SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or
Log in with Google Account

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বাংলা - Bangla - প্রমিত ভাষা ব্যবহার করি | NCTB BOOK

শব্দ ও বাক্যের উচ্চারণ

হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯-২০২১) বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ', 'জীবন ঘষে আগুন', 'আগুনপাখি' ইত্যাদি। নিচের গল্পটি হাসান আজিজুল হকের 'নামহীন গোত্রহীন' বই থেকে নেওয়া হয়েছে। গল্পটি সরবে পড়ো।

ফেরা 

হাসান আজিজুল হক

আমি যুদ্ধে গিইলাম ক্যানো?

দক্ষিণবঙ্গের লোকের কথায় সামান্য যে একটা টান থাকে, সেই টানের সঙ্গে সে বারদুয়েক ভেবে দেখার চেষ্টা করল, আমি যুদ্ধে গিইলাম ক্যানো? বাঁ পায়ের বুটটা সে তখন ছাড়েনি, হাঁটুর উপরে সেটা চেপে ধরে ডান হাতে রাইফেলের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে সে আর একবার কেন যুদ্ধে গিয়েছিল ভেবে দেখার চেষ্টা করে।

আজ বিকেলে হাসপাতাল থেকে চলে আসার সময়ে সে আমিনের মুখের দিকে চেয়ে দেখেনি। হাসপাতালের লোকেরা তাকে লাল কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলে তার কিছুই করতে ইচ্ছে করেনি। আমিন মরে গেলে কম্বল সরিয়ে তার মরা মুখ দেখার জন্যে আলেফ হাসপাতালে তিন দিন বসে ছিল। আসলে আমিন মরে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাই তার কাজ ছিল। তার মাকে সে সঠিক খবরটা দিতে চায়। আমিন ফিরে আসবে-এই আশায় অনর্থক কেন বুড়ি বসে থাকবে-তার সম্পর্কে পাকা খবরটা পেলে বরং তার কিছু কাজ হয়। ডান ঠ্যাংটা কেটে ফেলার তিন দিন পর সমস্ত শরীর পচে গিয়ে আমিন মরে গেল।

বাড়ি সে পৌঁছে যায় ভোরের দিকে ঠিকই। যেমন আন্দাজ করেছিল তার অনেক পরে। গাঁয়ের রাস্তায় সে উঠে আসে। ভার পিছু পিছু খালের দিক থেকে একটা ভারী কুয়াশা এসে গাঁয়ের দিকে চলে যায়। আলেফ দেখল তাদের বাড়িটা আগাগোড়া কুয়াশায় মোড়া, বলতে গেলে বাড়িটায় ঢোকার রাস্তা সে প্রথমে খুঁজে পায়নি। বুটজুতো জোড়া সে ফেলে দিয়ে এসেছে, এজন্যে যখন তাদের একমাত্র ঘরের ভাঙা দরজার দিকে এগিয়ে যায়-উঠোন পেরিয়ে সে বেড়ালের মতোই নিঃশব্দে দাওয়ায় ওঠে-কোথাও কোনো শব্দ হয় না। আলেফ দরজায় ধাক্কা না দিয়ে ডাকল, মা।

আলেফ রে, উরে আমার বাপরে! এতদিন কনে ছিলি বাপ?
আমি ফিরে আইছি মা, বাঁচে ছিলি তালি?
তোর জন্যি মরিনি, তোর জন্যি বাঁচে আছি বাপ।
ভালো করিছো-আলেফ হাসে। কুয়াশা খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে যায়।
আলেফের হাসিটা আবছা দেখায়, সে মায়ের মুখটাও ভালো দেখে না।
ভালো ছিলি আলেফ? মা বলে।

হ।

কিছু হয়নি তো তোর?
সামান্য উপদ্রুত মনে হয় আলেফকে। সে বলে, না, কিছু হয়নি। লোক আইছিলো আমার খোঁজ নিতি?
একদিন মিলিটারি আইলো গাঁয়ে আগুন দিতি।
আগুন দিইছে?
হ। আগুন দিইছে, সব বাড়ি পোড়ায়ে দিইছে। কয় ছ্যামড়া আমার বাড়ি আস্যে তর খোঁজ নেলে অনেক। তুমি কি বললে?
আগুনে গাঁ পোড়াতে লাগলো-সেকি আগুন তোরে কবো আলেফ-ছ্যামরা কড়া আমারে কয়-ও বুড়ি

আলেফ কনে?
আমি বললাম, আলেফের খোঁজ জানে কিডা? আমি মরতিছি নিজের জ্বালায়। সে কোঁয়ানে মরতিছে তার আমি কী জানি? আলেফ, আমি ঠিক বলিনি?
ঠিক বলিছো? তোমার আলেফ ছিল কনে কও তো দেখি।
তুই নড়াইয়ে ছিলি বাপ-আলেফের মা সোজা হয়ে দাঁড়াল। বউয়ের দিকে ফিরে আবার বলল বুড়ি, বউ ফিরে আইছে দেহেছিস?
দেহেছি।
বউ যেদিন ফিরলো-বুড়ি বকবক করে। আনন্দে তার ঘাড় নড়বড়ে করে দোলে। মুখ থেকে থুতু ছোটে। মা কিছুতেই থামতে চায় না। আলেফ তাকে অনেকক্ষণ বলতে দিয়ে হঠাৎ বলে, ঠিক আছে মা। বুড়ি চুপ করে। তারপর ঘরের বাইরে চলে যায়। বউ অন্ধকারে কোনে গিয়ে লুকিয়েছে। মা চলে গেলে আলেফ খানিকক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এখন সে কী করবে বুঝতে পারে না। মায়ের নোংরা বিছানার কাছে গিয়ে সে সটান শুয়ে পড়বে কি না, চিন্তা করতে থাকে। ফর্সা হয়ে আসছিল। ভোরবেলাকার ঠান্ডা বাতাস এ সময়ে হু হু করে ঘরে এসে ঢোকে।
দরজাটা বন্ধ করে দে-ঠান্ডা বাতাস আসতিছে- আলেফ বউয়ের দিকে ফিরে বলে। বউ দরজা বন্ধ করতে গেলে আলেফ একবার ঘরের ভিতরটা নজর করে দেখে।
বিশেষ কিছু চোখে পড়ে না। একপাশে তার ব্যাগটা পড়ে আছে। ঘরের কোণে রাইফেলটার নল এই আবছা আলোতেও চকচক করছে। দরজা বন্ধ করে বউ ফিরে আসতে আলেফ ক্লান্ত গলায় বলে, কবে ফিরে আলি তুই? বিড়বিড় করে সে কী বলল বোঝা গেল না। আলেফ হেঁকে উঠল, আ?
বউ বলল, শ্রাবণ মাসে।
ফিরলি ক্যানো?
না ফিরে কী করবো?
তাইলি গিইলি ক্যানো?
লাল ম্যাড়মেড়ে আলোর মধ্যেও আলেফ দেখতে পায়, বউয়ের দুচোখ জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেল।
কোথা ছিলি?
মজমপুর।
খাতি পাইছিলি? খাবার জন্যিই তো গিইলি। তা যাতি পাইছিলি তো?
বউ খুব জোরে জোরে মাথা নাড়ল। জমা জল ঝরে পড়ল ঝরঝর করে।

তয়?
আমি অনেকদিন আগে আইছি। তখন তুমি ছিলে না। আমি কোঁয়ানে ছিলাম?
তুমি নড়াইয়ে ছিলে। আলেফ মনে করে দেখল একটু আগে তার মা-ও ঠিক এই কথাটাই বলেছে।
চুপ কর- আলেফ অস্বাভাবিক জোরে চিৎকার করে উঠল। বউ থমকে যায়। আমি মারা যাতিছিলাম জানিস- আলেফ বসে পড়ে লুঙ্গিটা গুটিয়ে হাঁটুর উপরে তুলতে তুলতে বলে, এইখানে গুলি ঢুকিছিল। বউ সেখানেই মাটিতে বসে পড়ে, চোখ খুব কাছে এনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুকনো ক্ষতটা দেখে। আলেফ নিজেও কোনোদিন ভালো করে দেখেনি। জায়গাটার রং এখনো ফ্যাকাশে সাদা, কাটা আর ছেঁড়া মাংস জোর করে সেলাই করে দেওয়ায় উঁচু হয়ে আছে।
আর এট্টু উফর দিয়ে গেলে হাঁটুর হাড়টা ভাঙে যাতো-আলেফ বলল।
ভালি কী হতো?
হাঁটু খে কাটে ফালায়ে দিতি হতো। আর তাতে হতো কী আমি মরে যাতাম-হাসতে হাসতে এই কথা বলতে গিয়ে আলেফের আমিনের কথা মনে পড়ে গেল।
তোমার কোনো বেকায়দা হয়?
জাংটা এটু খাটো হয়ে গিছে।
আলেফের ভীষন ঘুম পাচ্ছিল। মায়ের ছেঁড়া কাঁথা বিছানো দুর্গন্ধ বিছানার উপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়তে গেলে সে কোমর থেকে পা পর্যন্ত মোটা দড়িটার আর একবার সন্ধান পায়। সে আবার বলে, এই ঠ্যাংটা এটু খাটো হয়ে গিছে। চোখ বন্ধ করেও আলেফ ঘুমাতে পারে না, ঘুম ঘুম গলায় সে জিগ্যেস করে, লড়াই শেষ হয়ে গিছে জানিস? দ্যাশের কী হলো ক দিনি?
দ্যাশ স্বাধীন হইছে-বউ যেন মুখস্থ বলল।
আলেফ প্রায় ঘুমিয়ে পড়ে। যোঁৎ একটা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে জেগে গিয়ে সে বলে, আমরা রাজা-বাদশা হবো নাকি বল তো? রাজা বাদশা হবানে মনে হয়।
বউ প্রতিবাদ করল, তা ক্যানো? রাজা বাদশা হবো ক্যানো? আমাদের কষ্ট আর থাকবে না।
মানে?
ভাত-কাপড় পাবানি।
ঠিক কচ্ছিস? প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে আলেফ চোখ খুলে চেয়ে রইল বউয়ের দিকে। তার মাথায় একটা কথাও
ঢুকছিল না, একঘেয়ে গলায় সে বলল, স্বাধীনতার মানে ভালোই বুঝিছিস বলে মনে হতিছে। কথা শেষ হবার
সঙ্গে সঙ্গে আলেফের নাক ডাকতে শুরু করে, তবে আরো একবার সে আধো ঘুমের মধ্যে বলে ওঠে,

ললিতনগরের খালে চিংড়ি ধরবানে দেহিস, এক একটা চিংড়ি আধসের ওজনের-এই পেল্লায় বড়ো চিংড়ি।
মা বলে, কোথা তোর গুলি লাগিছিলো আর একবার দেখা না বাপ। আলেফ সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু মুড়ে বসে গুলি- খাওয়া জায়গাটা বের করে মাকে বোঝাতে শুরু করে, গুলিটা লাগিলো ঠিক এইখানে। আমি ভাবতিছি শালা খানেরা বোধ হয় ভয়ে পলান দিছে। ঝোপ থেকে বেরোয়ে দাঁড়িয়েছি মাত্তর আর সুই করে গুলিটা একেবারে-
তরে সরকার থে ডাকবে না?
আলেফ হাঁ হয়ে যায়, সরকার আমাকে ডাকলে? ক্যানো?
ভোরে ডাকপে না তো কারে ডাকলে? গুলিটা যদি তোর মাথায় লাগতো আলেফ?
তা সরকার আমাকে ডাকপে ক্যানো?
তোরে একা না ডাকুক, তোরা যারা নড়াইয়ে ছিলি তাদের ডাকলে না? আমি আমার এই ভিটের চেহেরা ফেরাবো আলেফ কয়ে দেলাম আর জমি নিবি এট্টু। এট্টা গাই গোরু আর দুটো বলদ কিনবি-আর-
হইছে-তুমি থোও দেহি-আমিনের পচা লাশটার গন্ধ এসে হঠাৎ ভক করে আলেফের নাকে লাগে।
সে বলে, দুটো খাতি দাও, আমি একবার বেনেপুর যাবো।
বেনেপুর যাবি? ক্যানো?
বেনেপুরের এক ছ্যামড়া ছিল আমাদের সাথে। গুলি তার উরতে লাগিলো। হাসপাতালে তার ঠ্যাংটা কাটে ফেলায়ে দিলো। তিন দিনের মদ্যি পচে গন্ধ হয়ে ছ্যামরাটা মরিছে। তার মারে খবরটা দিতে যেতি হবে।

 

শব্দের অর্থ

 

Content added By

'ফেরা' গল্পের কথোপকথনে বহু আঞ্চলিক শব্দ আছে। গল্প থেকে বাছাই করে পনেরোটি আঞ্চলিক শব্দ নিচের ছকের বাম কলামে লেখো। মাঝখানের কলামে শব্দটির প্রমিত রূপ লিখবে এবং ডান কলামে এর প্রমিত উচ্চারণ লিখবে। নিচে দুটি করে দেখানো হলো।

 

Content added || updated By

'ফেরা' গল্পের কথোপকথনে ব্যবহৃত দশটি বাক্য নিচের ছকের বাম কলামে লেখো এবং ভান কলানে বাক্যগুলোর প্রমিত রূপ নির্দেশ করো। একটি নমুনা নিচে দেওয়া হলো। কাজ শেষে সহপাঠীদের সঙ্গে উত্তর নিয়ে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো।

প্রমিত ভাষা

অঞ্চলভেদে ভাষার ভিন্ন ভিন্ন রূপ থাকে। ভাষার এইসব রূপকে বলে আঞ্চলিক ভাষা। কোনো শব্দ অঞ্চলভেদে আলাদাভাবে উচ্চারিত হতে পারে, কিংবা একই অর্থ বোঝাতে আলাদা শব্দের প্রয়োগ হতে পারে। বাক্যের গঠনও অনেক সময়ে আলাদা হয়। আঞ্চলিক ভাষা সাধারণত মানুষের প্রথম ভাষা-এই ভাষাতেই মানুষ কথা বলা শুরু করে। গল্প-উপন্যাস-নাটকে বিভিন্ন চরিত্রের মুখে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ দেখা যায়।

ভাষার এই আঞ্চলিক রূপ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগে কিছু সমস্যা তৈরি করে। সেই সমস্যা দূর করার জন্য ভাষার একটি রূপকে প্রমিত হিসেবে গ্রহণ করা হয়, যাতে সব অঞ্চলের মানুষ তা সহজে বুঝতে পারে। একই কারণে দেশের যাবতীয় আনুষ্ঠানিক যোগাযোগে, শিক্ষা কার্যক্রমে, দাপ্তরিক কাজে, গণমাধ্যমে, সাহিত্যকর্মে ভাষার প্রমিত রূপ ব্যবহৃত হয়। সকল অঞ্চলের মানুষ সহজে বুঝতে পারে ভাষার এমন রূপের নাম প্রমিত ভাষা।

কথ্য প্রমিত লেখ্য প্রমিত

প্রমিত ভাষার দুটি রূপ আছে: কথা প্রমিত ও লেখ্য প্রমিত। কথা প্রমিত ব্যবহৃত হয় আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলার সময়ে, অন্যদিকে লেখ্য প্রমিত ব্যবহৃত হয় লিখিত যোগাযোগের কাজে।
কবিতা-গল্প-উপন্যাসে কখনো কখনো শব্দের কথ্য প্রমিত রূপ দেখা যায়। তবে আনুষ্ঠানিক গদ্যে শব্দের কথ্য প্রমিত রূপের পরিবর্তে লেখ্য প্রমিত রূপ ব্যবহার করা শ্রেয়। যেমন, শব্দের কথা প্রমিত রূপ-ধুলো, ফিতে, ভেতর ইত্যাদি। এগুলোর লেখা প্রমিত রূপ-ধুলা, ফিতা, ভিতর ইত্যাদি।
নিচের উদাহরণগুলো দেখো এবং লেখার সময়ে বিষয়টি খেয়াল রেখো।

 

Content added By

তুমি তোমার চারপাশের মানুষজনের কাছ থেকে শুনে কিছু আঞ্চলিক বাক্য সংগ্রহ করো। নিচের ছকের বাম কলামে সংগৃহীত আঞ্চলিক বাক্যগুলো লেখো। এরপর ভান কলামে বাক্যগুলোকে প্রমিত ভাষায় রূপান্তর করো। বাক্য সংগ্রহের সময়ে খেয়াল রেখো যাতে বিবৃতিবাচক, প্রশ্নবাচক, অনুজ্ঞাবাচক ও আবেগবাচক-সব ধরনের বাক্যই থাকে।

 

Content added || updated By
Promotion
Content for the offcanvas goes here. You can place just about any Bootstrap component or custom elements here.