অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - খ্রিষ্টান ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

পঞ্চম অধ্যায়

যীশুর বাণী প্রচারের মূলভাব

প্রভু যীশু খ্রিষ্ট পিতার ইচ্ছা অনুসারে এই জগতে এসেছেন মানবজাতির জন্য পরিত্রাণ সাধন করতে। প্রকাশ্য প্রচার জীবনে তিনি তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী ও আশ্চর্য কাজগুলোর মধ্য দিয়ে মানুষের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রদান করেছেন। তাঁর শিক্ষার মধ্যে রয়েছে সত্য ও সুন্দরের পথে জীবন যাপন এবং ন্যায্যতা, শাস্তি ও ভালোবাসার পথ অনুসরণ করার মতো সকল বিষয়ের দিক নির্দেশনা। বাণী প্রচারের মাধ্যমে যীশু খ্রিষ্ট মানুষকে ধীরে ধীরে পরিত্রাণের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছেন। এই অধ্যায়ে আমরা প্রভু যীশুর বাণী প্রচারের প্রধান মূলভাবগুলোর উপর আলোকপাত করব।

যীশুর কাছে অসংখ্য জনতার ভিড়

এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা

• যীশুর বাণী প্রচারের নিম্নলিখিত মূলভাবগুলো বর্ণনা করতে পারব

• ঈশ্বরের রাজ্য, দশ আজ্ঞা, সুখপস্থাসমূহ, শেষ বিচার, মৃতদের পুনরুত্থান, যেরুসালেমের মন্দির, ইহুদিদের বিধান, শান্তি, দীনদরিদ্র, পবিত্র আত্মার নির্দেশ ও মিশনকর্ম এবং বিবাহের অবিচ্ছেদ্যতা। আমরা যীশুর প্রচারিত বাণীর উপর বিশ্বাস স্থাপন করব, যীশুর কাজে যথাসম্ভব অংশগ্রহণ করব।

 

80

যীশুর বাণী প্রচারের মূলভাব

পাঠ ১ ঈশ্বরের রাজ্য

প্রতিটি মানবীয় কাজেরই একটি উদ্দেশ্য থাকে। উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো কাজকেই আমরা মানবীয় কাজ বলি না। আমরা যে পড়াশুনা করছি তার নিশ্চয়ই একটি কারণ রয়েছে। যেমন, আমরা লেখাপড়া শিখে বড় হবো, মানুষের মতো মানুষ হবো। প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশ ও সমাজের মঙ্গলের জন্য কাজ করব। মানুষের মাঝে আমাদের কাজ দিয়ে উন্নত জীবন পথের সন্ধান দিব। একইভাবে আমরা যে খাওয়াদাওয়া করি, বিশ্রাম করি, খেলাধুলা করি, গুরুজনদের বাধ্য হই ইত্যাদি সবকিছুরই একেকটি উদ্দেশ্য থাকে

প্রভু যীশুখ্রিষ্ট এই জগতে এসেছেন একটি বিশেষ কাজ সম্পন্ন করতে মানুষের পরিত্রাণ সাধন করতে। তিনি এসেছেন এই জগতের মাঝে ভালোবাসা, সেবা, ক্ষমা, একে অন্যের প্রতি মমতাবোধ, সহানুভূতি, ন্যায্যতা ও শান্তি স্থাপনের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তার করতে। এই কারণে প্রভু যীশু তাঁর বাণী প্রচার জীবনে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন যে ঐশরাজ্য কাছে এসে গেছে। তিনি চেয়েছেন মানুষ যেন মন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজ্যে প্রবেশের জন্য হৃদয়মন প্রস্তুত করে প্রভু যীশুর মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের রাজ্যের সূচনা এবং তাঁর মধ্য দিয়েই এই রাজ্য একদিন পূর্ণতা লাভ করবে। তিনি ভালোবাসা, ক্ষমা, সেবা ও মিলনের মধ্য দিয়ে এই জগতে তা প্রতিষ্ঠা করতে এসেছেন।

কিন্তু অনেকে যীশুকে ভুল বুঝেছে। তাঁকে অনেকে জাগতিক রাজা এবং তাঁর রাজ্যকে জাগতিক রাজ্য হিসাবে মনে করেছে। এমনকি তাঁর বারো জন শিষ্যের মধ্য থেকেও অনেকে প্রথম দিকে তাঁর রাজ্যের প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারেননি। সেই কারণে প্রেরিত শিষ্য যাকোব ও যোহন প্রভু যীশুখ্রিষ্টকে অনুরোধ করে বলেছিলেন যে, তাঁদের একজন যেন একদিন তাঁর রাজ্যে ডান পাশে এবং অন্যজন তাঁর বা পাশে বসতে পারেন। তাঁদের বুঝতে ভুল হয়েছিল যে, ঈশ্বরের রাজ্য সবার জন্যই সেখানে প্রবেশ করার অধিকার সকল মানুষেরই আছে। সেই রাজ্যে ডান পাশে বা বাম পাশে বসার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ঈশ্বরের রাজ্যে আমরা সবাই সমান।

কাজ : সবাই মিলে, “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে"- গানটি করব।

পাঠ ২ ঈশ্বরের দশ আজ্ঞা

নিয়মকানুন মানুষকে সুশৃঙ্খল করে। সহজ-সরল ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। এই কারণে প্রতিটি সমাজ ও দেশে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। এগুলো পালনের মধ্য দিয়ে মানুষ সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে বাস করতে পারে।

সৃষ্টির শুরুতে ঈশ্বর প্রকৃতির মধ্যে কিছু নিয়ম দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি কিছু কিছু বিষয়ে বিধি-নিষেধও করেছেন। তিনি সিনাই পর্বতে মোশীর মধ্য দিয়ে ইস্রায়েল জাতির জন্য দশটি আদেশ বা আজ্ঞা দান করেছেন। ঈশ্বরের সেই দশটি আজ্ঞা আমরা আগেই জেনেছি এবং সেগুলোর ব্যাখ্যাও শিখেছি।

88

খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

কাজ : একজন একজন করে পাঁচজন ঈশ্বরের দশ আজ্ঞা বলবে।

মোশীর মাধ্যমে ঈশ্বরের দেওয়া দশটি আজ্ঞার সারাংশ হিসেবে প্রভু যীশুখ্রিষ্ট দুইটি মূল আজ্ঞার মাধ্যমে আমাদের জন্য তুলে ধরেছেন। এভাবে তিনি দশ আজ্ঞার অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, তুমি তোমার সমস্ত অন্তর দিয়ে, সমস্ত মন দিয়ে ও সমস্ত শক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে ভালোবাসবে এবং প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসবে। সুতরাং দেখা যায় ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা ও প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসার মধ্য দিয়ে প্রভু যীশু যোশীর মাধ্যমে দেওয়া দশটি আজ্ঞার পূর্ণতা দান করেছেন ভালোবাসাই সমস্ত কিছু করতে পারে। পূর্ণ অন্তর, মন ও শক্তি নিয়ে যদি ঈশ্বরকে এবং সকল মানুষকে ভালোবাসা যায় তাহলেই ঐশ বিধানের সমস্ত কিছু পালন করা হয়ে যায়। ভালোবাসা একমাত্র পথ যার মধ্য দিয়ে আমরা ঈশ্বরের কাছে আসতে পারি এবং সকল ভাইবোনদের অর্থাৎ সকল মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি। এই কারণে প্রভু যীশু পরস্পরকে ভালোবাসার কথা বলেছেন।

কাজ কীভাবে তোমরা ঈশ্বরের দশ আজ্ঞা অনুসারে জীবন যাপন করতে পার তা দলে আলোচনা করবে।

পাঠ ৩: সুখপন্থাসমূহ

সব মানুষ জীবনে সুখী হতে চায়। মানুষের জীবন যাপন ও কাজকর্ম দেখলে উপলব্ধি করা যায় যে, মানুষের জীবনের প্রধান ও পরম লক্ষ্যই হলো সুখে থাকা । সুখের জন্যই যেন মানুষ এই পৃথিবীতে সব কিছু করে যাচ্ছে তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, সব ধরনের সুখ ও আনন্দ আমাদেরকে পরম বা স্থায়ী সুখ দিতে পারে না। দুই ধরনের সুখ আছে। যথা: জাগতিক সুখ ও পারমার্থিক সুখ। জাগতিক সুখভোগ হলো এই জগতের আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার মধ্য দিয়ে লব্ধ সুখভোগ। এগুলো আমাদের ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই ভোগ করে থাকি। মূলত পাওয়ার বা ভোগের মধ্য দিয়েই আমরা এসব সুখের সন্ধান করি। পারমার্থিক সুখ হলো ত্যাগের মধ্য দিয়ে, একে অন্যকে দান করার মধ্য দিয়ে এই সুখ লাভ করা যায়। এই সুখ এই জগতে আমরা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করি ও পরজগতের জন্য সঞ্চয় করি। প্রভু যীশু তাঁর প্রচার জীবনের শুরুতে জাগতিক সুখভোগের চেয়ে পারমার্থিক সুখভোগের কিছু পন্থা তুলে ধরেছেন। তিনি মোট আটটি সুখপন্থার কথা বলেছেন। এগুলো আমাদের কাছে অষ্টকল্যাণ বাণী নামেও পরিচিত।

সুখ পন্থাসমূহ বা অষ্টকল্যাণ ৰাণী

১। অন্তরে যারা দীন, ধন্য তারা স্বর্গরাজ্য তাদেরই।

২। দুঃখে-শোকে কাতর যারা ধন্য তারা তারাই পাবে সান্ত্বনা ।

 

যীশুর বাণী প্রচারের মূলভাব

৩। বিনয়ী, কোমলপ্রাণ যারা, ধন্য তারা প্রতিশ্রুত দেশ একদিন হবে তাদেরই আপন দেশ

৪। ধার্মিকতার দাবি পূরণের জন্য তৃষিত ব্যাকুল যারা, ধন্য তারা তারাই পরিতৃপ্ত হবে ৫। দয়ালু যারা, ধন্য তারা তাদেরই দয়া করা হবে।

৬। অন্তরে যারা পবিত্র, ধন্য তারা তারাই পরমেশ্বরকে দেখতে পাবে ।

৭। শান্তি স্থাপন করে যারা, ধন্য তারা তারাই পরমেশ্বরের সন্তান বলে পরিচিত হবে ।

৮। ধর্মনিষ্ঠ বলে নির্যাতিত যারা, ধন্য তারা স্বর্গ রাজ্য তাদেরই।

প্রভু যীশু খ্রিষ্ট পর্বতে দেওয়া তাঁর এই আটটি কল্যাণ বাণীর মধ্য দিয়ে এই জগতে ও পর জগতে সুখলাভের পথ দেখিয়েছেন এই বাণীর আলোকে জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে আমরা হৃদয় ও মনে শান্তি অনুভব করব ও সেই শাস্তি একে অন্যের মাঝে বিলিয়ে দিতে পারব।

পাঠ ৪ : শেষ বিচার

মানুষ এ জীবনে ভালো ও মন্দ যেসব কাজ করে তার জন্য তাকে পুরস্কার ও শাস্তি ভোগ করতে হয়। এ জীবনে না হোক পরজীবনে তার এসব ভোগ করতে হয় এই পৃথিবীতে যে যেমন জীবন যাপন করবে সেই ভাবেই সে পরজীবনের জন্য স্থান প্রস্তুত করবে। মানুষের জীবন যাপন ও কাজের উপর ভিত্তি করে শেষ বিচারের রায় হবে। যার যার কাজ অনুসারে তার তার বিচার হবে। মোটকথা সব মানুষকেই একদিন বিচার আসনের সামনে দাঁড়াতে হবে। খ্রিষ্টধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী শেষ বিচার অবশ্যম্ভাবী। আমরা সবাই তা বিশ্বাস করি।

শেষ বিচারে মানব পুত্র (যীশুখ্রিষ্ট) আপন মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে স্বর্গদূতদের নিয়ে আসবেন এবং সিংহাসনে বসবেন। তাঁর সামনে সবাইকে তখন সমবেত করা হবে। বিচার হবে অনেকটা যেভাবে মেষপালক ছাগ থেকে মেষদের পৃথক করে নেয়, সেভাবে তিনি মানুষ থেকে মানুষকে পৃথক করবেন। ধার্মিক মানুষকে তিনি তাঁর ডান পাশে রাখবেন এবং মন্দ লোকদের তাঁর বাম পাশে রাখবেন। তাঁর ডান পাশের লোকদের তিনি বলবেন, তোমরা এসো, আমার পিতার আশীর্বাদের পাত্র যারা। জগতের সৃষ্টির সময় থেকে তোমাদের জন্য যে রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে তা নিজেদের বলে গ্রহণ কর। কারণ তোমরা ক্ষুধার্তকে খেতে দিয়েছিলে, তৃষ্ণার্তকে জল দিয়েছিলে, বিদেশিদের আশ্রয় দিয়েছিলে, বস্ত্রহীনকে পোশাক পরিয়েছিলে, অসুস্থ ও পীড়িতকে সেবা করেছিলে, কারাবন্দীকে দেখতে গিয়েছিলে। এসব তুচ্ছতমদের জন্য তোমরা যা কিছু করেছ তা সবই আমারই জন্য করেছ।

অন্য দিকে অধার্মিকদের তিনি বলবেন, আমার সামনে থেকে দূর হও তোমরা, যত অভিশাপের পাত্র যারা । তোমাদের জন্য যে শাশ্বত আগুন প্রস্তুত করে রাখা আছে, সেখানেই যাও। কারণ তোমরা খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

ক্ষুধার্তকে খেতে দাও নি, তৃষ্ণার্তকে জল দাও নি, বিদেশিকে আশ্রয় দাও নি, বন্ধহীনকে পোশাক দাও নি, অসুস্থকে সেবা কর নি, কারাবন্দীকে দেখতে যাও নি। তিনি তখন তাদের শাশ্বত দণ্ডলোকে পাঠিয়ে দেবেন ।

সুতরাং আমরা বুঝতে পারছি, আমাদের একদিন সবাইকে বিচারের আসনের সামনে দাঁড়াতে হবে। আমাদের বিচার হবে গ্রাজুপ্রেমের মানদণ্ডে অর্থাৎ আমরা এ জগতে তুচ্ছতম মানুষের জন্য কতটুকু করেছি তার উপর ভিত্তি করে।

কাজ : আমরা কী কী কাজ করলে শাশ্বত জীবনলোকে যেতে পারব তার একটা তালিকা প্রস্তুত করব।

পাঠ ৫ মৃতদের পুনরুত্থান

আমরা যেমন একদিন এ জগতে জন্মগ্রহণ করেছি তেমনি এ জগতের মায়ামোহ পরিত্যাগ করে একদিন আমাদের পিতার কাছে চলে যেতে হবে। যেহেতু মৃত্যুটা আমরা কেউ কখনো কামনা করি না তাই তা নিয়ে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। মৃত্যু কেন হয়। মৃত্যুর পর আমাদের কী হবে? আমরা কোথায় যাব? ইত্যাদি। কারণ এ ধরনের অজানা বিষয়ের প্রতি সব মানুষের এক ধরনের উৎকণ্ঠা কাজ করে। সেই কারণে মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে কম বেশি সবারই উৎকণ্ঠার শেষ নেই ।

পুনৰুধিত প্রভু যীশু

 

যীশুর বাণী প্রচারের মূলভাব

89

আমরা মৃতদের পুনরুত্থানে বিশ্বাস করি। কারণ প্রভু যীশুখ্রিষ্ট নিজে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তিন দিন পর পুনরুত্থান করেছেন। তিনি পুনরুত্থান করে আমাদেরকেও তাঁর পুনরুত্থানের সহভাগী করেছেন। তিনি তাঁর প্রচার জীবনেও পুনরুত্থানের বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন। ইহুদিরা পুনরুত্থানে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু অন্য দিকে সাদুকীরা পুনরুত্থানে বিশ্বাস করতেন না। এই সাদুকীরা যখন যীশুকে পুনরুত্থানের বিষয় প্রশ্ন করেন তখন তিনি তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে, মৃতদের একদিন পুনরুত্থান ঘটবে। তবে পুনরুত্থানের পর মানুষ আর এই জগতের মানুষের মতো সব কিছু করবে না। পুনরুত্থানের পর তারা সবাই স্বর্গদূতদের মতো হয়ে উঠবে। তাদের চেহারার মধ্যে সেই স্বর্গদূতদের মতো ভাব ফুটে উঠবে । এই কারণে প্রভু যীশু যখন পুনরুত্থান করে শিষ্যদের সাথে দেখা দিয়েছেন তখন তাঁরা তাঁকে প্রথমে চিনতে পারেননি। যীশু বলেন, পরমেশ্বর তো মৃতদের ঈশ্বর নন, তিনি জীবিতদের ঈশ্বর । আমরা প্রত্যেকে একদিন পুনরুত্থান করব। কারণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা মহান ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করব সেই কারণে মৃত্যু কষ্টের নয় বরং খ্রিষ্ট বিশ্বাসী সবার জন্য তা মহা আনন্দের হওয়া উচিত

পাঠ ৬ যেরুসালেম মন্দির

প্রতিটি ধর্মেই ধর্মীয় অনুশীলনের জন্য বা উপাসনার জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান থাকে। যেমন, ইসলাম ধর্মে আছে মসজিদ, হিন্দু ধর্মে মন্দির, বৌদ্ধধর্মে প্যাগোডা এবং খ্রিষ্টধর্মে আছে গির্জা, মন্দির বা উপাসনালয়। এই পবিত্র স্থানগুলো সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতির চিহ্ন বহন করে

প্রভু যীশুখ্রিষ্টের সময়ে ইহুদিদের উপাসনার প্রধান কেন্দ্র ছিল যেরুসালেম মন্দির । বছরের বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন পর্ব উপলক্ষে ইহুদিরা একত্রে মিলিত হতো। প্রভু যীশুখ্রিষ্টের যেরুসালেম মন্দিরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তাঁর জন্মের চল্লিশ দিন পরে যোসেফ ও মারীয়া তাঁকে এই মন্দিরে উৎসর্গ করেছিলেন। বারোবছর বয়সে তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে এই মন্দিরেই পাওয়া গিয়েছিল। এই ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে পিতার কাজেই তাকে ব্যস্ত থাকতে হবে। তাঁর প্রকাশ্য জীবনে প্রতি বছর অন্ততপক্ষে নিস্তার পর্বের সময় তিনি যেরুসালেম মন্দিরে যেতেন

এই মন্দির হলো ঈশ্বরের গৃহ, যেখানে সকল জাতির মানুষ এসে প্রার্থনা করবে। সেই কারণে প্রভু যীশু একবার মন্দিরে ঢুকে যখন দেখলেন মন্দিরের পবিত্র স্থানটি বেচা-কেনার বাজারে পরিণত হয়েছে তখন তিনি তাদের বের করে দিলেন। বেচা-কেনার সব কিছু তিনি উল্টে ফেলে দিলেন । তিনি পিতার গৃহের পবিত্রতা নষ্ট হতে দেননি

পাশাপাশি প্রভু যীশু দেহ মন্দিরের কথাও বলেছেন। আমাদের দেহ হলো ঈশ্বরের মন্দির। এই হৃদয়রূপী পুরনো মন্দির তিনি ভেঙে ফেলে তিন দিনের মধ্যে নতুন হৃদয় মন্দির গড়তে চেয়েছেন। যদিও অনেকে তাকে ভুল বুঝেছে, তারপরও তিনি যেরুসালেম মন্দিরকে তার প্রচারের কেন্দ্র করেছিলেন । এই যেরুসালেমেই তিনি পিতার ইচ্ছার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করেছিলেন।

Br

খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

পাঠ ৭ : ইহুদিদের বিধান

সব ধর্মেই কিছু-না-কিছু নিয়ম কানুন বা বিধি-বিধান থাকে। এই নিয়ম বা বিধান পালনের মধ্য দিয়ে প্রথমত ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই বিধি-বিধান পালনের মধ্য দিয়ে মানুষ সত্য পথে পরিচালিত হতে পারে ও স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করতে পারে ।

ইহুদিধর্মের অনেক নিয়মকানুন বা বিধিবিধান একান্ত পালনীয় ছিল। অনেকে মনে করেছিল প্রভু যীশু সব নিয়মকানুন বা বিধিবিধান বাতিল করতে এসেছেন। কিন্তু তিনি নিজেই পর্বতের উপর উপদেশে এই বিষয়ে বলেছেন, "তোমরা এই কথা মনে করো না যে, আমি মোশীর বিধান বা প্রবক্তাদের নির্দেশ বাতিল করতে এসেছি। আমি তা বাতিল করতে আসিনি বরং পূর্ণ করতে এসেছি। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, আকাশ ও পৃথিবী যতদিন বিলুপ্ত না হয়, ততদিন বিধানের বিন্দুবিসর্গও লোপ পাবে না; তার আগেই যা-কিছু ঘটবার কথা সবই ঘটবে। তাই এই সব আদেশের মধ্যে গৌণতম আদেশগুলোর একটিও যদি কেউ লঙ্ঘন করে আর অপরকে লঙ্ঘন করতে শেখায়, তাহলে স্বর্গরাজ্যে সে তুচ্ছতম বলেই গণ্য হবে। কিন্তু যদি কেউ সেই সব আদেশ পালন করে ও পালন করতে শেখায়, তাহলে স্বর্গরাজ্যে সে মহান বলেই গণ্য হবে" (মথি ৫:১৭-১৯)।

যীশুখ্রিষ্ট ধর্মের আসল উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য এই বিধানগুলো পালনে আরও বেশি করে বিশ্বস্ত হতে বলেছেন। এগুলো পালন সম্পর্কে তিনি যে শিক্ষা দিয়েছেন তা আরও বেশি কঠিন। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেছেন, “তোমরা শুনেছ যে, প্রাচীনকালের মানুষদের এই কথা বলা হয়েছিল- হত্যা করবে না; যে কেউ হত্যা করবে, তাকে তার জন্য বিচারসভায় জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু আমি তোমাদের বলছি- যে কেউ নিজের ভাইয়ের উপর রাগ করবে, তাকে তার জন্যে বিচারসভায় জবাবদিহি করতেই হবে। আর ভাইকে যে অপদার্থ বলবে, তাকে তো মহাসভাতেই জবাবদিহি করতে হবে। আর ভাইকে যে পাষণ্ড বলবে, তাকে নরকের আগুনেই জবাবদিহি করতে হবে" (মথি ৫:২১-২২)।

প্রভু যীশুখ্রিস্টের মধ্য দিয়ে সমস্ত কিছু পূর্ণতা লাভ করেছে। তাই যারা এই বিধান পালন করে ও অন্যকে পালন করতে শিক্ষা দেয় তারা স্বর্গরাজ্যে মহান বলে গণ্য হবে। এই বিধি-বিধান ঐশরাজ্যে প্রবেশ করতে আমাদের সাহায্য করে। প্রভু যীশুখ্রিষ্ট সমস্ত বিধানের একটি নতুন রূপ দান করেছেন। ইহুদিরা তা আক্ষরিকভাবে পালন করত। কিন্তু যীশুখ্রিষ্ট তার আধ্যাত্মিক রূপ দান করেছেন। তাঁর বিধান হলো ভালোবাসার বিধান ।

কাজ : কেন নিয়ম পালন করতে হয় তা দলীয়ভাবে আলোচনা করবে ।

 

যীশুর বাণী প্রচারের মূলভাব

পাঠ ৮ : শাস্তি

সব মানুষই শান্তি কামনা করে। একটু সুখের, একটু শান্তিতে জীবনযাপন করার জন্য মানুষ কত কী-ই না করে থাকে অনেকে আবার দূরদূরান্তে পাড়ি জমায় একটু শান্তির আশায়।

যীশুখ্রিষ্ট হলেন শান্তিরাজ। শান্তিরাজ প্রভু যীশুর জন্মের হাজার হাজার বছর আগে বিভিন্ন প্রবক্তা ত্রাণকর্তার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে গিয়ে এই আখ্যাই দিয়েছেন তিনিই 'অনন্য মন্ত্রণাদাতা', 'বিশ্ব শান্তিরাজ'।

যীশু তাঁর প্রচার জীবনে মানুষের মাঝে শাস্তি বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'তোমাদের জন্যে শান্তি রেখে যাচ্ছি, তোমাদের দিয়ে যাচ্ছি আমারই শান্তি।' মৃত্যু থেকে পুনরুত্থিত হওয়ার পর যখন তিনি শিষ্যদের কাছে দেখা দিয়েছেন তখন শিষ্যদের মাঝে শাস্তি বিলিয়ে দিয়ে বলেছেন 'তোমাদের শান্তি হোক।' তবে প্রভু যীশুর দেওয়া শান্তি, এ জগতে দেওয়া শান্তির চেয়ে ভিন্নতর। প্রভু যীশুর দেওয়া শান্তির উৎস বা ভিত্তি হচ্ছে ন্যায্যতা, ত্যাগ ও আত্মদান । ভোগে নয় ত্যাগের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের মাঝে তাঁর শাস্তি বিলিয়ে গেছেন, যেন আমরা সবাই শান্তির মানুষ হতে পারি।

প্রভু যীশু ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষকে পুনর্মিলিত করেছেন এবং মণ্ডলীকে করে তুলেছেন মানবজাতির মধ্যে ঐক্যের এবং ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর মিলনের চিহ্ন কেননা তিনি নিজেই আমাদের মাঝে শাস্তি দিতে এসেছেন । তিনি ঘোষণা করেছেন, শান্তির সাধক যারা তারাই সুখী হবে

কাজ : নিজ বাড়ি ও শ্রেণিকক্ষে সর্বদা শাস্তি বজায় রাখার জন্য করণীয়সমূহ বাড়ি থেকে লিখে আনবে

পাঠ ৯ : দীন-দরিদ্র

যীশুখ্রিষ্ট পর্বতের উপর যে কথা বলে তাঁর উপদেশবাণী শুরু করেছেন তা হলো, "অন্তরে যাৱা দীন, ধন্য তারা-স্বর্গরাজ্য তাদেরই।" প্রভু যীশু ঈশ্বর-পুত্র হয়েও অতি দীন বেশে এই জগতে এসেছেন। অতি সাধারণ একটি কন্যা, কুমারী মারীয়ার গর্ভে এসে দীন-দরিদ্র বেশে গোশালায় জন্মগ্রহণ করলেন ।

তিনি এই জগতে এসেছেন অতি সাধারণ বেশে, দীন-দরিদ্রদের মাঝে মঙ্গলবাণী ঘোষণা করতে। নাজারেথের সমাজগৃহে যীশুখ্রিষ্ট প্রবক্তা ইসাইয়ার ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করে এ জগতে তাঁর আসার কথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। “তিনি আমাকে প্রেরণ করেছেন দীন-দরিদ্রদের কাছে মঙ্গলবার্তা প্রচার করতে; বন্দীর কাছে মুক্তি আর অন্ধের কাছে নবদৃষ্টি লাভের কথা ঘোষণা করতে, পদদলিত মানুষকে মুক্ত করে দিতে" (লুক ৪:১৮)। তিনি তাঁর প্রচারজীবনে যে বারোজনকে মনোনীত করেছেন তারা সবাই সাধারণ মানুষ ছিলেন। যাদের কাছে মঙ্গলবাণী প্রচার করেছেন তারাও সমাজের খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

অবহেলিত, লাঞ্ছিত, অভাবী, দুঃখী, বিধবা, অসুস্থ, পঙ্গুদের কাছে তাঁর আশার বাণী ঘোষণা করেছেন । তিনি বলেছেন, পিতা ঐশ রাজ্যের মর্মসভ্য সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশ করেছেন জ্ঞানীদের লজ্জা দেবার জন্য। তিনি সবাইকে শিশুর মতো সরল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন । কারণ শিশুর মতো সহজ-সরল হতে না পারলে কেউ ঐশ রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না।

পাঠ ১০ : পবিত্র আত্মার বাণী ও প্রেরণকর্ম

প্রভু যীশু এই জগৎ ছেড়ে পিতার কাছে চলে যাবার আগে বলেছেন যে, তিনি তাঁর অনুসারীদের অনাথ করে রেখে যাবেন না। তিনি এক সত্যময় আত্মা আমাদের দান করবেন, যিনি পূর্ণ সত্যের পথে আমাদের পরিচালিত করবেন। পবিত্র আত্মার বাণী পথপ্রদর্শক হবে এবং তাঁর শক্তিতে প্রেরণকর্ম পরিচালিত হবে।

পিতা যখন তাঁর বাণী প্রেরণ করেন, তিনি সব সময়ই তাঁর প্রাণবায়ুকেও দান করেন। পুত্রের মধ্য দিয়ে তাঁর বাণী আমাদের মাঝে এসেছে। কিন্তু আত্মা আমাদের বুঝিয়ে দেন যে, যদিও প্রেরণকর্মে পুত্র ও আত্মা স্বতন্ত্র তবুও অবিচ্ছেদ্য। অদৃশ্য ঈশ্বরের দৃশ্যমান প্রতিমূর্তি খ্রিষ্টকে আমরা দেখতে পাই বটে, কিন্তু তাঁকে প্রকাশ করেন স্বয়ং পবিত্র আত্মা। সেই কারণে প্রভু যীশুখ্রিষ্ট বলেন যে, যখন আমারই কারণে তোমাদের সমাজগৃহে বা শাসনকর্তার সামনে দাঁড় করানো হবে তখন কীভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করবে তা নিয়ে কোনো চিন্তা কোরো না। তোমাদের তখন যা কিছু বলতে হবে তা পবিত্র আত্মাই শিখিয়ে দেবেন। প্রেরণকর্মে পবিত্র আত্মার বাণীই হবে আমাদের চালিকাশক্তি। পবিত্র আত্মা আমাদের ঈশ্বর সন্তানে পরিণত করবেন। তাঁর কাজ হচ্ছে আমাদেরকে খ্রিষ্টের সাথে যুক্ত করা ও খ্রিষ্টের আশ্রয়ে জীবনযাপন করতে সহায়তা করা।

অনুসন্ধানমূলক কাজ : ধর্মপল্লিতে খ্রিষ্টমণ্ডলী কী কী প্রেরণকর্ম করছে এবং সেই কাজগুলোর মাধ্যমে সমাজের লোকদের কী কী উপকার সাধিত হচ্ছে তার উপর একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত কর

পাঠ ১১ : বিবাহের অবিচ্ছেদ্যতা

আমরা জানি, বিবাহ সাক্রামেন্ত অনুষ্ঠিত হয় একজন ছেলে (পুরুষ) ও একজন মেয়ের (নারী) মধ্যে। তারা সারা জীবন এক সাথে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে গির্জায় গিয়ে যাজকের উপস্থিতিতে ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করে। ঈশ্বর নিজেই তাদের মিলন করিয়ে দেন। তাই সারাজীবন তারা এক সাথে থাকে। একমাত্র মৃত্যু এই বন্ধন ছিন্ন করতে পারে, আর কেউ নয় ।

ঈশ্বর মানুষকে পুরুষ ও নারী করেই সৃষ্টি করেছেন যেন তাদের সম্মিলিত জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে পরিপূর্ণতা আসে। পুরুষ ও নারী করে সৃষ্টি করে তিনি বিবাহ ব্যবস্থার দ্বারা জীবন ও প্রেমের যে ঘনিষ্ঠ মিলন ঘটে তা প্রকাশ করেছেন। স্বয়ং ঈশ্বরই বিবাহবন্ধনের রচয়িতা। সেই কারণে বিবাহ শুধু যে একটি সামাজিক বা মানবীয় ব্যবস্থা, তা নয়। বরং দাম্পত্যজীবনে নর-নারীর সাথে ঈশ্বরের এক অবিচ্ছেদ্য মিলন সংঘটিত হয়, যা কখনো ভাঙার নয়। শাস্ত্রবাণী স্মরণ করিয়ে দেয়, তারা আর দুইজন নয়, কিন্তু একদেহ

যীশুখ্রিষ্ট দাম্পত্য জীবনের এই প্রেমের মিলনকে শ্রদ্ধা করেছেন। তিনি তাঁর প্রকাশ্য জীবনের শুরুতে তাঁর মায়ের সাথে কানা নগরের বিবাহ উৎসবে যোগ দিয়েছেন। তাঁর উপস্থিতি প্রকাশ করে এখন থেকে বিবাহ হবে খ্রিষ্টের উপস্থিতির ফলপ্রসূ চিহ্ন। আদি থেকেই সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনায় নর-নারীর মিলনের যে মূল অর্থ ছিল প্রভু যীশু তাঁর প্রচার জীবনে সেই শিক্ষাই দিয়েছেন। কারণ ঈশ্বর তা নিজেই স্থির করে দিয়েছেন। তিনি অতিরিক্ত কোনো বোঝা চাপিয়ে দেননি যা মোশীর বিধানের চেয়ে ভারী। তিনি বলেন, “ঈশ্বর যা যুক্ত করেছেন, মানুষ যেন তা বিচ্ছিন্ন না করে।” যেন বিবাহিত জীবনের পবিত্রতা, মাধুর্য, সৌন্দর্য ও অনুগ্রহ অক্ষুণ্ণ থাকে। যেন পারস্পরিক সম্মান, মর্যাদা ও ভালোবাসা স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ পায়

Content added || updated By