অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - সাহিত্য কনিকা - কবিতা | NCTB BOOK

এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল,

কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!

কাঁচা ধানের পাতার মতো কচি-মুখের মায়া,

তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।

জালি লাউয়ের ডগার মতো বাহু দুখান সরু,

গা খানি তার শাওন মাসের যেমন তমাল তরু।

বাদল-ধোয়া মেঘে কে গো মাখিয়ে দেছে তেল,

বিজলি মেয়ে পিছলে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল।

কচি ধানের তুলতে চারা হয়তো কোনো চাষি,

মুখে তাহার জড়িয়ে গেছে কতকটা তার হাসি।

 

কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি,

কালো দতের কালি দিয়েই কেতাব কোরান লেখি।

জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভুবনময়;

চাষিদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয়।

সোনায় যে-জন সোনা বানায়, কিসের গরব তার

রং পেলে ভাই গড়তে পারি রামধনুকের হার।

কালোয় যে-জন আলো বানায়, ভুলায় সবার মন,

তারির পদ-রজের লাগি লুটায় বৃন্দাবন।

সোনা নহে, পিতল নহে, নহে সোনার মুখ

কালো-বরন চাষির ছেলে জুড়ায় যেন বুক।

যে কালো তার মাঠের ধান, যে কালো তার গাঁও!

সেই কালোতে সিনান করি উজল তাহার গাও।

 

আখড়াতে তার বাঁশের লাঠি অনেক মানে মানী,

খেলার দলে তারে নিয়েই সবার টানাটানি।

জারির গানে তাহার গলা উঠে সবার আগে,

শাল-সুন্দি-বেত' যেন ও, সকল কাজেই লাগে।

বুড়োরা কয়, ছেলে নয় ও, পাগাল লোহা যেন,

রূপাই যেমন বাপের বেটা কেউ দেখেছ হেন?

যদিও রূপা নয়কো রুপাই, রূপার চেয়ে দামি,

এক কালেতে ওরই নামে সব গাঁ হবে নামি।

Content added || updated By
কচি লাউয়ের ডগার সাথে
রঙিন ফুলের সাথে
কঁচি ধানের পাতার সাথে
তমাল তরুর সাথে
কাঁচা ধানের পাতার মতো
জালি লাউয়ের ডগার মতো
শাওন মেঘের মতো
তমাল তরুর মতো
নতুন ফসলের ছায়া
নবীন তৃণের ছায়া
নতুন পাতার ছায়া
নবীন শস্যের ছায়া

ভ্রমর — ভোমরা, ভিমরুল।

নবীন তৃণ — কচি ঘাস।

জালি — কচি, সদ্য অঙ্কুরিত।

শাওন — শ্রাবণ, বঙ্গাব্দের চতুর্থ মাসের নাম।

কালো দত — লেখার কালি রাখার পাত্র বিশেষ, দোয়াত।

গরব — গর্ব, অহংকার।

রামধনুকের হার — অর্ধবৃত্তাকার রংধনুকে গলার হার হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে।

পদ-রজ — পায়ের ধুলা, চরণধূলি।

বৃন্দাবন — মথুরার 'নিকটবর্তী হিন্দুদের তীর্থস্থান।

সিনান — স্নান, গোসল।

উজল — উজ্জ্বল, দীপ্তিমান।

আখড়াতে — নৃত্যগীত শিক্ষা ও মল্লবিদ্যা অভ্যাসের স্থান।

শাল-সুন্দি বেত  শাল অর্থ শালগাছ বা মূল্যবান কাঠ, সুন্দি এক প্রকারের বেত। প্রয়োজনীয় উপকরণ। কবিতায় রুপাইকে এমনই উপকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে।

জারি গান — শোকগীতি; কারবালার শোকাবহ ঘটনামূলক গাথা।

পাগাল — ইস্পাত । পাগাল লোহা বলতে ইস্পাতসম কঠিন লোহাকে বোঝানো হয়েছে।

Content added || updated By

এ কবিতা পাঠ করে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রকৃতিকে ভালোবাসতে পারবে। তারা গ্রামীণ সৌন্দর্য সম্পর্কেও অবহিত হবে। সর্বোপরি শিক্ষার্থীরা প্রকৃতির পটভূমিতে গ্রামীণ কৃষকের শৈল্পিক রূপ অনুধাবন করতে পারবে।

Content added || updated By

কবি জসীমউদ্দীন রচিত 'নক্সী কাঁথার মাঠ' নামক কাহিনিকাব্যের এ অংশটুকু ‘রুপাই' কবিতা নামে সংকলিত হয়েছে। এ কবিতায় কবি গ্রামবাংলার প্রকৃতি, কৃষকের রূপ ও কর্মোদ্যোগ অসাধারণ ভাষায় প্রকাশ করেছেন। গ্রামবাংলার প্রকৃতির মধ্যে কালো ভ্রমর, রঙিন ফুল, কাঁচা ধানের পাতা এবং কচি মুখের মায়াবী কৃষককে প্রায়শই দেখতে পাওয়া যায়। কৃষকের বাহু লাউয়ের কচি ডগার মতো বলে মনে হয়। রোদে পুড়ে কৃষকের শরীরের রং কালো হয়ে যায়। এ কালো কালি দিয়েই পৃথিবীর সমস্ত কেতাব বা গ্ৰন্থ লেখা হয়ে থাকে। অর্থাৎ কবির মতে, কৃষকের শ্রমেই সভ্যতার ইতিহাস সৃষ্টি হয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব কিছুই কৃষকের কালো। আর এ কালো কৃষকই পৃথিবীর সবকিছু জয় করেছে। কালোকৃষকটি আখড়াতে বা জারির গানে যেমন দক্ষ তেমনি সকল কাজে পারদর্শী। তাই কবির দৃষ্টিতে এ কৃষক সবার কাছে দামি বলে গণ্য হয়েছে।

Content added By

কবি জসীমউদ্দীন ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ. পাশ করেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি পাঁচ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। পরে তিনি সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগে উচ্চপদে যোগ দেন। ছাত্রজীবনেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন তাঁর লেখা ‘কবর' কবিতাটি বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। তাঁর কবিতায় পল্লির মানুষ ও প্রকৃতির সহজ- সুন্দর রূপটি দেখতে পাওয়া যায়। পল্লির মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর কবিহৃদয় যেন এক হয়ে মিশে আছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাহিনিকাব্য : 'নক্সী কাঁথার মাঠ', 'সোজন বাদিয়ার ঘাট'; কাব্যগ্রন্থ : 'রাখালী', ‘বালুচর', ‘মাটির কান্না’; নাটক : 'বেদের মেয়ে’; উপন্যাস : 'বোবা কাহিনী' ; গানের সংকলন : ‘রঙিলা নায়ের মাঝি'। তাঁর শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : ‘হাসু’, ‘এক পয়সার বাঁশী’, ‘ডালিমকুমার’। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি এবং বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক পেয়েছেন । ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

Content added || updated By

ক. ‘রুপাই' কবিতা অবলম্বনে একজন গ্রামীণ কৃষকের চরিত্রে অভিনয় করে দেখাও (একক কাজ)।
খ. তোমাদের সংগৃহীত গ্রামীণ ছড়া বা লোকছড়া শ্রেণিতে প্রদর্শনের আয়োজন করো (দলগত কাজ)।

Content added || updated By
Please, contribute to add content into বহুনির্বাচনি প্রশ্ন.
Content
কাঁচা ধানের পাতা
জালি লাউয়ের ডগা
শাওন মাসের তমাল তরু
কচি ধানের চারা
কাঁচা ধানের পাতার মতো কচিমুখের মায়া
তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া
জালি লাউয়ের ডগার মতো বাহু দুখান সরু
কচিধানের তুলতে চারা হয়ত কোনো চাষি
Please, contribute to add content into সৃজনশীল প্রশ্ন.
Content