SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

On This Page
অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) - Science (Investigative Study) - NCTB BOOK

আমরা প্রতিদিন নানাভাবে চুম্বক ব্যবহার করি। আমাদের টেলিফোনে কথা বলতে হয়, টেলিফোনের স্পিকারে চুম্বক রয়েছে, সেখানে চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে স্পিকারে শব্দ সৃষ্টি করা হয়। শুধু টেলিফোনের স্পিকার নয় রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট এরকম সবকিছুর স্পিকারে চুম্বক থাকে। আমরা যখন গরমের দিনে ফ্যান ব্যবহার করি তখন ফ্যানের মোটর ঘোরানোর জন্য চুম্বক ব্যবহার করতে হয়। শুধু ফ্যানে নয়, এসি, ফ্রিজ গাড়ি এরকম যত যন্ত্রপাতিতে যখনই বিদ্যুৎ ব্যবহার করে কোনো কিছু ঘোরাতে হয় তখনই চুম্বক ব্যবহার করতে হয়। আমরা প্রতিদিন যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি সেটি বৈদ্যুতিক জেনারেটরে তৈরি করা হয়, সেখানে বিশাল চুম্বককে তারের কুণ্ডলীর মাঝে প্রবল বেগে ঘোরাতে হয়।

পৃথিবী একটা বিশাল চুম্বক এবং এই চুম্বকটির চৌম্বক ক্ষেত্র সূর্য থেকে প্রবল বেগে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসা চার্জ কণাগুলোকে পৃথিবীতে আঘাত করতে না দিয়ে প্রাণিজগতকে রক্ষা করে যাচ্ছে। অনুমান করা হয় যদি পৃথিবী এই চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীকে রক্ষা না করত তাহলে পৃথিবীতে হয়তো প্রাণের উদ্ভবই হতে পারত না। পৃথিবী হতো প্রাণহীন রুক্ষ পাথুরে একটা গ্রহ।

12.1 স্থায়ী চুম্বক

আমরা যারা সাধারণভাবে চুম্বক ব্যবহার করি তারা দুই ধরনের চুম্বক দেখে থাকি, এক ধরনের চুম্বক হচ্ছে স্থায়ী চুম্বক অর্থাৎ সেটি সব সময় চুম্বক, সব সময় লোহাকে আকর্ষণ করে। অন্য এক ধরনের চুম্বক হচ্ছে বৈদ্যুতিক চুম্বক এবং নাম দেখে বুঝতে পারছ বিদ্যুৎ প্রবাহ করে এই চুম্বক তৈরি করা হয়। তাই বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে এই ধরনের চুম্বকের চৌম্বকত্ব সরিয়ে ফেলা যায়। চৌম্বক ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করা যায় বলে আমাদের দৈনিন্দন ব্যবহারের প্রযুক্তিতে বৈদ্যুতিক চুম্বকের ব্যবহার অনেক বেশি।

তোমরা যখন পরমাণুর গঠন নিয়ে পড়েছ তখন তোমরা জেনেছ যে পরমাণু তৈরি হয় ইলেকট্রন এবং প্রোটন দিয়ে, ইলেকট্রনের চার্জ নেগেটিভ এবং প্রোটনের চার্জ পজিটিভ। শুধু তাই নয় বিপরীত চার্জ একে অপরকে আকর্ষণ করে এবং একই ধরনের চার্জ একে অপরকে বিকর্ষণ করে। তোমাদের ভেতর যারা দুটি চুম্বক নিয়ে নাড়াচাড়া করার সুযোগ পেয়েছ নিশ্চিতভাবেই তারা লক্ষ করেছে যে চুম্বকের দুই পাশে দুটি মেরু, একটি উত্তর মেরু অন্যটি দক্ষিণ মেরু। উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু একে অপরকে আকর্ষণ করে আবার উত্তর মেরু অপর উত্তর মেরুকে এবং দক্ষিণ মেরু অপর দক্ষিণ মেরুকে বিকর্ষণ করে। দেখতেই পাচ্ছ চার্জের সঙ্গে চুম্বকের মেরুর একটি মিল রয়েছে।

চুম্বকের মেরুগুলোকে পূর্ব-পশ্চিম নাম না দিয়ে উত্তর দক্ষিণ নাম দেওয়ার পিছনে একটি কারণ রয়েছে। একটু আগেই তোমাদের বলা হয়েছে পৃথিবী আসলে একটা বিশাল চুম্বক হিসেবে কাজ করে, সেজন্য কোনো চুম্বককে ঝুলিয়ে দিলেই পৃথিবীর এই বিশাল চুম্বকের আকর্ষণ সেটা উত্তর দক্ষিণ বরাবর ঝুলে থাকে। চুম্বকের যে দিকটি উত্তর দিকে মুখ করে থাকে সেটাকে আমরা বলি উত্তর মেরু এবং যে দিকটি দক্ষিণ দিকে মুখ করে থাকে সেটাকে বলেই দক্ষিণ মেরু। যেহেতু আমরা জানি চুম্বকের আকর্ষণ হয় বিপরীতে মেরুতে তাই আমরা বলতে পারি, পৃথিবীর ভেতরকার চুম্বকটির দক্ষিণ মেরু হচ্ছে উত্তর দিকে এবং চুম্বকটির উত্তর মেরুটি হচ্ছে দক্ষিণ দিকে।

চুম্বকের সঙ্গে চুম্বকের আকর্ষণ এবং বিকর্ষণের সঙ্গে চার্জের সঙ্গে চার্জের আকর্ষণ এবং বিকর্ষণের একটা মিল আছে সত্যি কিন্তু অন্য একটি ব্যাপারে কিন্তু অনেক বড়ো একটা পার্থক্য রয়েছে। চার্জের বেলায় আমরা শুধু পজিটিভ চার্জ কিংবা নেগেটিভ চার্জের একটি গোলক, দণ্ড বা অন্য কিছু ঝুলিয়ে রাখতে পারি। চুম্বকের বেলায় কিন্তু আমরা কখনোই শুধু উত্তর মেরু কিংবা শুধু দক্ষিণ মেরুর একটি চুম্বক তৈরি করে ঝুলিয়ে দিতে পারব না। তোমরা যদি মনে করো একটা দণ্ড চুম্বকের মাঝখানে ভেঙে দুটি চুম্বক তৈরি করবে যার একটি হবে উত্তর মেরু অন্যটি দক্ষিণ মেরু-তাহলে তোমরা অবাক হয়ে দেখবে আসলে সেটি না ঘটে দুটি পূর্ণ চুম্বক তৈরি হয়েছে, দুটোরই উত্তর ও দক্ষিণ মেরু রয়েছে। সেগুলো যদি আবার ভাঙ্গা হয় তাহলে দেখবে আবার সবকটি ভাঙা অংশই একটি করে পূর্নাঙ্গ চুম্বকে পরিণত হয়েছে যার এক মাথা হচ্ছে উত্তর মেরু আর অন্য মাথা হচ্ছে দক্ষিণ মেরু। এভাবে একেবারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা করে ফেললেও প্রত্যেকটি কণাই হবে একটি ছোট পূর্ণাঙ্গ চুম্বক যার একমাথা হবে উত্তর মেরু অন্য মাথা হবে দক্ষিণ মেরু। চুম্বকের বেলায় কখনোই একটা মেরুকে আলাদা করে পাওয়া সম্ভব নয়।'

নানা ধরনের যন্ত্রপাতি এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী চুম্বক তৈরি করা হয়। মানুষ অনেক প্রাচীন কাল থেকে প্রকৃতিতে পাওয়া এক ধরনের স্থায়ী চুম্বক দেখে এসেছে যেটাকে লোডস্টোন বলা হয়। এগুলো লোহার এক ধরনের আকরিক। অনুমান করা হয় এই আকরিকের উপর বজ্রপাতের কারণে এগুলো চৌম্বকায়িত হয়েছে-বজ্রপাতের সময় বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। তোমরা শুনে অবাক হয়ে যাবে যে একটি বজ্রপাতে যে পরিমাণ বৈদ্যুতিক শক্তি বের হয় সেটি দিয়ে ঢাকা শহরের মতো কয়েকটি শহরকে কয়েক মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব। বিদ্যুৎ প্রবাহের সঙ্গে চৌম্বক ক্ষেত্রের একটা অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সেটা একটু পরেই তোমরা জানতে পারবে।

প্রাচীনকালে মানুষেরা আবিষ্কার করেছিল যে চুম্বককে ঝুলিয়ে রাখা হলে সেটা উত্তর-দক্ষিণে ঝুলে থাকে। এই তথ্যটি ব্যবহার করে চীন দেশের নাবিকেরা প্রথম কম্পাস তৈরি করে দিক নির্ধারণ করা শুরু করেছিল প্রায় হাজার বছর আগে।

তোমরা যারা চুম্বক নাড়াচাড়া করেছ তারা সবাই নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ একটি চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করে। লোহা ছাড়াও চুম্বক নিকেল এবং কোবাল্টকে আকর্ষণ করে কিন্তু তামা, প্লাস্টিক বা অ্যালুমিনিয়ামকে আকর্ষণ করে না। চুম্বক যে সকল পদার্থকে আকর্ষণ করতে পারে তাদের একটা বিশেষত্ব আছে এবং এরকম পদার্থকে চৌম্বকীয় পদার্থ বলে। তোমাদের কাছে যদি একটা মোটামুটি শক্তিশালী স্থায়ী চুম্বক থাকে তাহলে সেটা ব্যবহার করে তুমি ইচ্ছা করলে অন্য একটা লোহা বা ইস্পাতের টুকরাকে একটা চুম্বকে পরিণত করতে পারবে। সেটা করার জন্য লোহা বা ইস্পাতের টুকরার এক মাথায় স্থায়ী চুম্বকের এক মাথা স্পর্শ করে টেনে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। তারপর স্থায়ী চুম্বকটি উপরে তুলে আবার আগের জায়গায় স্পর্শ করে টেনে নিতে হবে, অর্থাৎ ঘর্ষণটি সব সময়ই হতে হবে একমুখী। এভাবে কমপক্ষে বিশবার একই দিকে চুম্বকের একই মাথা ব্যবহার করে ঘর্ষণ করতে পারলে মোটামুটি একটা কাজ চালানোর মতো স্থায়ী চুম্বক তৈরি করে নিতে পারবে।

12.2 বিদ্যুতের চুম্বক ক্রিয়া

আগের পরিচ্ছেদগুলোতে চুম্বক নিয়ে অনেক কিছু বলা হয়েছে কিন্তু এখনো একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়নি। সেটি হচ্ছে কেন বিশেষ কোনো কোনো পদার্থের চৌম্বক ধর্ম আছে অর্থাৎ সেগুলো চুম্বক দিয়ে আকর্ষিত হয় এবং তাদেরকে দিয়ে চুম্বক তৈরি করা যায়, যেমন-লোহা, কোবাল্ট বা নিকেল। আবার কেন কোনো কোনো পদার্থের চুম্বক ধর্ম নেই, যেমন-কাগজ, কাঠ বা প্লাস্টিক।

আগের পরিচ্ছেদে আসলে কারণটির একটুখানি আভাস দেওয়া হয়েছে-বলা হয়েছে বিদ্যুৎ প্রবাহের সঙ্গে চুম্বকের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এই অধ্যায়ে সেটাই ব্যাখ্যা করা হবে।

আমাদের মনে হতে পারে বিদ্যুৎ প্রবাহ আর চৌম্বকত্ব বুঝি পুরোপুরি আলাদা দুটি বিষয়। বিদ্যুৎ প্রবাহ দিয়ে আমরা আলো জ্বালাই, ফ্যান ঘোরাই, চুম্বক দিয়ে লোহাকে আকর্ষণ করি কাজেই দুটিকে আমাদের আলাদা বিষয় মনে হতেই পারে। কিন্তু জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল নামে একজন বিজ্ঞানী 1865 সালে দেখেছিলেন দুটি আসলে একই বিষয় এবং সেই থেকে বিদ্যুৎ আর চুম্বক আর আলাদা বিষয় নয়। সেটা নাম হয়েছে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিজম বা বিদ্যুৎ চৌম্বকত্ব। কারণটি খুব সহজ, বিদ্যুৎ প্রবাহ হলে সেটি তার পাশে একটি চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে। একটি স্থির চার্জ যেভাবে তার চারপাশে বিদ্যুৎক্ষেত্র তৈরি করে বিদ্যুৎ প্রবাহও ঠিক সেভাবে তার চারপাশে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে, অর্থাৎ চৌম্বকত্ব বলে আলাদা কিছু নেই, বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য চৌম্বকত্ব তৈরি হয়। আর বিদ্যুৎ প্রবাহ হচ্ছে চার্জের প্রবাহ-তোমরা সবাই জানো আমাদের পরিচিত বিদ্যুৎ প্রবাহের সময় সেখানে ইলেকট্রনের প্রবাহ হয়।

তোমাদের মনে এখন প্রশ্ন জাগতে পারে যদি বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণেই চৌম্বকত্ব তৈরি হয় তাহলে স্থায়ী চুম্বক দণ্ডের ভেতর চৌম্বকত্ব কোথা থেকে আসে? তার ভেতরে তো কোনো বিদ্যুৎ প্রবাহ হচ্ছে না! তোমরা জেনে নিশ্চয়ই অবাক হবে যে, পরমাণুর গঠনের সময় তোমরা যখন পড়েছ, পরমাণুর কেন্দ্রে নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ইলেকট্রন ঘুরতে থাকে সেই ঘূর্ণন হচ্ছে এক ধরনের চার্জের প্রবাহ বা বিদ্যুৎ প্রবাহ-সেখান থেকেই চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়। শুধু তাই নয় পরমাণুর প্রত্যেকটা ইলেকট্রনকেও একটা অতি ক্ষুদ্র চুম্বক হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। কাজেই সহজ করে বলা যেতে পারে প্রত্যেকটা পরমাণুর জন্য তার ইলেকট্রনগুলো চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ সবগুলো পরমাণু একটি করে অতি ক্ষুদ্র চুম্বক। সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চুম্বকগুলো মিলে যখন একটা শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে আমরা সেটাকে বলি স্থায়ী চুম্বক।

তোমাদের মনে নিশ্চয়ই এখন দ্বিতীয় প্রশ্নটি এসেছে, যদি প্রত্যেকটা পরমাণুর ইলেকট্রনের ঘূর্ণনই চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে তাহলে তো সব পদার্থেরই চুম্বক হওয়ার কথা কারণ সবকিছুই তো পরমাণু দিয়ে তৈরি। এটি খুবই যৌক্তিক একটা প্রশ্ন। তোমরা যখন পরমাণুর গঠন নিয়ে আরো বিস্তারিতভাবে পড়বে তখন জানতে পারবে পরমাণু গঠনের সময় ইলেকট্রনগুলো দুটো দুটো করে এমনভাবে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষপথে নিজেদের সাজিয়ে নেয় যে প্রায় সব সময় একটি ইলেকট্রনের চৌম্বক ক্ষেত্র অন্যটির বিপরীত দিকে থাকে এবং দুটো কাটাকাটি করে কোনো চৌম্বক ক্ষেত্র অবশিষ্ট থাকে না। মাত্র অল্প কিছু পদার্থের বেলায় সেটি পুরোপুরি ঘটে না এবং সেগুলোরই শুধু স্থায়ী চৌম্বক ক্ষেত্র দেখা যায়, লোহা, নিকেল বা কোবাল্ট হচ্ছে সেরকম কিছু পদার্থ।

বিদ্যুতের প্রবাহের কারণে যে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয় সেটি পরীক্ষা করেও দেখানো সম্ভব। একটি ড্রিংকিং স্ট্রয়ের শুধু এক পাক তারে চৌম্বক ক্ষেত্র বেশি হয় না বলে বেশ কয়েকবার পেঁচিয়ে নিতে হয়। এবারে একটা কম্পাসের কাছে প্যাঁচানো তারটি রাখ, স্বাভাবিকভাবে কম্পাসের কাটাটি শুরুতে উত্তর দিকে মুখ করে থাকবে। এবারে কুন্ডলীর তারের দুই মাথায় যদি একটি ব্যাটারির দুইমাথা স্পর্শ করা হয় তাহলে দেখবে কম্পাসটি সঙ্গে সঙ্গে কুন্ডলি দিকে ঘুরে যাবে। ব্যাটারি থেকে বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং সেই চৌম্বক ক্ষেত্রটি কম্পাসের কাটাটিকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছে। যদি ব্যাটারিটি ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহের দিকে পাল্টে দেওয়া যায় তাহলে দেখবে কম্পাসটিও সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে যাবে! কোন দিকে বিদ্যুৎ প্রবাহ হলে কোনদিকে চুম্বক ক্ষেত্রের দিক ঠিক হবে সেটি ডান হাতের নিয়ম দিয়ে বের করা সহজ! আঙুলের ডগার দিকে যদি বিদ্যুৎ প্রবাহ হয় তাহলে বুড়ো আঙুলের দিকে চৌম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে।

একটি তারের কুণ্ডলীর ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ করলে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়, বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ করলে চৌম্বক ক্ষেত্র অদৃশ্য হয়ে যায়-অর্থাৎ আমরা ইচ্ছা করলেই চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারি আবার ইচ্ছা করলে সেটা অদৃশ্য করে দিতে পারি। শুধু তা-ই নয়, বিদ্যুতের প্রবাহ বাড়িয়ে-কমিয়ে চৌম্বক ক্ষেত্রও বাড়াতে বা কমাতে পারি। তবে শুধু তারের কুণ্ডলী দিয়ে চৌম্বক ক্ষেত্র খুব বেশি শক্তিশালী করা যায় না বলে এরকম বৈদ্যুতিক চুম্বক তৈরি করতে হলে সব সময় কুণ্ডলীর ভেতরে একটা লোহা জাতীয় চৌম্বকীয় পদার্থ ঢুকিয়ে দিতে হয়। একটা সাধারণ লোহার দণ্ড চুম্বক নয়, কারণ তার ভেতরে যে ছোটোছোটোচুম্বকের কণা আছে সেগুলো সাধারণত এলোমেলোভাবে থাকে কাজেই কোনো সম্মিলিত চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয় না। যদি এই লোহার দণ্ডটি ঘিরে একটা বৈদ্যুতিক তার পেঁচিয়ে তার ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ করা হয় তখন বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে এলোমেলো চুম্বক কণাগুলো চৌম্বক ক্ষেত্র বরাবর নিজেদের সাজিয়ে নেয়। তখন বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য যে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয় তার সাথে সাথে লোহার দন্ডটির ভেতরকার চৌম্বক ক্ষেত্র যুক্ত হয়ে অনেক শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়।

12.3 বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় আবেশ

একটি ছোট কাগজকে ভাঁজ করে তার দুই পাশে দুটি চুদ্ধকারীত সূচ গেঁথে কম্পাস তৈরি করা যায়। প্লাস্টিক আবৃত তারের কুণ্ডলির ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে সেখানে যে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হবে সেটি কম্পাসকে নিজের দিকে আকর্ষণ করবে। বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক পালটে দিলে চৌম্বক ক্ষেত্রের দিকও পালটে যাবে।

আমাদের চারপাশে যে অসংখ্য যন্ত্রপাতি আছে তাদের কোনো কিছুকে ঘোরানোর জন্য বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহার করা হয় এবং সব মোটরেই চুম্বক থাকতে হয়। কাজেই সেখান থেকে তোমাদের ধারণা হতে পারে যে চুম্বকের সত্যিকারের ব্যবহার বুঝি রয়েছে বৈদ্যুতিক মোটরের ভেতর। কিন্তু আসলে মোটরের মতোই গুরুত্বপূর্ণ কিংবা কোনো অর্থে মোটর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হয় বৈদ্যুতিক জেনারেটরেএখানে চুম্বক ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়। বিজ্ঞানী ওয়রস্টেড প্রথমে দেখিয়েছিলেন যে একটা তারের কুণ্ডলীর মাঝে যদি চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন করানো যায় তাহলে সেই তারের কুণ্ডলীর ভেতর বৈদ্যুতিক শক্তি তৈরি হয়।

 যদি একটা বৈদ্যুতিক তারের কুণ্ডলীর দুই প্রান্তে একটি এমিটার লাগানো হয় (যেটি বৈদ্যুতিক প্রবাহ মাপতে পারে) তাহলে আমরা দেখব যদি আমরা একটা চুম্বক বৈদ্যুতিক তারের কুণ্ডলীটির ভেতর প্রবেশ করাই তাহলে এমিটারের কাঁটা একদিকে নড়ে উঠে বিদ্যুৎ প্রবাহ দেখাবে। আবার যখনই চুম্বকটি বের করা হবে তখন এমিটারের কাঁটা অন্য দিক দিয়ে নড়ে উঠে উল্টোদিকে বিদ্যুৎ প্রবাহ দেখাবে। চুম্বকটি যদি নাড়ানো না হয় তাহলে চুম্বক ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয় না বলে তখন কোনো বিদ্যুৎ প্রবাহ হবে না। যদি চুম্বকটির মেরু পরিবর্তন করে আমরা আবার এই পরীক্ষাটি করি তাহলে আমরা বিপরীত দিকে বিদ্যুৎ প্রবাহ দেখতে পাব।

চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন করে তারের কুণ্ডলীতে বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি করাকে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় আবেশ বলে। এই আবেশ ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক জেনারেটরে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়।

12.4 পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র

তোমরা আগের শ্রেণিতে পৃথিবীর গঠন পড়ার সময় জেনেছ যে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠনকে মূল তিন ভাগে ভাগ করা যায়, একেবারে বাইরের ভূত্বক, কেন্দ্রের মজ্জা বা কোর এবং তার মাঝখানে সুবিস্তৃত তরল ম্যান্টেল। পৃথিবী গঠনের সময় তার মাধ্যাকর্ষণ বলের আকর্ষণের কারণে তুলনামূলকভাবে ভারী ধাতব মৌলগুলো-অর্থাৎ লোহা, নিকেল ইত্যাদি পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে জমা হয়েছিল। কেন্দ্রের মজ্জাটিকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়, কেন্দ্রের ভেতরের দিকের কঠিন অন্তঃস্থ মজ্জা এবং বাইরের দিকে তরল বহিঃস্থ মজ্জা। এই তরল বহিঃস্থ মজ্জা তার তাপ পরিবহন করার জন্য পৃথিবীর ভেতরে পরিচলন (convection) পদ্ধতিতে পরিবাহিত হয়। যেহেতু এই পরিবহন হয় মূলত তরল ধাতব পদার্থের, এবং ধাতব পরমাণু থেকে ইলেকট্রন বিচ্ছিন্ন হয়ে সেগুলো চার্জড অবস্থায় থাকে তাই এর পরিবহন এক ধরনের বিদ্যুৎ প্রবাহের সৃষ্টি করে। আমরা এর মাঝে জেনে গেছি যে বিদ্যুৎ প্রবাহ চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি করে তাই ধাতব মৌল দিয়ে তৈরি এই বিদ্যুৎ প্রবাহ পৃথিবীর ভেতরে এক ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। এটাকেই আমরা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র হিসেবে দেখি।

পৃথিবীর অভ্যন্তরে অনেক জটিল গঠনের কারণে বিজ্ঞানীরা এই প্রক্রিয়াটির অনেক খুঁটিনাটি এখনো নিখুঁতভাবে বের করতে পারেননি এবং সে জন্য তারা নানভাবে গবেষণা করে যাচ্ছেন। যেহেতু পরিচলন পদ্ধতিতে তরলের আবর্তন খুব সুনির্দিষ্ট নয়, তাই মাঝে মাঝেই এর কম বেশি পরিবর্তন হয়, সেজন্য বিদ্যুৎ প্রবাহেরও পরিবর্তন বা স্থানান্তর হয়। সেজন্য পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রটিও স্থান পরিবর্তন করে। চুম্বকের এই মেরুগুলো পৃথিবীর প্রকৃত ভৌগলিক উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুতে অবস্থিত নয়। এই মুহূর্তে এটি আলাস্কার কাছাকাছি এবং প্রতি বছর প্রায় 6 কিলোমিটার হিসেবে সাইবেরিয়ার দিকে সরে যাচ্ছে।

পৃথিবীর এই চৌম্বক ক্ষেত্রটি যে শুধু ভৌগলিক মেরুতে সুনির্দিষ্ট না থেকে আশপাশে স্থান পরিবর্তন করে তা নয়, প্রায় পঞ্চাশ হাজার বছরে উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে পৃথিবী সৃষ্টির পর এখন পর্যন্ত শতাধিক বার পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র তার দিক পরিবর্তন করেছে!

পৃথিবীর এই চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করে থাকে। এই চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর উত্তর দক্ষিণ মেরু থেকে শুরু হয়ে সারা পৃথিবীকে ঘিরে থাকে এবং পৃথিবীর উপরে হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। চুম্বক ক্ষেত্র দিয়ে তৈরি এই অঞ্চলকে ম্যাগনোস্ফিয়ার বলে থাকে। সূর্য থেকে আমরা যে আলো এবং তাপ পেয়ে থাকি তার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিকর অতিবেগুণী রশ্মি এবং কখনো কখনো আয়নিত চার্জ এসে উপস্থিত হয়। বাতাসের উপরে ওজোন স্তর আমাদের আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে রক্ষা করে এবং পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র দিয়ে তৈরি ম্যাগনোস্ফিয়ার আমাদেরকে এই আয়োনিত চার্জ থেকে রক্ষা করে। সূর্য থেকে নির্গত চার্জড কণার চাপের কারণে ম্যাগনেস্ফিয়ারের গঠনটি একটু বিচিত্র। পৃথিবীর যে অংশ সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে তার উচ্চতা কমে যায়, আবার উল্টোদিকে ম্যাগনোস্ফিয়ার অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। সূর্য থেকে যে চার্জ কণাগুলো প্রবলবেগে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে সেগুলো এই চৌম্বক ক্ষেত্র আঘাত করে দিক পরিবর্তন করে সরে যায়। মাঝে মাঝে কিছু কণা চৌম্বক ক্ষেত্রে আটকে পড়ে ঘুরতে থাকে এবং সেগুলো বায়ুমণ্ডলের কাছাকাছি এলে ঘর্ষণের কারণে উত্তপ্ত হয়ে আলো বিকিরণ করে। পৃথিবীর উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি চৌম্বক ক্ষেত্র সবচেয়ে শক্তিশালী বলে এ ধরনের আলোর বিকিরণ মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি হয়ে থাকে, এগুলোকে মেরুপ্রভা (Aurora) বলা হয়।

তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে সূর্য থেকে আগত চার্জ কণাগুলো কেন চৌম্বক ক্ষেত্র ভেদ করে যেতে পারে না? এর পেছনের কারণটি বুঝতে হলে তোমাদের চৌম্বক ক্ষেত্রের আরেকটি ধর্ম জানতে হবে। সেটি হচ্ছে একটি চার্জ কণা যদি সরাসরি চৌম্বক ক্ষেত্রের দিকে যায় তাহলে সেটি কোনো বল অনুভব করে না, কিন্তু যদি চৌম্বক ক্ষেত্রের দিকে লম্ব ভাবে যায় তাহলে সেটি পাশের দিকে লম্বভাবে একটি বল অনুভব করে। এই বলটি চার্জকে সরাসরি সামনে যেতে না দিয়ে তাকে পাশে সরিয়ে দেয়। সেজন্য সূর্য থেকে আসা চার্জ কণাগুলো চৌম্বক ক্ষেত্র ভেদ করতে পারে না, পাশে সরে যায়। যদি চৌম্বক ক্ষেত্র যথেষ্ট শক্তিশালী হয় তাহলে পাশের দিকে ঠেলে দেওয়া বলটিও যথেষ্ট শক্তিশালী হয়, এবং চার্জ কণাগুলোকে প্রতি মুহূর্তে দিক পরিবর্তন করিয়ে চৌম্বক ক্ষেত্রের চারপাশে ঘোরাতে থাকে।

বিজ্ঞানীরা গবেষণা করার জন্য যে এক্সেলেটর তৈরি করেন সেখানে ইলেকট্রন, প্রোটন বা চার্জড আয়নকে প্রচণ্ড বেগে ঘুরিয়ে তার টার্গেটকে আঘাত করেন। সেই চার্জ কণাগুলোর গতিপথ পরিবর্তন করার জন্য এভাবে শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করা হয়।

কবুতর কিংবা পাখিদের চুম্বক ক্ষেত্র অনুভব করার ক্ষমতা আছে বলে অনুমান করা হয়। পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে এই পাখিগুলো সঠিক দিকে উড়ে যেতে পারে।

Content added By

Promotion