SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান - History & Social Science - NCTB BOOK

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ

এই শিখন অভিজ্ঞতায় আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের বিষয়টি তুলে ধরব। আমরা পাঠ্যপুস্তকে প্রদত্ত তথ্য এবং এলাকার মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানেন এমন কোনো বয়স্ক ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করব। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এরপর আমরা ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থান থেকে আমাদের করণীয় কী কী তা নির্ধারণ করব। সবশেষে আমরা ছাব্বিশে মার্চের দিন 'বঙ্গবন্ধু মেলা'র আয়োজন করে বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের ঘটনার উপর কেস স্টাডি তৈরি করে উপস্থাপন করব।

দলগত কাজ ১ 

 

আমরা ৫ থেকে ৬ জনের দল গঠন করি। এরপর আমরা দলে বসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ নিয়ে আলোচনা করে একটি প্রবন্ধ/কবিতা/ছবি/দেয়ালিকা তৈরি করব।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ

 

 

 

 

আমরা ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি। এই শিখন অভিজ্ঞতায় আমরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নতুন কিছু তথ্য জানতে পারব। আমরা জানব বঙ্গবন্ধু কীভাবে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ এবং স্বাধীনতার চেতনা সমগ্র বাঙালির মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে জানব জীবনের পরতে পরতে বঙ্গবন্ধু যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা উপস্থাপন করে আমরা সব সময় ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দেব। চলো, তাহলে আমাদের এই মহান নেতা ও দেশপ্রেমীককে নিয়ে আমরা কিছু তথ্য জেনে নিই।

বঙ্গবন্ধু' ও 'বিশ্ববন্ধু'। চারটি শব্দই আমাদের সকলের কাছে পরম ভালোবাসার। একটা মজার বিষয় লক্ষ করে দেখতে পারো যে চারটি শব্দ বলা হয়েছে, তার প্রতিটি 'ব' অক্ষর দিয়ে শুরু। আজকের আলাপে প্রসঙ্গক্রমে 'ব' দিয়ে শুরু আরো একটি শব্দ আমাদের ব্যবহার করতে হবে- 'বঙ্গীয় ব-দ্বীপ'। এই শব্দগুলোর মধ্যেকার ঐতিহাসিক সংযোগ ও সম্পর্ক খুঁজে দেখার মাধ্যমে 'বঙ্গ' থেকে 'বাংলাদেশ' এবং 'বঙ্গবন্ধু' থেকে 'বিশ্ববন্ধু'তে রূপান্তরের ইতিহাস আমরা অনুসন্ধান করে দেখব। অনুসন্ধানের কাজ করতে গিয়ে বাংলা অঞ্চলে হাজার বছরে গড়ে ওঠা মানবতাবাদী চেতনার কিছু উদাহরণ খুঁজে বের করা হবে এবং সেই চেতনার ধারক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও মানুষের মুক্তির জন্য তাঁর লড়ায়ের দৃষ্টান্তমূলক কিছু উদাহরণ অনুধাবনের চেষ্টা করা হবে। বাংলার আঞ্চলিক সীমানার বাইরেও বিশ্বের সকল নিপীড়িত-নিষ্পেষিত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। তাই তো ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্বশান্তি পরিষদ কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে সম্মানজনক 'জোলিও কুরি' পদক প্রদান করা হয় এবং তাঁকে ভূষিত করা হয় 'বিশ্ববন্ধু' অভিধায়। শেখ মুজিবুর রহমানের 'ব্যক্তিত্ব' এবং তাঁর 'বঙ্গবন্ধু' ও 'বিশ্ববন্ধু' উপাধির সঙ্গে আমাদের 'বঙ্গ' ভূখণ্ডের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের রয়েছে গভীর যোগসূত্র বা সংযোগ। বাংলা অঞ্চলের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং মাটি-কাদা-পানি আর সবুজের ঘেরা ভূ-প্রকৃতি থেকে প্রয়োজনমতো উদাহরণ নিয়ে আমাদের আলাপ ও অনুসন্ধান এগিয়ে যাবে।

বাংলা অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিবেশ ও কয়েকটি প্রশ্ন

একটি স্বাধীন রাষ্ট্র অভ্যুদয়ের ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসের চূড়ান্ত পর্যায়ে একজন ব্যক্তির ভূমিকা বিশ্লেষণ করার আলাপে ভৌগোলিক বিষয়াবলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কারণ সাধারণত প্রাকৃতিক সীমানাবিধৃত কোনো একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক অংশে বা অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে বসতি স্থাপনকারী একদল মানুষ ইতিহাসের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বহু বিচিত্র চ্যালেঞ্জ বা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে অর্জিত সামষ্টিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ধীরে ধীরে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি রচনা করে থাকে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব গঠনেও ভূগোলের প্রভাব অনস্বীকার্য। তাই বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের ইতিহাস অনুসন্ধানের শুরুতেই একটি ভূখণ্ড নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সেই ভূখণ্ডের ভৌগোলিক প্রতিকূলতা ও বৈশিষ্ট্যগুলো জানা প্রয়োজন। প্রয়োজন প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার যোগ্যতাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা। আঞ্চলিক ভূখণ্ডটির ভৌগোলিক সম্ভাবনাগুলোকেও খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

ভারতবর্ষের পূর্বাংশের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত প্রাকৃতিক সীমানাবেষ্টিত একটি আঞ্চলিক ভূখণ্ড বাংলা। এই অঞ্চলেরই দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পৃথিবীর বৃহত্তর ব-দ্বীপ অবস্থিত। গঙ্গা নদীর দুটি প্রবাহের নাম ভাগীরথী ও পদ্মা। ভাগীরথী বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর পদ্মা বাংলাদেশের মধ্যে। গঙ্গার এই দুটি প্রবাহপথের অন্তর্বর্তী ভূ-ভাগ বঙ্গীয় ব-দ্বীপ নামে সারা পৃথিবীতে পরিচিত। এই ব-দ্বীপসহ গোটা বাংলা অঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও বিচিত্র সব জলাশয়।

মানচিত্র: আঞ্চলিক বাংলা ও বাংলাদেশ (১৩০০ সাল বা সাধারণ অব্দ পর্যন্ত)

যাই হোক, একদিকে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা এবং অন্যদিকে ক্ষমতাবান অত্যাচারী শাসকের নানান প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে এই বাংলা অঞ্চলের সাধারণ মানুষেরা প্রায় দুই হাজার বছর কাটিয়েছে, ভূখন্ডটির কোনো একক রাজনৈতিক পরিচয় তখন ছিল না। ছিল না সুনির্দিষ্ট কোনো সীমানা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য নাম-পরিচয় গড়ে তোলা হয়েছিল। সেগুলোরও কোনো সীমানা খুঁজে পাওয়া যায় না। নানান মানুষের বহুমাত্রিক কর্মকান্ড, নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর সমন্বয়ের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলা অঞ্চলের মানুষেরা সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতি সচেতন হতে থাকে। হাজার বছরের দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম বাংলার কাদামাটি আর পানির ভৌগোলিক প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে ওঠে এসে সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। সফল হয়েছেন। বাংলা অঞ্চলের পূর্বাংশের সুনির্দিষ্ট একটি ভূখন্ডে ১৯৭১ সালে 'বাংলাদেশ' নামে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র নির্মাণ করেছেন। ভাষা-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং সকল নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই চালিয়ে যাবার কারণে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুকে 'বিশ্ববন্ধু' অভিধায় অভিহিত করা হয়েছে।

বঙ্গ, বাংলা, বাংলাদেশ- স্থান ও নামের বিবর্তন

বর্তমান আলাপে 'বাংলাদেশ' বলতে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র, 'বঙ্গ' বলতে প্রাচীন বাংলার ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক ইউনিট বা জনপদ এবং 'বাংলা' বা 'বেঙ্গল' বলতে একটি ভৌগোলিক একক বা "অঞ্চল' বা 'ভৌগোলিক সত্তা'কে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। 'বাংলা' নাম-পরিচয় মূলত ১৯৪৭-পূর্ব সময়, পরিস্থিতি এবং স্থানিক পরিচিতি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক পরিচিতির আওতাভুক্ত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা প্রদেশ এবং ঝাড়খন্ড, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, ও মেঘালয় প্রদেশগুলোর অংশবিশেষ। মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলার এই আঞ্চলিক ভূখণ্ডেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত এই ভূখণ্ডে জাতি ও রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। স্থানিক এবং কালিক প্রেক্ষাপটে যেমন সীমানাগত হেরফের ঘটেছে, ঠিক তেমনই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে, বিভিন্ন সময়ে এই ভূখন্ড এবং ভূখণ্ডের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন 'পরিচিতি' গড়ে উঠেছে।

আলোচ্য বাংলা ভূখন্ডটি ভূ-প্রাকৃতিক গঠনগত প্রক্রিয়ায় তৈরি এবং এই গঠনে মানুষের কোনো হাত ছিল না। এর একদিকে সুউচ্চ পর্বত, দুই দিকে কঠিন শৈলভূমি, একদিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র এবং মাঝখানে সমভূমির সাম্য। দেখতে অনেকটা পিরিচের মতো ভূ-প্লেটটি দক্ষিণ দিকে কিছুটা ঢালু। ফলে তিন দিকের পাহাড় বেয়ে নেমে আসা জলরাশি সহজেই দক্ষিণের সমুদ্রে গিয়ে পতিত হয়। ভূ-গঠনপ্রক্রিয়া এ অঞ্চলে এনেছে বৈচিত্রা। তিন দিকে উঁচু পাহাড়ি লাল মাটির বন্ধনীর মধ্যে দক্ষিণে ঢালু ভূ-ভাগটির একটি বড় অংশ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-

মেঘনার বিপুল জলরাশি দ্বারা বয়ে আসা পলি গঠিত প্লাবন সমভূমি, যেখানে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ অবস্থিত। নীহাররঞ্জন রায়ের ভাষায়:

'এই প্রাকৃতিক সীমাবিধৃত ভূমি-খণ্ডের মধ্যেই প্রাচীন বাংলার গৌড়-বরেন্দ্র-রাঢ়-সুহ্ম-তাম্রলিপ্তি- সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল প্রভৃতি জনপদ; ভাগীরথী-করতোয়া-ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা-মেঘনা এবং আরও অসংখ্য নদ-নদী বিধৌত বাংলার গ্রাম, নগর-প্রান্তর, পাহাড়, কান্তার। এই ভূখণ্ডই ঐতিহাসিককালের বাঙালির কর্মকৃতির উৎস এবং ধর্ম-কর্ম-নর্মভূমি।'

ইতিহাসের অসম গতি

ইতিহাসের অসম গতি মানে হলো নদী বা জঙ্গলের কারণে বিচ্ছিন্ন এলাকায় বা উপ-অঞ্চলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ভিন্নতা। বাংলা অঞ্চল বড়ো বড়ো নদীর কারণে অন্তত ৪টি উপ-অঞ্চলে বিভক্ত। এই উপ- অঞ্চলগুলোতে মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতি গঠনের অভিজ্ঞতা আলাদা। কোনো একটি অংশে মানুষ নিড়ানি দিয়ে কৃষিকাজ করছে তো অপর কোনো অংশে মানুষ হয়তো তখনো কৃষিকাজই শেখেনি। কোনো একটি অংশে নগররাষ্ট্র গড়ে উঠেছে কিন্তু অন্য কোনো অংশে হয়তো তখনো চলছে কৌমভিত্তিক অর্থাৎ গোত্রভিত্তিক জীবন। এক অংশে মুদ্রার প্রচলন ঘটেছে কিন্তু অন্য অংশে হয়তো তখনো মানুষ মুদ্রা চোখেই দেখেনি। ইতিহাসের অসম গতি শিখতে গিয়ে তোমাদের নিশ্চয়ই এখন ধারণা হয়েছে যে, সরলীকরণ করে যখন যুগ বিভাজন করা হয় তখন তা ইতিহাস সম্পর্কে নানান ভ্রান্তি তৈরি করতে বাধ্য। বাংলার উপ-অঞ্চলগুলোতে বসতি স্থাপনকারী মানুষের জীবনের ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় না নিয়ে গোটা অঞ্চলটিকে এক করে দেখানো এবং একই যুগের অধীনে অঞ্চলটির সবখানে একই রকম অগ্রগতি ঘটেছে তা লেখা বা বর্ণনা করা ইতিহাসের ব্যত্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়

পরিচয় গঠনের আদিপর্ব: বাংলা অঞ্চলে প্রাণ-প্রকৃতির বোঝাপড়া

হাজার বছর ধরে 'বঙ্গ' এবং 'বঙ্গাল' নাম-পরিচয়টি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাচীনকালে বাংলা অঞ্চলের খণ্ড খণ্ড অংশ শাসনকারী শাসকের অসংখ্য দলিলে এবং গ্রন্থে 'বঙ্গ' নামের উল্লেখ আছে। কিন্তু এর স্পষ্ট কোনো সীমানার উল্লেখ নেই। দক্ষিণ ভারতের চোল রাজাদের লিপিসহ আরো বেশ কয়েকটি উৎসে 'বঙ্গাল' নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নাম-পরিচয়ের পাশাপাশি এই দুটি নাম দীর্ঘদিন টিকে থেকেছে।

মানচিত্র: বাংলা অঞ্চল, ব্রিটিশ বাংলা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়

পরিচয় গঠনের মধ্যপর্ব: বাঙ্গালা থেকে বেঙ্গল (বাংলা)

মধ্যযুগে 'গৌড়' এবং 'বঙ্গ' সত্তার পৃথক পরিচয় গড়ে ওঠে 'লখনৌতি' এবং 'সোনারগাঁও' নামের ভিন্ন প্রশাসনিক পরিচয়ের আদলে। এ সময় 'সাতগাঁও' নামেও পৃথক একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র তার বিশেষ পরিচিতি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গ ও গৌড় নামের প্রভাব-প্রতিপত্তি তখনও বজায় ছিল। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝিতে পারস্য (ইরান) থেকে আগত শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলার প্রায় সমগ্র এলাকা দখল করে 'বাঙ্গালাহ' নামের প্রাতিষ্ঠানিক প্রবর্তন ঘটান। এভাবে 'বঙ্গ' থেকে 'বঙ্গাল' এবং 'বঙ্গাল' থেকে 'বাঙ্গালা' নামের উৎপত্তি হয়। দিল্লির দরবারি ইতিহাসবিদ শামস-ই-সিরাজ আফিফ সুলতান ইলিয়াস শাহকে 'শাহ- ই-বাঙ্গালাহ', 'শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান' এবং 'সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ্' পরিচয়ে আখ্যায়িত করেন। এই বাঙ্গালার আইনগত সীমানা নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। কেননা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজবংশ ও রাজার ক্ষমতা বলয়ের সংকোচন ও সম্প্রসারণ ঘটে।

১৬ ও ১৭ শতকে পর্তুগিজদের বদৌলতে ইউরোপীয় লেখকদের কাছে বাংলা অঞ্চলের কিছু অংশ 'বেঙ্গালা' নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ভারথেমা (১৫১০), বারবোসা (১৫১৪) এবং জাও দ্য ব্যারোসের (১৫৪০-১৫৫০) বর্ণনায় 'বেঙ্গালা' রাজ্য ও শহরের উল্লেখ রয়েছে। সিজার ফ্রেডারিক (১৫৬৩-১৫৮১), রালফ ফিচ (১৫৮৬) প্রমুখও 'বেঙ্গালা' রাজ্যের অস্তিত্বের কথা লিখেছেন। সমসাময়িক মানচিত্রেও (যেমন রেনেল, ফানডেন ব্রোক প্রমুখ নির্দেশিত মানচিত্র) 'বেঙ্গা লা' রাজ্য বা শহরের অস্তিত্বের চিত্র আঁকা হয়েছে। পর্তুগীজদের দেয়া 'বেঙ্গালা' ইংরেজদের সময়ে 'বেঙ্গল' নামে রূপান্তরিত হয়। ১৯০৫ সালে নানাবিধ ঘটনা পরম্পরায় এই 'বেঙ্গল'কে দ্বি- খণ্ডিত করা হয় যা ইতিহাসে 'বঙ্গভঙ্গ' নামে পরিচিত। বঙ্গর এই ভঙ্গ বেশিদিন টেকেনি, ১৯১১ সালে গোটা অঞ্চলটিকে 'বেঙ্গল' নামে পুনরায় পরিচিতি দেওয়া হয়।

পরিচয় গঠনের সর্বশেষ পর্যায়: বাংলা থেকে বাংলাদেশ

বেঙ্গালাহ নামটি ১৮-২০ শতকে ব্রিটিশদের হাতে 'বেঙ্গল' নামে রূপান্তরিত হয়। এই বেঙ্গল কখনো হয়েছে 'ইস্ট বেঙ্গল' আবার কখনো 'ওয়েস্ট বেঙ্গল'। ইতিহাসের তথ্যপ্রবাহ একটি বিষয় স্পষ্ট করে জানা যায় আর তা হলো বঙ্গ থেকে বেঙ্গল নাম-পরিচয় বিবর্তন আর রূপান্তরের প্রায় দুই হাজার বছরের ইতিহাসে কখনোই বাংলার সুনির্দিষ্ট সীমানা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। এ কারণেই ভারতবর্ষের সর্বপূর্বপ্রান্তের প্রাকৃতিক সীমানা বিধৃত একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকে 'বাংলা অঞ্চল' হিসেবে ভূগোলবিদ এবং ইতিহাসবিদগণ বিবেচনা করে থাকেন। এই বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অংশীদার-জনগোষ্ঠীর একটি অংশ অঞ্চলটির পূর্বাংশে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম 'বাংলাদেশ' রাষ্ট্র-পরিচয়ের জন্ম দিয়েছে। বাংলা ভূখণ্ডের হাজার বছরের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে স্বাধীন 'বাংলাদেশ'-এর অভ্যুদয় ঘটে, বঙ্গ থেকে 'বাংলাদেশ' নির্মাণ প্রক্রিয়ার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় এভাবেই রচিত হয়। আর এই পর্যায়েই সম্ভবত প্রথমবারের মতো জনমানুষের ব্যাপক ও বিপুল অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়।

'বঙ্গবন্ধু' থেকে 'বিশ্ববন্ধু': মানবতাবাদী সুর ও সংযোগ সন্ধান

'বঙ্গ' ও 'বাংলাদেশ' এক ঐতিহাসিক কালপরিক্রমা ও কার্যকারণ সূত্রে গ্রথিত। এই মন্তব্যেও কোনো অতিশয়োক্তি নেই যে, এই ঐতিহাসিক বাস্তবতার সর্বশেষ ধাপটির সঙ্গে যে ব্যক্তি-নামের রয়েছে প্রধান সংযোগ তিনি হলেন 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসের ঊষালগ্নে ভূ-প্রাকৃতিক সীমানাবেষ্টিত জল-জঙ্গল সমন্বিত বিরল এই ভূখণ্ডে বহু-বিচিত্র চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে একদল মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং ক্রমান্বয়ে সমাজ-সংস্কৃতি রচনার পথে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। এই পদক্ষেপ গ্রহণের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় বঙ্গ ও বাংলার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের যে লক্ষণসমূহ ও সুরের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের 'ব্যক্তিত্ব', ও 'নেতৃত্ব'-এর কোনো ঐতিহাসিক সংযোগ রয়েছে কিনা এ পর্যায়ে তা অনুসন্ধান করে দেখা যাক। অনুসন্ধানের এই কাজ করার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ৩টি গ্রন্থ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গ্রন্থ তিনটির নাম 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', 'কারাগারের রোজনামচা', এবং 'আমার দেখা নয়াচীন'।

বঙ্গবন্ধু তাঁর গোটা জীবন তিন ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও পরিচিতির অধীনে অতিবাহিত করেছেন। এগুলো হলো ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাজনৈতিক পরিচিতি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পরিচিতির এই তিন ধাপেই বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল দ্বন্দ্বমুখর এবং প্রতিনিয়ত ভাঙা-গড়া ও বাঁক বদলে সক্রিয়। উপরে উল্লিখিত তিনটি গ্রন্থ এবং অগণিত ভাষণগুলোর বঙ্গবন্ধু বলেছেন, তিনি সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্য থেকে মানুষের মুক্তির জন্য রাজনীতি করেন। বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেই তিনি তা করার চেষ্টা করেছেন। আর একজন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ হিসেবে মুক্তির পথও সেই কাঠামোর মধ্যেই খুঁজেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ধারাবাহিক চিত্র অঙ্কন করলে তৎকালীন বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোগুলির সঙ্গে তাঁর প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে বাংলা অঞ্চলে বিদ্যমান 'অসাম্প্রদায়িক' ও 'মানবতাবাদী' সুরের যে ইঙ্গিত ইতোমধ্যেই বর্ণনা করা হয়েছে, তা বঙ্গ বা বাংলা ভূখণ্ডের জল-বৃষ্টি-মাটি-কাদার সঙ্গে মিলেমিশে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধুর 'ব্যক্তিত্বে' সব সময়ই ধারাবাহিকভাবে বজায় থেকেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের তিনটি পর্যায়কে কয়েকটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে কালানুক্রমিকভাবে খুব সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। কালানুক্রমিকভাবে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের প্রয়াস এই কারণে যাতে করে তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বঙ্গের উল্লিখিত আঞ্চলিক 'সুর' ও 'লক্ষণ'-গুলোর সংযোগ এবং তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা- চেতনার নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ অনুধাবন করা যায়। এই অনুসন্ধানের ভিত্তি হিসেবে অন্যান্য উৎসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু রচিত তিনটি গ্রন্থ এবং বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত তাঁর ভাষণসমূহকেই মূলত নিবিড় পাঠ এবং সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রথম পর্যায় (১৯২১-১৯৪৭)

শেখ মুজিবুর রহমান-এর জীবনে প্রথম রাজনৈতিক চিন্তার উপস্থিতি লক্ষ করা যায় ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৬। স্বদেশি আন্দোলনের রেশ তখনো রয়ে গেছে। এই আন্দোলন ও সুভাষ বোসের আদর্শে তিনি অনুপ্রাণিত। সময়টা ১৯৩৬ সাল। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজশক্তিবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, 'ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে'। স্বদেশি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গেই বঙ্গবন্ধু তখন মেলামেশা করতেন। এরপর ১৯৩৮ সালে তৎকালীন বাংলার শ্রমমন্ত্রী ও মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী-র গোপালগঞ্জ আগমন উপলক্ষে তরুণ মুজিব দল-মতনির্বিশেষে স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। হিন্দু ছেলেরা কংগ্রেস নেতাদের কথায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ত্যাগ করতে শুরু করলে শেখ মুজিব বেশ অবাক হন। তিনি লিখেছেন, 'আমার কাছে হিন্দু মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসঙ্গে গান-বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ানো সবই চলতো।'

দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৪৭-১৯৭১)

শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়টির সূচনা হয় ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের মাধ্যমে সৃষ্ট পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে। ব্রিটিশ রাজশাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। 'বঙ্গ' বা 'বাংলা' বিভক্ত হয় দ্বিতীয়বারের মতো এবং এর পূর্বাংশের একটি অংশকে যুক্ত করা হয় প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূরবর্তী পাকিস্তান নাম-পরিচয় ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর

সঙ্গে। এভাবেই বঙ্গ বা বাংলার সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলটিকে এবং সেখানে বসবাসকারী মানুষদেরকে কৃত্রিম বিভাজন রেখা টানার মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত/বিযুক্ত করা হয়। উপেক্ষিত হয় তাদের হাজার বছরে গড়ে ওঠা সামষ্টিক অভিজ্ঞতা ও বসতির ঐতিহ্য। ১৯৪৭-১৯৭১ সময়পর্বে শেখ মুজিব উপলব্ধি করেন, নতুন এই কাঠামো কেবলই শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্যের এক রাজনৈতিক খোলস বদল মাত্র। এই পরিস্থিতি থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য তিনি 'র‍্যাডাক্লিফ-রচিত সীমারেখার বাস্তবতা মেনে নিয়েই তৎকালীন দ্বন্দ্বমুখর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে 'বঙ্গ' থেকে 'বাংলাদেশ'-এর পরিচয় নির্মাণ, এবং 'বাঙালি' নাম-পরিচয় প্রতিষ্ঠার জাতীয়তাবাদী স্তর একটির পর একটি অতিক্রম করতে থাকেন। লক্ষণীয় যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যেও শেখ মুজিবের 'ব্যক্তিত্বে' বঙ্গ বা বাংলার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের 'মানবতা', 'উদারতা' ও 'অসাম্প্রদায়িকতা'র যে কয়েকটি সুর ও লক্ষণ ইতোমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে, তা মুখ্য হিসেবে বিরাজমান দেখা যায়। এগুলোই হয়তো তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে, তাঁর কর্মকাণ্ডকে দিয়েছে আদর্শিক ভিত্তি।

সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ সাল। শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় এসেছেন। ধর্মের নামে যে প্রক্রিয়ায় বাংলা ভাগ করা হয়েছে তা নিয়ে তিনি ছিলেন ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট। এই বিভাজনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বাংলার পূর্ব ও পশ্চিম অংশের সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমান, হিন্দুসহ অন্যদের নিয়ে তিনি গভীর উদ্বিগ্নও ছিলেন। এ সময়ে তিনি 'গণতান্ত্রিক যুবলীগ' নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তি বজায় রাখার জন্য কাজ শুরু করেন। শেখ মুজিব লিখছেন, এই প্রতিষ্ঠানের “একমাত্র কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা, যাতে কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা না হয়, হিন্দুরা দেশ ত্যাগ না করে, যাকে ইংরেজিতে বলে কমিউনাল হারমোনি, তার জন্য চেষ্টা করা"।

১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে শেখ মুজিব যোগ দেন ভাষা আন্দোলনে। মুসলিম লীগ সমর্থক-কর্মীদের বিরোধিতার মুখেও তিনি এ-আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াননি। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারাদেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়, ঢাকায় পরিচালিত সেই আন্দোলনে পুলিশি বাধা এবং নির্যাতন উপেক্ষা করে তিনি দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' তে তিনি লিখছেন, 'আমাদের প্রায় সত্তর-পঁচাত্তরজনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়। ফলে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। ঢাকার জনগণের সমর্থনও আমরা পেলাম। যাহোক, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ'-এ শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক (জেলে বন্দি অবস্থায়) এবং ১৯৫৩ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে তাঁর উদ্যোগেই দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি প্রত্যাহার করা হয় এবং বাংলার সকল মানুষকে সম্পৃক্ত করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে তিনি রাজনীতিতে ব্রতী হন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বাঁক-বদল, ভাঙাগড়া এবং পরিচয় নির্মাণে এই সময়কাল ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

১৯৪৮ সাল থেকে ভাষা প্রশ্নে সক্রিয় আন্দোলনের পাশাপাশি ফরিদপুর, ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার ধানশ্রমিকদের উপর জারি করা পীড়নমূলক সরকারি হুকুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের চলমান আন্দোলনে সমর্থন (১৯৪৯) এবং আরমানিটোলায় দরিদ্র মানুষের খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিলে (১৯৪৯) যোগদান করার কারণে শেখ মুজিব শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন এবং গ্রেপ্তার হন। ব্রিটিশ ভারতের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মতো পাকিস্তান কাঠামোর অধীনেও শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্য থেকে গণমানুষকে মুক্ত করার

কাজ এভাবেই তিনি চালিয়ে যেতে থাকেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র-পরিচয় ও রাজনীতির প্রতি নিজের মোহভঙ্গ নিয়ে শেখ মুজিব লিখছেন-

       আমার ভীষণ জেদ হয়েছে মুসলিম লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখন দেখি তার উল্টা হয়েছে। এর একটা পরিবর্তন করা দরকার। জনগণ আমাদের জানত এবং আমাদের কাছেই প্রশ্ন করত। স্বাধীন হয়েছে দেশ, তবু মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর হবে না কেন? দুর্নীতি বেড়ে গেছে, খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। বিনা বিচারে রাজনৈতিক কর্মীদের জেলে বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মুসলিম লীগ নেতারা মানবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প কারখানা গড়া শুরু হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না। রাজধানী করাচী। সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব বাংলায় কিছু নাই।'

১৯৫২ সাল। শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম পাকিস্তানের রাজধানী করাচি যান। করাচির ভূমিরূপ, আবহাওয়া দেখার পর তিনি বাংলার মানুষ বিশেষ করে মেহনতি কৃষক ও শ্রমিকদের মনন ও গড়নের সঙ্গে পাকিস্তানের ভূখণ্ড ও মানুষের যে আকাশ-পাতাল দূরত্ব তা গভীরভাবে অনুভব করেন। তিনি লিখেছেন,

                         এই প্রথম আমি করাচি দেখলাম; ভাবলাম এই আমাদের রাজধানী! বাঙালিরা কয়জন তাদের রাজধানী দেখতে সুযোগ পাবে! আমরা জন্মগ্রহণ করেছি সবুজের দেশে, যেদিকে তাকানো যায় সবুজের মেলা। মরুভূমির এই পাষাণ বালু আমাদের পছন্দ হবে কেন? প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐরকমই নরম, ঐরকমই সবুজ প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, ঐ সৌন্দর্যই ভালোবাসি।'

১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে শেখ মুজিবুর রহমান একটি শান্তি সম্মেলনে চীন সফর করেন। ১৯৫৭ সালের জুন মাসে তিনি দ্বিতীয়বার চীনে যান পাকিস্তানের সংসদীয় দলের প্রতিনিধি হিসেবে। সেখানে ভাষণ প্রদানের সময় তিনি উর্দু বা ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ভাষাকে বেছে নেন। এই দুইবার চীন সফর শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। চীন সফরকালের সময়ের অভিজ্ঞতা মানুষ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনা ও মতাদর্শিক জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল যা আমার দেখা নয়াচীন গ্রন্থে নানাভাবে ওঠে এসেছে। দু-একটি দৃষ্টান্ত দেখে নেওয়া যাক। চীন যাবার পথে শেখ মুজিব মিয়ানমারের রেঙ্গুনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। রাষ্ট্রদূতের বিলাসবহুল ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবন দেখে তিনি লিখেছেন, “যাদের টাকা দিয়া এতো জাঁকজমক তাদের অবস্থা চিন্তা করলেই ভালো হতো। তাদের ভাতও নাই, কাপড়ও নাই, থাকবার মতো জায়গাও নাই। তারা কেউ না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে। তাদেরই সামনে ছেলে-মেয়েরা না খেয়ে তিলে তিলে মারা যায়।' সফরকালীন সময়ে চীনের বিভিন্ন স্থান, কারখানা, বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার ফাঁকে ফাঁকে শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি প্রটোকলের বাইরে গিয়েও কৃষক, শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের

সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশেছেন, তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা শুনেছেন, গল্প করেছেন, এমনকি তাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাবার খেয়েছেন।

পর্যবেক্ষণে শেখ মুজিব দেখতে পান, খাদ্য বা ওষুধের অভাবে চীনে কোনো কৃষক মারা গেলে সেখানকার সরকারি কর্মচারীদের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়। শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। অথচ বাংলার কৃষক ও শ্রমিকদের করুণ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখেছেন, গ্রামে একজন কি দুজন মহাজন বা তালুকদার অথবা জমিদার থাকে। গ্রামের গরিব মানুষ কোনো বিপদে পড়লে, না খেয়ে থাকলে, মেয়ের বিবাহের সময় অথবা মামলা- মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়লে মহাজনদের কাছ থেকে তারা টাকা ধার নেন জমি বন্ধক, কেউবা বাড়ি বন্ধক দিয়ে। দেখা যায়, আস্তে আস্তে গ্রামের বারো আনা জমি এই মহাজনদের হাতে চলে যায়, আর কৃষকেরা ভূমিহীন অথবা জমিহীন কৃষকে পরিণত হয়। তারপর একদিন 'কালের করাল গ্রাসে পড়ে বিনা চিকিৎসায় না খেয়ে মারা যায়'।

দ্বিতীয়বার চীন সফরের আগে ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট করাচীতে পাকিস্তান গণপরিষদে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, 'ওরা পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। বাংলা শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য।' ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'শহিদ দিবস' ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করে। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তা পালনও করা হয়। কিন্তু ওই বছরই মার্শাল ল জারি হওয়ার পর সরকারি ছুটি এবং শহিদ মিনার তৈরির কাজ বাতিল করা হয়। ১৯৬০ সালে শেখ মুজিব 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি মহকুমায় এবং থানায় নিউক্লিয়াস গঠন করেন। বঙ্গ বা বাংলা ভূখণ্ডের পূর্বাংশের 'পূর্ব পাকিস্তান' নাম-পরিচয় তিনি কখনই মেনে নিতে পারেন নি। তাঁর জীবনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় (১৯৪৭-৭১)-এ বঙ্গ থেকে বাংলাদেশ নাম-পরিচয় নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৯ সালে। ২৩ ফেব্রুয়ারি 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিপ্রাপ্ত শেখ মুজিবুর রহমান ৫ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় 'পূর্ব বাংলা'র নামকরণ করেন 'বাংলাদেশ' এবং বলেন,

                      "একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে 'বাংলা' কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র 'বঙ্গোপসাগর' ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে 'বাংলা' কথাটির অস্তিত্ত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। ... জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম 'পূর্ব পাকিস্তান'-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র 'বাংলাদেশ'।"

ধারণা হিসেবে 'বাংলাদেশ' কখন বঙ্গবন্ধুর মাথায় এলো এরকম প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'সেই ১৯৪৭ সালে। তখন আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির এক দেশ। বাঙালিরা এক হলে কী না করতে পারত। তারা জগৎ জয় করতে পারত।'

ভাষা শহিদদের স্মরণে আয়োজিত ভোরের র‍্যালিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং তাজউদ্দীন আহমদ। ছবির সময়কাল: ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪

 

১৯৬৪ সালে শেখ মুজিব দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেন। একই বছর গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ, শুরু হয় আইয়ুববিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হন। কারাগার থেকে বের হয়ে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ছয়দফা দাবি পেশ করেন। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাগুলো হলো

 

১. পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাধীনে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার হবে। নির্বাচন হবে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে। 

২. কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মাত্র দুটি বিষয় থাকবে, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অন্যান্য সকল বিষয়ে অঙ্গরাজ্যগুলোর পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। 

৩. সারাদেশে হয় অবাধে বিনিয়োগযোগ্য দুধরনের মুদ্রা, না হয় বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে একই ধরনের মুদ্রা প্রচলন করা। 

৪. সকল প্রকার কর ধার্য করার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত রাজস্বের একটা নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। 

৫. অঙ্গরাজ্যগুলো নিজেদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মালিক হবে, এর নির্ধারিত অংশ তারা কেন্দ্রকে দেবে। 

৬. অঙ্গরাজ্যগুলোকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য আধা সামরিক বাহিনী গঠন করার ক্ষমতা দেওয়া।

 

'পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের পীড়ন থেকে বাংলার পূর্বাংশের মানুষের মুক্তির সনদ' হিসেবে এই ছয় দফা তিনি ঘোষণা করেছিলেন। গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও পরিচিতির আওতায় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে গেলেও শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান' নাম-পরিচয়ের বদলে তাঁর বক্তব্য ও লেখায় 'পূর্ব বাংলা' শব্দটি বেশি ব্যবহার করেছেন।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রকৃত রূপটি শেখ মুজিব খুব ভালোভাবেই ধরতে পেরেছিলেন। ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসের লেখা,

            'আইয়ুব খান সাহেব যাহাই বলুন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতেই হবে একদিন। না দিলে ফলাফল খুবই খারাপ হবে। ইতিহাস এই শিক্ষাই দিয়েছে। যখনই জনাব পূর্ব বাংলায় আসেন, তখনই তাঁকে বিরাট অভ্যর্থনা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয় লাখ লাখ টাকা খরচ করে। দেখে মনে হয় তিনি বাদশা হয়ে প্রজাদের দেখতে আসেন। পশ্চিম পাকিস্তান তাঁর দেশ আর পূর্ব বাংলা তাঁর কলোনি।'

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (পরবর্তীকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত তৎকালীন ঢাকার ইতিহাসের সর্বকালের সর্ববৃহৎ জনসমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসংবর্ধনা এবং আনুষ্ঠানিকভাবে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি প্রদান করা হয়। কেন 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি তা ব্যাখ্যা করে জনসমাবেশে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে যে সত্যটি - সবচাইতে ভাস্বর হয়ে ওঠে তা হচ্ছে তিনি মানবদরদি- বিশেষ করে বাংলা ও বাঙালির দরদি, প্রকৃত বন্ধু। তাই তাঁকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদানের জনসভায় জনতার 

মাঝে বঙ্গবন্ধু

গণসংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে 'ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা' বলে অভিহিত করেন। এছাড়া তিনি রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীতের উপর হতে সকল প্রকার বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, 'আমরা এই ব্যবস্থা মানি না। আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এই দেশে গীত হইবেই।'

পাকিস্তান এবং পূর্ব বাংলার মধ্যকার দূরত্ব এবং দুটি পৃথক পরিচয়-সত্তার বিষয় পূর্বেও পরিস্ফুট হয়েছে এমন অসংখ্য উদাহরণে। হাজার মাইল দূরে পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারি লোক চাঁদ দেখলে পূর্ব বাংলায় নাকি সরকারি হুকুমে ঈদ করতেই হতো, নামাজ পড়তেই হতো! আবার শেখ মুজিব পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষে কারাগারে গোলাপ ফুল বিতরণ ও শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। এসব বর্ণনা বাংলার পৃথক পরিচয়-সত্তার স্পষ্ট ইঙ্গিতবাহী। যাই হোক, শেখ মুজিবুর রহমান সমকালীন রাজনৈতিক কাঠামোর আওতায় পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা এবং নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য আন্দোলন করে গেছেন, কারাগারে অন্তরীণ হয়েছেন বহুবার। ১৯৬৭ সালের মে মাসে কারাগারে বসেই তিনি লিখেছেন, 'জেলের ভিতর আমি মরে যেতে পারি তবে এ বিশ্বাস নিয়ে মরব, জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার একদিন আদায় করবে।'

এ-কথা স্বীকার করতেই হবে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার বাঁক-বদল এবং পরিচয় নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ রচিত হয় ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবি পেশ করার মাধ্যমে। তাঁর আন্দোলনের গতিধারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারায় দ্রুতগতিতে রূপান্তরিত হতে থাকে। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন এতদঞ্চলের অবিসংবাদিত নেতা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে বসে সেই কাঠামোর নিয়মতান্ত্রিক বিরোধিতার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নামে তিনি

বাংলার পূর্বাংশের 'মানুষের মুক্তির পথ' রচনা করেন। ১৯৭০ সালের ১১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষদের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান গ্রহণ করে তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। ১২ নভেম্বর গোর্কিতে উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটলে নির্বাচনী প্রচারণা বাতিল করে বঙ্গবন্ধু দুর্গতদের পাশে দাঁড়ান, পাকিস্তানি শাসকদের ঔদাসীন্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং ত্রাণের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি অনুরোধ করেন। ১৯৭০-এর ঘুর্ণিঝড়ের মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেই ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু মানুষের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট অর্জন করেন।

তৃতীয় পর্যায় (১৯৭১-১৯৭৫)

বঙ্গ থেকে 'বঙ্গবন্ধু' আলোচনা পর্বের শুরুতেই যেমনটা বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু তাঁর গোটা জীবন তিন ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও পরিচিতির মধ্যে অতিবাহিত করেছেন; এবং বিদ্যমান কাঠামোর মধ্য থেকেই শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্য থেকে মানুষের মুক্তির জন্য মানবতাবাদী রাজনীতি করেছেন। দ্বন্দ্বমুখর রাজনৈতিক পরিচয়, বাঁক-বদল, ভাঙাগড়ায় পূর্ণ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের তৃতীয় ও সর্বশেষ স্তরটি রচিত হয় স্বাধীন ও সার্বভৌম 'বাংলাদেশ' রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও পরিচিতির অধীনে।

'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু ভারত-ভাগের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে 'মানুষ'কে রক্ষা করার জন্য অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী মনোভাব এবং সাহসী মনোবল নিয়ে কাজ করেছেন। পাকিস্তান অর্জিত হবার পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের শাসক শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছেন। ক্রমাগত বাঁক বদল এবং পরিচয় নির্মাণে অনেকগুলো স্তর পেরিয়ে এসে তিনি উপনীত হন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে এই পর্যায়ে তিনি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যান। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে বিপুল মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান রাষ্ট্র- ধারণার তেইশ বছরের ইতিহাসকে 'বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস' বলে অভিহিত করেন। পাকিস্তান শাসকবর্গের শোষণের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে সকল মানুষকে তিনি রুখে দাঁড়াতে আহ্বান জানান। এমনকি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর আগ্রাসী অবস্থান ও টহলের মধ্যেও অত্যন্ত কৌশলে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাংলার 'ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা'র নির্দেশ দেন।

ইতিহাসের সুদীর্ঘ কাল পরিক্রমায় বাংলার মানুষ কখনো প্রকৃতির প্রতিকূলতা কখনো বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা, ধর্ম, রাজশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এই অদম্য প্রাণশক্তিই ছিল ৭ই মার্চের ভাষণের প্রাণ যা কিনা বাংলার বিরল ভূ-বৈশিষ্ট্য থেকে উৎসারিত এবং এতদঞ্চলের হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মানুষের সামষ্টিক অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত। হাজার বছরের ইতিহাসে অস্তিত্ব রক্ষার যে অভিজ্ঞতা এই ভূমির মানুষের রয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেন, 'ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সামরিক ব্যক্তিত্ব তথা স্বাধীনতাকামী আপামর বাঙালি জনতার কাছে এই ভাষণ ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সবুজ সংকেত স্বরূপ।' বঙ্গ থেকে বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুর পরিচয় নির্মাণে ৭ মার্চের ভাষণ এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বাংলার মানুষের ধারাবাহিক সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতা মার্চে এমন এক নবতর পর্যায়ে উপনীত হয়, যেখানে নিপীড়ন ও - বৈষম্যের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা বাংলার মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে নতুন এক পরিচয় নির্মাণের পথে অগ্রসর হয়।

২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে সংঘটিত হয় ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা। এ রাতেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক রাত ১টা ৩০ মিনিটে গ্রেপ্তার হবার পূর্বে রাত ১২টা ২০ মিনিটে (২৬শে মার্চ প্রথম প্রহর, ১৯৭১) বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন-

 

'এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।'

 

এভাবে শেখ মুজিবের দেওয়া 'বাংলাদেশ' নাম এবং 'জয় বাংলা' স্লোগান ধারণ করে ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্র- পরিচয়ের নতুন এক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং কাঠামোতে প্রবেশ করেন। এই দিন রেসকোর্স ময়দানে বিপুল সংখ্যক মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। (এই ভাষণের বিস্তারিত জানার জন্য mujib100.gov.bd ওয়েবসাইট দেখা যেতে পারে) এই ভাষণের একপর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার পঙ্ক্তি উচ্চারণ করে তিনি বলেন,

                                               'রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি। কিন্তু কবিগুরুর সেই কথা আজ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে, আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।'

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রবেশ করেই বঙ্গবন্ধুর এই উচ্চারণ তাৎপর্যপূর্ণ। 'বাঙালি' পরিচয় ছাপিয়ে 'মানুষ' পরিচয় প্রতিষ্ঠার দিকে বঙ্গবন্ধুর প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণ দৃষ্টান্তমূলক। মুক্তিযুদ্ধে মানুষের 'আত্মাহুতি' ও 'ত্যাগ'-এর কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'এমন নজির বাংলা ছাড়া দুনিয়ার ইতিহাসে আর কোথায়! এত লোক আর কোথাও প্রাণ দেয় নাই।'

বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের প্রথম দুটি পর্যায়ে যে রাজনৈতিক পরিচিতি, পরিস্থিতি ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে রাজনীতি করেছেন, সেখানে শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে প্রধানত শাসক শ্রেণির সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতির পদে আসীন বঙ্গবন্ধু এক নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তিনি। সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের মানুষের ভেতরেও সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, ঘুষ, চুরি, জোতদারি এবং নানাবিধ অপ-তৎপরতা দেখে বঙ্গবন্ধুর 'সোনার বাংলা'র স্বপ্ন অনেকখানিই ফিকে হয়ে যায়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ কালপর্বে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও ভাষণগুলোতে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশেই কিছু মানুষের দূর্নীতি, অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এই জন্যই হয়তো তাঁকে সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে দেখা যায়।

২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২। ভোলার এক জনসভায় প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভূমিহীন কৃষকদের ভূমি দান করার বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করেন। একই বছর ডিসেম্বর মাসে সরকারি কর্মচারী সমিতির উদ্যোগে তাঁর সম্মানে আয়োজিত একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন,

                                        'মেহনতি মানুষের মৌলিক অভাবসমূহ পূরণ না হইলে বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা নিষ্ফল হইয়া যাইবে। ... ধনী দরিদ্রের ব্যবধান অবশ্যই ঘুচাইতে হইবে। জনগণের স্বার্থের প্রশ্নে আমি আমার রাজনৈতিক জীবনে কোনোদিন আপস করি নাই।'

শুধু ধনীদরিদ্রের বৈষম্য নয়, জাত-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষকে সঙ্গে নিয়ে 'মানবতা', 'অসাম্প্রদায়িকতা' এবং 'উদারতা'-এর নীতিতে অবিচল থেকে বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণের রাজনীতিতে অবিচল ছিলেন বঙ্গবন্ধু। 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ'-এর রাজনীতিকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো থেকে বাংলাদেশকে তিনি স্বাধীন করেছেন। অথচ স্বাধীনতা অর্জনের এক বছরের মধ্যেই ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন,

                   'সাম্প্রদায়িকতাকে নির্মূল করার রণকৌশল হিসেবেই আমি জাতীয়তাবাদী দর্শন অনুসরণ করেছি। এই মতবাদ কার্যকর হলে, আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের ভাবীকালের মানুষ ক্রমে ক্রমে জাতীয়তাবাদের গণ্ডি পার হয়ে উত্তীর্ণ হবে বিশ্বমানবতাবাদী উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে।'

অপর এক মন্তব্যে বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ভাষণে নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন,

'মুজিবুর রহমান নরম মানুষ, বাংলার মাটি যেমন নরম, পলিমাটি যেমন ভিজলে নরম হয়, আমিও তেমন নরম, আবার চৈত্রের প্রখর রৌদ্রে যেমন শক্ত হয় বাংলার মাটি, আমিও তেমন শক্ত হতে জানি।'

উল্লিখিত দুটি মন্তব্য থেকে বঙ্গবন্ধুর মানসপটের এমন একটি ছবি সামনে চলে আসে যেখানে তাঁর রাজনৈতিক জীবন, নিরন্তর ভাঙাগড়া, বাঁক-বদল, দ্বন্দ্বের মধ্যেও শাশ্বত মানবতাবাদী সুর বা লক্ষণের অব্যাহত উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। মানুষের সামগ্রিক মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতাকে নির্মূল করার জন্য বঙ্গবন্ধু বেছে নেন জাতীয়তাবাদ। আবার এই জাতীয়তাবাদের স্তর বা পর্যায়সমূহ অতিক্রম করে তিনি বিশ্বমানবতাবাদের দিকেই গন্তব্য স্থির করেন। এই গন্তব্যের স্বীকৃতিও তিনি অর্জন করেন। বিশ্বশান্তি পরিষদ কর্তৃক 'জুলিও কুরি' পদকপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে পরিষদের সেক্রেটারি জেনারেল ভূষিত করেন 'বিশ্ববন্ধু' অভিধায়।

১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশ-জাতি-বর্ণ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজের অবস্থান নির্দেশ করেন। তিনি বলেন, 'পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে শোষক শ্রেণি আরেক ভাগে শোষিত। আমি শোষিতের দলে।' ভাষা বা ধর্ম পরিচয়ের বদলে তিনি শ্রেণিকেন্দ্রিক আলোচনাকে সামনে আনেন এবং পৃথিবীর সব প্রান্তের শোষিত মানুষের পক্ষে নিজের অবস্থান ঘোষণা করেন। এই সম্মেলনে লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি এবং সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় বঙ্গবন্ধুর। তাঁরা প্রস্তাব দেন, 'ইসলামিক রিপাবলিক' ঘোষণা করলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, 'এটা সম্ভব নয়। কারণ, বাংলাদেশ সবার দেশ। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মানুসারী সবারই দেশ।' আলজেরিয়ার এই সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করেন কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও সাহসের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করে সেই সময়েই ক্যাস্ট্রো বলেন, 'আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়। আমি এভাবেই হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা পেয়েছি।'

মানবতাবাদী বিশ্ববন্ধু পরিচয় নির্মাণের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু যেখানেই গিয়েছেন বিশ্ব মানবতা, উদারতা এবং অসাম্প্রদায়িকতার কথা প্রচার করেছেন। এ সকল আদর্শকে সামনে রেখে তিনি 'সোনার বাংলা' গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিবাহিনীর সকল দলের অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের সোনার বাংলাকে শ্মশান করে গেছে। তবে তারা আমাদের সোনার বাংলার মাটিকে নিতে পারেনি।' ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন,

'গরিব কৃষক ও শ্রমিকের মুখে যতদিন হাসি না ফুটবে ততদিন আমার মনে শান্তি নাই। এই স্বাধীনতা আমার কাছে তখনই প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে যেদিন বাংলাদেশে কৃষক, মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে।'

এরপর তিনি দেশের যেসব মানুষেরা অসদুপায়ে টাকা অর্জন করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় বক্তৃতা প্রদান করেন। একই ভাষণে তিনি আরো বলেন-

'আমরা ইতিহাসের একটা বিরাট সংকটকাল অতিক্রম করছি। আমাদের দেশ তিনশো বছর লুণ্ঠিত ও শোষিত হয়েছে। এর সমাজ ও অর্থনীতিতে হাজারো সমস্যা। সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হলে সোনার মানুষ চাই।'\]

১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করলে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উপস্থিত প্রতিনিধিদের বিপুল করতালির মধ্যে বাংলায় ভাষণ প্রদান করেন এবং নিজেকে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে 'পরিচিতি' প্রদান করেন। মানুষের অজেয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস এবং যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ক্ষমতার ওপর প্রত্যয় ব্যক্ত করে বঙ্গবন্ধুর জাতিসংঘের বক্তৃতা শেষ হয়।

১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে কুমিল্লা সেনানিবাসে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন অপরাধ ও দুর্নীতিতে জড়িত মানুষের হাতে বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাওয়ার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, 'আমি প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, তোমরাও প্রতিজ্ঞা নাও।' মানুষকে যারা অত্যাচার করে তাদের উৎখাত করতে হবে বলে তিনি শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু মেহনতি মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতিবাজ শনাক্ত করতে গিয়ে বলেন,

'শিক্ষিত সমাজ চাকরি করেন। আপনার মাইনা দেয় ঐ গরিব কৃষক। আপনার মাইনা দেয় ঐ গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ঐ টাকায়। আমরা গাড়ি চড়ি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক।'

 মানুষের কল্যাণে নিজ হাতে স্বদেশ গড়ে তোলার বহুমূখী প্রকল্প গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ-রকম অসংখ্য উদ্যোগের প্রমাণ পাওয়া যায় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনিসুর রহমানের যে আগুন জ্বলেছিল গ্রন্থে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং সংক্ষিপ্ততম তৃতীয় পর্যায়ে (১৯৭১-৭৫) এসে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ গড়ার পাশাপাশি ধর্ম- জাতি-ভূমি-ভাষা-সংস্কৃতি হতে উদ্ভূত প্রায় সকল প্রকার 'গৌরব' ও 'শ্রেষ্ঠত্ব' স্থাপনের উর্ধ্বে ওঠে 'মানব' এবং 'বিশ্বমানব' রূপে পরিচয় প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছেন। এ সময়ে তিনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই গিয়েছেন সাম্য, উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতার আদর্শ দৃঢ়ভাবে প্রচার করেছেন। রাজনৈতিক জীবনের ভাঙা-গড়া ও বাঁক- বদলের স্তরসমূহ পেরিয়ে কেবল 'মানুষ' হিসেবে পরিচয় ধারণ ও ঘোষণার এক বিশেষ স্তরে বঙ্গবন্ধু নিজেকে উন্নীত করেছিলেন।

দলগত কাজ ২ 

আমরা একজন মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানে এমন কোনো বয়স্ক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আমরা পাঠ্যপুস্তক থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। এখন চলো আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিষয়ক কিছু তথ্য সংগ্রহ করে নিই। সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য কয়েকটি নমুনা প্রশ্ন দেওয়া হলো।

সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রশ্নমালা 

১. কেনো মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? 

২. পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা কেনো প্রয়োজন ছিল? 

৩. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা কী ছিল? 

৪. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কারা অংশগ্রহণ করেছিল?

 . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .

 . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .

এরপর সাক্ষাৎকার এবং পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন সময়ের ঘটনা যেখানে তিনি ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার দৃষ্টান্ত রেখেছেন তার একটি টাইম লাইন তৈরি করি। আমরা প্রয়োজনে নিচের টাইম লাইনের মতো করে একটি টাইম লাইন এঁকে আমাদের অনুসন্ধানের প্রাপ্ত ফলাফল উপস্থাপন করতে পারি।

দলগত কাজ ৩ 

এখন আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়ে আলোচনা করি। এরপর আমরা 'ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আমাদের করণীয়' বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। এরপর নিচের চিত্রের মতো চিত্র এঁকে পোস্টার পেপারে আমাদের করণীয়গুলো লিখে দেয়ালে টানিয়ে রাখি।

দলগত কাজ ৪ 

বঙ্গবন্ধু মেলার আয়োজন

আমরা আগে ৫ থেকে ৬ জন মিলে যে দল গঠন করেছি, সেই দলে এবারও কাজ করব। প্রতিটি দল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের যেকোনো একটি ঘটনাকে কেস স্টাডি হিসেবে নেব। সেই ঘটনা-সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করে একটি নাটিকা/পোস্টার পেপার/পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তৈরি করব। আমাদের তৈরি করা নাটিকা/পোস্টার পেপার/পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন ২৬শে মার্চে 'বঙ্গবন্ধু মেলা'তে উপস্থাপন করব। এই মেলার আয়োজন করার জন্য আমরা বিদ্যালয়ে একটি স্থান ও সময় নির্ধারণ করব। মেলায় উপস্থিত থাকার জন্য আমরা এলাকার বিভিন্ন বিশিষ্টজনকে আমন্ত্রণ জানাব। প্রয়োজনে শিক্ষকের সহায়তায় আমন্ত্রণ পত্র লিখতে পারি

 

 

Content added By