সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - শিল্প ও সংস্কৃতি - NCTB BOOK

বছর শেষে আসে আমাদের প্রিয় বিজয়ের মাস। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর আমরা পেয়েছি বিজয়। শুধু যে অস্ত্র হাতেই এই দেশের মানুষ যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে তা নয়। কিছু ব্যক্তি ছিলেন যারা তাদের শিল্পকেই বানিয়েছিলেন যুদ্ধের হাতিয়ার। অস্ত্র নয় শিল্পই ছিল তাদের সংগ্রামের মাধ্যম। একদল সাংস্কৃতিক কর্মী বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা নামে দল গঠন করে সীমান্ত এলাকায়, ট্রেনিং ক্যাম্পে, শরণার্থী শিবিরে ও সুযোগ হলে মাঠে প্রান্তরে গান গেয়ে সবার মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। তাদের সেই প্রেরণামুলক অবদান নিয়ে পরবর্তীতে তৈরি হয় একটি প্রামান্য চিত্র: ‘মুক্তির গান’।

এমনই আরেকটি সংগ্রামের হাতিয়ার ছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র'। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানের সৈন্যদের হাতে সকল রেডিও স্টেশন চলে যায়। চট্টগ্রামের কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্রটিকে বেতার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন কয়েকজন নেতা। এর নাম দেওয়া হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র।”

১৯৭১ সালের ২৮ শে মার্চ ‘বিপ্লবী' শব্দটি বাদ দিয়ে নামকরণ করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। ১৯৭১ সালের ৩০ শে মার্চ হানাদার বাহিনীর বোমা বর্ষণের ফলে বেতার কেন্দ্রটি নষ্ট হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ২৫ মে কোলকাতার বালিগঞ্জে বেতার কেন্দ্রটি ২য় পর্যায়ে সম্প্রচার শুরু হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তখন দেশাত্মবোধক গান প্রচারিত হতো, আরও কিছু অনুষ্ঠান হতো যার মধ্যে একটি হলো- চরমপত্র। শুধু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমেই নয় বরং তৎকালীন শিল্পীরা তাদের বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে গেছেন। আমরা তাদের অবদানকেও স্মরণ করব।

মনে রাখতে হবে, শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যম যে শুধু আমাদের মনের ভাষা, আবেগ অনুভূতি প্রকাশের বাহন তা নয় বরং আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক। আবার কখনও হতে পারে আমাদের প্রতিবাদের ভাষা।

যা করব— 

■ মুক্তিযুদ্ধের উপর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন বই, পত্রিকা, গল্প, ছবি, দেখে, শুনে, পড়ে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যে ধারণাও অনুভুতি লাভ করব। 

■ বিভিন্ন মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে শিল্পীদের অবদান সম্পর্কে জানব। 

■ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। 

■ মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত বই, পত্রিকা, গল্প, ছবি, দেখে, শুনে, পড়ে তার আলোকে নিজের অনুভুতি প্রকাশের জন্য আঁকা, গড়া, লেখার চেষ্টা করব। 

■ মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত গান শুনব, গানের সাথে ভঙ্গির মাধ্যমে স্বাধীনভাবে আনুভুতি প্রকাশের আনুশীলন করব। 

■ এই পাঠের শেষে আমরা একটি বাৎসরিক প্রদর্শনীর আয়োজন করব।

বছর জুড়ে অনেক কিছু করেছি যার মাধ্যমে নিজের এলাকার অনেক বিষয়/আচার অনুষ্ঠান/শিল্পকর্ম/ সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে খুঁজে পেয়েছি। বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে ঠিক করে নিতে হবে যে আমাদের করা কোন কোন বিষয়/ আচার অনুষ্ঠান/ শিল্পকর্ম নিয়ে আমরা বাৎসরিক প্রদর্শনীর আয়োজন করব।

বাৎসরিক প্রদর্শনীতে উপস্থাপনের জন্য আমাদের আঁকা ছবি/গড়া/গাওয়া গান/নাচ/অভিনিত নাটক নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে দিকগুলো লক্ষ রাখতে হবে –

■ যা আমাদের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ধারণ করে। 

■ যা আমাদের লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করে। 

■ আমাদের কাজগুলোতে যেন সৃজনশীলতার ও নান্দনিকতার প্রকাশ থাকে। 

■ আমাদের জাতীয়তাবোধের প্রকাশ থাকে এমন কাজ/উপস্থাপনা নির্বাচন করতে হবে।

জহির রায়হান চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক, ফেনী জেলায় ১৯৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। 

ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রথম ১০ জন ছাত্রের একজন যাঁরা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই ধরনের কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও মিছিলে বের হন। তাকে এবং আরও অনেককে গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় ।

ছাত্রজীবনে জহির সাহিত্যে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর প্রথম বই ‘সূর্যগ্রহণ'। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য বই হল – হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী ও আর কটা দিন। তার ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটির জন্য তিনি আদমজী সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন।

তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি ‘কখনো আসেনি’ ১৯৬১ সালে মুক্তি পায়। তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম রঙিন সিনেমা ‘সঙ্গম' নির্মাণ করেন। তারপর একের পর এক আসে- সোনার কাজল, কাঁচের দেয়াল, বেহুলা, জীবন থেকে নেয়া, আনোয়ারা এবং বাহানা। ‘জীবন থেকে নেয়া’ পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনের চিত্র তুলে ধরেন এবং জনগণকে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে তুলে ধরে একটি তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড' নির্মাণ করেন। এই তথ্যচিত্রটি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ‘আ স্টেট ইজ বর্ন' তার তৈরী আরেকটি তথ্যচিত্র।

১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তাঁর বড় ভাই বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারকে ঢাকার মিরপুরে খুঁজতে গিয়ে তিনি আর কখনই ফিরে আসেননি। দিনটি জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস হিসাবে পালন করা হয়।

যা করব— 

■ শহিদ বুদ্ধিজীবি জহির রায়হানের শিল্পকর্ম সম্পর্কে আমরা আরো জানার চেষ্টা করব।

 

Content added By