চতুর্থ শ্রেণি (প্রাথমিক) - খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

একাদশ অধ্যায়

পাপস্বীকার, খ্রিষ্টপ্রসাদ ও হস্তার্পণ

খ্রিষ্টমণ্ডলীর সাতটি সাক্রামেন্ত (সংস্কার) সম্পর্কে আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি। সাক্রামেন্তগুলোর নাম হলো যথাক্রমে : দীক্ষাস্নান, পাপস্বীকার, খ্রিষ্টপ্রসাদ, হস্তার্পণ, রোগীলেপন, যাজকবরণ ও বিবাহ। এই সাক্রামেন্তগুলো খ্রিষ্টীয় জীবনের সকল গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের সাথে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত । সাক্রামেন্তগুলো খ্রিষ্টমণ্ডলীতে আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। এগুলো আমাদের জীবনের পথ প্রদর্শক। এই সাক্রামেন্তগুলো আমাদের পবিত্রভাবে গ্রহণ করতে হয়। কারণ এগুলোর মাধ্যমে আমরা খ্রিষ্টের মধ্যস্থতায় ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করি, পিতার সাথে একাত্ম হই অর্থাৎ পিতার অনুগ্রহ লাভ করি, যীশুর শিষ্য হয়ে উঠি এবং খ্রিষ্টমণ্ডলীর প্রকৃত সদস্য হয়ে উঠি। ইতিপূর্বে আমরা দীক্ষাস্নান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখন আমরা পাপস্বীকার, খ্রিষ্টপ্রসাদ ও হস্তার্পণ সম্পর্কে জানব।

১। পাপস্বীকার

খ্রিষ্টমণ্ডলীর সাতটি সাক্রামেন্তের মধ্যে দ্বিতীয় সাক্রামেন্তটি হচ্ছে পাপস্বীকার বা পুনর্মিলন। এটাকে বলা হয় অনুতাপ, ক্ষমাদান, পাপস্বীকার ও মন পরিবর্তনের সাক্রামেন্ত। আমাদের যখন ভালো ও মন্দের তফাৎ বোঝার ক্ষমতা হয়, তখন পাপস্বীকার সাক্রামেন্ত গ্রহণ করতে পারি। পবিত্ৰতা অর্জনের জন্য যত ঘন ঘন সম্ভব পাপস্বীকার 

করা আমাদের জন্য কল্যাণকর। পাপের কারণে আমরা খ্রিষ্টের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। সেই বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আমরা পাপস্বীকার করে মন পরিবর্তন করি। এভাবে আমরা যীশুর সঙ্গে থাকতে পারি। পাপস্বীকারে পাপের জন্য প্রকৃত অনুতাপ করার পর পুরোহিতের (যাজকের) কাছে পাপের কথা বলতে হয়। পুরোহিত আমাদের উপদেশ ও দণ্ডমোচন দেন। তিনি পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার নামে আমাদের পাপ ক্ষমা করেন।

 

এতে আমরা ঈশ্বর ও মণ্ডলীর সঙ্গে পুনর্মিলিত হই। আমরা নরকের শাস্তি থেকে মুক্তি পাই, অন্তরে শান্তি পাই ও আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করি।

পাপস্বীকারের জন্য নিম্নলিখিত পাঁচটি বিষয় মনে রাখা দরকার : (১) পাপস্বীকারের পূর্বে আমার সব পাপ মনে করব

(২) সেসব পাপের জন্য অনুতাপ করব

(৩) ‘আর পাপ করব না' বলে সংকল্প করব

(৪) যাজকের কাছে গিয়ে সব পাপ খুলে বলব (৫) যাজক পাপের যে দণ্ডমোচন দেন তা পূরণ করব।

গান করি

আমি ক্রুশের তলে নত হয়ে তাঁকে বলব প্রভু, ক্ষমা কর মোরে ক্ষমা কর ৷ কত যে ঘুরেছি পাপের পথে (২) পাই নি তো সুখ, পেয়েছি আঘাত (২) প্রতিনিয়ত ।

পরিকল্পিত কাজ

(১) অনুতপ্ত হয়ে ঈশ্বরের কাছে একটি ক্ষমার প্রার্থনা লেখ। (২) তোমার বিগত দিনগুলোর অপরাধ স্মরণ কর এবং যাদের সঙ্গে নানা কারণে তোমার সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে তাদের কাছে ক্ষমা চাও এবং পুনর্মিলিত হওয়ার সিদ্ধান্ত

গ্রহণ কর।

২। খ্রিষ্টপ্রসাদ

খ্রিষ্টপ্রসাদ সাক্রামেন্ত বিভিন্ন নামে পরিচিত, যথা : ধন্যবাদজ্ঞাপক ক্রিয়া, পবিত্র খ্রিষ্টযাগ, প্রভুর ভোজ, প্রভুর স্মরণোৎসব, রুটি খণ্ডন অনুষ্ঠান, বেদীর আরাধ্য সংস্কার ইত্যাদি। খ্রিষ্টপ্রসাদ সাক্রামেন্ত হলো রুটি ও দ্রাক্ষারসের আকারে যীশুর দেহ ও রক্ত। আমরা জানি, যীশু খ্রিষ্টের দুইটি স্বভাব (প্রকৃতি) : ঐশ স্বভাব ও মানব স্বভাব। 

তিনি ঈশ্বরের স্বভাবে সব জায়গায় এবং মানুষের স্বভাবে স্বর্গে ও খ্রিষ্টপ্রসাদে উপস্থিত আছেন। খ্রিষ্টপ্রসাদে আমরা যীশু খ্রিষ্টকেই গ্রহণ করি । কারণ খ্রিষ্টযাগে যাজকের কথার মাধ্যমে রুটি ও দ্রাক্ষারস যীশুর দেহ ও রক্তে পরিণত হয়ে যায়।

 

 

 

 

 

 

খ্রিষ্টপ্রসাদে যীশু আমাদের আত্মার জীবন ও আহার হওয়ার জন্য নিজেকে দান করেন। তাই সুযোগ থাকলে প্রতিদিনই খ্রিষ্টপ্রসাদ গ্রহণ করা আবশ্যক। যীশু খ্রিষ্টযাগ প্রতিষ্ঠা করেছেন পুণ্য বৃহস্পতিবার। যে রাতে তিনি শত্রুদের হাতে সমর্পিত হয়েছিলেন সে রাতেই যীশু তাঁর শিষ্যদের সাথে শেষ ভোজ গ্রহণ করেছিলেন। সেই ভোজের সময় তিনি তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে একখানা রুটি হাতে নিয়ে তা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করলেন । তারপর তা শিষ্যদের দিয়ে বললেন: “নাও, খাও সকলে, এ আমার দেহ যা তোমাদের জন্য সমর্পিত হবে।” তারপর তিনি একটি পানপাত্রে দ্রাক্ষারস নিয়ে শিষ্যদের হাতে দিয়ে বললেন :

“নাও, পান কর সকলে, এ আমার রক্তের পাত্র, নতুন ও শাশ্বত সন্ধির রক্ত। এ রক্ত তোমাদের জন্য আর সকল মানুষের জন্য পাপমোচনের উদ্দেশ্যে পাতিত হবে। তোমরা আমার স্মরণার্থে এই অনুষ্ঠান করবে।” যীশুর শেষ ভোজের ঘটনাটিই আমরা খ্রিষ্টযাগে স্মরণ করি। এই স্মরণ করা শুধু ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণ নয়। বরং যতবার খ্রিষ্টযাগ অর্পিত হয় ততবারই যীশু খ্রিষ্ট নিজে বলিকৃত হন ।

খ্রিষ্টযাগ হলো খ্রিষ্টমণ্ডলীর জীবনের উৎস। খ্রিষ্টপ্রসাদ সংস্কার হলো ঈশ্বরের জীবনের সঙ্গে তাঁরই জনগণের মিলনের সময়। এর মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরের অনন্ত জীবনের স্বাদ বা আনন্দ লাভ করি।

খ্রিষ্টপ্রসাদের প্রতি আমাদের সম্মান

খ্রিষ্টপ্রসাদকে আমরা অবশ্যই সম্মান দেখাব। খ্রিষ্টযাগ অনুষ্ঠানের সময় হোক বা অন্য কোনো সময়েই হোক, আমরা যেন খ্রিষ্টের আরাধনা করি। খ্রিষ্টপ্রসাদ যে জায়গায় রাখা হয় তার পাশে সর্বদাই বাতি জ্বালানো থাকে। খ্রিষ্টমণ্ডলী অতি যত্নের সাথে খ্রিষ্টপ্রসাদ সাক্রামেন্ত সংরক্ষণ করে। সেই খ্রিষ্টপ্রসাদ অসুস্থ ব্যক্তি, যারা খ্রিষ্টযাগে অংশগ্রহণ করতে পারে না তাদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। পবিত্র খ্রিষ্টপ্রসাদ ভক্তদের আরাধনার জন্য প্রদর্শন করা হয়। শুধু তা-ই নয়, খ্রিষ্টপ্রসাদীয় শোভাযাত্রায় বহন করে সম্মান প্রদর্শন করা হয়।

খ্রিষ্টপ্রসাদ গ্রহণের ফল

১। খ্রিষ্টপ্রসাদ গ্রহণের ফলে খ্রিষ্ট ও তাঁর মণ্ডলীর সঙ্গে ভক্তের মিলন বৃদ্ধি পায়

২। খ্রিষ্টপ্রসাদ গ্রহণকারীদের মধ্যে ভ্রাতৃপ্রেম বৃদ্ধি পায়

৩। খ্রিষ্টভক্তের ভক্তি-ভালোবাসা আরও সবল হয়

৪। পাপ করা থেকে বিরত থাকার শক্তি লাভ করি ৫। অন্যের সাথে জীবন সহভাগিতা করার শক্তি পাই।

পরিকল্পিত কাজ

১। আজ থেকে আমি বিশ্বাস ও ভক্তিসহকারে খ্রিষ্টপ্রসাদ গ্রহণ করব

২। সুযোগ পেলে আমি প্রতিদিন খ্রিষ্টযাগে অংশগ্রহণ করব

৩। যারা খ্রিষ্টযাগে যেতে চায় না, তাদের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা দিয়ে খ্রিষ্টযাগে নিয়ে যাব।

৩। হস্তার্পণ

কাথলিক মণ্ডলীতে এই সাক্রামেন্তকে ‘হস্তার্পণ ' বলার কারণ হলো সাক্রামেন্ত প্রার্থীর মাথায় হাত রেখে পবিত্র আত্মার কৃপা যাচনা করা হয়। এই সাক্রামেন্ত ‘দৃঢ়ীকরণ সাক্রামেন্ত ' নামেও পরিচিত। কারণ এই সাক্রামেন্তের মাধ্যমে প্রার্থীর অন্তরে পবিত্র আত্মার উপস্থিতিকে দৃঢ়তর করে তোলা হয়। এই সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো প্রার্থীর কপালে অভিষেক তেল লেপন করা। তেল লেপনের মাধ্যমে ঐ ব্যক্তি প্রকৃত খ্রিষ্টান ও যীশুর উপযুক্ত শিষ্য হওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠে। যীশু পবিত্র আত্মার সাথে একাত্ম হয়ে তাঁর সমস্ত জীবনযাপন ও সমস্ত কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। পঞ্চাশত্তমী পর্বদিনে

প্রেরিতশিষ্যগণ পবিত্র আত্মাকে পেয়ে ঈশ্বরের মহিমা ও প্রশংসা করেছিলেন। সেই সময় যারা দীক্ষাস্নান গ্রহণ করত তাদের মাথায় হাত রেখে প্রেরিতশিষ্যগণ সেই একই পবিত্র আত্মাকে প্রদান করতেন। যুগের পর যুগ খ্রিষ্টমণ্ডলী সেই একই পবিত্র আত্মাকে আমাদের মাঝে জীবন্ত করে রাখছে।

হস্তার্পণ সাক্রামেন্ত দিয়ে থাকেন বিশপ (ধর্মপাল)। তিনিই প্রার্থীর মাথায় হাত রাখেন এবং কপালে তেল লেপন করেন। আর এর মাধ্যমে হস্তার্পণপ্রাপ্ত ব্যক্তি খ্রিষ্টমণ্ডলীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়। যে কোনো দীক্ষাস্নাত মানুষ হস্তার্পণ সংস্কার গ্রহণ করতে পারে। এই সংস্কার একজন খ্রিষ্টভক্ত জীবনে মাত্র একবার গ্রহণ করে। এই সংস্কার সার্থকভাবে গ্রহণ করতে গেলে ভক্তকে অন্তরে পবিত্র হতে হয়।

১। ভক্তের অন্তরে পবিত্র আত্মা নতুনভাবে আগমন করেন

২। আধ্যাত্মিক মুদ্রাঙ্কন দ্বারা চিহ্নিত হয়

৩। ভক্ত আরও দৃঢ়ভাবে খ্রিষ্ট ও খ্রিষ্টমণ্ডলীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়

৪। ভক্তের অন্তরে পবিত্র আত্মার শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠে 

৫। ভক্ত বিশেষ শক্তি পায়, যাতে সে খ্রিষ্টের যথার্থ সাক্ষী হতে পারে।

পাপস্বীকার, খ্রিষ্টপ্রসাদ ও হস্তার্পণ

কী শিখলাম

পাপস্বীকারের উপায়সমূহ জানতে পেরেছি। খ্রিষ্টপ্রসাদ গ্রহণ করে আমরা আত্মায় বলীয়ান হই। হস্তার্পণের সময় পবিত্র আত্মাকে লাভ করি। পবিত্র আত্মার শক্তিতে আমরা পরিপক্ব খ্রিষ্টান হয়ে উঠি।

পরিকল্পিত কাজ

১। বিশপ কর্তৃক হস্তার্পণ প্রদানের একটি চিত্র অঙ্কন কর।

অনুশীলনী

১। শূন্যস্থান পূরণ কর

(ক) সাক্রামেন্তগুলো -------ভাগে ভাগ করা যায় ৷

(খ) পাপস্বীকার সাক্রামেন্তের অপর নাম---------

(গ) পাপস্বীকারের মাধ্যমে আমরা----------------করি ।

(ঘ) পাপস্বীকারের জন্য------ বিষয় মনে রাখা দরকার

(ঙ) খ্রিষ্টপ্রসাদে আমরা----------------- গ্রহণ করি ।

৩। সঠিক উত্তরটিতে টিক (√) চিহ্ন দাও

৩.১ সাক্রামেন্তগুলো হলো জীবনের—

(খ) পথপ্ৰদৰ্শক

(ক) পাথেয়

(গ) নিরাময়কারী

(ঘ) মিলন সাধনকারী

৩.২ কোন্ সাক্রামেন্তের মাধ্যমে যাজক পাপের দণ্ডমোচন দেন ? 

(ক) পাপস্বীকার (খ) বাপ্তিস্ম

(গ) হস্তার্পণ (ঘ) খ্রিষ্টপ্রসাদ

৩.৩ যীশু খ্রিষ্টের কয়টি স্বভাব?

(খ) ৩টি

(ক) ৪টি

(ঘ) ১টি

(গ) ২টি

৩.৪ যীশু ঈশ্বরের স্বভাবে কোথায় উপস্থিত থাকেন ?

(ক) রুটির আকারে 

(খ) দ্রাক্ষারসের মধ্যে

(গ) আমার অন্তরে

(ঘ) সব জায়গায়

৩.৫ খ্রিষ্টপ্রসাদ গ্রহণকারীদের মধ্যে কী বৃদ্ধি পায় ?

(ক) হিংসা

(খ) রাগ

(গ) ভ্রাতৃপ্রেম 

(ঘ) সহমর্মিতা

৪। সংক্ষেপে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও

(ক) যীশু কবে শেষ ভোজের অনুষ্ঠান করেন?

(খ) খ্রিষ্টপ্রসাদ সংস্কার কী?

(গ) পাপস্বীকার সাক্রামেন্তে যাজকের কাছে গিয়ে কী করতে হয় ?

৫। নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও

(ক) খ্রিষ্টপ্রসাদ গ্রহণের ৪টি ফল কী কী? 

(খ) হস্তার্পণ সাক্রামেন্তের ফলগুলো উল্লেখ কর।

Content added By