নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - পদার্থবিজ্ঞান (পুরোনো সংস্করণ) - বিদ্যুতের চৌম্বক ক্রিয়া(Magnetic Effects of Current) | NCTB BOOK

যারা সাধারণভাবে চুম্বক হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে তারা নিশ্চয়ই কল্পনাও করতে পারবে না যে এটি তড়িৎ বা বিদ্যুৎ থেকে আলাদা কিছু নয় এবং তড়িৎ বা বিদ্যুতের প্রবাহ দিয়ে চুম্বক তৈরি করা যায়। একটা চার্জ থাকলে তার পাশে যেমন তড়িৎ ক্ষেত্র থাকে ঠিক সে রকম একটা তারের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে সেই তারের চারপাশে চৌম্বক

 ক্ষেত্র তৈরি হয়। ধরা যাক তুমি একটা কার্ডবোর্ডের মাঝখান দিয়ে একটা তার ঢুকিয়েছ এবং কার্ডের ওপর অনেকগুলো ছোট ছোট কম্পাস রেখেছ(চিত্র 12..02)। কম্পাসগুলো অবশ্যই উত্তর-দক্ষিণ বরাবর থাকবে ঠিক যে রকম থাকার কথা। এখন যদি এই তারের ভেতর দিয়ে কোনোভাবে বিদ্যুৎ বা তড়িৎ প্রবাহিত করতে পারো (মোটামুটি শক্তিশালী) তাহলে তুমি অবাক হয়ে দেখবে হঠাৎ করে সবগুলো কম্পাস একটা আরেকটার পেছনে সারিবদ্ধভাবে নিজেদের সাজিয়ে নেবে। তোমার স্পষ্ট অনুভুতি হবে যে এই বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য তারকে ঘিরে একটা বৃত্তাকার চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তুমি যদি বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ করে দাও তাহলে আবার সবগুলো ছোট ছোট কম্পাস উত্তর-দক্ষিণ বরাবর হয়ে যাবে। এবারে তুমি যদি বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক পাল্টে দাও তাহলে দেখবে আবার কম্পাসগুলো নিজেদের সাজিয়ে নেবে কিন্তু এবারে বৃত্তটায় কম্পাসের দিকটা হবে উল্টো দিকে। তার কারণ বিদ্যুৎ প্রবাহ সব সময় তাকে ঘিরে একটা নির্দিষ্ট দিকে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। 

একটা তারের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে তার জন্য তৈরি হওয়া চৌম্বক বলরেখাগুলোর দিক কোন দিকে হবে সেটা ডান হাতের নিয়ম দিয়ে বের করা যায়। বুড়ো আঙুলটা যদি বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক দেখায় তাহলে হাতের অন্য আঙুলগুলো চৌম্বক ক্ষেত্রের দিকটি নির্দেশ করে (চিত্র 12.03)। 

                       

                                

Content added By
Content updated By

একটা তারের ভেতর দিয়ে কতখানি বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা যায় তার একটা সীমা আছে, তারটা I I2R হিসেবে পরম হয়ে যায় তা ছাড়াও সবচেয়ে বেশি কতখানি বিদ্যুৎ প্রবাহ দেওয়া সম্ভব সেটা বিদ্যুতের উৎসের ওপর নির্ভর করে। তাই যদি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে হয় তাহলে একটা মাত্র বৃত্তাকার লুপ-এর ওপর নির্ভর না করে অপরিবাহী আস্তরণ দিয়ে ঢাকা তার দিয়ে অনেকবার প্যাঁচিয়ে একটা কুণ্ডলী বা কয়েল তৈরি করা হয়। এরকম কুণ্ডলীকে বলে সলিনয়েড। সেই কুণ্ডলী দিয়ে শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা যায়। কয়েলের প্রত্যেকটা সুপই তার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বিদ্যুতের জন্য চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করবে, তাই সম্মিলিত চৌম্বক ক্ষেত্র হবে অনেক গুণ বেশি। 

বৃত্তাকার তারের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে তার চৌম্বক ক্ষেত্র কোন দিকে হবে সেটাও ডান হাতের নিয়ম দিয়ে বের করা যায়। বুড়ো আঙুলটি হবে চৌম্বক ক্ষেত্রের দিক যদি অন্য আঙুলগুলো বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক দেখায়। একটা তারের কুণ্ডলী বা সনিয়েড আসলে দণ্ড চুম্বকের মতো কাজ করে এবং বুড়ো আঙুলের দিকটা হবে এই চুম্বকের উত্তর মেরু । 

একটা তারের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে তার জন্য তৈরি হওয়া চৌম্বক বলরেখাগুলোর দিক কোন দিকে হবে সেটা ডান হাতের নিয়ম দিয়ে বের করা যায়। বুড়ো আঙুলটা যদি বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক দেখায় তাহলে হাতের অন্য আঙুলগুলো চৌম্বক ক্ষেত্রের দিকটি নির্দেশ করে। 

Content added By
Content updated By

আমরা জানি, একটা চুম্বক অন্য চুম্বকের সমমেরুতে বিকর্ষণ এবং বিপরীত মেরুকে আকর্ষণ করে। আবার একটা তারের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে সেটি তাকে ঘিরে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। কাজেই একটা চৌম্বক ক্ষেত্রে যদি একটা তার রাখা হয় এবং সেই ভারের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয় তাহলে তারটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করার কারণে একটি বল অনুভব করে।

চিত্র 12.09: চৌম্বক ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ প্রবাহী তার রাআখা হলে সেটি বল অনুভব করে

12.09 চিত্রে একটা চুম্বকের উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুতে যাওয়া চৌম্বক বলরেখা এবং তার মাঝে একটা তারকে দেখানো হয়েছে, তারটি কাগজের ভেতর থেকে উপরের দিকে বের হয়ে এসেছে। তারের ভেতর দিয়ে নিচ থেকে উপরে বিদ্যুৎ প্রবাহ হলে এটি তাকে ঘিরে বৃত্তাকার চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করবে এবং উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুতে যাওয়া চৌম্বক ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত হয়ে চৌম্বক বলরেখাকে পুনর্বিন্যাস করবে। তারের নিচে বেশিসংখ্যক চৌম্বক বলরেখা এবং উপরে কমসংখ্যক চৌম্বক বলরেখার তৈরি হবে, যেটি ভারটিকে উপরের দিকে ঠেলে দেবে। যদি তারটিতে বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক পরিবর্তন করা হয় তাহলে তারকে ঘিরে বৃত্তাকার চৌম্বক ক্ষেত্রের দিক পাল্টে যাবে এবং তখন তারের ওপর চৌম্বক বলরেখার ঘনত্ব বেড়ে যাবে যেটি তারটিকে নিচের দিকে ঠেলে দেবে। 

Content added By
Content updated By

তোমরা জান একটি চুম্বক দিয়ে অন্য চুম্বকের উপর বল প্রয়োগ করা যায়। অন্যভাবে আমরা বলতে পারি একটি চৌম্বক ক্ষেত্র দিয়ে অন্য একটি চৌম্বক ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ করা যায়। একটি তারের ভেতর দিয়ে খুব বেশি বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা যায় না, তাই সেটি খুব বড় চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে না। কাজেই অন্য একটি চৌম্বক ক্ষেত্র দিয়ে তার ওপর শক্তিশালী বল প্রয়োগ করা যায় না। তোমরা দেখেছ যদি অনেকগুলো পাক দিয়ে একটা তারের কুণ্ডলী তৈরি করা যায় এবং তার ভেতরে একটা লোহার টুকরো বা আর্মেচার রাখা হয় তাহলে তারের ভেতর হালকা বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হলেই সেটি একটি তাড়িতচুম্বক বা ইলেকট্রোম্যাপনেট হয়ে শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। এই কয়েলকে আমরা একটা দণ্ড চুম্বক হিসেবে কল্পনা করে অন্য চৌম্বক ক্ষেত্রে তাকে রাখা হলে সেটি কী ধরনের আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বলের মুখোমুখি হবে এবং সে কারণে সেটির কোন দিকে গতি হবে সেটা বিশ্লেষণ করতে পারি। 12.10 চিত্রে এ রকম একটা তাড়িতচুম্বককে অন্য একটি চৌম্বক ক্ষেত্রে বিকর্ষণ বলের কারণে কীভাবে তার অবস্থান পরিবর্তন করবে সেটি দেখানো হয়েছে।তাড়িতচুম্বকটিকে যদি তার কেন্দ্র বরাবর একটা অক্ষে ঘুরতে দেওয়া হয় তাহলে এটি পরের চিত্রের মতো অবস্থানে যাবার চেষ্টা করবে। 

চিত্র 12.10 : বৈদ্যুতিক মোটর একটি তাড়িতচুম্বকের ভেতর দিয়ে এমনভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহ করানো হয়, যেন সব সময়েই এটি ঘুরতে থাকে

 

যদি কোনো বিশেষ অবস্থা তৈরি করে পরের অবস্থানে যাবার সাথে সাথে তাড়িতচুম্বকটির বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক পরিবর্তন করে দেওয়া যায় তাহলে সেখানে পৌঁছানোর সাথে সাথে কয়েল দিয়ে তৈরি দণ্ড চুম্বকটির উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরুতে আর দক্ষিণ মেরু উত্তর মেরুতে পাল্টে যাবে, তাই বিকর্ষণের কারণে আবার সেটি সরে যাবার চেষ্টা করবে অর্থাৎ এটি একটি ঘূর্ণন বল অনুভব করবে। এটি চেষ্টা করবে পরের স্থায়ী অবস্থানে পৌঁছাতে কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর সাথে সাথে আবার এটার বিদ্যুতের দিক পরিবর্তন করে দিলে এটি সেখানে থেমে যাবে না, আবার ঘুরতে শুরু করবে। তাই যখনই এটা একটা স্থায়ী অবস্থানে পৌঁছাবে তখনই যদি এটাতে এমনভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহ করানো হয় যেন বিকর্ষণের কারণে এটি একটি ঘূর্ণন বল অনুভব করে তাহলে এটি ঘুরতেই থাকবে। 

বিদ্যুতের দিক পরিবর্তন করার জন্য কম্যুটেটর নামে একটি উপকরণের মাধ্যমে খানিকটা যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার করতে হয়। মূল কয়েল যে অক্ষে ঘুরতে থাকে সেই ঘূর্ণায়মান অক্ষটির দুই পাশে তড়িৎ চুম্বকের দুটি তার এমনভাবে বসানো হয় যেন সেটি কম্যুটেটরে মূল বিদ্যুৎ প্রবাহের টার্মিনালকে স্পর্শ করে থাকে। যখনই স্পর্শ করে তখনই এমনভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করবে যেন সব সময়ই সেটি তাড়িতচুম্বক টিঁকে বিকর্ষণ করে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। মাঝামাঝি সময়ে যখন এটি মূল বিদ্যুৎ প্রবাহের টার্মিনাল থেকে সরে যাওয়ার কারণে তাড়িতচুম্বকটিতে কোনো বিদ্যুৎ প্রবাহ হয় না তখনো এটি থেমে না গিয়ে গতি জড়তার কারণে ঘুরতে থাকে । 

 

Content added By
Content updated By

শুধু বিদ্যুৎ ব্যবহার করে যে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা যায় তার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব যদি এই কুগুলীর ভেতর এক টুকরো লোহা ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। লোহা, কোবাল্ট আর নিকেল এই তিনটি ধাতুর বিশেষ চৌম্বকীয় ধর্ম আছে। এগুলোকে এলোমেলোভাবে থাকা অসংখ্য ছোট ছোট চুম্বক হিসেবে কল্পনা করা যায়। যেহেতু সবগুলো ছোট চুম্বক এলোমেলোভাবে আছে তাই পুরো লোহার টুকরোটা কোনো চুম্বক হিসেবে কাজ করে না।কিন্তু যখন এটাকে একটা কয়েল বা মলিনয়েডের মাঝে ঢোকানো হয় এবং সেই সলিনয়েডে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয় তখন সেটা যে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে সেটা লোহার টুকরার ছোট ছোট চুম্বকগুলোকে সারিবদ্ধ করে ফেলে তাই বিদুৎ প্রবাহের জন্য তৈরি চৌম্বক ক্ষেত্রের সাথে সাথে লোহার নিজন্য চৌম্বক ক্ষেত্র একত্র হয়ে অনেক শক্তিশালী একটা চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ করার সাথে সাথে লোহার টুকরোর ভেতরকার সারিবদ্ধ ছোট ছোট চুম্বকগুলো সব আবার এলোমেলো হয়ে যাবে এবং পুরো চৌম্বক ক্ষেত্র অদৃশ্য হরে যাবে। 

এভাবে তৈরি করা চুম্বককে বলা হয় তাড়িতচুম্বক । তাড়িতচুম্বকের ব্যবহারের কোনো শেষ নেই। স্পিকারে বা এয়ারফোনে যে শব্দ শোনা যায় সেখানে তাড়িতচুম্বক ব্যবহার করা হয়।(চিত্র12.08 )এখানে শব্দের কম্পন এবং তীব্রতার সমান বিদ্যুৎ প্রবাহ পাঠানো হয়, সেই বিদ্যুৎ একটা তাড়িতচুম্বক বা ইলেকট্রোম্যাগনেটের চৌম্বকত্ব শব্দের কম্পন বা ভীব্রতার উপযোগী করে তৈরি করে সেটা একটা ডায়াফ্রামকে কাঁপায় এবং সেই ডায়াফ্রাম সঠিক শব্দ তৈরি করে। 

Content added By
Content updated By