নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - মধ্যযুগের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস (১২০৪ - ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) | NCTB BOOK

বারোভূঁইয়াদের ইতিহাস:
সম্রাট আকবর সমগ্র বাংলার ওপর তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। বাংলার বড় বড় জমিদার মুঘলদের অধীনতা মেনে নেননি । জমিদারগণ তাঁদের নিজ নিজ জমিদারিতে স্বাধীন ছিলেন। তাঁদের শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী ও নৌবহর ছিল । স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাঁরা একজোট হয়ে মুঘল সেনাপতির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন । বাংলার ইতিহাসে এ জমিদারগণ 'বারোভূঁইয়া' নামে পরিচিত । এ ‘বারো' বলতে বারোজনের সংখ্যা বুঝায় না। ধারণা করা হয় অনির্দিষ্ট সংখ্যক জমিদারদের বোঝাতেই ‘বারো' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ।

বাংলার ইতিহাসে বারোভূঁইয়াদের আবির্ভাব ষোলো শতকের মাঝামাঝি থেকে সতেরো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। আলোচ্য সময়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে যাঁরা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তাঁরাই ‘বারোভূঁইয়া' । এছাড়াও, বঙ্গদেশে আরও অনেক ছোটখাটো জমিদার ছিলেন। তাঁরাও মুঘলদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ান । কিন্তু পরে তাঁরা মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। বারোভূঁইয়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন :

 

বারোভূঁইয়াদের নাম এলাকার নাম
 

ঈসা খান, মুসা খান

ঢাকা জেলার অর্ধাংশ, প্রায় সমগ্র ময়মনসিংহ জেলা এবং পাবনা, বগুড়া ও রংপুর জেলার কিছু অংশ ।
চাঁদ রায় ও কেদার রায়
 
       শ্রীপুর (বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ)

বাহাদুর গাজি

        ভাওয়াল

সোনা গাজি

       সরাইল (ত্রিপুরার উত্তর সীমায়)

ওসমান খান

      বোকাইনগর (সিলেট)

বীর হামির

        বিষ্ণুপুর (বাকুড়া)
 

লক্ষণ মাণিক্য

        ভুলুয়া (নোয়াখালী)

পরমানন্দ রায়

        চন্দ্রদ্বীপ (বরিশাল)

বিনোদ রায়,মধু রায়

        চান্দপ্ৰতাপ (মানিকগঞ্জ)

মুকুন্দরাম, সত্রজিৎ

         ভূষণা (ফরিদপুর)

রাজা  কন্দর্পনারায়ণ,রামচন্দ্র

       বরিশাল জেলার অংশবিশেষ

 

প্রথম দিকে বারোভূঁইয়াদের নেতা ছিলেন ঈসা খান । হুসেন শাহি বংশের অবসান হলে ঈসা খানের পিতা সোলায়মান খান সোনারগাঁ অঞ্চলে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন । খিজিরপুর দুর্গ ছিল তাঁর শক্তির প্রধান কেন্দ্র । সোনারগাঁ ও খিজিরপুরের নিকটবর্তী কাত্রাবু তাঁর রাজধানী ছিল। দাউদ কররানির পতনের পর তিনি সোনারগাঁয়ে রাজধানী স্থাপন করেন।

বারোভূঁইয়াদের দমন করার জন্য সম্রাট আকবর বিশেষ মনোযোগ দেন। এজন্য তিনি ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে শাহবাজ খান, ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সাদিক খান, ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে উজির খান ও ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজা মানসিংহকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান। তাঁরা ঈসা খান ও অন্যান্য জমিদারের সাথে বহুবার যুদ্ধ করেন । কিন্তু বারোভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খানকে সম্পূর্ণ পরাজিত করা সম্ভব হয়নি। তিনি সম্রাট আকবরের আনুগত্য স্বীকারের বিনিময়ে নিজের আধিপত্য বজায় রাখেন। অন্যদিকে তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ‘মসনদ-ই-আলা' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন ।

১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ঈসা খানের মৃত্যু হলে বারোভূঁইয়াদের নেতা হন তাঁর পুত্র মুসা খান । এদিকে ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দে মানসিংহকে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলায় পাঠানো হয় । এবার মানসিংহ কিছুটা সফল হন । ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে মুসা খান এক নৌযুদ্ধে মানসিংহের হাতে পরাজিত হন। কিন্তু চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করার আগে সম্রাট আকবরের অসুস্থতার খবর আসে। সম্রাটের ডাকে মানসিংহ আগ্রায় ফিরে যান ।
সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সেলিম জাহাঙ্গীর' নাম ধারণ করে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনি মানসিংহকে আবার বাংলায় প্রেরণ করেন। এক বছর পর ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে কুতুব উদ্দিন কোকাকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করা হয় । কুতুব উদ্দিন শের আফকুনের হাতে প্রাণ হারান । তাঁর পরবর্তী সুবাদার জাহাঙ্গীর কুলি খান এক বছর পর মারা যান । এর পর ইসলাম খান ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গের সুবাদার নিযুক্ত হন ।

বাংলার বারোভূঁইয়াদের দমন করে এদেশে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের কৃতিত্বপূর্ণ কাজ । আর এ কৃতিত্বের দাবিদার সুবাদার ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে)। শাসনভার গ্রহণ করেই তিনি বুঝতে পারেন যে, বারোভূঁইয়াদের নেতা মুসা খানকে দমন করতে পারলেই তাঁর পক্ষে অন্যান্য জমিদারকে বশীভূত করা সহজ হবে । সেজন্য তিনি রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । কারণ মুসা খানের ঘাঁটি সোনারগাঁ ঢাকার অদূরে ছিল। বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় আসার পথে ইসলাম খান কয়েকজন জমিদারের আনুগত্য লাভ করেছিলেন। বারোভূঁইয়াদের মোকাবেলা করার জন্য ইসলাম খান শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলেন । মুসা খানের সাথে প্রথম সংঘর্ষ বাধে ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে করতোয়া নদীর পূর্বতীরে যাত্রাপুরে । সেখানে মুসা খানের দুর্গ ছিল । যুদ্ধে মুসা খান ও অন্যান্য জমিদার শেষ পর্যন্ত পিছু হটেন । ইসলাম খান ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় প্রবেশ করেন । এ সময় থেকে ঢাকা হয় বাংলার রাজধানী । সম্রাটের নাম অনুসারে ঢাকার নাম রাখা হয় ‘জাহাঙ্গীরনগর’।

এরপর পুনরায় মুসা খানের নেতৃত্বে মুঘলদের বাধা দেওয়ার জন্য জমিদারদের নৌবহর একত্রিত হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে । ইসলাম খান এর পশ্চিম তীরের বিভিন্ন স্থানে সৈন্য ও নৌবহর প্রেরণ করেন । ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খানের সঙ্গে জমিদারদের যুদ্ধ শুরু হয়। নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত মুসা খানের কদম রসুল দুর্গসহ অন্যান্য দুর্গ মুঘলদের অধিকারে আসে। অবস্থার বিপর্যয়ে মুসা খান সোনারগাঁ চলে আসেন । রাজধানী নিরাপদ নয় মনে করে তিনি মেঘনা নদীতে অবস্থিত ইব্রাহিমপুর দ্বীপে আশ্রয় নেন । মুঘল সৈন্যরা সোনারগাঁ অধিকার করে নেন। এর ফলে জমিদারগণ বাধ্য হন আত্মসমর্পণ করতে । কোনো উপায় না দেখে মুসা খানও শেষ পর্যন্ত মুঘলদের নিকট আত্মসমর্পণে বাধ্য হন । ইসলাম খান মুসা খানকে অন্যান্য জমিদারদের মতো মুঘলদের অধীনস্থ জায়গিরের দায়িত্ব দিলেন। এরপর মুসা খান সম্রাটের অনুগত জায়গিরদার হিসেবে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন । মুসা খানের আত্মসমর্পণে অন্যান্য জামিদার নিরাশ হয়ে মুঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করেন । এভাবে বাংলায় বারোভূঁইয়াদের শাসনের অবসান ঘটে ।

 

Content added By