নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - পৌরনীতি ও নাগরিকতা - NCTB BOOK

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল অপরিহার্য । আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা মূলত রাজনৈতিক দলেরই শাসন । জনগণের ভোটের মাধ্যমে গঠিত সরকার হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকার । আর রাজনৈতিক দল ছাড়া এই গণতান্ত্রিক সরকার গঠন সম্ভব নয়। এ অধ্যায় পাঠের মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক দল কী, গণতন্ত্রের সাথে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচনের সম্পর্ক, নির্বাচন কমিশন কী ইত্যাদি সম্পর্কে জানব ।

এ অধ্যায় পাঠের মাধ্যমে আমরা-

♦ রাজনৈতিক দলের ধারণা ও বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে পারব

♦ গণতন্ত্রের বিকাশে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে পারব

♦ বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের বর্ণনা দিতে পারব

♦ গণতন্ত্র ও নির্বাচনের সম্পর্ক নিরূপণ করতে পারব

♦  বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি বর্ণনা করতে পারব ।

নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করা

দলীয় আদর্শ ও কর্মসূচির পক্ষে জনমত গঠন

গঠনমূলক বিরোধিতার মাধ্যমে সরকারের ভুলত্রুটি ধরা

বিভিন্ন দলের স্বার্থ একত্র করে রাজনৈতিক কর্মসূচি স্থির করা

রাজতান্ত্রিক সরকারে
একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায়
সমাজতান্ত্রিক শাসনে
সংসদীয় সরকারে

রাজনৈতিক দল হচ্ছে একটি দেশের জনগোষ্ঠীর সেই অংশ যারা একটি আদর্শ বা কিছু নীতি বা কর্মসূচির ভিত্তিতে সংগঠিত হয় । রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতায় গিয়ে দলের নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী দেশ পরিচালনা এবং নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা । রাজনৈতিক দল সকল ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সকলের স্বার্থে কাজ করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আদর্শ ও কর্মসূচিভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি। বিশ্বে এমন দেশও আছে যেখানে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব নেই । যেমন- সৌদি আরব । সেখানে রাজপরিবার এবং এর পরিষদই সকল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে । আবার কোন দেশে আইন করে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়, যেমন- ২০০৫ সাল পর্যন্ত আফ্রিকা মহাদেশের উগান্ডায় সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল ।

রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য:


সংঘবদ্ধ জনসমষ্টি : রাজনৈতিক দল হচ্ছে কতগুলো নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে সংগঠিত একটি জনসমষ্টি ।

ক্ষমতা লাভ :  রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের মাধ্যমে সরকার গঠন করা ।

সুনির্দিষ্ট আদর্শ ও কর্মসূচি : প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের একটি আদর্শ ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি থাকে । আদর্শের দিক থেকে কোনো দল ধর্মভিত্তিক আবার কোনো দল ধর্মনিরপেক্ষ হয়। অন্যদিকে অর্থনীতির রূপরেখা বিবেচনায়ও দল ভিন্ন হতে পারে । যেমন- সমাজতান্ত্রিক দল ।

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নেতৃত্ব : প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকে । কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত দলের শাখা বিস্তৃত থাকে। এছাড়া প্রত্যেক দলের কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটি থাকে । তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দ্বারা দল পরিচালিত হয় ।

নির্বাচনসংক্রান্ত কাজ : আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তথা গণতান্ত্রিক অথবা একনায়কতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । একনায়কতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার চেয়ে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচনের গুরুত্ব অধিকতর । এ সকল নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি, প্রার্থী মনোনয়ন, নির্বাচনে দলীয় কর্মসূচি প্রণয়ন, নির্বাচনি প্রচার ও ভোট সংগ্রহ দলের এবং দলীয় কর্মীদের দ্বারা সম্পাদিত হয়ে থাকে ।

রাজনৈতিক দলের ভূমিকা:

নেতৃত্ব তৈরি : রাজনৈতিক দলের যিনি প্রধান তিনিই হলেন দলের নেতা। দলের নেতৃত্ব যেমন জাতীয় পর্যায়ে থাকে, তেমনি স্থানীয় পর্যায়েও থাকে । আবার আজকে যারা স্থানীয় পর্যায়ের নেতা, আগামীতে তাঁরা যে জাতীয় পর্যায়ের নেতা হতে পারবেন না, তা নয় । এই নেতা তৈরির কাজটি করে রাজনৈতিক দল ও জনগণ।

সরকার গঠন : রাজনৈতিক দলের প্রধান কাজ হচ্ছে সরকার গঠন করা । গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় সেই দলই সরকার গঠন করে ।

জনমত গঠন : রাজনৈতিক দলের একটি অন্যতম কাজ হচ্ছে তার আদর্শ ও কর্মসূচির পক্ষে জনমত গঠন করা । এই জনমত গঠনে রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সভা, মিছিল ও গণযোগাযোগের কর্মসূচি গ্রহণ করে ।

রাজনৈতিক শিক্ষাদান : রাজনৈতিক দলের কাজ হচ্ছে জনগণকে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সচেতন করা । নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলীয় কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে এবং অন্যান্য দলের কাজের সমালোচনা করে । জনগণ বিভিন্ন দলের মতামত, আলোচনা-সমালোচনা ইত্যাদি থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার অনেক বিষয় জানতে পারে ।

গঠনমূলক বিরোধিতা : রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল সরকার গঠন করে এবং দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আইনসভায় বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করে। সরকারের কোনো কার্যক্রম ভুল হলে বিরোধী দলের প্রধান কাজ হচ্ছে গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া ।

সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা : একটি সমাজে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণির মানুষ থাকে । তাদের স্বার্থ পরস্পর থেকে আলাদা । এই আলাদা আলাদা স্বার্থ একত্রিত করে তা একটি কর্মসূচিতে পরিণত করা রাজনৈতিক দলের অন্যতম কাজ। রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের সমর্থন চায় । যেকোনো দল ক্ষমতায় গিয়ে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নীতি প্রণয়ন করে । এই নীতি বাস্তবায়নের উপর সামাজিক ঐক্য নির্ভর করে ।

বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ:

একটি দেশের দলব্যবস্থা দ্বারা শুধু সে দেশের রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি বোঝায় না। দলের সংখ্যা, গঠন, সরকারের সঙ্গে দলের সম্পর্ক ইত্যাদি বোঝায় । দেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ ও সংগঠন বা সমিতি করার অধিকার রয়েছে । এর প্রতিফলন হিসেবে আমরা বাংলাদেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান দেখতে পাই। বর্তমানে বাংলাদেশে অনেকগুলো রাজনৈতিক দল রয়েছে । এগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী উল্লেখযোগ্য । নিচে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোর সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়া হলো ।


বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ:
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস। আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে পুরাতন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন ঢাকায় আওয়ামী মুসলীম লীগ নামে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে ‘মুসলীম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয় । বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ আওয়ামী লীগের মূলনীতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই দল পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে । আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় । এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয় । ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পূনর্গঠন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে এ দলের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। এছাড়া এ দলের নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মানুষ অংশগ্রহণ করে সফল হয়েছে।


বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি):
সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হয়। বিভিন্ন দল ও আদর্শের নেতা-কর্মীদের একত্রিত করে গঠিত এ দলটি ইসলামী মূল্যবোধ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী ।

 

জাতীয় পার্টি:
জাতীয় পার্টি দেশের তৃতীয় বৃহৎ দল। ১৯৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি লেঃ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয় । জাতীয় পার্টির ঘোষণাপত্রে (১) স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব, (২) ইসলামি আদর্শ ও সকল ধর্মের স্বাধীনতা, (৩) বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, (৪) গণতন্ত্র এবং (৫) সামাজিক প্ৰগতি তথা অর্থনৈতিক মুক্তি— এই পাঁচটিকে দলের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয় ।


বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী:
জামায়াতে ইসলামী একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল । ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ ভারতে মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে এ দলের প্রতিষ্ঠা । তখন এর নাম ছিল ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ'। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এর নাম হয় ‘জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান' । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতন করার কাজে দলীয় শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের কর্মীরা সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এ দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ছিল। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের মে মাসে পুনরায় দলটি আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ লাভ করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত ইসলামীর কয়েকজন শীর্ষ নেতা যুদ্ধপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে ।

 

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ):

মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ৩১শে অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) প্রতিষ্ঠিত হয় । জাসদ সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ।

 

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি):

অবিভক্ত ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি এবং ভারত ভাগের পর ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ গঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি আত্মপ্রকাশ করে। এই দলটি মার্কসবাদী- লেলিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত। এদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃৎ কমরেড মনি সিং (মৃত্যু ১৯৯০) ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রাণপুরুষ।

 

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি:

এদেশের বহুধা বিভক্ত চীনপন্থী কমিউনিস্টদের কয়েকটি অংশ মিলিত হয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে । ১৯৮০ সালে এ দলের আত্মপ্রকাশ ।

গণতন্ত্রের বিকাশে রাজনৈতিক দল:

গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি । গণতন্ত্রের সফলতার জন্য রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব অপরিসীম । কেননা রাজনৈতিক দলই জনগণের মতামতকে সুসংগঠিত করে এবং জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটায় ।

রাজনৈতিক দল এর সদস্য ও নেতাদেরকে গণতান্ত্রিক আচার-আচরণে অভ্যস্ত হতে শেখায়। যেমন- দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় দলের নেতা ও কর্মীদেরকে মত প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয় এবং অন্যের মতের প্রতি সহনশীল হতে শেখায় ।

জনগণের স্বার্থবিরোধী সরকারকে অপসারণ করে রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে । ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জনস্বার্থবিরোধী সামরিক সরকারকে হটিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে । ১৯৯১ সালে দেশের সকল রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের মাধ্যমে আবারও সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় ।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সময় অন্তর ক্ষমতার পরিবর্তন হয় । সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকার গঠন করা হয় । রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া এ নির্বাচন সম্ভব নয় ।

নির্বাচন:
নির্বাচন হচ্ছে জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের পদ্ধতি । স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত ভোটাধিকার প্রাপ্ত সকল নাগরিক ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি বাছাই করে । প্রতিনিধি বাছাইয়ের প্রক্রিয়াকে নির্বাচন বলে । যারা ভোট দেয়, তাদের নির্বাচক বা ভোটার বলে । নির্বাচকের সমষ্টিকে নির্বাচকমণ্ডলী বলা হয় । সুষ্ঠু নির্বাচন গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতির অন্যতম শর্ত । এ ছাড়া সামরিক শাসন ও এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায়ও কখনো কখনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায় ।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম । নির্বাচনের মাধ্যমেই জনমত প্রকাশ পায় । নির্বাচনের মাধ্যমেই ভোটারগণ একাধিক প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। নির্বাচকমণ্ডলী সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে । গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচন সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করে । একটি দল নির্বাচিত হয়ে সঠিকভাবে জনগণের জন্য কাজ না করলে পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ সাধারণত সেই দলকে আর নির্বাচিত করে না । উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে এটি যেমন সত্যি, তেমনিভাবে অনুন্নত দেশের ক্ষেত্রেও সত্যি। যেমন- যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে এক দলের হাত থেকে অপর দলের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে।

নির্বাচনের প্রকারভেদ:
নির্বাচন দুই প্রকার । যেমন- প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও পরোক্ষ নির্বাচন ।

প্রত্যক্ষ নির্বাচন : যে নির্বাচনে জনগণ সরাসরি ভোট দিয়ে প্রতিনিধি বাছাই করে তাকে প্রত্যক্ষ নির্বাচন বলা হয় । যেমন- বাংলাদেশের সংসদ সদস্যগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন ।

পরোক্ষ নির্বাচন : জনগণ ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি বা একটি মধ্যবর্তী সংস্থা নির্বাচিত করেন । এই জনপ্রতিনিধিগণ ভোট দিয়ে যখন রাষ্ট্রপতি বা সংসদের সংরক্ষিত আসনের সদস্য নির্বাচন করেন, তখন তাকে বলা হয় পরোক্ষ নির্বাচন । যেমন- বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন । আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি মধ্যবর্তী সংস্থা দ্বারা নির্বাচিত হন ।

নির্বাচনের পদ্ধতি:
নির্বাচন পদ্ধতি বলতে সাধারণভাবে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে বুঝানো হয়। বর্তমানে ভোট প্রদানের দুটি পদ্ধতি রয়েছে । (ক) প্রকাশ্য ভোটদান পদ্ধতি ও (খ) গোপন ভোটদান পদ্ধতি । প্রকাশ্য ভোটদান পদ্ধতিতে ভোটারগণ নিজ নিজ পছন্দের ব্যক্তিকে সকলের সামনে প্রকাশ্যে ভোট দেয়। এতে ভোটাররা প্রকাশ্যে ‘হ্যাঁ' ধ্বনি বা ‘হাত তুলে’ সমর্থন দান করে। অন্যদিকে গোপন ভোটদান পদ্ধতিতে ভোটারগণ গোপনে ব্যালটপত্রে পছন্দকৃত ব্যক্তির নামের পাশে নির্ধারিত চিহ্ন এঁকে বা সিল দিয়ে ভোট প্রদান করে । বর্তমানে এ পদ্ধতি সর্বজনস্বীকৃত ।

 

এক ব্যক্তি এক ভোট:

নির্বাচনপদ্ধতির মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হচ্ছে ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট’ পদ্ধতি । ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট' বর্তমানে সর্বত্র গৃহীত নীতি । এ পদ্ধতিতে একটি আসনের জন্য যেকোনো সংখ্যক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন । একজন ভোটার কেবল তাঁর পছন্দের প্রার্থীকে একটি ভোট দিবেন । প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে যিনি বেশি ভোট পাবেন তিনি নির্বাচিত হবেন ।

নির্বাচন কমিশন:
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের পূর্ব শর্ত হচ্ছে কার্যকর নির্বাচনব্যবস্থা। অন্যকথায়, নির্বাচনের উপর জনগণের আস্থা। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ । আর এই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ।

গঠন:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় নির্বাচন কমিশন গঠিত । এটি সাংবিধানিকভাবে গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান । প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন কমিশনারসহ মোট পাঁচজন নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত । নির্বাচন কমিশনারগণকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন । নির্বাচন কমিশনের সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার সভাপতির কাজ করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারের মেয়াদ তাদের কার্যভার গ্রহণের তারিখ হতে পাঁচ বছর । নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সরকার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কর্তব্য । নির্বাচন কমিশন সংবিধানে বর্ণিত নির্দেশনাবলি এবং দেশের নির্বাচনি আইন দ্বারা পরিচালিত হয় ।

নির্বাচন কমিশনের কার্যাদি সম্পন্ন করার জন্য নিজস্ব সচিবালয় রয়েছে । সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নিয়ে সংসদ প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা খুবই জরুরি। নির্বাচন কমিশন এর জনবল ও আর্থিক ক্ষমতার জন্য সরকারের উপর নির্ভরশীল। তাই জনবল ও অর্থসংক্রান্ত ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা থাকা একান্ত আবশ্যক ।


ক্ষমতা ও কার্যাবলি:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৯-এ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বর্ণিত হয়েছে । নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন পরিচালনা, নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ, ভোটারদের পরিচয়পত্র প্রদান,আইন কর্তৃক নির্ধারিত অন্যান্য নির্বাচন (এর মধ্যে সকল স্থানীয় সরকার পরিষদ যেমন- ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ) পরিচালনা এবং আনুষঙ্গিক কার্যাদির সুষ্ঠু সম্পাদন । এছাড়া নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাছাইকরণ, দল সম্পর্কিত নীতিমালা ও নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করাও নির্বাচন কমিশনের কাজ। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ করা। যেমন- বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি নির্বাচনি এলাকা রয়েছে। সেখান থেকে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদ সদস্যগণ নির্বাচিত হন । ভৌগোলিক আয়তন ও ভোটার সংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচনি এলাকা নির্ধারিত হয়। ভৌগোলিক এলাকাভিত্তিক ৩০০ আসন ছাড়াও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আরো ৫০টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে । এগুলো মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট । তাঁরা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ৩০০ সংসদ সদস্য কর্তৃক পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন ।