সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা - NCTB BOOK

এ অধ্যায়ের শেষে আমরা ধারণা নিতে পারব -

■ মধু পূর্ণিমা কী; 

■ মধু পূর্ণিমার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট; 

■ মধু পূর্ণিমার শিক্ষা ; 

■ মধু পূর্ণিমার সামাজিক গুরুত্ব; 

■ প্রবারণা পূর্ণিমা কী; 

■ প্রবারণা পূর্ণিমার বিশেষত্ব; 

■ প্রবারণা পূর্ণিমার শিক্ষা প্রবারণা 

■ পূর্ণিমার সামাজিক গুরুত্ব।

উ-চিন মং বান্দরবানের একটি স্কুলে পড়ে। সৌম্য বড়ুয়া ও উদয় চাকমা তার প্রিয় বন্ধু। তারা অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। তারা একত্রে বৌদ্ধ বিহারে যায় এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। বৌদ্ধ আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে তারা বেশ কৌতূহলী। একদিন তারা শ্রেণিশিক্ষককে জিজ্ঞাসা করল, “স্যার,বৌদ্ধ আচার অনুষ্ঠান কী?' শ্রেণিশিক্ষক বললেন, বৌদ্ধদের ধর্মীয় সংস্কার এবং শাস্ত্রের নির্দেশনা অনুসারে পালনীয় অনুষ্ঠানগুলো হলো বৌদ্ধ আচার অনুষ্ঠান। যেমন, মধু পূর্ণিমা, কঠিন চীবর দান, সংঘদান ইত্যাদি বৌদ্ধদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। তখন উ চিন মং বলল, মধু পূর্ণিমা আগামী মাসে অনুষ্ঠিত হবে। কীভাবে পূর্ণিমা এ পালন করা হয়, তা আমাদের জানা উচিত। তারা বিষয়টি জানার জন্য একদিন সন্ধ্যায় বিহারে উপস্থিত হলো। বিহারে উপস্থিত হয়ে তারা শ্রদ্ধাচিত্তে সমবেত প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করল। প্রার্থনাশেষে তারা বিহারের ভিক্ষুকে বন্দনা নিবেদন করে পূর্ণিমা পালনের ঐতিহাসিক কারণ জানতে চাইল। ভিক্ষু প্রশান্তচিত্তে তাদের আশীর্বাদ জানিয়ে বিষয়টি এ ভাবে উপস্থাপন করলেন।

প্রত্যেক পূর্ণিমা তিথির সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের জীবনের অনেক মহৎ ঘটনা জড়িত আছে। সেই ঐতিহাসিক মহৎ ঘটনা অনুসারে অনেক পূর্ণিমা দিবসের নতুন নামকরণ হয়েছে। যেমন, বৈশাখী পূর্ণিমা। জন্ম, বুদ্ধত্ব এবং মহাপরিনির্বাণ লাভ - বুদ্ধের জীবনের এই তিনিটি মহৎ ঘটনা বৈশাখী পূর্ণিমায় সংঘটিত হয়েছিল। এ কারণে বৈশাখী পূর্ণিমা বুদ্ধ পূর্ণিমা নামে পরিচিত। তখন সৌম্য বলল, ‘ভন্তে আমরা মধু পূর্ণিমা ও প্রবারণা পূর্ণিমা সম্পর্কে জানতে চাই’। ভিক্ষু বললেন, “বেশ, আজ আমি তোমাদের মধু পূর্ণিমা এবং প্রবারণা পূর্ণিমা সম্পর্কে বলব। তোমরা মনোযোগ দিয়ে শুনবে।

 

মধু পূর্ণিমা

মধু পূর্ণিমা বৌদ্ধদের সম্প্রদায়ের একটি ধর্মীয় তিথি, একটি পুণ্যময় বৌদ্ধপর্ব এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পন্ন একটি ধর্মীয় উৎসব। অন্যান্য পূর্ণিমার মতো ‘মধু পূর্ণিমা’ তিথিও বৌদ্ধরা অত্যন্ত শ্রদ্ধাসহকারে এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালন করে । মধু পূর্ণিমা ভাদ্র মাসে পালিত হয়। এই পূর্ণিমার সঙ্গেও গৌতম বুদ্ধের জীবনের এক মহৎ ঘটনা জড়িত।

এই পূর্ণিমায় পারল্যিয় বনে অবস্থানকালে বুদ্ধকে এক বানর মধু দান করেছিল এবং সেই দান কর্মের ফলে মৃত্যুর পর বানরটি দেবলোকে জন্মগ্রহণ করে। সেই পুণ্যময় ঘটনার কারণে ভাদ্র পূর্ণিমা মধু পূর্ণিমা নামে পরিচিতি লাভ করে। এরপর, তিনি মধু পূর্ণিমার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বলতে আরম্ভ করলেন।

 

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : মধু পূর্ণিমা বা ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা তিথি। এ পূর্ণিমার একটি গৌরবময় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। এটি হলো গৌতম বুদ্ধের জীবিতকালের একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। তখন বুদ্ধ দশম বর্ষাবাস পালনকালে কৌশাম্বীতে অবস্থান করছিলেন। এ সময় তাঁর সাথে অনেক ভিক্ষু ছিলেন।

একদিন একটি তুচ্ছ বিষয়ে ভিক্ষুদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। বিষয়টি ক্ষুদ্র হলেও বিবাদ চরম আকার ধারণ করে এবং ভিক্ষুসংঘ দুদলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। একই বিহারে অবস্থান করা সত্ত্বেও উভয় পক্ষের ভিক্ষুগণ নিজেদের মধ্যে আলাপ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। ভিক্ষুদের এই অশান্ত ও অমৈত্রীপূর্ণ আচরণ বুদ্ধের অন্তরে পীড়া দেয়। মহাকারুণিক বুদ্ধ উভয় পক্ষের ভিক্ষুদের আহ্বান করে বিবাদ নিরসনের পরামর্শ দেন। করুণা ও মৈত্রী অনুসরণের উপদেশ দেন। কিন্তু ভিক্ষুসংঘ বিবাদ প্রশমনে ব্যর্থ হন। ভিক্ষুদের এই অসহিষ্ণু মনোভাবের কারণে বুদ্ধ নিজে বিবাদরত ভিক্ষুদের সংগ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি নীরবে নিভৃতে বনচারী হলেন। কৌশাম্বী ছেড়ে একাকী তিনি পারল্যিয় বনে অবস্থান নিলেন।

পারল্যিয় বনে নির্জনে বসবাসকালে বহু প্রাণীর সঙ্গে বুদ্ধের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বুদ্ধের মৈত্রীময় জীবনাচার বন্য প্রাণীদের আকৃষ্ট করে। সকল প্রাণী বুদ্ধের সেবায় এগিয়ে আসে। সে সময় এক হাতি বুদ্ধকে নানা রকম ফলমূল দিয়ে সেবা করতে থাকে। তা দেখে এক বানরের মনেও সেবার ইচ্ছা জাগে। সেদিন ছিল ভাদ্র পূর্ণিমা। বানরটি এক মধুচাক সংগ্রহ করে এনে বুদ্ধকে দান করল। বুদ্ধ সন্তুষ্ট চিত্তে সেই দান গ্রহণ করলেন। বুদ্ধ দান গ্রহণ করায় বানরটি অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়। দান ও ত্যাগের মাধ্যমে যে পারস্পরিক প্রীতিময় সম্পর্ক গড়ে ওঠে এটি একটি বন্য প্রাণীও উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়। পরে এই বানর ত্যাগ মহিমায় উৎফুল্ল চিত্তে মৃত্যুবরণ করে দেবলোকে উৎপন্ন হয়। এদিকে, বুদ্ধের কৌশাম্বী ত্যাগের কারণে ভিক্ষুসংঘ ও গ্রামবাসী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁরা সম্মিলিত হয়ে বুদ্ধকে ফিরিয়ে নিতে তৎপর হয়।

পরিশেষে ভিক্ষুসংঘ নিজেদের ভুল বুঝতে সক্ষম হন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক শান্তি ও সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সবাই সম্মিলিতভাবে এসে বুদ্ধের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং বুদ্ধকে কৌশাম্বীর বিহারে ফিরিয়ে নিয়ে যান। এ সময় মহাকারুণিক বুদ্ধের কাছে বন্য প্রাণীদের মৈত্রীসুলভ আচরণ, সহাবস্থান এবং দানবৃত্তির কথা শুনে সবার মৈত্রীচিত্ত উৎপন্ন হয়। বিবাদগ্রস্ত ভিক্ষুসংঘ এবং দায়ক-দায়িকাগণ উপলব্ধি করলেন, পারস্পরিক মৈত্রীবোধ ও সম্প্রীতির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন আত্মনিয়ন্ত্রণ। সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্যেই মানুষের প্রকৃত শান্তি নিহিত। এ ঘটনাটি স্মরণীয় করে রাখা এবং বুদ্ধের শিক্ষা-মৈত্রী ও করুণা অনুশীলনের জন্য প্রতিবছর ধর্মীয় চেতনায় মধু পূর্ণিমা পালন করা হয়।

এটুকু বলার পর ভিক্ষু বললেন, এখন আমি মধু পূর্ণিমার শিক্ষণীয় বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করব।

 

অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৩৩

তোমার দেখা একটি মধু পূর্ণিমা অনুষ্ঠানের বর্ণনা দাও।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

মধু পূর্ণিমার শিক্ষা : মধু পূর্ণিমার সঙ্গে বুদ্ধ, ভিক্ষুসংঘ, দায়ক-দায়িকা এবং প্রাণীকুলের সুসম্পর্কের বিষয়টি জড়িত। তাই মধু পূর্ণিমায় শিক্ষা বহুমুখী। মধু পূর্ণিমা মানুষকে ধৈর্য্য ও সহনশীল, পরোপকারী, সেবাপরায়ণ, উদার, পরমতসহিষ্ণু এবং মৈত্রী ও করুণাপরায়ণ হতে শিক্ষা দেয়। সম্প্রীতির মাধ্যমে সহাবস্থানের উদ্বুদ্ধ করে। প্রাণীকুলের প্রতি সদয় আচরণের প্রেরণা যোগায়। রাগ, হিংসা, বিদ্বেষ, বিবাদ, অহংকার পরিহারের প্রেরণা যোগায়। পরিশেষে, পারস্পরিক দায়িত্ব পালনের শিক্ষা দেয়।

মধু পূর্ণিমার শিক্ষা সহজভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ভিক্ষু তাদেরকে দীর্ঘায়ু কুমারের কাহিনিটি বর্ণনা করেন। তিনি বলেন :

দীর্ঘায়ু কুমার ছিলেন কোশলরাজ দীঘীতির পুত্র। রাজা পুত্রকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং সবসময় সৎ উপদেশ দিতেন। পুত্র দীর্ঘায়ু কুমার পিতার উপদেশ খুবই মান্য করতেন। একদিন রাজা উপদেশ দিয়ে বললেন, “দীর্ঘ কিংবা হ্রস্ব দেখিও না; বৎস দীর্ঘায়ু! বৈরিতার দ্বারা বৈরিতার উপশম হয় না, বরং অবৈরিতার দ্বারা বৈরিতার উপশম হয়।” পুত্র পিতার উপদেশ পালন করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। একদিন কাশীরাজ ব্রহ্মদত্ত দীর্ঘায়ু কুমারের পিতা-মাতাকে হত্যা করে কোশল রাজ্য দখল করে নেন। পিতা- মাতার শোকে দীর্ঘায়ু কুমারের অন্তরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে এবং প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকে। এক সময় দীর্ঘায়ু কুমার কাশীরাজের কর্মচারী হয়ে রাজার কাছে আসার সুযোগ লাভ করলেন। একদিন ঘুমন্ত রাজাকে একা পেয়ে তিনি প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হলেন। তিনি কয়েকবার হত্যার উদ্যোগ নেন। কিন্তু পিতার উপদেশ মনে পড়ে যাওয়ায় প্রতিবারই তিনি রাজাকে হত্যা করতে ব্যর্থ হন। ইতোমধ্যে রাজা ঘুম থেকে জেগে যান এবং তলোয়ার হাতে দীর্ঘায়ু কুমারকে দেখে অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। রাজা দীর্ঘায়ু কুমারকে তলোয়ার হাতে শোবার ঘরে প্রবেশ করার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। দীর্ঘায়ু কুমার বললেন, “আমি পিতা-মাতার হত্যার প্রতিশোধ নিতে এসেছিলাম। কিন্তু পিতার উপদেশ মনে পড়ে যাওয়ায় আমি আপনাকে হত্যা করতে পারছিলাম না।“ এরপর, রাজা পিতার উপদেশের মর্মার্থ জানতে চাইলে দীর্ঘায়ু কুমার বলেন, “আমার পিতা বলেছিলেন, চিরকাল কারো সাথে শত্রুতা করবে না। হঠাৎ মিত্রের সাথে বিচ্ছেদ ঘটাবেনা। শত্রুতার দ্বারা কখনো শত্রুতার অবসান হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়। তাই কখনো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ো না। প্রতিশোধের বশবর্তী হয়ে কাউকে হত্যা কোরো না।”কাশীরাজ দীর্ঘায়ু কুমারের এ রকম পিতৃভক্তি ও কর্তব্যবোধ উপলব্ধি করে খুব প্রসন্ন হন। তিনি কোশল রাজ্য দীর্ঘায়ু কুমারের কাছে হস্তান্তর করেন। তারপর তাঁর কন্যাকে দীর্ঘায়ু কুমারের সাথে বিয়ে দিয়ে উভয়ের সম্পর্ক আরো মৈত্রীপূর্ণ করেন।

ভিক্ষু পুনরায় বললেন, কলহ ও রাগের প্রভাব জন্ম-জন্মান্তরে প্রবাহিত হয়। এতে ক্ষতি ছাড়া কোনো প্রকার মঙ্গল সাধিত হয় না। তাই, কলহ, রাগ ও হিংসা সর্বদা পরিত্যাজ্য। দীর্ঘায়ু কুমারের শিক্ষা মানব জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববহ এবং অনুসরণযোগ্য। এরপর ভিক্ষু মধু পূর্ণিমার সামাজিক গুরুত্ব সম্পর্কে দেশনা করেন। তিনি বলেন :

মধু পূর্ণিমাার সামাজিক গুরুত্ব : মধু পূর্ণিমায় বৌদ্ধরা বিহারে গিয়ে একসঙ্গে ধর্মীয় আচরণগুলো পালন করে। দান, শীল ও ভাবনা চর্চা করে। ধর্মালোচনা ও বুদ্ধ কীর্তন শোনে। ফলে তাদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি গড়ে ওঠে, আত্মশুদ্ধি হয়। বুদ্ধের শিক্ষা অনুসরণ করে ধর্মময় আদর্শ জীবন যাপনের চেতনা জাগে। হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার ও কলহ-বিবাদের অসারতা উপলব্ধি করে কুশল কর্ম সম্পাদনে অনুপ্রাণিত হয়। সৃষ্টি হয় মানব সেবার মনোভাব। ফলে সমাজে অনৈক্য-বিশৃঙ্খলা দূর হয়ে ঐক্য ও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাই বলা যায় - মধু পূর্ণিমার সামাজিক গুরুত্ব অনেক।

মধু পূর্ণিমার ঐতিহাসিক কারণ জেনে উ চিন মং, সৌম্য বড়ুয়া ও উদয় চাকমা খুব সন্তুষ্ট হয়। তারা এবার প্রবারণা সম্পর্কে জানার উৎসাহবোধ করে। ভিক্ষু তাদের উৎসাহ দেখে প্রবারণা পূর্ণিমা সম্পর্কেও দেশনা করেন।

 

অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৩৪

মধু পূর্ণিমার শিক্ষা আমাদের জীবনে কী উন্নয়ন ঘটাতে পারে বলে তুমি মনে করো, তা লেখো ।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

 

প্রবারণা পূর্ণিমা

প্রবারণা পূর্ণিমা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভিক্ষু বললেন :

প্রবারণা শব্দের অর্থ : প্রবারণা পূর্ণিমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্যসমৃদ্ধ তিথি। ‘প্রবারণা' শব্দের অর্থ হলো প্রকৃষ্টরূপে বরণ ও বারণ করা। অর্থাৎ, যা কুশল, শোভন, সত্য, সুন্দর এবং সকলের জন্য মঙ্গলকর তা প্রকৃষ্টরূপে বরণ করা এবং যা অকুশল, অশোভন, অসত্য, অকল্যাণকর তা প্রকৃষ্টরূপে বারণ করা বা তা করা থেকে বিরত থাকার দৃঢ় শপথ হচ্ছে প্রবারণা। প্রবারণা পূর্ণিমায় ভিক্ষুসংঘের অনেক বিধিবদ্ধ নিয়ম পালন করতে হয়। এটি তাঁদের তিনমাস বর্ষাবাস অধিষ্ঠানের পূর্ণতার তিথি। যে অধিষ্ঠানের সূচনা হয় আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে বা আষাঢ়ী পূর্ণিমায়। সাধারণ গৃহী বৌদ্ধরাও উপোসথ তিথি হিসেবে এই পূর্ণিমাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে উদযাপন করে। এ সময় বিহারে বিহারে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। ভিক্ষুসংঘ ও গৃহী বৌদ্ধরা একসঙ্গে এসব অনুষ্ঠান অংশ গ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে সকল প্রকার কলুষতা ত্যাগ করে সকলে আত্মশুদ্ধির চেতনায় উদ্ভাসিত হয়।

প্রবারণা পূর্ণিমার বিশেষত্ব : আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই পূর্ণিমা উদযাপিত হয়। এ পূর্ণিমার তিন মাস আগে পালিত হয় আষাঢ়ী পূর্ণিমা। এ পূর্ণিমা তিথিতে তথাগত বুদ্ধ আত্মশুদ্ধি এবং প্রজ্ঞা অনুশীলনের জন্য ভিক্ষুসংঘকে আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিনমাস বর্ষাবাস পালনের জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। এটি ভিক্ষুসংঘের ‘ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস' নামে খ্যাত। তাই আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমা ভিক্ষুসংঘের জন্য সংযম ও আত্মশুদ্ধির পূর্ণতার তিথি। এদিন ভিক্ষুসংঘ একত্রিত হয়। তাঁরা পরস্পরের মধ্যে জানা-অজানা কারণে সংঘঠিত ভুলত্রুটি স্বীকার করেন এবং পরস্পরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজেদের পরিশুদ্ধ করেন। এটি মূলত ভিক্ষুসংঘের বিনয়বিধিমূলক একটি অনুষ্ঠান। এজন্য প্রবারণা পূর্ণিমাকে আত্মশুদ্ধি অনুশীলনের এক অনন্য তিথি হিসেবে গণ্য করা হয়। গৃহীরাও প্রাচীনকাল হতে এই অনুষ্ঠান বা তিথিকে চিত্তশুদ্ধি ও উপোসথ ব্রতচর্চার অনন্য অনুষ্ঠান হিসেবে পালন করে আসছে।

এই পূর্ণিমার আর একটি বিশেষত্ব হলো - গৌতম বুদ্ধ এই পূর্ণিমা তিথিতে বর্ষাবাস পালন শেষে ভিক্ষুসংঘকে দিকে দিকে ধর্ম প্রচারের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “হে ভিক্ষুগণ ! বহু জনের হিত ও সুখের জন্য, দেব মানবের কল্যাণের জন্য তোমরা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ো, প্রচার করো সেই ধর্ম যেই ধর্মের আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ এবং অন্তে বা শেষে কল্যাণ।” বুদ্ধের উপদেশ অনুসরণ করে সেদিন ভিক্ষুসংঘ বুদ্ধবাণী প্রচারের জন্য দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখনও ভিক্ষুসংঘ সকলের হিত ও কল্যাণের কথা ভেবে বিভিন্ন বিহারে সমবেত হয়ে তথাগত বুদ্ধের উপদেশবাণী প্রচার করেন। প্রবারণা পূর্ণিমা শেষে বিহারে বিহারে একমাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় ‘কঠিন চীবর দান’। কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভিক্ষুসংঘ ও দায়ক-দায়িকাদের মধ্যে এক মহাসমাবেশ ঘটে। ধর্মালোচনা ও পুণ্যকর্মের জন্য এই অনুষ্ঠান ও তিথি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

 

অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৩৫

তোমার দেখা প্রবারণা পূর্ণিমা অনুষ্ঠানের ভূমিকাভিনয় করো/নাটক মঞ্চস্থ করো ।

প্রবারণা পূর্ণিমার বিশেষত্ব বর্ণনা করার পর ভিক্ষু তাদের প্রবারণা পূর্ণিমার সামাজিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন :

প্রবারণা পূর্ণিমার সামাজিক গুরুত্ব : প্রবারণা পূর্ণিমার ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে সামাজিক সংস্কৃতিও সম্পৃক্ত। এই সামাজিক সংস্কৃতি অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। যেহেতু, প্রবারণা পূর্ণিমা একটি উৎসবময় তিথি। এ তিথিকে কেন্দ্র করে ফানুস ওড়ানোর আয়োজন করা হয়। প্রবারণা পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে ফানুস ওড়ানো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। প্রবারণা পূর্ণিমার ফানুস ওড়ানোর পর্বে এক অনন্য সামাজিক উৎসবের সৃষ্টি হয়। এতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করে। সকলেই আনন্দ লাভ করে। ফলে এটি বাঙালির এক চিরায়ত উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাই প্রবারণা পূর্ণিমাকে অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন এবং সম্প্রীতির উৎসব বা মিলন মেলা বলা চলে।

এই ফানুস ওড়ানোর আগে বিভিন্ন ধর্মীয় বিধি অনুসরণ করা হয়। ফানুস ওড়ানোর সময় বৌদ্ধ সংকীর্তনসহ বিভিন্ন শিক্ষণীয় অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। যেমন প্রথমে অনুষ্ঠানমণ্ডপ সাজানো হয় বিভিন্ন শৈল্পিক উপকরণ দিয়ে। এর মাধ্যমে অন্তরের সুপ্ত শিল্পচেতনা বিকাশের সুযোগ হয়। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মের গুজন এবং পণ্ডিত ব্যক্তিদের আগমন ঘটে। তাঁদের উপদেশ শুনে মানুষ আদর্শ-জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ হয়। তাই প্রবারণা পূর্ণিমা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এর সামাজিক সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিক প্রভাব রয়েছে।

সামাজিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করার পর ভিক্ষু প্রবারণা পূর্ণিমার শিক্ষণীয় বিষয় সম্পর্কে দেশনা করতে গিয়ে বলেন :

প্রবারণা পূর্ণিমার শিক্ষা : প্রবারণা পূর্ণিমার শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রবারণা পূর্ণিমা আত্মশুদ্ধি, সংযম, বিনয়, এবং ক্ষমাশীলতার শিক্ষা দান করে। কুশলকে বরণ এবং অকুশলকে বারণের শিক্ষা দেয়। আত্মশুদ্ধি চর্চায় নির্দোষ, সৎ ও আদর্শ জীবন গঠন করা যায়। সংযম ও বিনয় আত্মনিয়ন্ত্রণ, সদাচার ও পরোপকার সাধনে উদ্বুদ্ধ করে। ক্ষমাশীলতা মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা রাগ, দ্বেষ ও হিংসা প্রশমিত করে। প্রত্যেক মানুষ যদি ক্ষমাশীলতা অনুশীলন করে পরস্পরের কাছে স্ব-স্ব দোষ-ত্রুটি স্বীকার করে এবং তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাহলে ঝগড়া-বিবাদ, মনোমালিন্য প্রভৃতি দূর হয়ে যাবে। অপরদিকে, আন্তরিকতা ও সুসম্পর্ক সৃষ্টি হবে। এছাড়া, কুশল কর্ম সম্পাদন এবং অকুশল কর্ম হতে বিরত থাকার মাধ্যমে সমাজে শান্তি বিরাজ করবে। এভাবে প্রবারণা পূর্ণিমার শিক্ষা আমাদের জীবনকে সুন্দর ও শান্তিময় করে তুলতে সাহায্য করে।

প্রবারণা পূর্ণিমার সামাজিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করার পর ভিক্ষু সকল প্রাণীর মঙ্গল কামনা করে দেশনা শেষ করেন। উ চিন মং, সৌম্য বড়ুয়া এবং উদয় চাকমা পূর্ণিমা উৎসবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব প্রভৃতি জেনে অত্যন্ত খুশী হয়। এরপর তারা ভিক্ষুকে বন্দনা ও কৃতজ্ঞতা নিবেদন করে পূর্ণিমার শিক্ষা অনুশীলনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

 

অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৩৬

প্রবারণা পূর্ণিমার শিক্ষা আমাদের জীবনে কী উন্নয়ন ঘটাতে পারে, তার একটি তালিকা তৈরি করো।

 
 
 
 
 
 
 
 

 

অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৩৭

তোমার দেখা প্রবারণা পূর্ণিমা অনুষ্ঠানের বর্ণনা ও ছবির প্রদর্শনী করো। (সম্মিলিত কাজ-চিত্রশালা)

                                                               অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৩৮

নাটক মঞ্চস্থ ও ছবির প্রদর্শনী / চিত্রশালা অভিজ্ঞতাটি সম্পর্কে তোমার লিখিত মতামত দাও।

                  অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন কার্যক্রম : নাটক মঞ্চস্থ ও ছবির প্রদর্শনী / চিত্রশালা

কার্যক্রমের কী কী ভালো লেগেছে (ভালো দিক)

 
 
 
কার্যক্রম করতে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছ, (প্রতিবন্ধকতাসমূহ)
 
 
 
সমস্যা নিরসনে কী কী ব্যবস্থা নেয়া যায়?
 
 
 
ভবিষ্যতে আর কী কী উন্নয়ন করা যায় (পরামর্শ)
 
 
 

 

ফিরে দেখা: নিচের তালিকার সকল কাজ কি আমরা শেষ করেছি? হ্যাঁ হলে হ্যাঁ ঘরে এবং না হলে না ঘরে (√) চিহ্ন দাও:

অংশগ্রহণমূলক কাজ নং                                                সম্পূর্ণ করেছি
হ্যাঁনা
৩৩  
৩৪  
৩৫  
৩৬  
৩৭  
৩৮  

আচার-অনুষ্ঠান রীতি-নীতি, বাড়ায় সৌহার্দ্য, বাড়ায় সম্প্রীতি।।

Content added By