পারলাম না।” স্যার কোনও কথা না বলে থ হয়ে রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে রইলেন ।
বছরখানেক পরে রঞ্জুকে নিয়ে সমস্যা আরো বেড়ে গেল—কারণ তখন হঠাৎ করে সে সায়েন্স ফিকশান পড়া আরম্ভ করেছে। সায়েন্স ফিকশানের উদ্ভট কাহিনি পড়ে তার মাথাটা পুরোপুরি বিগড়ে গেল—আগে বানিয়ে বানিয়ে সে যে সব গল্প বলত সেগুলো তবুও কোনো-না-কোনোভাবে সহ্য করা যেত। কিন্তু আজকাল যেগুলো বলে সেগুলো আর সহ্য করার মতো নয়। একবার দুদিন তার ক্লাসে দেখা নেই, তৃতীয় দিনে সে মহা উত্তেজিত হয়ে দুদিন আগের একটা খবরের কাগজ নিয়ে হাজির হয়েছে। সবাই ক্রিকেট খেলা নিয়ে গল্প করছে সে তাদের থামিয়ে দিয়ে খবরের কাগজটা তাদের সামনে খুলে ধরে বলল, দেখ— সবাই খবরের কাগজটার দিকে তাকাল—দেখার মতো এমন কিছু নেই, প্রতিদিন যা থাকে তাই আছে খবরের কাগজে। আজমল জিজ্ঞেস করল, 'কী দেখব?' রঞ্জু একটু অধৈর্য হয়ে বলল, 'তারিখটা দেখ ! দুদিন আগের তারিখ, এর মাঝে দেখার কী আছে কেউ বুঝতে পারল না। রঞ্জু বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘এখনো বুঝতে পারছিস না?' উপস্থিত সবাই মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’ ‘আমি একটু আগে হকারের কাছ থেকে কাগজটা কিনেছি, এক ঘণ্টাও হয়নি।' আজমল ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘হকার পুরোনো কাগজ বিক্রি করে? রঞ্জু অধৈর্য হয়ে বলল, “দুর! পুরোনো কাগজ কিনব কেন? আজকের কাগজটাই কিনেছি। কিনে আসছি। হঠাৎ রাস্তার মোড়ে গাছের আড়ালে দেখি চকচকে সিলিন্ডারের মতো একটা জিনিস। কেমন একটু কৌতূহল হলো, তাই দেখতে গেলাম, কাছে যেতেই সাঁৎ করে গোল একটা দরজা খুলে গেল । বিশ্বাস করবি না, ভেতরে দুজন মানুষ বসে আছে, তাদের গায়ের রং সবুজ। আমাকে দেখে একজন বলল, ‘এই খোকা শুনে যাও—' আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম, একে অপরিচিত মানুষ, তার ওপর গায়ের রং সবুজ। ভাবলাম উলটো দিকে একটা দৌড় দিই। কিন্তু মানুষগুলোর চোখ দুটি দেখে থেমে গেলাম, কারণ চোখ দেখে মনে হলো খুব বিপদে পড়েছে। আমি কাছে গেলাম, ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?' একজন বলল, ‘আমরা হারিয়ে গেছি।'
‘হারিয়ে গেছ?’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এটা হচ্ছে তেমাথা; একটু সামনে গেলে আমাদের স্কুল, তার সামনে হচ্ছে বাসস্টেশন—' সবুজ রঙের দুই নম্বর মানুষটা বলল, ‘না, না তুমি বুঝতে পারছ না, আমরা জায়গার ক্ষেত্রে হারাইনি । আমরা সময়ের ক্ষেত্রে হারিয়ে গেছি।' ‘সময়ের ক্ষেত্রে?' ‘হ্যাঁ। এটা হচ্ছে টাইম মেশিন । এক হাজার বছর অতীতের একটা মিশন শেষ করে ভবিষ্যতে ফিরে যাচ্ছি, হঠাৎ হারিয়ে গেলাম। কোন সময়ে আছি জানি না। তাই টাইম মেশিনটাকে কেলিব্রেট করতে পারছি না। আমি বললাম, তা-ই বল! তার মানে তোমরা জানতে চাও আজকে কয় তারিখ?' 'হ্যাঁ।'
‘এই দেখ—বলে আমি তাদের সামনে খবরের কাগজটা খুলে ধরলাম, আটাশ তারিখ—শনিবার।' সবুজ চেহারার মানুষ দুজন তাই দেখে খুব খুশি হয়ে গেল, আমার হাত ধরে কয়েকবার হ্যান্ডশেক করে বলল, 'তুমি খুব উপকার করেছ আমাদের, কী চাও তুমি বলো।' ‘আমি তো আর বলতে পারি না—এইটা চাই সেইটা চাই, তাই ভদ্রতা করে বললাম কিছুই চাই না আমি ।’ লোক দুজন তখন আমাকে এত বড়ো একটা জিরকোনিয়ামের ক্রিস্টাল দিয়ে বলল, ‘এইটা নাও।' আমি বললাম, 'কী বলছ, , এত বড়ো একটা ক্রিস্টাল দিয়ে আমি কী করব—হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাবে। যদি সত্যিই কিছু দিতে চাও তাহলে তোমাদের টাইম মেশিনে করে আমাকে ঘুরিয়ে আন ।' লোক দুজন বলল, “ওঠো তাহলে ।’ আমি ভেতরে ঢুকলাম । একজন জিজ্ঞেস করল, ‘অতীতে যাবে, না ভবিষ্যতে?” আমি বললাম, ‘ভবিষ্যতে যাই।' ‘কতদিন যেতে চাও?' আমি বললাম, ‘বেশি দিন না। এক-দুই দিন ।' একজন তখন একটা সুইচ টিপে দিল, ঘটাং ঘটাং করে একটা শব্দ হল তারপর দরজা খুলে বলল, ‘এসে গেছি!” আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি, বাইরে এসে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী বার আজকে?' সে বলল, ‘সোমবার!”
আজমল সাদাসিদে ছেলে, সে মাথা নেড়ে বলল, ‘আসলেই আজকে সোমবার।' রঞ্জু চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, 'তার মানে শনি রবি এই দুটি দিন আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে! কী আশ্চর্য দেখলি?' সবাই রঞ্জুকে এতদিনে চিনে গেছে, তারা মুখ টিপে হেসে আবার ক্রিকেটের গল্পে ফিরে গেল । রঞ্জু রেগে গিয়ে বলল, “আমার কথা তোরা বিশ্বাস করলি না? ভাবছিস আমি গুল মারছি? তাহলে এই খবরের কাগজটা আমার হাতে এল কোথা থেকে? বল তোরা—দুদিন আগের খবরের কাগজ আমার হাতে এখন কেমন করে এল?' তার প্রশ্নের কেউ সদুত্তর দিতে পারল না, রঞ্জু তখন বইপত্র রেখে খবরের কাগজ নিয়ে বের হয়ে গেল অন্য কাউকে গল্প শোনানোর জন্যে ।
রঞ্জুর সায়েন্স ফিকশানের প্রতি বাড়াবাড়ি প্রীতি জন্ম নেবার পর শিউলির জন্যেও গল্পগুলো হজম করা কঠিন হয়ে পড়তে শুরু করল। প্রায় প্রতিদিনই রঞ্জু এসে মহাকাশের কোনো এক আগন্তুকের কথা বলতে লাগল। কোনো দিন সেই আগন্তুক তাকে ব্ল্যাকহোলের গোপন রহস্যের কথা বলে গেছে; তার কাছে কাগজ কলম ছিল না বলে লিখে রাখতে পারেনি, লিখে রাখতে পারলেই পৃথিবীতে হইচই শুরু হয়ে যেত। কোনোদিন একটা ফ্লাইং সসার থেকে বিদঘুটে কোনো প্রাণী লেজারগান দিয়ে তাকে গুলি করতে চেষ্টা করেছে আর সে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে, আবার কোনো দিন স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা জারুল গাছের নিচে চতুষ্কোণ একটা উজ্জ্বল আলো দেখে সেখানে উঁকি মারতেই ভিন্ন একটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক ঝলক দৃশ্য দেখে এসেছে।
কয়দিন পরের কথা । আম্মা নানাকে একটা চিঠি লিখছেন। চিঠি লিখতে লিখতে হঠাৎ আম্মার ফাউন্টেন পেনে কালি শেষ হয়ে গেল । আম্মা রঞ্জুকে ডেকে বললেন, ‘কালির দোয়াতটা নিয়ে আয় তো ।’ রঞ্জু দোয়াতটা নিয়ে আসছিল আর ঠিক তখন কোনো কারণ নেই, কিছু নেই হঠাৎ করে সে হোঁচট খেল, সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে কালির দোয়াত ছিটকে গেল উপরে তারপর আছড়ে পড়ল নিচে—আর কিছু বোঝার আগে দোয়াত ভেঙে একশো টুকরা হয়ে মেঝেতে কার্পেটে কালি ছড়িয়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হলো । আম্মা তখন এমন রেগে গেলেন যে, সে আর বলার মতো নয় । খানিক ক্ষণ রঞ্জু ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদল, তারপর সে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে গেল । নির্জন ছাদ, পাশে কয়েকটা নারকেল গাছ, বাতাসে তাদের পাতা ঝিরঝির করে নড়ছে। আকাশের মাঝামাঝি অর্ধেকটা চাঁদ, তাতেই চারদিকে আলো হয়ে আছে। ছাদে এসে রঞ্জুর মনটা একটু শান্ত হলো ।
ঠিক এরকম সময় রঞ্জুর মনে হলো পেছনে কেমন জানি এক ধরনের শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছে। একটু অবাক হয়ে পেছন ঘুরে সে যেটা দেখল তাতে তার সমস্ত শরীর শীতল হয়ে গেল, গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দেবে দেবে করেও সে অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে রাখল রঞ্জু দেখল তার পেছনে দুই মানুষ সমান উঁচু জায়গাতে গোলমতোন একটা মহাকাশযান ভাসছে। সেটি বিরাট বড়ো, প্রায় পুরো ছাদ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে—ঠিক নিচে একটা গোল গর্তের মতো, সেখান থেকে নীল আলো বেরিয়ে আসছে। মহাকাশযানটি প্রায় নিঃশব্দ, শুধু হালকা একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ, খুব কান পেতে থাকলে শোনা যায়। রঞ্জু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। প্রথমে মনে হলো সে বোধহয় পাগল হয়ে গেছে—পুরোটা দৃষ্টিবিভ্রম, কিন্তু ভালো করে তাকাল সে, বুঝতে পারল এটা দৃষ্টিবিভ্রম নয় সত্যি সত্যি দেখছে। কী করবে বুঝতে না পেরে সে মুখ হা করে তাকিয়ে রইল
একটু পরে নীল আলোতে হঠাৎ একটা আবছা ছায়া দেখতে পায়, ছায়াটা কিলবিল করে নড়তে থাকে। তারপর হঠাৎ সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়, মনে হতে থাকে অনেক দিন না খেয়ে একটা মানুষ শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে-শুধু মাথাটা না শুকিয়ে আরো বড়ো হয়ে গেছে, সেখানে গোল গোল চোখ, নাক নেই, সেখানে দুটি গর্ত। মুখের জায়গায় গোল একটা ফুটো দেখে মনে হয় বুঝি খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । প্রাণীটি কিলবিল করতে করতে একটা শব্দ করল। শব্দটি অদ্ভুত। শুনে মনে হয় একজন মানুষ হাঁচি দিতে গিয়ে থেমে গিয়ে কেশে ফেলেছে। রঞ্জু কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, ‘ওয়েলকাম জেন্টলম্যান।' কেন জানি তার ধারণা হলো ইংরেজিতে কথা বললে সেটা এই প্রাণী ভালো বুঝতে পারবে। প্রাণীটা তখন হঠাৎ করে পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘শুভসন্ধ্যা মানবশিশু।'
রঞ্জু অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি বাঙালি?” প্রাণীটা বলল, ‘না, আমি বাঙালি নই । তবে আমি তোমার গ্রহের যে কোনো মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারি । এই দেখ—' বলে প্রাণীটা পরিষ্কার চাটগাঁয়ের ভাষায় বলল, ‘আঁসার বজা কুরার বজা ফত্যি আডত বেচি, বাজার গরি বাড়িত আইলে ইসাব লয় তোর চাচি।' ফ্লাইং সসার এবং তার রহস্যময় প্রাণী দেখে রঞ্জু যত অবাক হয়েছিল তার মুখে চাটগাঁয়ে কথা শুনে সে তার থেকে বেশি অবাক হয়ে গেল। সে খুক খুক করে একটু হেসে ফেলে বলল, ‘তোমার নাম কী?’ ‘তোমাদের মতো আমাদের নামের প্রয়োজন হয় না । আমরা এমনিতেই পরিচয় রাখতে পারি।' রঞ্জু বলল, 'আমার নাম রঞ্জু । তোমাকে দেখে আমার খুব মজা লাগছে।' 'কেন?' ‘আমার তো সায়েন্স ফিকশন পড়তে খুব ভালো লাগে—তাই।' ‘আমাদের কিছু পড়তে হয় না। আমরা এমনিতেই সব জানি।' 'সত্যি?' ‘সত্যি । আমরা তোমার কাছে এসেছি একটা কারণে। আমাদের এক্ষুনি ক্র্যাব নেবুলাতে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু আমাদের ফুয়েল ট্যাংকে একটা লিক হয়ে গেছে সেটা সারানোর সময় নেই। তুমি সেজন্য আমাদের সাহায্য করবে।' রঞ্জু অবাক হয়ে বলল, ‘আমি?’ ‘হ্যাঁ তুমি ৷’ ‘কীভাবে?’ ‘তোমার বাম পকেটে একটা চিউইংগাম আছে। সেটা চিবিয়ে নরম করে দাও, আমাদের ট্যাংকের লিকটাতে সেটা লাগিয়ে নেব । রঞ্জু অবাক হয়ে গেল, সত্যি সত্যি তার পকেটে চিউইংগামের একটা স্টিক আছে। সেটা মুখে পুরে চিবিয়ে নরম করে মুখ থেকে বের করে প্রাণীটার দিকে এগিয়ে দেয় । প্রাণীটা বলল, ‘আরও কাছে আসো । আমি এই নীল শক্তি বলয় থেকে বের হতে পারব না।' রঞ্জু আরেকটু এগিয়ে গেল। প্রাণীটা তখন তার তুলতুলে নরম হাত দিয়ে চিউইংগামটা নিয়ে বলল, “অনেক ধন্যবাদ।' রঞ্জু বলল, ‘এখন তোমরা যাবে?' ‘হ্যাঁ। তুমি আমাদের সাহায্য করেছ বলে আমরা তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই।' রঞ্জু কাঁপা গলায় বলল, 'কী উপহার? ’ ‘আমরা যেখানে থাকি, সেই ক্র্যাব নেবুলার একটি ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি আছে। তোমাদের গ্রহতেই পেয়েছি, আমরা অনেকগুলো নিয়ে যাচ্ছি আমাদের বাসস্থানে। তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি একটা। হাত বাড়াও—— উত্তেজনায় রঞ্জুর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হলো। সে হাত বাড়িয়ে দেয় এবং সেখানে গোলমতোন একটা জিনিস এসে পড়ল ৷
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নীল আলোটা ভেতরে ঢুকে যায় আর ফ্লাইং সসারের মতো জিনিসটা ঘুরপাক খেতে খেতে উপরে উঠে যেতে থাকে । রঞ্জু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল সেটা ছোটো হয়ে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। গোলাকার জিনি- সটা হাতে নিয়ে সে সিঁড়ির দিকে ছুটে যায়। সিঁড়ির আলোতে জিনিসটা ভালো করে দেখল এবং সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল সেটা একটা আমড়া। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ল আমড়ার আঁটিটা আসলে সত্যিই ক্র্যাব নেবুলার মতো দেখতে। মহাকাশের এক বিচিত্র প্রাণী তার সঙ্গে এ রকম ফাজলামি করবে কে জানত! রঞ্জু হতচকিতের মতো নিজের ঘরে এসে ঢুকল, শিউলি তাকে দেখে এগিয়ে আসে, ‘কী রে রঞ্জু তুই কোথায় ছিলি, খুঁজে পাচ্ছিলাম না ৷' রঞ্জু নিচু গলায় বলল, 'ছাদে।’ ‘ছাদে একা একা কী করছিলি?' রঞ্জু খানিক ক্ষণ শিউলির দিকে তাকিয়ে রইল, ‘তারপর বলল, কিছু না।' “কিছু না?' 'না।' শিউলি একটু অবাক হয়ে রঞ্জুর দিকে ঘুরে তাকাল, তাকে ভালো করে দেখল তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘তোর কী হয়েছে? এরকম করে তাকিয়ে আছিস কেন?” ‘কী রকম করে?’ 'মনে হচ্ছে তুই ভূতটুত কিছু একটা দেখে এসেছিস!' রঞ্জু কিছু বলল না। শিউলি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তোর হাতে ওটা কী? ‘আমড়া ।’ ‘আমড়া!' শিউলির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ‘আমার জন্যে এনেছিস?” রঞ্জু দুর্বলভাবে হেসে বলল, ‘তুমি নেবে?’ ‘দে—' শিউলি রঞ্জুর হাত থেকে আমড়া নিয়ে ওড়না দিয়ে মুছে একটা কামড় দিয়ে বলল, “উহ্! কী টক ! কোথায় পেলি এই আমড়া?’ রঞ্জু কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘কোথায় আবার পাব? সবাই যেখানে পায় সেখানেই পেয়েছি!' লেখক-পরিচিতি মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নেত্রকোনা জেলায়। তিনি একজন প্রগতিশীল লেখক, পদার্থবিদ, কম্পিউটার-বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, কিশোর উপন্যাস ও কলাম লেখক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে 'কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ', 'ক্রুগো', 'ট্রাইটন একটি গ্রহের নাম’, ‘রবোনগরী' ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি; ‘হাতকাটা রবিন’, ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ' ইত্যাদি কিশোর-উপন্যাস; ‘নিউরনে অনুরণন’, ‘একটুখানি বিজ্ঞান’, ‘গণিতের মজা মজার গণিত', 'বিগ ব্যাং থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স' ইত্যাদি বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক গ্রন্থ। ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস' ও ‘ছোটোদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস' তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ। মুহম্মদ জাফর ইকবালের একাধিক উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ।
আমার বাবাকে আমি কখনো দেখিনি । আমার জন্মের ছয় মাস আগে আমার বাবার চোখ থেকে এই পৃথিবীর আলো চিরকালের জন্য মুছে গিয়েছিল, তিনিও আমাকে দেখেননি । আমি থাকতাম আমার মায়ের সঙ্গে । মা হালকা গড়নের মহিলা, আমার এক দাদি তাঁকে বলতেন মোমের পুতুল । মার স্বভাবটিও কোমল প্রকৃতির, তিনি কখনো রাগ করতে পারতেন না । আমাদের বাড়িতে কাজ করত পেগোটি বলে একটি মেয়ে, ওর সঙ্গেও মাকে কোনোদিন উঁচুগলায় কথা বলতে শুনিনি। পেগোটি থাকত আমাদের পরিবারের একজন হয়ে, আমাদের খেলাধুলা সব একসঙ্গে, খাওয়াদাওয়াও একসঙ্গে, একই টেবিলে। পড়াশোনা আমি করতাম মায়ের কাছেই, মায়ের কাছে লেখাপড়ার ব্যাপারটা খেলাধুলার মতোই ভালো লাগত। মা আর পেগোটির সঙ্গে আমার বেশ ভালোই কাটছিল।
আমার এই ছিমছাম সুখের জীবনে প্রথম ধাক্কা আসে আমার আটবছর বয়সে। মা একদিন ফের বিয়ে করলেন। আমার সৎ বাবা মার্ডস্টোন সাহেব দশাসই পুরুষ, তাঁর মস্ত জুলফি, পুরু গোঁফ এবং জোড়া ভুরু । তাঁকে দেখে প্রথম থেকেই আমার ঠিক নিজের লোক বলে মনে হয়নি। এর ওপর আমাদের সঙ্গে স্থায়ীভাবে বাস করতে এলেন তাঁর বোন। ভাইবোনের চেহারায় খুব মিল, গলার স্বরও প্রায় একই রকম। ভাইবোনের স্বভাবও
একইরকম— যেমন মার্ডস্টোন সাহেব তেমনি তাঁর বোন—দুজনেই কড়া মেজাজের মানুষ, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের দুষ্টুমি তাঁরা বরদাশত করতে পারতেন না, আসার পর থেকেই আমার কথাবার্তায়, আদব-কায়দায় খুঁত বার করার জন্য একেবারে হন্যে হয়ে উঠলেন। এমনকি আমার লেখাপড়া শেখাবার কাজটিও মার্ডস্টোন সায়েব নিজের হাতে নেওয়ার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠলেন। আমি কিন্তু কোনো ব্যাপারেই তাঁর কাছে ঘেঁষতে চাইতাম না, পড়াশোনা করে পড়া দিতে যেতাম মাকেই । কোথাও আটকে গেলে মা আদর করে বলতেন, ‘বাবা ডেভি, মনে করতে পারছ না? একটুখানি চেষ্টা করে দেখো তো।' মার্ডস্টোন সাহেব কর্কশ গলায় বলতেন, 'আহ্। ক্লারা, ওভাবে বললে হবে না।' মার্ডস্টোন সাহেবের বোনও একই রকম কণ্ঠে ভাইয়ের সমর্থনে এগিয়ে আসতেন, ‘সোজা বলে দাও, পড়া মুখস্থ করে আসুক।' এখন তাদের মুখের ওপর কিছু বলা আমার মায়ের সাধ্যে কুলায় না। আমি আবার বই নিয়ে বসি। কিন্তু মুশকিল হলো এই যে, মায়ের কোল ঘেঁষে বসে যে কাজটি আমি পানির মতো সহজ করে বুঝতে পারি, যে পড়া অবলীলায় বলে যাই, মার্ডস্টোন সাহেব কি তাঁর বোন সামনে থাকলে সেটি আর হয়ে ওঠে না। মার্ডস্টোন সাহেব জিজ্ঞেস করলে আমার জানা অংক ভুল হয়, মুখস্থ পড়া ভুলে যাই । ঠিকমতো পড়া দিতে পারলেও তাঁদের মন পাওয়া যায় না, মার্ডস্টোন সাহেব এমন সব কঠিন অংক কষতে দিতেন যে আমার একেবারে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হতো। তাঁদের এড়িয়ে চলার জন্য আমি গিয়ে ঢুকতাম আমার ঘরের লাগোয়া ছোটো ঘরে, এখানে আমার বাবার কয়েকটি বই স্তূপ করে রাখা ছিল, তাঁর মৃত্যুর পর থেকে এসব কেউ ছুঁয়েও দেখত না। এখানে একা একা বসে আমি ‘রডারিক র্যানডম', 'টম জোনস', ‘দি ভিকার অফ ওয়েকফিল্ড’, ‘ডন কুইকসোট', 'রবিনসন ক্রুসো', ‘আরব্য রজনী—এসব বইপত্র পড়তাম। কিন্তু মার্ডস্টোন সাহেবের হাত থেকে তবু আমার রেহাই নেই । আর আমার এমন অবস্থা যে তাঁর হাতে পড়লেই পড়া আর বলতে পারি না ৷ একদিন এমনি কী ভুল হয়ে গেল, মার্ডস্টোন সাহেব আমার ঘরে ঢুকলেন হাতে বেত নাচাতে নাচাতে । পেছনে তাঁর বোন। প্রায় ফৌজি কায়দায় দুজনকে ঢুকতে দেখে মা ভয়ে কাঁপছিলেন। আমার ওপর হঠাৎ করে বেতের বাড়ি পড়তে শুরু করলে আমি চিৎকার করে বললাম, ‘পায়ে পড়ি, মারবেন না, মারবেন না। আমি তো আজ সারাদিন ধরে পড়লাম, আপনাদের দুজনকে দেখেই সব ভুলে গিয়েছি, আপনাদের দেখলেই আমার জানা পড়া গুলিয়ে ফেলি।' ‘তাই?' বাজখাঁই গলায় মার্ডস্টোন সাহেব বললেন, ‘সব গুলিয়ে ফেলো, না? দেখি কি করে মনে রাখতে পারো, সেই ব্যবস্থা করি।’
আমার মাথাটা তিনি আঁকড়ে ধরতে চাইছিলেন, কিন্তু আমি মাথা গলিয়ে তাঁর হাত থেকে মুক্ত হলে তিনি আমার মুখ চেপে ধরে পিঠে সপাং সপাং করে বেতের কয়েকটা ঘা মারলেন, আমি আর সহ্য করতে না পেরে আমার মুখে চেপে ধরা তাঁর হাতের বুড়ো আঙুলে এ্যায়সা জোরে এক কামড় বসিয়ে দিলাম যে যন্ত্রণায় তিনি একেবারে চিৎকার করে উঠলেন । তারপর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে তিনি শুরু করলেন তাঁর আসল মার, বেতের মুহুর্মুহু আঘাতে আমার শরীর একেবারে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল। ভাবলাম আজ আমি একেবারে মরেই যাব। মারতে মারতে মার্ডস্টোন সাহেবও ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আমার ঘরে আমাকে ঠেলে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হলো । অন্ধকার গাঢ় হয়ে এল, কিন্তু ঘরে আমার একটি বাতিও জ্বলল না । এর মধ্যে মিস মার্ডস্টোন রুটি আর কয়েক টুকরো গোশত দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু অন্ধকার হওয়ার পর আর কেউ এল না। আমি একা একাই ঘুমিয়ে পড়লাম। এইভাবে পাঁচদিন কাটলো, আমার মনে হলো, মার্ডস্টোন সাহেবের হাত কামড়ে দিয়ে আমি বোধহয় ভয়ানক একটি অপরাধ করে ফেলেছি। আমার মা একদিনও এলেন না, তাঁকে পেলেও না হয় আমি মাফ চাইতে পারতাম ।
পেগোটি আমাকে চুপচুপ করে খবর দিয়ে যায় যে, লন্ডনের একটি আবাসিক স্কুলে আমাকে ভর্তি করার আয়োজন চলছে । দেখতে দেখতে আমার বিদায় নেওয়ার সময় ঘনিয়ে এল । আমি বিদায় নেওয়ার সময় মার গলা বেশ ভারি হয়ে আসছিল। এতে মার্ডস্টোন সাহেব এবং তাঁর বোন দুজনেই খুব বিরক্ত । আমার জন্যে মা যে একটু প্রাণ খুলে কাঁদবেন এঁরা সে অধিকারটুকুও তাঁকে দিতে রাজি নন ।
ঘোড়ার গাড়ি যাত্রা শুরু করল । পকেট থেকে রুমাল বের করে আমি চোখে চেপে ধরলাম, কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি তা ভিজে একেবারে চপচপে হয়ে গেছে । আধমাইল পথ পেরিয়ে গাড়িটা একটু থামে, থামতে না থামতে পথের ধারে ঝোপ থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে পেগোটি। এক লাফে গাড়িতে উঠে সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। বাড়িতে আমাকে আদর করা দূরে থাক, বেচারি কথা বলার সুযোগটা পর্যন্ত পায় না । আমাকে ছেড়ে দিয়ে একটি কাগজের টুকরো আমার হাতে তুলে দিয়ে আর একবার সে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর গাড়ি থেকে নামবার আগে গাড়িতে একটি ব্যাগ রেখে দিল । গাড়ি ফের গড়িয়ে চলতে শুরু করলে আমি ব্যাগটা খুলে দেখি এক টুকরো কাগজে আমার মার লেখা, “ডেভিকে অনেক আদর ও ভালোবাসা।' কাগজটির সঙ্গে কয়েকটি টাকা ।
কিছুক্ষণ পর একই এক্কাগাড়ি থেকে নেমে উঠতে হলো লন্ডনগামী কোচে। বিকাল তিনটেয় ঘোড়ায় টানা সেই কোচ ছাড়ল, লন্ডন পৌঁছবার কথা সকাল আটটায়। কোচে রাত্রিটা কিন্তু তেমন আরামে কাটেনি । দুইপাশে দুজন ভদ্রলোক ঘুমোতে শুরু করলেন, আমার দুই ঘাড় হলো তাঁদের দুজনের বালিশ। আমার অবস্থা একেবারে শোচনীয়।
শেষ পর্যন্ত সূর্য উঠল । আমার দুই দিকের দুই সহযাত্রীর ঘুম ভাঙল। কিছুক্ষণ পর দূর থেকে লন্ডন শহর দেখে আমার যে শিহরন হলো তা আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। এই আমাদের স্বপ্নের লন্ডন শহর। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, এখানে আমি একেবারে একা । রবিনসন ক্রুসোর চাইতেও একা। রবিনসন ক্রুসো যে একা তা তো আর কেউ দেখেনি, আর এই জনাকীর্ণ শহরে আমার একাকিত্ব যেন সকলের চোখে পড়ছে
নানারকম ঝামেলার পর এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হলো। তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসছিলেন। ‘তুমিই তো নতুন এলে?' আমার দিকে তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘এসো, আমি সালেম হাউসের শিক্ষক।' আমি জানি যে সালেম হাউসে আমাকে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু ওই স্কুলের এই শিক্ষকের চেহারা একটুও আকর্ষণীয় নয়। দেখতে তিনি বড়ো রোগা, গায়ের রং ফ্যাকাশে, তাঁর পোশাকও বিবর্ণ, প্যান্টের ঝুল ও শার্টের হাতা বেশ খাটো। আমার হাত ধরে তিনি চলতে শুরু করলেন। এদিকে আমার তখন খুব খিদে পেয়েছে, শরীর বেজায় ক্লান্ত । খিদের কথা বলতে আমার বাধো বাধো ঠেকছিল, তবে আমার নতুন শিক্ষকের চেহারা দেখে ভয় পাবার কিছু নেই । আমি বললাম, ‘কাল দুপুরের পর থেকে কিছু খাইনি।' আরো সাহস করে বললাম, “কিছু কিনে খেলে ভালো হতো।' তিনি রাজি হলে একটা দোকান থেকে ডিম আর মাংস কিনে নিলাম । এখন এগুলো খাব কী করে? আমার নতুন শিক্ষক একটি ঘোড়ার গাড়িতে করে কোথায় যে নিয়ে চললেন আমি ঠিক বুঝতেও পারছিলাম না। রাস্তায় সাংঘাতিক কোলাহল, হইচই, এইসব আওয়াজে আমার মাথায় জট পাকিয়ে যাচ্ছিল, লন্ডন ব্রিজ পেরোবার সময় ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছিল। কিছুক্ষণ চলবার পর শিক্ষক আমাকে নিয়ে নামলেন। তাঁর সঙ্গে আমি যে ছোটো ঘরটিতে ঢুকলাম সেটি বেশ গরিব কোনো মানুষের বাসস্থান, দেখেই বোঝা যায় এটা কোনো অনাথ আশ্রমের অংশ । আবার একটি পাথরে খোদাই করা রয়েছে, ‘পঁচিশ জন দরিদ্র রমণীর জন্য প্রতিষ্ঠিত ।’
ছোটো স্যাঁতসেতে ঘরটিতে ঢুকতেই বৃদ্ধা এক মহিলা খুশিতে ডেকে উঠলেন, ‘বাবা চার্লি।' কিন্তু আমার দিকে তাঁর চোখ পড়তেই একটু থতমত খেয়ে চুপ করলেন। নতুন শিক্ষক তাঁর হাতে ডিম দিলে সসপ্যানে সেটা ভেজে দিলেন, মাংসের টুকরো সেদ্ধ করে দিলেন। আমি তো তখন ক্ষুধার্ত, গোগ্রাসে ওইসব খাচ্ছি তো শুনি যে বৃদ্ধা মহিলা শিক্ষককে বলছেন, ‘বাঁশিটা সঙ্গে থাকলে একটু বাজাও না।' কোটের ভেতর হাত দিয়ে শিক্ষক বাঁশির তিনটে টুকরা বের করলেন, টুকরাগুলি জোড়া দিয়ে সম্পূর্ণ বাঁশি ঠিক করে নিয়ে তিনি বাজাতে শুরু করলেন । তিনি কী সুর বাজালেন আমি জানি না, কেমন বাজিয়েছেন তাও বুঝিনি, কিন্তু তাঁর বাঁশির তীব্র ধ্বনি আমার বুকে দারুণ প্রতিধ্বনি তুলল, আমার সমস্ত বেদনার কথা যেন খুঁড়ে ওপরে উঠে এল, আমার সব কষ্টের কথা মনে পড়ল, শেষপর্যন্ত চোখের পানি আর চেপে রাখতে পারলাম না । এর মধ্যে ওই মহিলা এবং আমার নতুন শিক্ষকের চেহারার মিল দেখে আমি বুঝতে পাচ্ছিলাম যে এঁরা মা এবং ছেলে। আমার শিক্ষকের মা এত গরিব কেন, দাতব্যভবনে বাস করেন কেন—এসব প্রশ্ন মনে একটু উঁকি দিলেও আমার সমস্ত মাথা জুড়ে তখন কেবল বাঁশির সুর। আমার আস্তে আস্তে ঘুম পেতে লাগল। যখন ঘুম ভাঙল, দেখি আমি ঘোড়ার গাড়িতে বসে রয়েছি, পাশে পায়ের ওপর আড়াআড়িভাবে আরেকটি পা রেখে বাঁশি বাজিয়ে চলেছেন আমার নতুন শিক্ষক । আমি ফের ঘুমিয়ে পড়ি ।
গাড়ি থামলে স্যার আমাকে নিয়ে নিচে নামলেন । সামনে উঁচু দেওয়ালে মস্ত একটি বাড়ি, সাইনবোর্ডে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘সালেম হাউস।' এটাই তাহলে আমার নতুন স্কুল । দরজায় কড়া নাড়লে শক্তসমর্থ একটি লোক বেরিয়ে আসে। ঘাড়টা ষাঁড়ের ঘাড়ের মতো মোটা, একটা পা কাঠের, ছোটো করে কাটা মাথার চুল। স্যার আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলে সে আমাকে ভালো করে দেখল। লোকটি ভেতর থেকে এক জোড়া জুতো এনে সামনে ফেলে দিতে দিতে বলল, ‘মেল সাহেব, মুচি আপনার জুতো ঠিক করতে চায় না। এটার মেরামত করার কিছু নেই, তালি দিতে দিতে একেবারে শেষ হয়ে গেছে।' জুতোজোড়া হাতে আমার নতুন শিক্ষক মেল সাহেব ওপরে উঠতে লাগলেন, পিছে পিছে আমি । দোতলায় উঠে শেষ প্রান্তের ঘরে হাঁটছি, হঠাৎ চোখ পড়ল একটি বোর্ডের দিকে, বোর্ডে সুন্দর করে লেখা ‘সাবধান এটা কামড়ায় ।' আশেপাশে নিশ্চয় কোনো কুকুর আছে এবং সেটা অবশ্যই কামড়ায় এই ভেবে আমি থমকে দাঁড়ালাম । মেল সাহেব পেছনে তাকিয়ে বললেন, “কী হলো?” ‘এখানে বোধ হয় কুকুর আছে স্যার।' বোর্ডের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কুকুর নয়, কপারফিল্ড। আমাকে বলা হয়েছে, ওই বোর্ডটা যেন তোমার পিঠের সঙ্গে আটকে দিই। এখানে এসে প্রথমেই তোমার মনটা খারাপ করে দিতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু এটা আমাকে করতেই হবে।' আমার সৎ বাবার হাতের আঙুলে কামড় দিয়েছিলাম, সেই খবর তাহলে এখানেও পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, তার শাস্তি কি আমাকে পেতে হবে এভাবে? সত্যি, আমি একেবারে দমে গেলাম। ক্লাসের সহপাঠীরা আমার পিঠ দেখবে আর আমাকে নিয়ে যে কি ঠাট্টা বিদ্রূপ করবে ভাবতেই লজ্জায়, ভয়ে আমি একবোরে কুঁকড়ে যেতে লাগলাম।
স্কুলের মালিক এবং প্রধান ক্রিকল সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর সুন্দর বৈঠকখানায় বসেছিলেন মিসেস ক্রিকল আর তাঁদের মেয়ে। এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম কাঠের পা-ওয়ালা ওই লোকটিকে । ক্রিকল সাহেবের মুখ টকটকে লাল, মনে হয় সবসময় সেখানে আগুন জ্বলছে, চোখজোড়া তাঁর ছোটো, কপালের রগগুলো সব স্পষ্ট দেখা যায়। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এর নামে কোনো রিপোর্ট আছে?’ ‘না স্যার’, কাঠের পা-ওয়ালা জবাব দিল, ‘নতুন এসেছে, এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই করার সুযোগ পায়নি ৷' ‘এদিকে এসো।’ ক্রিকল সাহেব আমাকে এই আদেশ দিলে কাঠের পা-ওয়ালা বলে ওঠে, ‘এদিকে এসো।' আমি তাঁর দিকে এগিয়ে এলে আমার কান ধরে ক্রিকল সাহেব বললেন, 'তোমার সৎবাবাকে আমি চিনি, শক্ত স্বভাবের মানুষ। তা তিনিও আমাকে ভালো করেই চেনেন । তুমি আমাকে চেন?” 'না স্যার।'
‘চেনো না, না?’ আমার কানে একটা মোচড় দিয়ে তিনি বললেন, 'চিনবে হে চিনবে ।’ ক্রিকল সাহেবের এই ব্যবহারে আমার যতই খারাপ লাগুক, অনেক বেশি ভয় করতে লাগল স্কুল খুললে ছেলেদের আচরণটা কী হবে সেই ভাবনা করে । তো একদিন স্কুল খুলল, ছেলেরা হোস্টেলে এসে পড়ল। ছেলেরা যথারীতি আমার পেছনে লাগল, কারো পিঠে অমনি একটা বোর্ড সাঁটা থাকলে কিছু ঝক্কি তো তাকে পোয়াতে হবেই। তবে যা ভেবেছিলাম সে রকম ভয়াবহ গোছের কিছু ঘটল না। ‘সাবধান, এটা কামড়ায়' বলতে বলতে ছেলেরা আমাকে খ্যাপাত, কেউ কেউ আঁতকে ওঠার ভান করত, আবার বুনো মানুষের মতো নাচতে নাচতে ‘কুকুর কুকুর' বলে চিৎকারও করেছে। কিন্তু বেশির ভাগ ছেলেই তেমন উৎপাত করেনি। এর ওপর ক্রিকল সাহেব ক্লাসে একদিন আমাকে বেদম মারতে গিয়ে দেখলেন যে পিঠে সাঁটা ওই বোর্ডের জন্য বেতের বাড়ি ঠিক জুতমতো লাগানো যাচ্ছে না, তাই তিনি নিজেই ওটা খুলে ফেললেন ।
তবে ছেলেদের উৎপাতের হাত থেকে বাঁচতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে আমাদের ক্লাসের একটি ছেলে । ওর নাম জে. স্টিরফোর্ড। আমার চেয়ে অনেক বছর বড়ো এই ছেলেটি দেখতে বেশ সুন্দর, ছাত্র হিসেবেও মেধাবী বলে তার বেশ নামডাক রয়েছে। তার প্রতি ক্রিকল সাহেবের একটু পক্ষপাতিত্বও লক্ষ করা যায়। তো এই ছেলেটি প্রথম থেকেই আমার সঙ্গে বেশ ভাব করে ফেলে । ‘রবিনসন ক্রুসো, ‘আরব্য রজনী,’ ‘ডন কুইকসোট’— এসব বইয়ের গল্প আমি বেশ জমিয়ে বলতে পারতাম বলে ছেলেরা অনেকেই আমার পাশে ভিড় করত। স্টিরফোর্ড আর আমি রাত্রে পাশাপাশি বিছানায় ঘুমাতাম, ঘুমাবার আগে তাকে রোজ ওইসব গল্প বলে শোনাতে হতো। এমনিতে স্টিরফোর্ড আমাকে ভালোবাসত আর স্বয়ং ক্রিকল সাহেব তাকে সমীহ করতেন বলে কোনো ছেলে আমাকে ঘাঁটাতে সাহস পেত না। কিন্তু স্টিরফোর্ড কখনো কখনো বড্ডো নিষ্ঠুর হয়ে উঠত।
একদিন বিকালবেলার কথা আমার খুব মনে পড়ে । মেল সাহেবের ক্লাসে গোলমাল হচ্ছিল । মেল সাহেব এমনিতে নিরীহ গোছের মানুষ, সহজে বড়োগলা করে কথা বলতে পারতেন না। সেদিন আমি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে পড়া দিচ্ছিলাম। ছেলেরা প্রায় সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলেই চলেছে, ক্লাসে যে একজন শিক্ষক আছেন তা বোঝাই যাচ্ছিল না। মেল সাহেবের সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তিনি হঠাৎ করে চিৎকার করে ধমক দিলেন, 'চুপ। চুপ কর।' তাঁর মুখে এরকম ধমক শুনতে অনভ্যস্ত ছেলেরা অবাক হয়ে চুপ করে গেল । শেষ সারিতে দেওয়ালে হেলান দিয়ে শিস দিচ্ছিল স্টিরফোর্ড, সে কিন্তু থামল না, শিস দিয়েই চলল। মেল সাহেব বললেন, “স্টিরফোর্ড, চুপ কর।' ‘আপনিই চুপ করুন।’ স্টিরফোর্ড পালটা ধমকের সুরে বলল, ‘জানেন আপনি চোখ রাঙিয়ে কথা বলছেন কার সঙ্গে?' “স্টিরফোর্ড, তুমি কি ভেবেছ তোমার বেয়াদবি আমি লক্ষ করিনি? ছোটো ছোটো ছেলেদের তুমি বারবার উসকে দিচ্ছ, আমি কি দেখছি না ভেবেছ?' বলতে বলতে মেল সাহেবের ঠোঁটজোড়া কাঁপছিল, ‘সবাই জানে যে এখানে তোমার দিকে পক্ষপাতিত্ব করা হয়, সেই সুযোগ নিয়ে তুমি একজন ভদ্রলোককে এভাবে অপমান করতে সাহস পাও?'
‘ভদ্রলোক?' স্টিরফোর্ড মহা বিস্মিত হবার ভান করে বলল, 'ভদ্রলোকটি কোথায় বলুন তো?’ ‘স্টিরফোর্ড, একজন হতভাগ্য মানুষকে এভাবে অপমান করে তুমি খুব ইতর ব্যবহার করলে। তুমি খুব অভদ্ৰ আচরণ করলে, , স্টিরফোর্ড।' বলতে বলতে মেল সাহেব আমার পিঠে আলতো করে চাপ দিয়ে বললেন, 'কপার- ফিল্ড, পড়া বলে যাও।' স্টিরফোর্ড বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল, “শুনুন, একজন ভিখেরির মুখে এরকম কথা মোটেই মানায় না ।’ হঠাৎ ঘরের ভেতর ক্রিকল সাহেবের ফ্যাসফেসে গলায় আওয়াজ গর্জে উঠল, ‘মেল সাহেব, কী হচ্ছে?' মেল সাহেব চমকে উঠলেন । স্টিরফোর্ড বলল, ‘স্যার, আমার প্রতি নাকি এখানে পক্ষপাতিত্ব করা হয়–মেল সাহেবের এই কথায় আমি প্রতিবাদ করছিলাম।' ‘পক্ষপাতিত্ব?’ ফ্যাসফেসে গলায় যতটা সম্ভব হুঙ্কার ছেড়ে ক্রিকল সাহেব বললেন, 'আমার স্কুলে পক্ষপাতিত্বের বদনাম? আপনি কী বলতে চান মেল সাহেব?' মেল সাহেব মাথা নিচু করে বললেন, ‘আমি খুব উত্তেজিত হয়ে বলেছি, স্যার, ঠান্ডা মাথায় থাকলে ও-রকম কথা বলতাম না।' মেল সাহেব বিনীত হলেও স্টিরফোর্ডের উত্তেজনা কিন্তু বেড়েই চলে, সে বলে, 'স্যার, আমাকে ইতর বলা হয়েছে, অভদ্র বলা হয়েছে, তাই আমি রেগে গিয়ে তাঁকে ভিখেরি বলেছি।' মেল সাহেব আমার পিঠে আস্তে আস্তে হাতের চাপ দিয়েই চলেছেন, তিনি যেন আমার কাছে আশ্রয় চাইছিলেন। ক্রিকল সাহেব বললেন, 'ভিখারি? মেল সাহেব ভিক্ষে করেন কোথায়?” “তিনি ভিক্ষে না-করলেও তাঁর নিকট আত্মীয় তো করেন, একই হলো।' বলতে বলতে স্টিরফোর্ড আমার দিকে তাকায়। মেল সাহেব তখনো আমার ঘাড়ে হাত রেখে আস্তে আস্তে চাপ দিচ্ছেন। লজ্জায়, অনুতাপে, আফসোসে আমি মাথা নিচু করে থাকি, আমিই একদিন কথায় কথায় মেল সাহেবের মায়ের গল্প করেছিলাম, তিনি যে দাতব্য আলয়ে বাস করেন সে কথাটিও বলা হয়ে গিয়েছিল । আমার চোখ নিচের দিকে, মেল সাহেব কিন্তু আমার ঘাড়ে আদর করে আস্তে আস্তে চাপ দিয়েই চলেছেন। এর মধ্যে স্টিরফোর্ড বলেই ফেলল, ‘মেল সাহেবের মা দাতব্য আলয়ে অন্যের খয়রাতের ওপর বেঁচে থাকেন।' মেল সাহেব তখন ওই সুন্দর বালকটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন । অনেক কষ্টে ক্রিকল সাহেব উত্তেজনা চেপে রেখে বললেন, 'আমার এই প্রতিষ্ঠানে তো এরকম লোককে থাকতে দেওয়া যায় না।' ক্রিকল সাহেবের কপালের রগ দপ করে ফুলে উঠল, তিনি বললেন, 'আপনি কি এটা একটা দাতব্য স্কুল ভেবেছেন? আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন এখান থেকে অব্যাহতি নিয়ে চলে গিয়ে আমাদের অপমান থেকে অব্যাহতি দিন।' মেল সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, 'আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি। আর সময় নেই । তাঁর সমস্ত সম্বল যা ছিল, কয়েকটি বই এবং তাঁর বাঁশিটি নিয়ে মেল সাহেব আমাদের স্কুল থেকে চলে গেলেন । ওই রাত্রেও স্টিরফোর্ডকে গল্প শোনাতে শোনাতে আমি মেল সাহেবের বাঁশির বিষণ্ন সুর শুনতে পাচ্ছিলাম। রাত অনেক হলে স্টিরফোর্ড ঘুমিয়ে পড়ল । বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি যেন শুনতে পাচ্ছিলাম যে এখান থেকে অনেক দূরে, অন্য কোথাও বসে মেল সাহেব যেন বিষাদাচ্ছন্ন সুরে এক নাগাড়ে বাঁশি বাজিয়েই চলেছেন। আমি খুব অসহায় বোধ করছিলাম।
সকালের খাবার দেবার পর দুজন সাদা মানুষ একবোঝা জামা কাপড় হাতে ঘরে ঢুকল। ভীত বন্দিদের বাঁধন খুলে দিয়ে সেগুলো কী করে পরতে হয় দেখিয়ে দেওয়া হলো। একটা বস্ত্রে পা থেকে কোমর পর্যন্ত, অন্য একটায় ঊর্ধ্বাঙ্গ ঢাকতে হয়। কুন্টার ঘা-গুলো সেরে এসেছিল। জামা-কাপড় পরামাত্র সেগুলো চুলকাতে শুরু করল। বাইরে লোকজনের কথাবার্তার কোলাহল ক্রমে বাড়ছিল। ক্রমশই লোক জমছিল। কুন্টারা জামাকাপড় পরে বিমূঢ় হয়ে বসেছিল- কী জানি এর পরে কপালে আছে! সাদা মানুষদুটো ফিরে এসে প্রথমে রাখা বন্দিদের মাঝে তিনজনকে বার করে নিয়ে গেল। তারপরেই বাইরের আওয়াজের ধরনটা বদলে গেল। কুন্টা অবাক হয়ে কতকগুলো অবোধ্য চিৎকার শুনছিল। "নিখুঁত স্বাস্থ্য ! অফুরন্ত কর্মশক্তি।' অন্য কোনো সাদা মানুষের গলা
‘তিনশো পঞ্চাশ!’ ‘চারশো !’ প্রথম সাদা মানুষটির চিৎকার শোনা গেলো, ‘ছয়! কে ছয় বলবেন? তাকিয়ে দেখুন। দুর্দান্ত কর্মক্ষমতা !” কুন্টা ভয়ে শিউরে উঠছিল। তার মুখ বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছিল । নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিল । যখন চারজন সাদা মানুষ ঘরে ঢুকল—সে যেন অসাড় ! কুন্টাকে স্পর্শ করতে সে রাগে ভয়ে দাঁত খিঁচিয়ে উঠল । তখনই মাথায় একটা প্রবল আঘাত পেয়ে তার বোধশক্তি লুপ্ত হয়ে গেল। সচেতন হয়ে উঠতে দেখতে পেল—উজ্জ্বল দিবালোকে আরো দুজনের সঙ্গে সেও বাইরে লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে শত শত সাদা মানুষ হা-করে তাকিয়ে আছে। তারই মাঝে দুটো কালো মানুষ শিকল হাতে দাঁড়িয়ে। মুখের ভাব দেখে মনে হয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে তারা একান্ত উদাসীন। চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত, লক্ষ্যহীন। ‘সদ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা ৷' ‘বাঁদরের মতো তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন ! ‘সবকিছু শিখিয়ে নেওয়া যাবে !” সাদা মানুষটা পায়চারি করতে করতে হাত নেড়ে কুন্টার আপাদমস্তক নির্দেশ করে কথাগুলো চিৎকার করে বলছিল। তারপর কুন্টাকে জোর করে ঠেলে সামনে একটা বেদির মতো উঁচু জায়গায় ওঠাল। ‘একেবারে সরেস! নিজের ইচ্ছামতো গড়ে নেওয়া যাবে! কুন্টা ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে লক্ষও করেনি কখন চারদিকের লোকজন এগিয়ে এসে তার সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করছে। ‘তিনশো ডলার!’-‘তিনশো পঞ্চাশ!’ ‘পাঁচশো!” “ছয়!’ সাদা মানুষটা ক্রুদ্ধ গর্জনে বলে উঠল—'বাজারের সেরা। তরুণ যুবা । কেউ কি সাড়ে সাত বলবেন? একজন চেঁচিয়ে উঠল— “সাড়ে সাত!’ ‘আট ! আট !’ ডাক উঠল—‘আট!' আর কেউ কিছু বলে ওঠার আগেই আবার শোনা গেল—'সাড়ে আট ।’ ডাক আর চড়ল না। যে সাদামানুষটা এদিক থেকে চেঁচাচ্ছিল, সে কুন্টার শিকল খুলে নিয়ে তাকে সামনে একজনের দিকে ঠেলে দিল । এই নতুন সাদা মানুষটার পেছনে একজন কালো লোক। শিকলের প্রান্তটা তারই হাতে দেওয়া ছিল। তার প্রতি কুন্টার অনুনয়পূর্ণ চাহনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো। সে লক্ষ্যহীন নির্বিকার দৃষ্টিতে কুন্টাকে শিকলসুদ্ধ টেনে একটা চার চাকার বাক্সের সামনে নিয়ে এল। বাক্সটার সামনে একটা বিরাট গাধাজাতীয় পশু। কালো লোকটা রূঢ়ভাবে কুন্টাকে বাক্সের মেঝেতে ঠেলে ফেলে দিয়ে শিকলটা কোথায় আটকে দিল। কিছুক্ষণ পরে কুন্টা গন্ধে অনুভব করল-সাদা মানুষটা ফিরে এসেছে। সে গাড়ির ওপরে চড়ে বসতে, কালো লোকটিও সামনের সিটের মাথায় উঠে বসে একটা চামড়ার ফিতে পশুটার পিঠে আছড়ে ফেলল । অমনি বাক্সটা গড়িয়ে চলতে শুরু করল।
কুন্টা শিকলটা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখল । বড়ো ক্যানুতে তাদের যে শিকল দিয়ে বাঁধা হয়েছিল, তার থেকে এটা হালকা ধরনের। প্রাণপণে চেষ্টা করলে কি ছেঁড়া যাবে না? কিন্তু এখন গাড়ি থেকে লাফাবার উপযুক্ত সময় নয়। কুন্টা একবার মাথা তুলে সাদা মানুষটার দিকে তাকাল। সেই মুহূর্তে সেও পেছন ফিরে তাকাতে তাদের চোখাচোখি হয়ে গেল । ভয়ে কুন্টার দেহ হিম। কিন্তু সাদা মানুষটার মুখে ভাবের লেশমাত্র ছিল না । পথের ধারে বিস্তৃত শস্যক্ষেত্র। বিভিন্ন রঙের শস্য দেখা যাচ্ছে। তার মাঝে ভুট্টা সে চিনতে পারল। জুফরেতে ফসল কাটবার সময় যেমন দেখতে হয়, তেমনি। খানিকক্ষণ পর সাদা মানুষ এবং কালোটি দুজনেই শুকনো রুটি আর মাংস বের করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল । কুন্টার খুবই ক্ষিধে পেয়েছিল। খাদ্যের সুগন্ধে তার জিভে জল এসে গেল । তবুও সামনের কালো লোকটি যখন পেছন ফিরে তাকে এক টুকরো রুটি দিতে চাইল, সে তার মুখ ফিরিয়ে নিল। সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। তাদের গাড়ির পাশ দিয়ে আর একটি গাড়ি বিপরীত দিকে ছুটে গেল। গাড়িটির পেছনে চরম ক্লান্তিভরে দ্রুত পদক্ষেপে চলছিল মোটা কাপড়ের পুরোনো ছেঁড়া পোশাক পরা সাতটি কালো মানুষ। তাদের মুখে গভীর হতাশার ছাপ। ক্রমে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে কুন্টাদের গাড়িটা পাশের ছোটো রাস্তায় ঢুকে পড়ল । দূরে গাছের ফাঁকে একটা বিরাট সাদা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। এবার কী হবে? এখানেই কি তাকে হত্যা করে খাওয়া হবে? বাড়িটার কাছে এসে কুন্টা আরো কালো মানুষের গন্ধ পেল। অন্ধকারের ভেতর তিনটি মানুষের আকার বোঝা যাচ্ছিল। একজনের হাতে আলো ঝোলানো। বড়ো ক্যানুর অন্ধকার খোলের ভেতর এ ধরনের আলো কুন্টা দেখেছে। কেবল এটার চারপাশে একটা স্বচ্ছ চকচকে আবরণ, তার ভেতর দিয়ে অবশ্য স্পষ্ট দেখা যায়। কালো লোকগুলোর পাশ দিয়ে একটা সাদা মানুষ এগিয়ে এল। গাড়িটা থেমে যেতে একজন আলোটা উঁচু করে ধরল। ভেতরের সাদা মানুষটা নেমে এসে নতুন লোকটার সঙ্গে করমর্দন করল। তারপর দুজনে হাসিমুখে বাড়ির দিকে চলে গেল । কুন্টার মনে একটু আশা হলো । এবার কালো লোকেরা তাকে ছেড়ে দেবে না? কিন্তু এ কেমন কালো লোক? তারা তাকে দেখে বিদ্রূপের হাসি হাসছে! নিজের স্বজাতির লোক নিয়ে এরা পরিহাস করছে? ছাগলের মতো সাদা মানুষের হুকুমে কাজ করে? এদের আফ্রিকাবাসীর মতো দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু এরা কখনো তা হতে পারে না । গাড়িটা কুন্টাকে নিয়ে এগিয়ে গেল । অন্য কালো লোকগুলো হাসাহাসি করতে করতে পাশে পাশে চলল। কিছুদূর গিয়ে গাড়িটা থামতে, চালক নেমে এসে শিকলের অপর প্রান্ত খুলে রূঢ় ভঙ্গিতে টান মেরে কুন্টাকে নামতে ইঙ্গিত করল। লোকগুলো জোর করে তাকে নামাল । তারপর একটা খুঁটির সঙ্গে শিকলটা আবার বেঁধে দিল । কুন্টা দৈহিক যন্ত্ৰণা, ত্রাস, ক্রোধ ও ঘৃণাতে কাতর হয়ে সেখানে পড়ে থাকল। একজন তার সামনে এক পাত্র জল ও এক পাত্র খাদ্য নামিয়ে রাখল। খাদ্যটা যেমন অদ্ভুত দেখতে, তেমনি অদ্ভুত তার গন্ধ । তবুও তা দেখেই কুন্টার রসনা
লালায়িত হয়ে উঠল। কিন্তু কুন্টা মুখ ফিরিয়েই থাকল। কালো লোকগুলো তা দেখে আবারও বিদ্রূপের হাসি হাসল। গাড়ির চালক আলোটা তুলে ধরে মোটা খুঁটির কাছে গিয়ে শিকলটা জোরে টেনে কুন্টাকে দেখিয়ে দিল—ওটা ছেঁড়া যাবে না। তারপর খাবারের দিকে ইঙ্গিত করে শাসানির ভঙ্গি করল। সবাই হাসতে হাসতে চলে গেল ।
কুন্টা অপেক্ষা করতে লাগল—কখন সবাই ঘুমোবে, কখন সে পালাবার সুযোগ পাবে। এরই মধ্যে একটা কুকুর এসে তার খাবারের পাত্র খালি করে দিয়ে গেল। রোষে কুন্টার সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল। সে খানিকটা জলপান করে নিল। কিন্তু তাতে শারীরিক অবস্থার বিশেষ উন্নতি হলো না । পালাবার অদম্য ইচ্ছা অতি কষ্টে দমন করে সারারাত সে জেগে কাটাল। সে জানে শিকল ভাঙবার চেষ্টা করলেই ঝনঝনানির শব্দে পাশের কুটিরের লোক ছুটে আসবে। ইতোমধ্যেই কুকুরের ডাকে গাড়ির চালকটি একবার বেরিয়ে এসে শিকল পরীক্ষা করে গিয়েছে।
পুবের আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছিল । কুন্টা আর একটু জল পান করল । এমন সময় সেই কালো লোক চারটে দ্রুত পায়ে এসে কুন্টাকে টেনে তুলে আবার সেই গড়ানো বাক্সের মতো গাড়িটাতে চড়ে বসল। তারপর গাড়ি বড় রাস্তা দিয়ে আগের দিনের মতই চলল । কুন্টার দুই চক্ষু অপরিসীম ক্রোধ ও ঘৃণায় সামনের মানুষগুলোর পিঠের ওপর অগ্নিবর্ষণ করতে থাকল । যদি এদের খুন করা যেত! কিন্তু বুদ্ধি স্থির রাখতে হবে । মাথা গরম করলে চলবে না। অযথা শক্তি ক্ষয় করে লাভ নেই । কিছু দূর গিয়ে ঘন বন দেখা গেল। কতক জায়গায় গাছ কেটে জঙ্গল সাফ করা হয়েছে। আবার কিছু জায়গায় জঙ্গল পোড়ানো হচ্ছে। ধূসর বর্ণ ধোঁয়ার রাশি উঠছিল। সাদা মানুষরাও কি জুফরের মতো গাছপালা পুড়িয়ে জমির ফলন শক্তি বৃদ্ধি করে?
আরো খানিকটা দূরে কাঠের তৈরি একটি ছোট্ট চৌকো কুটির, আর তার সামনে পরিষ্কার একখণ্ড জমি । একটা ষাঁড়ের পেছনে বাঁকানো হাতলওয়ালা কী একটা মস্ত জিনিস। একজন সাদা মানুষ হাতল দুটো চেপে ধরেছে। তাতে পেছনের মাটি বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আরো দুটো রোগামতন সাদা মানুষ গাছের নিচে উবু হয়ে আছে। তিনটে রোগা-পটকা শুয়োর আর কিছু মুরগি চারপাশে ছুটোছুটি করছে। কুটিরের দরজায় একটি লাল চুলের সাদা মেয়ে মানুষ। তিনটে সাদা বাচ্চা খেলে বেড়াচ্ছিল। তারা গাড়িতে কুন্টাকে দেখে হাত নেড়ে চেঁচাতে লাগল । কুন্টার ভাব দেখে মনে হলো সে হায়েনা শিশু দেখছে! এতদিনে সে সত্যি একটি সাদা মানুষের পুরো পরিবার দেখতে পেল। পথে যেতে যেতে আগেকার মতো আরো দুটি মস্ত সাদা বাড়ি দেখা গেল । প্রত্যেকটির ওপর দিকে একটার ওপর আর একটা চাপানো—দুটো বাড়ির সমান। প্রত্যেকটিরই কাছাকাছি বেশ কিছু ছোটো ছোটো অন্ধকার কুটির। কুন্টা আন্দাজ করল—সেগুলোতেই কালো লোকেদের বাস। আর চারপাশ ঘিরে বিস্তীর্ণ তুলোর খেত ৷ অল্পদিন আগে ফসল তোলা হয়েছে। তখনও গোছা-গোছা তুলো চারদিকে ছড়ানো-ছিটানো ।
প্রিয় মুস্তাফা এক্ষুনি তোর চিঠি গেলাম। তাতে তুই আমায় লিখেছিস যে, তোর ওখানে থাকবার জন্য যা যা করা জরুরি ছিল, সব তুই করে ফেলেছিস। আমি এই খবরও পেয়েছি যে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইনचিनয়ারিং বিভাগে আমাকে নেওয়া হয়েছে। তুই আমার জন্যে যা করেছিল, দোস্ত, সবকিছুর জন্যে তোকে ধন্যবাদ, শুকরিয়া। তবে এটা নিশ্চয়ই, তোর কাছে একটু অদ্ভুত ঠেকবে যখন আমি এ খবরটা দেবো না দোস্ত, আমি আমার মত পালটেছি। আমি তোকে অনুসরণ করে সেই দেশে যাৰ না, যে দেশ 'শ্যামল, সজল আর সুত্র সু সব মুখে ভরা'—যেমন তুই লিখেছিল। না, আমি এখানেই থাকব। কোনোদিন এদেশ ছেড়ে যাব না ।
আমি কিন্তু সত্যি বড় অন্ধতে আছি, মুস্তাফা। আমাদের জীবন আর কখনোই এক খাতে বয়ে যাবে না। অর্থভিন্ন কারণ, আমি যেন শুনতে পাচ্ছি তুই আমার মনে করিয়ে দিচ্ছিস—কী রে, আমরা না কথা দিয়েছিলাম সব সময় একসঙ্গে থাকব, যেমন আমরা চিরকাল একসঙ্গে বালে উঠতাম, 'আমরা বড়োলোক হবোই। আমাদের অনেক টাকা হবে।” কিন্তু দোস্ত, কিছুই আর আমার করার নেই। হ্যাঁ, আমার এখনও সেদিনটা মনে পড়ে যেদিন কায়রোর বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আমি তোর হাত চেপে ধরেছিলাম।
তুই বলছিলি, ‘উড়োজাহাজ ছাড়বার আগে আরো পনেরো মিনিট সময় আছে হাতে । অমনভাবে হা করে আকাশে তাকিয়ে থাকিস না। শোন। পরের বছর তুই কুয়েত যাবি। মাইনে যা পাবি তা থেকে যথেষ্ট টাকা বাঁচাতে পারবি। ফিলিস্তিনের মাটি থেকে শেকড় ওপড়াতে তাই যথেষ্ট। তারপর ক্যালিফোর্নিয়া গিয়ে নতুন করে শেকড় পুঁতবি। আমরা একসঙ্গে সব শুরু করেছি, আর একসঙ্গেই চালিয়ে যেতে হবে আমাদের...'
সেই মুহূর্তে আমি তোর ঠোঁটের দ্রুত নড়াচড়া দেখছিলাম, মুস্তাফা। তোর কথা বলবার ধরনটাই ছিল ওরকম, দাঁড়ি-কমা বাদ দিয়ে হড়বড় করে তোড়ে বলে চলা। কিন্তু আবছাভাবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল তোর এই পালানোতে তুই পুরোপুরি সুখী না। পালাবার তিনটে ভালো কারণ তুই দেখাতে পারিসনি। আমিও সর্বক্ষণ এই আক্ষেপে ভুগেছি । কিন্তু সবচেয়ে স্পষ্ট চিন্তাটা ছিল—এই গাজাকে ছেড়ে সবাই মিলে পালিয়ে যাই না কেন আমরা? কেন যাই না? কেন পারি না? তোর অবস্থা অবশ্য ভালো হতে শুরু করেছিল। কুয়েতের শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে তোকে কনট্রাক্ট দিয়েছিল, যদিও আমাকে দেয়নি। যে দুরবস্থার দাবনার মধ্যে আমি গড়াগড়ি যাচ্ছিলাম, সেটা যেন আর পালটাবেই না। তুই মাঝে মাঝে আমাকে কিছু টাকা পাঠাতিস । তুই চেয়েছিলি আমি যেন ঋণ হিসেবেই তা গ্রহণ করি, কারণ তোর ভয় ছিল নয়তো আমি অপমানিত বোধ করব। আমার বাড়ির হালচাল তো তুই জানতিস । তুই জানতিস, স্কুলের চাকরিতে আমি যে সামান্য মাইনে পেতাম, তাতে আমার আম্মা, আমার ভাবি, আর তার ছেলেমেয়েসহ সংসারটা চালানোই অসম্ভব ছিল । পরে কুয়েতের শিক্ষামন্ত্রণালয় আমাকেও কনট্রাক্ট দিয়েছিল। আমি তোকে সবকিছু জানিয়েই চিঠি লিখতাম । সেখানে আমার বেঁচে থাকাটা ছিল কেমন একটা চটচটে ফাঁকা দমবন্ধ দশা । আমার গোটা জীবনটাই কেমন যেন পিচ্ছিল হয়ে গেছে, মাসের গোড়া থেকেই পরের মাস পয়লার জন্যে একটা উগ্র বাসনা আমায় কুরে কুরে খায় । সেই বছরটার মাঝামাঝি, ফিলিস্তিনে বোমা হামলা হয়। ঘটনাটা আমার রুটিন খানিকটা পালটে দিয়ে থাকবে—তবে সেদিকে নজর দেবার খুব একটা ফুরসৎ বা উপায় আমার ছিল না। এই ফিলিস্তিন পেছনে ফেলে রেখে আমি চলে যাব ক্যালিফোর্নিয়া, নিজেকে নিয়ে নিজে বাঁচব, আমার এই হতভাগা বেচারি জীবন কত ভুগেছে, কত সয়েছে ! আম্মা, ভাবি আর তার বাচ্চাদের জন্যে সামান্য টাকা পাঠাতাম আমি, যাতে তারা কোনোক্রমে টিকে থাকতে পারে। তবে এই শেষ বন্ধনটাও আমি ছিঁড়ে ফেলে নিজেকে মুক্ত করে ফেলব—সবুজ ক্যালিফোর্নিয়ায়। এই হার, এই পরাজয়ের পচা গন্ধ থেকে বাঁচাব নিজেকে। যে সহানুভূতি, যে সমব্যথা আমাকে আমার ভাইজানের বাচ্চা-কাচ্চাদের সঙ্গে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল, তাদের আম্মা আর আমারও আম্মা—এরা কেউই কোনোকালে এই খাড়াই থেকে আমার উড়াল ঝাঁপকে কোনো মানে দিতে পারবে না। অনেকদিন কেটেছে—আর এই পিছুটান টানাহেঁচড়া চলবে না । আমাকে পালাতে হবে। এসব অনুভূতি তোর চেনা, মুস্তাফা, কারণ তোরও তো সত্যি এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল ।
যখন আমি জুন মাসে ছুটিতে গেলাম। আমার যাবতীয় পার্থিব সম্পত্তি জড়ো করলাম এক জায়গায়। মধুর পলায়নের জন্যে উদ্বেল হয়ে উঠলাম । কিন্তু কী সেই অস্পষ্ট আবছায়া যা কোনো লোককে তার পরিবারের কাছে টেনে নিয়ে আসে? মুস্তাফা, আমি জানি না। আমি শুধু জানি—আমি আম্মার কাছে গিয়েছি, আমাদের বাড়িতে সেদিন সকালবেলায় । আমি যখন গিয়ে পৌঁছেছি, আমার ভাবি, আমার মরহুম ভাইজানের স্ত্রী, আমার সঙ্গে দেখা করল । আর ফুঁপিয়ে বলল, তার মেয়ে নাদিয়া জখম হয়ে গাজার হাসপাতালে আছে, আমাকে দেখতে চায় । আমি কি তাকে দেখতে যাব সেদিন সন্ধ্যাবেলা? তোর মনে আছে নাদিয়াকে, তেরো বছর বয়েস, আমার ভাইয়ের মেয়ে?
সেদিন সন্ধ্যেয় আমি এক পাউন্ড আপেল কিনে নিয়ে নাদিয়াকে দেখতে হাসপাতালের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম । আমি জানতাম কিছু একটা রহস্য আছে। আমার আম্মা আর আমার ভাবি আমার কাছে যা চেপে গিয়েছে, এমন একটা কিছু যা তারা মুখ ফুটে বলতে পারছে না। নাদিয়াকে আমি ভালোবাসতাম নিছক অভ্যাসবশেই, সেই একই অভ্যাস যা আমাকে ভালোবাসিয়েছে তাদের প্রজন্মের সবকিছুকে। সেই যে প্রজন্ম বড়ো হয়ে উঠেছে পরাজয়, হতাশায় আর বাস্তুহীনতায় ।
কী ঘটেছিল সেই মুহূর্তে? আমি জানি না মুস্তাফা । খুব শান্তভাবেই আমি ঢুকেছিলাম ধবধবে সাদা ঘরটায়। নাদিয়া শুয়ে আছে তার বিছানায় একটা মস্ত বালিশে পিঠ দিয়ে, যার ওপর তার চুল কালো এক ঘন পশলার মতো ছড়িয়ে আছে । তার ডাগর চোখ দুটোয় কী রকম একটা ছমছমে গভীর স্তব্ধতা । তার কালো চোখের তারায় টলমল করছে পানি। তার মুখখানি শান্ত নিশ্চল। এখনো বড্ড ছেলেমানুষ আছে নাদিয়া, কিন্তু তাকে দেখাচ্ছে কোনো বাচ্চার চেয়েও বেশি, আরো বেশি, কোনো বাচ্চার চেয়ে বড়ো, অনেক বড়ো । 'নাদিয়া !' সে তার চোখ তুলে তাকিয়েছিল আমার দিকে। তার ক্ষীণ, মৃদু হাসির সঙ্গে আমি তার গলা শুনতে পেলাম । “চাচা! তুমি কি এক্ষুনি কুয়েত থেকে এলে'?
তার কণ্ঠস্বর কী রকম যেন ভেঙে গেল তার গলায়। দুই হাতে ভর দিয়ে কোনোমতে সে উঠে বসল। গলাটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। আমি হালকাভাবে তার পিঠ চাপড়ে তার পাশে বসে পড়লাম । ‘নাদিয়া! আমি তোর জন্যে কুয়েত থেকে উপহার নিয়ে এসেছি, অনেক উপহার। বিছানা ছেড়ে উঠবি যখন, একেবারে সেরে যেতে হবে কিন্তু, ততদিন আমি সবুর করব। তারপর তুই আমার বাড়ি আসবি আর এক এক করে সব আমি তোকে দেব। তুই যে লাল সালোয়ারগুলো আনতে লিখেছিলি সেগুলো এনেছি। একটা নয়—অনেক।' মিথ্যে কথা। আমি এমনভাবে কথাগুলো বললাম যেন জীবনে এই প্রথম আমি কোনো পরম সত্য কথা বলছি । নাদিয়া কেঁপে উঠল, ভয়ঙ্কর এক স্তব্ধতার মধ্যে সে তার মাথা নোয়াল। আমি টের পেলাম, তার চোখের জল আমার হাতের পিঠ ভিজিয়ে দিচ্ছে। “কিছু বল, নাদিয়া ! লাল সালোয়ারগুলো তোর চাই না?”
সে তার ডাগর চোখ দুটি তুলে আমার দিকে তাকাল। কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থতমত খেয়ে থেমে গেল । তারপর দাঁতে দাঁত চাপল। আমি তার গলা শুনতে পেলাম আবার। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। “চাচা !’
সে তার হাত বাড়িয়ে দিল । আঙুল দিয়ে তুলে ধরল গায়ের সাদা চাদর। আঙুল তুলে দেখাল তার পা, উরুর কাছ থেকে কেটে বাদ দেওয়া । দোস্ত, মুস্তাফা... আমি কোনোদিন নাদিয়ার পা দুটো ভুলব না—উরুর কাছ থেকে কাটা। না! হাসপাতাল থেকে সেদিন আমি বেরিয়ে গিয়েছিলাম। হাতের মধ্যে মুঠো করা দুটি পাউন্ড, নাদিয়াকে দেব বলে এনেছিলাম। জ্বলজ্বলে সূর্য রাস্তা ভরিয়ে দিয়েছে টকটকে রক্তের রঙে। এই ফিলিস্তিনে সবকিছু দপদপ করছে বিষাদে, মনস্তাপে, যা শুধুই কোনো রোদনের মধ্যে আবদ্ধ নয়। যুদ্ধের আহ্বান এই বিষাদ। তারও বেশি, এ যেন কাটা পা ফিরে পাবার জন্যে একটা প্রচণ্ড দাবি ! গাজার রাস্তায় রাস্তায় আমি হেঁটে বেড়ালাম । চোখ ধাঁধানো আলোয় ভরা সব রাস্তা । ওরা আমাকে বলেছে— নাদিয়া তার পা হারিয়েছে, যখন সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার ছোটো ছোটো ভাইবোনদের ওপর, তাদের ঢেকে দিয়েছিল নিজের ছোট্ট শরীরটা দিয়ে । বোমা আর আগুন থেকে তাদের বাঁচাতে, যে-আগুনের হিংস্র থাবা তখন বাড়িটায় পড়েছিল। নাদিয়া নিজেকে বাঁচাতে পারত, সহজেই সে ছুটে পালিয়ে যেত পারত লম্বা লম্বা পা ফেলে, রক্ষা করতে পারত তার পা। কিন্তু সে তা করেনি। কেন?
না, মুস্তাফা, দোস্ত আমার, আমি ক্যালিফোর্নিয়া যাব না—আর তাতে আমার কোনো খেদ নেই । ছেলেবেলায় এক সঙ্গে আমরা যা শুরু করেছিলাম, তাও আমরা শেষ করব না। সেই আবছা মতো অনুভূতি যা তুই গাজা ছেড়ে যাবার সময় অনুভব করেছিলি, সেই ছোট্ট বোধটাকে বিশাল হয়ে গড়ে উঠতে দিতে হবে তোর ভেতর। ছড়িয়ে পড়তে দিতে হবে তাকে, নিজেকে ফিরে পাবার জন্যে হাতড়াতে হবে তোকে, তন্নতন্ন করে তোকে নিজেকে খুঁজতে হবে পরাজয়ের এই ধ্বংসস্তূপে। আমি তোর কাছে যাব না মুস্তাফা। বরং তুই, তুই আমাদের কাছে ফিরে আয় । ফিরে আয়, মুস্তাফা, নাদিয়ার কাটা পা দুটি থেকে শিখতে, ফিরে আয় জানতে কাকে বলে জীবন, অস্তিত্বের মূল্য কী আর কতটা ! ফিরে আয়, মুস্তাফা, দোস্ত আমার, ফিরে আয় ! আমরা সবাই তোর জন্যে অধীর অপেক্ষা করে আছি
ইবাদত অর্থ গোলামি করা, মালিকের কথামতো চলা। আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুল (স)-এর কথামতো কাজ করাকে ইবাদত বলে। ইবাদত শব্দটির অর্থ ব্যাপক। যেমন, সালাত আদায় করা,কুরআন মজিদ তিলাওয়াত করা, রোগীর সেবা করা, কথা বলার সময় সত্য কথা বলা সব কিছুই ইবাদত।
ইবাদতের পরিচয়
আল্লাহ ...ায়ালা কুরআন মজিদে বলেন, “ আমি সৃষ্টি করেছি জিন এবং মানুষকে এজন্য যে, তারা শুধু আমারই ইবাদত করবে।”
এর অর্থ হলো :
১. আমরা কেবল আল্লাহ তায়ালার গোলামি করব, অন্য কারও নয় ৷
২. আমরা কেবল আল্লাহ তায়ালার আদেশমতো চলব, অন্য কারও নয় ৷
৩. কেবলমাত্র তাঁরই সামনে মাথা নত করব, অন্য কারও নয়।
৪. কেবলমাত্র তাঁকেই ভয় করব, অন্য কাউকে নয় ৷
৫. কেবলমাত্র তাঁর কাছে সাহায্য চাইব, অন্য কারও কাছে নয় ৷
এই পাঁচটি জিনিসকে আল্লাহ তায়ালা বুঝিয়েছেন ইবাদত শব্দ দ্বারা। কুরআন মজিদের বিভিন্ন আয়াত হতে ইবাদত শব্দের এরূপ অর্থ পাওয়া যায় । তাই অর্থ বুঝে ইবাদত করা উচিত । আমাদের প্রিয় নবি (স) এবং তাঁর পূর্ববর্তী সকল নবির শিক্ষার সারকথা হলো, “আল্লাহ ছাড়া আর কারও ইবাদত করো না।” আমরা সালাতের প্রতি রাকআতে সূরা ফাতিহা পড়ি; তখন একথাগুলোরই ঘোষণা করে থাকি।
ইয়্যাকা না'বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতাঈন,
অর্থ : আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি। আমরা শুধু তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপর বিভিন্ন ইবাদত ফরজ করেছেন। যেমন সালাত, সাওম, যাকাত ও হজ।
দলীয় কাজ : দলে বসে পরস্পর আলাপ-আলোচনা করে ইবাদতের একটি তালিকা তৈরি করে মার্কার দিয়ে পোস্টার পেপারে লিখবে।
মানুষের স্বভাব ও চরিত্রকে আরবিতে আখলাক বলে । চরিত্র ভালো হলে জীবন সুন্দর হয়। সুখের হয়। আখিরাতে শান্তি পাওয়া যায়। সুখ পাওয়া যায়। সুন্দর ও ভালো চরিত্রই সচ্চরিত্র। যেমন সত্য কথা বলা। রোগীর সেবা করা। আব্বা-আম্মাকে সম্মান করা। প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার করা।
মন্দ স্বভাব ও খারাপ চরিত্রকে ...সচ্চরিত্র বলা হয়। চরিত্র অসৎ হলে কেউ তাকে ভালোবাসে না। সকলে ঘৃণা করে। তার সাথে কেউ মেলামেশা করে না। খেলা করে না। আল্লাহ তাকে অপছন্দ করেন। মন্দ স্বভাব ও খারাপ চরিত্র হলো মিথ্যা কথা বলা, লোভ করা, অপচয় করা, পরনিন্দা করা ইত্যাদি।
আমাদের মহানবি (স) ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।”
মহানবি (স) বলেন, “সত্যিকার মুমিন তারাই, যাদের চরিত্র সুন্দর।”
নিচে সচ্চরিত্র এবং অসচ্চরিত্রের একটি তালিকা দেওয়া হলো :
সচ্চরিত্রের তালিকা
অসচ্চরিত্রের তালিকা
১
আব্বা-আম্মার সাথে ভালো
ব্যবহার করা
১
আব্বা-আম্মার সাথে খারাপ
ব্যবহার করা
২
শিক্ষককে সম্মান করা
২
লোভ করা
৩
বড়দের সম্মান করা
৩
অপচয় করা
৪
ছোটদের স্নেহ করা
৪
পরনিন্দা করা
৫
সত্য কথা বলা ও ওয়াদা পূরণ করা
৫
অহংকার করা
৬
সালাত আদায় করা
৬
সালাত আদায় না করা
আমরা চরিত্র সুন্দর করব। সকলে আমাদের ভালোবাসবে। আল্লাহ আমাদের উপর খুশি হবেন। দুনিয়াতে আমরা শান্তি পাব । পরকালে পাব জান্নাত।
আমরা সর্বদা-
ইমান আনব, সালাত আদায় করব ।
আব্বা-আম্মা, শিক্ষক ও বড়দের সম্মান করব ।
ছোটদের স্নেহ করব, সত্য কথা বলব ।
স্বভাব চরিত্র সুন্দর করব, শান্তি পাব ।
পরিকল্পিত কাজ : শিক্ষার্থীরা সচ্চরিত্রের একটি তালিকা তৈরি করবে।