নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - প্রাত্যহিক জীবনে তড়িৎ | NCTB BOOK

কোনো দ্রবণের মধ্যে বিদ্যুৎ বা তড়িৎ প্রবাহিত করে এর অণুগুলোকে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক অংশে বিভক্ত করার পদ্ধতিকে তড়িৎ বিশ্লেষণ বলে।তড়িৎ প্রবাহ করে দ্রবণের যে দ্রবটিকে দুই ভাগে বিভক্ত বা বিশ্লেষণ করা হয়, তাকে তড়িৎ দ্রব বা তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ বলে। আমরা আগে দেখেছি যে পরিবাহকের দুই পাশে ব্যাটারি সেল দিয়ে বিভব পার্থক্য তৈরি করলে পরিবাহকের মুক্ত ইলেকট্রনগুলো প্রবাহিত হয়, যেটাকে আমরা বিদ্যুৎ বা তড়িৎ প্রবাহ বলি। তড়িৎ বিশ্লেষণের সময় দ্রবণের ভেতর দিয়ে কীভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হবে? তড়িৎ বিশ্লেষণের বা ইলেকট্রোলাইসিসের সময় তড়িৎ দ্রবটি ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক আয়নে বিভক্ত এবং ঋণাত্মক আয়নের প্রবাহ দিয়ে দ্রবণে বিদ্যুৎ প্রবাহ করা হয়। সকল এসিড, ক্ষার, কয়েকটি নিরপেক্ষ লবণ, এসিড মেশানো পানি ইত্যাদি তড়িৎ দ্রব বা তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ। যেমন: H2SO4, HNO3, CuSO4, AgNO3, NaOH ইত্যাদি।আমরা জানি, স্বাভাবিক অবস্থায় পরমাণু বা অণুতে ইলেকট্রনের সংখ্যা নিউক্লিয়াসে অবস্থিত প্রোটনের সংখ্যার সমান হয়ে থাকে। কোনো অণু, পরমাণু বা যৌগমূলকে যদি স্বাভাবিক সংখ্যার ইলেকট্রনের চেয়ে কম বা বেশি ইলেকট্রন থাকে তাহলে তাকে আয়ন বলে। ইলেকট্রনের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে তাকে বলে ধনাত্মক আয়ন। আর যদি ইলেকট্রনের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয় তাহলে তাকে বলে ঋণাত্মক আয়ন।তড়িৎ বিশ্লেষণের সময় তড়িৎ দ্রব ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক আয়নে ভাগ হয়ে যায়। একটু আগে উল্লেখ করা তড়িৎ দ্রবগুলো নিচে দেখানো উপায়ে আয়নে বিভক্ত হয়ে যাবে:
→ 2H++ SO
HNO3 → H+ + NO3
CuSO4 AgNO3 → Ag+ + NO3®
→ Cu++ +
NaOH → Na+ + OH - 
বিখ্যাত বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস (Arrhenius) ১৮৮১ সালে তড়িৎ বিশ্লেষণের ব্যাখ্যা দেন। তিনি দেখিয়েছিলেন এসিড, ক্ষার বা লবণজাতীয় যৌগিক পদার্থকে তরলে প্রবীভূত করলে সেগুলো আয়নায়িত হয়ে সম-পরিমাণ ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধান বা চার্জযুক্ত আরনে ভাগ হয়ে যায়। আধানযুক্ত অবস্থায় আরনগুলোর রাসায়নিক ধর্ম প্রকাশ পার না। তবে চাহীন বা নিষ্ক্রিয় হলে এরা আবার রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। আয়নগুলো তরলের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরে বেড়ার। পরিবাহকে যেরকম ইলেকট্রন বিদ্যুৎ প্রবাহ করতে পারে, দ্রবণে এই আয়নগুলো সেরকম বিদ্যুৎ প্রবাহ করতে পারে। এখন এই তরলের মাঝে দুটি পরিবাহী দণ্ড বা তড়িৎদ্বার রেখে তরলের ভেতর যদি বিদ্যুৎ প্রবাহ করা হয় তাহলে ঋণাত্মক আয়নগুলো অ্যানোড ও ধনাত্মক আয়নগুলো ক্যাথোডের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। দুটি পরিবাহী দণ্ড বা ইলেকট্রোডের মধ্যে আয়নগুলোর এই বিপরীতমুখী প্রবাহের জন্য তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্টি হয়।
 

১২.২.১ তুঁতের শ্রবণের তড়িৎ বিশ্লেষণের ব্যাখ্যা
ঋণাত্মক সালফেট আয়নগুলি ধণাত্মক অ্যানোডের দিকে যাচ্ছে
ধণাত্মক কপার আয়নগুলি ঋণাত্মক ক্যাথোডের দিকে যাচ্ছে
CuSO4
চিত্র ১২.০৮: তড়িৎ বিশ্লেষণ
ধরা যাক একটি কাচপাত্রে কিছু ভূত বা CuSO4 ও পানি নেওয়া হলো। CuSO4 পানিতে দ্রবীভূত হয়ে Cu ++ ও 504 - আয়নে বিশ্লিষ্ট হয় (চিত্র ১২.০৮)। এখন দ্রবণের মধ্যে দুটি তামার পাত ডুবিয়ে যি পাত দুটির সাথে একটি তড়িৎ কোষ সংযুক্ত করা হয় তাহলে আয়নের প্রবাহ শুরু হবে। Cu+ আরনগুলো ক্যাথোডে গিয়ে ক্যাথোড থেকে দুটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে এবং নিশ্চয়িত তামায় পরিণত হয়ে ক্যাখোজে জমা হতে থাকবে। অন্যদিকে SO 4 - আয়নগুলো অ্যানোড দ্বারা আকৃষ্ট হরে সেখানে যাবে এবং সেখানে দুটি ইলেকট্রন ত্যাগ করে নিতষ্ঠিত হয়। নিস্তরিত SO 4 অ্যানোড থেকে Cu গ্রহণ করে CuSO4 উৎপন্ন করবে। এই CuSO4 আবার দ্রবণে দ্রবীভূত হবে বলে প্রবণের ঘনত্ব অপরিবর্তিত থাকবে।সুতরাং দেখা যাবে, প্রবল থেকে যে পরিমাণ Cu ক্যাথোডে জমা হচ্ছে, ঠিক সেই পরিমাণ Cu অ্যানোড থেকে দ্রবণে চলে আসছে । অর্থাৎ মোট ফল হচ্ছে অ্যানোডের ভর যতটুকু হ্রাস পায় ক্যাথোডের ভর ঠিক ততটুকই বৃদ্ধি পায়, আমাদের মনে হবে অ্যানোড থেকে Cu বুঝি ক্যাথোডে জমা হচ্ছে। কিন্তু ইলেকট্রোড দুটি তামার বদলে অন্য কোনো নিষ্ক্রিয় ধাতুর তৈরি হলে ক্যাথোডে ঠিকই আগের মতো তামার অণু জমা হবে কিন্তু CuSO4 অ্যানোড থেকে Cu নিয়ে CuSO4 হতে পারবে না বলে শুধুমাত্র বাড়তি ইলেকট্রন ত্যাগ করে পানির সাথে বিক্রিয়া করে H2SO4 উৎপন্ন করবে এবং O2 গ্যাস বুদবুদ আকারে বেরিয়ে আসতে থাকবে। ফলে আমরা দেখব দ্রবণের ঘনত্ব ধীরে ধীরে কমে আসছে।
 

১২.২.২ প্রাত্যহিক জীবনে তড়িৎ বিশ্লেষণের গুরুত্ব
 

১. তড়িৎ প্রলেপন (Electroplating) তড়িৎ বিশ্লেষণ করে একটি ধাতুর ওপর অন্য কোনো ধাতুর প্রলেপ দেওয়াকে তড়িৎ প্রলেপন বলে । সাধারণত কোনো কম দামি ধাতু (যেমন তামা, লোহা, ব্রোঞ্জ ইত্যাদি) দিয়ে তৈরি জিনিসকে জলবায়ু থেকে রক্ষা করার জন্য কিংবা সুন্দর দেখানোর জন্য সেগুলোর ওপর সোনা, রুপা, নিকেল এরকম মূল্যবান খাতুর প্রলেপ দেওয়া হয়। যে ধাতব বস্তুটিকে প্রলেপ দিতে হবে, সেটি খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করে ধুয়ে একটি পাত্রে রাখতে হবে। এটি হবে ক্যাথোড ইলেকট্রোড। যে ধাতুর প্রলেপ দিতে হবে তাকে অ্যানোড করা হয়। তড়িৎ দ্রব হিসেবে যে ধাতুর প্রলেপ দিতে হবে, তার কোনো একটি লবণের দ্রবণ ব্যবহার করা হয়। এখন ব্যাটারি বা পাওয়ার সাপ্লাই ব্যবহার করে অ্যানোড থেকে ক্যাথোডে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে ধাতুর তড়িৎ বিশ্লেষণের ফলে ক্যাথোডে রাখা ধাতব বস্তুর ওপর ধাতুর প্রলেপ পড়ে (চিত্র ১২.০৯)।

উদাহরণ হিসেবে ছবিতে কীভাবে রূপার প্রলেপন দিতে হবে সেটি দেখানো হয়েছে।
খাঁটি সিলভারের দন্ড, অ্যানোড আকারে রাখা হয়েছে
Ag-
NO3
AgNO3
যেই বস্তুকে
প্রলেপ দেয়া হবে সেটাকে ক্যাথোড আকার রাখা হয়েছে। এখানে সেটা একটা কাঁটা চামচ
চিত্র ১২.০৯ : তড়িৎ প্রলেপন
 

২. তড়িৎ মুদ্রণ (Electrotyping) তড়িৎ প্রলেপের একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে হরফ, ব্লক মডেল ইত্যাদি তৈরি করাকে তড়িৎ মুদ্রণ বলে। তড়িৎ মুদ্রণের জন্য প্রথমে লেখাটি সাধারণ টাইপে মোমের ওপর ছাপ নেওয়া হয়। এর উপরে কিছু গ্রাফাইট গুঁড়ো ছড়িয়ে একে তড়িৎ পরিবাহী করা হয়। তারপর কপার সালফেট দ্রবণে এটি ক্যাথোড পাত হিসেবে ডুবানো হয় এবং একটি তামার পাতকে অ্যানোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখন দ্রবণের মধ্যে তড়িৎ প্রবাহ চালালে মোমের ছাঁচের ওপর তামার প্রলেপ পড়বে। প্রলেপ খানিকটা পুরু হলে ছাঁচ থেকে ছাড়িয়ে ছাপার কাজে ব্যবহার করা হয়।
 

৩. ধাতু নিষ্কাশন ও শোধন (Extraction and purification of metals)  খনি থেকে কোনো ধাতু সাধারণত বিশুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় না। এদের মধ্যে নানা ধাতুর মিশ্রণ থাকে যাকে আকরিক বলা হয়। তড়িৎ বিশ্লেষণের সাহায্যে আকরিক থেকে সহজে ধাতু নিষ্কাশন এবং শোধন করা যায়। যে আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশন করতে হবে, সেটিকে অ্যানোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যে ধাতু নিষ্কাশন করতে হবে, তার কোনো লবণের দ্রবণকে তড়িৎ দ্রব এবং তার ছোট একটি বিশুদ্ধ পাতকে ক্যাথোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখন দ্রবণের মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ চালনা করলে আকরিক থেকে বিশুদ্ধ ধাতু নিষ্কাশিত হয়ে ক্যাথোডে সঞ্চিত হতে থাকবে।
 

Content added || updated By