পঞ্চম শ্রেণি (প্রাথমিক) - বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ। বুদ্ধ ও বুদ্ধের শিষ্যদের স্মৃতিবিজড়িত তীৰ্থ, মহাতীর্থ, ঐতিহাসিক স্থান ও নিদর্শনগুলো অতীব পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ।

তোমরা পূর্বে তীর্থ ও মহাতীর্থ সম্পর্কে জেনেছ। এ অধ্যায়ে ঐতিহাসিক স্থান ও নিদর্শন সম্বন্ধে জানতে পারবে।

বৌদ্ধ ঐতিহাসিক স্থান ও নিদর্শন

বৌদ্ধধর্ম একটি সুপ্রাচীন ধর্ম। এ ধর্মের অনেক ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রয়েছে। বিশেষ করে বুদ্ধ, বুদ্ধ শিষ্য, রাজন্যবর্গ ও শ্রেষ্ঠীদের স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন স্থানকে বৌদ্ধ ঐতিহাসিক স্থান বলে। আবার এসকল স্থানে প্রাচীন যেসব প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে তাকে নিদর্শন বলা হয়। বৌদ্ধ ঐতিহ্য ও নিদর্শন অত্যন্ত গৌরবময়।

ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হলো একটি জাতির মূল শেকড়। জাতির ইতিহাস ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে সংস্কৃতি। ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙ প্রমুখ চীনা পর্যটকেরা বৌদ্ধ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কীর্তি ইতিহাসের বিবরণ লিখে গেছেন। বৌদ্ধ বিহারগুলো সেকালে ধর্ম, শাস্ত্র ও সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল।

বৌদ্ধ ঐতিহাসিক স্থান

ঐতিহাসিক স্থান ইতিহাসের এক পরম সম্পদ। বৌদ্ধ ঐতিহাসিক স্থান হলো গৌরবময় স্মৃতি ও ঘটনাবিজড়িত পবিত্র স্থান। এগুলো বুদ্ধ, বুদ্ধশিষ্য, অতীতের রাজা-মহারাজা বা ব্যক্তি মানুষের রেখে যাওয়া কীর্তি। এসব কীর্তি কালের আবর্তে ধ্বংস হয়ে গেছে, কিছু কিছু মাটির নিচে নানা কারণে চাপা পড়ে গেছে। পরবর্তীকালে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকেরা এসব স্থান নির্দিষ্ট করেছেন।

পুরাতত্ত্ববিদরা এসব স্থান খনন করে আবিষ্কার করেছেন। খনন কাজের ফলে বৌদ্ধ কীর্তির বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। এসব বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করছে। ঐতিহাসিক বৌদ্ধ স্থানগুলো হলো— শ্রাবস্তী, বৈশালী, রাজগৃহ, নালন্দা, তক্ষশিলা, অজন্তা, কপিলাবস্তু, কুশিনগর, বুদ্ধগয়া প্রভৃতি ।

বাংলাদেশের এরূপ প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ ঐতিহাসিক স্থান আছে। যেমন- বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, কুমিল্লার ময়নামতি। এ ছাড়াও চট্টগ্রামের পণ্ডিত বিহার, চক্রশালা, মহামুনি, রামকোট, ঠেগরপুনি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে বৌদ্ধ নিদর্শন হিসেবে আছে সোমপুর মহাবিহার, শালবন মহাবিহার, জগদ্দল মহাবিহার, হলুদ বিহার, সীতাকোট বিহার প্রভৃতি। ঐতিহাসিক স্থানগুলো আমাদের অতীত গৌরবের স্বাক্ষর বহন করে।

ঐতিহাসিক স্থানের গুরুত্ব

ঐতিহাসিক স্থান দর্শন ও ভ্রমণের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। এসব স্থান ভ্রমণ করলে বৌদ্ধ নিদর্শনগুলোর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো দেখা যায়। ঐতিহাসিক স্থানের ভৌগোলিক পরিচয় জানা যায়। এতে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা যায়। এ ছাড়াও মনের প্রসারতা বাড়ে, ধর্ম ও ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এসব জায়গা দেখে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়। বই পড়ে লাভ করা জ্ঞানের সঙ্গে চাক্ষুষ দেখার জ্ঞানের যোগ ঘটে।

বৌদ্ধধর্ম মতে, তীর্থ ভ্রমণ বা ঐতিহাসিক স্থান দর্শন একটি পুণ্যকর্ম। এতে দুঃখ খণ্ডন, পুণ্য সঞ্চয়, বর্তমান জন্মে সুখ ও পরকালে সুগতি লাভ হয়। এজন্য সকলেরই সাধ্য অনুযায়ী, সময় ও সুযোগ করে তীর্থ দর্শন করা উচিত। বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের ঐতিহাসিক স্থান দর্শন ও ভ্রমণে যাওয়ার গুরুত্ব অত্যধিক।

এককথায় ঐতিহাসিক স্থানে পাওয়া যায় মানুষের শৌর্য, বীর্য ও সমাজ সংস্কৃতির পরিচয়। তাই দেশে ঐতিহ্য সংস্কৃতির গুরুত্ব বিবেচনা করে তা সংরক্ষণে প্রত্যেকের যত্নবান হওয়া উচিত।

এখন আমরা কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থানের বর্ণনা জানতে পারব।

শ্রাবস্তী

শ্রাবস্তী ভারতের উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত গোণ্ডা জেলার অচিরাবতী নদীর তীরে অবস্থিত। এ নগরকে অনেকে ‘সবস্থ’ বা ‘সাবস্ত’ বলে। আবার কেউ কেউ ‘সবস্থ’ ঋষির নামানুসারে এই স্থানের নাম শ্রাবস্তী হয়েছে বলে মনে করেন।

শ্রাবস্তীর বর্তমান নাম সাহেত-মাহেত।

বুদ্ধের সময়ে শ্রাবস্তী ছিল উত্তর প্রদেশের শ্রেষ্ঠ জনপদ। এটি ছিল কোশলরাজ প্রসেনজিৎ –এর রাজধানী ও শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য কেন্দ্র। শ্রাবস্তীর সঙ্গে বুদ্ধের জীবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তাই শ্রাবস্তী বৌদ্ধদের প্রধান তীর্থ স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম ।

শ্রাবস্তীতে জেতবন, পূর্বারাম এবং রাজকারাম নামে তিনটি প্রসিদ্ধ বিহার ছিল। এর মধ্যে জেতবন বিহারটি খুবই সুন্দর। শ্রাবস্তীর ধনী শ্রেষ্ঠী ছিলেন সুদত্ত। তিনি বহু স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে রাজকুমার জেতের কাছ থেকে জেতবন উদ্যান ক্রয় করেন। সেখানে তিনি জেতবন বিহার নির্মাণ করে বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যদের দান করেন। বৌদ্ধ ইতিহাসে শ্রেষ্ঠী সুদত্ত অনাথপিণ্ডিক নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি বুদ্ধের খুব প্রিয় গৃহী শিষ্য ছিলেন। তিনি বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যদের বসবাসের জন্য বিহার নির্মাণের স্থান হিসেবে জেতবন উদ্যান পছন্দ করেন। এটি ছিল রাজকুমার জেতের প্রমোদ উদ্যান। সুদত্ত শ্রেষ্ঠী এটি কিনতে চাইলে রাজকুমার বললেন, সোনার মোহরে জমিটি ঢেকে দিতে পারলে তিনি তা বিকি করবেন। সুদত্ত শ্রেষ্ঠী সোনার মোহর এনে জায়গাটি ভরে দিলেন। জায়গাটি ক্রয় করেন। তারপর তিনি সেখানে নির্মাণ করেন বিরাট জেতবন বিহার।

ইতিহাস মতে, এতে ৬০টি বড় হলঘর ও ৬০টি ছোট-বড় কক্ষ ছিল। বিহারটির তোরণ নির্মাণ করেন রাজকুমার জেত। এই বিহারের ভিতরে ছিল কয়েকটি কুটির। বুদ্ধ জেতবনে ১৯টি বর্ষা যাপন করেন। এখানে সারিপুত্র ও মৌদ্‌গল্যায়ন এর পূতাস্থি রাখা হয়। সম্রাট অশোক তা পরে অন্য স্থানে পুনপ্রতিষ্ঠা করেন।

মহাউপাসিকা বিশাখা পূর্বারাম নামে এক মহাবিহার নির্মাণ করে বুদ্ধকে দান করেন। বিশাখা ছিলেন সাহেত নামক স্থানের এক ধনী শ্রেষ্ঠীর সুন্দরী কন্যা। পরে শ্রাবস্তী নগরীর শ্রেষ্ঠী মিগার বিশাখাকে নিজের পুত্রবধূ করে ঘরে আনেন। বিশাখা বুদ্ধের ভক্ত ছিলেন। বিশাখাকে মিগার মাতা বলা হয়। তাই পূর্বারাম বিহারটি মিগারমাতা বিহার নামে পরিচিত। বিহারটি ছিল দ্বিতল ভবন বিশিষ্ট। বুদ্ধ পূর্বারামে ছয় বর্ষা যাপন করেন। জানা যায়, বিশাখা মহামূল্যবান সোনার হার বিক্রি করে এই পূর্বারাম বিহার নির্মাণ করেন।

জেতবনের তৃতীয় বিহার রাজকারাম। কোশালরাজ প্রসেনজিৎ এই বিহার নির্মাণ করেন। অগ্রমহিষী মল্লিকা দেবীর অনুরোধে রাজা প্রসেনজিৎ এখানে একটি অতিথিশালাও নির্মাণ করেন। এর নাম ছিল মল্লিকারাম। এতে বুদ্ধের ধর্মদেশনা ও ধর্মালোচনা হতো ।

শ্রাবস্তীর কাছেই ছিল অঞ্জন বন। বুদ্ধের শিষ্য গবম্পতি এখানে বাস করতেন। থেরী সুজাতা বুদ্ধের ধর্মোপদেশ শুনে এখানে অর্হত্ব ফল লাভ করেন। বুদ্ধের অগ্রশ্রাবিকা উৎপলবর্ণাও বাস করতেন শ্রাবস্তীতে। বর্তমানে মাহেত ও সাহেত নামক স্থানে প্রাচীন শ্রাবস্তীর ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে মাহেতের জেতবন বিহারের ধ্বংসাবশেষের প্রায় চারশত একর এলাকা জুড়ে রয়েছে মূল শ্রাবস্তী নগরীর ধ্বংসাবশেষ।

বৈশালী

বৈশালী ভারতের বিহার রাজ্যের মোজাফ্ফরপুর জেলায় অবস্থিত। বৈশালী বর্তমানে বেসার নামে পরিচিত। রাজগৃহ ও বুদ্ধগয়া থেকে সড়কপথে এখানে যাওয়া যায়। বুদ্ধের সময় বৈশালী সমৃদ্ধ নগরী ছিল। এটি ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন গণরাজ্য। এটি লিচ্ছবিদের গণরাজ্যের রাজধানী ছিল। আটটি জাতির মিলিত শক্তিতে এই গণরাজ্য গঠিত ছিল।

গণশক্তির মধ্যে লিচ্ছবিরা ছিল সংখ্যায় বেশি। সেজন্য একে লিচ্ছবি গণরাজ্য বলা হয় । ত্রিপিটকের মহাবর্গে এর উল্লেখ আছে। এখানে বহু প্রাসাদ, কুটাগার, প্রমোদ উদ্যান ও পুকুর ছিল। বুদ্ধ বৈশালীতে অনেকবার আসেন। তিনি এখানে বর্ষাবাস যাপন করেন। এখানে বুদ্ধ তাঁর শিষ্যসহ নর্তকী আম্রপালির নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। পরে তাঁকে ত্রিশরণে দীক্ষিত করেন। আম্রপালি বুদ্ধের ধর্মদেশনা শুনে অর্হত্ব ফল লাভ করেন। চাপাল চৈত্যে অবস্থান করা কালে বুদ্ধ তাঁর পরিনির্বাণের কথা ঘোষণা করেন। বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর লিচ্ছবিরা তাঁর পূতাস্থি এনে এখানে স্তূপ নির্মাণ করেন।

প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, ‘রাজাবিশালকাগড়’ নামক স্থানটি প্রাচীন বৈশালী নগরের ধ্বংসাবশেষ। এটি খননের ফলে এখানে অনেক প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায়। ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাঙ বৈশালী পরিদর্শন করেন। এখানে তাঁরা অনেক স্থাপত্য ও প্রাচীন শিল্পের নমুনা দেখতে পান। রাজাবিশালকাগড়ের উত্তরে কোলৌ নামক স্থানের অনতিদূরে আছে সিংহমূর্তিসহ একটি স্তম্ভ। এর মধ্যে আছে অশোকের শিলালিপি। হিউয়েন সাঙ এটি দেখতে পান।

বৈশালী জৈনদের বড় তীর্থস্থান। জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর এখানে জন্মগ্রহণ করেন।

তক্ষশিলা

তক্ষশিলা ভারতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে প্রাচীন ও সুপ্রসিদ্ধ। গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবকালেই এ বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যমান ছিল। বৌদ্ধ যুগের পূর্ববর্তীকালেও তক্ষশিলা বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। তক্ষশিলা পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি নগরের চব্বিশ কিলোমিটার দূরে সরাইকলা নামক রেলওয়ে জংশনের পার্শ্ববর্তী স্থানে অবস্থিত। এটি গান্ধার রাজ্যের রাজধানী ছিল। এখনো বিশাল এলাকা জুড়ে প্রাচীন তক্ষশিলার ধ্বংসস্তূপ পরিলক্ষিত হয়। গ্রিক পণ্ডিত তাঁদের গ্রন্থে তক্ষশিলার সমৃদ্ধি ও গৌরবের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ভারতীয় আর্যগণ অতি প্রাচীনকালেই এখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন।

মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের কূটনীতিজ্ঞ মন্ত্রী চাণক্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপণ্ডিত ছিলেন। অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ সূত্রের রচয়িতা পাণিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রসিদ্ধ ছাত্র। বৌদ্ধ ভিক্ষু ধর্মরক্ষা ও মাতঙ্গ তক্ষশিলার প্রসিদ্ধ ছাত্র ছিলেন। তাঁরা বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য চীন দেশে গিয়েছিলেন। গুপ্ত রাজাদের শাসনামলে চীন দেশ থেকে দলে দলে শিক্ষার্থী ছাত্ররা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে।

এখানে নানা ললিতকলা, ধর্মদর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হতো। মহাবর্গ গ্রন্থেও এর বিপুল খ্যাতির কথা বর্ণিত আছে।

তক্ষশিলাকে বৌদ্ধগণ ‘তক্কসির’ বা ‘তাকসিলা' নামে অভিহিত করেছেন। জাতক অনুসারে জানা যায় বুদ্ধ কোনো এক জন্মে এ স্থানে শির দান করে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। কুম্ভকার জাতকে উল্লেখ আছে যে, তক্ষশিলা ‘নগ্‌গজি' নামক এক রাজার রাজধানীও ছিল।

সম্রাট বিন্দুসার কুমার অশোককে তক্ষশিলার বিদ্রোহ দমনের জন্য পাঠিয়েছিলেন। দীপবংস থেকে জানা যায়, দীপংকর নামে এক বৌদ্ধ রাজা ও তাঁর ১২ জন উত্তরসূরি তক্ষশিলা শাসন করেন। কুষাণরাজ কণিষ্কের সময়ে তক্ষশিলা থেকে রাজধানী পুরুষপুরে স্থানান্তরিত করলে তক্ষশিলার মর্যাদা ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়। তৎকালে রাজপুত্র, ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা বিদ্যাশিক্ষার জন্য তক্ষশিলাকেই প্রাধান্য দিতেন। রাজবৈদ্য জীবক তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত বছর আয়ুর্বেদশাস্ত্র শিক্ষা করেন।

কথিত আছে, তিনি চৌদ্দ বছরের শিক্ষণীয় বিষয় সাত বছরে সমাপ্ত করেছিলেন। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আয়ুর্বেদশাস্ত্রে তাঁকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি প্রদান করেছিল । হুন জাতি ৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে এ নগর আক্রমণ করে ধ্বংস করেন।

মহাস্থানগড়

বাংলাদেশের বগুড়া শহর থেকে উত্তরে করতোয়া নদীর তীরে মহাস্থানগড় অবস্থিত। এর প্রাচীন নাম পুণ্ড্রবর্ধন। স্থানটি অত্যন্ত মনোরম ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। একসময় পুণ্ড্রবর্ধন উত্তরবঙ্গের শাসনকেন্দ্র ছিল। মহাস্থানগড়ের ইতিহাস অতি প্রাচীন। মৌর্য, গুপ্ত ও পাল রাজাদের রাজত্বকালে এটি বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল। এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অনেক বৌদ্ধ বিহার, চৈত্য ও বৌদ্ধধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ স্থানে খনন কার্যের ফলে বিভিন্ন যুগের বহু ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। বৌদ্ধযুগের বহু নিদর্শন এ স্থানে বিদ্যমান ।

ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধনই মহাস্থানগড়। এটি প্রাচীন বাংলার সর্ববৃহৎ নগরী ছিল।

বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এখানে আসেন। তিনি এখানে অনেকগুলো বৌদ্ধ বিহার ও চৈত্য দেখেছিলেন। নগর প্রান্তে বুদ্ধের দেহাবশেষ সংরক্ষিত একটি স্তূপ দেখতে পান। সম্রাট অশোক স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন।

১৮০৮ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ বুকানন হেমিল্টন স্থানটির প্রথম বর্ণনা দেন। ১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম স্থানটি পরিদর্শন করেন। ১৯৭৩-৭৪ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ নরপতির ধাপ নামক জঙ্গল খনন করতে গিয়ে ভাসু বিহার আবিষ্কার করে। এটি একটি বিরাট বিহার।

ভাসু বিহারের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাচীন মুদ্রা, নানা দ্রব্য, ধ্যানী বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর, তারা, মঞ্জুশ্রী, ধর্মচক্র ও বুদ্ধ পূজারিণীর মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ছাড়া বহির্ভাগে গোবিন্দ ভিটা, মংকনির কুন্ড, বৈরাগী ভিটা প্রভৃতি নিদর্শন আছে।

মহাস্থানের খনন কাজ অনেক দিন আগে শুরু হয়েছিল। এখনও শেষ হয়নি। অর্ধখনন অবস্থায় পড়ে আছে। প্রাচীন নিদর্শন সমৃদ্ধ মহাস্থানগড় অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ এলাকার মাটির নিচে পড়ে আছে বহু বৌদ্ধ নিদর্শন। সঠিকভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার কাজ চালানো হলে এদেশের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য জানা যাবে।

পাহাড়পুর

পাহাড়পুর জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি নওগাঁ জেলার একটি বৌদ্ধ ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান ।

খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত পালবংশীয় রাজাগণ বাংলাদেশ শাসন করেন। পাল রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন। রাজা ধর্মপাল তাঁর রাজত্বের প্রথম দিকে এখানে একটি বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার নাম ছিল সোমপুর মহাবিহার। এ বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। সোমপুর (বা ওমপুর) গ্রামটি এখনও সেই প্রাচীন নামের স্মৃতি বহন করছে।

সে সময় এত বড় বিহার হিমালয়ের দক্ষিণাঞ্চলে আর ছিল না। ভারতের উত্তরে নর্মদা থেকে উজ্জয়িনী পর্যন্ত রাজা ধর্মপালের রাজ্য বিস্তৃত ছিল। তাঁর রাজ্যের মধ্যেও এটি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ বিহার। তাঁর স্ত্রী রন্নাদেবী ‘মূর্তিমতি কীর্তি' বলে বর্ণিত হয়েছেন। কারণ তিনিও অনেক বিহার ও মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। সে বিহার ও মন্দির সোমপুর বিহারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। রাজা ধর্মপালের উদারতা ও বৌদ্ধধর্মে পৃষ্ঠপোষকতাই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ধর্মপাল সোমপুর বিহারকে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেখে আরও পঞ্চাশটি বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে সোমপুর বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। ইটের তৈরি উঁচু ও পুরু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল প্রতিষ্ঠানটি। সোমপুর বিহারের অভ্যন্তরে ১৭৭টি কক্ষ ছিল। সেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বাস করতেন এবং ধর্মচর্চা ও ধ্যান সমাধি করতেন।

বিশাল বিহার সংলগ্ন ছিল জলাধার ও জল নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা। সোমপুর বিহারের ভিত্তি ও নিচের চত্বরের কারুকাজ ছিল অপূর্ব। পোড়ামাটির তৈরি ফলকের বিভিন্ন চিত্র সহজেই মনকে আকর্ষণ করে।

মহাপণ্ডিত ভিক্ষু বোধিভদ্র ও অতীশ দীপঙ্কর এ বিহারে অবস্থান করতেন। তাঁদের রচিত বহু গ্রন্থ তিব্বতি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এ বিহারে বসে ভাব বিবেকের‘মধ্যমকর রত্নদ্বীপ' গ্রন্থ তিব্বতি ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি তিব্বতে ধর্ম প্রচার করে অমর হয়ে আছেন। কল্যাণশ্রী মিত্র ও বিপুলশ্রী মিত্র এ বিহারে থাকতেন। পাল বংশের পতনের পর ধীরে ধীরে বিহারের উন্নয়ন সমৃদ্ধি লুপ্ত হতে থাকে। একসময় অযত্ন অবহেলায় প্রাকৃতিক কারণে এটি মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। সম্প্রতি জাতিসংঘ সোমপুর বিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

রামকোট

কক্সবাজারের নিকটবর্তী রম্যভূমি রামুর রামকোট বিহার একটি প্রাচীন বৌদ্ধ ঐতিহ্য। একসময় রামু বৌদ্ধ সংস্কৃতির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। রামুর লামার পাড়া কেয়াং, সীমা বিহার অত্যন্ত প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার।

রামকোট ছোট বড় অনেকগুলো পাহাড় বেষ্টিত। পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ইটের স্তূপ, বুদ্ধমূর্তির ভগ্নাবশেষ, শিলালিপি, পোড়ামাটির ফলক এখনো অনুচ্চ টিলার ওপর অবস্থিত। পাশে ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে রামকোট জগৎজ্যোতি শিশু সদন ।

১৯৩০ সালে জগৎচন্দ্র মহাস্থবির শ্রীলংকায় উদ্ধারকৃত একটি শিলালিপিতে রামকোট বিহারের কথা জানেন। এতে প্রাপ্ত তথ্যমতে অনুসন্ধান ও খননকার্য চালিয়ে এ সুবৃহৎ সংঘারামের ধ্বংসাবশেষ ও প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি আবিষ্কার করেন। এতে বেলে পাথরের নির্মিত ভাস্কর্যের মধ্যে বুদ্ধের দুটি পদচিহ্ন (পূর্ণাকার) ও হস্তপদাদি ভগ্ন ভূমিস্পর্শ মুদ্রার বুদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের প্রাণপুরুষ ছিলেন চকরিয়া হারবাং -এর চন্দ্রজ্যোতি মহাস্থবির। তিনি ছিলেন চেন্দি রাজের পুত্র। তিনি তাঁর ধর্ম প্রচার অভিযানে রামুর পল্লিগ্রামে এসে উপনীত হন। রামুতে তিনি সাতটি ধর্মচৈত্য নির্মাণ করেছিলেন। ইতিহাস মতে, খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে ধর্মপালের রাজত্বকালে চট্টগ্রাম স্বল্প সময়ের জন্য পাল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। রাজা ধর্মপাল শাসিত বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলের রাজধানী ছিল রাহমী বা রাহমা। অর্থাৎ বৃহত্তম চট্টগ্রামের রামু। রামুকে রম্যভূমি বা রম্যস্থান বলা হয়। রামুর প্রাচীন বৌদ্ধ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস হিন্দু-মুসলিম শাসনামলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

গবেষক ও ঐতিহাসিকদের মতে, রামকোট বৌদ্ধ বিহার ও সধাতুক বড় বুদ্ধমূর্তি সম্রাট অশোকের নির্মিত ৮৪ হাজার চৈত্যের মধ্যে একটি। ঐতিহাসিক রামকোটে প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে মেলা বসে। এই প্রত্নস্থল ও প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি দর্শনে স্বদেশি বিদেশি অনেক পর্যটক ও ইতিহাস গবেষক আসেন। এটি বর্তমানে প্রাচীন বৌদ্ধ ঐতিহ্য ও পুণ্যতীর্থ হিসেবে প্রসিদ্ধ।

তোমরা বৌদ্ধ ঐতিহাসিক স্থানগুলো দর্শন করবে। বাংলাদেশের সর্বত্র মাটির নিচে বৌদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতি লুকিয়ে আছে। পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি, উয়ারি বটেশ্বর, চক্রশালা, রামকোট প্রভৃতি স্থানগুলো পুরাতন স্মৃতি হিসেবে বৌদ্ধদের কাছে তীর্থে পরিণত হয়েছে। পর্যটকদের কাছেও অজানাকে জানার প্রেরণা দিচ্ছে। ঐতিহাসিক স্থানগুলো আমাদের অতীত গৌরবের স্বাক্ষর। আমাদের হারানো গৌরবময় অতীতকে জানতে হলে এসব ঐতিহাসিক স্থান দর্শন প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার এ লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার ও যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

Content added By

শূন্যস্থান পূরণ কর :

১. জাতির ইতিহাস ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে ___ ।

২. ঐতিহাসিক স্থান ইতিহাসের এক পরম ___ ।

৩. ধর্ম ও ঐতিহ্যের প্রতি ___ সৃষ্টি হয় ।

৪. শ্রাবস্তীর বর্তমান নাম ___।

৫. জীবক ___ বছর আয়ুর্বেদশাস্ত্র শিক্ষা করেন ৷

৬. সম্রাট অশোক ___ নির্মাণ করেছিলেন ।

৭. রামকোটে প্রতিবছর ___ মেলা বসে।

 

বাম পাশের বাক্যাংশের সাথে ডান পাশের বাক্যাংশের মিল কর :

বামডান

১. ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হলো

২. বুদ্ধের সময়ে বৈশালী

৩. বৌদ্ধ ইতিহাসে শ্রেষ্ঠী সুদত্ত

৪. একসময় পুণ্ড্রবর্ধন

৫. পাল বংশের রাজারা

৬. সোমপুর মহাবিহারে

১. বৌদ্ধ ছিলেন।

২. উত্তরবঙ্গের শাসনকেন্দ্র ছিল।

৩. একটি জাতির মূল শেকড়।

৪. ১৭৭টি কক্ষ ছিল।

৫. সমৃদ্ধ নগরী ছিল।

৬. অনাথপিণ্ডিক নামে পরিচিত ছিলেন।

৭. গান্ধার রাজ্যের রাজধানী ছিল।

 

নিচের প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও :

১. পাঁচটি প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ ঐতিহাসিক স্থানের নাম লেখ। 

২. তক্ষশিলায় কারা বিদ্যাশিক্ষা লাভ করেছিলেন উল্লেখ কর। 

৩. শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও । 

৪. মহাস্থানগড়ের প্রাচীন নাম কী? স্থানটি কেমন ছিল? 

৫. সোমপুর বিহারে কোন কোন পণ্ডিত অবস্থান করেছিলেন? 

৬. ভাসু বিহারের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। 

৭. রামুর প্রাচীন নাম কী ছিল?

 

নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :

১. বৌদ্ধ ঐতিহ্য কী? ঐতিহাসিক স্থানগুলো কেন দর্শন করবে? 

২. ঐতিহাসিক স্থানের গুরুত্ব আলোচনা কর। 

৩. তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবরণ দাও। 

৪. বৌদ্ধ ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে বৈশালীর বর্ণনা দাও। 

৫. সোমপুর মহাবিহারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও । 

৬. মহাস্থানগড়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। 

৭. ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে রামকোট বিহারের বর্ণনা দাও ।

Content added By
নিজের ইচ্ছা পূরণ
মনের প্রসারতা বৃদ্ধি
বুদ্ধ জ্ঞান লাভ
মার্গফল লাভ