নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - দেখতে হলে আলো চাই | NCTB BOOK

চিত্র ৫.০৭: আমরা কীভাবে দেখি

৫.৪.১ আমরা কীভাবে দেখতে পাই

তোমরা অষ্টম শ্রেণিতে চোখের গঠন সম্পর্কে জেনেছ। বর্তমান পাঠে চোখের ক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা কীভাবে দেখতে পাই (চিত্র ৫.০৭) সেটি আলোচনা করা হবে।

চোখের উপাদানগুলোর মাঝে রয়েছে রেটিনা, চোখের লেন্স, অ্যাকুয়াস হিউমার, ভিট্রিয়াস হিউমার এবং কর্নিয়া। তোমরা লেন্স কীভাবে কাজ করে তার একটি ধারণা পেয়েছ। তাই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ চোখের লেন্সও একটি অভিসারী লেন্সের মতো কাজ করে। আমরা দেখেছি, উত্তল বা অভিসারী লেন্স সবসময় উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরি করে। ক্যামেরায় ছবি তোলার জন্য এভাবে প্রতিবিম্ব তৈরি করা হয়। যখনই আমাদের সামনে কোনো বস্তু থাকে, তখন ঐ বস্তু থেকে আলোকরশ্মি এই লেন্স দ্বারা প্রতিসারিত হয় এবং রেটিনার ওপর একটি উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরি করে। রেটিনার ওপর আলো পড়লে স্নায়ুর সাথে সংযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রড এবং কোণ কোষগুলো সেই আলো গ্রহণ করে তাকে তড়িৎ বা বিদ্যুৎ সিগন্যালে পরিণত করে। স্নায়ু এই বিদ্যুৎ বা তড়িৎ সিগন্যালকে তাৎক্ষণিকভাবে অপটিক নার্ভ বা অক্ষি স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠায়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কোণকোষগুলো তীব্র আলোতে সাড়া দেয় এবং রঙের অনুভূতি ও রঙের পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়। অন্যদিকে রডকোষগুলো খুব কম আলোতে সংবেদনশীল হয়। এ জন্য জ্যোৎস্নার অল্প আলোতে আমরা “রড” কোষগুলোর কারণে দেখতে পাই কিন্তু কোনো রং বুঝতে পারি না। মস্তিষ্ক রেটিনায় সৃষ্ট উল্টো প্রতিবিম্বকে সোজা করে নেয় বলে আমরা বস্তুটি যে রকম থাকে সেরকমই দেখি ।

৫.৪.২ স্পষ্ট দৃষ্টির ন্যূনতম দূরত্ব

স্বাভাবিক চোখের খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা সীমাহীন নয়। মানুষ তার চোখের লেন্সে ফোকাস দূরত্ব বাড়িয়ে বা কমিয়ে একটা বস্তুকে সব সময় স্পষ্ট দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু লক্ষ্যবস্তু চোখের কাছাকাছি একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে বেশি কাছে এলে আর স্পষ্ট দেখা যায় না। চোখের সবচেয়ে কাছে যে বিন্দু পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুকে খালি চোখে স্পষ্ট দেখা যায়, তাকে স্পষ্ট দৃষ্টির নিকট বিন্দু বলে এবং চোখ থেকে ঐ বিন্দুর দূরত্বকে স্পষ্ট দৃষ্টির ন্যূনতম দূরত্ব ধরে নেওয়া হয় । এই দূরত্ব মানুষের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। একজন শিশুর এই দূরত্ব ৫ সেন্টিমিটারের কাছাকাছি এবং একজন স্বাভাবিক বয়স্ক লোকের এই দূরত্ব ২৫ সেমি পর্যন্ত হতে পারে। দূর বিন্দু চোখ থেকে অসীম দূরত্বে অবস্থান করে। এ কারণে আমরা বহুদূরের নক্ষত্রও খালি চোখে দেখতে পারি।

৫.৪.৩ চোখের ত্রুটি এবং তার প্রতিকার

তোমাদের কি চোখের সমস্যা সম্পর্কে ধারণা আছে? এ পাঠে আমরা চোখের বিভিন্ন ত্রুটি এবং তাদের প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করব।

আমরা জানি, সুস্থ এবং স্বাভাবিক চোখ “নিকট বিন্দু” (Near point) থেকে শুরু করে অসীম দূরত্বের দূর বিন্দুর মাঝখানে যে স্থানেই কোনো বস্তু থাকুক না কেন সেটা স্পষ্ট দেখতে পারে। এটাই চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি। এই স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ব্যাহত হলেই তাকে চোখের দৃষ্টির ত্রুটি বলা হয়।চোখের দৃষ্টির অনেক ধরনের ত্রুটি থাকলেও আমরা প্রধান দুটি ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করব। সেই দুটি

(ক) হ্রস্বদৃষ্টি বা ক্ষীণদৃষ্টি (Myopia or shortsightedness)

(খ) দীর্ঘদৃষ্টি বা দুরদৃষ্টি ( Hypermetropis or farsightedness)

 

হ্রস্বদৃষ্টি বা ক্ষীণদৃষ্টি (Myopia)

যখন চোখ কাছের বস্তু দেখতে পায় কিন্তু দূরের বস্তু দেখতে পায় না, তখন চোখের এই জুটিকে হ্রস্বদৃষ্টি বলে। এরূপ চোখের দূর বিন্দুটি অসীম দূরত্ব অপেক্ষা খানিকটা নিকটে থাকে এবং বস্তুকে স্পষ্ট দৃষ্টির ন্যূনতম দূরত্ব হতে আরও কাছে আনলে অধিকতর স্পষ্ট দেখায়। নিম্নলিখিত দুটি কারণে এই ত্রুটি হয়ে থাকে।

১. চোখের লেন্সের অভিসারী শক্তি বৃদ্ধি পেলে বা ফোকাস দূরত্ব কমে গেলে এ

২. কোনো কারণে অক্ষিগোলকের ব্যাসার্ধ বৃদ্ধি পেলে।

এর ফলে দূরের বস্তু থেকে আসা আলোকরশ্মি চোখের লেন্সের মধ্য দিরে প্রতিসরণের পর রেটিনার উপরে প্রতিবিম্ব তৈরি না করে একটু সামনে (F) প্রতিবিম্ব তৈরি করে (চিত্র ৫.০৮)। ফলে চোখ বস্তুটি স্পষ্ট দেখতে পায় না ।

প্রতিকার : এই ত্রুটি দূর করার জন্য এমন একটি অবতল লেন্সের চশমা ব্যবহার করতে হবে, যার ফোকাস দূরত্ব হ্রস্বদৃষ্টির দীর্ঘতম দূরত্বের সমান। চশমার এই লেন্সের অপসারী ক্রিয়া চোখের উত্তল লেন্সের অভিসারী ক্রিয়ার বিপরীত কাজেই চোখের ফোকাস দূরত্ব বেড়ে যাবে বলে প্রতিবিম্বটি আরো পিছনে তৈরি হবে। অর্থাৎ অসীম দূরত্বের বন্ধু থেকে আসা সমান্তরাল আলোকরশ্মি চশমার অবতল লেল L (চিত্র ৫.০৮) এর মধ্য দিয়ে চোখে পড়ার সময় প্রয়োজনমতো অপসারিত হয়। এই অপসারিত রশ্মিগুলো চোখের লেলে প্রতিসারিত হয়ে ঠিক রেটিনা বা অক্ষিপট R-এর ওপর স্পষ্ট প্রতিবিম্ব তৈরি করে।

চিত্র ৫.০৯: দীর্ঘদৃষ্টি ও তার প্রতিকার

দীর্ঘদৃষ্টি বা দূরদৃষ্টি (Hypermetropia)

যখন কোনো চোখ দূরের বস্তু দেখে কিন্তু কাছের বস্তু দেখতে পায় না, তখন এই জুটিকে দীর্ঘদৃষ্টি বলে। সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে এই জুটি দেখা যায়। নিম্নলিখিত দুটি কারণে এই ত্রুটি ঘটে।

১. চোখের লেন্সের অভিসারী ক্ষমতা হ্রাস পেলে অথবা চোখের লেন্সের ফোকাস দূরত্ব বেড়ে গেলে।

২. কোনো কারণে অক্ষিগোলকের ব্যাসার্ধ কমে গেলে।

এর ফলে দূর থেকে আসা আলো সঠিকভাবে চোখের রেটিনাতে প্রতিবিম্ব তৈরি করলেও কাছাকাছি বিন্দু থেকে আসা আলোকরশ্মি চোখের লেন্সের মধ্য দিয়ে প্রতিসরণের পর রেটিনার ঠিক উপরে না হয়ে পিছনে (F) বিন্দুতে মিলিত হয় (চিত্র ৫.০৯)। ফলে চোখ কাছের বস্তু স্পষ্ট দেখতে পায় না।

প্রতিকার : এই ত্রুটি দূর করার জন্য একটি উত্তল লেন্সের চশমা ব্যবহার করতে হবে। ফলে কাছাকাছি বিন্দু (চিত্র ৫.০৯) থেকে আসা আলোকরশ্মি চশমার লেন্সে এবং চোখের লেলে পর পর দুইবার প্রতিসারিত হওয়ার কারণে ফোকাস দূরত্ব কমে যাবে এবং প্রয়োজনমতো অভিসারী হয়ে প্রতিবিম্বটি রেটিনা (R)-এর উপরে পড়বে।

৫.৪.৪ চোখ ভালো রাখায় উপায়

আমাদের চোখ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এটির যথাযথ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন যেন এটিকে ত্রুটিমুক্ত রাখা যায়। বিভিন্ন উপায়ে আমাদের চোখকে ভালো রাখা যায়। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কথা বলা যেতে পারে :

(ক) সঠিক পুষ্টি গ্রহণ চোখের জন্য খুবই দরকারি। ভিটামিন এ, সি ও ই সমৃদ্ধ খাবার; ফ্যাটি এসিড যুক্ত খাবার, জিংকসমৃদ্ধ খাবার, গাঢ় সবুজ শাকসবজি ও বিভিন্ন ফল চোখের জন্য খুবই ভালো। এ ধরনের খাবার চোখকে রোগমুক্ত রাখতে সহায়তা করে। গাজর, মাছ, ব্রকলি, গম, মিষ্টি কুমড়া, হলুদ (যেমন, পাকা পেঁপে, আম) ফল ইত্যাদি বেশি করে খেতে হবে।

(খ) চোখের সঠিক যত্নের জন্য সঠিক জীবনধারণ পদ্ধতি মেনে চলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সারা দিনের পরিশ্রমের পর শরীরের মতো চোখও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। চোখকে পুনরায় সতেজ করতে সারা রাত ঘুমানো প্রয়োজন। তাই এই নির্ধারিত সময় ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপানও চোখের ক্ষতি করে। তাই ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। কেউ যদি রোদ থেকে চোখকে রক্ষা করার জন্য সানগ্লাস ব্যবহার করতে চায় তাহলে অবশ্যই অতিবেগুনি রশ্মি প্রতিহত করতে পারে এমন সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে। তেল দিয়ে রান্না করার সময় কিংবা ঝালাইয়ের কাজ করার সময় যখন উত্তপ্ত কণা ছিটকে আসে, তখন খুব সাবধান থাকতে হবে। তাছাড়া কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করার সময় চোখ রক্ষা করার সেফটি গ্লাস পরা বুদ্ধিমানের কাজ।

(গ) আবছা বা অপর্যাপ্ত আলোতে কাজ করলে সবকিছু চোখের খুব কাছে এনে দেখতে হয়, সেটি চোখের জন্য ক্ষতিকর। ঘরের আলো পর্যাপ্ত রাখতে হবে যেন পড়তে অসুবিধা না হয়। চোখকে যখন ক্লান্ত মনে হবে, তখন না পড়ে বিশ্রাম নেওয়া ভাল। আমাদের চোখের স্পষ্ট দর্শনের ন্যূনতম দূরত্ব থেকে কম বা বেশি দূরত্বে রেখে বই পড়লে চোখে চাপ পড়ে। তাই সঠিক দূরত্বে রেখে বই পড়তে হয়। তুমি হয়তো খেয়াল করেছ অনেকক্ষণ ধরে কম্পিউটার ব্যবহার করলে চোখ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘক্ষণ টেলিভিশন দেখা বা কম্পিউটার ব্যবহারে চোখের ক্ষতি হয়। তাই এই ক্ষতি থেকে চোখকে রক্ষা করতে নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে এবং বিরতি দিয়ে টেলিভিশন দেখা বা কম্পিউটার ব্যবহার করা উচিত।

Content added By