সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ | NCTB BOOK

আকার এবং আয়তনের দিক থেকে কোষ অত্যন্ত ক্ষুদ্র হলেও এগুলোর গঠন উপাদান বেশ বৈচিত্র্যময়। আর কোষের এসব গঠন উপাদানের কাজের পরিধিও বিস্তৃত। ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা যায় এমন কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোষীয় অংশ হলো- (ক) কোষ প্রাচীর, (খ) কোষ ঝিল্লি এবং (গ) প্রোটোপ্লাজম।

সংক্ষেপে এগুলোর গঠন এবং কাজ বর্ণনা করা হলো-

(ক) কোষপ্রাচীর (Cell wall): উদ্ভিদ এবং কিছু অণুজীব কোষের অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোষপ্রাচীর। কোষের একেবারে বাইরের দিকে শক্ত আবরণকে বলা হয় কোষপ্রাচীর। প্রাণী কোষে কোষপ্রাচীর থাকে না। উদ্ভিদ কোষের কোষপ্রাচীরের প্রধান রাসায়নিক উপাদান হলো- সেলুলোজ (Cellulose) নামে কার্বোহাইড্রেট। একই সঙ্গে লিগনিন (Lignin) নামে এক ধরনের জৈব পদার্থ (যা বেশির ভাগ উদ্ভিদের মূল কাঠামো তৈরিতে সহায়তা করে) উদ্ভিদের কোষপ্রাচীরে পাওয়া যায়।

অপরদিকে ব্যাকটেরিয়ার কোষ প্রাচীরের মূল উপাদান হচ্ছে কিছু প্রোটিন ও লিপিড। ছত্রাকের কোষপ্রাচীরে কাইটিন (Chitin) জাতীয় এক ধরনের কার্বোহাইড্রেট থাকে। সুতরাং, অনেক জীবে কোষপ্রাচীর থাকলেও, সেগুলোর গঠন উপাদানে কিছুটা পার্থক্য থাকে ।

কোষপ্রাচীর কোষের নির্দিষ্ট আকৃতি দান করে, বাইরের প্রতিকূল অবস্থা থেকে ভেতরের বস্তুকে রক্ষা করে, কোষকে প্রয়োজনীয় দৃঢ়তা প্রদান করে, পানি ও খনিজ লবণ শোষণ-পরিবহনে সহায়তা করে এবং পাশাপাশি কোষগুলোর স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে তাদেরকে পরষ্পরের সাথে সংযুক্ত করে রাখে।

(খ) কোষ ঝিল্লি (Cell / plasma membrane): কোষ ঝিল্লি কোষকে নিরাপদ রাখার কাজটি করে। তাই এটি হচ্ছে কোষকে ঘিরে থাকা দুটো স্তরবিশিষ্ট একটি নমনীয় (Flexible) আবরণ বা পর্দা (ঝিল্লি) যা বাইরের পরিবেশ থেকে কোষের ভিতরের উপাদানগুলোকে আলাদা রাখে। এটি মূলত লিপিড এবং প্রোটিন দিয়ে গঠিত। প্রাণীকোষে যেহেতু কোষপ্রাচীর থাকে না, তাই কোষঝিল্লিই হচ্ছে প্রাণীকোষের সবচেয়ে বাইরের স্তর। অপরদিকে যেসব কোষে কোষপ্রাচীর থাকে, সেগুলোর ক্ষেত্রে এই ঝিল্লি বা পর্দা কোষপ্রাচীরের ঠিক নিচেই অবস্থান করে। কোষ ঝিল্লির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এগুলো ভেদ করে সব উপাদান কোষের ভেতর থেকে বাইরে যেতে পারে না, বা বাইরে থেকে ভেতরে আসতে পারে না। বরং কেবল নির্দিষ্ট কিছু উপাদান এই পর্দা ভেদ করে কোষের বাইরে থেকে কোষের ভেতরে যাতায়াত করতে পারে।

(গ) প্রোটোপ্লাজম (Protoplasm): কোষ প্রাচীর এবং ঝিল্লি দ্বারা ঘিরে থাকা কোষের যে স্বচ্ছ, ঘন ও জেলির মতো বস্তু দেখা যায়, তাকে বলা হয় প্রোটোপ্লাজম। প্রোটোপ্লাজমে শতকরা ৭৫ থেকে ৯৫ ভাগ পানি। কোষের সমস্ত জৈব-রাসায়নিক (Biochemical) কাজ প্রোটোপ্লাজমে সম্পন্ন হয়। প্রোটোপ্লাজমকে প্রধানত দুই অংশে ভাগ করা যায়। সেগুলো হচ্ছে ১। নিউক্লিয়াস এবং ২। সাইটোপ্লাজম ।

তোমরা যারা ‘ঠাকুরমার ঝুলি'তে রূপকথা পড়েছ, সেখানে নিশ্চয়ই দেখে থাকবে, গল্পের দৈত্যটিকে বধ করা খুব কঠিন। কারণ, তার প্রাণ লুকানো থাকে গভীর এক তালপুকুরের মাঝখানে ছোট্ট একটি কৌটার মধ্যে রাখা এক ভোমরার ভেতরে। গল্পের তালপুকুর আর তার মাঝখানের কৌটার কথাটা মনে রেখে সাইটোপ্লাজম এবং নিউক্লিয়াসের পরিচয়টা খুব সহজেই বুঝে নেওয়া যায়।

আমরা যদি কোষের প্রোটোপ্লাজমকে গল্পের তালপুকুর মনে করি, তবে পুকুরের মাঝখানের কৌটাটা হচ্ছে কোষের নিউক্লিয়াস, আর পুকুরের পানি হচ্ছে কোষের সাইটোপ্লাজম। শুধু তাই নয় নিউক্লিয়াসের ভেতরে যে ক্রোমোজম থাকে, সেটাকে তুলনা করা যায় প্রাণভোমরার সঙ্গে। লক্ষ করে দেখো, কৌটাটা পুকুরের ভেতর থাকলেও তার কিন্তু নিজস্ব সীমা আছে, আবরণ আছে। কোষের নিউক্লিয়াসের বেলায়ও তাই। সেটিরও নিজস্ব আবরণ আছে যা সেটিকে সাইটোপ্লাজম থেকে আলাদা করে রাখে। এবার আমরা রূপকথার বাইরে গিয়ে আরো একটু বিস্তারিতভাবে এই গঠন বৈশিষ্ট্য জানব ।

১। নিউক্লিয়াস (Nucleus): বিভিন্ন কোষের প্রোটোপ্লাজম-এ অবস্থিত দ্বি-স্তরবিশিষ্ট ঝিল্লি দিয়ে ঘিরে রাখা ঘন, অস্বচ্ছ অঙ্গাণুটি হলো নিউক্লিয়াস। সকল জীবের কোষে নিউক্লিয়াস থাকে না। যেসব কোষের নিউক্লিয়াস সুগঠিত অর্থাৎ নিউক্লিয়ার ঝিল্লি দ্বারা পরিবেষ্টিত ও সুসংগঠিত থাকে, তাকে প্রকৃত কোষ (Eukaryotic cell) বলে। প্রকৃত কোষ দুই প্রকার, যথা: দেহকোষ এবং জনন কোষ। অপরদিকে যেসব কোষে নিউক্লিয়াস সুগঠিত থাকে না, সেগুলোকে আদি কোষ (Prokaryotic cell) বলে। যেমন, ব্যাকটেরিয়া হচ্ছে এক ধরনের আদিকোষ।
রবার্ট ব্রাউন ( Robert Brown) (১৮৩১) অর্কিডের পাতার কোষে নিউক্লিয়াস আবিষ্কার এবং নামকরণ করেন। প্রতিটি কোষে সাধারণত একটি নিউক্লিয়াস থাকে। তবে কোনো কোনো শৈবাল এবং ছত্রাকের একেকটি কোষে বহুসংখ্যক নিউক্লিয়াস থাকে। নিউক্লিয়াস প্রধানত কোষের কেন্দ্রস্থলে থাকে এবং বিভিন্ন কোষভেদে নিউক্লিয়াস সাধারণত গোলাকার, উপবৃত্তাকার বা নলাকার হয়ে থাকে।

কোষের মধ্যে নিউক্লিয়াসের সুরক্ষিত অবস্থান। নিউক্লিয়াসের নিজস্ব পর্দা আছে যা তাকে সাইটোপ্লাজমের অন্যান্য অংশ থেকে পৃথক রাখে।

নিউক্লিয়াস কোষের সব ধরনের কার্য-কলাপের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। নিউক্লিয়াসের ভেতরে ক্রোমোজম (Chromosome ) নামে একটি বিশেষ বস্তু অবস্থান করে (অনেকটা উপরের গল্পের প্রাণভোমরার মতো), যা জীবের বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। এই ক্রোমোজমে আসলে জীবের বংশগতি পদার্থ ডিএনএ (DNA: Deoxyribonucleic acid বা ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিয়িক অ্যাসিড)-এ ধারণ করে। ডিএনএ তথা ক্রোমোজমের যদি কোনো ক্ষতি হয়, তবে তা জীবের জন্যও ক্ষতিকর পরিণতি বয়ে আনে। তাই ডিএনএ কে সুরক্ষা দেবার জন্যই নিউক্লিয়াসের ভেতর তার অবস্থান। ডিএনএর গঠন ও কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার মাধ্যমে মাতা-পিতার জন্মগত বৈশিষ্ট্যগুলো সন্তানদের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়।

২। সাইটোপ্লাজম (Cytoplasm): কোষের নিউক্লিয়াসের বাইরে অবস্থিত এবং কোষ ঝিল্লি দ্বারা পরিবেষ্টিত প্রোটোপ্লাজমের বাকি অংশের নাম সাইটোপ্লাজম। এটি প্রধানত প্রোটিন দ্বারা গঠিত। সাইটোপ্লাজম কিন্তু কোনো ফাঁকা স্থান নয়। ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখলে এই সাইটোপ্লাজমে বেশ কয়েক রকমের অঙ্গাণু দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে মাইটোকন্ড্রিয়া, রাইবোসোম (Ribosome), গলজি বডি (Golgi body), আন্তঃপ্লাজমীয় জালিকা (Endoplasmic reticulum), কোষ গহবর (Vacuole), লাইসোসোম (Lysosome) ইত্যাদি। এছাড়া উদ্ভিদ কোষে প্লাস্টিড (Plastid) এবং প্রাণী কোষে সেন্ট্রোসোম (Centrosome) ও সেন্ট্রিয়োল (Centrioles) থাকে।

সাইটোপ্লাজম কোষের এসব অঙ্গাণু ধারণ করে। এছাড়া কোষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন জৈব- রাসায়নিক প্রক্রিয়া, যেমন- শক্তি উৎপাদন, জীবাণুর আক্রমণ প্রতিরোধ, পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা ইত্যাদি সম্পন্ন হয় সাইটোপ্লাজমে। যে কোনো জীবের দেহে সংঘটিত সকল রাসায়নিক বিক্রিয়াকে একত্রে বিপাক (Metabolism) বলে। বিপাক প্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য কোষে নির্দিষ্ট মাত্রার অম্লত্ব বা ক্ষারীয় অবস্থা বজায় রাখতে হয়। সাইটোপ্লাজম কোষের অম্লীয় বা ক্ষারীয় অবস্থাও নিয়ন্ত্রণ করে।

আগেই বলা হয়েছে, সাইটোপ্লাজমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গাণু অবস্থান করে। তবে এই শ্রেণিতে আমরা সেগুলোর সবার পরিচয় বিস্তারিত জানব না। কেবল দুটো অঙ্গাণু- মাইটোকন্ড্রিয়া এবং ক্লোরোপ্লাস্টের গঠন ও কাজ সম্বন্ধে আলোচনা করা হবে। বাকি অঙ্গাণুগুলো নিয়ে আমরা উপরের শ্রেণিতে জানব।


আমরা অনেক সময় গাছের যে অনুভূতি আছে বা গাছ যে সংবেদনশীল তা প্রমাণে লজ্জাবতীর পাতা উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করি। এর কারণ কি জানো? এর পেছনে কোষ গহ্বর (Vacoule) এর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। লজ্জাবতী পাতার গোড়ায় অনেক কোষ থাকে। ওই সব কোষের কোষ গহ্বর পানি ভর্তি থাকে। পানিভর্তি হওয়ার কারণে | লজ্জাবতী গাছের পাতার ডাঁটা সোজা হয়। কিন্তু হঠাৎ পাতা ছুঁলে কোষ থেকে পানি বেরিয়ে যায়। ফলে ফোলা কোষগুলো চুপসে যায় এবং লজ্জাবতী পাতার ডাঁটা নিচের দিকে নুয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে সব পাতার কোষে এই প্রভাব পড়ে এবং এভাবে সব পাতা নুয়ে যায়।

Content added || updated By