নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - ইংরেজ শাসন আমলে বাংলায় প্রতিরোধ, নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলন | NCTB BOOK

ইংরেজরা এদেশে এসেছিল ব্যবসায়-বাণিজ্য করতে । উপমহাদেশের শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে তারা এদেশের শাসক হয়ে ওঠে। তবে সব সময় তাদের ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল সজাগ । এই সজাগ ব্যবসায়িক বুদ্ধির কারণেই বাংলার উর্বর ফসলের ক্ষেতে তাদের দৃষ্টি পড়ে । তারা এই উর্বর ক্ষেতগুলোতে খাদ্য-ফসলের (খাবার ফসল) পরিবর্তে বাণিজ্য- ফসল (বাণিজ্যের জন্য যে ফসল) উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। নীল ছিল তাদের সেই বাণিজ্যিক ফসল । ঐ সময়ে নীল ব্যবসা ছিল খুবই লাভজনক । বস্তুত বস্ত্র শিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কাপড় রং করার জন্য ব্রিটেনে নীলের চাহিদা খুব বেড়ে যায় । তাছাড়া আমেরিকার ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো স্বাধীন হয়ে যাওয়ার কারণে ইংরেজ বণিকদের সেখানকার নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায় । ফলে বাংলা হয়ে ওঠে নীল সরবরাহের প্রধান কেন্দ্ৰ । ১৭৭০ থেকে ১৭৮০ সালের মধ্যে ইংরেজ আমলে বাংলাদেশে নীল চাষ শুরু হয়।

নীল চাষের জন্য নীলকরা কৃষকের সর্বোৎকৃষ্ট জমি বেছে নিত । কৃষকদের নীল চাষের জন্য অগ্রিম অর্থ গ্রহণে (দাদন) বাধ্য করা হতো । আর একবার এই দাদন গ্রহণ করলে সুদ-আসলে যতই কৃষকরা ঋণ পরিশোধ করুক না কেন, বংশপরম্পরায় কোনো দিনই ঋণ শোধ হতো না । নীল চাষে কৃষকরা রাজি না হলে তাদের উপর চরম অত্যাচার চালানো হতো। বাংলাদেশে নীলের ব্যবসা ছিল একচেটিয়া ইংরেজ বণিকদের । ফরিদপুর, যশোর, ঢাকা, পাবনা, রাজশাহী, নদীয়া, মুর্শিদাবাদে ব্যাপক নীল চাষ হতো । জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নীল চাষের খরচও বৃদ্ধি পায় । নীলকররা বিষয়টি বিবেচনায় রাখত না । তাছাড়া, প্রথম দিকে তারা চাষিদের বিনামূল্যে নীল বীজ সরবরাহ করলেও পরের দিকে তাও বন্ধ হয়ে যায় । ফলে নীল চাষ অব্যাহত রাখা চাষিদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

উপর্যুক্ত বঞ্চনার হাত থেকে চাষিদের বাঁচার কোনো উপায় ছিল না । আইন ছিল তাদের নাগালের বাইরে । আইন যারা প্রয়োগ করবেন, সেসব বিচারকের বেশির ভাগ ছিলেন নীলকরদের স্বদেশি বা বন্ধু । আবার নীলকররাও অনেক সময় নিজেরাই অবৈতনিক (অনারারি) ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ পেতেন। ফলে, আইনের আশ্রয় বা সুবিচার পাওয়া চাষির জন্য ছিল অসম্ভব । এমতাবস্থায় নীলকর সাহেবরা বাংলার গ্রামাঞ্চলে শুধু ব্যবসায়ী রূপে নয় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক অভিনব অত্যাচারী জমিদার রূপেও আত্মপ্রকাশ করে । এরা এতটাই নিষ্ঠুর আর বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে, অবাধ্য নীলচাষিকে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি ।

শেষ পর্যন্ত দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নীল চাষিরা ১৮৫৯ সালে প্রচণ্ড বিদ্রোহে ফেটে পড়ে । গ্রামে গ্রামে কৃষকরা সংগঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এসব বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় নীলচাষিরাই। যশোরের নীল বিদ্রোহের নেতা ছিলেন নবীন মাধব ও বেণী মাধব নামে দুই ভাই । হুগলিতে নেতৃত্ব দেন বৈদ্যনাথ ও বিশ্বনাথ সর্দার। নদীয়ায় ছিলেন মেঘনা সর্দার এবং নদীয়ার চৌগাছায় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস নামে দুই ভাই । স্থানীয় পর্যায়ের এই নেতৃত্বে বাংলায় কৃষক বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে । কৃষকরা নীল চাষ না করার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। এমনকি তারা ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশও অগ্রাহ্য করে । শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি নীলচাষিদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব প্রকাশ করতে থাকে । বিভিন্ন পত্রিকায় নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি ছাপা হতে থাকে । দীনবন্ধু মিত্রের লেখা 'নীলদর্পণ' নাটকের কাহিনি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ।

শেষ পর্যন্ত বাংলার সংগ্রামী কৃষকদের জয় হয় । ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার ইণ্ডিগো কমিশন’ বা ‘নীল কমিশন গঠন করে । এই কমিশনের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে নীল চাষকে কৃষকদের ‘ইচ্ছাধীন' বলে ঘোষণা করা হয় । তাছাড়া ইন্ডিগো কন্ট্রাক্ট বাতিল হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে নীল বিদ্রোহের অবসান হয় । পরবর্তীকালে নীলের বিকল্প কৃত্রিম নীল আবিষ্কৃত হওয়ায় ১৮৯২ সালে এদেশে নীল চাষ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় ।

Content added By

Promotion