উপরে কেউ নেই। তিনি পরম পিতা, তিনি পরম স্রষ্টা, পরম ব্রহ্ম, পরমেশ্বর, ভগবান। পরমাত্মা নামেও তিনি পরিচিত। তিনি ঈশ্বর নামেও অভিহিত। তাঁকে দেখা না গেলেও, তিনি সর্বত্র বিরাজিত। তিনি নিরাকার, এই ঈশ্বর বা পরমাত্মাই জীবের মধ্যে আত্মারূপে অবস্থান করেন। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আমরা তাঁকে অনুভব করি। কারণ তিনি তাঁর সৃষ্ট জীবের মধ্যে আত্মারূপে অবস্থান করেন। সৃষ্ট জীব-জগতের মধ্য দিয়ে তাঁকে অনুভব করা যায়। সাধকেরা সাধনার মাধ্যমে এবং ভক্তেরা ভক্তির মাধ্যমে তাঁর সান্নিধ্য অনুভব করে থাকেন।
ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং মানুষের তৈরি
বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি বিজ্ঞানমেলার আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে পাশাপাশি দুইটি স্টল আছে। একটি স্টলে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট কিছু বস্তু বা বস্তুর ছবি আছে। অন্য স্টলে মানুষের তৈরি কিছু জিনিস বা জিনিসের ছবি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ একজন এগুলো সম্পর্কে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
একটা ছবিতে মানুষ, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, চন্দ্র, সূর্য, পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র, সৌরজগৎ ইত্যাদি আছে। অন্য একটা ছবিতে টেবিল, চেয়ার, বই-পত্র, ল্যাপটপ ইত্যাদি আছে। প্রথম ছবিটি প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। দ্বিতীয় ছবিটি মানুষের তৈরি কিছু জিনিসের ছবি। এখন আমরা এই দুইটি ছবির পার্থক্য বোঝার চেষ্টা করি।
আমরা জানি, এই মহাবিশ্বের সবকিছু ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। আর এই দৃশ্যমান সৃষ্টিকে আমরা প্রকৃতি বলি। ছবিতে দৃষ্ট প্রাকৃতিক ছবিটিই প্রকৃতি। আমরা এই প্রকৃতির একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন- মানুষ, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, চন্দ্র, সূর্য, পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র, সৌরজগৎ তথা সবকিছু। তিনি এই সৃষ্টি করার সময় কিন্তু কারও কোনো সাহায্য নেননি। অথচ মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্টির সহায়তা ছাড়া কোনো কিছুই তৈরি করতে পারে না। অর্থাৎ ঈশ্বরের সৃষ্ট বস্তুর সাহায্যে মানুষ নানা জিনিস-পত্র তৈরি করছে। দ্বিতীয় ছবিতে মানুষের তৈরি জিনিস দেখানো হয়েছে।
আমরা যদি আরও একটু পরিষ্কার করে বলি, তাহলে বলা যায় সবকিছুই ঈশ্বরের ইচ্ছাধীন। ঈশ্বর চাইলে সব কিছু সৃষ্টি করতে পারেন। মানুষ কিন্তু ঈশ্বরের মতো সব কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। যেমন- ঈশ্বর গ্রহ, নক্ষত্র, পাহাড়, সমুদ্র প্রভৃতি সৃষ্টি করতে পারেন। মানুষ তা পারে না। মানুষ প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্রের সাহায্যে রোবট তৈরি করতে পারে। কিন্তু মানুষ সেই রোবটের মধ্যে আত্মাকে প্রবেশ করাতে পারে না। মানুষ প্রকৃতি থেকে সৃষ্ট গাছের কাঠ দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করতে পারে। কিন্তু মানুষ নিজে প্রকৃতি সৃষ্টি করতে পারে না। তাই আমরা বলতে পারি ঈশ্বরের পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব তা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক
স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসেন, প্রতিপালন করেন। স্রষ্টাকে ছাড়া যেমন সৃষ্টিকে কল্পনা করা যায় না, তেমনি সৃষ্টি ছাড়া স্রষ্টাকেও ভাবা যায় না। উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। স্রষ্টার সৃষ্টি নানাভাবে আমাদের উপকার করে থাকে। যেমন ঈশ্বরের সৃষ্টি জল, বায়ু, সূর্য প্রভৃতির কারণে জগতের প্রাণিকুল বেঁচে আছে। এদের কারণেই আমরা নানাবিধ শস্য ও ফসল চাষ করতে পারি, এই ফসল আমাদের খাদ্যের যোগান দেয় এবং আমাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। গাছপালা সূর্যের আলোয় তার খাদ্য প্রস্তুত করে বেড়ে উঠে। জল ছাড়া কোনো প্রাণীর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। নদ-নদীর মাধ্যমে আমরা প্রাকৃতিকভাবে জল পেয়ে থাকি। সৃষ্টিকর্তার এই সৃষ্ট সম্পন্ন মানুষ নানাভাবে ব্যবহার করে। মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি প্রস্তুত করে জীবনযাপন করে। সৃষ্টিকর্তার এসব সৃষ্টি ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। এভাবে বলা যেতে পারে, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক বিরাজমান।
সকল জীবের মধ্যে ঈশ্বরের অবস্থান
ঈশ্বর আমাদের সকলকে সৃষ্টি করেছেন। আমরা তাঁরই একটা অংশ। কারণ সৃষ্টিকর্তাকে পরমাত্মা বলা হয়। আর আমাদের মধ্যে যে আত্মা বিরাজিত সেই আত্মা পরমাত্মারই অংশ। তাই ব্যাপকার্থে জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ। এখন প্রশ্ন হতে পারে তাহলে মানুষ কেন ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়ায়? সে কেন ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য কঠোর সাধনা করে? এর সহজ উত্তর হলো, ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য সাধনাই যথেষ্ট নয়। তাঁকে পেতে হলে আগে জীবের সেবা করতে হবে। ভালোবাসতে হবে তাঁর সৃষ্টিকে। তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসলেই তিনি খুশি হন আর তাতেই তিনি ভক্তের প্রতি সদয় হন। এ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। "
এজন্য আমাদেরকে সকল জীবের প্রতি সদয় হতে হবে। সকল জীবকে ভালোবাসতে হবে। তবেই ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে। এই জীব বলতে প্রধানত বিভিন্ন প্রাণীকে বোঝানো হয়েছে। আমাদের যেমন সকল মানুষকে ভালোবাসতে হবে তেমনি গৃহপালিত পশু-পাখিসহ সকল প্রাণীর যত্ন নিতে হবে। তাদেরকে সেবা করতে হবে। পাশাপাশি বাড়ির চারপাশের গাছ-পালারও পরিচর্যা করতে হবে। অর্থাৎ, সৃষ্টিকর্তার সকল সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে। তবেই হবে ঈশ্বরকে ভালোবাসা। তবেই হবে প্রকৃতপক্ষে ধর্মপালন।
ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য যে বিভিন্ন বিষয়বস্তু সম্বন্ধে জানলাম এবং আমাদের পিতামাতা, শিক্ষক এবং পুরুজনদের নিকট থেকে যা শিখলাম তার উপর ভিত্তি করে একটি সুন্দর দেয়াল পত্রিকা তৈরি করব দেয়াল পত্রিকাটি আমাদের শ্রেণিকক্ষের সামনে নোটিশ বোর্ডে স্থাপন করব যেন সকলে দেখতে পায়।
তবে কিভাবে একটি সুন্দর দেয়াল পত্রিকা তৈরি করা যায় তা শিক্ষকের নিকট থেকে জেনে নেব।
দেয়াল পত্রিকা
দেয়াল পত্রিকা হলো বিভিন্ন তথ্যের এক ধরনের নান্দনিক প্রদর্শনী। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে কোনো একটি বিষয় নিয়ে শিক্ষকের সহায়তায় আলোচনা, মতবিনিময়, উপস্থাপনের সাপেক্ষে লেখা, গল্প, প্রবন্ধ, ছড়া, ছবি, ইত্যাদি রচনা এবং নির্বাচন করে। এগুলোই শিক্ষার্থীরা বোর্ডে নিজ হাতে লিখে বা এঁকে আকর্ষণীয় এবং সুপাঠ্য করে অন্য দর্শক বা পাঠকের সামনে তুলে ধরে।
দেয়াল পত্রিকা করতে যা যা লাগবে তা এক নজরে দেখো।
এই যে আমরা বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি আঁকলাম এর প্রতিটি ঈশ্বরের একেকটি রূপ। ঈশ্বরকে এইভাবে আমরা বিভিন্নরূপে আরাধনা করে থাকি।
ঈশ্বর নিরাকার তাই আমরা তাঁকে দেখতে পাই না। তবে তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমরা তাঁকে অনুভব করি। এই নিরাকার ব্রহ্মরূপে তিনি সর্বত্র বিরাজিত। বিশ্বের সবকিছু তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি জ্ঞানীর কাছে ব্রহ্ম, যোগীর কাছে পরমাত্মা এবং ভক্তের কাছে ভগবান রূপে পরিচিত। ঈশ্বরকে বলা হয় "স্বয়ম্ভু'। কারণ তিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিতা, শুষ্ক ও পরম পবিত্র। তিনি সকল কর্মের ফলদাতা। যে যেমন কাজ করে তিনি তাকে সেই কাজ অনুসারে ফল প্রদান করেন। ঈশ্বরের রূপের অন্ত নাই। অনন্তরূপ তাঁর। তিনি সর্বব্যাপী।
কোনো বিশেষ শক্তির প্রকাশ ঘটাতে সাকার রূপে ঈশ্বর পৃথিবীতে আসেন। ঈশ্বরের কোনো বিশেষ গুণ বা শক্তির সাকার রূপ হলো দেবতা বা দেব-দেবী। হিন্দুধর্মে বিভিন্ন দেব-দেবীর কথা উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়া ঈশ্বর আত্মারূপে জীবের মধ্যে অবস্থান করেন।
ঈশ্বর কখনো কখনো জীবদেহ ধারণ করে পৃথিবীতে আসেন। তাঁর এই আসা বা অবতীর্ণ হওয়াকে বলে অবতার। তিনি অবতীর্ণ হন দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনের জন্য। পৃথিবীতে শান্তি এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সাকার রূপ ধারণ করেন। সাকার রূপে আবির্ভূত হয়ে তিনি নানা কর্মের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করেন।
তবে নিরাকার এবং সাকার রূপ মূলত সেই এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরেরই ভিন্ন প্রকাশ মাত্র।
দেব-দেবী রূপে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার রূপ
ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। 'একনের অদ্বিতীয়ম্'। অনন্ত তাঁর গুণ ও শক্তি। তাঁর এই গুণ বা শক্তি দেখা যায় না। তবে অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। যেমন- আলো, বাতাস, শব্দ, গন্ধ ইত্যাদি দেখা যায় না। শুধু অস্তিত্ব বা উপস্থিতি অনুভব করা যায়। তেমনি ঈশ্বরকেও দেখা যায় না, অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। তিনি নিরাকার, সর্বশক্তিমান। নিরাকার ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তির সাকার রূপই হচ্ছেন দেব-দেবী। অর্থাৎ দেব-দেবীরা ঈশ্বরের বিশেষ গুণ বা শক্তিরই মূর্ত প্রকাশ মাত্র। আমরা ঈশ্বরের সাকাররূপী বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করি। যেমন- ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা, বিষ্ণুরূপে ঈশ্বর জীবজগৎকে রক্ষা ও প্রতিপালন করেন, শিবরূপে তিনি ধ্বংস করে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করেন। বিদ্যাশক্তির সাকার রূপ সরস্বতী দেবী, ধনসম্পদের শক্তির রূপ লক্ষ্মীদেবী, সকল শক্তির সম্মিলিত রূপ দুর্গাদেবী। এই দেব-দেবীদের পূজা করার মধ্য দিয়ে আমরা মূলত সেই এক ঈশ্বরেরই পূজা করে থাকি।