নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - পৌরনীতি ও নাগরিকতা - NCTB BOOK

রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক যাতে সুখে-শান্তিতে স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারে, রাষ্ট্র সে জন্য আইন প্ৰণয়ন করে । আইন ছাড়া সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। আইনের শাসনের মূলকথা হচ্ছে, আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের সকলের আইনের বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ ও উৎস, স্বাধীনতার স্বরূপ, প্রকারভেদ, সংরক্ষণের উপায়, সাম্যের ধারণা, আইন, স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক এবং নাগরিক জীবনে আইনের শাসনের গুরুত্ব ইত্যাদি জানা একান্ত আবশ্যক ।
এ অধ্যায় পড়া শেষে আমরা-
♦ আইন, স্বাধীনতা ও সাম্যের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব
♦ আইনের উৎস বর্ণনা করতে পারব
♦ আইন, স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে পারব
♦ আইনের শাসনের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করতে পারব
♦ আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করব এবং আইন মেনে চলব ।

আইনের চোখে সবাই সমান
বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে
ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষক
রীতিনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত
এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সাথে ভালো আচরণ করে
রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক বজায় থাকে
বিভিন্ন রাষ্ট্র সঠিকভাবে প্রশাসন পরিচালনা করে
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয়

আইনের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Law'। সাধারণভাবে আইন বলতে আমরা সুনির্দিষ্ট নীতি ও নিয়ম কানুনকে বুঝে থাকি যা সকলের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্নভাবে আইনের সংজ্ঞা দিয়েছেন ।
এরিস্টটল বলেন, “সমাজের যুক্তিসিদ্ধ ইচ্ছার অভিব্যক্তিই হচ্ছে আইন।”
অধ্যাপক হল্যান্ড এর মতে, আইন হচ্ছে, “সেই সাধারণ নিয়ম যা মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রয়োগ ও বলবৎ করা হয়।”
আইনবিদ স্যামন্ড এর মতে, “আইন হলো ন্যায় প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও প্রয়োগকৃত নীতিমালা ।”
সংক্ষেপে বলতে গেলে, আইন বলতে সমাজ স্বীকৃত এবং রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত নিয়ম-কানুনকে বোঝায় যা মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। আইন মানুষের মঙ্গলের জন্য প্রণয়ন করা হয়। আইনের দ্বারা ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, ব্যক্তির সাথে রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয় । সাধারণভাবে দেশের আইনসভা কতৃক আইন প্রণীত হয় এবং নির্বাহী বিভাগ তা প্রয়োগ করে। আইন ভঙ্গ করলে শাস্তির বিধান আছে ।

আইনের কতগুলো মৌলিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় । নিচে তা আলোচনা করা হলো ।
১. বিধিবদ্ধ নিয়মাবলি : আইন কতগুলো প্রথা, রীতি-নীতি এবং নিয়মকানুনের সমষ্টি ।
২. বাহ্যিক আচরণের সাথে যুক্ত : আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণ ও কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে । যেমন- আইনবিরোধী কোনো কাজের জন্য শাস্তি পেতে হয় । শাস্তির ভয়ে মানুষ অপরাধ থেকে বিরত থাকে ।

৩. রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ও স্বীকৃতি: সমাজের যেসব নিয়ম রাষ্ট্র অনুমোদন করে সেগুলো আইনে পরিণত হয় । অন্য কথায়, আইনের পিছনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব থাকে। রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ও স্বীকৃতি ব্যতিরেকে কোনো বিধিবিধান আইনে পরিণত হয় না ।

৪. ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষক : আইন ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে কাজ করে । এজন্য আইনকে ব্যক্তিস্বাধীনতার ভিত্তি বলা হয় ।

৫. সর্বজনীন : আইন সর্বজনীন। সমাজের সকল ব্যক্তি আইনের দৃষ্টিতে সমান। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ, ধনী, দরিদ্র সবার জন্য আইন সমানভাবে প্রযোজ্য ।

৬. সুস্পষ্ট: আইন অবশ্যই সুস্পষ্ট হবে। অন্যথায় নিরাপরাধী ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে যেতে পারে ।

৭. পরিবর্তনশীল: আইনকে দেশ, কাল ও সময় ভেদে পরিবর্তনশীল হতে হবে।

আইন কত প্রকার তা নির্দিষ্ট নয়। এ সম্পর্কে বিভিন্নজন বিভিন্ন মত দিয়েছেন। অধ্যাপক হল্যান্ড আইনকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করেছেন-
১. ব্যক্তিগত আইন ২. সরকারি আইন ।
মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক আর. এম. ম্যাকাইভারের মতে আইন দুই প্রকার। ১. জাতীয় আইন ২. আন্তর্জাতিক আইন। জাতীয় আইনকে তিনি আবার দুইভাগে ভাগ করেছেন- ক. সাংবিধানিক আইন খ. সাধারণ আইন ।
আইনের উৎসের ভিত্তিতে আইন আবার ছয় প্রকার-
১. শাসনতান্ত্রিক আইন
২. সাধারণভাবে প্রণীত আইন ৩. প্রথাভিত্তিক সাধারণ আইন
৪. বিভাগীয় কর্মকর্তা কর্তৃক প্রণীত আইন
৫. শাসনবিভাগীয় আইন ৬. আন্তর্জাতিক আইন।
আইন সাধারণত তিন প্রকার-
১. রাষ্ট্র সম্পর্কিত আইন (Public Law)
২. ব্যক্তি সম্পর্কিত আইন (Private Law)
৩. আন্তর্জাতিক আইন (International Law)
১. রাষ্ট্র সম্পর্কিত আইন : রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত ও বলবৎকৃত নিয়মকানুনই হলো রাষ্ট্র সম্পর্কিত আইন। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে নানা ধরনের আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হয়। রাষ্ট্র সম্পর্কিত আইন সাধারণত আইনসভা বা পার্লামেন্টে প্রণীত হয়ে থাকে । রাষ্ট্র সম্পর্কিত আইন আবার নিম্নরূপ-
ক. ফৌজদারি আইন : রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের কাজ পরিচালনার জন্য এ ধরনের আইন প্রণয়ন করা হয়। সমাজে শান্তি বজায় রাখা এবং ব্যক্তির অধিকার নিশ্চিত করা এবং দণ্ড দেয়ার জন্য ফৌজদারি আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।

খ. প্রশাসনিক আইন : প্রশাসনিক আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনসেবা নিশ্চিত করা হয় ও সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তি বর্গের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
২. ব্যক্তি সম্পর্কিত আইন : এ আইন রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রণীত না হলেও সামাজিকভাবে স্বীকৃত। ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক রক্ষা ও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এ আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। যেমন- চুক্তি ও দলিল সংক্রান্ত আইন ।
৩. আন্তর্জাতিক আইন : এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক রক্ষার জন্য যে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়, তাকে আন্তর্জাতিক আইন বলে। বিভিন্ন রাষ্ট্র পরস্পরের সাথে কেমন আচরণ করবে, এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের সাথে কেমন ব্যবহার করবে, কীভাবে আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধান করা হবে তা আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়।

আইনের উৎপত্তি বিভিন্ন উৎস থেকে হতে পারে । আইনের উৎসগুলো নিম্নে বর্ণিত হলো ।

১. প্রথা : দীর্ঘকাল যাবৎ কোনো নিয়ম সমাজে চলতে থাকলে তাকে প্রথা বলে। রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে প্রথার মাধ্যমে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ হতো । রাষ্ট্র সৃষ্টির পর যেসব প্রথা রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে সেগুলো আইনে পরিণত হয়। যুক্তরাজ্যের অনেক আইন প্রথার উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছে।

২. ধর্ম : ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মগ্রন্থ আইনের অন্যতম উৎস। সকল ধর্মের কিছু অনুশাসন রয়েছে যা ঐ ধর্মের অনুসারীরা মেনে চলে। এসব অনুশাসন সমাজ জীবনকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করতে সহায়তা করে । ফলে এসব ধর্মীয় অনুশাসনের অনেক কিছুই পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমে আইনে পরিণত হয় । যেমন- মুসলিম আইন, হিন্দু আইন প্রভৃতি । আমাদের দেশে পারিবারিক ও সম্পত্তি আইনের অনেকগুলো উপরে উল্লেখিত দুটি ধর্ম থেকে এসেছে ।

৩. আইনবিদদের গ্রন্থ : আমরা যখন গল্প, উপন্যাস কিংবা খবরের কাগজ পড়ি, কোনো শব্দের অর্থ বুঝতে সমস্যা হলে অভিধান ও বিশ্বকোষের সাহায্য নিই। ঠিক তেমনি, বিচারকগণ কোনো মামলার বিচারকার্য সম্পাদন করতে গিয়ে আইন সংক্রান্ত কোনো সমস্যায় পড়লে তা সমাধানের জন্য আইন- বিশারদদের বিজ্ঞানসম্মত গ্রন্থের সাহায্য নিয়ে এসব আইন ব্যাখ্যা করেন যা পরবর্তীকালে আইনে পরিণত হয়। যেমন- অধ্যাপক এ ভি ডাইসির ‘দ্যা ল অব দ্যা কনস্টিটিউশন' এবং উইলিয়াম ব্লাকস্টোনের ‘কমেনটরিজ অন দ্যা লজ অব ইংল্যান্ড' ।

৪. বিচারকের রায় : আদালতে উত্থাপিত মামলার বিচার করার জন্য প্রচলিত আইন অস্পষ্ট হলে বিচারকগণ তাদের প্রজ্ঞা ও বিচারবুদ্ধির উপর ভিত্তি করে ঐ আইনের ব্যাখ্যা দেন এবং উক্ত মামলার রায় দেন । পরবর্তীকালে বিচারকগণ সেসব রায় অনুসরণ করে বিচার করেন। এভাবে বিচারকের রায় পরবর্তীকালে আইনে পরিণত হয় । সুতরাং বলা যায়, বিচারকের রায় আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস ।

৫. ন্যায়বোধ : আদালতে এমন অনেক মামলা উত্থাপিত হয় যা সমাধানের জন্য অনেক সময় কোনো আইন বিদ্যমান থাকে না। সে অবস্থায় বিচারকগণ তাদের ন্যায়বোধ বা বিবেক দ্বারা উক্ত মামলার বিচারকাজ সম্পাদন করেন এবং পরবর্তী সময়ে তা আইনে পরিণত হয় ।

৬. আইনসভা : আধুনিককালে আইনের প্রধান উৎস আইনসভা। জনমতের সাথে সঙ্গতি রেখে বিভিন্ন দেশের আইনসভা নতুন আইন প্রণয়ন করে এবং পুরাতন আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করে তোলে।

আইনের শাসনের অর্থ হচ্ছে - কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সবাই আইনের অধীন। অন্যকথায় আইনের চোখে সবাই সমান । আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিকের সমান অধিকার প্রাপ্তির সুযোগকে আইনের শাসন বলে । সবার উপরে আইন- এর অর্থ আইনের প্রাধান্য। আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান-এর অর্থ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ -লিঙ্গ-পেশা নির্বিশেষে আইনের সমান আশ্রয় লাভ করা। এর ফলে ধনী-দরিদ্র, সবল-দুর্বল সকলে সমান অধিকার লাভ করে। আইনের শাসনের প্রাধান্য থাকলে সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বিরত থাকবে এবং জনগণ আইনের বিধান মেনে চলবে ।
আইনের শাসনের গুরুত্ব অপরিসীম । আইন না থাকলে সমাজে অনাচার অরাজকতা সৃষ্টি হয়। আইনের শাসন অনুপস্থিত থাকলে নাগরিক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সামাজিক মূল্যবোধ, সাম্য কিছুই থাকে না । সাম্য, স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের শাসন অত্যাবশ্যক ।
আইনের শাসনের দ্বারা শাসক ও শাসিতের সুসম্পর্ক সৃষ্টি হয়। সরকার স্থায়িত্ব লাভ করে এবং রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় । এর অভাবে অবিশ্বাস, আন্দোলন ও বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে । আর বিশৃঙ্খলা, অশান্তি ও হানাহানি সমাজের শক্ত ভিতকে দুর্বল করে তুলে । সমাজে ধনী-দরিদ্র, সবল-দুর্বলের ভেদাভেদ প্রকট আকার ধারণ করে ।
সুতরাং সামাজিক সাম্য, নাগরিক অধিকার, গণতান্ত্রিক সমাজ ও স্থিতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য আইনের শাসন অপরিহার্য । আইনের শাসন একটি সভ্য সমাজের মানদণ্ড ।

সাধারণ অর্থে স্বাধীনতা বলতে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী যেকোনো কাজ করাকে বোঝায় । কিন্তু প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা বলতে এ ধরনের অবাধ স্বাধীনতাকে বোঝায় না। কারণ, সীমাহীন স্বাধীনতা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, কাউকে ইচ্ছামত সবকিছু করার স্বাধীনতা দিলে সমাজে অন্যদের ক্ষতি হতে পারে যা এক অশান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করবে । তাই পৌরনীতিতে স্বাধীনতা ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয় । অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টি না করে নিজের ইচ্ছানুযায়ী নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে কাজ করাই হলো স্বাধীনতা । অর্থাৎ স্বাধীনতা হলো এমন সুযোগ-সুবিধা ও পরিবেশ, যেখানে কেউ কারও ক্ষতি না করে সকলেই নিজের অধিকার ভোগ করে। স্বাধীনতা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করে এবং অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে বাধা অপসারণ করে ।

স্বাধীনতা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন- ১। ব্যক্তি স্বাধীনতা, ২। সামাজিক স্বাধীনতা, ৩ । রাজনৈতিক স্বাধীনতা, ৪ । অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও ৫। জাতীয় স্বাধীনতা ।

১. ব্যক্তি স্বাধীনতা : ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে এমন স্বাধীনতাকে বোঝায়, যে স্বাধীনতা ভোগ করলে অন্যের কোনো ক্ষতি হয় না । যেমন- ধর্মচর্চা করা ও পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষা করা। এ ধরনের স্বাধীনতা ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব বিষয় ।

২. সামাজিক স্বাধীনতা : জীবন রক্ষা, সম্পত্তি ভোগ ও বৈধ পেশা গ্রহণ করা সামাজিক স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত । এ ধরনের স্বাধীনতা ভোগের মাধ্যমে নাগরিক জীবন বিকশিত হয় । সমাজে বসবাসকারী মানুষের অধিকার রক্ষার জন্যই সামাজিক স্বাধীনতা প্রয়োজন। এই স্বাধীনতা এমনভাবে ভোগ করতে হয় যেন অন্যের অনুরূপ স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ না হয় ।

৩. রাজনৈতিক স্বাধীনতা : ভোটদান, নির্বাচিত হওয়া, বিদেশে অবস্থানকালীন নিরাপত্তা লাভ ইত্যাদি নাগরিকের রাজনৈতিক স্বাধীনতা। এসব স্বাধীনতার মাধ্যমে ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় শাসনকাজে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে । গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

8. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা : যোগ্যতা অনুযায়ী পেশা গ্রহণ এবং উপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ করাকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলা হয়। মূলত আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির জন্য নাগরিকরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে । এই স্বাধীনতা না থাকলে অন্যান্য স্বাধীনতা ভোগ করা যায় না। সমাজের অন্য শ্রেণির শোষণ থেকে মুক্ত থাকার জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রয়োজন ।

৫. জাতীয় স্বাধীনতা : বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং অন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত । বাংলাদেশের এই অবস্থানকে জাতীয় স্বাধীনতা বা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা বলে । এই স্বাধীনতার ফলে একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের কর্তৃত্বমুক্ত থাকে । প্রত্যেক স্বাধীন রাষ্ট্র জাতীয় স্বাধীনতা ভোগ করে ।

আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। তাঁদের অনেকেই বলেন, আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। আবার তাদের কেউ কেউ বলেন, আইন ও স্বাধীনতা পরস্পরবিরোধী। প্রকৃতপক্ষে আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক বিরোধী নয় বরং ঘনিষ্ঠ । নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ।

১. আইন স্বাধীনতার রক্ষক : আইন স্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে কাজ করে। যেমন- আমাদের বাঁচার স্বাধীনতা রয়েছে । আইন আছে বলেই আমরা সকলে বাঁচার স্বাধীনতা ভোগ করছি । জন লক যথার্থই বলেছেন, যেখানে আইন থাকে না, সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে না ।

২. আইন স্বাধীনতার অভিভাবক : আইন স্বাধীনতার অভিভাবক হিসেবে কাজ করে। পিতা-মাতা যেমন অভিভাবক হিসেবে সন্তানদের সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে নিরাপদে রাখেন, ঠিক তেমনি আইন সর্ব প্রকার বিরোধী শক্তিকে প্রতিহত করে স্বাধীনতাকে রক্ষা করে ।

৩. আইন স্বাধীনতার শর্ত : আইনের নিয়ন্ত্রণ আছে বলে সবাই স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। উইলোবির মতে, আইনের নিয়ন্ত্রণ আছে বিধায় স্বাধীনতা রক্ষা পায় ।
৪. আইন স্বাধীনতাকে সম্প্রসারিত করে : আইন নাগরিকের স্বাধীনতা সম্প্রসারিত করে। সুন্দর, শান্তিময়, সুষ্ঠু জীবন যাপনের জন্য যা প্রয়োজন তা আইনের দ্বারা সৃষ্টি হয়। এসব কাজ করতে গিয়ে যদিও আইন স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু বাস্তবে স্বাধীনতা তাতে সম্প্রসারিত হয়।
সুতরাং বলা যায়, আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তবে সকল আইন স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করে না। যেমন- জার্মানির হিটলারের আইনের কথা উল্লেখ করা যায়। কারণ, তার আইন মানবতাবিরোধী ছিল । তবে যে আইন জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত, সে আইন স্বাধীনতার রক্ষক, অভিভাবক, শর্ত ও ভিত্তি ।

সাম্যের অর্থ সমান । অতএব শব্দগত অর্থে সাম্য বলতে সমাজে সবার সমান মর্যাদাকে বোঝায় । কিন্তু সমাজে সবাই সমান নয় এবং সবাই সমান যোগ্যতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। প্রকৃত অর্থে সাম্য বলতে এমন এক সামাজিক পরিবেশকে বোঝায়, যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদি নির্বিশেষে যোগ্যতা অনুযায়ী সবাই সমান সুযোগ-সুবিধা লাভ করে, যেখানে কারো জন্য কোনো বিশেষ সুযোগ সুবিধা নাই এবং সে সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে সকলে নিজ নিজ দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে পারে। মূলত, সাম্য বলতে বোঝায়, প্রথমত: কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণির জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধার অবসান, দ্বিতীয়ত: সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা, তৃতীয়ত: যোগ্যতা অনুযায়ী সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা ।

মানুষের বিভিন্নমুখী বিকাশ সাধনের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। নাগরিক জীবনে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগের জন্য সাম্যকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- ১। সামাজিক সাম্য, ২। রাজনৈতিক সাম্য, ৩ । অর্থনৈতিক সাম্য, ৪ । আইনগত সাম্য, ৫। স্বাভাবিক সাম্য ও ৬। ব্যক্তিগত সাম্য ।

১. সামাজিক সাম্য : জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-পেশা নির্বিশেষে সমাজের সকল সদস্যের সমানভাবে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করাকে সামাজিক সাম্য বলে। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণিকে কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যাবে না ।

২. রাজনৈতিক সাম্য : রাষ্ট্রীয় কাজে সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ-সুবিধা থাকাকে রাজনৈতিক সাম্য বলে । নাগরিকরা রাজনৈতিক সাম্যের কারণে মতামত প্রকাশ, নির্বাচিত হওয়া এবং ভোট দেওয়ার অধিকার ভোগ করে ।

৩. অর্থনৈতিক সাম্য : যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যেকের কাজ করার ও ন্যায্য মজুরি পাওয়ার সুযোগকে অর্থনৈতিক সাম্য বলে । বেকারত্ব থেকে মুক্তি, বৈধ পেশা গ্রহণ ইত্যাদি অর্থনৈতিক সাম্যের অন্তর্ভুক্ত।

৪. আইনগত সাম্য : জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে আইনের দৃষ্টিতে সমান মনে করা এবং বিনা অপরাধে গ্রেফতার ও বিনা বিচারে আটক না করার ব্যবস্থাকে আইনগত সাম্য বলে । 

৫. স্বাভাবিক সাম্য : এর অর্থ জন্মগতভাবে প্রত্যেক মানুষ স্বাধীন এবং সমান। কিন্তু বাস্তবে জন্মগতভাবে প্রত্যেক মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে সমান হতে পারে না। এ জন্য বর্তমানে স্বাভাবিক সাম্যের ধারণা প্রায় অচল ।

৬. ব্যক্তিগত সাম্য : জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশ ও মর্যাদা ইত্যাদি নির্বিশেষে মানুষে মানুষে কোনো ব্যবধান না করাকে ব্যক্তিগত সাম্য বলে ।

সাম্য ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দু'টি ধারণা রয়েছে। যথা- ১। সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর সম্পূরক এবং ২। সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী। এ ধারণা দু'টি ব্যাখ্যা করলে উভয়ের সত্যিকার সম্পর্ক সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে ।

১. পরস্পর নির্ভরশীল : সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর নির্ভরশীল । সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার কথা যেমন কল্পনা করা যায় না, ঠিক তেমনি স্বাধীনতা ছাড়া সাম্যের কথা ভাবা যায় না । সুতরাং বলা যায়, একটি রাষ্ট্র যত সাম্যভিত্তিক হবে সেখানে স্বাধীনতা তত নিশ্চিত হবে ।

২. গণতন্ত্রের ভিত্তি : সাম্য ও স্বাধীনতা গণতন্ত্রের ভিত্তি রূপে কাজ করে। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যেমন সাম্যের দরকার হয়, তেমনি স্বাধীনতার প্রয়োজন হয়। সাম্য ও স্বাধীনতা একই সঙ্গে বিরাজ না করলে গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করা সম্ভব হতো না। সাম্য উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ দূর করে আর স্বাধীনতা সকলের সুযোগ-সুবিধাগুলো ভোগ করার অধিকার দান করে । পরিশেষে বলা যায়, সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর পরিপূরক ও সম্পূরক । রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ, চলাফেরা ও জীবনধারণের জন্য সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে না । সমাজের সুবিধাগুলো সকলে মিলে সমানভাবে ভোগ করতে হলে স্বাধীনতার প্রয়োজন । তাই বলা হয় যে সাম্য মানেই স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা মানেই সাম্য ।