নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - পদার্থবিজ্ঞান (পুরোনো সংস্করণ) - চল বিদ্যুৎ (Current Electricity) | NCTB BOOK

বিদ্যুৎ ছাড়া আমরা এখন এক মুহূর্তও চিন্তা করতে পারি না। আমাদের ঘরে এটি আলো সরবরাহ করে, গরমের সময় ফ্যান চালিয়ে এটা আমাদের শীতল রাখে। এটা দিয়ে আমরা টেলিভিশন চালাই, কম্পিউটার চালাই। খাবার সংরক্ষণ করার জন্য এটা দিয়ে ফ্রিজ চালানো হয়। কাপড় ইস্ত্রি করার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। আমাদের মোবাইলের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেলে আমরা এই বিদ্যুৎ দিয়ে ব্যাটারি চার্জ করি। বিলাসী মানুষ বিদ্যুৎ দিয়ে বাসায় এসি ব্যবহার করে, কাপড় ধোয়ার জন্য ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করে, ইলেকট্রিক হিটার দিয়ে রান্না করে। মাইক্রোওয়েভ ওভেনে খাবার গরম করে। 

বাসার বাইরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ক্ষেত-খামার, কারখানা, হাসপাতাল এসবের কথা বিবেচনা করলে আমরা বিদ্যুতের ব্যবহারের কথা বলে শেষ করতে পারব না। আমাদের দেশে সাধারণত বিদ্যুৎ 220 V (AC) হিসেবে সরবরাহ করা হয়, এই বিদ্যুতের ভোল্টেজের পরিমাণ মানুষকে ইলেকট্রিক শক দিতে পারে এমনকি সেই শকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। তাই সকল বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন ভুলেও কখনো কেউ সরাসরি এর সংস্পর্শে চলে না আসে। 

সরাসরি হৃৎপিণ্ডের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ চলে গেলে মাত্র 10 mA বিদ্যুতেই মানুষ মারা যেতে পারে। ব্যবহার করার জন্য আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি সেটি AC এবং AC বিদ্যুৎ DC বিদ্যুৎ থেকে প্রায় 5 গুণ বেশি ক্ষতিকর। শুকনো অবস্থায় মানুষের চামড়ার রোধ প্রায় 30,002 থেকে 50,000 52 হলেও ভেজা অবস্থায় সেটি হাজার গুণ কমে আসে। কাজেই ও'মের সূত্র ব্যবহার করে আমরা দেখাতে পারি আমাদের দেশের 220 V শরীরের ভেতর দিয়ে মানুষকে মেরে ফেলার মতো বিদ্যুৎ প্রবাহ করতে পারে। যখন কেউ ভেজা মাটিতে ভেজা পা নিয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় সেটি হয় সবচেয়ে বিপজ্জনক। 

যখন কেউ হঠাৎ করে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় তখন শরীরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে হাত-পা নাড়াতে পারে না, তাই বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার কথা বুঝতে পারলেও সেখান থেকে সরে আসতে পারে না। 

আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি সেটি যথেষ্ট বিপজ্জনক হতে পারে কিন্তু সাধারণ সতর্কতা বজায় রাখলেই নিরাপদে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায় এবং সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ প্রতি মুহূর্তে নিরাপদে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। বিদ্যুতের নিরাপদ ব্যবহার করার জন্য নিচের কয়েকটা বিষয় জানা থাকা প্রয়োজন: 

(a) বিদ্যুৎ অপরিবাহক আস্তরণ: বিদ্যুতের খোলা তার বিপজ্জনক তাই সব সময়ই সেটা প্লাস্টিক বা অন্য কোনো ধরনের বিদ্যুৎ অপরিবাহী একটা আস্তরণ দিয়ে ঢাকা থাকে। যদি কোনো কারণে শর্ট সার্কিট হয় অর্থাৎ সরাসরি কোনো রোধ ছাড়াই পজিটিভ এবং নেগেটিভ স্পর্শ করে ফেলে তখন ও'মের সূত্র অনুযায়ী অনেক বেশি বিদ্যুৎ প্রবাহ হয়, তার গরম হয়ে যায়, প্লাস্টিক পুড়ে গিয়ে আগুন পর্যন্ত ধরে যায়। তাই সব সময়ই সতর্ক থাকতে হয় যেন বৈদ্যুতিক তারের ওপর অপরিবাহী আস্তরণটা অবিকৃত এবং অক্ষত থাকে। 

(b) ভালো সংযোগ: যখন কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার সময় অনেক বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় তখন বৈদ্যুতিক সংযোগগুলো খুব ভালো হতে হয়। বৈদ্যুতিক সংযোগ ভালো না হলে সেখানে বাড়তি রোধ তৈরি হয় এবং 12R হিসেবে সেটা উত্তপ্ত হয়ে যেতে পারে, উত্তপ্ত হয়ে অপরিবাহী আস্তরণ পুড়ে যেতে পারে, বৈদ্যুতিক সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 

(c) আর্দ্রতা: পানি বিদ্যুৎ পরিবাহী, কাজেই কোনো বৈদ্যুতিক সার্কিটে পানি ঢুকে গেলে সেখানে শর্ট সার্কিট হয়ে বিপজ্জনক অবস্থা হতে পারে। হেয়ার ড্রায়ার বা ইস্ত্রির মতো জিনিস পানির কাছাকাছি ব্যবহার করা খুব বিপজ্জনক, হঠাৎ করে পানিতে পড়ে গেলে এবং সেই পানি কেউ স্পর্শ করলে বৈদ্যুতিক শক খেয়ে অনেক বড় বিপদ হতে পারে। 

(d) সার্কিট ব্রেকার এবং ফিউজ: বিদ্যুতের বড় বড় দুর্ঘটনা হয় যখন হঠাৎ করে কোনো একটা ত্রুটির কারণে অনেক বেশি বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। হঠাৎ করে বিপজ্জনক বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ করার জন্য সার্কিট ব্রেকার কিংবা ফিউজ ব্যবহার করা হয়। সার্কিট ব্রেকার এমনভাবে তৈরি করা হয় যে এর ভেতর থেকে নিরাপদ সীমার বেশি বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলেই সার্কিট ব্রেক (বিচ্ছিন্ন) করে দেয়। ফিউজ সে তুলনায় খুবই সরল একটা পদ্ধতি, একটি যন্ত্রে যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় সেটি যন্ত্রে ঢোকানোর আগে সরু একটা তারের ভেতর দিয়ে নেওয়া হয়। যদি কোনো কারণে বেশি বিদ্যুৎ যাওয়ার চেষ্টা করে ফিউজের সরু তার সেই (রোধ বেশি, কাজেই I2R বেশি অর্থাৎ তাপ বেশি) বিদ্যুতের কারণে উত্তক্ত হয়ে পুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে ফেলে। 

(e) সঠিক সংযোগ: বিদ্যুৎ সরবরাহে সব সময়ই দুটি তার থাকে, একটিতে উচ্চ বিভব (জীবন্ত বা Live) অন্যটি ভোল্টেজহীন নিরপেক্ষ (Neutral)। একটা যন্ত্র যখন ব্যবহার করা হয় তখন Live তার থেকে বিদ্যুৎকে যন্ত্রের ভেতর দিয়ে ঘুরিয়ে নিরপেক্ষ ভার দিয়ে তার উৎসে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ভোল্টেজহীন নিরপেক্ষ তারটি নিরাপদ কিন্তু উচ্চ বিভবের তারটিকে সতর্কভাবে ব্যবহার করতে হয়। কোনো যন্ত্রপাতিতে যখন একটা সুইচ দিয়ে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয় তখন সুইচটি উচ্চ ভোল্টেজের তার কিংবা নিরপেক্ষ তার দুটিতেই দেওয়া যায়। বুদ্ধিমানের কাজ হয় যখন সুইচটি লাগানো হয় উচ্চ ভোল্টেজের তারের সাথে তাহলে শুধু যখন যন্ত্রটি চালু করা হয় তখনই উচ্চ ভোল্টেজ যন্ত্রের ভেতর প্রবেশ করে। যখন যন্ত্রটি বন্ধ থাকে তখন যন্ত্রের ভেতর কোথাও উচ্চ ভোল্টেজ থাকে না। 

(f) গ্রাউন্ড: তোমরা যদি তোমাদের বাসায় স্কুলে কিংবা অন্য কোথাও বিদ্যুতের সংযোগ লক্ষ করে থাকো তাহলে দেখৰে সব সময় অন্তত দুটি সংযোগ থাকে, একটি উচ্চ ভোল্টেজ অন্যটি নিউট্রাল। কিন্তু সেই বিদ্যুতের সাথে যদি মূল্যবান কোনো যন্ত্র যুদ্ধ করা হয় (যেমন কম্পিউটার, ফ্রিজ) তাহলে দেখবে সেখানে উচ্চ বিভব আর নিউট্রাল ছাড়াও তৃতীয় একটা সংযোগ থাকে, যেটি হয়ে ভূমি সংযোগ বা ground. সাধারণত এটা যন্ত্রপাতির ঢাকনা বা কাঠামোতে লাগানো থাকে। যদি কোনো দুর্ঘটনায় যন্ত্রপাতিটি বিদ্যুতায়িত হয়ে যায় তাহলে ঢাকনা বা কাঠামোটি থেকে ভূমিতে সরাসরি বিদ্যুৎ প্রবাহ হয়ে যায়। বিদ্যুতের এই প্রবাহের কারণে সাধারণত ফিউজ পুড়ে যন্ত্রটি বিপদমুগ্ধ হয়ে যায়। কাজেই কেউ যদি ভুলে যন্ত্রটি স্পর্শ করে তার ইলেকট্রিক শক খাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। 

Content added By
Content updated By