নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - চারু ও কারুকলা - NCTB BOOK

পাঠ : ১, ২, ৩, ৪, ৫ ও ৬

লোকায়ত বাংলার জীবন ও সংস্কৃতি

লোকজীবন হলো মানুষের জীবন। সেই মানুষ যখন বাঙালি অর্থাৎ যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি এবং বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছি, স্থায়ীভাবেই বাংলাদেশ নামক অঞ্চলে বসবাস করছি তাদের জীবনযাপনে স্বাভাবিকভাবে কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য হলো চারু ও কারুকলার ব্যবহার ও অন্যান্য সংস্কৃতি। তবে অঞ্চলতিত্তিক লোকজীবনে কিছু ভিন্ন ভিন্ন রূপ রয়েছে। যেমন- গ্রামের জীবনযাপনে এবং শহরের জীবনযাপনে বৈপরিত্য রয়েছে। আবার গ্রামের জীবনযাপন ও প্রাকৃতিক পরিবেশগত কারণে পোশাক-পরিচ্ছদে বিভিন্নতা, ঘরবাড়ি তৈরিতে বিভিন্নতা, চাষবাস ইত্যাদিতে বিভিন্নতা লক্ষ করা যায়। আবার মিলও আছে অনেক। আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজীবনেও চারু ও কারুকলার ব্যবহার অনেক। কিছু উদাহরণ উল্লেখ করলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। শহরের ঘরবাড়ি বেশিরভাগই ইট, লোহা ও কাঠের তৈরি। আজকাল যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আসবাবপত্র এবং বসবাসের অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো একটির সঙ্গে আরেকটির সামঞ্জস্য করে তৈরি করা হয়। খাওয়া দাওয়ার টেবিল, চেয়ার, খাট, পালং, আলমারি, পোশাক-পরিচ্ছন রাখার আলমারি, বই রাখার আলমারি, সোফাসেট, দরজা, জানালা সর্বত্রই চারু ও কারুকলার প্রতিফলন ঘটানো হয়। নানারকম নকশা করে এসব আবাসিক কন্তুসামগ্রীর শিল্পরূপ দেয়া হয়। কাঠের দরজা, জানালা ও ঘাট-পালং-এ কারুশিল্পীরা খোদাই করে ফুল, পাখি, লতাপাতা ইত্যাদি বিষয়ের চিত্র ফুটিয়ে তোলেন। আবার কিছু দরজা ও অন্যান্য আসবাবে জ্যামিতিক নকশা ও রেখার সমন্বয়ে শিল্পরূপ দেয়া হয়। দরজা-জানালায় যে সব পর্দা টাঙানো হয় তার রং, নকশার ছাপ, লতাপাতা ও প্রাকৃতিক দৃশ্য চারু ও কারুশিল্পীরাই ফুটিয়ে তোলেন। কখনো তাঁতি বুননের মাধ্যমে কখনো কারুশিল্পী নানারকম কাঠ ও রাবারের ব্লক তৈরি করে ছাপ তুলে তা করে থাকেন। বাড়িঘরের অন্যান্য সাজসজ্জায় সর্বত্রই চারু ও কারুশিল্পীদের কাজ ব্যবহার করা হয়। যেমন- চিত্রিত কাঠের ঘোড়া, হাতি, বর-কনে, পেঁচা, পাখি ইত্যাদি। টেরাকোটা ফলক, পোড়ামাটির ছোট বড় টেপা পুতুল, হাতি, ঘোড়া মানুষসহ পোড়ামাটির ফুলদানি, নানা আকার ও আকৃতির পাত্র, শখের হাঁড়ি, লক্ষ্মীসরা, পাটের শিকা, থলে ও অন্যান্য কারুশিল্প নকশিকাঁথা ইত্যাদি। এসব শিল্পকর্ম বেশিরভাগই বাংলার গ্রাম অঞ্চলের মানুষেরা করে থাকে। কিছু তৈরি হয় চারু ও কারুকলা চর্চার স্বাভাবিক কারণে ও স্বভাবগত অভ্যাসে। আমরা এসব শিল্পকে তাই নাম দিয়েছি লোকশিল্প। আবার জীবনযাপনের প্রয়োজনে বাঁশ, বেত, পাট ইত্যাদি উপকরণে এবং মাটির হাঁড়ি-পাতিল যারা বানান লোহা, পিতল, কাঁসার বিভিন্ন ব্যবহারিক কস্তুসামগ্রী যারা তৈরি করেন (দা, কুড়াল, গাগুল, কোনাল, থালাবাটি, কলসি ইত্যাদি) তাঁদের নাম কারুশিল্পী। বর্তমানে লোকশিল্প ও কারুশিল্পের বিশেষ কিছু বস্তুসামগ্রী বাণিজ্যিকভাবে দেশে-বিদেশে বিস্তারের জন্য শহরে বিশেষ ব্যবস্থায় তৈরি হয়ে থাকে।

প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত চিত্রশিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্ম দেয়ালে টাঙিয়ে এবং ভাস্করদের তৈরি সিমেন্ট, পাথর, ব্রোঞ্জ ও কাঠের ছোট ভাস্কর্য সাজিয়ে চারু ও কারুশিল্পকে সুন্দর জীবনযাপনে প্রয়োজনীয় করে তোলা হচ্ছে। গ্রাম গ্রামের ঘরবাড়ির আনল শহর থেকে যথেষ্ট ভিন্ন। পেশাগত ও অর্থনৈতিক কারণে গ্রামের ঘরবাড়ি তৈরি হয় মাটি, কাঠ, টিন, ছন, পাটখড়ি, খড়, গোলপাতা, নারকেলপাতা ইত্যাদি দিয়ে। গ্রামের কৃষিজীবী মানুষ, জেলে, মাঝি, কামার, কুমার তাঁরাই নিজেদের প্রয়োজনমতো এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেদের বসবাস উপযোগী ঘরবাড়ি তৈরি করেন। নিজেরা স্থাপত্যকলায় পারদর্শী না হলেও স্বাভাবিক চিন্তায় এসব ঘরবাড়িতে গ্রামের পেশাজীবী মানুষদেরশিল্পবোধের ও সৌন্দর্যের পরিচয় পাওয়া যায়। দোচালা ঘর, চৌচালা ও আটচালা ঘরবাড়িতে বাশ, বেত ও কাঠের নানারকম শিল্পকর্মের মাধ্যমে চারু ও কারুকলার প্রকাশ ঘটে। ঝড়, বন্যা, ইত্যকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আজকাল গ্রামেও ইটের ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে। দালানকোঠা হলেও শহরের মতো না হয়ে গ্রামীণ প্রাকৃতিক পরিবেশকে মনে রেখে সেগুলো তৈরি হয়।
গ্রামের লোকজীবনে যেসব পেশা রয়েছে- তাদের জীবনযাপনে যেসব বস্তুসামগ্রী প্রয়োজন হয় তাতে কম বেশি চারু ও কারুশিল্পের প্রয়োগ দেখা যায়। এসব কস্তুসামগ্রী শহুরে জীবনেও কিছু কিছু ব্যবহার হয়ে থাকে। যা আগে উল্লেখ করেছি। যেমন না, কুড়াল, কোদাল, কাস্তে, খণ্ডা, লাঙল, জোয়াল, মই এগুলো কামারেরা লোহা পিটিয়ে তৈরি করে। জোয়াল ও মই অবশ্য কাঠ ও বাশের তৈরি। বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় ছোট বড় নানা আকৃতির টুকরি, কুলা, থাকা, খালুই, মাছ ধরার চাই। মাছ ধরার চাই তৈরিতে চারু ও কারুকলার প্রকাশ বেশ সুন্দর। কারুশিল্পের উন্নত নিদর্শন হিসেবে চাই সমাদর পেয়ে এসেছে। মুর্তা গাছের বাকল দিয়ে তৈরি হয় শীতলপাটি। পাটিতেও কারুশিল্পীরা বুনটের মাধ্যমে নকশা ও চিত্র ফুটিয়ে তোলেন।

বাংলাদেশের আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন অঞ্চলে। রাজশাহী, দিনাজপুর অঞ্চলে রয়েছে সাঁওতাল, ওঁরাও ও রাজবংশীরা ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুরে বসবাস করে গারো ও কোচ। খাসিয়া, মনিপুরী, ত্রিপুরারা বাস করে সিলেট অঞ্চলে। বরিশালে বাস করে রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ। পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে রয়েছে অনেক আদিবাসীদের বসবাস। এরা হলো- চাকমা, মারমা, শুনেছলা, বম, বোমা, ত্রিপুরাসহ আরো অনেক। এরা উঁচু নিচু পাহাড়ে ও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করে। পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এরা নিজেদের বসবাসের ঘর তৈরি করে। যা স্থাপত্য ও কারুশিল্পের সুন্দর প্রকাশ। এরা চাষবাস করে ঢালু পাহাড়ের গায়ে। চাষের পদ্ধতির নাম জুম চাষ। নিজেরাই বিশেষ করে মেয়েরা ঘরে বসে তাঁতে নিজেদের পরিধেয় পোশাক তৈরি করে। আদিবাসীদের লোকজীবনে সর্বত্রই চারু ও কারুকলার প্রকাশ বিদ্যমান।

বাংলাদেশে চারু ও কারুকলার চর্চা বিভিন্ন শিল্পবস্তু তৈরি এবং শৈল্পিক কস্তুসামগ্রীর ব্যবহার লোকায়ত অর্থাৎ জীবনযাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালিরা চারু ও কারুশিল্পীদের তৈরি করা কন্তুসামগ্রী জাতি, ধর্ম ও গোত্র নির্বিশেষে সবাই ব্যবহার করে এসেছে। সব ধর্মের মানুষই শিল্পকর্ম তৈরি করে থাকে।

বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। সাধারণ মানুষ অসাম্প্রদায়িক। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ধর্মের মানুষ পাশাপাশি একই সঙ্গে বসবাস করার ঐতিহ্য দীর্ঘকালের। একে অপরের কাজে সহযোগী। ভাগাভাগি করে অনেক কাজই সমাধা করে বিভিন্ন ধর্মের প্রধানরা। একজন হিন্দু কামারের তৈরি-দা, কুড়াল, খন্তা, কাঁচি ইত্যাদি মুসলমান, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধরা নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে। একজন কুমার যে হিন্দু ধর্মের মানুষ, তাঁর তৈরি মাটির হাঁড়ি-পাতিলে রান্না করে খেতে মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মের মানুষের কোনো আপত্তি নেই। তাঁর তৈরি মাটির কলসি থেকে সবাই আনন্দের সঙ্গেই পানি পান করে।

আদিবাসী মেয়েরা তাতে তাদের সুন্দর পোশাকের কাপড় বুনে নেয়। রং, নকশায় ও বৈচিত্র্যে আনিবাসীদের তৈরি কাপড় ও পোশাক সমতলের সব ধর্মের মানুষদের কাছেই আকর্ষণীয়। বিশেষ করে তাদের তৈরি চাদরের কদর সারা বাংলাদেশে। সেই চাদর গায়ে জড়িয়ে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সব লোকই সমান আরাম পায় এবং ঠাণ্ডা থেকে সমানভাবেই রেহাই পায়। সোনা, রুপার অলঙ্কারে নিখুঁতভাবে নকশা খোদাই করার কাজে বাংলাদেশের কারুশিল্পীরাখ্যাতি অর্জন করেছে। সবধর্মের মানুষের মধ্যেই অনকার শিল্পের কারিগর বা কারুশিল্পী রয়েছে। একজন মানুষ অনেক খুঁজে ও অনেক বেছে তার পছন্দের অলঙ্কারটি সংগ্রহ করে। তার পছন্দ, রুচি ও শিল্পবোধই তাকে বাছাই করতে সাহায্য করে। তার বাছাই করা অলঙ্কারের নিখুঁত নকশা খোদাই ও সুন্দর কারুকাজের জন্য তিনি অলঙ্কার শিল্পীকে সম্মান দেখান প্রশংসা করেন। শিল্পের জন্যই তিনি কারিগরকে প্রশংসা করেন। অন্য কোনো কারণে নয়। বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি উৎসব হয়ে থাকে। যেমন- মুসলমানদের ঈদ উৎসব, হিন্দুদের দুর্গাপূজা, বৌদ্ধদের বুদ্ধপূর্ণিমা, খ্রিষ্টানদের বড়দিন। ধর্মভিত্তিক হলেও অন্যান্য ধর্মের মানুষ নানাভাবে সেই উৎসবে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের প্রায় ৯৯ ভাগ মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলে। আনিবাসীদের নিজস্ব ভাষা আছে। তা সত্ত্বেও তারা বাংলা ভাষায়ও কথা বলে। এই বাংলাভাষার কারণে আমাদের সাহিত্য, গান, নাটক, যাত্রাপালা এবং অন্যান্য সংস্কৃতি লোকায়ত
বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিরাজমান। সব ধর্মের মানুষদের মধ্যেই তা বিস্তৃত। চারু ও কারুকলা বিষয়টিও সমানভাবে লোকায়ত।

স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বাঙালিরা একতাবদ্ধ হয়ে ২৩ বছর ধরে সপ্তগ্রাম করেছে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য। বাঙালিরা বাংলাভাষা, চিরায়ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও লোকায়ত বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে দিয়ে সেখানে বিজাতীয় ভাষা, পাকিস্তানি উদ্ভট সংস্কৃতি তথা ধর্মের দোহাই দিয়ে সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা জোরজুলুম করে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পূর্ব বাংলার বাঙালিরা এক হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭১ সালে সামান্য যুদ্ধার নিয়েই পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। নয় মাস যুদ্ধ করে বিপুল অস্ত্রসসের সজ্জিত শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাদের পরাস্ত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। বাঙালির লোকায়ত বৈশিষ্ট্যও ভাষা, সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতির মিলিত চেতনাই ছিল প্রধান মানসিক শক্তি ও মনোবল।

দীর্ঘকাল ধরে বাঙালিরা বাংলা নববর্ষ ১লা বৈশাখকে অনেক ঘটা করে পালন করে এসেছে। পহেলা বৈশাখ এখন বাংলাদেশে সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব। শহরে, গ্রামে সর্বত্র এই উৎসব ও মেলা বেশ কিছুদিন ধরে চলতে থাকে। পহেলা বৈশাখের উৎসব অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি দুই-তিন মাস আগে থেকেই চলতে থাকে। চুলিরা তাদের দল গঠন করে, শিশুদের আনন্দের খেলা বুলন্ত চেয়ার ঘূর্ণি, যাত্রাপালা, নাচ, গান অভিনয় মঞ্চে নিজেদের তৈরি করে। অন্যদিকে কুমার তাদের ঢাকার নানারকম মাটির পাত্র তৈরি করে পুড়িয়ে নেয়, শখের হাঁড়ি, লক্ষ্মীসরা, কাঠ ও বাঁশের অনেক কারুশিল্প ও খেলনা তৈরি হয় মেলার জন্য। যেমন- রঙিন হাতি, ঘোড়া, বর-কনে, একতারা, দোতরা, তবলা, ছোট-বড় অসংখ্য ঢোল, বাঁশের বাশি নানারকম খেলনা ইত্যাদি। গ্রামীণ জীবনকে বিষয় করে চারুশিল্পীদের আঁকা নানারকম পট (চিত্র) গাজীরপট খুবই বিখ্যাত চারুশিল্প।

ঢাকা শহরে বাংলা নববর্ষকে প্রথম আহ্বান জানানো হয় রমনার সবুজ চতুরের বটতলায়। পহেলা বৈশাখে সূর্য ওঠার আগে লক্ষ মানুষের সমাবেশ ঘটে এই বটমূলে। শিশু, মহিলা, তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের মানুষ নতুন নতুন পোশাকে সুন্দর সব সাজে অপেক্ষা করে কখন নতুন বছরের সূর্য উঠবে। শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চার শক্তিশালী ভিত্তি দাঁড়ানো প্রতিষ্ঠান ছায়ানট প্রতিবছর আয়োজন করে এই উৎসরে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা গেয়ে ওঠে- এসো হে বৈশাখ এসো এসো....

ছায়ানটের শিল্পীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলায় হাজার হাজার কন্ঠ-না লক্ষ কণ্ঠ। একের পর এক গান চলতে থাকে মানুষের প্রাণের গান, ভালোবাসার গান, উদ্দীপনার গান, বেঁচে থাকার গান। প্রাণ ভরে উপভোগ করে ছায়ানটের এই বিশাল আবেদন বিশাল আয়োজন।

শহেলা বৈশাখের প্রভাত সূর্যকে আহ্বান জানিয়ে আরো কিছু  প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠান ও উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এরা হলো ঋষিজ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, উদীচী, রবিরাগ, সুরের ধারা সহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান।কা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে প্রতিবছর আয়োজন করা হয় বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বিশাল শোভাযাত্রা (মাল শোভাযাত্রা। স্থলীনের গোলের ভালে ভালে নাচকে মাচতে আনন্দ-উল্লাসে এগুতে থাকে শোভাযাত্রা। চারু ও কারুশিল্পীরা তৈরি করে লোকশিল্পের আনলে বিভিন্ন সব ভাস্কর্য। হাতি, ঘোড়া, কুমির, পেঁচা, সাপ, মোরগ, মাছ, ফুল, পাখিসহ অনেক কিছু। বিশাল আকারে তৈরি হয় লোকশিল্পের এই ভাস্কর্য-বী কিছু গাছে কুটিন, গোতা, আলবদর, রাজাকারদের মা, কিছু পাছে-ভালো, সৎ মানুষের - যারা মানুষের চার। চারু ও কারুশিল্পীদের এই বর্ণাঢ্য বাংলা নববর্ষের শোভাযাত্রা দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মানুষের কাছে সমাদৃত। বাংলা নববর্ষের উৎসব - শহরে নিয়ে শাণিত হচ্ছে।

লোকারক ও সর্বজন গ্রাহ্য না হলে একুশে চেতনার উপস্থাপন। ভাষাশহিদদের প্রতি প্রন্থা ও সম্মান জানাবার প্রতীকী খালি পায়ে প্রভাতফেরি, রাস্তায় ও শহিদমিনার লেপনা আঁকা। এই আঁকে, আলপনা আঁকা রাস্তায় খালি পারে মানুষ হেঁটে যায় ফুল হাতে শহিদমিনারের দিকে কণ্ঠে থাকে প্রন্থা ৩ ভালোবাসার গান- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।২৬শে মার্চ ১৯৭১, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেই দিন থেকেই বাঙালিরা জসর হাতে তুলে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশকে স্বাধীন করে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। এই দুটো দিনকে বাঙালি জাতি আনন্দ উল্লাসে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের মরণ করে উৎসব করে।

বাংলাদেশের সর্বত্র অনেক নদী। এই নদীকে ঘিরে যে উৎসব হয় তা হলো নৌকাবাইচ। কারুশিল্পীরা সুন্দর ও চমৎকার সব আদলে ও নকশায় কাঠের নাও তৈরি করে। নৌকাবাইচ উৎসবের সঙ্গে রয়েছে-তালের গান, ঢোল, বাঁশি ইত্যাদি। লোকায়ত বাংলার জীবন ও সংস্কৃতিতে উল্লেখিত উৎসব ও আনন্দ অনুষ্ঠানগুলো (পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব, বসন্ত উৎসব, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, নৌকাবাইচ) বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই উৎসবগুলোর মাধ্যমে অন্যান্য সাংস্কৃতিক বিষয়ের সঙ্গে সমন্বর করে চারু ও কারুকলার প্রকাশ ও বিকাশ ঘটে থাকে।

পাঠ : ৭, ৮, ৯, ১০

পেশাগত জীবনে চারু ও কারুকলার প্রয়োগ

লোকশিল্প বলতে আমরা যে শিল্পকলাকে চিহ্নিত করি তা আমাদের গ্রামগঞ্জের শিল্পীরা একসময় যথাযথ পেশা হিসেবে বিচার করত না। যেমন নকশিকাঁথা গ্রামের মেয়েদের সুখ-দুঃখের কাহিনী বা অন্য কোনো গল্প সে মনের মাধুরী মিশিয়ে রঙিন সুতো ও সুচ দিয়ে দিনের পর দিন সময় নিয়ে কাঁথায় ফুটিয়ে তুলত। এক-একটি সময় ঠিক করে সে নকশিকাঁথা নিয়ে কলত। এই কাঁথা বিক্রি করা তার পেশা ছিল না। নিজের জন্য বা কোনো প্রিয় মানুষের জন্যই সে তৈরি করত।

একইভাবে শখের হাঁড়ি, টেরাকোটা, টেপা পুতুল ও পাটের শিকা, হাতপাখা ইত্যাদি নিজেদের আনন্দেই শিল্পীরা করত। ধীরে ধীরে লোকজীবনে এসব শিল্পের কার বাড়তে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে বাংলার অনেক লোকশিল্প ও কারুশিল্পের সঙ্গে মিশ্রিত রূপ নেয়। নকশিকাঁথার জনপ্রিয়তা এখন দেশে ও বিদেশে সর্বা। তাই নকশিকাঁথাকে কো করে কিছু পেশাজীবী শিল্পী তৈরি হয়েছে।এদের মধ্যে গ্রামের মেয়েরা যেমন আছে তেমনি শহরের মেয়েরাও রয়েছে। এমন কী চারুকলা থেকে গান করা শিল্পীরাও নকশিকাঁথা তৈরি করাকে শিল্পকর্মের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। গ্রামীণ জীবনে কামার, কুমার, তাঁতি এরা কারুশিল্পে পেশাজীবী। বাশ, কাঠ, খড়, পাতা ও পাট দিয়ে নানারকম খেলনা, শখের জিনিস এমন কী লোকজীবনে ব্যবহারের অনেক বস্তুসামগ্রী তৈরিতে স্বশিক্ষিত শিল্পী এবং চারুকলার শিক্ষাপ্রাপ্ত শিল্পীরা পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। নতুন নতুন ডিজাইনে ও চিত্র বিচিত্র সাজসজ্জায় পোশাকশিল্পকে অনেক আধুনিক আকর্ষণীয় করে তুলেছে চারুকলার শিল্পীরা। যা দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও সুনাম অর্জন করেছে। বাংলাদেশ নামক অঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলার চর্চার শুরুতে (৫০-৬০এর দশক) চারু ও কারুশিল্পীদের জন্য পেশা হিসেবে তেমন কোনো কাজ লোকজজীবনে অনুভূত হতো না। দিনের পর দিন চারুশিল্পীরাও সংস্কৃতি জগৎ-এর মানুষেরা চিত্রকলার প্রয়োজনীয়তা, কারুশিল্পের গুরুত্ব সমাজকে বুঝাতে পেরেছে। একটি উন্নত সমাজে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী এমনি পেশার মানুষ যেমন প্রয়োজন, পাশাপাশি প্রয়োজন স্থপতির, চিত্রশিল্পীর এবং সংস্কৃতির মানুষের। পেশাগতভাবে চারু ও কারুশিল্পীরা বর্তমানে অনেক এগিয়ে রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই চারু ও কারুকলা বিষয়টি শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে চারু ও কারুকলার অনেক শিক্ষক। ৪টি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রয়েছে চারুকলা বিষয়ের বিশাল আকারের অনুষদ ও বিভাগ। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রয়েছে চারু ও কারুকলা শিক্ষার বিভাগ। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে চারুকলা চর্চার। নিম্নপর্যায় থেকে শিক্ষার একেবারে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত চারু ও কারুকলায় বহু শিল্পী শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত।

বাংলাদেশের চারু ও কারুশিল্পে সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটেছে অনেক আগে থেকেই। চিত্রশিল্পীদের থাকা ছবির সমাদর দেশে-বিদেশে ব্যাপৃত। সমাজে শিক্ষাবোধ ও সংস্কৃতি চেতনা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে। অনেক ব্যবসায়ী শিল্পকর্ম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ফলে সংস্কৃতিবানরা অর্থের বিনিময়ে ছবি সপ্তাহ করছেন। কারুশিল্পও সংগ্রহ করছেন। তাদের বসবাসের আবাসে চিত্র সাজাচ্ছেন, কারুশিল্প সাজাচ্ছেন, স্থাপন করছেন ভাস্কর্য। অফিস প্রতিষ্ঠানের চত্বরে ভাস্কর্যশিল্প প্রতিস্থাপন করে, প্রতিষ্ঠানের ভবনের দেয়ালে চারু ও কারুশিল্পীদের নিয়ে সৃজনশীল মুরাদশিল্প স্থাপন
করে প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীরা বিজ্ঞাপনী সংস্থার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। টেলিভিশন মাধ্যমে শিল্পীরা অনুষ্ঠানের পটভূমিকে চমৎকার নান্দনিকতায় তুলে ধরে প্রতিটি অনুষ্ঠান আনন্দময় ও সুখকর করে ভুলতে পারছে। সংবাদপত্রের জন্য চিত্রশিল্পী অবশ্যই প্রয়োজন। প্রয়োজন চলচ্চিত্রশিল্পে। বাণিজ্যিক ও শিল্প মেলায় শিল্পীরা চমৎকার আকার-আকৃতি ও নকশায় প্যাভিলিয়ন, গেট স্টল তৈরি ও অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা করে যাচ্ছেন। বাড়ি, অফিস, দোকান,
সুপার মার্কেটের অভ্যন্তরীণ নকশা, সাজসজ্জা চারু ও কারুশিল্পীরা নিপুণভাবে সমাধা করছে। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় চারু ও কারুশিল্পের প্রয়োজনীয়তা বিস্তৃতি ও প্রসার ঘটার কারণে পেশা হিসেবে শিল্পীর গুরুত্ব সমাজে তথা দেশে রুমে সমৃদ্ধির পথেই এগুচ্ছে। নিসংকোচে তরুণ প্রজন্য চারু ও কারুকলাকে পেশা হিসেবে আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করছে।

পাঠ ১১, ১২, ১৩ ও ১৪

লোকজীবনে সম্পৃক্ত বিভিন্ন শিল্পকর্ম

লোকজীবনে সম্পৃক্ত বিভিন্ন শিল্পকর্ম সম্পর্কে পূর্বের বিভিন্ন আলোচনায় প্রায় সর্বত্র বলা হয়েছে। শিল্পকর্মগুলোকে আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। ১. লোকশিল্প : পোড়ামাটির ছোট-বড় পুতুল, পোড়ামাটির ফলকচিত্র, কাঠের তৈরি হাতি, ঘোড়া, মানুষ, পাখি, নকশিকাথা, সরাচিত্র, মাটির রঙিন পুতুল, মাটির খেলনা, শীতলপাটি, শখের হাঁড়ি, গল্পের চিত্র, গাজীরপট ইত্যাদি।

২. কারুশিল্প না কুড়াল, কোনাল, পোড়ামাটির হাড়ি পাতিল, শানকি, বাটি, মাটির তৈরি ব্যাংক, মটকা ইত্যাদি। বাশের তৈরি টুকরি, খাঁচা, বাঁকা, ছোট বড় বাঁশি, হুঁকো, মাছ ধরার চাই, মাথা, ঘরবাড়ির জন্য নানারকম নকশা ইত্যাদি। কাসার থালা, ঘটি, পিতলের কলসি ইত্যাদি। সোনা, রূপার অলঙ্কার, তামার পাত্র। বাংলাদেশের কাঠের কারুশিল্প বেশ সমৃদ্ধ। ঘরের দরজা-জানালার কপাট, খাট, পালং ও আলমারির গায়ে ফুল-পাখির ছবি, লতাপাতা এমনকি লোকজীবনের দৃশ্য নিপুণভাবে কাঠ খোলাই করে রিলিফ শিল্পকর্মগুলো উন্নতমানের কারুশিল্প। বাংলাদেশের নদীতে ও সমুদ্রে চলাচলের ছোটবড় নানা অবয়বের নৌকা বাংলার কারুশিল্পীরা করে থাকেন।
বাঁশ, কাঠ, লোহা, টিনের পাত ও প্লাস্টিকের সমন্বয়ে তৈরি হয় যানবাহন রিকশা। রিকশার কারুকাজ সৌন্দর্যসৃষ্টি ও নান্দনিক রূপের জন্যে দেশে-বিদেশে নন্দিত। জাপান, বৃটেন, আমেরিকা: ও কানাডায় রিকশার কারুকাজের প্রদর্শনী হয়েছে। রিকশার পেছনে শিল্পীরা যে ছবি আঁকেন সেই চিত্রকলাও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা অর্জন করেছে।

লোকজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আধুনিক চিত্রকলা, নকশা, পোশাকশিল্প, সিরামিক শিল্প, ইন্টেরিয়র ডিজাইন, ভাস্কর্য, ম্যুরাল এবং স্থাপনা শিল্প।

বাঙালি লোকজীবনে চারু ও কারুকলা

বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীদের অনেক প্রদর্শনী হচ্ছে। ভাস্কর্যের ও আধুনিক কারুকলার প্রদর্শনী হচ্ছে। সংস্কৃতিবান রুচিশীল মানুষ ও শিল্পের সমঝদার মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। তাঁরা শিল্পকলা-তথা চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও অন্যান্য শিল্পকলা অর্থের বিনিময়েই সংগ্রহ করছেন। নিজেদের বাড়ি, ঘর, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজাচ্ছেন। শিল্প তাদের জীবনে আনন্দ বয়ে আনছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন পশুর চামড়া দিয়েও নানারকম কারুশিল্পের কাজ হচ্ছে। চামড়ার ব্যাগ, জুতা ও পোশাকের দেশে যেমন কদর বিদেশেও তেমনি।

Content added By