নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - প্রাচীন বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৩২৬-১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ) | NCTB BOOK

পাল যুগের অধিকাংশ সময়েই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা স্বাধীন ছিল । তখন এ অঞ্চলটি ছিল বঙ্গ জনপদের অন্তর্ভুক্ত । অষ্টম শতকের মাঝামাঝি থেকে বেশ কিছু রাজবংশের রাজারা কখনো পাল রাজাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীনভাবে তাদের এলাকা শাসন করতেন, আবার কখনো পাল রাজাদের অধীনতা স্বীকার করে চলতেন।

খড়গ বংশ : সপ্তম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মগধ ও গৌড়ে পরবর্তী গুপ্তবংশীয় রাজারা প্রভুত্ব স্থাপন করেন । এ সময় খড়গ বংশের রাজারা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের রাজধানীর নাম ছিল কর্মান্ত-বাসক । কুমিল্লা জেলার বড় কামতার প্রাচীন নামই সম্ভবত এ কর্মান্ত-বাসক । খড়গদের অধিকার ত্রিপুরা ও নোয়াখালী অঞ্চলের ওপর বিস্তৃত ছিল ।

দেব বংশ : খড়গ বংশের শাসনের পর একই অঞ্চলে অষ্টম শতকের শুরুতে দেব বংশের উত্থান ঘটে। এ বংশের চারজন রাজার নাম পাওয়া যায় । এরা হলেন শ্রী শান্তিদেব, শ্রী বীরদেব, শ্রী আনন্দদেব ও শ্রী ভবদেব। দেব রাজারা নিজেদের খুব শক্তিধর মনে করতেন । তাই তাঁরা তাঁদের নামের সাথে যুক্ত করতেন বড় বড় উপাধি । যেমন— পরম সৌগত, পরম ভট্টারক, পরমেশ্বর, মহারাজাধিরাজ ইত্যাদি । তাঁদের রাজধানী ছিল দেবপর্বতে । কুমিল্লার নিকট ময়নামতির কাছে ছিল এ দেবপর্বত । দেবদের রাজত্ব বিস্তৃত ছিল সমগ্ৰ সমতট অঞ্চলে । আনুমানিক ৭৪০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দেব রাজারা শাসন করেন । পাল রাজাদের মতো শক্তিশালী এ দেব রাজারাও ছিলেন বৌদ্ধ।

কান্তিদেবের রাজ্য : দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার হরিকেল জনপদে নবম শতকে একটি স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। এ রাজ্যের রাজা ছিলেন কান্তিদেব । দেব রাজবংশের সঙ্গে কান্তিদেবের কোনো সম্পর্ক ছিল কি-না তা জানা যায় না । তাঁর পিতা ছিলেন ধনদত্ত ও পিতামহ ভদ্রদত্ত । বর্তমান সিলেট কান্তিদেবের রাজ্যভুক্ত ছিল। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল বর্ধমানপুর। বর্তমানে এ নামে কোনো অঞ্চলের অস্তিত্ব নেই। এ সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চন্দ্র বংশ বলে পরিচিত নতুন এক শক্তির উদয় হয় । কান্তিদেবের গড়া রাজ্যের পতন হয় এ চন্দ্র বংশের হাতে ।

চন্দ্ৰ বংশ : দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী স্বাধীন রাজবংশ ছিল চন্দ্র বংশ। দশম শতকের শুরু থেকে এগারো শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত দেড়শ' বছর এ বংশের রাজারা শাসন করেন। চন্দ্রবংশের প্রথম নৃপতি পূর্ণচন্দ্র ও তার পুত্র সুবর্ণচন্দ্র রোহিতগিরির ভূস্বামী ছিলেন। সুবর্ণচন্দ্রের পুত্র ত্রৈলোক্যচন্দ্রই এ বংশের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উপাধি ছিল 'মহারাজাধিরাজ' । ত্রৈলোক্যচন্দ্র হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ (বরিশাল ও পার্শ্ববর্তী এলাকা), বঙ্গ ও সমতট অর্থাৎ সমগ্র পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় নিজ বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন । লালমাই পাহাড় ছিল চন্দ্র রাজাদের মূল কেন্দ্র । এ পাহাড় প্রাচীনকালে রোহিতগিরি নামে পরিচিত ছিল । আনুমানিক ত্রিশ বছরকাল (৯০০-৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি রাজত্ব করেন ।

ত্রৈলোক্যচন্দ্রের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন তাঁর পুত্র শ্রীচন্দ্র। তাঁর শাসনামলে চন্দ্র বংশের প্রতিপত্তি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে। নিঃসন্দেহে তিনি বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন। তিনি ‘পরমেশ্বর পরম ভট্টারক মহারাজাধিরাজ' উপাধি ধারণ করেছিলেন । তাঁর রাজ্য দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা ছাড়াও উত্তর-পূর্ব কামরূপ ও উত্তরে গৌড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে তিনি তাঁর রাজধানী গড়ে তোলেন। শ্রীচন্দ্র প্রায় ৪৫ বছর (আনু. ৯৩০-৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) শৌর্যবীর্যের সঙ্গে রাজত্ব করেন । শ্রীচন্দ্রের পুত্র কল্যাণচন্দ্র (আনু. ৯৭৫-১০০০ খ্রিষ্টাব্দ) ও পৌত্র লডহচন্দ্র (আনু. ১০০০-১০২০ খ্রিষ্টাব্দ) চন্দ্র বংশের গৌরব অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন । লডহচন্দ্রের পুত্র গোবিন্দচন্দ্র ছিলেন শেষ চন্দ্র রাজা । তাঁর রাজত্বকালে চোলরাজ রাজেন্দ্র চোল ও কলচুরিরাজ কর্ণ বঙ্গ আক্রমণ করেন । এই দুই বৈদেশিক আক্রমণ চন্দ্র রাজার ক্ষমতা হ্রাস করে তাদের শাসনের পতন ঘটায় ।

বর্ম বংশ : এগারো শতকের শেষভাগে পাল রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় বর্ম উপাধিধারী এক রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয় । বঙ্গদেশে যিনি এ বংশের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি হলেন বজ্রবর্মার পুত্র জাতবর্মা । কলচুরিরাজ কর্ণের সাথে বর্মরা এদেশে এসেছিল বলে ধারণা করা হয় । পিতার মতো প্রথম দিকে তিনিও ছিলেন কলচুরিরাজ গাঙ্গেয়দেব এবং কর্ণের সামন্তরাজ। কৈবর্ত বিদ্রোহের সময় তিনি শ্বশুর কলচুরিরাজ কর্ণের সাহায্য ও সমর্থনে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন । বর্মদের রাজধানী ছিল বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর । জাতবর্মার পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র হরিবর্মা একটানা ৪৬ বছর রাজত্ব করেন । পাল রাজাদের সঙ্গে তিনি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন ।

Content added By