নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - আমাদের সম্পদ | NCTB BOOK

বাংলাদেশে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক জ্বালানির মধ্যে অন্যতম হলো প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা এবং পেট্রোলিয়াম। এছাড়া রান্নার কাজে ব্যবহৃত কাঠের খড়ি, গাছের পাতা, পাটকাঠি, ধানের গুঁড়া এবং খড় বা গোবর দিয়ে তৈরি লাকড়ি, এগুলোকেও প্রাকৃতিক জ্বালানি হিসেবে গণ্য করা যায়। এখন আমাদের দেশে বহুল ব্যবহৃত গ্যাস, কয়লা ও পেট্রোলিয়াম সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক ।
 

Content added By

তোমরা কি জান আমরা বাসায় গ্যাসের চুলায় বা সিএনজি (CNG) পাম্প স্টেশন থেকে গাড়িতে যে গ্যাস নিই, তাতে আসলে কী গ্যাস থাকে? এতে থাকে প্রাকৃতিক গ্যাস, যা মূলত মিথেন (CH4) গ্যাস, তবে সামান্য পরিমাণে অন্যান্য পদার্থ যেমন: ইথেন, প্রোপেন এবং বিউটেনও থাকে। এছাড়া এতে অতি সামান্য পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন সালফাইড, হাইড্রোজেন, আর্গন এবং হিলিয়াম থাকে।এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে প্রাকৃতিক গ্যাস তৈরি হয়? প্রাকৃতিক গ্যাস কীভাবে তৈরি হয় তা নিয়ে কিছুটা ভিন্ন মত আছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত অনুযায়ী, প্রাকৃতিক গ্যাস তৈরি হয় মৃত গাছপালা ও প্রাণীদেহ থেকে। লক্ষ লক্ষ বছর আগে মরে যাওয়া গাছপালা ও প্রাণীর পচা দেহাবশেষ কাদা ও পানির সাথে ভূগর্ভে জমা হয়। সময়ের সাথে সাথে এগুলো বিভিন্ন রকম শিলা স্তরে ঢাকা পড়ে। শিলা স্তরের চাপে পচা দেহাবশেষ ঘনীভূত হয় এবং প্রচণ্ড চাপে ও তাপে দেহাবশেষে বিদ্যমান জৈব পদার্থ প্রাকৃতিক গ্যাসে ও পেট্রোলিয়ামে পরিণত হয়। প্রকৃতিতে এভাবে উৎপন্ন গ্যাসের খনিকে আমরা গ্যাসকূপ বলি। 
প্রাকৃতিক গ্যাস প্রক্রিয়াকরণ
প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রক্রিয়াকরণ একটি জটিল শিল্পপ্রক্রিয়া, যেটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয় (চিত্র ৮.০৩)। সাধারণত যেখানে গ্যাসকূপ পাওয়া যায়, সেখানেই এর প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। প্রক্রিয়াকরণ অনেকাংশে নির্ভর করে গ্যাসের গঠন অর্থাৎ এতে বিদ্যমান অন্যান্য পদার্থের উপর। সাধারণত গ্যাসকূপে গ্যাস ও তেল একসাথে থাকে। তাই প্রথমেই ভেলকে গ্যাস থেকে আলাদা করা হয়। এরপর প্রাকৃতিক প্যাসে থাকা বেনজিন ও বিউটেন ঘনীভূত করে আলাদা করা হয়। প্রাকৃতিক গ্যাসে থাকা পানি দূর করার জন্য নিরুদকের মধ্য দিয়ে চালনা করা হয়। অতঃপর গ্যাসে থাকা দূষকগুলো (H2S, CO2) পৃথক করা হয়। এরপর প্রান্ত প্যাসের মিশ্রণ থেকে নাইট্রোজেন আলাদা করা হয়। এই অবস্থায় প্রাপ্ত প্রাকৃতিক প্যাস বিশুদ্ধ মিথেন গ্যাস, যেটি পাইপলাইনের মাধ্যমে সঞ্চালন করা হয়।

ব্যবহার

প্রাকৃতিক গ্যাস আমরা নানা কাজে ব্যবহার করি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইউরিয়া সার উৎপাদন। শতকরা প্রায় ২১ ভাগ প্রাকৃতিক গ্যাস ইউরিয়া সারের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ বিদ্যুৎও উপন্ন করা হয় প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে। শতকরা প্রায় ৫১ ভাগ প্রাকৃতিক গ্যাসই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। প্রায় শতকরা ২২ ভাগ প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয় শিল্প-কারখানায়, ১১ ভাগ বাসা-বাড়িতে এবং ১১ ভাগ জ্বালানি হিসেবে। এছাড়া প্রায় শতকরা ১ ভাগ প্রাকৃতিক গ্যাস বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে জ্বালানির কাজে ব্যবহৃত হয়। বাকি শতকরা ৫ ভাগ অপচয় (System Loss) হয়। আমাদের দেশে ২০০৩ সাল থেকে যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা শুরু হয়েছে।
 

সীমাবদ্ধতা ও সংরক্ষণ
তোমাদের কি মনে হয় আমাদের যে প্রাকৃতিক গ্যাস মজুত আছে তা অফুরন্ত? না, মোটেও তা নয় । মজুত প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিমাণ নির্দিষ্ট এবং সীমিত। ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে একসময় তা শেষ হয়ে যাবে। তাই এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে আমাদের অত্যন্ত সচেতন হতে হবে, কোনোভাবেই এটিকে অপচয় করা যাবে না। অনেকে বাসায় বিনা প্রয়োজনে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখে এবং এতে অতি মূল্যবান এই সম্পদের অপচয় করে, যা কোনোমতেই সমীচীন নয়। এসব বিষয় নিয়ে সবাইকে যার যার নিজের বাসায় এবং এলাকার সবাইকে সচেতন করতে হবে।


 

Content added By

পেট্রোলিয়াম হলো খনিজ তেল, অর্থাৎ খনিতে পাওয়া তরল জ্বালানি পদার্থ। সাধারণত প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে খনিতে পেট্রোলিয়ামও থাকে। প্রোপেন ও বিউটেন স্বাভাবিক চাপ ও তাপমাত্রায় (২৫° সেলসিয়াস) গ্যাসীয় হলেও উচ্চ চাপে তরল অবস্থায় থাকে বলে এরাও পেট্রোলিয়ামের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া গ্যাসোলিন, কেরোসিন, ডিজেল— এগুলো সবই পেট্রোলিয়াম ।
পেট্রোলিয়াম প্রক্রিয়াকরণ
খনি থেকে প্রাপ্ত তেল মূলত নানারকম হাইড্রোকার্বন এবং অন্যান্য পদার্থের (যেমন- সনালফার) মিশ্রণ, তাই বেশিরভাগ সময়েই তা সরাসরি ব্যবহারের উপযোগী হয় না। সেজন্য অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করে নিতে হয়। প্রায় ৪০০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আংশিক পাতন করে/ আংশিক পাতনের মাধ্যমে অপরিশোধিত তেলের উপাদানগুলোকে আলাদা করা হয়।
পেট্রোলিয়ামের ব্যবহার
পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থের বড় একটি অংশ ব্যবহৃত হয় যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে। কৃষিজমিতে সেচকাজে, ডিজেলচালিত ইঞ্জিনে জ্বালানি হিসেবে প্রচুর পরিমাণে পেট্রোলিয়াম ব্যবহৃত হয়। এছাড়া শিল্প-কারখানায় সার, কীটনাশক, মোম, আলকাতরা, লুব্রিকেন্ট, গ্রিজ ইত্যাদি তৈরিতেও পেট্রোলিয়াম ব্যবহৃত হয়।

 

 

Content added By


কয়লা হলো কালো বা কালচে বাদামি রঙের একধরনের পাললিক শিলা। এতে বিদ্যমান মূল উপাদান হচ্ছে কার্বন। তবে স্থানভেদে এতে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে হাইড্রোজেন (H2), সালফার (S), অক্সিজেন (O2) কিংবা নাইট্রোজেন (N2) থাকে। কয়লা একটি দাহ্য পদার্থ, তাই জ্বালানি হিসেবে এর বহুল ব্যবহার রয়েছে।প্রাকৃতিক গ্যাস আর খনিজ তেলের মতো কয়লা একটি জীবাশ্ম জ্বালানি (Fossil Fuel) হলেও এর গঠন প্রক্রিয়া আলাদা। প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন বছর আগে জলাভূমিতে জন্মানো প্রচুর ফার্ন, শৈবাল, গুল্ম ও অন্যান্য গাছপালা মরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কয়লা তৈরি হয়েছে। গাছপালায় বিদ্যমান জৈব পদার্থে থাকা কার্বন প্রথমে জলাভূমির তলদেশে জমা হয়। এভাবে জমা হওয়া কার্বনের স্তর আস্তে আস্তে পলি বা কাদার নিচে চাপা পড়ে যায় এবং বাতাসের সংস্পর্শ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরকম অবস্থায় কার্বনের স্তর আরো ক্ষয় হয়ে পানিযুক্ত, স্পঞ্জের মতো ছিদ্রযুক্ত জৈব পদার্থে পরিণত হয়, যাকে বলা হয় পিট (Peat)। পিট অনেকটা হিউমাসের মতো পদার্থ। পরবর্তীতে উচ্চ চাপে ও তাপে এই পিট পরিবর্তিত হয়ে কার্বনসমৃদ্ধ কয়লায় পরিণত হয়। কয়লা তিন রকমের হয়। যেমন: অ্যানথ্রাসাইট, বিটুমিনাস এবং লিগনাইট। অ্যানথ্রাসাইট হলো সবচেয়ে পুরোনো ও শক্ত কয়লা, যা প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন বছর আগে তৈরি এবং এতে শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ কার্বন থাকে। বিটুমিনাস কয়লা প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বছরের পুরোনো এবং এতে শতকরা ৫০-৮০ ভাগ কার্বন থাকে। লিগনাইট কয়লা ১৫০ মিলিয়ন বছরের পুরোনো আর এতে সর্বোচ্চ শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত কার্বন থাকে।
 

প্রক্রিয়াকরণ
ভূগর্ভের কয়লার খনি থেকে মেশিনের সাহায্যে কয়লা উত্তোলন করা হয়। কয়লা উত্তোলনের জন্য দুটি পদ্ধতি আছে। একটি হলো ওপেন পিট মাইনিং (Open Pit Mining) আর অন্যটি হলো ভূগর্ভস্থ মাইনিং (Underground Mining)। সাধারণত কয়লার স্তর ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকে বলে ওপেন পিট মাইনিং পদ্ধতি বেশি ব্যবহৃত হয়। মেশিন দিয়ে ভূগর্ভ থেকে কয়লা তোলার পর কনভেয়ার বেল্ট দিয়ে সেগুলো প্রক্রিয়াকরণ প্লান্টে নেওয়া হয়। সেখানে কয়লায় থাকা অন্যান্য পদার্থ যেমন : ময়লা, শিলা কণা, ছাই, সালফার – এগুলোকে পৃথক করে ফেলা হয়।
 

ব্যবহার
তোমরা কি জান, কোন কোন কাজে কয়লা ব্যবহার করা হয়? বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কয়লা ব্যবহৃত হয় ইটের ভাটায়। জ্বালানি হিসেবে শিল্প-কারখানায় এবং বাসাবাড়িতে জ্বালানি হিসেবেও সামান্য কিছু কয়লা ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখনো কয়লা ব্যবহৃত না হলেও পৃথিবীর সব দেশেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার খুবই বেশি। এছাড়া হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাবাব-জাতীয় খাবার তৈরিতে এবং কর্মকার ও স্বর্ণকারগণ বিভিন্ন সামগ্রী এবং অলংকার তৈরির সময় কয়লা ব্যবহার করে থাকেন।প্রাকৃতিক জ্বালানির সংরক্ষণে নবায়নযোষ্ট শক্তি: আলোচিত প্রাকৃতিক জ্বালানির সবগুলোই এক সমর নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। তাই এগুলোর ব্যবহার কমানো ও সংরক্ষণের জন্য আমরা নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে পারি। সৌরশক্তি, বায়ুপ্রবাহ, পানির স্রোত এগুলোকে কাজে লাগিয়ে আমরা প্রাকৃতিক জ্বালানির উপর চাপ কমাতে পারি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শক্তি সংরক্ষণ করতে পারি।

 

Content added || updated By