নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - জীবনের জন্য পানি | NCTB BOOK

২.৬.১ পানিতে বৈশ্বিক উষ্ণতাৰ প্ৰভাৰ
সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি
বৈশ্বিক উষ্ণতা হলো বিশ্বের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা, যা বিভিন্ন কারণে দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে পানির তাপমাত্রাও বেড়ে যাবে। প্রায় ১০০ বছর আগে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা প্রায় ১° সেলসিয়াস কম ছিল। তোমরা হয়তো ভাবছ, ১০০ বছরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা মাত্র ১° সেলসিয়াস বেড়েছে, এটি আর এমনকি ব্যাপার! কিন্তু আসলে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ, তাপমাত্রা অল্প একটু বেড়ে গেলেই মেরু অঞ্চলসহ নানা জায়গায় সঞ্চিত বরফ গলতে শুরু করে। এ বরফ গলা পানি কোথায় যাবে? শেষ পর্যন্ত এই পানি সমুদ্রে গিয়েই পড়বে। এর ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। ফলে পৃথিবীর যে সকল দেশ নিচু, সেগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাবে। বাংলাদেশ হচ্ছে সেরকম নিচু এলাকার একটি দেশ!
 

লবণাক্ততা
সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি নদ-নদী, খাল- বিল, পুকুর, ভূগর্ভস্থ পানি আর হ্রদের পানিতে মিশে যাবে। এর কথায় পানির সকল উৎসই লবণাক্ত হয়ে পড়বে। পানির সকল উৎস লবণাক্ত হলে কী কী অসুবিধা হবে? প্রথমত মিঠা পানিতে বসবাসকারী জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এবং এক পর্যায়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তার কারণ, পানির তাপমাত্রা বাড়লে যেরকম পানির দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যায়, ঠিক সেরকম লবণাক্ততা বাড়লেও দ্রবীভূত অক্সিজেন অনেক কমে যাবে, যার ফলে জলজ প্রাণীরা আর বেঁচে থাকতে পারবে না। জলজ উদ্ভিদের বড় একটি অংশ লবণাক্ত পানিতে জন্মাতেও পারে না, বেড়ে উঠতেও পারে না, যে কারণে পানির জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।
 

বৃষ্টিপাত
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে পারে। এ সংক্রান্ত কম্পিউটার মডেলিং থেকে ধারণা করা যায়, কোনো কোনো এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে, আবার কোনো কোনো এলাকায়, বিশেষ করে নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাবে। বৃষ্টিপাত কমে গেলে খরা সৃষ্টি হয়, এমনকি বিস্তীর্ণ এলাকা মরুভূমিতেও পরিণত হতে পারে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আর ধরন পরিবর্তন হলে নদ-নদী, খাল-বিলে পানির পরিমাণ এবং প্রবাহ পরিবর্তিত হবে, যা অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কম্পিউটার মডেলিং থেকে এটাও অনুমান করা যায়, কোনো এলাকায় শীতকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে, যা থেকে অসময়ে বন্যা হতে পারে।

 

Content added || updated By

বাংলাদেশে বৈশ্বিক উষ্ণতার একটি বড় প্রমাণ হলো, এখন গ্রীষ্মকালে অনেক বেশি গরম পড়ে, এমনকি মাঝে মাঝে বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা ৪৭° সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যায় যেটি আগে কখনো হয়নি। তাপমাত্রার উপাত্ত থেকে এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে গ্রীষ্মকাল ও শীতকাল- দুই সময়েই তাপমাত্রা আগের তুলনায় বেশি থাকে। অর্থাৎ বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব স্পষ্টভাবেই বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশের মিঠা পানিতে এর প্রভাব কী হবে? তোমরা আগেই জেনেছ যে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা বাড়লে পৃথিবীতে সঞ্চিত বরফ গলতে শুরু করবে এবং সমুদ্রে পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। এর প্রভাব বাংলাদেশে অনেক বেশি তীব্র হবে, যার কারণে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে আমাদের দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ অংশ পানির নিচে চলে যাবে। সাগরের লবণাক্ত পানি মূল ভূখন্ডে ঢোকার কারণে নদ-নদী, খাল-বিল আর ভূগর্ভের পানি লবণাক্ত হয়ে যাবে। যার ফলে দেশে মিঠা পানি বলতে আর কিছু থাকবে না। তোমরা হয়তো জান যে, সাতক্ষীরাসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় চিংড়ি চাষের জন্য নালা কেটে লবণার পানি মূল ভূখণ্ডে আনা হয়। এ কারণে ঐ সকল এলাকার ভূগর্ভের পানিসহ মিঠা পানির অন্যান্য উৎসও লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে খাওয়ার এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার উপযোগী পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বলতে গেলে ঐ সকল এলাকার মিঠা পানির একমাত্র উৎস এখন বৃষ্টির পানি। এমনও দেখা গেছে যে প্রায় ১০-১৫টি গ্রামের মানুষ সবাই মিলে একটি পুকুরে বৃষ্টির পানি ধরে রাখে এবং সারা বছর সেই পানি ব্যবহার করছে। 

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে পানি আনার জন্য গৃহবধূদের অনেক সমর ৭-৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পুকুরে ধরে রাখা পানি আনতে হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে প্রায় পুরো বাংলাদেশেই এ অবস্থা হতে পারে।ইতোমধ্যেই কয়েকটি দেশের অংশ বিশেষ (যেমন: মালদ্বীপ, ভারতের কিছু অংশ) বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় পানির নিচে ডুবে গেছে এবং ঐ সকল দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ “জলবায়ু শরণার্থীতে” পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে গিয়ে নদ-নদীতে পানির প্রবাহ আর গতিপথও পাল্টে যেতে পারে, যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।


 

Content added By