নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

পঞ্চদশ অধ্যায়

আমাদের মুক্তির পথ

 

প্রতিটি মানুষের জীবনে কিছু নির্ধারিত লক্ষ্য থাকে । এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তারা জীবন পথে এগিয়ে চলে। অনেকে লক্ষ্যচ্যুত বা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও বেশিরভাগ মানুষই লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়। যারা লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না তাদের জীবন অর্থহীন হয়ে যায় কিন্তু যারা লক্ষ্যের সন্ধান পেতে পারে তাদের জীবন হয় অর্থবহ । খ্রিষ্টভক্ত হিসেবে আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো অনন্ত জীবন লাভ করা ও স্বর্গে চিরকাল সুখী হওয়া । অনন্তকাল সুখী হওয়ার একমাত্র মাধ্যম হলেন যীশু খ্রিষ্ট। প্রভু যীশুই আমাদের মুক্তির পথ ও জীবনের পূর্ণতা । কারণ তিনিই পথ, সত্য ও জীবন । তাঁর মধ্য দিয়ে গেলে অনন্ত মুক্তির স্বাদ লাভ করা যায় ও পিতা ঈশ্বরের শ্রীমুখ দর্শনে চিরকাল সুখী হওয়া যায় ।

এই অধ্যায় শেষে আমরা-

  • জীবনের অর্থবহ লক্ষ্য অর্জনের আকাঙ্ক্ষা বর্ণনা করতে পারব;
  • সব সময় অর্থপূর্ণ জীবনের সন্ধান না পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারব;
  • খ্রিষ্টের দেখানো পথই আমাদের পথ, এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারব এবং
  • খ্রিষ্টের দেখানো পথে চলব ।

অর্থবহ লক্ষ্যের সন্ধানে

সন্তানদের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে পিতামাতা কথা ও ভাষা শিক্ষা দেন, ছড়া বা গান শিক্ষা দেন, বই কিনে দেন, ছবি আঁকতে শেখান, স্কুলে পাঠান । এসব কিছুর পিছনে কারণ কী? আমরাই বা কেন স্কুলে যাই ও পড়াশুনা করি? প্রথম দিকে হয়তো পিতামাতা আমাদেরকে স্কুলে পাঠিয়েছেন, তাই আমরা স্কুলে গিয়েছি । পরে আমরা বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি? তারই বা কারণ কী? হয়তো আমরা তা করেছি যেন ভালো ফল বা শ্রেণিকক্ষে ভালো স্থান পেতে পারি । এই পর্যায়ে এসে আমরা এখন কীভাবে এই কারণ বিশ্লেষণ করব? কেন আমরা স্কুলে যাই, পড়াশুনা করি, পরীক্ষা দেই এমনকি বিজ্ঞান, বাণিজ্য বা মানবিক শাখা বেছে নেই? এসব বিষয় আমাদের নিজেদেরই চিন্তা করে আবিষ্কার করা দরকার ।

আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, যার জীবনের লক্ষ্য নেই, তার বেঁচে থাকার অধিকারও নেই । প্রতিটি মানুষের জীবনে লক্ষ্য থাকা দরকার । সেই লক্ষ্য অনুসারে জীবন পথে এগিয়ে যাওয়া দরকার । যদি লক্ষ্য না থাকে তবে জীবন সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না। আবার জীবনের সঠিক সময়ে সঠিক লক্ষ্যটি নির্ধারণ করতে না পারলে জীবন হয় অর্থহীন । ফলে হতাশা এসে জীবনকে গ্রাস করবে ।

তাই জীবনে লক্ষ্য থাকা এবং সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা প্রত্যেকের দরকার । নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার, জীবন কী? জীবন কেন? আমি কে? আমি কার জন্য? আমি এখন কী করছি এবং ভবিষ্যতে কী করতে চাই? জীবন যদি সত্য হয়, তবে তার চেয়েও সত্য আর কী আছে? মৃত্যু কী? মৃত্যু কেন আসে? আমি চলে গেলে, পেছনে আমি কী রেখে যাব? মৃত্যুর পরে আমি কোথায় যাব? ইত্যাদি । এসব প্রশ্নের উত্তর যখন স্পষ্টভাবে চোখের সামনে ভেসে উঠবে তখনই সহজ হবে লক্ষ্য নির্ধারণ করে সেই মতো এগিয়ে চলা ।

 

 

একটি ঘটনা

প্রকাশ সবে মাত্র কলেজ শেষ করেছে । সে খুব ভালো ছাত্র এবং খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। জীবন পথের এই সন্ধিক্ষণে এসে সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে । সে ভাবছে, এখন সে কোন্ দিকে যাবে? কোন্ বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করবে ? তার ছোট বেলা থেকে ইচ্ছা ছিল, সে ডাক্তার হবে। অন্যদিকে তার বড় ভাই একজন ইঞ্জিনিয়ার । দাদার পেশাও প্রকাশের ভালো লাগে । সে এখন কী করবে, মনস্থির করতে পারছে না ।

একদিন প্রকাশ খেলার মাঠে পায়চারী করছে এমন সময় পিছন থেকে এক ব্যক্তি তার কাঁধে হাত রাখল । ঘাড় ফিরিয়ে প্রকাশ দেখল, তার কলেজের অধ্যক্ষ । সে এই সুযোগটি গ্রহণ করল এবং তার মনের অস্থিরতা অধ্যক্ষকে জানালো । প্রকাশ শিক্ষকের পরামর্শ গ্রহণ করল এবং সেইভাবে কাজ করল । আজ প্রকাশ একটি বড় হাসপাতালের বড় ডাক্তার ।

জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য মানুষ সময় ব্যয় করে, যেন যোগ্যতা ও দক্ষতাকে বৃদ্ধি করতে পারে । একইসাথে যেন চরিত্র ও বিবেককে গঠন করতে পারে । চরিত্র ও বিবেকের গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এর জন্য জ্ঞানচর্চা এবং সাধনা ও অনুশীলন করতে হয় । লক্ষ্য পূরণের জন্য বা লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য যা ভালো, মানুষ তারই সন্ধান করে, এই সন্ধান করার কাজ যতই কঠিন হোক না কেন । তাই সবাই স্কুলে যায়, পড়াশুনা করে, জ্ঞানচর্চা করে, পরীক্ষা লিখে এবং অজানাকে জানার অনুসন্ধান করে ।

এই অনুসন্ধানের পথে মানুষ যখন বাধার সম্মুখীন হয়, তখন যতক্ষণ এই বাধা উত্তরণের একটি সঠিক উত্তর খুঁজে না পায় ততক্ষণ তারা হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে । দিশাহারা হয়ে যায় । জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলে । তারা প্রয়োজনে অন্যের কাছে যায় যেন নির্দেশনা পায় । যারা আরও অভিজ্ঞ, যোগ্য, দক্ষতা সম্পন্ন মানুষ তাদের কাছে যায় । এই যাওয়া হতে পারে পরিবারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কিংবা কোনো গুরু বা অভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছে । এমনিভাবে জীবনের অর্থবহ লক্ষ্যের সবাই সন্ধান করে ।

 

কাজ: ১. তোমার নিজের আকাঙ্ক্ষা বা লক্ষ্য কী তা লেখ ।

কাজ: ২. এমন কী আকাঙ্ক্ষা আছে যা পূরণের মাধ্যমে চিরস্থায়ী সুখ ও আনন্দ পাওয়া যায়?

পূর্ণতার সন্ধানে ব্যর্থতার কারণ

জীবনের অনেক ক্ষেত্রে সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না । সকল অনুসন্ধান সার্থক হয় না । সকল সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় না । অনেক সময় ব্যর্থতা এসে সামনে দাঁড়ায়। ফলে লক্ষ্যে পৌঁছানো আর হয় না । ব্যক্তিগত জীবনে কিংবা পারিবারিক জীবনে এমন কি প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনেও পূর্ণতার সন্ধানে এরূপ ব্যর্থতা নেমে আসে । কোন একটি বিষয়ে যখন সাফল্য খুঁজে পাওয়া যায়, আমরা অনেক আনন্দ করি । মন তৃপ্তিতে ভরে যায় । পরক্ষণেই আরেকটি সাফল্যের চেষ্টা করি ।

আবার অনেক সময় আমাদের মুখের হাসি বিলীন হয়ে যায় । চোখে জল নেমে আসে । মন ভালো লাগে না । হতাশা নিরাশা দানা বাঁধে। পূর্ণতার সন্ধান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । ফলে জীবন নিরর্থক হয় । এই ব্যর্থতার কারণগুলো হয়তো সহজভাবে বোঝা যায় না । কারণগুলো খোঁজার জন্য এই প্রশ্নগুলো করতে পারি: আমাদের জীবনের কি সঠিক লক্ষ্য ছিল? সেই লক্ষ্যমতে আমরা কি চলেছি? আমাদের চরিত্র ও বিবেকের

 

 

গঠন কি যথাযথ হয়েছে? আমরা কি বিবেকের কথা শুনে চলেছি? আমরা কি সঠিক সময়ে সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম? সর্বোপরি, আমরা কি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করেছিলাম? না কি নিজের শক্তির ওপরই নির্ভর করে চলেছিলাম?

পবিত্র বাইবেলে আমরা দেখি,

যীশু যুবকটিকে বললেন, “যদি পূর্ণতা লাভ করতে চাও, তাহলে এখন যাও; তোমার যা-কিছু আছে, সবই বিক্রি করে দাও; আর সেই টাকাটা গরিবদের দিয়ে দাও; তাহলে স্বর্গে তোমার জন্য প্রচুর মহা সম্পদ সঞ্চিত থাকবে । তারপর আমার কাছে এসো আর আমার সঙ্গে সঙ্গে চল । এই কথা শুনে যুবকটি কেমন যেন বিষণ্ন হয়েই ফিরে গেল; কেন না তার নিজের প্রচুর সম্পত্তি ছিল ” (মথি ১৯:২১-২২)। যীশু যাদেরকে পূর্ণতা লাভের জন্য আহ্বান জানান, তাদের কাছ থেকে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ চান । কিন্তু মঙ্গলসমাচারের এই যুবকটির পূর্ণতার পথের বাধা ছিল তার নিজস্ব ধনসম্পদের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ । দ্বিতীয়ত, সমাজে ধনী হিসেবে তার একটা সামাজিক মর্যাদা ছিল । সম্পদ হারালে তার আর সেই মর্যাদা থাকবে না । এই আশংকা তার পথের বাধা হয়ে দাঁড়াল । যুবকটি যীশুর পরামর্শ চাইল ঠিকই, কিন্তু সেই পরামর্শ অনুসারে চলার মানসিকতা তার ছিল না । কাজেই পূর্ণতার পথে বাধা হতে পারে মানুষের স্বার্থপরতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতা ।

আমরা জানি, স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক মানুষ তার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নানাবিধ অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয় । এ ধরনের কাজের ফলে এই লোকদের জীবনে ব্যর্থতা অবশ্যই নেমে আসে । পূর্ণতার সন্ধানে তারা আর বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে না । জীবনের সঠিক দিক নির্দেশনা খুঁজে পায় না ।

কাজঃ কোন্ আকাঙ্ক্ষা-পূরণ ইতিবাচক সুখের জন্ম দেয় ও কোন রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় না এবং কোন্ আকাঙ্ক্ষা-পূরণ নেতিবাচক সুখ অর্থাৎ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী সুখের জন্ম দেয় তা দুইটি সারণিতে লেখ।

খ্রিষ্টের দেখানো পথ

পূর্ণতা লাভের জন্য খ্রিষ্টের দেখানো পথই হলো সর্বোত্তম ।

একবার দুইজন মেয়ের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল । তাদের একজন ছিল গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক ও অন্যজন ছিল কলেজ ছাত্রী । দুইজনকে পৃথকভাবে একই প্রশ্ন করা হয়েছিল। প্রশ্নটি ছিল: “ঈশ্বর যে আছেন তুমি কি তা বিশ্বাস কর”? দুইজনই উত্তর দিয়েছিল: “হ্যাঁ”। তাদের কাছে দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল “সৃষ্টিকর্তা দেখতে কেমন”? শ্রমিক মেয়েটির মনে তেমন উৎসাহের ভাব ছিল না। সেই মনোভাব নিয়েই সে উত্তর দিল, “আপনি হয়তো আমার উত্তরে সুখী হবেন না, কিন্তু আমি মনে করি ঈশ্বর মানুষকে খেলার সামগ্রী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন ।” আর কলেজ পড়ুয়া মেয়েটি একটু সময় নিয়ে উত্তর দিল । সে বলল, “আমার মনে হয় ঈশ্বর খুবই মহৎ, তিনি এই পৃথিবী ও মানুষকে অতি সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন ।”

শ্রমিক মেয়েটি ছিল একটি ভগ্ন পরিবারের সন্তান। তার বাবা ও মা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। আর কলেজ পড়ুয়া মেয়েটি বড় হয়েছে একটি ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার পিতামাতা, বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকদের ভালোবাসার পরিমণ্ডলে । এই দুইজন মেয়ের দেওয়া উত্তরের মধ্যে পার্থক্যের কারণ কী? এর কারণ হলো, আমরা সবাই আমাদের পারিপার্শ্বিক বাস্তব অবস্থা দ্বারা পরিচালিত । আমরা যে যেই

 

 

পরিবার ও পরিবেশে বড় হই, সে সেই পরিস্থিতি দ্বারা গঠিত, পরিচালিত কিংবা সক্রমিত হই । আমাদের চিন্তা, বুদ্ধি ও দর্শন অনেক সময় সেই পরিবেশের আলোকেই সৃষ্টি হয়ে থাকে ।

এই দুইজন মেয়ের মতো আমরাও কখনো কখনো নিজেদের হতাশার অনুভূতিতে আবার কখনো কখনো সুখের অনুভূতিতে সবকিছু দেখে থাকি । কারণ এই অনুভূতিগুলো আমাদের মধ্যে এতই প্রবল যে, সেগুলো আমাদের চিন্তার সাথে রং মিশিয়ে দিতে পারে এবং দৃষ্টিভঙ্গিও প্রভাবিত করতে পারে ।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা শুধুমাত্র আমাদের অনুভূতি দ্বারা নিজেদেরকে পরিচালিত হতে দিতে পারি না । কারণ বাস্তব জগতে আমরা দেখি: এমন কোন ব্যবসায়ী নেই যিনি কোন একটি প্রতিষ্ঠানকে শুধু ভালো লাগে বলেই সেই প্রতিষ্ঠানে তার নিজের মূল্যবান টাকাপয়সা বিনিয়োগ করবেন । তেমনিভাবে এমন কোন ডাক্তার নেই যিনি এই মুহূর্তে তার অনুভূতি ভালো আছে বলেই একজন রোগীর দেহে অপারেশন করতে চাইবেন।

সত্যিকার অর্থে আমাদের প্রত্যেককেই বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালিত হতে হয়। শুধু মনের ভাবুকতা আর অনুভূতির দ্বারা আমাদের পরিচালিত হওয়া ঠিক নয় । উপরে উল্লিখিত ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা বা অন্য কোনো পেশার বেলায় যা প্রযোজ্য অন্যান্য সবকিছুর বেলায়ও সেই একই বিষয় প্রযোজ্য । অর্থাৎ ব্যবসায়ী ও চিকিৎসকের মতো করে আমাদেরও অনুভূতির দ্বারা পরিচালিত না হয়ে বাস্তব অবস্থার ওপর নির্ভর করতে হবে ।

আসলে আমরা জীবনে সফল ও সুখী হতে এবং পুর্ণতা লাভ করতে পারবো না, যদি আমরা ঘটনার সত্যতা ও বাস্তবতা খুঁজে না পাই । আমাদের সকল সফলতা ও ব্যর্থতা, উন্নতি ও অবনতি, উজ্জ্বল ও অন্ধকার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে আমাদেরই ওপর । আমরা যে যেভাবে সত্যকে খুঁজি সে সেভাবেই পরিচালিত হই বাস্তবতা ও বিবেকের প্রয়োজনে ।

দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে মনোবিজ্ঞানী কার্ল ইয়ুং বলেছিলেন, “আমি আমার জীবনে যত মানুষের চিকিৎসা করেছি, তাদের মধ্যে একজনকেও খুঁজে পাইনি যার সব সমস্যার গোড়ায় ধর্মীয় সমস্যা ছিল না । . . .কাজেই তাদের চিকিৎসাও আমাকে ধর্মীয়ভাবেই করতে হয়েছে ।”

এই খ্যাতনামা মনোচিকিৎসক কেন ধর্মকে স্বাস্থ্যলাভের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে প্রাধান্য দিয়েছেন ? কারণটা খুবই স্পষ্ট । প্রতিটি ব্যক্তির জীবনের গভীরতম তলদেশে অবস্থিত যেসব সমস্যা, সেগুলো হচ্ছে তার জীবন, মৃত্যু, তার ভালো ও মন্দ অভিজ্ঞতা, ভালোবাসা ও ঘৃণা, কষ্টভোগ কেন্দ্রিক সমস্যা । এসব সমস্যার অর্থপূর্ণ উত্তর পাওয়া যায় ধর্ম থেকে । মানসিকভাবে সুস্থ থাকার লক্ষ্যে যেসব সমস্যার উৎপত্তি হয় সেগুলোর যথাযথ উত্তর শুধু মনোচিকিৎসাবিদ্যার বেলায় সম্ভব নয়। এসবের উত্তর পাওয়ার জন্য মানুষকে আরও গভীরে প্রবেশ করতে হবে। অর্থাৎ তার অন্তরাত্মায় প্রবেশ করে সেখানে ধর্মীয় দিক থেকে উত্তর সংগ্রহ করতে হবে ।

ধর্ম আমাদেরকে একটি বিষয় বোঝার জ্ঞান দিয়ে থাকে যে, আমাদের চারপাশের পরিবর্তনশীল অবস্থাগুলো হচ্ছে বিভিন্ন চিহ্ন । এই চিহ্নগুলো আমাদেরকে ‘কেন’ এবং ‘কীভাবে' প্রশ্নের উত্তর পেতে সাহায্য করে । এগুলো আমাদের কাছে ঈশ্বরের উপস্থিতি আর পরিকল্পনার কথা বলতে চায় ।

 

 

বিশ্বের আরও একজন খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানীর নাম হলো ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কল্ । তিনি ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে মার্চ অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ২রা সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন । তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের হাতে বন্দী হয়ে নাৎসী কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বহু কষ্টকর জীবন কাটিয়েছিলেন । তাঁর মতে ঐ বন্দী অবস্থা তাঁর জন্য ছিল পৃথিবীতে একটা জীবন্ত নরক । কারণ ওখানে বন্দীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হতো, তাদেরকে দিনের পর দিন না খাইয়ে রাখা হতো। এভাবে তাদের স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে গেলে একদিন তাদেরকে নিয়ে গ্যাসের চুলায় ঢুকিয়ে দেওয়া হতো । সেই জ্বলন্ত চুলার ভিতরেই ঐ অসহায় লোকগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত । ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কল্ বলেছেন, ঐ ক্যাম্পে যারা দৈহিকভাবে সুস্থ ছিল তারাই যে এই ভয়ানক যন্ত্রণাময় অবস্থা থেকে রেহাই পেত, তা নয় । বরং যাদের মনে বেঁচে থাকার কোন একটা উদ্দেশ্য থাকত, তারাই বেঁচে থাকতে পারত--সহজে রোগা হতো না আর তাদেরকে চুলার মধ্যে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হতো না । তাঁর এই ধারণা থেকেই তিনি পরবর্তীতে মানসিক চিকিৎসার জন্য একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন । এই পদ্ধতিটির নাম ছিল লোগোথেরাপি। এর মাধ্যমে মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিদেরকে তাদের জীবনের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে সাহায্য করার মাধ্যমে তাদের মানসিক রোগের চিকিৎসা করা হতো। তিনি বলতেন, যদি তোমার জীবনে ‘কেন’ কথার উত্তর পাও, তবে নিশ্চয়ই ‘কীভাবে’ প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে পাবে ।

সব জীবন ও সত্যের গভীরতম বাস্তবতা ও ভিত্তি হলেন স্বয়ং ঈশ্বর । তিনি আমাদেরকে সাহায্য করতে চান আমরা যেন সবকিছুর বাস্তব অবস্থা খুঁজে বের করতে পারি । তিনি এর জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছেন। প্রতিদিন আমরা যে অভিজ্ঞতা করি আর যা কিছু দেখি সেগুলো শুধু জাগতিক অভিজ্ঞতাই নয় বরং সেগুলো আমাদেরকে স্বয়ং ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ।

সবচেয়ে বড় চিহ্ন হলেন যীশু খ্রিষ্ট যিনি পৃথিবীতে এসে আমাদের কাছে প্রতিদিনকার এসব চিহ্নের অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন । এভাবে আমাদেরকে তিনি পথ দেখিয়ে ও পরিচালনা করে পিতার কাছে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন ।

খ্রিষ্টানুসারী হিসেবে আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য বিষয়টি হলো এই যে, ঈশ্বর আমাদের প্রেমময় পিতা। আমাদেরকে তিনি আহ্বান করেছেন তাঁর সন্তান হতে । যখন আমরা খাঁটি অন্তরে এই আহ্বানে সাড়া দেই তখন আমরা জীবনের গভীরতম অর্থেরও সন্ধান পেতে পারি । পিতাকে আমরা কীভাবে জানতে পারি? তাঁকে না জেনে তো আমরা তাঁকে ভালোবাসতে পারি না ।

ঈশ্বর আমাদের পিতৃপুরুষদের মধ্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে আমাদের কাছে জীবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সত্য প্রকাশ করেছেন: “প্রাচীনকালে পরমেশ্বর আমাদের পিতৃপুরুষদের কাছে বহুবার বহুরূপে কথা বলেছিলেন প্রবক্তাদের মুখ দিয়ে, কিন্তু শেষ যুগের এই দিনগুলোতে আমাদের কাছে তিনি কথা বললেন আপন পুত্রেরই মুখ দিয়ে, সেই তাঁরই মুখ দিয়ে, যাঁকে তিনি দিয়েছেন নিখিল বিশ্বের ওপর তাঁর আপন অধিকার । তাঁর দ্বারাই তিনি রচনা করেছেন বিশ্বচরাচর” (হিব্রু ১:১-২)।

 

 

যীশু বলেন, “আমিই পথ, সত্য ও জীবন” (যোহন ১৪:৬)। আমাদের মনে যত রকমের প্রশ্ন জাগে, সেসবের উত্তর লাভ করে পিতার কাছে যাবার পথ আমাদের দেখান যীশু নিজে । তিনি এর প্রমাণ দিয়েছেন তাঁরই নিজ জীবনে । এই পথ হলো ভালোবাসার পথ, ঈশ্বর ও মানুষকে ভালোবাসার পথ । যীশু খ্রিষ্ট নিজে এই পথ অবলম্বন করেছেন । তিনি মুত্যুর মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে পুনরুত্থান করেছেন, মানুষ হিসাবে তিনি পরিপূর্ণতা লাভ করেছেন, পিতার যোগ্য পুত্র হয়েছেন । তাঁকে অনুসরণ করলেই আমরা যে-কোন পথের মোড়ে এসে সঠিক পথের দিকনির্দেশনা পেতে পারব । কারণ তিনিই সত্যিকারের পথ ও জীবন ।

কাজ ১: জীবনকেন্দ্রিক যেসব প্রশ্নের উত্তর তুমি ধর্ম বিশ্বাস ও শিক্ষা থেকে পাও, সেগুলো তোমার জন্য কতখানি অর্থপূর্ণ হয় তা দলে সহভাগিতা কর । 

কাজ ২: একটি ছেলে স্কুল বাদ দিয়ে সিগারেট খায় ও এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে । তাকে আবার স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য দলের সকলে মিলে একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত কর ।

 

 

 

অনুশীলনী

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১. যারা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না তাদের জীবন কেমন হয় ?

ক. অপূর্ণ

খ. সাৰ্থক

গ. বিশৃঙ্খল

ঘ. অর্থহীন

২. পূর্ণতার পথে বাধা হতে পারে

i. স্বার্থপরতা

ii. ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা

iii. দরিদ্রতা

নিচের কোনটি সঠিক ?

ক. i

গ. ii ও iii

খ. i ও ii

ঘ. i, ii ও iii

নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ে ৩ ও ৪নং প্রশ্নের উত্তর দাও :

সকল ও রঞ্জন একই গ্রামে পাশাপাশি বসবাস করেন । সজল অবস্থাপন্ন, রঞ্জন তুলনামূলকভাবে অস্বচ্ছল । সজল জোর করে রঞ্জনের জায়গা দখল করে সেখানে ঘর তৈরি করেছেন । রঞ্জন গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছে সুবিচার পাওয়ার জন্য বিচার দিলেন । এদিকে সজল ব্যাপারটা জানতে পেরে চেয়ারম্যানকে খুশি করার জন্য উপহার পাঠালেন । চেয়ারম্যান বিচারে সুকৌশলে সজলের পক্ষে কথা বললেন ।

৩. চেয়ারম্যানের আচরণে কী প্রকাশ পায় ?

ক. সততা

গ. দুর্নীতি

খ. স্বার্থপরতা

ঘ. স্বজনপ্রীতি

 

 

৪. চেয়ারম্যানের এরূপ আচরণের ফলে সমাজের পরিণতি কী হতে পারে ?

i. সম্পর্কের উন্নতি

ii. অরাজকতা

iii. বিশৃঙ্খলা

নিচের কোনটি সঠিক ?

ক. i

খ. i ও ii

গ. ii ও iii

ঘ. i, ii ও iii

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন

১. লক্ষ্য পূরণের জন্য মানুষ কী করে ?

২. খ্রিষ্টভক্ত হিসেবে আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী হওয়া উচিত ? ব্যাখ্যা কর ।

৩. খ্রিষ্টের দেখানো পথই আমাদের পথ – বিষয়টি ব্যাখ্যা কর ।

৪. সবসময় অর্থপূর্ণ জীবনের সন্ধান না পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা কর ।

৫. তুমি কীভাবে খ্রিষ্টের দেখানো পথে চলবে ? লেখ ।

সৃজনশীল প্রশ্ন

১. সীমা লেখাপড়া করছে । তার বাবা-মায়ের ইচ্ছা মেয়ে ডাক্তার হবে। কিন্তু সীমা লেখাপড়ায় মোটেও মনোযোগী নয় । বাবা-মা তাকে সবসময় বলেন মন দিয়ে লেখাপড়া করতে । ভালো রেজাল্ট করতে হলে এখন থেকেই মনোযোগী হয়ে পরিশ্রম করে পড়তে হবে। কিন্তু সীমা লেখাপড়ার ব্যাপারে একেবারে উদাসীন । ফলে তার রেজাল্টও খুব একটা ভালো হলো না । রেজাল্ট ভালো না হওয়ার কারণে সে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারল না । এমনকি পরবর্তীতে সে ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানেও ভর্তি হতে পারল না।

ক. পূর্ণতা লাভের জন্য কোন পথ সর্বোত্তম ?

খ. ‘লোগোথেরাপি' বলতে কী বুঝ ?

গ. সীমার জীবনের ব্যর্থতার কারণ কী ? ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. জীবনে সফলতা লাভের জন্য সীমাকে কী কী করতে হবে তা বিশ্লেষণ কর ।

 

Content added By
অনন্ত জীবন লাভ করা
অর্থবহ জীবন লাভ করা
লক্ষ্য নির্ধারণ করা
মুক্তির পথ লাভ করা