নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - প্রাচীন বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস | NCTB BOOK

প্রাচীন বাংলার সামাজিক জীবন:

মৌর্য শাসনের পূর্বে বাংলার অধিবাসীদের মধ্যে তেমন কোনো রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে ওঠেনি। এ সময়ে সমাজ বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। একে বলা হতো কৌম সমাজ। আর্যপূর্ব কিছু কিছু ধর্মচিন্তা বা দৰ্শন পরবর্তী সময়ে এদেশের হিন্দু ধর্মে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কর্মফল, জন্মান্তরবাদ, যোগ সাধনা ইত্যাদি। এ যুগের অনেক সামাজিক প্রথা ও আচার-আচরণের প্রভাব পরবর্তী সময়ে হিন্দু সমাজে লক্ষ করা যায়। যেমন – অতিথিদের পান-সুপারি খেতে দেওয়া, শিবের গীত গাওয়া, বিয়েতে গায়ে হলুদ দেয়া, ধুতি-শাড়ি পরা এবং মেয়েদের কপালে সিঁদুর দেয়া ইত্যাদি ।

আর্য সমাজে জাতিভেদ প্রথা অত্যন্ত ব্যাপক ছিল । তারা দীর্ঘদিন এদেশে বসবাস করার ফলে বাংলায়ও এ ব্যবস্থা চালু হয় । তখন হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এ চারটি বর্ণের বিভাজন ছিল। পরবর্তী সময়ে আরও নানা প্রকার সংকর অর্থাৎ মিশ্র জাতির সৃষ্টি হয়। সমাজে প্রত্যেক জাতিরই নির্দিষ্ট পেশা ছিল । অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও পূজা-পার্বণ করা- এগুলো ছিল ব্রাহ্মণদের নির্দিষ্ট কর্ম । তারা সমাজে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা লাভ করতো। ক্ষত্রিয়দের পেশা ছিল যুদ্ধ করা। ব্যবসা-বাণিজ্য করা ছিল বৈশ্যদের কাজ। সবচেয়ে নীচু শ্রেণির শূদ্ররা সাধারণত কৃষিকাজ, মাছ শিকার ও অন্যান্য ছোটখাটো কাজ করত । ব্রাহ্মণ ছাড়া বাকি সব বর্ণের মানুষ একে অন্যের সাথে মেলামেশা করতো। সাধারণত এক জাতির মধ্যেই বিবাহ হতো, তবে উচ্চ শ্রেণির বর ও নিম্ন শ্রেণির কনের মধ্যে বিবাহও চালু ছিল । কিন্তু পরবর্তী সময়ে এসব ব্যাপারে কঠোর নিয়ম চালু হয় ।

বাঙালি মেয়েদের গুণাবলির সুখ্যাতি ছিল । মেয়েরা লেখাপড়া শিখত । সে যুগে অবরোধ বা পর্দাপ্রথা ছিল না। একটি বিবাহ ছিল সমাজের নিয়ম । তবে পুরুষেরা বহু স্ত্রী রাখতে পারত। বিধবাকে নিরামিষ আহার করে সব ধরনের বিলাসিতা ত্যাগ করতে হতো । স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রীকেও মৃত স্বামীর চিতায় সহমরণে যেতে হতো। এ প্রথাকে বলা হয় 'সতীদাহ প্রথা'। ধন-সম্পত্তিতে নারীদের কোনো আইনগত অধিকার ছিল না। বাংলার প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে বাঙালির উন্নত চরিত্রের কথা জানা যায় । কিন্তু তাই বলে বাঙালির সামাজিক জীবনে কোনোরূপ দুর্নীতি ও অশ্লীলতা ছিল না, এমন কথা বলা যায় না ।

বাঙালির প্রধান খাদ্য বর্তমান সময়ের মতো তখনও ছিল ভাত, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, দুধ, দধি, ঘৃত, ক্ষীর ইত্যাদি । চাল থেকে প্রস্তুত নানা প্রকার পিঠাও জনপ্রিয় মুখরোচক খাবার ছিল । বাঙালি ব্রাহ্মণেরা আমিষ খেত । তখন সকল প্রকার মাছ পাওয়া যেত। পূর্ববঙ্গে ইলিশ ও শুঁটকি মাছ খুব প্রিয় খাবার ছিল । তরকারির মধ্যে বেগুন, লাউ, কুমড়া, ঝিঙ্গা, কাঁকরোল, কচু উৎপন্ন হতো। ফলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, কলা, তাল, পেঁপে, নারকেল, ইক্ষু পাওয়া যেত। তবে ডালের কথা কোথাও বলা নেই । দুধ, নারকেলের পানি, ইক্ষুরস, তালরসসহ নানা প্রকার পানীয় খাবার প্রচলিত ছিল । খাওয়া-দাওয়া শেষে মসলাযুক্ত পান খাওয়ার রীতি ছিল ।

পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে রাজা-মহারাজা ও ধনীদের কথা বাদ দিলে বিশেষ কোনো আড়ম্বর তখন ছিল না । বাংলার নর-নারীরা যথাক্রমে ধুতি ও শাড়ি পরিধান করত । মাঝে মাঝে পুরুষেরা গায়ে চাদর আর মেয়েরা পরতো ওড়না। উৎসব-অনুষ্ঠানে বিশেষ পোশাকের ব্যবস্থা ছিল । পুরুষ-নারী উভয়ের মধ্যেই অলঙ্কার ব্যবহারের রীতি প্রচলিত ছিল । তারা কানে কুণ্ডল, গলায় হার, আঙ্গুলে আংটি, হাতে বালা ও পায়ে মল পরিধান করত । মেয়েরাই কেবল হাতে শঙ্খের বালা পরত এবং অনেক চুড়ি পরতে ভালোবাসত । মণি-মুক্তা ও দামি সোনা-রুপার অলঙ্কার ধনীরা ব্যবহার করত। মেয়েরা নানাপ্রকার খোঁপা বাঁধত। পুরুষদের বাবরি চুল কাঁধের ওপর ঝুলে থাকত । কর্পূর, চন্দন প্রভৃতি প্রসাধনসামগ্রীর সঙ্গে বিভিন্ন সুগন্ধির ব্যবহারের প্রচলন ছিল । মেয়েদের সাজসজ্জায় আলতা, সিঁদুর ও কুমকুমের ব্যবহারও তখন প্রচলিত ছিল । পুরুষেরা মাঝে মধ্যে কাঠের খড়ম বা চামড়ার চটিজুতা ব্যবহার করত । তখন ছাতারও প্রচলন ছিল । তখনকার দিনে নানা রকম খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা ছিল। পাশা ও দাবা খেলার প্রচলন ছিল। তবে নাচ-গান ও অভিনয়ের প্রচলন ছিল খুব বেশি। বীণা, বাঁশি, মৃদঙ্গ, ঢাক, ঢোল, খোল, করতাল ইত্যাদি তো ছিলই, এমনকি মাটির পাত্রকেও বাদ্যযন্ত্ররূপে ব্যবহার করা হতো । কুস্তি, শিকার, ব্যায়াম, নৌকাবাইচ ও বাজিকরের খেলা পুরুষদের খুব পছন্দ ছিল। নারীদের মধ্যে উদ্যান রচনা, জলক্রীড়া ইত্যাদি আমোদ-প্রমোদের প্রচলন ছিল ।

অন্নপ্রাশন, বিয়ে, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি সামাজিক আচার-আচরণ অনুষ্ঠান সে যুগেও প্রচলিত ছিল। বারো মাসে তেরো পার্বণ অনুষ্ঠিত হতো। এ উপলক্ষে নানা প্রকার আমোদ-উৎসবের ব্যবস্থা ছিল । প্রাচীনকালে বাংলায় বর্তমানকালের ন্যায় ভ্রাতৃদ্বিতীয়া (ভাইফোঁটা), নবান্ন, রথযাত্রা, অষ্টমী স্নান, হোলি, জন্মাষ্টমী, দশহরা, অক্ষয় তৃতীয়া, গঙ্গাস্নান প্রভৃতি সুপরিচিত অনুষ্ঠান সেকালেও প্রচলিত ছিল। এসব আমোদ-উৎসব ছাড়াও তখন হিন্দুধর্মে অনেক লৌকিক অনুষ্ঠানও দেখা যায়। শিশুর জন্মের পূর্বে তার মঙ্গলের জন্য গর্ভাধান, সীমন্তোন্নয়ন ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো । জন্মের পর নামকরণ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি উপচার পালন করা হতো। প্রাচীনকালে বাংলার জনগণের দৈনন্দিন জীবনে ধর্মশাস্ত্রের প্রবল প্রভাব ছিল । কোন তিথিতে কী খাদ্য নিষিদ্ধ, কোন তিথিতে উপবাস করতে হবে এবং বিবাহ, শিশু বয়সে পড়াশুনা শুরু করা, বিদেশ যাত্রা, তীর্থযাত্রা প্রভৃতির জন্য কোন কোন সময় শুভ বা অশুভ ইত্যাদি বিষয়ে নিয়ম কঠোরভাবে পালিত হতো ।

প্রাচীন বাংলার মানুষের যাতায়াতের প্রধান বাহন ছিল গরুর গাড়ি ও নৌকা। খাল-বিলে চলাচলের জন্য ভেলা ও ডোঙ্গা ব্যবহার করা হতো। মানুষ ছোট ছোট খাল পার হতো সাঁকো দিয়ে। ধনী লোকেরা হাতি, ঘোড়া, ঘোড়ার গাড়ি প্রভৃতি যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতো। তাদের স্ত্রী-পরিজনেরা নৌকা ও পালকিতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আসা-যাওয়া করতো। বিয়ের পর নববধূকে গরুর গাড়ি বা পালকিতে করে শ্বশুরবাড়ি আনা হতো। সর্বোপরি মনে হয় যে, আধুনিক কালের গ্রামীণ জীবনযাত্রা এবং সেকালের জীবনযাত্রার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না ।

কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলার অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করত। মানুষের জীবন মোটামুটি সুখের ছিল । তবে প্রাচীন বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের কথাও জানা যায় । সমাজের উঁচু শ্রেণি অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের হাতে ছিল মূল ক্ষমতা । এ সময় শুধু ব্রাহ্মণরাই শাস্ত্রজ্ঞান চর্চা করতে পারতো। ব্রাহ্মণদের অত্যাচার সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল । এ উৎপাত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অধিক হতো । শেষ দিকে সেন রাজাদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। সেন বংশের শাসনামলে বৌদ্ধ সমাজ ও সংস্কৃতিতে নেমে আসে দুর্দশা। ব্রাহ্মণদের প্রভাবে সেনদের সময়ে সাধারণ হিন্দু সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে । প্রাচীন বাংলার শেষ পর্যায়ে এ বিশৃঙ্খল অবস্থায় মুসলমান সমাজের ভিত গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয় । মুসলমান সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলায় মধ্যযুগের সূচনা হয়। আর এ যুগে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির রূপও পাল্টে যায় ।

 

Content added By