SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইসলাম শিক্ষা - Islamic Study - NCTB BOOK

ইবাদাত

পৃথিবীর সকল মাখলুককে মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর মানুষ ও জিন জাতিকে শুধু আল্লাহর ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, 'আমি সৃষ্টি করেছি জ্বিন এবং মানুষকে এই জন্য যে, তারা আমারই ইবাদাত করবে'। (সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ৫৬) ইবাদাতের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। সুতরাং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরিয়ত সমর্থিত যেকোনো উত্তম কাজই ইবাদাত।

ইবাদাত অর্থ আনুগত্য করা, বিনয় প্রকাশ করা, নমনীয় হওয়া, দাসত্ব করা। ইসলামের পরিভাষায় জীবনের সকল কাজ-কর্মে আল্লাহর বিধি-বিধান মেনে চলাকে ইবাদাত বলে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে তোমরা ইবাদাতের পরিচয়, তাৎপর্য ও প্রকারভেদ সম্পর্কে জেনেছ। ইসলামের প্রধান কয়েকটি ইবাদাত সালাত (নামায), সাওম (রোযা) ও যাকাত সম্পর্কে জানতে পেরেছ। এখানে আমরা ইসলামের মৌলিক ইবাদাতগুলোর মধ্যে সালাত (নামায), সাওম (রোযা), যাকাত ও হজ সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।

 

Content added By

সালাত

প্রিয় শিক্ষার্থীরা, তোমরা পূর্বের শ্রেণির ইবাদাত অধ্যায়ে ইসলামের মৌলিক ইবাদাত সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছ। এখন নিশ্চয়ই বাস্তব জীবনে সেগুলো অনুশীলন ও চর্চা করো। নবম শ্রেণির এই অধ্যায় থেকে তুমি চারটি ইবাদাত সম্পর্কে আরো বিস্তারিত ধারণা অর্জন করবে। এভাবে এই অধ্যায়ের বিভিন্ন অংশে শিক্ষকের নির্দেশনা অনুযায়ী ইবাদাতগুলো নিজে অনুশীলন ও চর্চা করার মাধ্যমে ইবাদাতের মূল শিক্ষা আত্মস্থ করতে পারবে।

এই অধ্যায়ের পাঠের আলোচনা শুরুর পূর্বেই একটু মনে করার চেষ্টা করো, পূর্বের শ্রেণির ইবাদাত অধ্যায়ে তুমি কী কী পড়েছিলে বা শিখেছিলে? এই ব্যাপারে তোমার সহপাঠী বন্ধুদের সহায়তা নাও, প্রয়োজনে শ্রেণি শিক্ষকের সহায়তা নাও। শিক্ষকের নির্দেশনা অনুসারে এই অধ্যায়ের বিভিন্ন কার্যক্রমে তুমি অংশগ্রহণ করবে। তাহলে চলো, আমরা এই ইবাদাত- সংক্রান্ত আলোচনা শুরু করি।

নামাজ শব্দটি ফারসি ভাষার। আরবিতে সালাত। সালাত সর্বোত্তম ইবাদাত। সালাতই একমাত্র ফরয ইবাদাত যা নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, সুস্থ-অসুস্থ প্রত্যেক মু'মিন বান্দার ওপর প্রতিদিন পাঁচবার আদায় করা ফরয। কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার সালাতের হিসাব নেওয়া হবে। কোনো কারণে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে না পারলে, বসে আদায় করতে হবে, বসে আদায় করতে না পারলে শুয়ে সালাত আদায় করতে হবে। তাও সম্ভব না হলে ইশারায় সালাত আদায় করতে হবে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ওযু করতে না পারলে বা পানি পাওয়া না গেলে তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করতে হবে। কিন্তু প্রত্যেক বান্দাকে সালাত আদায় করতেই হবে। কোনো কারণে যদি সালাত কাযা হয়েই যায়, তাহলে অবশ্যই কাযা সালাত আদায় করে নিতে হবে। তোমরা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে সালাত আদায়ের প্রয়োজনীয় নিয়মাবলি শিখেছ ও অনুশীলন করেছ। অষ্টম শ্রেণিতে সালাতুল আওয়াবিন, সালাতুত তাহাজ্জুদসহ বিভিন্ন নফল সালাত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছ। তারই ধারাবাহিকতায় নবম শ্রেণিতে ইশরাকের সালাত, ইসতিসকার সালাত, ইমামের সঙ্গে সালাত আদায়ের প্রয়োজনীয় নিয়মাবলি ও সালাতের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব সম্পর্কে শিখবে। তাহলে চলো এবার আলোচনা শুরু করা যাক।

 

জোড়ায় আলোচনা

 

 

'পূর্ববর্তী শ্রেণির (৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণি) সালাতের পুনরালোচনা' 

শ্রেণি শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক পূর্বের শ্রেণির ইবাদাত অধ্যায়ে সালাত বিষয়ক যা যা তোমরা জেনেছো জোড়ায় আলোচনা করে উপস্থাপন করো।

 

সালাতের ইমাম

ইমাম শব্দটি একবচন, বহুবচনে আইম্মাহ। ইমাম শব্দের অর্থ নেতা, সর্দার, প্রধান, অগ্রণী, দিক-নির্দেশক, দলপতি ইত্যাদি। পরিভাষায় জামা'আতে সালাত আদায়ের সময় মুসল্লিগণ যাকে অনুসরণ করে সালাত আদায় করে, তাকে ইমাম বলা হয়। ইমাম সালাত পরিচালনা করেন। মোটকথা, জামা'আতে নামায পড়ার সময় যিনি নামায পড়াবেন, তাঁকে ইমাম বলে। আর যারা পেছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়বেন তথা ইকতিদা করবেন তাদেরকে মুকতাদি বলে।

ইমামের যোগ্যতা 

একজন ইমামের জন্য নিম্নোক্ত যোগ্যতা থাকা অপরিহার্য।

১. মুসলমান হওয়া; 

২. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া; 

৩. সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া; 

৪. পুরুষ হওয়া; 

৫. বিশুদ্ধভাবে কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করতে সক্ষম হওয়া ও নামাযের বিধি-বিধান সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা।

ইমামতের জন্য সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তি

উপস্থিত মুসল্লিগণের মধ্যে যখন নির্ধারিত ইমাম অথবা রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিদের কেউ উপস্থিত না থাকেন, তখন নিম্নবর্ণিত ব্যক্তিগণ পর্যায়ক্রমে ইমামতের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন।

১. যিনি নামাযের মাসয়ালা-মাসায়েল সম্পর্কে বেশি জানেন, তিনিই ইমাম নির্বাচিত হবেন। 

২. এ গুণে সবাই সমান হলে বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াতকারী ব্যক্তি ইমাম হবেন। 

৩. এক্ষেত্রেও সবাই সমান হলে যিনি সবচেয়ে বেশি খোদাভীরু তিনি ইমাম হবেন। 

8. এতেও যদি সমান হয়, তাহলে যিনি বয়সে বড় তিনিই ইমাম হবেন। 

৫. এতেও যদি সকলে সমান হন, তাহলে উপস্থিত মুসল্লিগণের মতামতের ভিত্তিতে ইমাম নির্বাচিত হবেন।

ইমামের দায়িত্ব পালনের নিয়ম

ইমাম নামায শুরু করার সময় মুসল্লিগণ কাতার সোজা করে দাঁড়াবেন। মুসল্লিগণ প্রতিটি ক্ষেত্রে ইমামকে অনুসরণ করবেন। অর্থাৎ ইমাম তাকবিরে তাহরিমা বাঁধার পর মুক্তাদিগণ তাকবিরে তাহরিমা বাঁধবেন। ইমাম রুকুতে যাওয়ার পর মুক্তাদিগণ রুকুতে যাবেন। কোনো ক্ষেত্রে মুক্তাদি ইমামের আগে রুকু, সিজদা বা কোনো রুকন আদায় করলে মুক্তাদির নামায ভেঙে যাবে। ইমামের পেছনে নামায আদায়ের সময় মুক্তাদি সূরা কিরাআত পড়বেন না। ইমাম তিলাওয়াতে ভুল করলে বা অন্য কোনো ভুল করলে, নিকটবর্তী মুক্তাদি সংশোধন করে দেবেন। কোনো কারণে ইমামের নামায ভেঙে গেলে মুক্তাদির নামাযও ভেঙে যাবে। তাই ইমামকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে নামায আদায় করতে হয়। যদি ইমামের ওযুভঙ্গ হয়, তবে অন্য কাউকে ইমাম বানিয়ে পেছনে চলে আসতে হবে। নামাযে ইমাম বা মুক্তাদি যে কেউ ঘুমিয়ে পড়লে, বেহুঁশ হয়ে গেলে - অথবা অট্টহাসি দিলে নতুনভাবে ওযু করে পুনরায় নামায শুরু করতে হবে।

 ইমামের দায়িত্ব

রাসুলুল্লাহ (সা.) ইমাম ও মুয়াজ্জিনের জন্য দোয়া করেছেন। প্রিয় রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'ইমাম হলেন জিম্মাদার আর মুয়াজ্জিন হলেন আমানতদার। হে আল্লাহ! আপনি ইমামদের সুপথে পরিচালিত করুন এবং মুয়াজ্জিনদের ক্ষমা করে দিন'। (আবু দাউদ, তিরমিযি)

ইমামতি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব। ইমামকে মানবতার পথপ্রদর্শক ও সরল পথের দিশারি হতে হবে। একজন প্রকৃত ইমামই পারেন, দিগ্‌ভ্রান্ত মানুষকে সরল পথে পরিচালিত করতে এবং আল্লাহর সঙ্গে মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিতে। ইমাম শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়িয়ে নিজেকে দায়িত্বমুক্ত ভাবলে তা কখনো কাম্য নয়। মানুষ, মনুষ্যত্ব ও সমাজ নিয়েও একজন ইমামকে ভাবতে হবে। তাঁকে মানুষের সংশোধনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

যদি মুসল্লিদের নামাযে ভুল-ত্রুটি হয়, তাহলে কিছু সময় বের করে তাদেরকে সঠিকভাবে নামায আদায় করা শেখাতে হবে। যাঁরা কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত শিখেনি, তাদের কুরআন মাজিদ শেখার ব্যবস্থা করতে হবে। কুরআন মাজিদের অন্তত যতটুকু অংশ সঠিকভাবে তিলাওয়াত করতে জানলে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা যায়, এতটুকু তিলাওয়াত শেখা ফরয। মুসল্লিদের ফরয পরিমাণ কিরাআত শুদ্ধ না থাকলে এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। নামাযের প্রতি অলস ও উদাসীনকে সচেতন করতে হবে, নামাযের গুরুত্ব বুঝাতে হবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামা'আতের সঙ্গে আদায়ের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। সমাজের কেউ শরিয়তবিরোধী কাজ করলে ধীরে ধীরে তাকে সংশোধনের চেষ্টা করাও একজন ইমামের দায়িত্ব।

 

প্রতিবেদন লিখন (একক কাজ) 

'একজন ইমামকে যেসব কারণে আমি সম্মান করবো' 

(উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তুমি ২০০ শব্দের মধ্যে একটি প্রতিবেদন তৈরি করো। এক্ষেত্রে তুমি তোমার পরিবারের সদস্য, সহপাঠীদের সাহায্য নিতে পারো।

 

 সালাতুল ইসরাক (صَلوةُ الْإِشْرَاقِ ) 

ইশরাক অর্থ উদয়, প্রভাত বা সকাল। ইশরাকের নামায হলো প্রভাতের বা সকালের নামায। সূর্যোদয়ের পর যে সালাত আদায় করা হয়, তাকে ইশরাকের নামায বলে। হাদিসে এ সালাতকে সালাতুদ দোহাও বলা হয়েছে। সালাতুল ইশরাক বা ইশরাকের নামায আদায় করা সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদা অর্থাৎ আদায় করলে সাওয়াব পাওয়া যায়, আদায় না করলে কোনো গুনাহ হয় না।

সূর্যোদয়ের পর থেকে দ্বিপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত এ সালাত আদায় করা যায়। তবে ওয়াক্তের শুরুতেই ইশরাকের নামায পড়ে নেওয়া উত্তম। ফজরের সালাত আদায় করে সূর্যোদয় পর্যন্ত নামাযের স্থানে বসে দু'আ, দুরুদ, তাসবিহ পাঠ করে এরপর সূর্য পরিপূর্ণ উদয় হলে ২ রাকা'আত করে ৪, ৬ বা ৮ রাকা'আত নামায আদায় করতে হয়। ইশরাকের নামাযের আগে দুনিয়ার কোনো কাজকর্ম না করা উত্তম। কোনো কাজকর্ম করলেও সালাত আদায় করা যাবে, তবে তাতে সাওয়াব কম হবে। যেহেতু সূর্যোদয়ের সময় নামায পড়া হারাম, তাই সূর্যোদয়ের সময় থেকে অন্তত ১৫-২০ মিনিট সময় দেরি করে ইশরাকের নামায আদায় করতে হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই নামাযের জন্য দাঁড়ানো উচিত নয়। কারণ, তাতে গুনাহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ইশরাকের নামায অনেক ফযিলতপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ফযিলত সম্পর্কে বলেন, 'যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামা'আতে আদায় করে, তারপর সূর্যোদয় পর্যন্ত সেখানেই বসে থাকে এবং আল্লাহর যিকর করে, তারপর দুই রাকা'আত সালাত আদায় করে, সে একটি হজ ও একটি ওমরাহ এর সাওয়াবের সমান সাওয়াব পাবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) পূর্ণ (সাওয়াব) কথাটি তিনবার বলেছেন'। (তিরমিযি)

এ নামায আদায়কারীর সগিরা গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.), সাহাবিগণ ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ এ নামায আদায় করতেন। আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভ ও অধিক সাওয়াব অর্জনের জন্য আমরা নিয়মিত ইশরাকের নামায আদায় করব।

সালাতুল ইসতিসকা ( صَلُوةُ الْإِسْتِسْقَاءِ )

ইসতিসকা অর্থ পানি বা বৃষ্টি প্রার্থনা করা। অনাবৃষ্টির সময় আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে যে সালাত আদায় করা হয়, তাকে ইসতিসকার নামায বলে। এ নামায সুন্নাত। প্রিয় নবি (সা.) বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে বলতেন,

اللَّهُمَّ اسْقِ عِبَادَكَ وَبَهَائِمَكَ وَانْشُرْ رَحْمَتَكَ وَأَحْيِ بَلَدَكَ الْمَيِّتَ

অর্থ: হে আল্লাহ! তোমার বান্দা ও পশুপালকে পানি দান করো। তাদের প্রতি তোমার অনুগ্রহ বর্ষণ করো। মৃত জমিনকে জীবিত করো। (আবু দাউদ)

ইসতিসকার নামায আদায়ের নিয়ম ও ফযিলত

সব বয়সী মুসলিম পুরুষেরা হেঁটে খোলা মাঠে একত্রিত হবে। গুনাহের কথা চিন্তা করে কাকুতি মিনতি করে আল্লাহ তা'আলার নিকট তাওবা করবে। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, 'রাসুলুল্লাহ (সা.) খুবই সাদামাটাভাবে, বিনয়-নম্রতা ও আকুতিসহ বাড়ি থেকে বের হয়ে (ইসতিসকার) নামাযের মাঠে উপস্থিত হতেন।' (আবু দাউদ)

ইসতিসকার নামায দুই রাকা'আত, এ নামায জামা'আতের সঙ্গে আদায় করতে হয়। এর জন্য কোনো আজান বা ইকামত দিতে হয় না। একজন মুত্তাকি তথা আল্লাহভীরু ব্যক্তি ইমাম নিযুক্ত হবেন। ইমাম উচ্চঃস্বরে কিরাআত পড়বেন এবং সালাম ফিরিয়ে দুটি খুতবা দেবেন। এরপর সবাই মিলে কিবলামুখী হয়ে হাত প্রসারিত করে দু'আ করবে। এভাবে পরপর তিন দিন নামায পড়তে হয়। এই দিনগুলোতে রোযা রাখা এবং দান সদকা করা মুস্তাহাব। এর মধ্যে বৃষ্টি শুরু হলেও তিন দিন পূর্ণ করা উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃষ্টির জন্য নামায আদায় করা ব্যতীতও দোয়া করেছেন। যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, 'একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) জুমুআর খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক মরুবাসী বেদুইন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 'হে আল্লাহর রাসুল! (পানির অভাবে) ঘোড়া মরে যাচ্ছে, ছাগল বকরিও মরে যাচ্ছে। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করুন, যাতে তিনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করেন।' তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের দু'হাত প্রসারিত করলেন ও দোয়া করলেন।' (বুখারি)। তাঁর দোয়ার ফলে বিপুল পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছিল।

বৃষ্টির নামাযে বিনয়-নম্রতার সঙ্গে গমন করা সুন্নাত। একমাত্র আল্লাহ তা'আলাই যে বান্দার সব প্রয়োজন পূরণ করেন, এ বিশ্বাস অন্তরে জাগ্রত রাখতে হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'তোমরা তোমাদের রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল। তোমাদের জন্য তিনি মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন।' (সূরা নূহ, আয়াত: ১০-১১)

সালাত অনুশীলন

 

 

প্রিয় শিক্ষার্থী,

তুমি আজকের আলোচনা থেকে সালাত সম্পর্কে যে ধারণা লাভ করেছো সে অনুযায়ী বাড়িতে চর্চা বা অনুশীলন করবে।

 

সালাতের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব

ধর্মীয় গুরুত্ব

নামায সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদাত ও দ্বীন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। প্রিয় নবি (সা.) সালাতকে দ্বীনের খুঁটি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে নামাযের বিকল্প নেই। যারা নিয়মিত নামায আদায় করে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ الَّذِيْنَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خُشِعُوْنَ 

অর্থ: মু'মিনরাই সফলকাম হয়েছে। যারা তাদের সালাতে বিনয়ী-নম্র হয়। (সূরা আল-মু'মিনুন, আয়াত: ১-২)

সালাত আল্লাহ তা'আলা এবং বান্দার মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি করে। ব্যক্তির অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে সালাত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে শৃঙ্খলিত এবং সুসংগঠিত জীবনে অভ্যস্ত করে তোলে। সালাতের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন,

مَنْ حَافَظَ عَلَيْهَا كَانَتْ لَهُ نُورًا وَبُرْهَانًا وَنَجَاةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ

অর্থ: যে ব্যক্তি যথাযথভাবে নামায আদায় করে, নামায তাঁর জন্য কিয়ামতের দিন জ্যোতি, দলিল এবং মুক্তির উপায় হবে। (মুসনাদে আহমদ)

আল্লাহ তা'আলা ব্যক্তির একনিষ্ঠ ইবাদাতকে গ্রহণ করেন। একাগ্রতার সঙ্গে সালাত আদায় করলে ব্যক্তির গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। প্রিয় নবি (সা.) বলেন, 'ফরয নামাযের সময় হলে যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযু করে একাগ্রতার সাথে রুকু-সিজদা আদায় করে নামায পড়ল, তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। যতক্ষণ না সে কোনো কবীরা গুনাহে লিপ্ত হয় এবং তার সারা জীবন এমনটি চলতে থাকবে'। (মুসলিম)

পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামা'আতে আদায় করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর আবশ্যক। জামা'আতে সালাত আদায় করলে একাকী আদায়ের চেয়ে সাতাশ গুণ বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'যে ব্যক্তি সকালে বা সন্ধ্যায় মসজিদে যায় (অর্থাৎ জামা'আতে সালাত আদায় করে), আল্লাহ তা'আলা তার জন্য জান্নাতে আতিথেয়তার আয়োজন করেন। যতবার সে সকাল সন্ধ্যায় যায়, ততবারই। (বুখারি ও মুসলিম)

বিচার দিবসে প্রথম যে বিষয়ের হিসাব নেওয়া হবে তা হলো নামায। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'সর্বপ্রথম বান্দার যে বিষয়ের হিসাব নেওয়া হবে, তা হলো সালাত।' (ইবনে মাজাহ)

ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত ত্যাগ করা যাবে না। মহানবি (সা.) বলেন,

إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ

অর্থ: বান্দা এবং শিরক ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে নামায পরিত্যাগ করা। (মুসলিম)

 

প্যানেল/দলে আলোচনা

'নিয়মিত সালাত আদায়ের মাধ্যমে আমার/আমাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণে যেসব পরিবর্তন করব'

(উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তোমরা প্যানেল বা দলে আলোচনা করে উপস্থাপন করো)।

 

সামাজিক গুরুত্ব

সালাতের সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। সালাত সমাজে ঐক্য, শান্তি, শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। জামা'আতে ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই একই সারিতে দাঁড়িয়ে ঐক্যের বীজ বপন করে সাম্য প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ হয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'তোমরা রুকুকারীদের সাথে রুকু করো'। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৪৩)

সালাতের মাধ্যমে দৈনিক পাঁচবার একে-অপরের খোঁজ-খবর নেওয়ার সুযোগ হয়। এর মাধ্যমে সমাজে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বাড়ে। সালাতের অনুশীলন মানুষকে নিয়মানুবর্তিতা শেখায়। এতে সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। নামায আদায়ের জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া পূর্বশর্ত। ফলস্বরূপ মানুষ পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়।

ধৈর্যশীলতা সালাতের অন্যতম শিক্ষা। সালাতের সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি অনুসরণ করে মানুষ ধৈর্যধারণে পারদর্শী হয়ে উঠে। এজন্য আল্লাহ তা'আলা বলেন,

يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلوةِ 

অর্থ: হে ইমানদারগণ, তোমরা সালাত এবং ধৈর্যের দ্বারা সাহায্য প্রার্থনা করো। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৩)

সালাতে অভ্যস্ত ব্যক্তি যাবতীয় অশ্লীলতা এবং পাপাচার থেকে মুক্ত থাকে। সালাত মানুষকে পুণ্যকাজে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

إِنَّ الصَّلوةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ . ط

অর্থ: নিশ্চয় নামায মানুষকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। (সূরা আল-আনকাবুত, আয়াত: ৪৫)

 

Content added By

সাওম

সাওম বা রোযা ইসলামের তৃতীয় রুকন। ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রাপ্তবয়স্ক সবার ওপর রমযান মাসে রোযা রাখা ফরয। সাওমের প্রতিদান আল্লাহ তা'আলা নিজেই দেবেন। পানাহার না করার কারণে রোযাদার ব্যক্তির মুখে যে ঘ্রাণ তৈরি হয়, তা আল্লাহ তা'আলার নিকট মিশকের সুগন্ধ থেকেও অধিক প্রিয়। রমযান মাস, সিয়াম পালন, তারাবিহর সালাত ও লাইলাতুল ক্বদর সবই আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য বিশেষ উপহার।

পূর্বের শ্রেণিতে তোমরা সাওম পালন সম্পর্কে বেশ কিছু বিধি-বিধান শিখেছ। তারই ধারাবাহিকতায় এবার তোমরা সাওমের প্রস্তুতি, রমযান মাসের ফযিলত, লাইলাতুল ক্বদরের মাহাত্ম্য, ঈদ ও ঈদের দিন সম্পর্কে জানতে পারবে। তোমরা যথাযথভাবে সাওম পালন করার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করতে পারবে এবং সে অনুযায়ী মানবিক জীবন গঠন করতে পারবে। তাহলে চলো! এবার আমরা মূল আলোচনা শুরু করি।

প্রিয় শিক্ষার্থী, ইবাদাত অধ্যায়ে সাওম সম্পর্কে আলোচনার শুরুতে তুমি/তোমরা বিগত রমযান মাসে যেসব ইবাদাত করেছ, তোমার বন্ধুর সঙ্গে সেসব ইবাদাতের অভিজ্ঞতা বিনিময় করো। তুমি/তোমরা বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে বিগত রমযান মাসের স্মৃতিচারণ করে যা যা পেলে, তা নিচের ছকে লিখে ফেলো।

সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও জৈবিক চাহিদা পূরণ থেকে বিরত থাকার নাম সাওম বা রোযা। সাওম দ্বীন ইসলামের অন্যতম প্রধান রুকন। ইসলামি শরিয়তে সালাতের পর সাওম একমাত্র সর্বজনীন ফরয ইবাদাত। অর্থাৎ রমযান মাসে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মু'মিন ব্যক্তির ওপর সাওম পালন করা ফরয। এক মাসের সিয়াম সাধনা মু'মিন ব্যক্তিকে তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধি অর্জনে সাহায্য করে। ফলে ইবাদাতের প্রতি ইখলাস তৈরি হয়।

সারাদিন পানাহার ও জৈবিক চাহিদা পূরণ থেকে বিরত থাকার দরুন রোযাদারের ধৈর্য বৃদ্ধি পায়, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা-সহানুভূতি বৃদ্ধি পায়। প্রত্যেক ইবাদাতেরই সাওয়াব রয়েছে। কিন্তু হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তা'আলা রোযা সম্পর্কে বলেছেন, 'রোযা আমার জন্য আর আমিই এর প্রতিদান দেব।' তোমরা সপ্তম শ্রেণিতে সাওম পালন সম্পর্কে বিস্তারিত শিখেছ। অষ্টম শ্রেণিতে তোমরা সাওমের প্রস্তুতি, রমযান মাসের ফযিলত, লাইলাতুল কদরের মাহাত্ম্য ও ঈদুল ফিতর সম্পর্কে জেনেছ। তারই ধারাবাহিকতায় নবম শ্রেণিতে তোমরা যেসব পরিস্থিতিতে সাওম পালন নিষিদ্ধ, যেসব অবস্থায় রোযা ভাঙা বৈধ, ফিদিয়ার বিধান, ইবাদাত হিসেবে সাওমের গুরুত্ব এবং সাওমের নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষা সম্পর্কে জানতে পারবে। আশা করি, তোমরা সাওমের শিক্ষা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। তাহলে চলো, আমরা আলোচনা শুরু করি।

যেসব পরিস্থিতিতে সাওম পালন নিষিদ্ধ

আল্লাহ তা'আলা প্রতিটি ইবাদাতকে তাঁর বান্দাদের জন্য সহজসাধ্য করেছেন। তিনি সাধ্যাতীত কোনো কিছুকে বান্দার ওপর চাপিয়ে দেননি। পূর্ববর্তী ইমানদারদের মতো প্রত্যেক সুস্থ, সবল, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ওপর আল্লাহ তা'আলা এক মাস সিয়াম পালন ফরয করেছেন। এছাড়া রমযান পরবর্তী দিনগুলোতেও সিয়ামের বিশেষ ফযিলত ও গুরুত্ব রয়েছে।

তবে এমন কিছু দিন ও অবস্থা রয়েছে, যাতে রোযা রাখা হারাম। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা এবং তার পরের তিন দিন অর্থাৎ শাওয়াল মাসের ১ তারিখ ও যিলহজ মাসের ১০, ১১, ১২ ও ১৩ তারিখসমূহ বছরে এই পাঁচটি দিনে যেকোনো ধরনের রোযা রাখা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

সাহাবি হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, 'রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার দিনে রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। (বুখারি ও মুসলিম)

আর নারীদের ক্ষেত্রে হায়েয (মাসিক ঋতুস্রাব) এবং নেফাস (সন্তান জন্মদানের পর রক্তস্রাব) অবস্থায় রোযা রাখা নিষেধ। তবে পরবর্তী সময়ে যখন সুস্থ হবে, তখন উক্ত রোযাগুলো কাযা করতে হবে।

যেসব অবস্থায় সাওম ভাঙা বৈধ

কোনো ব্যক্তি অসুস্থ হলে তার সাওম বা রোযা ভঙ্গ করার অনুমতি আছে।

সফর অবস্থায় অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি তিন মঞ্জিল (৪৮ মাইল বা ৮০ কিলোমিটার) বা তার অধিক পথ অতিক্রম করে, তার রোযা পালন করা বা না করা উভয়ের অনুমতি রয়েছে। তবে বেশি কষ্ট না হলে রোযা রাখাই উত্তম। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَّرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ

গর্ভবতী কিংবা স্তন্যদাত্রী নারী নিজের কিংবা সন্তানের জীবননাশের আশঙ্কা করলে রোযা ভঙ্গের অনুমতি রয়েছে। মহানবি (সা.) বলেন, 'আল্লাহ তা'আলা মুসাফিরের অর্ধেক নামায কমিয়ে দিয়েছেন (চার রাকা'আত বিশিষ্ট নামায দুই রাকা'আত পড়বে) আর গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিণী নারীদের রোযা ভঙ্গের অনুমতি দিয়েছেন (আবু দাউদ, তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ)। অর্থাৎ তাদের জন্য এ সময় রোযা না রেখে পরবর্তী সময়ে তা পূরণ করার অনুমতি রয়েছে।

যে রোযাসমূহ বিশেষ অবস্থায় ভঙের অনুমতি রয়েছে, পরবর্তীতে তার কাযা আদায় করা ওয়াজিব।

ফিদিয়ার বিধান

ফিদিয়া অর্থ কাফফারা, মুক্তিপণ ইত্যাদি। এমন অসুস্থ বা বৃদ্ধ ব্যক্তি, যার সুস্থতার আশা করা যায় না অথবা যদি কোনো ব্যক্তি রোযার কাযা আদায় না করে মারা যায়, তাহলে তার পক্ষ থেকে রোযার ফিদিয়া আদায় করতে হবে। রোযার ফিদিয়া হলো এক ফিতরা পরিমাণ অর্থাৎ অর্ধ সা' বা ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম গম বা আটা অথবা সমপরিমাণ মূল্য প্রতিটি রোযার পরিবর্তে কোনো মিসকিনকে প্রদান করা। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ 

অর্থ: (আর যদি কারো জন্য রোযা রাখা নিতান্তই কষ্টকর হয়) তাহলে সে (প্রতিটি রোযার পরিবর্তে) ফিদিয়া হিসেবে একজন অভাবীকে খাওয়াবে। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৪)

সাহাবি হযরত আনাস (রা.) বৃদ্ধ হওয়ার পর এক কিংবা দুই বছর রোযা রাখতে পারেননি। তাই প্রতি রোযার পরিবর্তে তিনি একজন মিসকিনকে গোশত-রুটি খাইয়েছেন। (ফাতহুল বারি) প্রতি রোযার পরিবর্তে একজন দরিদ্র ব্যক্তিকে ইফতার ও সাহরি খাওয়ালেও ফিদিয়া আদায় হয়ে যাবে। শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান কোনো ব্যক্তি রোযা না রেখে ফিদিয়া আদায় করলে তা জায়েয হবে না।

 

একক কাজ 

'ফিদিয়ার প্রযোজ্য ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করো' 

(উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে শ্রেণি শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তুমি ফিদিয়ার প্রযোজ্য ক্ষেত্রগুলো উপস্থাপন করো)।

 

ইবাদাত হিসেবে সাওমের গুরুত্ব

আরবি 'সাওম' শব্দের অর্থ বিরত থাকা। সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার, পাপাচার, কামাচার থেকে বিরত থাকার নাম সাওম বা রোযা। যা পালন করা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর ওপর ফরয। রোযার অনেকগুলো প্রকার রয়েছে, তন্মধ্যে রমযান মাসের রোযা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'যে ব্যক্তি ওজর (বিশেষ অপারগতা) এবং রোগ ব্যতীত রমযানের একটি রোযা ভাঙল, তার সারা জীবনের রোযা দ্বারাও এর কাযা আদায় হবে না। যদিও সে সারা জীবন রোযা রাখে'। (বুখারি)

একজন মু'মিনের আত্মশুদ্ধির ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের অন্যতম মাধ্যম হলো সিয়াম বা রোযা। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ 

অর্থ: হে ইমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩)

অন্যান্য ইবাদাত মানুষকে দেখানো যায় বলে এতে রিয়া বা লৌকিকতার সম্ভাবনা থাকে। আর রোযা এমন একটি বিশেষ ইবাদাত যা রোযাদার নিজে জানতে পারে। চাইলেও কাউকে দেখানো যায় না। তাই আল্লাহ তা'আলা এর বিশেষ প্রতিদানের ঘোষণা দিয়েছেন।

হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, 'মহান আল্লাহ বলেন,

 الصَّوْمُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ

অর্থ: রোযা আমার জন্য আর আমিই এর প্রতিদান দিব'। (বুখারি ও মুসলিম)

প্রিয় নবি (সা.) বলেন, 'রোযাদারের জন্য দুইটি খুশি। একটি হলো তার ইফতারের সময়, আর অপরটি হলো আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।' (বুখারি ও মুসলিম)

সিয়াম সাধনার ফলে রোযাদার অনাহার, অর্ধাহার ও পিপাসায় থাকা মানুষ কতটা দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করে তা অনুভব করতে পারে। ফলে রোযাদার সমাজের সকলের প্রতি বিশেষভাবে অসহায়, গরিব-দুঃখীদের প্রতি - সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে।

আগুনের তাপ যেভাবে একটি বাঁকা কাঠকে সোজা করে তোলে, তেমনিভাবে রোযা বান্দার কলবের রিপু দূরীভূত করে লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, পরনিন্দা, ঝগড়া-ফাসাদ, অশ্লীলতার চর্চা প্রভৃতি থেকে মুক্ত করে। এতে আমাদের দৃষ্টি নিজের অক্ষমতা ও অপারগতা এবং আল্লাহ তা'আলার কুদরতের দিকে নিবদ্ধ হয়। অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়। পাশবিকতা ও পশুত্ব অবদমিত হয়। আমাদের চরিত্রে পশুসুলভ গুণের অবদমন ও ফেরেশতাসুলভ বৈশিষ্ট্য তৈরি হয় এবং রুহানি (আত্মিক) শক্তি বৃদ্ধি পায়। তাই অন্তর আত্মার পশুত্ব দমনে রোযার কোনো বিকল্প নেই।

 খাবার গ্রহণের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রোযাদার আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় এ সবকিছু থেকে বিরত থাকেন। ফলে রোযাদার অন্তরাত্মাকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে অভ্যস্ত হন। মহানবি (সা.) বলেন,

إِنَّ الشَّيْطَانَ لَيَجْرِي مِنْ ابْنِ آدَمَ مَجْرَى الدَّمِ فَضَيِّقُوْا مَجَارِيَهُ بِالْجُوْعِ

অর্থ: নিশ্চয়ই শয়তান মানব শরীরের রক্তের মতো চলাচল করে, তাই তাদের চলাচলের পথকে ক্ষুধার মাধ্যমে সংকোচন করে দাও। (তাবকাতুশ শাফী'ইয়্যাহ)

আর রমযান মাসে রোযা রাখার মধ্য দিয়ে সারা দিন প্রচণ্ড ক্ষুধা-তৃষ্ণা সত্ত্বেও পানাহার পরিহার করতে হয়। রাতে দীর্ঘ সময় তারাবির নামায আদায় এবং ভোররাতে ঘুম ভেঙে সাহরি গ্রহণ করতে হয়। এর মাধ্যমে রোযাদারের ধৈর্যের পরীক্ষা হয়। যারা এ পরীক্ষায় সফলতা লাভ করে, পরকালে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন,

وَهُوَ شَهْرُ الصَّبْرِ وَالصَّبْرُ ثَوَابُهُ الْجَنَّةُ

অর্থ: রমযান মাস ধৈর্যের মাস, আর ধৈর্যের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। (মিশকাতুল মাসাবিহ)

তিনি আরো বলেন- اَلصَّوْمُ نِصْفُ الصَّبْرِ অর্থাৎ রোযা ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার অর্ধেক। (তিরমিযি )

সাওমের নৈতিক শিক্ষা

সাওম এমন এক ইবাদাত যা সাওম পালনকারীকে দান করে সজীবতা, হৃদয়ের পবিত্রতা, চিন্তার বিশুদ্ধতা, আত্মিক তৃপ্তি, নতুন উদ্দ্যম ও প্রেরণা। সাওমের বিশুদ্ধতা যখন বান্দার অন্তর ছাড়িয়ে সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গে পৌঁছে যায়, তখন ঐ ব্যক্তি হয় সর্বোচ্চ নীতিবান। তাঁর হাত দ্বারা কোনো অন্যায় হয় না। সে কাউকে অশালীন ও বিব্রতকর কথা বলে না। সাওমের অন্যতম নৈতিক শিক্ষা মিথ্যা পরিত্যাগ করা। কোনো ব্যক্তি সাওম পালন করা সত্ত্বেও মিথ্যা বলার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে না পারলে তার রোযা রাখা আর না রাখার মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

সাওমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিপন্থী কাজ হতে বিরত থাকার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বদা বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন। সাওম অবস্থায় আমাদের অশ্লীলতায় লিপ্ত হওয়া এবং ঝগড়া-বিবাদ করা উচিত নয়। কেউ যদি রোযাদারকে গালি দেয় বা সংঘাতে লিপ্ত হয়, তাহলে রোযাদার শুধু বলবে, 'আমি রোযাদার'।

সাওম আমাদের ইমান ও তাকওয়ার নৈতিক শিক্ষা দেয়। একজন মু'মিনের নৈতিক শিক্ষার সঙ্গে আল্লাহর কাছে গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া পূর্বের জীবনের গুনাহ মাফ, যা সাওমের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ

অর্থ: যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে ও সাওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখবে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারি)

হাদিসে রোযাকে ঢালস্বরূপ বলা হয়েছে। তবে মিথ্যা কথা ও গিবত দ্বারা রোযার বরকত নষ্ট হয়। হালাল রিযিক আহার রোযার অন্যতম শর্ত। রোযার মূল উদ্দেশ্য হলো অন্তরের পাশবিকতা নির্মূল করা, যা হারাম খেয়ে কখনো সম্ভব নয়। রোযা মানুষকে কাম ক্রোধসহ সকল রিপুকে দমন করে।

সাওমের সামাজিক শিক্ষা

সাওম মানুষকে ভোগে বিতৃষ্ণ, ত্যাগে উদ্বুদ্ধ এবং আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করে তোলে। পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই শুধু সাওম নয়; বরং সমাজের অবহেলিত অসহায় মানুষদের দুঃখ, দুর্দশা, ক্ষুধা ও পিপাসার যন্ত্রণা অনুভব করা এবং তাদের প্রতি সদয় হওয়াকে বোঝায়। রমযান মাসে বেশি বেশি দান-সদকা করা সাওমের অন্যতম শিক্ষা। মহানবি (সা.) নিজে বেশি বেশি দান-সদকা করতেন এবং রমযান মাস এলে তার দানশীলতা আরো বেড়ে যেত। সাওমের এই ত্যাগের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হলে সমাজে সহমর্মিতা ও সহানুভূতির বীজ অঙ্কুরিত হয়। সমাজে মানুষে মানুষে উঁচু-নীচু ভেদাভেদ দূর হয়।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'এ মাস (রমযান মাস) সহানুভূতির মাস। (ইবনে খুজায়মা)

সাওমের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক শিক্ষা অশ্লীলতা, গালিগালাজ ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিরত রাখা। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ বিষয়ে জোর তাগিদ দিয়েছেন।

রমযান মাস আসলে দেখা যায় কিছু মুনাফাখোর মজুতদার ব্যবসায়ী দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়, এ কারণে সকল শ্রেণির লোক বিপাকে পড়ে। এটি সরাসরি সাওমের শিক্ষার বিপরীত।

সাওমের সামাজিক শিক্ষা বাস্তবায়িত হলে ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সামাজিক অস্থিরতা, ঘুষ-দুর্নীতি, মিথ্যা ও চরিত্রহীনতার কলুষতা থেকে মুক্ত করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আদর্শ ও কল্যাণমুখী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

 

অনুসন্ধানমূলক কাজ

সাওম পালনের মাধ্যমে তোমার নিজের বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের জীবন-যাপনে কী কী পরিবর্তন হলো তা পর্যবেক্ষণ করো'

(উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তুমি নিজেকে বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যকে পবিত্র রমযান মাসে পর্যবেক্ষণ করে তোমার বা তাদের মধ্যে পরিবর্তনগুলো চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করো। (পবিত্র রমযান মাসে এ কাজটি সম্পন্ন করবে।)

 

 

Content added By

যাকাত ( الزَّكُوةُ ) 

প্রিয় শিক্ষার্থী যাকাত ইসলামের অর্থনৈতিক স্তম্ভ। সালাতের পরেই যাকাতের স্থান। যাকাত সমাজের ধনী ব্যক্তিদের সম্পদে অসহায়, গরিব-দুঃখী ও নিঃস্বদের হক। এ হক বা অধিকার আদায় করা অবশ্যকর্তব্য। তোমরা পূর্বের শ্রেণিতে যাকাতের নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছো। যাকাত ফরয হওয়ার শর্ত, যাকাত ব্যয়ের খাত, যাকাতের গুরুত্ব, যাকাত আদায় না করার পরিণাম, যাকাতের নিসাব এবং যাকাত হিসাবের নিয়ম সম্পর্কে জেনেছ। চলো আমরা আরো বিস্তৃত পরিসরে কৃষিজ ফসল, ব্যবসায়িক সম্পদ ও গবাদি পশুর যাকাত এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে যাকাতের ভূমিকা সম্পর্কে জেনে নিই।

যাকাতের পরিচয়

যাকাত অর্থ হলো পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তির মনের কলুষতা দূর হয়। তার অন্তর থেকে কার্পণ্য চলে যায়। তার অন্তর মানুষের প্রতি সদয় হয়। এভাবে তার মনের পবিত্রতা অর্জিত হয়। এছাড়া তাঁর সম্পদে অসহায়, গরিব-দুঃখীদের যে হক আছে তা যাকাতের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। ফলে তার সম্পদও পবিত্র হয়। এ জন্য যাকাতের অর্থ পবিত্রতা। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন,

خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا

অর্থ: 'তাদের সম্পদ হতে 'সদকা' গ্রহণ করবেন। এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিশোধিত করবেন।' (সূরা তাওবা, আয়াত: ১০৩)।

তাছাড়া যাকাত দানকারীর সম্পদে আল্লাহ তা'আলা বরকত দান করেন। যাকাত প্রদানের ফলে সমাজে অসহায়, গরিব-দুঃখী ও নিঃস্বদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে সামগ্রিক উৎপাদন, সরবরাহ ও ভোগ-ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। ফলে দেশের অর্থনীতি গতিশীল হয় এবং প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পায়। তাই যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদও বৃদ্ধি পায়। এজন্য যাকাতের অন্য অর্থ বৃদ্ধি।

ইসলামি পরিভাষায়, সাহিবে নিসাবের সম্পদে দরিদ্র, অসহায়, গরিব, অভাবী ও নিঃস্ব ব্যক্তিদের আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত যে অংশ রয়েছে, তা যথাযথভাবে আদায় করে দেওয়ার নামই যাকাত।

 

প্যানেল আলোচনা 

'সঠিক নিয়মে যাকাত প্রদান করলে আমাদের সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে' 

(উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তোমরা প্যানেল আলোচনা করে উপস্থাপন করো)।

 

 উশর (عُشْرٌ) বা ফসলের যাকাত 

সোনা, রূপা, নগদ টাকা ও ব্যবসায়িক সম্পদের যেমন যাকাত প্রদান করতে হয়; তেমনি জমিনে উৎপাদিত কৃষি সম্পদের যাকাত প্রদান করতে হয়। কৃষি সম্পদ বা ফসলের যাকাতকে উশর নামে অভিহিত করা হয়। একে ফল ও ফসলের যাকাতও বলা হয়। আল্লাহ তা'আলা ফসলের যাকাতের কথা উল্লেখ করে বলেন,

وَهُوَ الَّذِي أَنشَأَ جَنَّتٍ مَّعْرُوشُتٍ وَغَيْرَ مَعْرُوشُتٍ وَالنَّخْلَ وَالزَّرْعَ مُخْتَلِفًا أُكُلُهُ وَالزَّيْتُونَ وَالرُّمَّانَ مُتَشَابِهًا وَغَيْرَ مُتَشَابِهٍ كُلُوا مِنْ ثَمَرَةٍ إِذَا أَثْمَرَ وَأَتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ * وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ 3

অর্থ: তিনিই লতা ও বৃক্ষ উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং খেজুর বৃক্ষ, বিভিন্ন স্বাদবিশিষ্ট খাদ্যশস্য, যায়তুন ও আনার সৃষ্টি করেছেন। এগুলো একে অন্যের সদৃশ ও বিসদৃশও। যখন এগুলো ফলবান হয়, তখন এগুলোর ফল খাও আর ফসল তোলার দিন ফসলের হক দিয়ে দাও। (সূরা আল-আন'আম, আয়াত: ১৪১)

এই আয়াতে ফসলের হক বলতে ফসলের যাকাতকে বুঝানো হয়েছে।

উশর ( عُشر )অর্থ এক-দশমাংশ বা ১০ ভাগের ১ ভাগ। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় নদী, ঝরনা বা বৃষ্টির পানি দ্বারা সিক্ত জমি থেকে যে ফসল উৎপন্ন হয়, তার এক-দশমাংশ যাকাত প্রদান করাকে উশর বলে। তবে কৃত্রিম চাষাবাদ পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসলের ক্ষেত্রে ২০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত আদায় করতে হয়। এটাকে নিসফে উশর বলে।

এ যাকাত অন্যান্য গবাদি পশু, নগদ সম্পদ ও ব্যবসায়ের পণ্য ইত্যাদির যাকাত থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এর হিসাবও আলাদা। এতে এক বছর পূর্ণভাবে অতিবাহিত হওয়ার কোনো শর্ত নেই; বরং শুধু তা উৎপাদিত হলেই যাকাত প্রদান করতে হবে। কেননা, উৎপাদিত ফসলই জমির প্রবৃদ্ধি।

রাসুলুল্লাহ (সা.) ফসলের যাকাতের পরিমাণ উল্লেখ করে বলেন,

فِيمَا سَقَتِ السَّمَاءُ وَالْعُيُونُ أَوْ كَانَ عَثَرِيَّا الْعُشْرُ وَمَا سُقِيَ بِالنَّضْحِ نِصْفُ الْعُشْرِ

অর্থ: বৃষ্টি ও প্রবাহিত পানি দ্বারা সিক্ত ভূমিতে উৎপাদিত ফসল বা সেচ ছাড়া উর্বরতার জন্য উৎপন্ন ফসলের ওপর উশর (১০ ভাগের ১ ভাগ) যাকাত ওয়াজিব হয়। আর সেচ দ্বারা উৎপাদিত ফসলের ওপর নিসফে উশর (২০ ভাগের ১ ভাগ)। (বুখারি)

উৎপাদিত ফসল ও ফলের নিসাব

ধান, গম, যবসহ অন্যান্য সকল ফসল অল্প হোক বা বেশি, ভূমি থেকে উৎপাদিত সকল শস্যের ওপর উশর ওয়াজিব হবে। তা প্রবাহিত পানি দ্বারা সিঞ্চিত হোক, কিংবা বৃষ্টির পানি দ্বারা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বৃষ্টি ও প্রবাহিত পানি দ্বারা সিক্ত ভূমিতে উৎপাদিত ফসলের ওপর উশর আর সেচ দ্বারা উৎপাদিত ফসলের ওপর নিসফে উশর ওয়াজিব হয়। (বুখারি) এ হাদিসে ফসলের কোনো পরিমাণের কথা উল্লেখ করা হয়নি।

আর কারো কারো মতে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ৫ ওয়াসাক হলে উশর ওয়াজিব হবে। এক ওয়াসাক হলো ৬০ সা এর সমপরিমাণ। তাদের দলীল হলো-রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

لَيْسَ فِيْمَا دُونَ خَمْسَةِ أَوْسُقٍ صَدَقَةٌ

অর্থ: 'পাঁচ ওয়াসাকের কম হলে যাকাত ওয়াজিব নয়।' (বুখারি)

পাঁচ ওয়াসাক'-এর পরিমাণ 

১ ওয়াসাক সমান ৬০ সা। ৫ ওয়াসাক সমান ৬০×৫ = ৩০০ সা।

১ সা সমান ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম। অতএব ৩০০ সা সমান ৯৯০ কেজি বা ২৪ মণ ৩০ কেজি। এই পরিমাণ শস্য উৎপাদিত হলে যাকাত ফরয হবে।

যেসব ফসলের ওপর উশর ধার্য হবে

জমি থেকে উৎপন্ন প্রতিটি ফসলের ওপর উশর ওয়াজিব। যেমন-খাদ্যশস্য, সরিষা, তিল, বাদাম, আখ, খেজুর, আঙ্গুর, অন্যান্য ফল ইত্যাদি। এছাড়া জমিতে উৎপাদিত শাকসবজির ওপরও উশর ওয়াজিব। কেননা, আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে জমি থেকে উৎপন্ন সকল ফসলের হক (যাকাত) আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জমিতে যা-ই উৎপাদিত হবে, তাতেই এক-দশমাংশ যাকাত ধার্য হবে। এমনকি জমির ফসলের ফুল থেকে উৎপাদিত মধুতেও যাকাত ধার্য হবে। কেননা, রাসুলুল্লাহ (সা.) মধু থেকেও উশর আদায় করেছেন।

তবে কারো কারো মতে, যে সকল শস্য মানুষের সাধারণ খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয় এবং যা ওজন ও গুদামজাত করা যায়, সে সকল শস্যেই কেবল যাকাত ফরয। যেমন: গম, যব, কিসমিস, খেজুর প্রভৃতি।

গবাদিপশুর যাকাত

মানব সভ্যতার ইতিহাসে পশুর অনেক ব্যবহার রয়েছে। সকল পশুর মধ্যে আল্লাহ তা'আলা কেবল গৃহপালিত পশুর ওপর যাকাত ফরয করেছেন। তবে সকল গৃহপালিত পশুর ওপর যাকাত ফরয নয়। উট, গরু, মহিষ, দুম্বা, ভেড়া ও ছাগলের ওপর যাকাত প্রদান করতে হয়। গবাদিপশুর ওপর যাকাত ফরয হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত শর্ত আবশ্যক:

(ক) প্রতিটি জাতের গবাদিপশুর সংখ্যা ভিন্ন ভিন্নভাবে নিসাব পরিমাণ হতে হবে। 

(খ) গবাদি পশু চারণভূমিতে বিচরণশীল হতে হবে। 

(গ) নিসাব পরিমাণ পশু পূর্ণ এক বছর মালিকানাধীন থাকতে হবে।

উটের নিসাব

উট পাঁচটি হলে যাকাত প্রদান করতে হয়। এর কম হলে যাকাত ফরয হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন-

لَيْسَ فِيْمَا دُونَ خَمْسِ ذَوْدٍ مِنَ الْإِبِلِ صَدَقَةٌ

অর্থ: উট পাঁচটির কম হলে তার যাকাত নেই। (বুখারি)

গরু বা মহিষের নিসাব

গরু বা মহিষের যাকাত একই নিয়মে প্রদেয় হবে। গরু বা মহিষ ৩০টি হলে যাকাত ফরয হবে। এর কম হলে যাকাত ফরয হবে না। মু'আয ইবনে জাবাল (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আমাকে ইয়ামানের উদ্দেশ্যে পাঠালেন, তখন তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন,

أَنْ أَخُذَ مِنْ كُلِّ ثَلَاثِيْنَ بَقَرَةً تَبِيعًا أَوْ تَبِيْعَةً وَمِنْ كُلِّ أَرْبَعِيْنَ مُسِنَّةً

অর্থ: আমি যেন প্রতি ৩০টি গরুতে একটি তাবী অথবা তাবী'আহ (এক বছরের গরু) গ্রহণ করি এবং প্রতি ৪০টিতে একটি 'মুসিন্নাহ' (দু'বছরের গরু)। (তিরমিযি)

বকরি, ভেড়া ও দুম্বার নিসাব

বকরি, ভেড়া ও দুম্বা সমগোত্রীয় গবাদি পশু। এ সকল পশুর নিসাব হলো ৪০টি। এর কম হলে তার ওপর যাকাত ফরয হবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বকরি ৪০টি থেকে ১২০টি পর্যন্ত একটি বকরি। এর বেশি হলে ২০০টি পর্যন্ত ০২টি বকরি। দুইশর অধিক হলে তিনশ পর্যন্ত তিনটি বকরি। তিনশ'র বেশি হলে প্রতি এক শ' তে একটি করে বকরি। কারো বকরির সংখ্যা ৪০ থেকে একটিও কম হলে যাকাত নেই। (বুখারি)

ব্যবসায়িক সম্পদের যাকাত

পৃথিবীতে সম্পদের বণ্টন ও উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। আল্লাহ তা'আলা ব্যবসা-বাণিজ্য হালাল করেছেন, আর সুদকে হারাম করেছেন। ইসলাম ব্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ওপর যাকাত প্রদান করাকে বাধ্যতামূলক করেছে। ব্যবসায়িক সম্পদের যাকাত সোনা-রুপার যাকাতের পরিমাণের মতোই ২.৫% হারে আদায় করতে হয়। চলো, আমরা ব্যবসায়িক সম্পদের যাকাত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করি।

ব্যবসায়িক সম্পদ ও পণ্য

যেসব সম্পদ ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয়-বিক্রয় করা হয় তাকে ব্যবসায়িক সম্পদ বা পণ্য বলে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত সব ধরনের সম্পদই ব্যবসায়িক সম্পদ হতে পারে। যেমন জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি, খাদ্যদ্রব্য, কৃষিপণ্য, চতুষ্পদ প্রাণী, শেয়ার, যন্ত্রপাতি, গোডাউন, গাড়ি ইত্যাদি। এসব সম্পদ একক মালিকানাধীন হতে পারে বা যৌথ মালিকানাভুক্ত হতে পারে। তবে পারিবারিক প্রয়োজনে কোনো সম্পদ বা পণ্য ক্রয়ের পর লাভে বিক্রি করে দিলেও তা ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে গণ্য হবে না।

ব্যবসায়িক সম্পদ ও পণ্যের যাকাত প্রদান করা প্রতিটি বালেগ ও বুদ্ধিমান মুসলমানের ওপর আবশ্যক। ব্যবসায়িক পণ্য যাকাত প্রদানের জন্য সারা বছর বিদ্যমান থাকা জরুরি নয়। যাকাত নিরূপণকালে বছর সমাপ্তি দিবসে মালিকানায় যে সম্পদ থাকবে তা-ই সারা বছর ছিল ধরে নিয়ে তার ওপর যাকাত প্রদান করতে হবে। সমাপ্তি দিবসে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির যে স্থিতিপত্র তৈরি করা হয়, এতে সাকুল্য দেনা-পাওনা, যেমন মূলধন সম্পদ, চলতি মূলধন, অর্জিত মুনাফা, নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ-সম্পদ, দোকানে এবং গুদামে রক্ষিত মালামাল, কাঁচামাল, প্রক্রিয়ায় অবস্থিত মাল, প্রস্তুতকৃত মাল, ঋণ, দেনা ও পাওনা ইত্যাদি যাবতীয় হিসাব আনতে হবে। এসবের মধ্য থেকে ব্যাংক ঋণ, ক্রেডিটকৃত মাল এবং অন্যান্য ঋণ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট সম্পদের ওপর যাকাত দিতে হবে।

যেসব ব্যবসায়িক সম্পদের ওপর যাকাত নেই

ব্যবসায়ের স্থাবর পণ্য বা ব্যবসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, দালান কোঠা, জমি, কলকারখানা গোলাঘর, শোরুমে ব্যবহৃত শেলফ, চেয়ার, টেবিল, ফার্নিচার ইত্যাদির ওপর যাকাত ধার্য হবে না। এসব সম্পদ ব্যবসায়ে স্থাবর বা মূল সম্পদ, এগুলো যাকাতের সম্পদের মধ্যে ধরা হবে না। তাই এতে যাকাত ফরয হবে না।

ব্যবসায়িক পণ্যে যাকাত ফরয হওয়ার শর্ত

ব্যবসায়িক পণ্যের ওপর যাকাত ফরয হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত শর্ত থাকা আবশ্যক। যথা: 

১. পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হওয়া। অর্থাৎ পণ্যটি নগদ অর্থ, তাৎক্ষণিক ঋণ বা বাকি ঋণের বিনিময়, প্রতিদান বা ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় করা। 

২. সম্পদের ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যবসার নিয়ত তথা লাভের নিয়ত থাকতে হবে। যদিও কোনো কোনো অবস্থায় লাভ না-ও হতে পারে। 

৩. ব্যবসায়িক পণ্যের নিসাব পূর্ণ হতে হবে। অর্থাৎ ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য ৮৫ গ্রাম বা ৭.৫০ তোলা সোনার মূল্যের সমান হতে হবে।

 

দলগত আলোচনা 

'ফসল, গবাদি পশু ও ব্যবসায়িক সম্পদের যাকাত সঠিক নিয়মে প্রদান করলে আল্লাহ তা'লা সম্পদ বৃদ্ধি করেন' 

(শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তোমরা দলে আলোচনা করে উপস্থাপন করো)।

 

দারিদ্র্য দূরীকরণে যাকাতের ভূমিকা

যাকাত ইসলামি অর্থ ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি। যাকাতকে কেন্দ্র করেই সম্পদের সুষম বণ্টন, ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে কর্মপদ্ধতি পরিচালিত হয়। যাকাতের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে সম্পদ যেন মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা, সমাজের অভাব ও বৈষম্য দূর করা।

আল্লাহ তা'আলা প্রথমে মানুষকে যাকাত প্রদানের জন্য উৎসাহিত করেছেন। এরপর পুরস্কারের আশ্বাস দিয়েছেন, যাকাত অনাদায়ে শাস্তির ভয় দেখিয়েছেন। যাকাতকে ধনীদের জন্য অবশ্য প্রদেয় এবং দরিদ্রদের অধিকার বলে ঘোষণা করেছেন। আর এ অধিকার বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের ওপর ন্যস্ত করেছেন। আল্লাহ বলেন-

خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا

অর্থ: তাদের ধন-সম্পদ থেকে সাদাকা (যাকাত) আদায় করে তাদের পবিত্র ও পরিশোধিত করুন। (সূরা তাওবা, আয়াত: ১০৩) আল্লাহ তা'আলা আরো বলেন,

وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّابِلِ وَالْمَحْرُومِ 

অর্থ: তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার। (সূরা আয যারিয়াত, আয়াত: ১৯)

আল্লাহ তা'আলার বিধান অনুযায়ী মহানবি (সা.) যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাকাত আদায় ও বণ্টনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তা পূর্ণাঙ্গ ও আবশ্যিকভাবে নয়, ঐচ্ছিকভাবে। এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বিচ্ছিন্নভাবে যাকাত আদায় করে থাকেন। যা সমন্বয়হীনতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে দারিদ্র্য বিমোচনে পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখতে পারছে না। এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সাময়িকভাবে উপকৃত হলেও স্থায়ী কোনো উপকার হচ্ছে না। ফলে সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূরীভূত হচ্ছে না।

যাকাতের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যাকাত গ্রহীতাকে সচ্ছল করে তোলা। তাকে গ্রহীতার পর্যায় থেকে দাতার পর্যায়ে উন্নীত করা। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিতে যাকাত প্রদানের ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। নগদ ৫০০/১০০০ টাকা কিংবা শাড়ি, লুঙ্গি দিয়ে যাকাত প্রদান করা হয়, যা দারিদ্র্য বিমোচনে কোনো কাজে আসে না। তাছাড়া যাকাত যে সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি তারও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। তাই দারিদ্র্য বিমোচনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যাকাত আদায় ও বণ্টন করা প্রয়োজন।

যাকাত আদায় ও তার যথাযথ ব্যবহার সমাজে আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদের একটি সুনির্দিষ্ট অংশ এমন কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতে ব্যবহৃত ও বণ্টিত হয়, যারা প্রকৃতই বিত্তহীন শ্রেণিভুক্ত। এদের মধ্যে রয়েছে গরিব, মিসকিন, ঋণগ্রস্ত, মুসাফির ও নওমুসলিম। কিন্তু বাংলাদেশে বাধ্যতামূলকভাবে যাকাত আদায় করা হয় না। ফলে যাকাত আদায় ও বণ্টন ব্যক্তিগত ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই যাকাত আদায় বাধ্যতামূলক করা হলে এর মাধ্যমে বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও স্বনির্ভরতা অর্জন করা সম্ভব।

যাকাত দারিদ্র্য বিমোচনের একটি স্থায়ী পদ্ধতি। সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে দারিদ্র দূরীকরণের বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। এসব উদ্যোগের পাশাপাশি যাকাতভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীন জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন এবং সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। দরিদ্র ব্যক্তিকে এমন পরিমাণ যাকাত প্রদান করা উচিত, যাতে তার কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা হয় এবং সে আর দ্বিতীয়বার যাকাতের অর্থের মুখাপেক্ষী না হয়। ইমাম নববী বলেছেন, ফকির ও মিসকিনকে এতটুকু পরিমাণ সম্পদ দিতে হবে যাতে তারা অভাবের গ্লানি থেকে মুক্তি পায় এবং তাদের সচ্ছলতা ফিরে আসে। ইমাম মালেক এবং ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ)-এর মতে, ফকির-মিসকিনকে তার পরিবার-পরিজনের এক বছরের ভরণ-পোষণ সম্ভব- এমন পরিমাণ সম্পদ যাকাত দিতে হবে। আর সর্বনিম্ন এক বছর সচ্ছলভাবে চলার পর ব্যতিক্রম ছাড়া সকল ব্যক্তিই স্বনির্ভরতা অর্জনে সক্ষম হয়।

যাকাত উৎপাদন বৃদ্ধি করে। কারণ, সমাজের গরিব, অসহায়, দুস্থ ও বেকার লোকদের হাতে অর্থ বা ক্রয়  ক্ষমতা থাকে না বললেই চলে। কিন্তু যাকাত বণ্টন করে তাদের হাতে অর্থ পৌঁছালে তাদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং তারা পূর্বের চেয়ে বেশি পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে সক্ষম হবে। ফলে পণ্যসামগ্রীর চাহিদা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে। বর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো হবে এবং উৎপাদন ও যোগান বৃদ্ধি পাবে। ক্রয়-বিক্রয় বৃদ্ধি পাবে, উৎপাদনকারীদের লাভের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। যাকাত এভাবেই ক্রয় ক্ষমতা সৃষ্টির মাধ্যমে চাহিদা, উৎপাদন ও মুনাফা বৃদ্ধি করে। এই উৎপাদনকারীরাই যাকাত দেন, যা আবার বর্ধিত মুনাফা হয়ে তাদের হাতেই ফিরে আসে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَا أَتَيْتُمْ مِّن رِّبًا لِّيَرْبُواْ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُوا عِنْدَ اللَّهِ وَمَا أَتَيْتُمْ مِّنْ زَكُوةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَبِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ 

অর্থ: মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে বলে তোমরা যে সুদ দিয়ে থাকো, আল্লাহর দৃষ্টিতে তা ধনসম্পদ বৃদ্ধি করে না। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তোমরা যে যাকাত দাও, প্রকৃতপক্ষে তাই-বৃদ্ধি পায়, তারাই (যাকাতদানকারীই) সমৃদ্ধিশালী। (সূরা আর রূম, আয়াত: ৩৯)

যাকাত উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং নগদ অর্থকে অলসভাবে ধরে রাখার পথে বাঁধা হিসেবে কাজ করে। সম্পদ অলসভাবে ফেলে রাখলে বছর বছর যাকাত দিতেই তা শেষ হয়ে যাবে। তাই যাকাতভিত্তিক অর্থনীতিতে যাবতীয় সম্পদ এমনভাবে বিনিয়োগ করা হয়, যাতে কমপক্ষে যাকাতের হারের সমান আয় বাড়ানো সম্ভব হয়। অন্যথায় আসল থেকে যাকাত দিতে হয়। ফলে অর্থনীতিতে পূর্ণ বিনিয়োগ ও সর্বোচ্চ উৎপাদন সম্ভব হয়। বেকার লোকদের কর্মসংস্থান ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, চাহিদা বাড়ে এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। এভাবেই যাকাত একদিকে ভোগ ও অন্যদিকে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। মহান আল্লাহ বলেছেন, 

يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبُوا وَيُرْبِي الصَّدَقْتِ

অর্থ: আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৬)

সমাজ থেকে দারিদ্র্য নির্মূল করা যাকাতের অন্যতম লক্ষ্য। এদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ যাকাত বিধানের মাধ্যমে আহরণ ও বিতরণ করা যায়। যদি সুষ্ঠু ও সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে যাকাত আদায় ও তা বণ্টন করা যায়, তাহলে প্রতিবছর বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে স্বনির্ভর করা সম্ভব হবে। একটি গ্রামের যাকাতের অর্থ দ্বারা প্রতিবছর অন্তত ৩/৪টি পরিবারকে স্বনির্ভর করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বা রিকশা, ভ্যান, নৌকা, সেলাই মেশিন, গাভি, ছাগল বা এ জাতীয় কোনো উপার্জনের উপকরণ দিয়ে সাহায্য করা যায়। এভাবে ১০-১৫ বছর পর্যায়ক্রমিকভাবে করতে পারলে একটা গ্রামের অসচ্ছলতা দূর করা সম্ভব।

তাছাড়া জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে যাকাত প্রদানের জন্য বিত্তবানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে গ্রাম, সমাজ বা উপজেলা পর্যায়ে সমন্বিতভাবে যাকাত আদায় করে তহবিল গঠন এবং দরিদ্র পরিবারের তালিকা তৈরি করে পর্যায়ক্রমিকভাবে তাদের মধ্যে সেই তহবিল থেকে টাকা দিয়ে তাদের স্থায়ী উপার্জনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্য কিংবা ভূমিহীন পরিবারের বিপরীতে বাৎসরিক আদায়যোগ্য যাকাতের পরিমাণ কম নয়। যদি আমাদের দেশে যাকাতযোগ্য সম্পদের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকা হয়, তাহলে এর থেকে ২.৫% হারে যাকাত আদায় করলে ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব।

যাকাত আদায়যোগ্য ২৫ হাজার কোটি টাকা প্রথম বছর ভূমিহীন ১৫ লাখ পরিবারকে দেড় লাখ টাকার বেশি করে কর্মসংস্থানের কাজে বণ্টন করা সম্ভব। আর ১ লক্ষ টাকা করে দেওয়া যাবে ২৫ লাখ পরিবারকে। পরের বছর আরো ২৫ লক্ষ পরিবারকে এর আওতায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এভাবে ১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে দুই কোটি ৫০ লক্ষ মানুষকে স্বনির্ভর করা সম্ভব। এ ১০ বছরের যাকাত গ্রহীতা থেকেও নতুন যাকাত দাতা সৃষ্টি হবে। এতে যাকাত দাতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এভাবে যাকাত গ্রহীতার সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা সম্ভব। তাই সরকারি পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যাকাত সংগ্রহ করে তার সুপরিকল্পিত বণ্টন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

 

প্যানেল আলোচনা

 'আমাদের সমাজে দারিদ্র্য-দূরীকরণে যাকাতের ভূমিকা বিশ্লেষণ'

 (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তোমরা প্যানেল বা দলে আলোচনা করে যাকাত সংক্রান্ত পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বাণী উল্লেখপূর্বক শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক উপস্থাপন করো।)

 

Content added By

হজ (  أَلْحَجَّ  )

হজ ইসলামি শরিয়তের অন্যতম ফরয ইবাদাত। শাওয়াল, জিলকদ ও যিলহজের প্রথম ১০ দিনকে হজের সময় ধরা হলেও মূলত ৮ থেকে ১২ যিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিনই হজের আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়। হজের নির্ধারিত স্থান হলো কাবা শরিফ, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা ও মুযদালিফা। হজের প্রতি গুরুত্বারোপ করে আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে সূরা হজ নামে একটি সূরা নাযিল করেছেন। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে হজের নির্দেশ দিয়ে বলেন,

وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا 

অর্থ: মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহের হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)

হজে আর্থিক ও শারীরিক শ্রমের সমন্বয় রয়েছে যা অন্য কোনোটিতে নেই। ফরয হজ আদায় না করলে ইহুদি- নাসারার মতো মৃত্যু হবে বলে হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি হজ করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হজ করে না, সে ইহুদি হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খ্রিষ্টান হয়ে, তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই।

অন্যদিকে হজের ফযিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, 'যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ করল এবং এসময় অশ্লীল ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকল, সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে' (বুখারি)। আর 'মাবরুর হজের বিনিময় জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়।' (বুখারি) হজ মানুষকে সচ্ছলতা প্রদান করে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, 'হজ ও ওমরাহ পর পর করতে থাকো। কারণ, হজ ও ওমরাহ উভয়ই দারিদ্র্য, অভাব এবং গুনাহগুলোকে এমনভাবে দূর করে দেয়; যেমন আগুনের ভাট্টি লোহা, সোনা ও রূপার ময়লা দূর করে দেয়।'

 

হজ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধান

 (প্রিয় শিক্ষার্থী, তুমি ধর্মীয় গ্রন্থ, অনলাইন সোর্স বা সাক্ষাৎকার এর মাধ্যমে হজ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করো। তোমার সংগৃহিত তথ্যগুলো খাতায় লিখে নাও)।

হজের সচিত্র কার্যাবলি

চিত্র: হজের স্থানসমূহ

হজের প্রথম দিন (মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা)

৮ যিলহজ থেকে ১২ যিলহজ পর্যন্ত এই পাঁচ দিনকে হজের দিন বলা হয়। ৮ যিলহজ সকালে হাজিগণ ইহরাম বাঁধা অবস্থায় মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। ৮ যিলহজের যোহর, আসর, মাগরিব, এশা এবং ৯ যিলহজের ফজরের নামায মিনায় আদায় করা এবং রাতে মিনায় অবস্থান করা সুন্নাত।

হজের দ্বিতীয় দিন (আরাফায় অবস্থান)

হজের দ্বিতীয় দিন ৯ যিলহজ আরাফায় অবস্থান করা ফরয। ফজরের নামায মিনায় পড়ে আরাফার ময়দানের দিকে রওনা করতে হয়। প্রয়োজনে ফজরের আগে রাতেও আরাফার উদ্দেশ্যে রওনা করা যায়। আরাফার ময়দানে দুপুর ১২টার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করতে হয়। আরাফার ময়দানে দোয়া কবুল হয়।

মুযদালিফায় অবস্থান

মিনা ও আরাফার মাঝখানে অবস্থিত ময়দানের নাম মুযদালিফা। এখানে ১০ যিলহজ রাত (৯ যিলহজ দিবাগত রাত) অতিবাহিত করা হাজিদের জন্য ওয়াজিব। মুযদালিফায় পৌঁছে এশার ওয়াক্ত হলে এক আজান ও এক ইকামতে প্রথমে মাগরিবের ফরয তারপর এশার ফরয পড়তে হয়। এরপর মাগরিব ও এশার সুন্নাত এবং বিতর পড়তে হয়। মাগরিব ও এশার সালাত আদায়ের পর সুবহে সাদিক পর্যন্ত মুযদালিফায় অবস্থান করা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। এখানে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত অবস্থান করা ওয়াজিব। এ রাতে জাগ্রত থাকা ও ইবাদাতে নিমগ্ন হওয়া মুস্তাহাব।

হজের তৃতীয় দিন (পাথর নিক্ষেপ, কুরবানি, চুল মুণ্ডন ও তাওয়াফ)

হজের তৃতীয় দিন ১০ যিলহজ মিনায় পৌঁছার পর এ দিনের চারটি কাজ ধারাবাহিকভাবে পালন করতে হয়:

১. পাথর নিক্ষেপ করা: এই দিনের প্রথম কাজ হলো জামারায়ে আকাবায় গিয়ে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করা (ওয়াজিব)। এটাকে জামারাতুল কুবরাও বলা হয়। 

২. কুরবানি করা : এই দিনের দ্বিতীয় কাজ হলো দমে শোকর বা হজের শুকরিয়া স্বরূপ কুরবানি করা (ওয়াজিব)। কিরান ও তামাত্তু হজ পালনকারীদের জন্য এটা ওয়াজিব। আর ইফরাদ হজ পালনকারীদের জন্য মুস্তাহাব। 

৩. চুল মুণ্ডন বা কর্তন করা: এই দিনের তৃতীয় কাজ হলো হলক বা কসর করা। চুল মুণ্ডন বা কর্তন করা ওয়াজিব। কুরবানি করার পর পুরো মাথার চুল মুণ্ডন করে ফেলা উত্তম। মুণ্ডনকারীদের জন্য রাসুল (সা.) তিনবার দোয়া করেছেন। তাই এতে ফযিলত বেশি। তবে মহিলারা চুলের অগ্রভাগ থেকে সামান্য পরিমানে কেটে ফেলবেন। 

৪. তাওয়াফে যিয়ারত: এ দিনের চতুর্থ কাজ হলো তাওয়াফে যিয়ারত (ফরয)। একে 'তাওয়াফে ইফাযা'ও বলা হয়। এটা হজের শেষ রুকন। মিনায় উপরোক্ত কাজগুলো সেরে হাজিগণ মক্কা শরিফে গিয়ে তাওয়াফ-ই-যিয়ারত করেন। তাওয়াফে যিয়ারতের কোনো বদলা নেই, এ তাওয়াফ করতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।

হজের চতুর্থ দিন (মিনায় রাতযাপন এবং পাথর নিক্ষেপ)

১১ যিলহজ মিনায় রাতযাপন সুন্নাত। এদিন মিনায় তিন জামারায় পাথর মারা ওয়াজিব। দুপুরের পর প্রথমে জামারায়ে সুগরা, (মসজিদে খাইফের সন্নিকটে) অতঃপর জামারায়ে উসতা, সর্বশেষ জামারায়ে আকাবায় ৭টি করে মোট ২১টি পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। প্রতিটি পাথর নিক্ষেপের সময় তাকবির বলতে হবে।

হজের পঞ্চম দিন (মিনায় রাতযাপন এবং পাথর নিক্ষেপ)

১২ যিলহজের আগের দিনের মতো মিনায় রাতযাপন সুন্নাত। মিনায় তিন জামারায় পাথর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব।

বিদায়ী তাওয়াফ

পবিত্র মক্কা থেকে বিদায়ের আগে বিদায়ী তাওয়াফ ওয়াজিব। প্রত্যেক হাজি সাহেবের উচিত মাকামে ইবরাহিমে দুই রাকা'আত নামায পড়ে মূলতাযাম, কাবার দরজা ও হাতিমে দোয়া করা; যমযমের পানি পান করেও দোয়া করা এবং বিদায়ের বেদনা দিয়ে কাবা ঘর থেকে বিদায় নেওয়া। তাওয়াফে বিদা না করলে দম দিতে হবে।

 

চিত্রাঙ্কন (বাড়ির কাজ) 

 

'হজের কার্যাবলি সম্পন্ন করার জন্য নির্ধারিত স্থানসমূহ চিত্রাঙ্কন' 

(উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তুমি মিনা, মুযদালিফা, আরাফা, বাইতুল্লাহ ইত্যাদি স্থান চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে হজের চিত্র আঁকো।)

হজের প্রকারভেদ

হজ তিনভাবে আদায় করা যায়: তামাত্তু, কিরান ও ইফরাদ।

১. তামাত্তু হজ

হজের মাসগুলোতে হজের সফরে বের হওয়ার পর প্রথমে শুধু ওমরাহ এর ইহরাম বাঁধা এবং ওমরাহ সম্পন্ন করে হালাল হয়ে যাওয়া। এরপর ৮ যিলহজ তারিখে হজের ইহরাম বেঁধে হজের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করাকে তামাত্তু হজ বলে।

তামাত্তু হজের নিয়ম

হজ পালনকারী হজের মাসগুলোতে প্রথমে শুধু ওমরাহ এর জন্য তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে ইহরাম বাঁধবেন। তারপর তাওয়াফ ও সাঈ সম্পন্ন করে মাথা মুণ্ডন অথবা চুল ছোট করার মাধ্যমে ওমরাহ পালন সম্পন্ন করে ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যাবেন এবং স্বাভাবিক কাপড় পরে নেবেন। ইহরাম অবস্থায় হারাম কাজগুলো তার জন্য হালাল হয়ে যাবে। তারপর যিলহজ মাসের ০৮ তারিখ মিনা যাবার আগে নিজ অবস্থানস্থল থেকে হজের ইহরাম বাঁধবেন। তারপর যথাযথ নিয়মে হজের যাবতীয় কার্যাবলি সম্পন্ন করবেন।

তামাত্তু হজকারীর জন্য এক সফরে দুটি ইবাদাতের সুযোগ লাভের শুকরিয়াস্বরূপ হাদি বা পশু জবেহ করা ওয়াজিব।

২. কিরান হজ

এক সফর ও এক ইহরামে ওমরাহ ও হজ আদায় করাকে কিরান হজ বলে। অর্থাৎ হজের সফরে ইহরাম বেধে প্রথমে ওমরা আদায় করা এবং ঐ ইহরাম থেকে হজের নির্ধারিত দিনে হজের কার্যাবলি সম্পন্ন করাকে কিরান হজ বলে।

কিরান হজের নিয়ম

মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধার সময় একই সঙ্গে হজ ও ওমরার জন্য لَبَّيْكَ عُمْرَةً وَحَجَّاً )লাব্বাইকা ওমরাতান ওয়া হজ্জান) বলে তালবিয়া পাঠ শুরু করা। তারপর মক্কায় পৌঁছে প্রথমে ওমরাহ আদায় করা এবং ইহরাম অবস্থায় মক্কায় অবস্থান করা। অতঃপর হজের সময় ৮ যিলহজ ইহরামসহ মিনা-আরাফা-মুযদালিফায় গমন এবং হজের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করা।

কিরান হজকারীর জন্য এক সফরে দুটি ইবাদাতের সুযোগ লাভের শুকরিয়াস্বরূপ হাদি বা পশু জবেহ করা ওয়াজিব।

৩. ইফরাদ হজ

হজের মাসগুলোতে শুধু হজের ইহরাম বেঁধে হজের কার্যক্রম সম্পন্ন করাকে ইফরাদ হজ বলে।

ইফরাদ হজের নিয়ম

হজের মাসগুলোতে শুধু হজের ইহরাম বাঁধার জন্য لَبَّيْكَ حَبًّا )লাব্বাইকা হজ্জান) বলে তালবিয়া পাঠ শুরু করা। এরপর মক্কায় প্রবেশ করে তাওয়াফে কুদুম অর্থাৎ আগমনী তাওয়াফ এবং হজের জন্য সাঈ করা। অতঃপর ১০ যিলহজ কুরবানির দিন হালাল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থাকা। এরপর হজের অবশিষ্ট কাজগুলো সম্পাদন করা।

উত্তম হজ

এ তিন প্রকার হজের মধ্যে সাওয়াবের দিক দিয়ে সর্বোত্তম হলো কিরান, এরপর তামাত্তু, এরপর ইফরাদ। তবে আদায় সহজ হওয়ার দিক থেকে প্রথমে তামাত্তু, এরপর ইফরাদ, এরপর কিরান। তামাত্তু হজ পালন করা সবচেয়ে সহজ হওয়ায় অধিকাংশ বাংলাদেশি তামাত্তু হজ আদায় করে থাকেন। আর যাঁরা অন্যের বদলি হজ করতে যান বা যাঁদের অবস্থান মিকাতের মধ্যে, তাঁরা সাধারণত ইফরাদ হজ করেন। এছাড়া কিছুসংখ্যক হাজি কিরান হজ করেন, যাঁদের সংখ্যা খুবই কম।

ইহরাম দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে নিষেধাজ্ঞাবলি সঠিকভাবে মেনে চলতে না পারার আশঙ্কা থাকলে হজ্জে তামাত্তুই উত্তম।

বদলি হজ

ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হচ্ছে হজ। এটি মুসলিম উম্মাহর অন্যতম ইবাদাত। একে জিহাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এতে সাওয়াব বেশি এবং উপকারিতাও অনেক। এ ইবাদাতের জন্য রয়েছে বিশেষ দুটি শর্ত। একটি হলো সম্পদশালী হওয়া আর অন্যটি হলো শারীরিকভাবে সক্ষম হওয়া। বিধানগত দিক থেকে হজ আদায় করা সহজ, কিন্তু এর জন্য সফর করতে হয়। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জমায়েত। বিশেষ বিশেষ স্থানে একসঙ্গে এই ইবাদাত আদায় করতে হয়। তাই এটি কঠিন ও কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে অনেক মানুষের আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও শারীরিক অক্ষমতার কারণে তা আদায় করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের মাজুরদের প্রতি দয়া করে আল্লাহ তা'আলা বদলি হজ-এর অবকাশ দান করেছেন।

অনেকে মনে করেন, বদলি হজের জন্য আলাদা কোনো নিয়ম আছে। তা ঠিক নয়। যেভাবে নিজের হজ আদায় করা হয় সেভাবেই বদলি হজ আদায় করা হয়। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে, নিয়ত ও তালবিয়ার সময় বদলি হজে প্রেরণকারীর পক্ষ থেকে হজের নিয়ত করা হয়। এরপর হজের সকল কাজ এক ও অভিন্ন। হজের নিয়ম এক হলেও বদলি হজ সংক্রান্ত কিছু বিষয় এমন আছে, যা বদলি হজে প্রেরণকারী ও প্রেরিত উভয়েরই জানা থাকা জরুরি।

বদলি হজের প্রামাণ্যতা

যদি কোনো ব্যক্তি ফরয হজ আদায় করতে অক্ষম হন তাহলে তাঁর পক্ষ থেকে দায়িত্ব নিয়ে অন্য কোনো ব্যক্তির হজ পালনকে বদলি হজ বলে। কয়েকটি হাদিস থেকে বদলি হজের বিধান পাওয়া যায়। যেমন:

১. খাসআম গোত্রের জনৈক মহিলা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বললেন, 'ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাদের ওপর যে ফরয আরোপ করেছেন, তা আমার পিতাকে খুব বৃদ্ধ অবস্থায় পেয়েছে। তিনি বাহনের ওপর স্থির হয়ে বসতে পারেন না। তবে কি আমি তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করে দেব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। ঘটনাটি ছিল বিদায় হজের সময়কার। (বুখারি) 

২. রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলেন, শুবরামার পক্ষ থেকে লাব্বাইক। তিনি বললেন, শুবরামা কে? লোকটি বলল, আমার ভাই বা আত্মীয়। তিনি বললেন, তুমি কি নিজের হজ করেছ? সে বলল, না। তিনি বললেন, আগে নিজের হজ করো। তারপর শুবরামার হজ। (মুসনাদে আহমাদ)

তিন প্রকার হজের মধ্যে বদলি হজ কোন প্রকার হবে তা যে ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ করা হচ্ছে তিনি নির্ধারণ করে দেবেন। যদি ইফরাদ করতে বলেন তাহলে ইফরাদ করতে হবে, যদি কিরান করতে বলেন তাহলে কিরান করতে হবে, আর যদি তামাত্তু করতে বলেন তাহলে তামাত্তু করতে হবে। এর অন্যথা হলে হবে না। বদলি হজ ইফরাদ হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।

 বদলি হজ যখন করতে হয় 

১. হজ ফরয হওয়ার পর আদায় না করে মৃত্যুবরণ করলে; 

২. হজ ফরয হওয়ার পর তা আদায়ের আগে বন্দি হলে; 

৩. এমন অসুস্থ হলে, যাতে আরোগ্য হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই; 

8. শারীরিকভাবে চলাচলে অক্ষম হয়ে গেলে; 

৫. দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেললে বা একেবারেই অন্ধ হয়ে গেলে; 

৬. এমন বয়োবৃদ্ধ হয়ে গেলে যে, বাহনে চলাচলের সক্ষমতাও নেই; 

৭. নারী তার হজের সফরে স্বামী বা উপযুক্ত মাহরাম পুরুষ সঙ্গী না পেলে; 

৮. কোনো কারণে রাস্তা অনিরাপদ হলে; 

৯. সফর করতে গেলে জান-মালের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে। 

এসব কারণে ঐ ব্যক্তিকে মাজুর বা অক্ষম গণ্য করা হবে এবং সে নিজের পক্ষ থেকে বদলি হজ করাতে পারবে।

বদলি হজ কে করবেন

যে ব্যক্তির নিজের জন্য হজ আদায় করা ফরয হয়ে গেছে, তার নিজের ফরয হজ আগে আদায় করতে হবে, তারপর অন্যের বদলি হজ আদায় করতে পারবেন। আর যে ব্যক্তির ওপর হজ ফরয হয়নি তিনি নিজে হজ না করলেও অন্যের বদলি হজ আদায় করতে পারবেন। তাই প্রত্যেক বিবেকবান মুসলিমের উচিত বদলি হজ করানোর আগে ব্যক্তি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানা। তারপর ঐ ব্যক্তির মাধ্যমে বদলি হজ করানো।

যিনি বদলি হজ আদায় করবেন, তাঁকে ইহরামের সময় অবশ্যই যার বদলি হজ আদায় করছেন তার নামেই নিয়ত করতে হবে।

যে ব্যক্তি নিজের ফরয হজ আদায় করেছেন, তার জন্য নফল হজ করার চেয়ে অন্য কারো বদলি হজ করা উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, 'কোনো ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে বদলি হজ করলে, সে-ও মৃতের সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে।' (মাজমাউয যাওয়াইদ)  

হযরত হাসান বসরি (র.) বলেন, 'যে ব্যক্তি কারো পক্ষ থেকে বদলি হজ করবে, তার জন্যও ঐ ব্যক্তির সমপরিমাণ সাওয়াবের আশা করা যায়।'

সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজের গুরুত্ব

জুমুআ ও ঈদের সালাত সীমিত পরিসরে মুসলিমদের মাঝে সাম্য ও ঐক্য সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু বিশ্ব মুসলিমের মাঝে সাম্য ও ঐক্য সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে একমাত্র হজ। ইহরাম বেঁধে 'লাব্বাইক' বলে যখন হারাম শরীফের চতুর্দিক থেকে মানুষ ছুটে আসে এবং বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করতে থাকে, তখন সাদা-কালো, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র সকল ভেদাভেদ লোপ পায়। জগৎসমূহের স্রষ্টা, আমাদের একমাত্র প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে তারা সেখানে হাজির হয়। সাম্য প্রতিষ্ঠায় সেখানে সুগন্ধি ব্যবহার করা, টুপি-পাজামা-পাগড়ি পরিধান করা নিষিদ্ধ, এমনকি মাথার চুল পর্যন্ত ছেঁটে ফেলতে হয়। হজ ব্যতীত এমন কোনো অনুষ্ঠান নেই, যা এত ভিন্ন ভিন্ন দেশের, এত ভিন্ন ভিন্ন বংশের ও বর্ণের মানুষকে একইরূপে চিত্রিত করতে পারে। সাম্যের অপূর্ব চিত্র ফুটে ওঠে যখন সবাই একত্রে চিরশত্রু শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে, সাফা-মারওয়ায় দৌঁড়ায়, আরাফার ময়দানে অবস্থান করে, মিনায় গমন করে এবং আল্লাহর রাহে একত্রে পশু কুরবানি করে। ফলে দুনিয়ায় প্রচলিত ভেদাভেদের কথা মনে স্থান পায় না। এমন অকৃত্রিম সাম্য ও ঐক্য আর কোথাও দেখা যায় না।

বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজ

মুসলমানদের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ইসলামী মহাসম্মেলন হচ্ছে হজ। এটি আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান পবিত্র মক্কা নগরীতে মিলিত হয়। নানাবিধ ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও এ সময় সকলে ভাই ভাই হয়ে সম্মিলিতভাবে হজের কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে, একে অপরকে সহযোগিতা করে। ফলে মুসলমানদের মাঝে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব তৈরি হয়। মহান আল্লাহ বলেন,

وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِيْنَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ 

অর্থ: এবং মানুষের নিকট হজের ঘোষণা দিন; তারা আপনার নিকট আসবে (মক্কায়) পায়ে হেঁটে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটের পিঠে আরোহণ করে। তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে। (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ২৭)

হজ পালনের সময় সবার পোশাক একই ধরনের থাকে। সকলে সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ করে বলতে থাকে লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক অর্থাৎ হাজির হে আল্লাহ! আমরা তোমার দরবারে হাজির। এক অতুলনীয় আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষ একত্রিত হয়। ফলে বিভিন্ন দেশের মানুষের বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি দেখার ও জানার সুযোগ হয়। তাদের মাঝে আলোচনা করার ও সমস্যা সমাধানের পথ তৈরি হয়।

যিলহজের নয় তারিখ আরাফার ময়দানে ইমাম সাহেব বিশ্ব মুসলিমের উদ্দেশ্যে জ্ঞানগর্ভ খুতবা দেন। তাতে আগামী বছরের জন্য মুসলিম উম্মাহর করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়ের দিকনির্দেশনা থাকে। হজ থেকে শিক্ষা লাভ করে আমরা বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হবো। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার শপথ নেবো।

 

প্যানেল আলোচনা 

'হজের ধর্মীয় ও সামাজিক তাৎপর্য' 

(উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তোমরা প্যানেল আলোচনা করে সমাজে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করো।)

 

Content added By

ওমরাহ

ওমরাহ আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো ভ্রমণ করা, কোনো স্থানের যিয়ারত করা। হজের নির্দিষ্ট দিনগুলো তথা ৮ যিলহজ থেকে ১৩ যিলহজ্জ পর্যন্ত ছয় দিন ব্যতীত বছরের যেকোনো সময় ইসলামি শরিয়ত নির্ধারিত পন্থায় কা'বা শরিফ তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়ায় সাঈ করাকে ওমরাহ বলে। ওমরাহ এর ফরয দুটি যথা: (১) ইহরাম বাঁধা (২) বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করা

২. মাথা মুণ্ডানো অথবা চুল ছাঁটা। 

ওমরাহ এর সুন্নতসমূহ 

১. ইহরামের আগে গোসল করা। গোসল সম্ভব না হলে ওযু করলেও চলবে। 

২. একটি চাদর ও একটি সেলাইবিহীন লুঙ্গিতে ইহরাম বাঁধা। 

৩. উঁচু স্বরে তালবিয়া পাঠ করা। 

৪. তাওয়াফের সময় ইজতিবা করা। ইজতিবা হলো ডান বগলের নিচ দিয়ে চাদর পেঁচিয়ে বাম কাঁধের ওপর রাখা। 

৫. সম্ভব হলে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা।

ইহরাম বাঁধার পূর্বে গোঁফ, চুল ও নখ কেটে গোসল করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ইহরামের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। গোসল সম্ভব না হলে ওযু করে নিলেও যথেষ্ট হবে। অতঃপর আতর বা সুগন্ধি থাকলে ব্যবহার করতে হবে। তবে সেন্ট ব্যবহার করা নিষেধ।

এর পর মীকাত থেকে ওমরাহ-এর নিয়্যতে ইহরাম বাঁধতে হবে। সেলাইবিহীন দুটি কাপড়, চাদর ও লুঙ্গির মতো পরিধান করতে হবে। এই কাপড়ের রং সাদা হওয়া উত্তম। ইহরামের কাপড় পরিধানের পর দুই রাকা'আত সালাত আদায় করে ওমরাহ এর নিয়্যত করার সঙ্গে সঙ্গে তালবিয়া পাঠ করতে হবে। পুরুষগণ জোরে জোরে আর নারীরা আস্তে আস্তে তালবিয়া পড়বেন। এরপর কা'বা শরিফ সাতবার তাওয়াফ করতে হবে। হাজরে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফ শুরু করে আবার হাজরে আসওয়াদের নিকট গিয়ে তাওয়াফ শেষ করতে হবে। এভাবে সাত চক্কর দিতে হবে। সম্ভব হলে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করতে হবে। আর সম্ভব না হলে ইশারা করে হাতে চুম্বন করলেও যথেষ্ট হবে। তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহিমে বা এর পিছন বরাবর কিছু দূরে, এখানে সম্ভব না হলে মসজিদে হারামের যেকোনো স্থানে দুই রাকা'আত তাওয়াফের সালাত আদায় করতে হবে। অতঃপর কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে তিন চুমুকে যমযমের পানি পান করতে হবে।

অতঃপর সাতবার সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ বা দৌঁড়াতে হবে। সাফা-মারওয়ার মাঝ পথে দুই সবুজ চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থানে পুরুষদের জোরে দৌঁড়াতে হবে। সাঈর জন্য নির্ধারিত কোনো দোয়া নেই।

সাঈ সমাপ্ত হলে মাথা মুণ্ডন বা মাথার চুল ছোট করে হেঁটে নিতে হবে। এভাবেই ওমরাহ সম্পন্ন হয়ে যাবে এবং ইহরামের পর যা হারাম ছিল এখন তা হালাল হয়ে যাবে।

ওমরাহ-এর ফযিলত

সক্ষম হলে সারা জীবনে একবার ওমরাহ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। আর সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ হলো ঐ সকল কাজ যা মহানবি (সা.) নিজে সর্বদা পালন করতেন এবং অন্যদের তা পালন করতে তাগিদ দিতেন। এটা যখনই করা হোক, তার জন্য প্রতিদান ও বরকত রয়েছে। তবে রমযান মাসে ওমরাহ করার ফযিলত বেশি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'নিশ্চয় রমযান মাসের ওমরাহ একটি হজের সমান।'

ওমরাহ পালন করলে মহান আল্লাহর হুকুম পালন করা হয়। আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, 'তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ ও ওমরাহ পরিপূর্ণভাবে পালন করো।' (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯৬)

ওমরাহ বান্দার গুনাহসমূহ মোচন করে দেয়। দরিদ্রতা দূর করে জীবনে সচ্ছলতা আনয়ন করে। মহানবি (সা.) বলেন, 'তোমরা হজ ও ওমরাহ আদায় করো। কেননা, হজ ও ওমরাহ দারিদ্র্য বিমোচন করে ও গুনাহ দূর করে দেয় ঠিক সেভাবে, যেভাবে হাঁপরের আগুন লোহা, সোনা ও রুপা থেকে ময়লা দূর করে দেয়।' (তিরমিযি)

তিনি আরো বলেন, 'এক ওমরাহ থেকে পরবর্তী ওমরাহ এর মধ্যবর্তী সময়ে সংঘটিত সগিরা গুনাহর জন্য কাফফারা বা প্রায়শ্চিত্ত করে।' (বুখারি)

ওমরাহ একটি ফযিলতপূর্ণ ইবাদাত। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের জীবনে অন্তত একবার ওমরাহ পালন করা উচিত। মহানবি (সা.) জীবনে চার বার ওমরাহ পালন করেছেন। সুতরাং আমরা ওমরাহ পালনের নিয়মকানুন ভালোভাবে জানব এবং যখনই সামর্থ্য হবে তখন তা আদায় করব।

 

Content added By