নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - NCTB BOOK

আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশত কোটি বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের উৎপত্তি হয়। পৃথিবীর জলবায়ু তখন স্থিতিশীল ছিল না। তারপর কয়েক শত কোটি বছর পরে আজ পৃথিবী শান্ত, তার জলবায়ুও  মোটামুটি স্থিতিশীল। পৃথিবীতে এখন বহু প্রজাতির জীবের বসবাস। অর্থাৎ এই দীর্ঘ সময়কালে প্রথম আবির্ভূত অনুন্নত জীবক্রম পরিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে বিভিন্ন জীবপ্রজাতি সৃষ্টি করেছে ।মানুষের জীবন শুরু হয় মাতৃগর্ভে মায়ের ডিম্বাণু এবং বাবার শুক্রাণুর মিলনে সৃষ্টি হওয়া একটি কোষ থেকে। মানুষ তার জীবনকালে প্রথমে থাকে শিশু। পরবর্তীকালে শিশু থেকে ধাপে ধাপে কৈশোর-যৌবন পার হয়ে বৃদ্ধ অবস্থায় উপনীত হয়। জীবনকালের এই পরিবর্তনের একটি ধাপ হচ্ছে বয়ঃসন্ধিকাল। বয়ঃসন্ধিকালে সবারই দৈহিক এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটে। আমরা এই অধ্যায়ে পৃথিবীতে জীবের উৎপত্তি কীভাবে ঘটেছে এবং মানুষের বয়ঃসন্ধিকালে দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো কীভাবে ঘটে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করব।

 

এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা:

  • বয়ঃসন্ধিকাল ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করতে পাৱৰ ।
  • বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক ও আচরণিক পরিবর্তনে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর উপায় বর্ণনা করতে পারব।
  • ৰয়ঃসন্ধিকালে দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার কৌশল ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • বয়ঃসন্ধিকালীন বিবাহে স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং এর প্রভাব বিশ্লেষণ করতে পারব।
  • টেস্টটিউব বেবির ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • লিঙ্গ নির্ধারণের কৌশল ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • জীবনের উৎপত্তি এবং জীবজগতে বিবর্তনের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • পৃথিবীতে নতুন প্রজাতির উৎপত্তির ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব।
Content updated By

কোনো বাড়িতে একটি শিশু জন্ম নিলে সেখানে আনন্দের সাড়া পড়ে যায়। সকলেই শিশুটিকে আদর করতে চায়, কোলে নিতে চায়। শিশুটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত থাকে তাদের শৈশবকাল। ছয় থেকে দশ বছর পর্যন্ত বয়সকে আমরা বাল্যকাল বলি, তখন একজন শিশুকে মেয়ে হলে বালিকা এবং ছেলে হলে বালক বলা হয়। দশ বছর বয়সের পর একটি মেয়েকে কিশোরী এবং একটি ছেলেকে কিশোর বলা হয়। মানুষের জীবনের এই সময়কে বয়ঃসন্ধিকাল বলে। দশ বছর থেকে উনিশ বছর বয়স পর্যন্ত কিশোরকালের বিস্তৃতি। অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকাল বাল্যাবস্থা ও যৌবনকালের মধ্যবর্তী সময়। এ সময়কালে বালক ও বালিকার শরীর যথাক্রমে পুরুষের এবং নারীর শরীরে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সাধারণত মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল ছেলেদের চেয়ে একটু আগে শুরু হয়। মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হয় আট থেকে তেরো বছর বয়সের মধ্যে। ছেলেদের বয়ঃসন্ধিকাল শুরুর বয়স দশ থেকে পনেরো বছর। কারো কারো ক্ষেত্রে এর চেয়ে একটু আগে বা পরেও বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হতে পারে।

৪.১.১ বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনসমূহ

বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনগুলোর মধ্যে দৈহিক বা শারীরিক পরিবর্তনগুলোই প্রথমে চোখে পড়ে। এই পরিবর্তন দেখলেই বোঝা যায় যে কারো বয়ঃসন্ধিকাল চলছে।শৈশব থেকে বাল্যকাল পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা ধীরে ধীরে বেশ সময় নিয়ে বেড়ে ওঠে। কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালের বেড়ে ওঠা অনেকটা আকস্মিক। ছেলেমেয়েরা হঠাৎ দ্রুত লম্বা হতে থাকে (চিত্র ৪.০১), ওজনও বাড়তে থাকে দ্রুত। দশ বছর বয়সের পরে তিন থেকে চার বছর ধরে মেয়ে ও ছেলেদের শরীরে নানারকম পরিবর্তন আসে।নানা কারণে আমাদের দেশের মানুষেরা এই অভ্যন্ত স্বাভাবিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো আলোচনা করতে সংকোচ বোধ করে। কিন্তু যেহেতু তোমরা এখন বয়ঃসন্ধিকালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ, তাই তোমার ভেতর কী কী পরিবর্তন হবে, সেগুলো জেনে রাখা ভালো। তাহলে তোমরা ভয় কিংবা লজ্জা না পেয়ে তোমাদের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে প্রস্তুত থাকতে পারবে। চিত্র ৪,০১; বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েরা দ্রুত লম্বা হয়ে ওঠে

বয়ঃসন্ধিকালে যেসব পরিবর্তন দেখা দেয়, সেগুলো প্রধানত তিন রকম:

১. শারীরিক পরিবর্তন

২. মানসিক পরিবর্তন

৩. আচরণগত পরিবর্তন।

১. শারীরিক পরিবর্তন

(ক) দ্রুত লম্বা হয়ে ওঠা এবং দ্রুত ওজন বেড়ে যাওয়া

(খ) ছেলেদের (১৬/১৭ বছর বয়সে) দাড়ি-গোঁফ গজানো এবং মেয়েদের স্তন বর্ধিত হতে শুরু করা

(গ) শরীরের বিভিন্ন অংশে লোম গজানো

(ঘ) ছেলেদের স্বরভঙ্গ হওয়া ও গলার স্বর মোটা হওয়া

(ঙ ) ছেলেদের বীর্যপাত এবং মেয়েদের মাসিক শুরু হওয়া

(চ) ছেলেদের বুক ও কাঁধ চওড়া হয়ে ওঠা এবং মেয়েদের কোমরের হাড় মোটা হওয়া।

২. মানসিক পরিবর্তন

(ক) অন্যের, বিশেষত নিকটজনের মনোযোগ, যত্ন ও ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছা তীব্র হওয়া

(খ) আবেগ দ্বারা চালিত হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হওয়া

(গ) ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হওয়া

(ঘ) বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়া

(ঙ) মানসিক পরিপক্বতার পর্যায় শুরু হওয়া

(চ) পরনির্ভরতার মনোভাব পরিবর্তিত হয়ে আত্মনির্ভর হওয়ার পর্যায় শুরু হওয়া।

৩. আচরণগত পরিবর্তন

(ক) প্রাপ্তবয়স্কদের মতো আচরণ করা

(খ) সে যে একজন আলাদা ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা

(গ) প্রত্যেক বিষয়ে নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা

(ঘ) দুঃসাহসিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে প্রবৃত্ত হওয়া।

 

 

৪.১.২ বয়ঃসন্ধিকাল পরিবর্তনের কারণ

সাধারণত ছেলেমেয়েদের ১১-১৯ বছরের সময়কালকে বয়ঃসন্ধিকাল বলে। তোমরা এর মাঝে জেনে গেছ যে এ সময়ে ছেলেমেয়েদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়। তবে আবহাওয়া, স্থান, খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ও মানের তারতম্যের কারণে এক একজনের বয়ঃসন্ধিকালের সময়টা এক এক রকম হতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে যেসব পরিবর্তন ঘটে, তার জন্য দায়ী হরমোন নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ, যা অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়। হরমোন শরীরের ভিতরে স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়। ছেলে ও মেয়েদের শরীরের হরমোন ভিন্ন। এ কারণে তাদের শরীর ও মনে যে পরিবর্তন হয় সেটিও ভিন্ন। মেয়েদের শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তনের জন্য দায়ী প্রধানত দুটি হরমোন। এ হরমোন দুটোর নাম হলো ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন। এসব হরমোনের প্রভাবে কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন হয়, দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধি হয় এবং শরীরের বিভিন্ন অ- প্রত্যঙ্গের আকার বৃদ্ধিসহ অন্যান্য পরিবর্তন ঘটে। এ হরমোনের কারণে মেয়েদের ঋতুস্রাব বা মাসিক শুরু হয়। বয়স যখন ১০-১৭ বছর হয়, সাধারণত তখনই মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরু হয়। নারীর সন্তান ধারণের সক্ষমতার লক্ষণ হলো নিয়মিত ঋতুস্রাব। ঋতুস্রাব শুরু হওয়া সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। বাংলাদেশের নারীদের সাধারণত ৪৫-৫৫ বছর বয়সের মধ্যে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। ২৮ দিন পরপর বা মাসে একবার এই ঋতুস্রাব প্রক্রিয়া চলে এবং সাধারণত এটি ৩-৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তনের জন্য যে হরমোন দায়ী, তার নাম হলো টেস্টোস্টেরন। এ হরমোনের প্রভাবে তাদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। ছেলেদের গলার স্বর ভারী হয়। মুখে দাড়ি ও গোঁফ গজায় (চিত্র ৪.০২), দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধি পায়। ১৩ থেকে ১৫ বছরের ছেলেদের শরীরে শুক্রাণু তৈরি হয় এবং মাঝে মাঝে রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে বীর্যপাত ঘটে। ছেলে ও মেয়ে উভয়ের মাঝেই শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি মানসিক পরিবর্তন হয়। ছেলে ও মেয়েরা এ বয়সে কল্পনাপ্ৰৰণ হয় এবং আবেগ দ্বারা চালিত হয়। তারা পরিপাটি রূপে নিজেকে সাজিয়ে রাখতে চায় (চিত্র ৪.০৩)। এ সময় ছেলেরা মেয়েদের প্রতি এবং মেয়েরা ছেলেদের প্রতি আকর্ষণবোধ করে। এভাবেই ধীরে ধীরে কিশোর-কিশোরীরা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষে পরিণত হতে শুরু করে। বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনগুলো ঘটে হরমোনের কারণে বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনের কারণ অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ ।মেয়েদের শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোন কাজ করে । ইস্ট্রোজেন হরমোন ছেলেদের শরীরে তৈরি হয়ে ছেলেদের বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনগুলো ঘটে প্রজেস্টেরন হরমোনের প্রভাবে ইস্ট্রোজেন খাদ্য হজমে সহায়তা করে । তোমরা জেনেছ যে ছেলে-মেয়েদের ১১-১৯ বছর বয়সের সময়কালকে বলা হয় বয়ঃসন্ধিকাল। তোমরা এও জেনেছ, এ সময় ছেলে-মেয়েদের দৈহিক ও মানসিক ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনগুলোর সাথে স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টি জড়িত।  বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া প্রয়োজন।

৪.১.৩ দৈহিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের মাঝে মাঝে রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে যে বীর্যপাত ঘটে, সেটাকে স্বপ্নদোষ বলা হয়ে থাকে। স্বপ্নদোষ ভয় বা লজ্জার কোনো বিষয় নয়। “স্বপ্নদোষ" বলা হলেও এটি কোনো দোষ নয়। এটা এ বয়সে শরীরের একটি স্বাভাবিক কার্যক্রম। বয়ঃসন্ধিকালে সাধারণ ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ছেলেদের শুক্রাণু তৈরি শুরু হয়। কখনো কখনো ঘুমের মধ্যে বীর্যের মাধ্যমে এ শুক্রাণু দেহের বাইরে বেরিয়ে আসে। শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই শরীর থেকে বীর্যপাত হয় এবং তা অবিরাম তৈরি হতে থাকে। স্বপ্নদোষ হলে গোসল করে পরিষ্কার হওয়া ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে দুর্ভাবনা করার কিছু নেই। এ সময় শরীর দ্রুত বেড়ে উঠে বলে পুষ্টিকর খাবার (চিত্র ৪.০৪, চিত্র ৪.০৫) বিশেষ করে বেশি করে শাক- সবজি খাওয়া ও পানি পান করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা উচিত। বয়ঃসন্ধিকালে স্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তন ছাড়াও নানা রকম মানসিক পরিবর্তন হয়। প্রয়োজন হলে এ বিষয়ে মা-বাবা ও নিকটাত্মীয়দের সাথে আলাপ-আলোচনা বা পরামর্শ করা যেতে পারে। বয়সন্ধিকালে সবাই খুব আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে, সবাইকে বুঝতে হবে এটি হরমোনের ক্রিয়া এবং বয়ঃসন্ধিকাল পার হওয়ার পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ছেলেদের মতো মেয়েদেরও বয়ঃসন্ধিকালে অনেক পরিবর্তন ঘটে। এ সময় মেয়েদের শরীরের যেসব পরিবর্তন ঘটে, তার মধ্যে ঋতুস্রাব বা মাসিক এবং সাদা স্রাব সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।সাধারণত ৯-১৩ বছর বয়সের মধ্যে মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরু হয়। প্রত্যেক মাসে একবার ঋতুস্রাব হয় বলে একে মাসিক বলে। মেয়েদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব শরীরের একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। ঋতুস্রাবের সময় ৩-৫ দিন পর্যন্ত রক্তস্রাব হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে এ সময় কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। কখন ঋতুস্রাব শুরু হবে, সেই সময়টুকু অনুমান করে তার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা দরকার। এ সময় মেয়েদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, নিয়মিত গোসল করা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং বেশি পরিমাণে পানি পান করা প্রয়োজন। এ সময় সাধারণত, একটু বেশি বিশ্রাম নেওয়া দরকার।যেহেতু মাসিকের সময় শরীর থেকে অনেক রক্ত বেরিয়ে যায়, তাই ক্ষয়পূরণের জন্য মাছ, মাংস, সবজি এবং ফলমূল বেশি পরিমাণে খাওয়া দরকার। মাসিকের সময় তলপেটে ব্যথা হতে পারে। সেক্ষেত্রে গরম পানির সেঁক দিলে আরাম বোধ হবে। এ সময় মাথাব্যথা ও কোমরে ব্যথা হতে পারে। এসব দেখে বিচলিত হওয়া বা ভয় পাবার কিছু নেই। ব্যথা বেশি হলে ডাক্তারের পরামর্শে ঔষধ সেবন করতে হবে।মাসিকের সময় আজকাল শোষক হিসেবে ব্যবহার করার জন্য প্যাড পাওয়া যায়। প্যাড জোগাড় করা সহজ না হলে পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত তুলা বা পরিষ্কার শুকনো কাপড় ব্যবহার করা যেতে পারে। মাসিকের সময় ব্যবহার করা কাপড় শোষক হিসেবে আবার ব্যবহার করতে হলে সাবান দিয়ে গরম পানিতে ধুতে হবে এবং রোদে শুকিয়ে গুছিয়ে রাখতে হবে। এই কাপড় অন্ধকার ও স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় রাখা ঠিক নয়, তাহলে বিভিন্ন রোগ-জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে ।

৪.১.৪ মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা

বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনের সময়ে অনেকে একা থাকতে পছন্দ করে। অনেকে খানিকটা অস্বাভাবিক আচরণও করতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক পরিবর্তনের চাইতেও অনেক সময় মানসিক পরিবর্তন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অনেকে অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং এ কারণে পরিবারের সদস্যদের সাথে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হতে পারে। এ বয়সে তাদের যে মানসিক পরিবর্তন ঘটে, পরিবারের অন্য সদস্যদের সেই পরিবর্তনের বিষয়গুলো মনে রেখে তাদের সাথে বন্ধুসুলভ এবং সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে। তাদেরকে মানসিক দিকসহ অন্য সকল ব্যাপারে সহযোগিতা প্রদান করতে হবে এবং সাহস যোগাতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য ছেলেমেয়েরা নিজেরাও সচেষ্ট থাকবে। তাদের প্রথম কাজ হবে বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলোর সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করা। এ পরিবর্তনগুলো যে খুবই স্বাভাবিক, এ বিষয়টি খুব স্পষ্ট করে বুঝতে হবে। এটা বুঝতে পারলে অস্বস্তি, লজ্জা বা ভয় কমে যাবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে খোলা মনে মা-বাবা বা বড় ভাই-বোনের সাথে আলোচনা করতে পারলে সংকোচও কেটে যাবে। তখন একা থাকা বা লোকজন এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা কমে যাবে। এছাড়া ভালো গল্পের বই পড়লে, সাথিদের সাথে খেলাধুলা করলে মানসিক প্রফুল্লতা বজায় থাকবে।বয়ঃসন্ধিকালে বাবা-মা, ভাই-বোন এবং পরিবারের সদস্য কিংবা স্কুলের শিক্ষক সবাইকেই ছেলে- মেয়েদের প্রয়োজনীয় মানসিক সহায়তা কিংবা পরামর্শ দিতে হবে। এতে তারা সুস্থ সবল মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে সক্ষম হবে।

একক কাজ

কাজ: বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে ও মেয়েদের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তার একটি ছক তৈরি কর।

৪.১.৫ বয়ঃসন্ধিকালীন বিবাহ ও গর্ভধারণ

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বিয়ের জন্য মেয়েদের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলেদের বয়স কমপক্ষে ২১ বছর হতে হয়। কিন্তু এই আইন থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের অনেক মেয়েকেই ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেন। তোমরা কখনও কি ভেবে দেখেছ, উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগেই মেয়েদের বিয়ে দিলে তারা কোন কোন অসুবিধার সম্মুখীন হয়? অল্প বয়সের বিবাহিত মেয়েরা নানা ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে। এর মধ্যে একটি হলো অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ।

গর্ভধারণ কী?

পুরুষের শুক্রাণু যখন মেয়েদের ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়, তখনই একটি মেয়ে গর্ভধারণ করে অর্থাৎ তার শরীরে সন্তান গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মেয়েদের জন্য এটি একটি বিশেষ শারীরিক প্রক্রিয়া এবং শুধু সন্তান গর্ভে এলেই শরীরের এই বিশেষ পরিবর্তনগুলো ঘটে।গর্ভধারণের প্রথম কয়েক মাস মেয়েদের শরীরে কিছু কিছু অস্বস্তিকর লক্ষণ দেখা যায়।এ লক্ষণগুলো হলো:

  • বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া 
  • মাথা ঘোরা;
  • বারবার প্রস্রাব হওয়া;

 

স্বাস্থ্যঝুকি

সন্তান জন্ম দেওয়া খুবই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। তাই পরিণত বয়সে গর্ভধারণ করলে মানসিক ও শারীরিক জটিলতা তেমন একটা দেখা যায় না। এ সময়ে যেসব শারীরিক পরিবর্তন দেখা দেয়, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সেগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হলে দুর্ভাবনারও কিছু থাকে না এবং একটি সুস্থ শিশু জন্ম নেয়। অপরিণত বয়সে একটি মেয়ের মা হওয়ার মতো মানসিক পরিপক্বতা কিংবা শারীরিক প্রস্তুতি বা পূর্ণতা থাকে না। একটি মেয়ে যদি ২০ বছর বয়সের আগে গর্ভবর্তী হয়, তখন তাদের নিজেদেরই শারীরিক বৃদ্ধি ও পঠন সম্পূর্ণ হয় না বলে তার নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া অপরিণত বয়সের একটি মেয়ের সন্তান ধারণ এবং সন্তান জন্ম দেওয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকে না। কাজেই সে তার গর্ভের সন্তান এবং তার নিজের শরীরকে ঠিকভাবে রক্ষা করতে পারে না। অপরিণত বয়সে যদি কোনো মেয়ে গর্ভধারণ করে, তবে শুধু যে মেয়েটিই শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়; ভবিষ্যৎ শিশুটির জীবনও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এর কারণে পুরো পরিবার এবং সমাজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

স্বাস্থ্যগত সমস্যা

অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের ফলে গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ, শরীরে পানি আসা, খুব বেশি ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, এমনকি গর্ভপাত পর্যন্ত ঘটে থাকে। তাছাড়া মা ও সন্তানের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি থাকে।অপরিণত বয়সে গর্ভে সন্তান এলে সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য গর্ভে পর্যাপ্ত জায়গা থাকে না। ফলে কম ওজনের শিশু জন্ম নেয়। এসব শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। বড় হওয়ার পর এসব শিশু স্বাস্থ্যবান এবং সফল মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে না।বিদ্যালয়ে পড়ার সময় যদি কোনো মেয়ে গর্ভধারণ করে, তবে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় (চিত্র ৪.০৭)। সে লজ্জায় আর বিদ্যালয়ে যায় না। তার মানসিক চাপ বেড়ে যায় এবং নানা অশান্তিতে ভোগে। শারীরিক দিক থেকেও সে চলাফেরা করতে সমস্যায় (চিত্র ৪.০৮ ) পড়ে। এসব কারণে সে ঘরে বসেও লেখাপড়া করতে পারে না।

পারিবারিক সমস্যা

অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের ফলে মেয়েরা সুস্থভাবে অন্যান্য কাজকর্ম করতে পারে না। অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে তার পরিবারের অশান্তি দেখা দেয়। ইন্দোনেশিয়ার বাল্যবিবাহের হার খুব বেশি এবং দেখা পেছে, সেখানে অর্ধেকের বেশি ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের দম্পতির মাঝে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়।

আর্থিক সমস্যা

স্বাভাবিক গর্ভধারণে চিকিৎসকের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং পরামর্শ হলেই কাজ চলে যায় কিন্তু অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ করলে নয় মাসের পুরো সময় জুড়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হয়। এছাড়া কোনো জটিল স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিলে বারবার চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। চিকিৎসক এবং ঔষধপত্রের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়। গর্ভবর্তী মায়ের জন্য অতিরিক্ত পুষ্টিকর খাদ্যেরও ব্যবস্থা করতে হয়। এতেও বেশ অর্থের প্রয়োজন হয়। সব মিলিয়ে পরিবারের উপর একটি বড় ধরনের আর্থিক চাপ পড়ে (চিত্র ৪.০৯)।

গর্ভপাত কী এবং গর্ভপাতের জটিলতা

একটি মেয়ের গর্ভে যখন সন্তান আসে তখন প্রথম ভ্রুণ   হিসেবে জরায়ুতে তার বৃদ্ধি ঘটে। ভ্রূণের  বৃদ্ধি  অবস্থায় কোনো কারণে সময়ের আগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জরায়ু থেকে ভ্রুণ বের হয়ে যাওয়াকে গর্ভপাত বলে। গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেও অনেকে গর্ভপাত ঘটায়।গর্ভধারণের ফলে সঙ্গীর চাপ, অন্যের প্রভাব এবং হতাশার কারণে অনেক মেয়ে আনাড়ি গর্ভপাতকারীদের কাছে যায় এবং অত্যন্ত  ঝুঁকিপূর্ণভাবে গর্ভপাত ঘটায়। এ ধরনের গর্ভপাতের ফলে মেয়েদের বড় ধরনের শারীরিক ঝুঁকি ছাড়াও তাদের উপর মানসিক এবং প্রবল আবেগীয় প্রভাব পড়ে। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে।

কাজ : অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের সমস্যাসমূহ ও তা থেকে পরিত্রাণের উপায়  চিত্রেলিপিবদ্ধ কর।

 

৪.১.৬ টেস্টটিউব বেবি

কৃত্রিম উপায়ে দেহের বাইরে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন ঘটিয়ে প্রাথমিক ভ্রূণ সৃষ্টি করে সেটি নারীদের জরায়ুতে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে শিশুর জন্ম হলে তাকে টেস্ট টিউব বেবি বলা হয়। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তানের জন্ম না হলে অনেক বাবা-মা এই প্রক্রিয়ায় সন্তানদের জন্ম দিতে আগ্রহী হন। দেহের বাইরে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন ঘটানোকে বলে ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন। ইটালির বিজ্ঞানী ড. পেট্রসি (Dr. Petrucci) ১৯৫৯ সালে প্রথম টেস্টটিউব বেবি জন্ম প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তবে তিনি ততটা সফলতা অর্জন করতে পারেননি, শিশুটি মাত্র ২৯ দিন বেঁচে ছিল। এর প্রায় ১৯ বছর পর ১৯৭৮ সালে ইংল্যান্ডের ড. প্যাট্রিক স্টেপটো ও ড. রবার্ট এডওয়ার্ডের প্রচেষ্টায় লুইস জয় ব্রাউন নামে একটি টেস্টটিউব বেবি জন্মায়। পর্যায়ক্রমে কতগুলো প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন ঘটিয়ে টেস্টটিউব বেবির জন্ম দেওয়া হয় ।প্রক্রিয়াগুলো হলো (১) সক্ষম দম্পতি থেকে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু সংগ্রহ করে বিশেষ ধরনের পালন মাধ্যমে (Culture medium) এদের মিলন ঘটান। (২) অতঃপর পালন মাধ্যমে প্রাথমিক ভ্রূণ উৎপাদন। ( ৩ ) উৎপাদিত ভ্রূণকে স্ত্রী জরায়ুতে প্রতিস্থাপন এবং সবশেষে (৪) প্রসূতির পরিচর্যা ও সন্তান লাভ সম্পন্ন করা। নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান লাভের জন্য আজকাল এই প্রক্রিয়া আমাদের দেশেও বেশ ভালোভাবে চালু হয়েছে।

Content added || updated By

আমরা জানি, কোনো জীবের জীবকোষের নিউক্লিয়াসের ভেতর নির্দিষ্টসংখ্যক ক্রোমোজোম থাকে। মানুষের জীবকোষে ক্রোমোজোমের সংখ্যা ২৩ জোড়া (মোট ৪৬টি)। এই ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের ভেতর এক জোড়া ক্রোমোজোমকে লিঙ্গ নির্ধারক বা সেক্স ক্রোমোজোম বলে। ছেলেদের বেলায় এই এক জোড়া ক্রোমোজোম দুটি ভিন্ন, যার একটিকে X, অন্যটিকে Y নাম দেওয়া হয়েছে। ছবিতে দেখ, X ক্রোমোজোমটি লম্বা এবং Y ক্রোমোজোমটি ছোট। মেয়েদের বেলায় এই এক জোড়া সেক্স ক্রোমোজোমের দুটিই X ক্রোমোজোম। সেক্স ক্রোমোজোম ছাড়া বাকি অন্য সব ক্রোমোজোমকে অটোজোম বলে।মানুষের শরীরের সব কোষেই ২৩ জোড়া (বা ৪৬টি) ক্রোমোজোম থাকলেও সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য মেয়েদের ডিম্বাণু এবং ছেলেদের শুক্রাণু এর ব্যতিক্রম। এই কোষগুলোতে অর্ধেকসংখ্যক ক্রোমোজোম থাকে । ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের প্রতি জোড়া থেকে একটি ক্রোমোজোম নিয়ে ডিম্বাণু তৈরি হয়, কাজেই সব ডিম্বাণুতেই ২২টি অটোজোম এবং একটি X ক্রোমোজোম থাকে। ছেলেদের সেক্স ক্রোমোজোমে যেহেতু X এবং Y দুটিই আছে, তাই ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের প্রত্যেকটি থেকে একটি করে ক্রোমোজোম দিয়ে শুক্রানু তৈরি করা হলে দুটি ভিন্ন ধরনের শুক্রানু তৈরী করা সম্ভব। একটিতে থাকবে ২২টি অটোজোম এবং একটি x ক্রোমোজোম, অন্যটিতে থাকবে ২২টি অটোজোম এবং একটি Y ক্রোমোজোম ।

ডিম্বাণু ও শুক্রাণু মিলে গর্ভধারণ হয় এবং তোমরা দেখতে পাচ্ছ দুটি ভিন্নভাবে গর্ভধারণ সম্ভব। অর্থাৎ মিলিত কোষে মানুষের ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে এবং সেটি ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ মানবসন্তানে জন্ম নেয়। যদি এটি ২২ জোড়া অটোজোম এবং Xx সেক্স ক্রোমোজোম নিয়ে বেড়ে উঠে তাহলে কন্যাসস্থান হিসেবে জন্ম নেয়। যদি এটি ২২ জোড়া অটোজোম এবং XY সেক্স ক্রোমোজোম নিয়ে গড়ে ওঠে, তাহলে পুত্রসন্তান হিসেবে জন্ম নেয় (চিত্র ৪.১৩)। একজন সুস্থ সন্তান, সে ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেন, মা-বাবার জন্য অনেক বড় একটি আশীর্বাদ, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অজ্ঞতা এবং কুসংস্কারের কারণে অনেকে ছেলে সন্তানকে প্রাধান্য দেয়। শুধু তা-ই নয়, মেয়ের জন্ম হলে মাকে দোষারোপ করা হয়। কিন্তু তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, সন্তান কী ছেলে সন্তান হবে না মেয়ে সন্তান হবে, তার জন্য মা কোনোভাবেই দায়ী নয়। ছেলেদের অসংখ্য শুক্রাণুর ভেতর x ক্রোমোজোম বহনকারী না Y ক্রোমোজোম বহনকারী শুক্রাণু ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হবে, সেটি হচ্ছে প্রকৃত কারণ।

Content added || updated By

বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে আমরা যেসব জীবের সঙ্গে পরিচিত, তাদের মধ্যে দশ লাখের বেশি প্রাণী প্রজাতি এবং চার লাখের মতো উদ্ভিদ-প্রজাতি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। একসময় মানুষের ধারণা ছিল, পৃথিবী বুঝি অপরিবর্তিত, অর্থাৎ সৃষ্টির আদিতে পৃথিবীর যে আকার বা আয়তন ছিল, এখনো সেরকমই আছে। অর্থাৎ তার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। মানুষ ভাবতো আদি জীবজগতের সঙ্গে বর্তমানকালের জীবজগতের কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে জেনোফেন (Xenophane) নামের একজন বিজ্ঞানী প্রথম কতকগুলো জীবাশ্ম (fossil) আবিষ্কার করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে অতীত এবং বর্তমান যুগের জীবদেহের গঠনে যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে। অর্থাৎ জীবদেহের আকার অপরিবর্তনীয় নয়। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ( Aristotle) প্রমাণ করেন যে জীবজগতের বিভিন্ন জীবের ভেতর এক শ্রেণির জীব অন্য শ্রেণির জীব থেকে অপেক্ষাকৃত উন্নত এবং জীবগুলো তাদের পূর্বপুরুষ থেকে উৎপত্তি লাভ করে বিবর্তন বা অভিব্যক্তির মাধ্যমে ক্রমাগত পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। বিবর্তন একটি মন্থর এবং চলমান প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠনগতভাবে সরল জীবন থেকে জটিল জীবনের উৎপত্তি ঘটেছে।

বিভিন্ন বিজ্ঞানীর মতানুসারে, প্রায় সাড়ে চারশত কোটি বছর আগে এই পৃথিবী একটি উত্তপ্ত গ্যাস- পিণ্ড ছিল। এই উত্তপ্ত গ্যাস-পিণ্ড ক্রমাগত তাপ বিকিরণ করায় এবং তার উত্তাপ কমে যাওয়ায় ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে তরল অবস্থা প্রাপ্ত হয়। পরে এই পিণ্ডটি বাইরের দিক থেকে ভেতরের দিকে ক্রমশ কঠিন হতে থাকে এবং উদ্ভূত জলীয় বাষ্প থেকে মেঘের সৃষ্টি হয়। ওইরকম মেঘ থেকে বৃষ্টি হওয়ায় পৃথিবীর কঠিন বহিঃস্তরে জলভাগ অর্থাৎ সমুদ্রের আবির্ভাব ঘটে। এক সময়ে সমুদ্রের পানিতে প্রাণের আবির্ভাব হয় এবং সমুদ্রের পানিতে সৃষ্ট জীবকূলের ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে বর্তমানের বৈচিত্র্যময় জীবজগতের সৃষ্টি হয়েছে।গভীর যুক্তিনির্ভর চিন্তাভাবনা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আধুনিক মানুষের ধারণা হয়েছে যে জীব সৃষ্টির মূলেই রয়েছে বিবর্তন। ল্যাটিন শব্দ 'Evolveri' থেকে বিবর্তন শব্দটি এসেছে। ইংরেজ দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ হার্বার্ট স্পেনসার (Herbert Spencer) প্রথম ইভোলিউশন কথাটি ব্যবহার করেন। যে ধীর, অবিরাম এবং চলমান পরিবর্তন দ্বারা কোনো সরলতর উদবংশীয় জীব পরিবর্তিত হয়ে জটিল ও উন্নততর নতুন প্রজাতির বা জীবের উদ্ভব ঘটে, তাকে বিবর্তন বা অভিব্যক্তি বা ইভোলিউশন বলে। সময়ের সাথে কোনো জীবের পরিবর্তনের ফলে যখন নতুন কোনো প্রজাতি সৃষ্টি হয়, তখন তাকে বলে জৈব বিবর্তন।

৪.৩.১ জীবনের আবির্ভাব কোথায়, কবে এবং কীভাবে ঘটেছে

পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ বর্তমানে প্রচলিত আছে। তবে জীবনের উৎপত্তি যে প্রথমে সমুদ্রের পানিতে হয়েছিল এ সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই। এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা যে যুক্তি রেখেছেন, সেগুলো এরকম: প্রথমত, অধিকাংশ জীবকোষ এবং দেহস্থ রক্ত ও অন্যান্য তরলে নানারকম লবণের উপস্থিতি, যার সঙ্গে সমুদ্রের পানির খনিজ লবণের সাদৃশ্য রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সমুদ্রের পানিতে এখনো অনেক সরল এবং এককোষী জীব বসবাস করে।পৃথিবীতে কীভাবে জীব সৃষ্টি হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের অনুমান এরকম: প্রায় ২৬০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে মিথেন, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড এবং জলীয় বাষ্প, নাইট্রোজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস ছিল; কিন্তু অক্সিজেন গ্যাস ছিল না। অহরহ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটত এবং বজ্রপাতের ফলে ও অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে এই যৌগ পদার্থগুলো মিলিত হয়ে অ্যামাইনো এসিড এবং নিউক্লিক এসিড উৎপন্ন করে। ল্যাবরেটরিতে এই প্রক্রিয়াটি পরীক্ষা করে প্রমাণ করা হয়েছে। পরে অ্যামাইনো এসিড এবং নিউক্লিক এসিড মিলিত হওয়ায় নিউক্লিওপ্রোটিন অণুর সৃষ্টি হয়। নিউক্লিওপ্রোটিন অণুগুলো ক্রমে নিজেদের প্রতিরূপ-গঠনের (replication) ক্ষমতা অর্জন করে এবং জীবনের সূত্রপাত ঘটায়। পৃথিবীর উৎপত্তি ও জীবনের উৎপত্তির ঘটনাপ্রবাহকে বলে রাসায়নিক বিবর্তন বা অভিব্যক্তি।ধারণা করা হয়, প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিড সহযোগে সৃষ্টি হয় নিউক্লিওপ্রোটিন। এই নিউক্লিওপ্রোটিন থেকেই সৃষ্টি হয় প্রোটোভাইরাস এবং তা থেকে সৃষ্টি হয় ভাইরাস। ভাইরাস এমন একটা অবস্থা নির্দেশ করে যেটি হচ্ছে জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী অবস্থা।

এরপর সম্ভবত উদ্ভব হয় ব্যাকটেরিয়া এবং আরও পরে সৃষ্টি হয় প্রোটোজোয়া। ব্যাকটেরিয়ার নিউক্লিয়াস আদি প্রকৃতির, তাই এদেরকে আদি কোষ বলা হয়। পরে প্রোটোজোয়ানদের দেহে দেখা গেল সুগঠিত নিউক্লিয়াস। কিছু এককোষী জীবদেহে সৃষ্টি হলো ক্লোরোফিল ফলে একদিকে যেমন খাদ্য সংশ্লেষ সম্ভব হলো, তেমনি খাদ্য সংশ্লেষের উপজাত (by product) হিসেবে অক্সিজেন সৃষ্টি হতে শুরু করল। তখন সবাত শ্বসনকারী জীবদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকল। উদ্ভব হলো এককোষী থেকে বহুকোষী জীব। এরপর একদিকে উদ্ভিদ ও অপরদিকে প্রাণী—দুটি ধারায় জীবের অভিব্যক্তি বা বিবর্তন শুরু হলো।

বিবর্তনের স্বপক্ষে প্ৰমাণ

বিবর্তনের আলোচনায় মূলত দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। একটি হলো, বিবর্তন যে হয়েছে তার প্রমাণ, অপরটি হলো, বিবর্তনের পদ্ধতি অর্থাৎ কীভাবে জীবজগতে বিবর্তন এসেছে তার বর্ণনা। প্রাণ সৃষ্টির পর থেকে কোটি কোটি বছর ধরে জীবজগতের যে পরিবর্তন বা বিবর্তন ঘটেছে, তার স্বপক্ষে একাধিক প্রমাণ আছে। নিচে সেগুলো আলোচনা করা হলো।

১. অঙ্গসংস্থান সম্পর্কিত প্রমাণ

বিভিন্ন জীবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাহ্যিক গঠনকে অঙ্গসংস্থান বলে। এদের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের আলোচনাকে তুলনামূলক অঙ্গসংস্থান বলে। সমসংস্থ অঙ্গ, সমবৃত্তীয় অঙ্গ এবং লুপ্তপ্রায় অঙ্গের তুলনামূলক অঙ্গসংস্থান এখানে আলোচিত হলো।

(ক)সমসংস্থ অঙ্গ: পাখির ডানা, বাদুড়ের ডানা, ভিমির ফ্লিপার, সিলের অগ্রপদ, ঘোড়ার অগ্রপদ, মানুষের হাত—এর সবগুলোই সমসংস্থ অঙ্গ। আপাতদৃষ্টিতে এদের আকৃতিগত পার্থক্য দেখা গেলেও অভ্যন্তরীণ কাঠামো পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে এদের অস্থিবিন্যাসের মৌলিক প্রকৃতি একই ধরনের (চিত্র ৪.১৫)। অর্থাৎ সকল প্রাণীর জন্যই এখানকার অস্থিগুলো উপর থেকে নিচের দিকে পরপর সাজানো রয়েছে। বাইরে থেকে দেখতে যে বৈসাদৃশ্য রয়েছে, সেটি ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হওয়ার জন্য ঘটেছে। পাখি ও বাদুড়ের “অগ্রপদ” ওড়ার জন্য, তিমির ফ্লিপার সাঁতারের জন্য, ঘোড়ার অগ্রপদ দৌড়ানোর জন্য ও মানুষের অগ্রপদ কোনো জিনিস ধরা ও অন্যান্য সৃজনশীল কাজের জন্য পরিবর্তিত হয়েছে। সমসংস্থ অঙ্গগুলো থেকে বোঝা যায় যে সংশ্লিষ্ট অঙ্গ তথা জীবগুলো উৎপত্তিগতভাবে এক, যদিও সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে অভিযোজিত হওয়ার ফলে বর্তমানে তাদের গঠন বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। তাই বিবর্তনবিদগণ মনে করেন যে সমসংস্থ অঙ্গবিশিষ্ট জীবগুলোর উৎপত্তি একই পূর্বপুরুষ থেকে ঘটেছে। এই তথ্য জৈব বিবর্তন সমর্থন করে।

(খ) সমবৃত্তি অঙ্গ : বিভিন্ন প্রাণীর যে অঙ্গগুলোর উৎপত্তি, বিকাশ এবং গঠন ভিন্ন হলেও তারা একই কাজ করে, সেই অঙ্গগুলোকে সমবৃত্তি অঙ্গ বলে। যেমন পতঙ্গ কিংবা বাদুড়ের ডানা উড়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। এদের উৎপত্তি ও গঠন সম্পূর্ণ আলাদা হলেও একই পরিবেশের প্রভাবে তারা একই রকম কাজ করার জন্য অভিযোজিত হয়েছে অর্থাৎ বাদুড় এবং পতঙ্গ দুটিই প্রয়োজনের তাগিদে উড়তে কর্ট সাহায্য করার উপযোগী অঙ্গ তৈরি করেছে। এরকম সমবৃত্তি অঙ্গগুলো বিবর্তন সমর্থন করে।

(গ) লুপ্তপ্রায় অঙ্গ: জীবদেহে এমন কতকগুলো অঙ্গ দেখা যায়, যেগুলো কিছু জীবদেহে সক্রিয় থাকে কিন্তু অপর জীবদেহে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে, এমন অঙ্গগুলোকে লুপ্তপ্রায় অঙ্গ বা নিষ্ক্রিয় অঙ্গ বলে। প্রাণীদেহের মধ্যে বহু লুপ্তপ্রায় অঙ্গ রয়েছে। মানুষের সিকাম এবং সিকাম-সংলগ্ন ক্ষুদ্র অ্যাপেন্ডিক্সটি নিষ্ক্রিয়, কিন্তু স্তন্যপায়ীভুক্ত তৃণভোজী প্রাণীদের (যেমন ঘোড়া কিংবা গিনিপিগের) দেহে এগুলো সক্রিয়। মানুষের দেহে লেজ নেই, তবু মেরুদণ্ডের শেষ প্রান্তে ককসিক্স নামক লুপ্তপ্রায় অঙ্গ রয়েছে। এই ককসিক্স মানুষের পূর্বপুরুষে সুগঠিত ছিল। গরু, ঘোড়া, ছাগল, মানুষ এদের সবার কানের গঠনের বৈশিষ্ট্য একই ধরনের। এ ধরনের আলোচনা থেকে বলা যায় যে লুপ্তপ্রায় অল্প বহনকারী প্রাণীটির উৎপত্তি ঘটেছে এমন উদবংশীর প্রাণী থেকে, যার দেহে একসময় উচ্চ অল্পটি সক্রিয় ছিল ।

২. তুলনামূলক শারীরস্থানিক প্রমাণ

বিভিন্ন প্রাণীর অঙ্গের অন্তর্গঠনের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য-সংক্রান্দ্র আলোচনাকে তুলনামূলক শারীরস্থান বলে। বিভিন্ন শ্রেণির মেরুদণ্ডী প্রাণীর কোনো কোনো অঙ্গের গঠনের তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যাবে যে এদের গঠনে মৌলিক মিল রয়েছে। এই তথ্য জৈব বিবর্তনকে সমর্থন করে। উদাহরণস্বরূপ মেরুদণ্ডী প্রাণীদের হৃৎপিণ্ডের গঠনের উল্লেখ করা যায়। মাছের হৃৎপিন্ড দুটি প্রকোষ্ঠযুক্ত; উভচরের (ব্যাঙের) হৃৎপিন্ড তিনটি প্রকোষ্ঠযুক্ত। আবার সরীসৃপের হৃৎপিন্ড দুটি অলিন্দ এবং অসম্পূর্ণভাবে বিভক্ত দুটি নিলয় থাকে। পাখি এবং স্তন্যপায়ীর হৃৎপিন্ড চারটি প্রকোষ্ঠযুক্ত অর্থাৎ সেখানে রয়েছে দুটি অলিন্দ এবং দুটি নিলয়। উপরিউর মেরুদণ্ডী প্রাণীগুলোর হৃৎপিণ্ডের মৌলিক গঠন এক, যদিও ধীরে ধীরে সেটি জটিল হয়েছে। অর্থাৎ একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তনের ধারায় ক্রমশ বিভিন্ন জটিল জীবগুলোর উৎপত্তি ঘটেছে।

৩. সংযোগকারী জীবন সম্পর্কিত প্রমাণ

জীবজগতে এমন জীবের অস্তিত্ব দেখা যায়, যাদের মধ্যে দুটি জীবগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে। এ ধরনের জীবকে সংযোগকারী জীব বা কানেকটিং লিংক (Connecting link) বলে। উদাহরণ দেওয়ার জন্য প্লাটিপাসের (চিত্র ৪.১৭) নাম উল্লেখ করা যায়। প্লাটিপাসের মধ্যে সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ী দুই ধরনের প্রাণীরই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্লাটিপাস সরীসৃপের মতো ডিম পাড়ে। অপরদিকে স্তন্যপায়ীর মতো এদের শরীর লোমে ঢাকা, বুকে রয়েছে দুগ্ধগ্রন্থি। শুধু তা-ই নয়, এদের ডিম ফুটে শাবক জন্মালে এরা শাবককে স্তন্য পান করায়। সংযোগকারী প্রাণীদের অধিকাংশই পৃথিবীর পরিবর্তনের সাথে কার্যকরীভাবে অভিযোজিত হতে সক্ষম না হওয়ায় ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জীবাশ্মের পরীক্ষা থেকে অন্তবর্তী উদ্ভিদের অস্তিত্ব বিরল ঘটনা হলেও এমন কিছু কিছু উদ্ভিদের কথা জানা যায়, যাদের মধ্যে পাশাপাশি দুটি গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য বর্তমান। Gnetum (নিটাম) নামক গুপ্তবীজী উদ্ভিদে ব্যক্তবীজী এবং গুপ্তবীজী দুই ধরনের উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যই দেখা যায় ।জৈব বিবর্তনের মতবাদ অনুসারে এক গোষ্ঠীর জীব থেকে অপর গোষ্ঠীর জীবের আবির্ভাব ঘটে থাকলে দুই গোষ্ঠীর মাঝামাঝি অন্তবর্তী জীবের অস্তিত্ব থাকা উচিত। অর্থাৎ সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা জন্ম হলে মাঝামাঝি এমন প্রাণীর অস্তিত্ব থাকা উচিত যেটি সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাঝামাঝি কাজেই প্রকৃতিতে এই সকল সংযোগকারী জীবের উপস্থিতি জৈব বিবর্তনকে সমর্থন করে।

৪. ভ্ৰূণতত্ত্বঘটিত প্রমাণ

ডিমের ভিতরে অথবা গর্ভের মধ্যে (স্তন্যপায়ীর ক্ষেত্রে) অবস্থিত শিশু প্রাণীকে এবং উদ্ভিদের বীজের মধ্যে অবস্থিত শিশু উদ্ভিদকে ভ্রূণ বলে। বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের ভ্রূণের সৃষ্টি এবং তাদের ক্রমবৃদ্ধি পরীক্ষা করা হলে যে তথ্য পাওয়া যায়, সেটি জৈব বিবর্তনের মতবাদকে সমর্থন করে।মৎস্য, উভচর, সরীসৃপ, পাখি এবং স্তন্যপায়ীর অন্তর্গত মেরুদণ্ডী প্রাণীগুলোর ভ্রূণ পর্যবেক্ষণ করলে তাদের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য দেখা যায়। ভ্রূণের প্রাথমিক অবস্থায় কোনটি কোন প্রাণীর তা শনাক্ত করা অসম্ভব। প্রতিটি মেরুদণ্ডী প্রাণীর ভ্রূণে ফুলকা, ফুলকা ছিদ্র এবং লেজ থাকে ।ভ্রূণের একরম সাদৃশ্য লক্ষ করে বিজ্ঞানী হেকেল (Haeckel) এই সিদ্ধান্তে আসেন, যে প্রতিটি জীব তার ভ্রূণের বিকাশের সময় অতি অল্প সময়ের জন্য হলেও উদ্‌ংশীয় জীব বা তার পূর্বপুরুষের বিবর্তনের রূপের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। প্রকৃতির এই নিয়মকেই হেকেল পরে বলেছিলেন, ‘অনটোজেনি রিপিটস্ ফাইলোজেনি' (Ontogeny repeats phylogeny), অর্থাৎ কোনো জীবের ভ্রূণের ক্রমপরিণতি পর্যবেক্ষণ করলে তার পূর্বপুরুষের ইতিহাস জানা যাবে, যা বিবর্তনের স্বপক্ষে একটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ।

৫. জীবাশ্মঘটিত প্রমাণ

বিজ্ঞানের যে শাখা বর্তমান পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া জীব সম্পর্কে অনুসন্ধানে নিয়োজিত, তাকে প্রত্নজীববিদ্যা বলে। বিজ্ঞানের এই শাখা থেকে নানা প্রকারের জীবাশ্মের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন অবলুপ্ত জীব সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়।বিবর্তন সম্পর্কে যেসব প্রমাণ আছে, তাদের মধ্যে জীবাশ্মঘটিত প্রমাণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভূগর্ভের শিলাস্তরে দীর্ঘকাল চাপা পড়ে থাকা জীবের সামগ্রিক বা আংশিক প্রস্তরীভূত দেহ বা দেহছাপকে জীবাশ্ম বলে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরে অবস্থিত শিলার মধ্যে এগুলো সঞ্চিত রয়েছে। জীবাশ্মের সাহায্যে অকাট্যভাবে প্রমাণ করা যায় যে বিবর্তনের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে এক রকম জীব থেকে অন্য রকম জীবের উৎপত্তি ঘটেছে। জীবাশ্ম আবিষ্কারের আগে ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্যে উপযুক্ত প্রমাণের অভাব থাকায় বিবর্তনের ইতিহাসে বেশ কিছু ফাঁক থেকে গিয়েছিল। অনুমান করা হয় যে ফাঁকগুলোতে এমন কোনো ধরনের জীব ছিল, যাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এই রকম খোঁজ না পাওয়া জীবদের মিসিং লিংক (missing link) বা হৃত-যোজক বলা হয়। জীবাশ্ম আবিষ্কারের মাধ্যমে ঐ সমস্ত মিসিং লিংকের সন্ধান পাওয়ায় আজকাল বিবর্তনের ধারাবাহিক ইতিহাসের অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে।

জীবাশ্মকে প্রাগৈতিহাসিক যুগের বা বিপত্ত যুগের জীবন্ত সাক্ষী হিসেবে গণ্য করা হয়। শিলাস্তর থেকে জীবাশ্ম দেখে জীবটির জীবিতকালের তথ্য পাওয়া যায়। তাছাড়া ঐ জীবাশ্মের বৈশিষ্ট্য দেখে বৰ্তমান এবং অতীতের যোগসূত্র খুঁজে বের করা সম্ভব হয় ।উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা যায় যে, লুপ্ত আর্কিওপটেরিক্স (Archaeopteryx) নামে একরকম প্রাণীর জীবাশ্ম (চিত্র ৪.১৮) পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এদের সরীসৃপের মতো পা ও দাঁত, পাখির মতো পালকবিশিষ্ট দুটি ডানা, একটি দীর্ঘ লেজ, লেজের শেষ প্রান্তে একগুচ্ছ পালক এবং চক্ষু ছিল। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী থেকেই বিবর্তনের মাধ্যমে পাখি-জাতীয় প্রাণীর উৎপত্তি ঘটেছে।উদ্ভিদের ক্ষেত্রে বিলুপ্ত টেরিডোস্পর্য (Pteridosperm) নামে এক ধরনের উদ্ভিদের জীবাশ্মে ফার্ন ও বান্ধবীজী (gymnosperm) উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়- এ কারণে ফার্ন-জাতীয় উদ্ভিদ থেকে জিমনোস্পার্ম অর্থাৎ ব্যক্তবীজী উদ্ভিদের আবির্ভাব ঘটেছে বলে মনে করা হয়।

৬. জীবন্ত জীবাশ্ম

কতগুলো জীব সুদূর অতীতে উৎপত্তি লাভ করেও কোনোরকম পরিবর্তন ছাড়াই এখনো পৃথিবীতে বেঁচে আছে, অথচ তাদের সমগোত্রীয় এবং সমসাময়িক অনেক জীবনের বিলুপ্তি ঘটেছে। এই জীবনের জীবন্ত জীবাশ্ম বলে। নিমুলাস বা রাজকাঁকড়া (চিত্র ৪.১৯) নামক সন্ধিপদ প্রাণী, স্কোনোডন নামক সরীসৃপ প্রাণী, প্লাটিপাস নামক স্তন্যপায়ী প্রাণী এর উদাহরণ। অন্যদিকে ইকুইজিটাম, নিটাম ও সিল্কো বাইলোবা নামের উদ্ভিদগুলো উদ্ভিদের জীবন্ত জীবাশ্মের উদাহরণ।প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর আগের লিমিউলাস জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে। এর সমসাময়িক অন্যান্য আর্থোপোডাগুলো বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এরা আজও বেঁচে আছে। তাই এদের জীবন্ত জীবাশ্ম বলা হয়।

 

Content added || updated By

বিবর্তন বা অভিব্যক্তির ফলে নতুন প্রজাতির অথবা একটি প্রজাতি থেকে অন্য একটি প্রজাতির উৎপত্তি হয়। অভিব্যক্তির কৌশল সম্পর্কে যে সকল বিজ্ঞানী বিভিন্ন মতবাদ (theories) প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাঁদের মতবাদগুলো আমরা এখন আলোচনা করব ।

৪.৪.১ ল্যামার্কের তত্ত্ব

ল্যামার্ক (চিত্র ৪.২০) 'বায়োলজি' শব্দটির প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি প্রথম বিবর্তন বা অভিব্যক্তির ওপর বিশ্লেষণী তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এ বিষয়টি তিনি ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর লেখা 'ফিলোসোফিক জুওলজিক' (Philosophic Zoologique) নামে একটি বইতে লিপিবদ্ধ করেন।ল্যামার্কের তত্ত্বকে ল্যামার্কিজম (Lamarckism ) বা ল্যামার্কবাদ বলে। কয়েকটি প্রধান প্রতিপাদ্যের ওপর ভিত্তি করে ল্যামার্কবাদ পঠিত। সেগুলো এখানে আলোচনা করা হলো:

১. ব্যবহার ও অব্যবহারের সূত্র

ল্যামার্কের মতে, জীবের প্রয়োজনে জীবদেহে কোনো নতুন অঙ্গের উৎপত্তি অথবা কোনো পুরোনো অঙ্গের অবলুপ্তি ঘটতে পারে। তাঁর মতে, যদি কোনো জীবের কোনো অঙ্গ ধারাবাহিকভাবে ক্রমাগত ব্যবহৃত হয়, তবে সেই অঙ্গ পরিবেশের প্রয়োজনীয়তার জন্য ধীরে ধীরে সবল ও সুগঠিত হবে। অন্যদিকে, জীবের কোনো অঙ্গ পরিবেশের জন্য অপ্রয়োজনীয় হলে ঐ অঙ্গের আর ব্যবহার থাকে না। সুতরাং ক্রমাগত অব্যবহারের ফলে অঙ্গটি নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হবে এবং অবশেষে অবলুপ্ত হয়ে যাবে। ল্যামার্কের মতে, অঙ্গের ব্যবহার ও অব্যবহার জীবদেহে পরিবর্তন সূচিত করে, যা জীবের বংশপরম্পরায় অর্জিত বৈশিষ্ট্য।

২. পরিবেশের প্রভাব

জীব সদা পরিবর্তনশীল পরিবেশে নিজেকে উপযুক্তভাবে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সব সময় চেষ্টা করে। এটি জীবের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তনশীল পরিবেশে নিজেকে অভিযোজিত করতে জীবদেহে নানা রকমের পরিবর্তন দেখা যায়। ল্যামার্কের মতে, পরিবেশের পরিবর্তন ঘটলে জীবের স্বভাব এবং দৈহিক পরিবর্তন ঘটে। এটাও একটি জীবের অর্জিত বৈশিষ্ট্য।

৩. অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ ও নতুন প্রজাতির উৎপত্তি

ল্যামার্কের মতে, কোনো জীবের জীবনকালে যে সকল বৈশিষ্ট্য অর্জিত হয়, সেই সমস্ত বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় অর্থাৎ অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ ঘটে।ল্যামার্কের তত্ত্ব অনুযায়ী, অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণের জন্য এবং প্রতিটি প্রজন্মে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জিত হওয়ায় ধীরে ধীরে একটি প্রজাতি থেকে অপর একটি নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়।ল্যামার্ক কতগুলো পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই তার মতবাদ রচনা করেছিলেন। তার দেওয়া কয়েকটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে মতবাদটির স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দেওয়া হলো :

  • ক্রমাগত পানিতে সাঁতার কাটার ফলে জলজ পাখির পায়ের আঙ্গুলের অন্তবর্তী স্থানগুলো পাতলা চামড়া দ্বারা সংযুক্ত হওয়ায় লিপ্তপদে পরিণত হয়েছে।
  • সাপের পূর্বপুরুষদের গিরগিটির মতো চারটে পা ছিল, কিন্তু গর্ত ও ফাটলে বাস করার জন্য পায়ের ক্রমাগত অব্যবহারের ফলে বর্তমানে ঐ বৈশিষ্ট্যটি সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হয়েছে।
  • ল্যামার্কের মতে, জিরাফের সুদীর্ঘ গ্রীবা, খুব উঁচু গাছ থেকে পাতা সংগ্রহের জন্য, অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণের ফলেই ঘটেছে।

আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরা জৈব বিবর্তনে ল্যামার্কের মতবাদ গ্রহণ করতে পারেননি। শুধু সময়ের সাথে প্রজাতির পরিবর্তন হয়েছে, সেটি বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন না। বংশগতিবিদ্যার প্রসারের পর বিজ্ঞানীরা জীবের মধ্যে অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুক্রম অনুসন্ধান করেছেন কিন্তু সেটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ বাস্তব অর্জিত বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত হয়, এর স্বপক্ষে বর্তমান বংশগতিবিদগণ কোনো প্রমাণ পাননি। সহজভাবে বলা যায়, কোনো মানুষ ব্যায়াম করে এবং ক্রমাগত ব্যবহার করে তার একটি হাতকে শক্তিশালী করে তুললে তার সন্তান শক্তিশালী হাত নিয়ে জন্ম নেবে সেটি সত্যি নয় ।

 

৪.৪.২ ডারউইনবাদ বা ডারউইনের মতবাদ

ল্যামার্ক বিবর্তনের যে মতবাদ দেন, তার ৫০ বছর পর ব্রিটিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন (চিত্র ৪.২১) একটি বৈপ্লবিক চিন্তাধারার সৃষ্টি করেন। বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন (Charles Darwin, ১৮০১- ১৮৮২) ইংল্যান্ডের সাসবেরি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ পরিভ্রমণকালে তিনি ঐ অঞ্চলের উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য দেখে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন এবং সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তনের প্রায় ২০ বছর পরে ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা প্রজাতির উদ্ভব' (Origin of species by means of natural selection) নামে একটি বইয়ে তাঁর মতবাদটি প্রকাশ করেন।

ডারউইনের দৃষ্টিতে প্রকৃতিতে সংঘটিত সাধারণ সত্যগুলো এরকম:

১. অত্যাধিক হারে বংশবৃদ্ধি

ডারউইনের মতে, অত্যধিক হারে বংশবৃদ্ধি করাই জীবের সহজাত বৈশিষ্ট্য। এর ফলে জ্যামিতিক ও গাণিতিক হারে জীবের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি সরিষা গাছ থেকে বছরে প্রায় ৭৩০,০০০টি বীজ জন্মায়। এই ৭৩০,০০০ বীজ থেকে ৭৩০,০০০ সরিষা গাছের জন্ম হওয়া সম্ভব। আবার একটি স্ত্রী স্যামন মাছ প্রজনন ঋতুতে প্রায় ৩ কোটি ডিম পাড়ে। ডারউইনের মতে, এক জোড়া হাতি থেকে উদ্ভূত সবগুলো হাতি বেঁচে থাকলে ৭৫০ বছরে হাতির সংখ্যা হবে এক কোটি নব্বই লাখ ।

২. সীমিত খাদ ও বাসস্থান

ভূপৃষ্ঠের আয়তন সীমাবদ্ধ হওয়ায় জীবের বাসস্থান এবং খাদ্য সীমিত।

৩. অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম'

জীবেরা জ্যামিতিক ও পাণিতিক হারে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটায় এবং খাদ্য ও বাসস্থান সীমিত থাকায় জীবকে বেঁচে থাকার জন্য কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। ডারউইন এ ধরনের সংগ্রামকে 'অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম' বলে অভিহিত করেন। ডারউইন লক্ষ করেন যে জীবকে তিনটি পর্যায়ে এই সংগ্রাম করতে হয়। সেগুলো হচ্ছে:

(ক) আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম: উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্যাঙ কীটপতঙ্গ খায়, অন্যদিকে সাপ ব্যাঙদের খায়। আবার ময়ূর সাপ এবং ব্যাঙ দুটোকেই খায়- এভাবে নিতান্ত জৈবিক কারণেই বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে খাদ্য-খাদক সম্পর্কের একটি নিষ্ঠুর জীবনসংগ্রাম গড়ে ওঠে।

(খ) অন্তঃপ্রজাতিক সংগ্রাম: একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের খাদ্য ও বাসস্থান একই রকমের হওয়ায়, এদের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এরা নিজেদের মধ্যেই বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতা শুরু করে; উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে একটি দ্বীপে তৃণভোজী প্রাণীর সংখ্যা বেড়ে গেলে খাদ্য ও বাসস্থান সীমিত থাকায় তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সংগ্রাম শুরু করে। সবল প্রাণীগুলো দুর্বল প্রাণীদের প্রতিহত করে গ্রাসাচ্ছাদন করে। ফলে দুর্বল প্রাণীগুলো কিছুদিনের মধ্যেই অনাহারে মারা পড়ে।  ..

(গ) পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম: বন্যা, খরা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বালিঝড়, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত—এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশ জীবের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে। সুতরাং জীবকে তার অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য প্রতিনিয়ত এসব প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়। যে প্রাণীগুলো এই পরিবেশে টিকে থাকতে পারে তারা বেঁচে থাকে অন্যরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে উত্তর ও মধ্য আমেরিকার কোয়েল পাখি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও তুষারপাতের ফলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

৪. প্রকরণ বা জীবদেহে পরিবর্তন

চার্লস ডারউইনের মতে, পৃথিবীতে দুটি জীব কখনোই অবিকল একই ধরনের হয় না। যত কমই হোক এদের মধ্যে কিছু না কিছু পার্থক্য থাকে। জীব দুটির মধ্যে যে পার্থক্য দেখা যায়, তাকে প্রকরণ বা পরিবৃত্তি বলে। অস্তিত্বের জন্য জীবনসংগ্রামে অনুকূল প্রকরণ একটি জীবকে সাহায্য করে।

৫. যোগ্যতমের জয়

ডারউইনের মতে, যেসব প্রকরণ জীবের জীবনসংগ্রামের পক্ষে সহায়ক এবং পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনমূলক, তারাই কেবল বেঁচে থাকে; অন্যরা কালক্রমে পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যায়। মেরু অঞ্চলের ভাল্লুক বা বাঘ বা উদ্ভিদ গ্রীষ্মপ্রধান পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে না ।

৬. প্রাকৃতিক নির্বাচন

ডারউইন তত্ত্বের এই প্রতিপাদ্যটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘অনুকূল (বা অভিযোজনমূলক) প্রকরণ সমন্বিত জীবেরা অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে—এই প্রক্রিয়াকে প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে।' অনুকূল প্রকরণ সমন্বিত জীবেরা প্রকৃতির দ্বারা নির্বাচিত হয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি সংখ্যায় বেঁচে থাকে এবং অত্যধিক হারে বংশবিস্তার করে। অপরদিকে, প্রতিকূল প্রকরণসম্পন্ন জীবেরা প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে ধীরে ধীরে তারা অবলুপ্ত হয় (চিত্র ৪.২২)।ডারউইনের মতবাদ অনুসারে পরিবেশে যে জীবটি খাপ খাইয়ে নিবে, সে হবে যোগ্য এবং যোগ্য জীবটি পরিবেশে প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে বেঁচে থাকার জন্য বংশবৃদ্ধি করবে এবং টিকে থাকবে।

৭. নতুন প্রজাতির উৎপত্তি

যেসব প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে সুবিধাজনক প্রকরণ দেখা যায়, প্রকৃতি তাদের নির্বাচন করে এবং তাদের লালন করে। সুবিধাজনক প্রকরণযুক্ত প্রাণী এবং উদ্ভিদ পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে এবং অযোগ্যদের তুলনার বেশি হারে বংশবিস্তার করতে পারে। উত্তরাধিকার সূত্রে এদের বংশধরদের মধ্যে প্রকরণগুলো সঞ্চারিত হয়। এই বংশধরদের মধ্যে আবার যাদের সুবিধাজনক প্রকরণ বেশি থাকে, প্রকৃতি আবার তাদের নির্বাচন করে। এভাবে যুগ-যুগান্তর ধরে নির্বাচিত করে করে প্রকৃতি প্রাণী ও উদ্ভিদের নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করে।বর্তমানে বংশগতিবিদ, কোষতত্ত্ববিদ ও শ্রেণিবিদগণ নতুন প্রজাতির উৎপত্তির বিষয়ে মেন্ডেলের বংশগতি মতবাদের এবং ডারউইনের বিবর্তন মতবাদের ভিত্তিতে বলেন, ধীর গতিতে তিনটি ভিন্ন উপায়ে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হতে পারে:

(ক) মূল প্রজাতির থেকে পৃথক হয়ে (isolation) যাওয়ার ফলে

(খ) সংকরায়ণের (hybridization) ফলে এবং

(গ) সংকরায়ণ প্রজাতিতে কোষ বিভাজনের সময় ঘটনাক্রমে কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যার বৃদ্ধির (Polyploidy) ফলে। এর ফলে নতুন জীবটির অভিযোজন ঘটবে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা একটি নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হবে।

চার্লস ডারউইনকে জৈব বিবর্তনের জনক বলা হলেও তার মতবাদের ওপর এখনো কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে। তার মতবাদের যে বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, তার উত্তরের খোঁজে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে যাচ্ছেন। পৃথিবীর সব বিজ্ঞানীকে নিয়ে একবার একটা জরিপ নেওয়া হয়েছিল, জরিপের বিষয়বস্তু ছিল পৃথিবীর নানা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ কোনটি। বিজ্ঞানীরা রায় দিয়ে বলেছিলেন, বিজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ তত্ত্ব হচ্ছে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব।

Content added || updated By